শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৯

ভ্রমণকথাঃ বছর শেষে মেঘের দেশে

সবুজ পাহাড় মেঘকে ডেকে বললো- তুই আমায় এভাবে ভেজালি!
মেঘ মৃদু হেসে উত্তর দিলো- ভেজালাম কোথায়?
একটু না হয় ছুঁয়েই দিলাম, সফেদ-শুভ্রতায়।

মেঘ-পাহাড়কে ছুঁয়েছিলো বলে পাহাড় কতটুকু ভিজেছিলো জানি না, তবে আমি ভিজেছিলাম পুরোপুরি। সাজেক ভ্যালির পাহাড় আর মেঘ আমার মনকে ভরিয়ে দিয়েছিলো এক অনাবিল আনন্দে। সবুজ পাহাড়ের বুকে পেজো তুলোর মত সাদা মেঘের চাঁদর আমাকে আবিষ্ট করে রেখেছিলো দীর্ঘক্ষণ। অতি সাধারণ একজন মানুষ আমিভালোবসি ভ্রমণ করতে আর প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটাতে। মাত্র ক’দিন আগে ঘুরে এলাম সাজেক ও কাপ্তাই লেক, রাঙামাটি। যেখানেই যাই, যা কিছু দেখি সবার সাথে শেয়ার করতে ভালবাসি। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা বলেছেন- ভ্রমণ তোমাকে প্রথমে নির্বাক করে দেবে তারপর তোমাকে গল্প বলতে বাধ্য করবে। আমিও আজ সাজেক আর রাঙামাটি ভ্রমণের গল্প সবার সাথে শেয়ার করছি।



ঘুরে এলাম মেঘের রাজ্য সাজেক ভ্যালী

     মেয়ের পরীক্ষা শেষ। এদিকে বছরও শেষ হয়ে আসছে, তবে শীত তেমন জেঁকে বসেনি এখনও। অফিস কলিগ মাসুদ ভাই একদিন প্রস্তাব রাখলো- চলেন ফ্যামিলি নিয়ে ঘুরে আসি নতুন কোন জায়গা থেকে। তার মেয়েদেরও পরীক্ষা শেষ। ঠিক হলো- অফিসের কাজের চাপ কিছুটা কমে এলে বেরিয়ে পড়বো। কিন্তু কোথায় যাওয়া যায়? কক্সবাজার, কুয়াকাটা, রাঙামাটি, সিলেট, টাঙুয়ার হাওর- এসব জায়গায় ইতিমধ্যে ঘুরে এসেছি। তবে সাজেক কিংবা বান্দববান যাওয়া হয়নি। ইদানীং অনেকেই দেখছি সাজেক ভ্যালী ঘুরে আসছে। এবার তাহলে ঘুরে আসা যাক মেঘের দেশ সাজেক থেকে। মাসুদ ভাইয়ের একই কথা- সাজেকেই যাওয়া যাক। তবে সাজেকে দেখার মত যা আছে তার জন্য দু’দিনই যথেষ্ট। সাজেক যেতে হলে খাগড়াছড়ি হয়ে যেতে হয়, আর খাগড়াছড়ি থেকে রাঙামাটির দূরত্ব খুব বেশি নয়। মাসুদ ভাইয়ের যেহেতু রাঙামাটি যাওয়া হয়নি, তাই ঠিক হলো- ঢাকা থেকে সাজেক ঘুরে আমরা সরাসরি রাঙামাটি চলে যাবো। আমাদের ট্যুর প্ল্যান ফাইনাল হলো- ১১ই ডিসেম্বর রাতে আমরা ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হবো, আর ১৫ই ডিসেম্বর রাতে রাঙামাটি থেকে ঢাকা ফিরবো।

     ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি এবং রাঙামাটি থেকে ঢাকা ফেরার জন্য সেন্টমার্টিন পরিবহনের এসি বাসের টিকিট কনফার্ম করা হলো। এবার হোটেল বুকিং। বন্ধু সাত্তারের সহায়তায় সাজেকে হোটেল বুকিং সম্পন্ন হলো, আর আলমগীরের বিআরডিবির খাগড়াছড়ি অফিসের লোকজনের মাধ্যমে খাগড়াছড়ি থেকে সাজেকে যাওয়া-আসার জন্য একটা মাহিন্দ্র (স্থানীয় লোকজন বলে চাঁদের গাড়ি) ভাড়া করা হলো। আমি রাঙামাটিতে পর্যটনের মোটেলে রুম বুক করে ফেললাম। ব্যাস, আমাদের যাত্রার প্রস্তুতি সম্পন্ন, এবার শুধু নির্দিষ্ট দিনে বেরিয়ে পড়া। 

     ১১ই ডিসেম্বর রাতে কলাবাগান থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। সবাই পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র সাথে নিয়েছিঢাকায় তেমন শীত না পড়লেও সমতল থেকে ১৮০০ ফুট উপরে সাজেক ভ্যালীতে শীতের মাত্রা কেমন আমাদের জানা নেই। হঠাৎ সাজেকে যাওয়া নিয়ে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিলাম। কিছুক্ষণ পর বন্ধু ড. মাকসুদের ফোন। ওরা তখন বান্দরবান যাচ্ছে। হয়তো সেই মুহূর্তে ওদের বাস আমাদের কাছাকাছি কোথাও ছিলো। কিছুটা আফসোস হলো। আগে জানলে হয়তো ট্যুর প্ল্যান চেঞ্জ করতে পারতাম। এ যাত্রায় আমরাও ওদের সাথে বান্দরবান ঘুরে আসতে পারতাম। পরে সময় বুঝে সাজেকে যাওয়া যেতো। যাই হোক, আমাদের গাড়ি ঘুটে চলেছে চেনা পথে। এই পথে বহুবার ঢাকা-চিটাগাঙ জার্নি করা হয়েছে। তবে এখন রাস্তা ওয়ানওয়ে, লেন সংখ্যাও বেড়েছে, তাই গাড়ির গতিও আগের তুলনায় বেশি। বাসের মধ্যে ঠাণ্ডার মাত্রা বেড়ে গেছে। আমি কিছুক্ষণ পর পরই দেখছি মেয়ের ঠাণ্ডা লাগছে কি-না, কারণ ওর এমনিতেই কোল্ড এলার্জির সমস্যা আছে, তাই টুপি, মাফলার দিয়ে মাথা ঢেকে দিয়েছি। মাসুদ ভাইও তাই করলো রাত দেড়টার দিকে আমাদের বাস কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে হোটেল অফ-বিটে যাত্রা বিরতি করলো। আমরাও ওখানে নামলাম। ফ্রেশ হয়ে হালকা কিছু খেয়ে নিলাম সবাই প্রায় বিশ মিনিট পর আবার শুরু হলো আমাদের যাত্রা ফেনী এসে আমাদের গাড়ি দিক পরিবর্তন করলো। ঢাকা-চিটাগাঙ হাইওয়ে ছেড়ে গাড়ি খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে বাম দিকের রাস্তায় ঢুকে পড়লো। এদিকের রাস্তা ঢাকা-চিটাগাঙ হাইওয়ের মত অতটা স্মুথ নয়, কিছুটা সরুও বটে, তবে রাস্তা ফাঁকা থাকায় তেমন একটা সমস্যা হচ্ছে না।
     সমস্যা শুরু হলো যখন আমাদের গাড়ি পাহাড়ি রাস্তায় প্রবেশ করলো। উচু-নিচু রাস্তায় অসংখ্য বাঁক, সেইসাথে ড্রাইভারের বেপরোয়া ড্রাইভিং। গাড়ি পাহাড়ি পথ ধরে কখনও উপরে ওঠে আবার নিচে নেমে আসে। এভাবেই এগিয়ে চলছিলো। আমরা ড্রাইভারকে আস্তে চালাতে বললাম। বিশেষ করে বাঁকগুলো ক্রস করার সময়। তবে খুব একটা কাজ হলো না। যাত্রীদের কথায় গতি কমালেও কিছুক্ষণ পর আবার ড্রাইভার আগের অবস্থায় চলে গেলো। কখনও কখনও মনে হচ্ছিলো এই বুঝি গাড়ি উল্টে খাদে পড়লো! যাত্রীদের মধ্যে বয়স্ক একজন হাঁক ছাড়লো ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে- এই ড্রাইভার, তোমাকে না আস্তে চালাতে বলেছি! এবার কিছুটা কাজ হলো। বেশ কিছুক্ষণ গাড়ি আস্তে চললো। বিশেষ করে বাঁকগুলোতে ড্রাইভার সাবধানে গাড়ি ঘোরালো। আমরা পাহাড়ি রাস্তায় ক্রমশঃ উপরে উঠছিলাম। জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে মনে হচ্ছিলো সমতল থেকে কয়েকশ ফুট উপরে। তবে কিছুক্ষণ পরই গাড়ি আবার নামতে শুরু করলো। এক সময় নেমে এলো সমতলে। আমরা যখন মাটিরাঙা নামক এক জায়গায় পৌঁছেছি, তখনই শুরু হলো আরেক বিপত্তি। গাড়ির টায়ার পাঙচার! তখন আমরা খাগড়াছড়িতে আমাদের শেষ গন্তব্যস্থল থেকে মাত্র পনেরো মিনিট দুরত্বে। কি আর করা! শুরু হলো স্পেয়ার চাকা লাগানোর কাজ। গাড়ি ঠিক হতে একঘণ্টার বেশি সময় লাগলো। আমরা প্রায় সোয়া সাতটার দিকে খাগড়াছড়ি পৌঁছালাম।

     আলমগীর নেওয়াজের বিআরডিবি অফিসের ড্রাইভার মান্নান ফজরের নামাজের পর থেকেই চাঁদের গাড়ি (মাহিন্দ্র) নিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো। আমরা যখন অরণ্য বিলাস রিসোর্টের সামনে বাস থেকে নামলাম তখন দেখলাম অসংখ্য পর্যটক রাস্তায় ভিড় করে আছে। এরা সবাই সাজেকে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ পর সাজেকের উদ্দেশ্যে রওনা দিবে, কারণ পথে আর্মিদের চেকিং, যা বেলা দশটার আগে সম্পন্ন হয় না; আর আর্মি চেকিং ছাড়া কোন পর্যটকের গাড়ি সাজেকের রাস্তায় যেতে পারে না। আমরা সবাই স্থানীয় রেস্টুরেন্টে ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তা সারলাম। কিছুক্ষণ পর আমরা মাহিন্দ্র নিয়ে সাজেকের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবো এই মাহিন্দ্র ভাড়া করার ক্ষেত্রে মান্নান আমাদের যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে। আমরা এই গাড়ি নিয়ে সাজেকে যাব, ওখানে আজ সারাদিন আর রাত্রি যাপন করে আগামীকাল সকালে আবার খাগড়াছড়ি ফিরবো। এখানকার দর্শনীয় স্থানগুলো দেখে বেলা তিনটার দিকে এই গাড়ি নিয়েই রাঙামাটির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবো।

     সকাল সাড়ে আটটার দিকে আমাদের গাড়ি খাগড়াছড়ি থেকে সাজেকের পথে চলতে শুরু করলো। নতুন জনপদ আর মানুষের বিচিত্র জীবনযাত্রা দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে চলছিলাম। আমাদের মাহিন্দ্রর ড্রাইভার ও তার সহকারী- দু’জনই স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোক। ড্রাইভার চাপাই মারমা বেশ হাসিখুশি ও ভদ্র, ড্রাইভার হিসেবেও দক্ষ আর তার সহকারী বাবু চাকমা কম কথা বললেও তার সাথে সাথে কথা বলে তাদের কালচার, জীবনধারা সম্মন্ধে বেশ কিছু মজার তথ্য জানা গেলো। চারপাশের প্রকৃতি দেখতে দেখতে আমরা ছুটে চলছিলাম। হঠাৎ ঠাণ্ডার মাত্রা বেড়ে গেলো। চারিদিক থেকে একটা হিম-শীতল বাতাস আমাদের কাঁপিয়ে দিচ্ছিলো। বাচ্চাদের ঠিকমত ঢেকে দিলাম। আরও কিছুটা পথ সামনে এগোনোর পর বাঘাইহাটে এসে আমাদের গাড়ি থেমে গেলো। সামনে আর্মি চেকিং। এখানে নাম রেজিস্ট্রি করতে হবে। আমি এগিয়ে গিয়ে নাম রেজিস্ট্রি করে এলাম। বাবু চাকমা জানালো এখানে চেকিঙের পর আর্মিদের এস্কর্ট যাবে বেলা দশটার দিকে তখন গাড়ি ছাড়বে। আমরা কিছুটা হতাশই হলাম কারণ দশটা বাজতে এখনও অনেক সময় বাকি। আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। স্থানীয় লোকজন নানা রকম সওদা ফেরি করে বেড়াচ্ছে। পেঁপে, জাম্বুরা, আঁখ, কলা ইত্যাদি। আমরা কিছু কলা কিনলাম। মাসুদ ভাই কিছুটা সামনে এগিয়ে বড় সাইজের তিনটা পাকা পেঁপে কিনলো মাত্র একশ টাকায়। পাশের দোকানে বাঁশের চা বিক্রি হচ্ছে। ‘বাঁশের চা’ বলতে আসলে কাপের পরিবর্তে বাঁশের চোঙায় করে চা দিচ্ছিলো দোকানি। মেয়েরা সেই বৈচিত্র্যময় বাঁশের চা খাওয়ার জন্য বায়না ধরলো। আমরা দোকানে গিয়ে দেখলাম চা শেষ। আশেপাশের লোকজন জানালো সাজেকেও পাওয়া যাবে এই চা। মেয়েদেরকে তাই বোঝালাম- 'সাজেকে গিয়ে বাঁশের চা খাওয়াবো’। ওরা মেনে নিলো।

     কিছুক্ষণ পরই আমাদের গাড়ি ছেড়ে দিলো। যতই সামনে এগোচ্ছিলাম প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী বদলে যাচ্ছিলো। ধীরে ধীরে পাহাড়ি এলাকা দৃশ্যমান হচ্ছিলো। গতরাতে খাগড়াছড়ি আসার পথে রাস্তায় যে ধরনের বাঁক ছিলো এখন তার থেকেও বেশি। তবে গতরাতে অন্ধকারে প্রকৃতি ছিলো আমাদের দৃষ্টির বাইরে আর আজ দেখছি অন্যরকম এক বাংলাদেশ। রাস্তার দু’পাশে চোখ জুড়ানো অপার সৌন্দর্য। শুধু সবুজ আর সবুজ। বহুদূর পর্যন্ত উঁচুনিচু সবুজ পাহাড়, গিরিখাত, আর অনেক নিচে সরু জলধারা আঁকাবাঁকা পথ ধরে বয়ে চলেছে অজানা গন্তব্যে। এ যেন ভয়ঙ্কর সুন্দর এক রূপকথার রাজ্য। এই সবুজের মধ্যেই সরু আঁকাবাঁকা রাস্তা পাহাড়ের বুক চিরে ছুটে চলেছে। কখনও পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সর্পিল গতিতে উপরে উঠে যাচ্ছে আবার কখনও ঢাল বেয়ে নিচে নামছে। যাত্রার পূর্বে আমি কিছুটা শঙ্কিত ছিলাম এই ভেবে যে বাচ্চারা হয়তো পাহাড়ি পথে চলতে ভয় পাবে, তবে এখন দেখছি- না, ওরা ভয় তো পায়ই-নি, বরং প্রত্যেকেই বেশ রোমাঞ্চিত ছিলো; যেন ওরা রোলার কোস্টারে চড়েছে।

                                                                              গাড়ি থেকে তোলা পাহাড়ি দৃশ্য

     আমাদের মাহিন্দ্রর সহকারী বাবু চাকমা হঠাৎ দূরে একটা পাহাড়ের দিকে ইশারা করে দেখালো “ঐ যে পাহাড়টার উপরে একটা সাদা ঘর দেখা যাচ্ছে, ওটাই সাজেক; আমরা ওখানেই যাবো”  আমরা সবাই উৎসুক হয়ে সেদিকে তাকালাম। আমি জানতে চাইলাম- আর কতক্ষণ লাগবে? ও জানালো- আরও আধাঘণ্টা। তবে বাবুর সেই আধাঘণ্টা শেষমেশ ৪৫ মিনিটে শেষ হয়েছিলো।
      আমরা ছুটে চললাম সাজেকের পথে মাহিন্দ্র খুব দ্রুতগতিতে চলছিলো। আমি চলন্ত গাড়ি থেকে স্থির ছবি তুলছিলাম, তবে গাড়ির দ্রুত গতি আর রাস্তার পাশে ঝোপঝাড়ের (রাস্তার দু’পাশে নলখাগড়ার মত অসংখ্য গুল্ম এবং সেসব গাছে কাশফুলের মত গোলাপি রঙের ফুল) জন্য মনের মত ছবি তুলতে পারছিলাম না। যাই হোক প্রায় চল্লিশ মিনিট পর আমরা পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছালাম। বাবু তখন জানালো- এখন আমরা শুধু উপরে উঠবো। আমরা লক্ষ করলাম রাস্তাটা যেন হঠাৎ খাড়া হয়ে পাহাড়ের পাশ ঘেঁষে উপরে উঠে গেছে। চাপাই মারমা যে একজন সুদক্ষ ড্রাইভার তা আমরা আবার টের পেলাম। সেই খাড়া পথ বেয়ে কেমন সুচারুভাবে একই গতিতে উপরে উঠে যাচ্ছে সে। আমার যতটুকু মনে হয়েছে কখনও কখনও সেই পথ ৫৫ থেকে ৬০ ডিগ্রী পর্যন্ত এঙ্গেলে উঠে গিয়েছে। এভাবে প্রায় পাঁচ মিনিট ওঠার পর আমরা পাহাড়ের উপরে পৌঁছে গেলাম। বাবু জানালো- এটাই সাজেক আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য আমি চারপাশে তাকিয়ে দোকানপাটের সাইনবোর্ড দেখলাম। হ্যা, আমরা পৌঁছে গেছি সেই রুইলুই পাড়া, সাজেক ভ্যালী কিছুক্ষণের মধ্যে মাহিন্দ্র এসে দাঁড়ালো আমাদের নির্ধারিত হোটেল সাজেক বিলাসের সামনে।  
      আমাদের রুমের সামনেই কিছুটা খোলা ছাদ। মালামাল রুমে রেখে আমি করিডোর ধরে এগিয়ে খোলা ছাদে এসে দাঁড়ালাম। সামনে এবং চারপাশে যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ, উঁচুনিচু পাহাড়ের সারি, আর সেই সবুজ পাহাড় তার ভাঁজে ভাঁজে ধরে রেখেছে এক অপার সৌন্দর্য। অনেককেই বলতে শুনেছি- সাজেকের রূপ তার সবুজ পাহাড়ে আর সাদা মেঘে এখন দেখলাম কথাটা সত্য। প্রকৃতি যেন খুব যত্ন করে সাজিয়েছে এই পুরো এলাকা। এখানে না এলে প্রকৃতির এই অসাধারণ সৌন্দর্য দেখা থেকে বঞ্চিত হতাম।
                                                      হোটেল রুমের সামনে থেকে তোলা পাহাড়শ্রেণী

     গতকাল রাত থেকে জার্নির ধকল, তাই গোসল করাটা জরুরি। তবে পানি বেশ ঠাণ্ডা। কিচ্ছু করার নেই, অভ্যেস না থাকলেও আজ সেই ঠাণ্ডা পানিতেই গোসল সেরে নিলাম। স্ত্রী-মেয়েকে বললাম তোমরা গোসল করে রেডি হও, আমি একটু ঘুরে আসছি। মাসুদ ভাইও রেডি হচ্ছেন। আমি চারপাশটা একটু দেখতে বেড়িয়ে পড়লাম। প্রকৃতির পাশাপাশি স্থানীয় আদিবাসীদের বিচিত্র জীবনযাত্রার প্রতিও আমার কিছুটা আগ্রহ আছে
      সাজেকের প্রথম গ্রাম রুইলুই পাড়া রুইলুই পাড়ায় ঢুকে কিছুদূর এগিয়েই সাজেকের মূল পর্যটন এরিয়া শুরু। এই স্থানটা মূলতঃ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৮০০ ফুট উপরে অবস্থিত। সাজেকের শুরুতেই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিজিবি ক্যাম্প। এখানে একটি হেলিপ্যাড আছে। আরও সামনে এগোলে উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় যে গ্রামটি দেখা যায় ওটাই সাজেকের শেষ গ্রাম, নাম কংলাক পাড়া। বিকেলে আমরা কংলাক পাহাড়ে যাবো। সাজেকে প্রচুর হোটেল আর রিসোর্ট হয়েছে; এখানকার ঘরগুলো বেশির ভাগই লাল-নীল-সবুজে রাঙানো। কিছু পাকা বিল্ডিং আর বেশ কিছু টিন আর ছনের তৈরি কটেজ। বেশির ভাগ হোটেল রিসোর্টেই রয়েছে পাহাড়ের দিকে মুখ করা ঝুল বারান্দা, যেখান থেকে দূরে তাকালে সবুজ পাহাড়ের সারি চোখে পড়ে। ফুটপাথের পাশে নানান রকম ফলমুল আর শাক সব্জি নিয়ে বসেছে আদিবাসী নারী-পুরুষ। এ সবই তাদের নিজস্ব বাগানে ফলানো। হোটেলে ফিরে দেখি মাসুদ ভাই তৈরি হয়ে গেছে। মেয়েরা খোলা ছাদে ছবি তুলতে ব্যস্ত। কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা লাঞ্চে যাব।

     সবাই তৈরি হয়ে এলে আমরা লাঞ্চে বের হলাম।  হোটেলে পৌঁছেই দুপুরের খাবার বুকিং দিয়ে গিয়েছিলাম। এখানে আগে থেকে বুকিং দিয়ে না রাখলে খাবার পাওয়া কষ্টকর। খাবার দামটাও কিছুটা বেশি। আমার হাঁসের মাংস খাওয়ার ইচ্ছে ছিলো, তবে মেয়েরা কেউ খেতে রাজি ছিল না, তাই মুরগি, সবজি, আলু ভর্তা, ডাল বুকিং দেয়া ছিলো। আমরা হোটেলে পৌঁছে দেখি- প্রচুর ভিড়। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর টেবিল খালি পাওয়া গেলো। খেতে গিয়ে কেউ তেমন খুশি হতে পারলো না। তাদের কাছে খাবার মজা লাগেনি। লম্বা জার্নির পর পেটে বেশ ক্ষুধা ছিল, তাই আমার তেমন খারাপ লাগেনি। যাই হোক, লাঞ্চ শেষে আমরা আশপাশটা একটু ঘুরে দেখলাম। রাস্তার দু’দিকে যেখানেই তাকাই শুধু সবুজ পাহাড়। অবশ্য এমনটাই তো হবার কথা! এখন তো আর মেঘ দেখা যাবে না। মেঘ দেখার জন্য আগামীকাল সকালটা বরাদ্দ থাক। আমরা হোটেলেই ফিরে গেলাম। কিছু সময় রেস্ট নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে কংলাক পাহাড়ের উদ্দেশ্যে।

     কেউ কেউ শুয়ে রেস্ট নিলেও আমি খোলা ছাদে চলে এলাম। এখান থেকে সাজেকের একপাশের পুরোটা দেখা যায়। পাহাড়ে সবুজের ফাঁকে ফাঁকে অসংখ্য লাল-নীল-সবুজ রঙ করা কাঠ আর টিনের তৈরি কটেজ, যেখান থেকেও এই মেঘের রাজ্যের অপার সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। আমার মেয়ে পেছনে এসে দাঁড়ালো। বাবা, ঐদিকটায় কি? আঙুল দিয়ে সামনের দিকে দেখিয়ে জানতে চাইলো। আমি বললাম- ওদিকটায় ভারতের মিজোরাম। সে বেশ কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো- ভারত এত কাছে? আই বললাম- হ্যা, আমরা এখন ভারত-বাংলাদেশ বর্ডারের কাছাকাছি। একে একে অন্যরাও ছাদে এসে দাঁড়ালো। মাসুদ ভাই বললো- চলেন কংলাকের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ি, আবার ফিরতে হবে তো।
                                              মেয়েদের কংলাক পাহাড়ে ওঠা

আমরা বেরিয়ে পড়লাম কংলাক পাহাড়ের উদ্দেশ্যে আমাদের সেই মাহিন্দ্র হোটেলের সামনেই দাঁড়ানো। সবাই উঠে বসলে চাপাই মারমা গাড়ি ছেড়ে দিলো। বাবু জানালো এদিকে একটা হেলিপ্যাড আছে, তবে আমরা সেখানে না গিয়ে আরও সামনে কংলাকের উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেলাম। ওখান থেকে ফিরে হেলিপ্যাডে যাবো। কিছুদূর এগিয়ে গাড়ি থেমে গেলো। বাবু জানালো- গাড়ি আর যাবে না, এবার হেঁটেই যেতে হবে। কি আর করা! আমরা সবাই গাড়ি থেকে নামলাম। এখান থেকেই পাহাড়ে ওঠা শুরু। পথে দেখা গেলো কয়েকজন বাঁশের লাঠি বিক্রি করছে। দেখলাম যারাই পাহাড়ে উঠছে সবার হাতে বাঁশের লাঠি। আমরা প্রত্যেকে একটা করে লাঠি নিয়ে নিলাম। মাটির রাস্তা ধরে উঁচুনিচু পথে এগিয়ে চললাম। আমরা  ক্রমশঃ উপরে উঠছিলাম আর পথের দু’পাশে ভয়ঙ্কর সুন্দর সবুজ পাহাড়ের মাঝে যেন হারিয়ে যাচ্ছিলাম। বাচ্চারা সবার আগে আগে উৎফুল্ল চিত্তে পাহাড়ে উঠে যাচ্ছে। যেন এটা একটা মজার খেলা। আমি সবার পেছনে পেছনে যাচ্ছিলাম এবং ওদের থেকে বেশ কিছুটা পিছিয়ে পড়ছিলাম, কারণ আমি সামনে এগোচ্ছিলাম আর ছবি তুলছিলাম। যেদিকেই তাকাচ্ছি, মনে হচ্ছে এ জায়গাটার ছবি তুলে রাখি। ওরা বেশ সামনে চলে গেছে। আমি কিছুটা দ্রুত ছুটতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠলাম। একসময় ওদের ধরে ফেললাম। লাঠিসোঁটাসহ ওদের কিছু ছবি তুলে রাখলাম। কিছুটা রেস্ট নিয়ে আবার এগিয়ে চলা। একসময় চূড়ার কিছুটা আগে সবচেয়ে উঁচু খাঁড়া অংশের গোরায় উঠে আসলাম, তবে এর পরের পথটা বাচ্চাদের যাওয়ার উপযোগী নয়। তাই আমরা আর এগোলাম না। ওখানে কিছুটা সময় কাটিয়ে নিচে নামতে শুরু করলাম। পাহাড়ের চূড়ায় কংলাক গ্রামে আর যাওয়া হলো না আমাদের। এ নিয়ে আফসোস নেই, বাচ্চারা বেশ মজা পেয়েছে, এতেই খুশি। নামতে গিয়ে আমাদের বেশ সাবধানী হতে হলো। ওঠাটা কঠিন ছিলো, তবে নামাটা যতটা সহজ ভাবছিলাম ঠিক ততটা নয়। কোথাও কোথাও বেশ খাঁড়া। একটু অসাবধান হলে বিপদ হতে পারে, তাই বাচ্চাদের দিকে খেয়াল রাখতে হচ্ছে। নামার সময় লাঠিটা বেশ কাজে দিয়েছে। এভাবেই একসময় নেমে এলাম। আমাদের কংলাক ভ্রমণ শেষ।
হোটেলের সামনে এসে বাচ্চারা সেই বাঁশের চা খাওয়ার বায়না ধরলো। সবাই মিলে চায়ের দোকানে বসলাম। দোকানির বাঁশের চা বানানোর কৌশল দেখে বেশ মজা পাচ্ছিলাম। একটা বাঁশের চোঙায় দুধ-চিনি দিয়ে তার মধ্যে গরম চায়ের পানি ঢেলে দিলো, তারপর চিকণ বাঁশের কঞ্চির তৈরি এক ধরনের ঘুটনি দিয়ে কিছুক্ষণ নেড়ে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিলো। আমি আর মাসুদ ভাই হাসলাম। এই তাহলে বাঁশের চা! তবে বাচ্চারা বেশ মজা পাচ্ছিলো। বাঁশের চা খাওয়া শেষ, এবার কি করা যায়? চারিদিকে আঁধার ঘনিয়ে এসেছে, এখন কোথাও গিয়ে লাভ নেই। চাপাই মারমা জানতে চাইলো- রাতের খাবার কোথায় খাবো। আমরা দুপুরে যেখানে খেয়েছি সেখানে আর খেতে চাইলাম না। ওকে জিজ্ঞেস করলাম- নতুন ধরণের খাবার কোথায় আছে? পেদা টিন টিনে যেতে পারেন, ওখানে ব্যাম্বু-চিকেন পাওয়া যায় সবাই ব্যাম্বু-চিকেন খাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলো। আমি আর মাসুদ ভাই চললাম ব্যাম্বু-চিকেনের বুকিং দিতে। অনেকটা পথ হাঁটতে হলো, তবে রাতের খাবারের বুকিং দিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। আমি ছাদে গিয়ে বসলাম। বাইরে বেশ ঠাণ্ডা। ঢাকায় শীত এখনও শুরু হয়নি কিন্তু সাজেকে বেশ শীত। ব্লেজারের সাথে মাফিলারও পড়তে হচ্ছে।
মাসুদ ভাইকে ছাদে দেখে আমি বলে উঠলাম- ইটালিয়ান জ্যাকেট পরে তো দেখি পুরাই প্যাকেট হয়ে গেছেন! মাসুদ ভাই হেসে বললো- শীত তো কম না। আমার মেয়েকেও সোয়েটার টুপি, গলাবন্ধ পরিয়ে দিয়েছে তার মা। দূরে কুয়াশা জমেছে, ছাদ থেকে এখন আবছাভাবে পাহাড় দেখা যায়, তবে মেঘের দেখা এখনও পাইনি। হোটেলের বয়টাকে জিজ্ঞেস করতেই জানালো- কাল সকালে দেখতে পাবেন। আমি জানতে চাইলাম- ক’টায় উঠতে হবে? সাড়ে পাঁচটায় উঠলেই দেখতে পাবেন। আমি মোবাইলে এলার্ম দিয়ে রাখলাম। রাতে পেদা টিন টিনে খেতে গিয়েও দুপুরের মত হতাশ হতে হলো। সব্জিটাই যা একটু মজা হয়েছে, বাকী রান্নাটা যাচ্ছে-তাই। ব্যাম্বু-চিকেন কারো কাছেই মজা লাগেনি। যাই হোক, রাতের খাবার শেষে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম এবং সকালে মেঘ দেখার প্রত্যাশা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

এলার্ম বাজবার আগেই ভোর পাঁচটার দিকে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। মেঘ দেখার লোভে কম্বলের নিচ থেকে বেরিয়ে গরম কাপড় গায়ে চাপিয়ে ছাদে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাইরে বেরিয়ে অনুভব করলাম ঠাণ্ডা পড়েছে বেশ কুয়াশাও জমেছে। চারপাশ ঘোলাটে লাগছে এখন সামনে তাকিয়ে দেখলাম কোন সবুজের চিহ্ন নেই, সামনের পুরা এলাকাই সাদা আমি কিছু ছবি তুললাম, তবে কুয়াশার জন্য মেঘ ভালমত দেখা যাচ্ছে না। চারিদিকে আবছায়া আঁধার। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম লোকজনের সাড়া নেই। আমি তখনকার মত ভেতরে চলে গেলাম। মনে মনে ভাবলাম ঘণ্টাখানেক পরে উঠে মেঘ দেখবো।
                                             হোটেল রুমের সামনের ছাদ থেকে তোলা মেঘের ছবি

     মেয়ের ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে গেলো আবার। বাবা, মেঘ দেখবে না? দেখো কি সুন্দর মেঘ জমেছে! আমি ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললাম- তুমি দেখেছো? তাকে খুব উচ্ছ্বাসিত দেখে বুঝলাম- সে মেঘ দেখে খুব খুশি। ওর এই আনন্দে আমিও খুশি। আবার কম্বলের নিচ থেকে বেরিয়ে পড়লাম ছাদে গিয়ে আমি নিজেই হতবাক হয়ে গেলাম। ভোরে যখন এখানে এসেছিলাম তখন একেবারেই বোঝা যায়নি। এখন দেখছি আমি একটা মেঘের নদীর সামনে দাঁড়িয়ে! কী অসাধারণ ! আমাদের সামনে যে সবুজ গিরিখাতটা ছিলো সেটা এখন নেই! ওখানে শুধু তুলোর মত সাদা মেঘ। দূরের পাহাড়গুলোও মেঘে ঢেকে আছে। আমার মনে হলো এই যে এত পরিশ্রম, ধকল সহ্য করে আমরা এতদূর এলাম- সেটা এখন সার্থক হলো। এদিকে-ওদিকে যেদিকেই তাকাই একটা নিরব নিস্তব্ধ পরিবেশ; মনে হচ্ছে একটা মেঘের নদী বহুদূর পর্যন্ত বয়ে গেছে। আকাশ-পাহাড় আর মেঘের অদ্ভুত এক মেলবন্ধন। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি, সবুজ পাহাড় আর মেঘের মিতালী দেখি। এভাবেই বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেলো। তারপর বেশ কিছু ছবি তুললাম। চারিদক পরিষ্কার হয়ে এসেছে তবে সূর্য এখনও ওঠেনি। আমরা অপেক্ষা করছিলাম সুর্য ওঠার জন্য। বেশ কিছুক্ষণ পর মেঘ-কুয়াশার চাঁদর সরিয়ে পূব দিগন্তে সূর্য যখন উঁকি দিলো আমার মেয়ের সে কী আনন্দ! সে পুরো দৃশ্যটি ভিডিও করতে শুরু করলো। সূর্য একটু একটু করে বড় হতে হতে যখন গোল থালার মত রুপ নিলো- সে খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো- দেখো বাবা, কেমন লাল টুকটুকে সূর্য উঠেছে! তখনই আমার মনে পড়লো- এই প্রথম সে সূর্যোদয় দেখছে। মাসুদ ভাইয়ের মেয়েরাও ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ওদের মধ্যে উচ্ছ্বাসের মাত্রাও কম নয়, হয়তো এটা ওদেরও প্রথম সূর্যোদয় দেখা

                                                                                               সাজেকে সূর্যোদয়

      মেঘকন্যা সাজেকে আমাদের সময় ফুরিয়ে এলো, এবার ফেরার পালা। খাগড়াছড়ি ফিরে ওখানকার কিছু স্পট ঘুরে আজ বিকাল তিনটার মধ্যে আমাদের রাঙামাটির উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। চাপাই চাকমা জানালো দেরি করলে পাহাড়ি পথে রাঙামাটি যেতে সমস্যা হবে। সকাল দশটায় এখান থেকে আর্মি এস্কর্ট ছাড়েআমাদের তাদের সাথেই যেতে হবে। আমরা ফ্রেশ হয়ে নাস্তা খেতে বেরিয়ে পড়লাম। নাস্তা সেরে হোটেলে ফিরে সবাইকে তাড়াতাড়ি তৈরি হতে বললাম। মেয়েদের তৈরি হতে কিছুটা সময় বেশি লাগে, তাই আমি আর মাসুদ ভাই তাড়া দিচ্ছিলাম। সময়ের নিঁখুত হিসেব করেও বেলা সাড়ে ন’টার আগে আমরা বের হতে পারলাম না। তাই গাড়ির সিরিয়ালে অনেকটা পেছনে পড়ে গেলাম। যাই হোক, আমাদের গাড়ি চলতে শুরু করলো। আমরা সাজেক ভ্রমণ শেষে ফিরে চললাম পরবর্তী গন্তব্য খাগড়াছড়ির পথে। খাড়া পাহাড়ের ঢাল বেয়ে আমাদের গাড়ি যখন নামছিলো, প্রথমে কিছুটা ভয় ভয় লাগলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটা কেটে গেলো। মেয়েরা এবারও ভয় পাবার পরিবর্তে মজাই পাচ্ছিলো। খাড়া পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে খুব দ্রুতবেগে নেমে আসছিলো গাড়ি। আমরা খুব শক্ত করে সামনের সিটের হ্যাণ্ডেল ধরে রাখছিলাম। রাস্তার দু’পাশের অসাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী চিরদিন আমার মনস্পটে আঁকা থাকবে। অনেকটা পথা আসার পর আমাদের গাড়ি থেমে গেলো। বাবু জানালো- সামনে জ্যাম। এখানে আর্মিরা পালা করে গাড়ি ছাড়ে। কিছুক্ষণ সাজেক আসার গাড়ি ছাড়ে এবং কিছুক্ষণ যাওয়ার গাড়ি। খাগড়াছড়ি থেকে সাজেকের পথে আসা গাড়ির লম্বা লাইন। ক্রমাগত গাড়ি আসছে তো আসছেই। প্রায় ঘণ্টাখানেক আটকে ছিলাম আমরা। তারপর আবার চলতে শুরু করলো। চাপাই মারমা সময় বাঁচানোর জন্য খুব দ্রুতবেগে গাড়ি চালাচ্ছিলো, তবে আমাদের খাগড়াছড়ি পৌঁছুতে প্রায় দুপুর দু’টো বেজে গেলো। হাতে সময় আর বেশি নেই। দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য রেস্টুরেন্টে ঢুকে গেলাম। লাঞ্চ সেরে যতটা সম্ভব খাগড়াছড়িতে দেখার মত স্পট দেখে রাঙামাটির উদ্দেশ্যে রওনা দেবো। খাওয়া শেষ হতে বেলা আড়াইটা পার হয়ে গেলো। চাপাই মারমা জানালো- রাঙামাটি যেতে হলে আপনারা এখানকার একটি মাত্র স্পটে যেতে পারবেন। খাগড়াছড়ির বিখ্যাত সেই রিসাং ঝর্ণা দেখা হলো না আমাদের। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আলুটিলা পাহাড়ের গুহা দেখে সোজা রাঙামাটি চলে যাবো।

     কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা আলুটিলা পাহাড়ের প্রবেশদ্বারে পৌঁছে গেলাম। টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকে একটু সামনে এগিয়ে পর্যটকদের জন্য বসার ব্যবস্থা রয়েছে। তার পাশেই রেলিঙ দেয়া একটি গোলাকার পাকা চত্বর, যেখান থেকে খাগড়াছড়ি শহরের প্রায় সবটুকুই দেখা যায়। লোকমুখে শোনা যায় এটি খাগড়াছড়ির সবচেয়ে উঁচু পর্বতশ্রেনী। সন্ধ্যার পর এখান থেকে খাগড়াছড়ি শহরের দৃশ্য দেখার মজাই আলাদা। আমর সবাই এই চত্ত্বরে কিছু ছবি তুললাম। যাই হোক আমরা আমাদের মূল গন্তব্য আলুটিলা গুহার দিকে এগিয়ে গেলাম। সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলাম। নামছি তো নামছিই। অসংখ্য ধাপ অতিক্রম করে আমরা পাহাড়ের পাদদেশ তথা গুহামুখের কাছে পৌঁছালাম। তবে গুহামুখে পৌঁছে বেশ হতাশই হলাম, কারণ আমরা কেউ গুহায় প্রবেশের প্রস্তুতি নিয়ে আসিনি। ভেতরটা অন্ধকার, পিচ্ছিল এবং স্যাঁতসেঁতে। মাসুদ ভাই একবার চেষ্টা করে ফিরে এসে জানালো ভেতরে পানি আছে। তাছাড়া সাথে মহিলা ও বাচ্চারা থাকায় গুহায় প্রবেশের চিন্তা বাদ দিলাম।

                           মাসুদ ভাইয়ের আলুটিলা গুহায় প্রবেশের চেষ্টা

       আশপাশটা ঘুরে দেখে আমরা ফিরে চললাম। গুহায় নামতে গিয়ে সবাই যে রকম আনন্দ পেয়েছিলো উপরে উঠতে গিয়ে টের পেলো ওঠাটা কত কষ্টকরসবাই মোটামোটি হাঁপিয়ে উঠলাম। প্রায় তিন’শর কাছাকাছি সিঁড়ির ধাপ অতিক্রম করতে হয়েছে। যাই হোক, কিছু সময় রেস্ট নিয়ে গাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটা দিলাম। আমরা গাড়িতে উঠতেই চাপাই মারমা রাঙামাটির পথে চলতে শুরু করলো। খাগড়াছড়ি থেকে রাঙামাটি যাওয়ার পথটা যতটা সহজ হবে ভেবেছিলাম, চলতে গিয়ে তেমন মনে হচ্ছে না। রাস্তায় প্রচুর বাঁক আর উঁচুনিচু। পথ সমস্যার কারণ না হলেও বাঁক গুলোই ভোগাচ্ছে বেশি। গাড়িতে বসে থাকাই কষ্টকর। চাপাইকে বললাম একটু আস্তে চালাতে। কখনও সবুজ পাহাড় আবারর কখনও সমতল ভুমি দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে চললাম। পাহাড়ের ঢালে আনারসের চায হচ্ছে, কোথাও নতুন চারা লাগানো হচ্ছে। সেগুলো দেখে বাচ্চাদের নানা প্রশ্ন, উত্তর দিতে হচ্ছে। রাস্তা মোটামাটি নির্জনই বলা যায়। চাপাই মারমা সন্ধ্যার আগে রাঙামাটি পৌঁছুতে চায়, তাই গাড়ি বেশ দ্রুত চালাচ্ছিলো। পথে দু’জায়গায় আর্মি চেকিঙের জন্য গাড়ি থামালোড্রাইভারকে কিছু রুটিন প্রশ্ন করে ছেড়ে দিলো। সন্ধ্যা নামার কিছুটা আগেই আমরা রাঙামাটি পৌঁছে গেলাম।  


রাঙামাটির পথে পথে, নীল জলে ভেসে...

      আগেরবার যখন রাঙামাটি এসেছিলাম তখন আমার মেয়ে রিয়াসা অনেক ছোট। ওর স্মৃতিতে হয়তো তখনকার কোন ছবিই নেই। তাই ভাবলাম এবারের রাঙামাটি ভ্রমণ ওর জন্যও অনেক আনন্দদায়ক হবে। মাসুদ ভাইদের জন্য এটি নতুন জায়গা। রিয়াসা জিজ্ঞেস করলো- বাবা, এখানেও কি পাহাড়-মেঘ দেখা যাবে? আমি বললাম- পাহাড় দেখা যাবে তবে সাজেকের মত মেঘ দেখা যাবে না। লেক দেখতে পাবে, আমরা সবাই মিলে বোটে চড়ে ঘুরবো সেই লেকে তোমরা ঝুলন্ত ব্রিজে উঠবে, বোটে করে সুবলং ঝর্ণার কাছে যাবে, তবে মনে হয় না ঝর্ণায় এখন পানি দেখতে পাবে। এতকিছু দেখতে পাবে শুনে ওরা বেশ খুশি।

     যাই হোক, রাতে আমাদের আর কোথাও যাওয়া হলো না। পর্যটনের মোটেলটা বেশ পছন্দসই ছিলো। আমার স্ত্রী এসব ব্যাপারে বেশ খুঁতখুঁতে, সেও পছন্দ করলো। সবকিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, সামনে লম্বা করিডোর, পেছনে প্রশস্ত বারান্দা। হোটেলের পেছন দিকে কিছুটা খোলা জায়গা, সেখানে বাচ্চাদের খেলার জন্য কয়েকটা রাইড বসানো আছেমেয়েরা সেখানে দোলনায় বসে কিছুটা সময় কাটালো। তবে বারান্দার দরজায় বানরের বিষয়ে সতর্কবাণী দেখে ওরা আমাদের পাহারাদার হিসেবে দাঁড় করিয়ে রাখলো। সাজেকের তুলনায় এখানে শীত কিছুটা কম। আমি ও মাসুদ ভাই ঝুলন্ত ব্রিজের ওপারে গিয়ে পরেরদিন সকালে লেকে ভ্রমণের জন্য বোট ভাড়া করে আসলাম। সকালে বোটে করে রওনা দেবো, সারাদিন ধরে লেকের আশেপাশে বেশ কয়েকটি দর্শনীয় স্থান ঘুরে সন্ধ্যায় আবার ফিরে আসবো এখানেই- এভাবেই বোট মালিকের সাথে কথা ফাইনাল হলো। আমরা পর্যটনের রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেলাম, তারপর রুমে ফিরে শুয়ে পড়লাম। সারাদিনের ক্লান্তিতে সে রাতের ঘুমটা চমৎকার হয়েছিলো।
      খুব সকালে ঘুম ভেঙে গেলো আমারপেছনের বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই একটা অদ্ভুত ভাললাগায় ছেয়ে গেলো মনটাসবুজ গাছপালা ঘেরা নিরব নিস্তব্ধ পরিবেশ। চারিদিকে একটা শান্ত স্নিগ্ধ ভাব। সেই গাছপালার ফাঁক দিয়ে পেছনের কাপ্তাই লেকের টলটলে নীল জল দেখা যাচ্ছিলোএকপাশ থেকে ঝুলন্ত ব্রিজের কিছুটা অংশও চোখে পড়ছিলো। আমি মেয়েকে ডেকে তুললাম। প্রথমে কম্বলের ওম ছেড়ে বের হতে চাচ্ছিলো না, তবে ঝুলন্ত ব্রিজের কথা শুনে উঠে পড়লো। মেয়েকে তুলে দিয়ে আমি গোসলে চলে গেলাম। গোসল সেরে বের হতেই দেখি গিন্নি বিছানা পরিপাটি করে গুছিয়ে ফেলেছে। আমি তৈরি হয়ে নিচে চলে গেলাম। মুমু-ইরা-রিয়াসা যথারীতি দোলনায় দোল খাচ্ছে আর লেকের টলটলে নীল জলের গুণগান করছে। আমি ওদের তাড়া দিয়ে বললাম- ওখানে যেতে হলে গোসল সেরে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে এসো। ওরা রুমে চলে গেলে আমি আর মাসুদ ভাই হোটেলের সামনে আদিবাসীদের তৈরি দ্রব্যের দোকানে গেলাম। এখানে স্থানীয় আদিবাসীদের গ্রামে তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি হয়। দামও তেমন বেশি নয়। আমরা ঠিক করলাম লেক থেকে ঘুরে এসে কিছু কেনাকাটা করবো।

                                                                     ঝুলন্ত ব্রিজে ওঠার আগমুহূর্তে রিয়াসা

      নাস্তা সেরেই আমরা ঝুলন্ত ব্রিজের দিকে এগোলাম। ব্রিজের ওপার থেকে বোটে উঠবো। মেয়েরা ব্রিজে এবং তার আশেপাশে কিছুক্ষণ ছবি তুললো। অব্যবস্থাপনা এবং তত্ত্বাবধানের অভাবে ব্রিজটা আর আগের মত আকর্ষণীয় নেই। কাঠগুলো বেশ নড়বড়ে হয়ে আছে। যাই হোক, আমরা ব্রিজ পার হয়ে বোটে উঠে বসলাম। কিচ্ছুণের মধ্যেই আমাদের প্রমোদ তরী লেকের জল কেটে চলতে শুরু করলো। লেকের শান্ত জলের উপর দিয়ে আমরা ভেসে চলছিলাম তবে নৌকার ইঞ্জিনের ভটভট শব্দটা পরিবেশের সাথে বেমানান লাগছিলো। মাঝে মাঝে বিরক্তিকরও। ইঞ্জিনের শব্দে আমরা নিজেদের কথাই ঠিকমত শুনতে পাচ্ছিলাম না। আহা! এমন চমৎকার পরিবেশে এই শব্দটা যদি না থাকতো! মাসুদ ভাইয়ের আক্ষেপের উত্তরে আমি হাসতে হাসতে বললাম- এই ইঞ্জিঞ্চালিত বোটে করে সুবলং ঝর্ণার কাছে যেতে এবং ফিরে আসতেই তিন ঘণ্টার বেশি সময় লাগবে, আর বৈঠা চালিত নৌকায় গেলে তো আজ আর ফেরা হতো না। তাছাড়া আমাদের আরও কয়েকটি স্পটে যেতে হবে। আমরা এগিয়ে চলছিলাম নীল জলে ভেসে ভেসে আর চারপাশে দেখছিলাম সবুজ পাহাড়ের সারি; দুরে-কাছে, উঁচুনিচু। কোথাও ঝাপসাভাবে পাহাড়ের অবয়ব চোখে পড়ছে অনেক দূরে। আবার থেকে থেকেই লেকের জলরাশির মাঝে দ্বীপের সদৃশ ছোট ছোট পাহাড় চোখে পড়ছিলো। মোটকথা এমন চমৎকার পরিবেশে সারাদিন অনায়াসেই পার করে দেয়া যায়। আমাদের বোট চালকের নাম মিল্টন। ওকে জিজ্ঞেস করলাম- এখানে কোথাও একটা পুরনো রাজবাড়ী ছিলো, আমরা কি ওখানে যাবো? ও জানালো- রাজবাড়িটা এখন আর নেই, ওটা পানির নিচে চলে গেছে। আমার মনে পড়ছিলো আগেরবার আমরা সেখানে গিয়েছিলাম। তখন ওখানে পুড়ে যাওয়া কিছু ঘর দেখেছিলাম। আমি আবার ওকে জিজ্ঞেস করলাম- আর ‘রাজবন বিহার’? উত্তরে মিল্টন বলল- ওখানে তো শহর থেকেও যাওয়া যায়, তাছাড়া ওখানে বাঙালিরা আর তেমন যায় না। আমি জানতে চাইলাম- কেন? ও জানালো- রাজবন বিহারে প্রতিদিন প্রচুর পর্যটকের আনাগোনার ফলে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উপাসনা ভান্তেদের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যহত হয়, তাই পর্যটকদের জন্য রাজবন বিহারে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে আমি বললাম- ও আচ্ছা! আমাদের তাহলে রাজবন বিহারে যাওয়া হচ্ছে না!
                                                                                       কাপ্তাই লেক

     কাপ্তাই লেকে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দে মেয়েরা খুব খুশি ছিলো। হঠাৎ আমি ওদের আনন্দে ব্যঘাত ঘটালাম। জিজ্ঞেস করলাম- এই কাপ্তাই লেক কীভাবে তৈরি হয়েছে জানো? আজ আমরা এই নীল জল দেখে আনন্দিত হচ্ছি, অথচ জানো এই জলের নিচে জমে আছে কত মানুষের কান্না? ওরা সবাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো- কেন?  
     কর্ণফুলী জল বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির ইতিহাস সম্পর্কে আমি যতটুকু শুনেছি তাই ওদের বললাম। ওরা খুব মনোযোগী শ্রোতার মতই শুনছিলো। আমি বললাম- তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আমেরিকার অর্থায়নে ১৯৫৬ সালে কর্ণফুলী জল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ শুরু করে যা ১৯৬২ সালে শেষ হয়। এই বাঁধের কারণে এই অঞ্চলের চুয়ান্ন হাজার একর কৃষিজমি ডুবে যায় যা এখানকার মোট কৃষি জমির ৪০ শতাংশ। সেই সাথে প্রায় আড়াই’শ বর্গমাইল বনাঞ্চলও ডুবে যায়। এই এলাকায় বেশির ভাগই ছিলো চাকমা সম্প্রদায়ের বসবাস। এদের প্রায় ১৮ হাজার পরিবারের এক লাখের মত মানুষ তাদের বসতবাড়ি আর কৃষিজমি হারিয়েছিল। তাই বলা হয়- কাপ্তাই লেকের নীল জলে মিশে আছে এখানকার আদিবাসিদের কান্না।

     আমার কথা বলা শেষে দেখলাম ওদের সবার মন খারাপ হয়ে গেছে। পরিবেশটা হালকা করতেই বললাম- তোমাদের মন খারাপ করার কিছু নেই। বৃহত্তর স্বার্থে অনেক ক্ষেত্রেই কাউকে না কাউকে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য এই স্থানকেই হয়তো তৎকালীন বিশ্লেষকরা উপযোগী মনে করেছিলো। এটা বিশ্বের সব দেশেই হয়ে থাকে। নদীতে বাঁধ নির্মান, ব্রিজ তৈরি কিংবা রাস্তা তৈরির জন্য অনেক মানুষের ঘরবাড়ি সরকার চাইলেই নিয়ে নিতে পারে। এই যেমন পদ্মা সেতুর জন্য অনেক মানুষের বাড়ি-ঘর, চাষের জমি সরকার অধিগ্রহণ করেছে। যাদের কাগজপত্র ছিলো- তারা এই জমির পরিবর্তে টাকাও পেয়েছে। মন খারাপ না করে তোমরা মজা করো।
                                                                 কাপ্তাই লেক- সুবলং ঝর্ণার সামনে থেকে

     আমাদের এখনকার গন্তব্য সুবলং ঝর্ণা, ওটাই সবচেয়ে দূরে অবস্থিত। আমরা সেদিকেই ছুটে চলছিলাম। ঝর্ণা দেখে বাকী স্পটগুলো দেখতে দেখতে ফিরে আসবো আবার সেই ঝুলন্ত ব্রিজের কাছেচারিপাশের দৃশ্যপট দ্রুত বদলে যাচ্ছিলো। কোথাও টিলাসদৃশ ছোট ছোট পাহাড়, কোথাওবা উঁচু। পাহাড়ের পাড়গুলো অনেকটা পাথরের মত শক্ত। লেকে জেলেনৌকা খুব একটা দেখা যাচ্ছিলো না। দু’একটা নৌকা চোখে পড়ছিলো এই দীর্ঘসময় ধরে। আমি বিভিন্ন এঙ্গেলে লেকের ছবি তুলছিলাম। মেয়েদেরও দেখলাম মোবাইলে ছবি তুলতে ব্যস্ত। কখনও নিজেদের আবার কখনওবা লেকের দৃশ্য। এভাবে চলতে চলতেই আমরা পৌঁছে গেলাম সুবলং ঝর্ণার কাছে। জায়গাটা আসলেই খুব সুন্দর। চারিদিকে অনেকগুলো উঁচু পাহাড়, তার মধ্যে দিয়ে একটা সরু চ্যানেল বেরিয়ে গেছে অন্য প্রান্তে। সেখান দিয়ে ছোট বড় নৌকা ছুটে চলছে। আমরা সবাই ঝর্ণার স্পটে নামলাম। তবে সবচেয়ে হতাশার কথা হলো- এবারও ঝর্ণায় পানি নেই। আগেরবারও যেমন দেখতে পাইনি। আমরা সবাই ওখানে বেশ কিছু ছবি তুললাম। কিছুটা সময় কাটিয়ে সুবলং ত্যাগ করলাম।
                                                                                          পানিবিহীন সুবলং ঝর্ণা

     আমরা ফিরে চলেছি সেই একই পথ ধরে, অর্থাৎ লেকের যেদিক থেকে এসেছিলাম সেদিকে। এখান থেকে অল্প কিছুদূর এগোলেই একটি আদিবাসিদের গাঁ রয়েছে। এখানে গাঁ বলতেও সেই পাহাড়। পাহাড়ের কোলঘেঁষে ভিড়লো আমাদের বোট। আমরা সবাই সিঁড়ি বেয়ে উঠে পড়লাম পাহাড়ের উপরে। লেক থেকে পাহাড়ের উচ্চতা কম-বেশি এক’শ ফুটের মত হবে। আমার কাছে সেই পাহাড়ি গাঁয়ের আলাদা কোন বিশেষত্ব চোখে পড়েনি। কয়েকটি টিনের ঘর, সবজী মাচা ও বিভিন্ন ফলমূলের গাছগাছালি আর আদিবাসী মানুষজন। তবে সেখানে কয়েকটি দোকান ছিলো, আদিবাসিদের হাতে বোনা কাপড়চোপড়, শাল, ব্যাগ ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছিলো। আমরা সেখান থেকে কিছু কেনাকাটা করে নেমে পড়লাম।

     আবার চলতে শুরু করেছে আমাদের নৌকা। এবারের গন্তব্য- রেস্টুরেন্ট। কাপ্তাই লেকে ছোট ছোট কয়েকটি দ্বীপে গড়ে উঠেছে রেস্টুরেন্ট। লেকে ভ্রমণরত পর্যটকদের একটা বড় অংশ এসব রেস্টুরেন্টেই দুপুরের খাবার খেয়ে থাকে। এমনই দু’টো রেস্টুরেন্ট পেদা টিং টিং অথবা চাংপাং এর যে কোন একটিতে আমরা দুপুরের খাবার খাবো। ‘আর যাই হোক- ব্যাম্বু-চিকেন আমি খাবো না’ মাসুদ ভাইয়ের বলার স্টাইলে হেসে ফেললাম। হাসতে হাসতেই বললাম- ‘ঠিক আছে আপনি ব্যাম্বু-ফিশ খাইয়েন’ মাথা নেড়ে সে বলল- ‘দরকার নাই আমার ব্যাম্বু-ফিশ চিকেনের। তবে বাঁশকোড়ল দিয়ে চিংড়ি খাওয়া যেতে পারে, না পেলে আমার জন্য ডাল-আলু ভর্তাই যথেষ্ট’এমনি হাসি আনন্দে আমাদের সমটা কেটে যাচ্ছিলো। চাংপাং এর কাছে পৌঁছুতেই নৌকা ভিড়ালাম। চলেন এখানেই খাই। মনে পড়লো- ন’বছর আগে আমরা এখানেই খেয়েছিলাম। মাসুদ ভাইয়ের জন্য দুঃসংবাদ; ডাল-আলুভর্তা পাওয়া যায়নি। তাই আমরা মুরগী আর রুই মাছ অর্ডার করলাম। আমাদের আধা ঘণ্টা বসিয়ে রেখে রাধুনি রান্না করলো, তারপর যা খাওয়ালো তাতে আমাদের মুরগী খাওয়ার ইচ্ছেটাই মরে গেছে। সে খাবার কোনরকম গলদকরণ করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম।
     আরও কিছুদূর এগিয়েই দেখতে পেলাম পাহাড়ের উপরে একটি বৌদ্ধমূর্তি। আমাদের বোটম্যান মিল্টন পাহাড়ের পাদদেশে নৌকা ভিড়ালো। মাসুদ ভাই আর মহিলারা বোটেই রয়ে গেলেন, বাচ্চাদের নিয়ে আমি নেমে পড়লাম। ওদের নিয়ে কিছুদূর উঠলাম। তবে মেয়েদের নিয়ে খাড়া পাহাড় বেয়ে বেশি উপরে ওঠা বিপদজনক হতে পারে ভেবে আর উঠলাম না। পাহাড়ের শুরুতে, লেক থেকে কিছুটা উচ্চতায় একটি ছোট বাজার রয়েছে। এখানেও আদিবাসিদের হাতে বোনা কাপড়চোপড় অন্য অন্যান্য জিনিসপত্র বিক্রি করা হয়। আমরা নেমে আসতেই দেখি মাসুদ ভাই ডাব নিয়ে বসে আছে। সবাই সেই ডাবের সুমিষ্ট পানি খেয়ে আবার চলতে শুরু করলাম। ঝুলন্ত ব্রিজের কাছাকাছি দূরত্বে রয়েছে পলওয়েল পার্কলেক সংলগ্ন একটি বিনোদন কেন্দ্র। বেশ কিছুক্ষণ পর আমরা সেখানে পৌঁছে গেলাম।

     আমাদের নৌকা পলওয়েল পার্কের পাশে এসে নোঙর করলো। পাড়ে নেমে প্রবেশ টিকিট সংগ্রহ করে ভেতরে প্রবেশ করলাম। ডিসি বাংলো রোডে গড়ে তোলা পলওয়েল পার্কটি রাঙামাটির পর্যটকদের জন্য বিনোদনের একটি নতুন সংযোজন। আগেরবার যখন রাঙামাটি এসেছিলাম, তখন এই পার্কটি ছিলো না। যাই হোক, এখানে রয়েছে শিশুদের জন্য একটি কিডস জোন, গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য তুলে ধরবার জন্য কিছু ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে। পায়ে চলা রাস্তার পাশে লেকের পাড় ঘেঁষে পর্যটকদের বসার জন্য রাখা আছে কিছু বিচ চেয়ার, এখানে বসে পর্যটকরা লেক আর পাহাড়ে সন্ধ্যা নামার দৃশ্য উপভোগ করতে পারে। দেখতে পারে লেকের টলটলে নীল জল; কাছে-দূরে সারি সারি সবুজ পাহাড় আর আকাশের নিবিড় মিতালী। এছাড়া পার্কটিতে রয়েছে পলওয়েল কটেজ ও সুইমিং পুল। আরও রয়েছে পুনাক কর্তৃক পরিচালিত একটি প্রদর্শনী ও বিক্রয় কেন্দ্র; যেখানে স্যুভেনির, আদিবাসীদের হাতে বোনা কাপড়চোপড় পাওয়া যায়। মেয়েরা কিডস জোনে খেলায় মেতে উঠলো। আমরা সামনে এগিয়ে গেলাম। পার্কটির একেবারে শেষ প্রান্তে তৈরি করা হয়েছে একটি ‘লাভ পয়েন্ট’। এই ভালোবাসার স্মারকটি তৈরির পেছনে একটি মর্মান্তিক গল্প আছে। ২০১৪ সালের ২৯শে মার্চ কাপ্তাই লেকে বোট উল্টে মৃত্যু হয় আমেরিকা প্রবাসী দম্পত্তি আলাউদ্দিন ও তার স্ত্রী আইরিন লিমা’র। তিনদিন পর কাপ্তাই লেক থেকে তাদের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয় তবে বাংলাদেশ নৌবাহিনী, পুলিশ, সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের সম্মিলিত অভিযানে উদ্ধারকৃত এই দম্পত্তির মৃতদেহ দুটিকে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরা অবস্থায় লেকে পাওয়া যায়। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত একে অপরকে জড়িয়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা একটি বিরল ঘটনা। তাদের এই ভালোবাসাসহ পৃথিবীর সকল মানুষের ভালোবাসার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পার্বত্য চট্টগ্রাম উনয়ন বোর্ডের উদ্যোগে নির্মাণ করা এই ‘লাভ পয়েন্ট’। সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে আমরা পলওয়েল পার্ক থেকে নেমে আসলাম। আবার আমাদের বোট ছুটে চলেছে নীল লেকের জল কেটে। তার কিছুক্ষণ পরই পশ্চিম আকাশ লাল করে সূর্য তার বিদায় বার্তা জানান দিলো। পশ্চিম দিগন্তে পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে গোধূলির লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে লেকের জলে। সে এক অসাধারণ মুহূর্ত। দিনের এই বিশেষ সময়টার প্রতি আমার কিছুটা দুর্বলতা আছে। আর নৌকায় বসে এমন দৃশ্য দেখা সত্যিই এক দারুণ অভিজ্ঞতা। ধীরে ধীরে সূর্য ডুবে গিয়ে চারিদকে আঁধার নেমে আসলো, আর আমরাও পৌঁছে গেলাম ঝুলন্ত ব্রিজের কাছে। এখানেই আমাদের লেক ভ্রমণের সমাপ্তি ঘটলো। 

                                                       পলওয়েল পার্কে ‘লাভ পয়েন্ট’

     রাতে মোটামোটি বিশ্রাম নিয়েই সময়টা কাটালাম। মহিলারা হোটেলের পাশের বিক্রয়কেন্দ্রে কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করলো। তারপর রাতের খাবার খেয়ে যার যার রুমে চলে গেলাম। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলাম। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলো পাখির ডাকে। ফ্রেস হয়ে নিচে নেমে আসলাম। রিসেপশনের ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম আর কোথায় যাওয়া যায়। ও জানালো ক্যান্টমমেন্টের কাছে আছে আরণ্যক রিসোর্ট, ওখানে যেতে পারেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম ওখানে কি কি আছে? ও জানালো- ওটা একটা পার্কের মত। সুইমিং পুল, বোটে ভ্রমণ, বাচ্চাদের জন্য কিছু রাইড আছে। আর কোথাও যাওয়ার আছে? রাজবন বিহারে যেতে পারেন, ছেলেটা বললো। ওখানে তো আমাদের ভেতরে প্রবেশ নিষেধ, তো ওখানে গিয়ে লাভ কি? ছেলেটা হেসে সায় জানালো। রুমে ফিরে সবাইকে জানালাম। মেয়েরা আরণ্যক রিসোর্টে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখালো না। তো কোথাও গিয়ে কাজ নেই। কিছু কেনেকাটা থাকলে টেক্সটাইল মার্কেটে চলো। সবাই তৈরি হয়ে নাস্তা সেরে মার্কেটের দিকে চললাম। আবার সেই স্থানীয় আদিবাসিদের তৈরি কাপড়চোপড় কেনা হলো, তবে এখানে দাম অন্য জায়গা থেকে কম।

     দুপুরের খাবার পর কিছু সময় রেষ্ট নিয়ে নিলাম। আমাদের গাড়ি ছাড়বে রাত সাড়ে আটটায়। হাতে অনেক সময়। ঝুলন্ত ব্রিজের ওপারে আদিবাসিদের একটা গাঁ আছে। গতকাল বোটে চড়ার সময় দেখেছিলাম, যাওয়া হয়নি। এখন সেখানে ঘুরতে বেরিয়ে পড়লাম। আবার সেই পাহাড় বেয়ে নামা এবং ব্রিজের ওপারে গিয়ে উপরে ওঠা। আমাদের নামতে উঠতে কিছুটা সময় লাগলেও মেয়েরা খুব দ্রুত উঠে যাচ্ছিলো। পাহাড়ের উপরে উঠেই দেখলাম একটা বাজারের মত। আদিবাসী নারীপুরুষ তাদের নিজস্ব বাগানো ফলানো নানান ধরণের ফলমূলের পসরা সাজিয়ে বসেছে। আনারস, পেঁপে, কলা, বড়ই, তেঁতুল, ডাব ও বিভিন্ন ধরণের সবজী। কেউ কেউ বাহারি স্যুভেনির ও হস্তশিল্পদ্রব্য নিয়ে বসেছিলো। এদের মধ্যে অবশ্য পাহাড়ি আদিবাসিদের সাথে বিভিন্ন বয়সী বাঙালিদেরও দেখা যাচ্ছিলো। আরও কিছুদূর এগিয়ে আবার কিছু কাপড়চোপড়ের দোকান। তার পাশ দিয়ে গ্রামে ঢোকার রাস্তা চলে গেছে। আমরা গ্রামের কিছু অংশ ঘুরে দেখলাম। খুব সাধারণ জীবনযাপন। তবে এখানে বাঙালি-আদিবাসী উভয়ের বসবাসই চোখে পড়লো। আমরা আরও কিছু সময় কাটিয়ে ফিরে আসলাম হোটেলে।

     টুকটাক গোছগাছ যা বাকি ছিল সম্পন্ন করে রাখলাম। রিসেপশনে গাড়ির জন্য বলে রেখেছিলাম। সাড়ে সাতটার দিকে আমাদের গাড়ি এসে হাজির। আমরা হোটেল থেকে বিদায় নিলামরাঙামাটি শহরে কোন রিক্সা নেই, তাই ট্রাফিক জ্যামও নেই। অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা বাসস্ট্যাণ্ডে পৌঁছে গেলাম। যাত্রার আগে কেউ কিছু খেতে চাইছিলো না, তাই রাতের জন্য কিছু শুকনো খাবার নিয়ে নিলাম। নির্ধারিত সময়ে আমাদের গাড়ি ছেড়ে দিলো। আমরা ফিরে চললাম আমদের নীড়ে।

চীনা লেখক লিন ইউভাং বলেছেন- ভ্রমণ শেষে নিজ বাড়িতে ফেরার আগ পর্যন্ত কেউ বুঝতে পারে না ভ্রমণ কত সুন্দর ছিলো। তবে আমি ভ্রমণের সময়কালীন প্রতিটা মুহূর্তই উপভোগ করেছি। সবুজ পাহাড়, সফেদ-শুভ্র মেঘ, নীল জলের কাপ্তাই লেক, আদিবাসিদের বৈচিত্র্যময় জীবনযাপন- সবকিছুই। আর আমাদের মেয়েরাও দারুণভাবে উপভোগ সেই খাগড়াছড়ি হয়ে সাজেক গমণ থেকে শুরু করে কাপ্তাই লেকে ভ্রমণ- পুরো সময়। আমার কাছে এটাই এই ভ্রমণের সার্থকতা।


শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

ভ্রমণকথাঃ হাওরে বৃষ্টি-জলের গান


বিস্তীর্ণ নীল জলরাশির বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে আমাদের ছোট প্রমোদ তরী চান্নি-পসর রাত। মাথার উপর পূর্ণ চাঁদের জোছনা। হাজার নক্ষত্রের মেলা বসেছে সেখানে। তার ছায়া পড়েছে জলের বুকে। আমরা ক’জন বন্ধু নৌকার ছাদে বসে সেই জ্যোৎস্না রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করছি। বাউল শিল্পীরা সুরের মূর্ছনা তুলেছে......... 
বেশ ক’দিন ধরে এমনটাই ভাবছিলাম সবকিছু ঠিকঠাকই ছিলো- সময়, হাওরের জলরাশি, শিল্পীর গানের মূর্ছনা- সবকিছু; কেবল বাদ সাধলো বৃষ্টি। জ্যোৎস্না আর দেখা হয়নি, কারণ মেঘের আড়ালে ঢাকা ছিলো চাঁদ। তবুও আমাদের যাত্রা থেমে থাকেনি। যতটুকুই পেয়েছি, উপভোগ করেছি পুরোমাত্রায়।  



ডাক্তার কিছু সীমাবদ্ধতা বেঁধে দেয়ার পর থেকে একটা বিষয় মনের ভেতরে গেঁথে গেছে। যে করেই হোক মনটাকে হালকা করতে হবে। এই ইট-কংক্রীটের শহর ছেড়ে দূরে কোথাও ঘুরে আসতে হবেকিন্তু কিছুতেই সময় সুযোগ মিলছিলো না। মেয়ের স্কুল খোলা; আজ এই পরীক্ষা- তো কাল সেই পরীক্ষা, গিন্নী ভীষণ ব্যস্ত। তাই বেড়াতে যাওয়ার কোনরকম চান্স পাচ্ছিলাম না। একা একা তো আর ঘুরতে যাওয়া যায় না! নিদেনপক্ষে একজন কিংবা দু’জন সঙ্গী দরকার; সবচেয়ে ভাল হয় একটা দল সাথে পেলেঅনেকদিন পর হঠাৎ সেই আকাঙ্ক্ষিত সুযোগটা মিলে গেলো। হাওরে ভ্রমণের সুযোগ।
আমাদের বন্ধু আলমগীর সুনামগঞ্জে পোষ্টিং হওয়ার পর বেশ সুখেই দিন কাটাচ্ছে বলে মনে হচ্ছিলো। একের পর এক ঘুরে বেড়ানোর ছবি আপলোড করে সবাইকে লোভ দেখাচ্ছিলো। একদিন টাঙ্গুয়ার হাওরে ভ্রমণের ছবি দেখে আমারও খুব লোভ হলো। সুনামগঞ্জের বৈচিত্রময় টাঙ্গুয়ার হাওরের কথা অনেক শুনেছি; সীমান্তের কাছে যাদুকাটা নদী, স্বচ্ছ নীল জলের নীলাদ্রি লেক আর মেঘালয়ের পাহাড়শ্রেণী। কার না দেখতে মন চায়! আমারও যাওয়ার ইচ্ছা ছিলো খুব, কিন্তু যাওয়া আর হয়নি। ধীরে ধীরে সেই লোভটা প্রবল ইচ্ছায় পরিণত হলো যখন দেখলাম আমাদের ব্যাচের আরও কিছু বন্ধু হাওরে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করছে। ব্যাস! শুরু হলো আলোচনা। দিনক্ষণ ঠিক করার জন্য সবার মতামত নেয়া। টার্গেট করা হলো পূর্ণিমা রাতকে কেন্দ্র করে। আসছে পূর্ণিমায় ঈদ। অর্থাৎ এই পূর্ণিমায় যাওয়া হচ্ছে না। সবাই কুরবানি নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, কেউ কেউ গ্রামে যাবে ঈদ উৎযাপন করতে। আগামী পূর্ণিমা আবার একমাস পরে। অগত্যা ঠিক হলো একমাস পরেই যাবো
গ্রুপে সদস্য সংখ্যা শতাধিক, সবাইকে আহবান করা হলো। অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করলো তবে শেষ পর্যন্ত সময়-সুযোগের অভাবে কেউ কেউ আমাদের হাওর যাত্রার সঙ্গী হতে পারলো না সবমিলে হাওর ট্যুরের সদস্য সংখ্যা দাঁড়ালো ২৩ জন। দল হিসেবে একেবারে ছোট নয়। শুরু হলো ট্যুর প্ল্যান। অর্থাৎ কিভাবে যাওয়া। প্রফেসর মিজান গোঁ ধরে বসলো- ট্রেনেই যেতে হবে, এসি এবং বার্থ ছাড়া চলবে না। আমাদের বন্ধু ট্যুর কো-অর্ডিনেটর সাত্তার যথাসাধ্য চেষ্টা করছিলো ট্রেনে বার্থ ম্যানেজের জন্য, তবে শেষ পর্যন্ত বার্থ কিংবা এসি সীট পাওয়া সম্ভব হলো না। সবশেষে পর্যটনের এসি মিনিবাসের ব্যবস্থা করা হলো। ৩০ সীটের নতুন বাস, সীটগুলোও বেশ আরামদায়ক। আমাদের ২৩ জনের দলের জন্য চমৎকার ব্যবস্থাপনা। হাওর ভ্রমণ উপলক্ষ্যে আমাদের ৯১ ব্যাচের লোগোসহ টি-শার্ট এবং ক্যাপ তৈরি করা হয়েছে। হোস্ট আলমগীর আরও জানালো তাহিরপুরে নৌকার ব্যবস্থাও করা হয়েছে এবং টাঙ্গুয়ার হাওরে যতগুলো নৌকা চলে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় নৌকাটাই ভাড়া করা হয়েছে। সুনামগঞ্জে রেস্ট নেয়ার ব্যবস্থাপনাও সম্পন্ন। এখন আমরা বেরিয়ে পড়লেই হয়।  
নির্ধারিত দিনে যথারীতি আমরা সবাই উপস্থিত হলাম মহাখালিস্থ পর্যটন কর্পোরেশনের কার্যালয়ের সামনে। রাত এগারোটায় আমাদের যাত্রা শুরু হল সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যে। এরই মধ্যে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হল। মনে আশঙ্কা জাগলো- হাওরে পৌঁছানোর পর বৃষ্টি থাকবে না তো! তাহলে আমাদের জ্যোৎস্না বিলাশের কী হবে! যাই হোক, আমরা ছুটে চললাম সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যে। বাসের মধ্যে গল্পে-আড্ডায় সময়টা চমৎকার কাটছিলো। পথিমধ্যে যাত্রা বিরতি হলো আশুগঞ্জে হালকা খাওয়া-দাওয়া হল উজানভাটি রেস্টুরেন্টে। গুড়িগুড়ি বৃষ্টির মধ্যেই আবার শুরু হল আমাদের যাত্রা সিলেট অভিমুখে।
বৃষ্টি থাকায় আমাদের গাড়ি ধীর গতিতে চলছিলো। সকালে আমরা যখন সুনামগঞ্জে পৌঁছালাম সূর্য ততক্ষণে তার স্ব-রূপ দেখানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। হোস্ট আলমগীর আমাদের অভ্যর্থনার যথার্থ ব্যবস্থাই করেছিলো। লম্বা জার্নির পর সুনামগঞ্জে হাওর উন্নয়ন বোর্ড গেস্ট হাউজে আমাদের বিশ্রাম এবং সকালের নাস্তার আয়োজন- সুচারুভাবেই সম্পন্ন করে রেখেছে। সবাই ফ্রেস হয়ে নাস্তা সেরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নিলাম। অনেকে গেস্ট হাউজেই গোসল সেরে নিলো। তবে নদীর কাছাকাছি এসে বাথরুমে গোসলের পক্ষপাতি আমি নই। গেস্ট হাউজ থেকে একটু এগোলেই সুরমা নদী। আমি আলমগীরের সাথে নদীতে চলে গেলাম। নদীর ঠাণ্ডা পানি গায়ে লাগতেই সারা রাতের ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো। আমার কাছে নদীতে গোসলের মজাটাই আলাদা। বাড়িতে গেলে কখনও বাসায় কিংবা পুকুরে গোসল করি না। কারণ খুব কাছে কীর্তনখোলা নদী। ছেলেবেলা থেকেই এই কীর্তনখোলা আমার মনে অনেকটা জায়গা করে নিয়েছে। এই নদীর পাড়ে হেসেখেলে আমার শৈশব কাটিয়েছি, আজ অনেকদিন পর তার কিছুটা স্বাদ পেলাম
আমাদের আজ রাতের খাবার নৌকায় রান্না হবে। খাসী বারবিকিউ, ফিশ ফ্রাই, হাওরের তাজা গলদা চিংড়ি, আইড় মাছ ইত্যাদি। রান্নাবান্নার যাবতীয় সামগ্রী গোছগাছ করে আলমগীর আর সাত্তার বেলা একটার দিকে আমাদের নিয়ে রওনা দিলো তাহিরপুরের উদ্দেশ্যে। হাওর-বাওরের জন্য বিখ্যাত সুনামগঞ্জের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে চললাম তাহিরপুরের দিকে। চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। রাস্তার দু-দিকেই জলাভুমি। শুধু জলের রাজত্ব। ইতোমধ্যে বৃষ্টি থেমে গেছে পুরোপুরি, রোদ উঠেছে। আমরা সবাই আশান্বিত হয়ে উঠলাম এই ভেবে যে আজ হয়তো আর বৃষ্টি হবে না। আমাদের হাওর যাত্রা সফল হবে।   
বিশ্বম্ভরপুর পার হয়ে আরো কিছুটা পথ চলার পরই শুরু হলো বিপত্তি। সামনের রাস্তা পানিতে ডুবে আছে গতকাল রাতে বৃষ্টিতে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢলের কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আমরা সবাই গাড়ি থেকে নামলাম। অনেক গাড়ি এখানে এসে আটকে পড়েছে। ড্রাইভারকে বলেও কাজ হলো না। অফিসে কথা বলে সে জানালো গাড়ির এসি নষ্ট হবার সম্ভাবনা আছে, তাই আর যাওয়া যাবে নাআমরা চেক করে দেখলাম প্রায় দেড়শ গজের মত রাস্তা পানিতে ডুবে আছে লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জানলাম ওখান থেকে তাহিরপুর ছয়-সাত কিলোমিটার পথ। ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা, টেম্পু, মাইক্রোবাস- অনেককে অনুরোধ করা হলো কিন্তু কেউ পানি ভেঙে যেতে রাজি হলো না। ধীরে ধীরে বেলা গড়াচ্ছিলো। অলরেডি আড়াইটা বাজে, এখনও আমাদের দুপুরের খাবার খাওয়া হয়নি। তাহিরপুরে লাঞ্চ সেরে নৌকায় উঠতে হবে, তাই দেরি করার উপায় নেই। বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজতে আরও প্রায় আধাঘণ্টা সময় চলে গেলো। অগত্যা সবাই পানিতে নেমে পড়লাম। পানিতে নেমেই বুঝলাম কেন কেউ যেতে রাজি হচ্ছে না। পানিতে বেশ স্রোত, কখনও কখনও নিজেকে সামলানোই মুশকিল রাস্তায় বিছানো সূচালো পাথরের টুকরার উপর দিয়ে হাঁটতে বেশ সমস্যা হচ্ছিলো সবার। কোথাও কোথাও পানির উচ্চতা হাঁটুর উপরে। অনেক কসরত করে পানির চাপ আর পাথরের আঘাত সহ্য করে আমরা পার হলাম। ওপারে উপস্থিত ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সায় করে যে যার মত ছুটে চললাম তাহিরপুরের দিকে।

পায়ে হেঁটে ভাঙা রাস্তা পারাপার

বৃষ্টিভেজা ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে অটো বেশ স্লথ গতিতেই চলছিলো। প্রায় বিশ মিনিট চলার পর আনোয়ারপুরে এসে থেমে গেলো অটো। আবার রাস্তা ভাঙা এবং যথারীতি পানিতে ডুবে আছেঅগত্যা কি আর করা! আবার সেই পানি ভেঙে সামনে এগিয়ে চলাতবে এবারের যাত্রাটি আরও কষ্টকর। পানির নিচে এবড়োথেবড়ো ব্লকের উপর দিয়ে হাঁটতে গিয়ে বেশ বিপাকে পড়তে হচ্ছে। একটু অসাবধান হলেই বিপদ। যাই হোক শেষ অবধি পানিপথের যুদ্ধ শেষ করে আমরা সবাই ওপারে পৌঁছলাম। তবে আলমগীর আর সাত্তারের জন্য যুদ্ধটা আরও কঠিন হয়ে দাঁড়ালো, কারণ- নৌকায় রাতের খাবার রান্নার যাবতীয় সামগ্রী তাহিরপুরে বয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্ব ওরাই কাঁধে তুলে নিয়েছিলো। আবার অটো ধরে তাহিরপুরে পৌঁছুতে আমাদের বেলা চারটা বেজে গেলো।
হোস্ট আলমগীর তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ ডাকবাংলোয় আমাদের বিশ্রামের ব্যবস্থা করে রেখেছিলো। বিআরডিবি উপজেলা দপ্তর তাহিরপুরের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। আমরা সবাই ওখানে ফ্রেস হয়ে দুপুরের খাবার খেলাম। এর মধ্যেই আবার শুরু হলো বৃষ্টি। আকাশের অবস্থাও ভাল নয়। নাহ! এই বৃষ্টির বাড়াবাড়ি আর ভাল লাগছে নাএত কষ্ট করে আসলাম, এখন বসে থাকতে ভাল লাগে! বন্ধু বাকী অবশ্য প্রশ্ন তুলেছিলো- এই বিরূপ আবহাওয়ায় নৌকা নিয়ে হাওরে যাওয়া উচিৎ হবে কি-না; তবে আমরা অনেকেই হাওরে যাওয়ার ব্যাপারে অনড় ছিলাম এতদূর এসে হাওরে নামবো না, তাই কী হয়! আরও বেশ কিছু সময় পর বৃষ্টি কমে এলো। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম- আর দেরি নয়, এখনই বেরিয়ে পড়তে হবে। বৃষ্টিস্নাত স্নিগ্ধ বিকেল শেষ বিকেল। কিছুক্ষণ আগে যে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে, প্রকৃতিতে তার রেশ রয়ে গেছে এখনও। এমন ভেজা আবহাওয়ায় অভিমানী সূর্য কী আর দেখা দেয়! অগত্যা আমরা ধীরে ধীরে ঘাটের দিকে এগিয়ে চললাম।  
থানাঘাটায় প্রস্তুত আমাদের হাওর যাত্রার বাহন- নৌকা

আমরা সবাই দাঁড়িয়ে আছি তাহিরপুরের থানাঘাটায় সামনে দিগন্তবিস্তৃত জলরাশি। পাশেই ভিড়ানো আগে থেকে ভাড়া করে রাখা আমাদের হাওর-যাত্রার বাহন- নৌকা। কারুকাজ করা সুন্দর একটি নৌকা। এতক্ষণে সবার মুখে ফুটলো তৃপ্তির হাসি। এত ঝঞ্ঝাল পেড়িয়ে শেষ অবধি আমরা সেই আকাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছালামসবাই যার যার ব্যাগেজ নিয়ে নৌকায় উঠে বসলাম। রাতে নৌকায় রান্নার যাবতীয় সরঞ্জামও তুলে নেওয়া হল। বৈরী আবহাওয়াতেই আমাদের যাত্রা শুরু হল। তাহিরপুরের থানাঘাটা থেকে আমাদের নৌকা ছাড়লো, গন্তব্য- টেকেরঘাট; ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়ের ঠিক পাদদেশে। হাওর ভ্রমণে আসা বেশির ভাগ মানুষ এখানেই রাত কাটায়। আজকের রাতটা আমরা ওখানেই কাটিয়ে দেবো। পরদিন সকালে সবাই মিলে বেরিয়ে পড়বো। বাংলার কাশ্মীরখ্যাত নীলাদ্রি লেক, যাদুকাটা নদী, বারিক্কা টিলা, শিমুল বাগান ঘুরে আবার মূল হাওরে ঢুকে পড়বো। ওয়াচ টাওয়ারের চারিদিকে ডুবন্ত হিজল-করচের বনের কাছে নেমে গোসল করবো, তারপর আবার ফিরে আসবো তাহিরপুরে। আগামীকাল বিকেলের মধ্যেই সেখান থেকে রওনা দেবো ঢাকার উদ্দেশ্যে। আর সৌভাগ্যক্রমে যদি রাতে চাঁদ দেখা দেয় তবে আমাদের ভ্রমণ সম্পুর্ণরূপে সার্থক হয়!

তাহিরপুরের থানাঘাটায় নৌকায় ওঠার পূর্বমুহূর্তে আমরা কয়েকজন

কেউ কেউ সেলফি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কিছু গ্রুপ ছবিও তোলা হলো। আমি তাকিয়ে ছিলাম সামনের দিকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে বার বার দেখছিলাম, মনে ক্ষীণ আশা যদি মেঘ সরে গিয়ে আকাশ পরিষ্কার হয়আমি বরাবরই একটু স্মৃতিকাতর মানুষ। সামনের থৈথৈ জলরাশি নিমেষেই আমাকে শৈশবে ফিরিয়ে নিয়ে গেলো। আজকের এই হাওরভ্রমণ ছেলেবেলায় ভরা নদীতে নৌকায় ঘুরে বেড়ানোর স্মৃতিকে নতুন করে জাগিয়ে তুললো আবার।
নীল জলরাশির বুক চিরে ছুটে চলেছে আমাদের ইঞ্জিনচালিত নৌকা উপরে খোলা আকাশ আর দূরে আকাশ যেখানে দিগন্তে মিশেছে তার পায়ের কাছে মেঘালয়ের পাহাড়গুলি যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। দিনের শেষ আলোটুকু মিলিয়ে গেলে চারিদিকে ধীরে ধীরে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছিলো। আকাশ মেঘলা তাই জ্যোৎস্না দেখার আশা ছেড়েই দিয়েছি আমরাআমাদের সবারই প্রত্যাশা ছিলো বিকেলে নৌকাযাত্রা শুরু করে হাওরে বসেই সূর্যাস্ত দেখবো, তারপর রাতে ধবল জ্যোৎস্নায় স্নান করতে করতে হারিয়ে যাবো অন্য জগতে। কিন্তু বৃষ্টির কারণে তার কিছুই হলো না। আমি বুঝে গেলাম এই অন্ধকারে হাওর দর্শনের আশা বৃথা। যা দেখার আগামীকালই দেখতে হবে।
আলমগীর নৌকার ছাদে এসে বললো- সবাই এত চুপচাপ কেন? এখন বাউল গান হবে, আমরা নাচবো। হ্যা, তাহিরপুর থেকে বাউল শিল্পীদের একটা দল আমাদের সাথে নৌকায় যোগ দিয়েছে। বাউল হীরা মোহন ও তার দল। শিল্পীরা তাদের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে নৌকার ছাদের মাঝখানে আসন গেড়ে বসলো। দলে সদস্য সংখ্যা তিনজন। বাউল হীরা মোহন নিজে হারমোনিয়াম, অল্পবয়সী একটি ছেলে ঢোল এবং লাল রঙের ফতুয়া পরনে পাগড়ি মাথায় কাঁচাপাকা শ্মশ্রুমণ্ডিত একজন খঞ্জরি নিয়ে প্রস্তুত। সিলেট অঞ্চলের মরমী শিল্পী শাহ আব্দুল করিমের একটি বিখ্যাত গান দিয়ে শুরু হলো তাদের পরিবেশনা-
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
আমরা আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম...
সবাই যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেল। আলমগীর সত্যি সত্যিই নাচতে আরাম্ভ করলো, সাথে আরও কয়েকজন যোগ দিলো। আসর বেশ জমে উঠলো। এর মধ্যেই সাত্তার মুড়ি মাখিয়ে নিয়ে হাজির। রসিক সাত্তার অবশ্য কোমল পানি, কঠিন পানির ব্যবস্থাও রেখেছিলো। যার যেমন প্রয়োজন- তুলে নিলো। খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা-গানে বেশ জমে উঠলো আসর। এই সুনামগঞ্জে অনেক মরমী বাউল সাধকের জন্ম। তাদের গানে হাওরের জীবনের দুঃখগাঁথাই বেশি ফুটে ওঠে একে একে আরও অনেকগুলো গান হয়ে গেলো। শাহ আব্দুল করিম, হাছন রাজা ও সিলেট অঞ্চলের আরও কিছু জনপ্রিয় গান।

গানে-আড্ডায় আমাদের সময়টা আনন্দেই কাটছিলো। নৌকা ছুটে চলেছে তার নির্দিষ্ট গন্তব্যে। হঠাৎ মাঝিদের তৎপরতা দেখে আমরা কেউ কেউ সচকিত হয়ে উঠলাম। ব্যাপার কি? মাঝিরা নানা কসরত চালিয়েও নৌকা সামনে নিতে পারছে না। কিছুক্ষণের মধ্যে কারণ জানা গেলো। পাহাড়ি ঢলের জন্য স্রোত খুব বেড়ে গেছে। নৌকা সেই স্রোত ঠেলে সামনের খাঁড়ি পার হতে পারছে না। বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছে কিন্তু যতবারই স্রোত ঠেলে ওপারে যেতে চাইছে নৌকা ঘুরে আবার আগের জায়গায় চলে আসছে। আমাদের বাউলদের দলটিকে দেখা গেলো সবাই সারিবদ্ধ হয়ে হাত উপরের দিকে তুলে কারো উদ্দেশ্যে কিছু বলছে- সেটা সৃষ্টিকর্তা না অন্য কারো উদ্দেশ্যে ঠিক বোঝা গেলো না। প্রায় বিশ মিনিট কসরত করার পর মাঝিরা সফল হলো। নৌকা খাঁড়ি পার হয়ে এলো। আমরাও অনেকটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। রাত প্রায় ন’টার দিকে আমরা টেকেরঘাট পৌঁছালাম।
অসংখ্য নৌকা ভিড়ে আছে ঘাটে সবাই আমাদের মত ভ্রমণ পিপাসু দল। আমরা কয়েকজন পাড়ে নামলাম। একটু সামনেই ভারতের মেঘালয়, অন্ধকারে প্রহরীর মত উঁচু পাহাড়শ্রেণী দাঁড়িয়েতার উপরের রাস্তায় সারিবদ্ধভাবে হলুদ রঙের আলো জ্বলছে। পাহাড়ের কোল ঘেঁষেই বাংলাদেশী সীমান্ত সড়ক। তবে নৌকা থেকে বেশি দূরে যাওয়া হল না আমাদের, কারণ- চারিদিকে বেশ অন্ধকার। নিরাপত্তার কথা ভেবে আমরা নৌকার কাছাকাছি কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে ফিরে এলাম। নৌকার ছাদে রান্নাবান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সাত্তার, আলমগীর ও তার লোকজন। ফিশ ফ্রাই, খাসী বার-বি-কিউ এর সুঘ্রাণ আসছেএকপাশে অবশ্য বাউল শিল্পীরা গানে মত্ত। কেউ কেউ নিচে কেবিনে কার্ড নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আশেপাশে নৌকা থেকেও হৈ-হল্লার শব্দ ভেসে আসছিলো। কেউ কেউ ফানুস উড়াচ্ছিলো।
টেকেরঘাটে নোঙর করা অবস্থায় নৌকার ছাদে বাউল শিল্পীদের সঙ্গীত পরিবেশনা

      ‘রঙের বাড়ই রঙের বাড়ইরে বেষম উন্দুরায় নাগাল পাইলো’ গানের সাথে আলমগীর আর মাঝহারের যুগলনৃত্য দর্শন করতে করতে আর ভাজা মাছ খেতে খেতে সময়টা বেশ আনন্দেই কাটছিলো আমাদের এর মধ্যেই সাত্তার জানালো খাসী বার-বি-কিউ প্রস্তুতআবার শুরু হলো খাসী ভক্ষণ। নিচে অবশ্য মাঝির রন্ধনশালায় চলছে পোলাও, হাওরের গলদা চিংড়ি, আইড় মাছ আর গরুর মাংস রান্না। গান-আড্ডা-খাওয়া দাওয়ায় সময় দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছিলোআমাদের রাতের খাবার শেষ হবার কিছুক্ষণ পরই আবার বৃষ্টি নামলো। আমরা সবাই নিচে কেবিনে চলে গেলাম। নিরাপত্তার কথা ভেবে ঘাট থেকে কিছুটা দূরত্বে হাওরের পানিতে নৌকাটা নোঙর করালাম। বেশির ভাগ নৌকা দেখলাম সেভাবেই নোঙর করা।
নৌকার ভেতরে একটা ভ্যাঁপসা গরম ভাববদ্ধ কেবিনে এতগুলো মানুষ, গরম তো লাগবেই। যে যেভাবে পেরেছে শুয়ে পড়েছে। অনেকেই ঘুমিয়ে গেছে। কেউ আধশোয়া হয়ে, কেউ কুণ্ডুলি পাকিয়ে, আবার কেউ বা বসে বসেই। সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে হাসি পেলো। আরাম আয়েশের ঘর-বিছানা ছেড়ে এই অবস্থায়! কারো কারো তো আবার এসি ছাড়া ঘুমই আসে না, অথচ এখন এই গরমে ঠিকই ঘুমিয়ে পড়েছে! আমার ঘুমটা কেটে গেছে। মনে হয় ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়েছিলাম। রাত প্রায় দুইটা বাজে। রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। ছাদে এসে দাঁড়াতেই ঝিরিঝিরি বাতাসে প্রাণটা জুড়িয়ে গেলো ঠিক এই মুহূর্তে হুমায়ূন আহমেদের লিলুয়া বাতাসের কথা মনে পড়ে গেলো।  লোকটা বড় জ্যোৎস্না পাগল ছিলো। চারিদিকে নিস্তব্ধ নিঝুম, কোথাও মানুষের পদচারণা, শোরগোল-হৈচৈ নেই। চারিদিকে একটা স্নিগ্ধ, শান্ত ভাব।
এবার তোমার মন ভেজাবার পালা,
মেঘলা রাতে খুব নিশীথে, জলের বুকে জলকপোতে-
এবার তোমার হারিয়ে যাবার পালা

আমি সত্যি সত্যিই হারালাম। নক্ষত্রবিহীন এই রাতে নিবিড় নিস্তব্ধতার মাঝে নৌকার ছাদে আমি একা। চারিদিকে অসংখ্য নৌকা ভেড়ানো, দূরে- কাছে; তবে মানুষজনের সাড়া নেই। একদিকে আবছায়া অন্ধকারে মেঘালয়ের পাহাড়শ্রেণী প্রাচীরের মত দাঁড়িয়ে। অন্যদিকে বিস্তীর্ণ জলরাশি। যতদূর চোখ যায়- শান্ত, টলটলে জলঅবশ্য বিশাল এই জলাশয়ের মাঝেই গাছপালা ঘেরা ছোট ছোট দীপের মত ছায়াছায়া কিছু স্থলভূমি চোখে পড়ছে, তবে সেখানে মানুষের বসবাস আছে কি-না বোঝা গেলো না। হঠাৎ হঠাতই মেঘ সরে গিয়ে আকাশ কিছুটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে, তবে তা অতি সামান্য সময়ের জন্যই। তারপর আবার সেই মেঘেদের রাজত্ব। আবার গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হলোআমি সামিয়ানার নিচে চেয়ার পেতে বসলাম। এমন শান্ত নির্মল পরিবেশ হয়তো আর কখনও পাবো না। বৃষ্টি হঠাৎ বেড়ে গেলো। আর ছাদে থাকা যাবে না। অনিচ্ছা সত্বেও নিচে নেমে এলাম। ভেতরে বসার জায়গা তেমন নেই। সবাই এলোপাথাড়ি শুয়ে-বসে ঘুমাচ্ছে। বাধ্য হয়ে আমিও শুয়ে পড়লাম। তবে ঘুম আসছিলো না।   
এটা সেটা ভাবতে ভাবতেই কখন জানি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ফজরের আযানের ধ্বনি কানে যেতেই ঘুম ভেঙে গেলো। নৌকার বদ্ধ রুমের মধ্যে আর থাকতে ইচ্ছে করছিলো না। বাইরে বেরিয়ে খোলা ছাদে চলে এলাম। হালকা বৃষ্টির ছাঁট এসে চোখেমুখে লাগছে, গায়ে মাখলাম না। চারিদিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়লো মনে। ভোরের আলো ফোটেনি তখনো আকাশ মেঘলা থাকায় সবকিছু স্পষ্টভাবে দেখাও যাচ্ছিলো না। তারপরও হালকা আলোয় যতটুকু চোখে পড়লো আমার কাছে তা-ই ছিল যথেষ্ট। অন্ধকারে ছাওয়া রাতের টাকেরঘাট এই প্রত্যুষে আমার কাছে ভিন্নরূপে ধরা দিলো। স্নিগ্ধ ভোরের এই নৈস্বর্গিক রূপের সৌন্দর্য যতটা অনুভব করলাম, বর্ণনা করা আমার জন্য ততটা সহজতর নয়।



একজন দু’জন করে আরও কয়েকজন উঠে এলো ছাদে। মিজান, মাকসুদ, বদরুল, শাহীন। আকাশ ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে আসছে। যত আলো ফুটছে মেঘালয়ের পাহাড়শ্রেণী যেন নতুন করে জেগে উঠছে; অথৈ জলরাশির পাশে একটা সবুজ প্রাচীর, তার ভাঁজে ভাঁজে ভেসে বেড়াছে খণ্ড খণ্ড সাদা মেঘবেলা আরও কিছুটা বাড়লে অনেকেই উঠে পড়লো। সাত্তার আর আলমগীরের সাথে বসে আমাদের পরবর্তী করনীয় নিয়ে আলোচনা করলাম। এরপর আমরা যাদুকাটা নদীতে, নীলাদ্রি লেকে কীভাবে যাবো, নৌকা কোথায় থাকবে ইত্যাদি। তবে বৃষ্টি আমাদের ভাবনার বেশি সময় দিলো না, হুড়মুড় করে নামলো আবার। এবার মুষলধারে। কিছুক্ষণ দেখার পর ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিলো না, কারণ নীলাদ্রি লেক কিংবা যাদুকাটা নদীতে যেতে হলে আমাদের নৌকা থেকে নেমে অন্য ট্রান্সপোর্ট নিয়ে যেতে হবে। বৃষ্টির জন্য সেটা আর সম্ভব নয়। আজ বিকেলের আগেই আমাদের ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। অতএব সম্মিলিত সিদ্ধান্ত হলো যাদুকাটা নদী, বারিক্কা টিলা ও নীলাদ্রি লেক দেখা হচ্ছে না আমাদের। ঠিক হলো আমরা হাওরে বেড়াবো, ওয়াচ তাওয়ারের কাছে গিয়ে গোসল করবো, তারপর ফিরে যাবো।
          আমাদের নৌকা ছুটে চললো মূল হাওরের দিকে। গতকাল রাতে অন্ধকার থাকায় তেমন কিছু দেখতে পাইনি। আজ এই দিনের আলোয় হাওরের আসল রূপটা ধরা দিলো। এখন বর্ষার শেষ সময়, চারিদিকে থৈথৈ জল, খাল-বিল-নদী সব পানিতে একাকার। শীতে এই হাওরে পরিযায়ী পাখিদের মেলা বসে যায়। এই বর্ষায় পাখি তেমন চোখে পড়ছে না। সকাল থেকে একটা দুইটা পানকৌড়ি দেখা গেলো মাত্র। বৃষ্টি থেমে গেছে পুরোপুরি। আকাশে নীল সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে, তার ছায়া পড়েছে হাওরের জলে। আলমগীর এসে জানালো- সকালের নাস্তা রেডি। খিচুড়ি আর গরুর মাংস। নৌকার ছাদে সবাইকে পরিবেশন করা হলো।
খিচুড়ি স্বাদ নিতে নিতেই শেয়ার করা যাক টাঙ্গুয়ার হাওর নিয়ে কিছু তথ্যটাঙ্গুয়ার হাওরের বিশালত্ব এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য সম্পর্কে আগেই শুনেছিলাম, তবে আজ নিজ চোখে দেখার সৌভাগ্য হলো। এই হাওরটি সুনামগঞ্জ জেলার দু’টি উপজেলা- ধর্মপাশা ও তাহিরপুর জুড়ে অবস্থিত। এই দুই উপজেলার পঞ্চাশটিরও বেশি হাওরের সমন্বয়ে ন’হাজার হেক্টরেরও বেশি এলাকা জুড়ে টাঙ্গুয়ার হাওর জেলার সবচেয়ে বড় জলাভূমি। এর শেষপ্রান্তে ভারতের মেঘালয় পাহাড় পাহাড় থেকে ছোট বড় বেশ কিছু ঝর্ণা এসে মিশেছে এই হাওরে। শীত মৌসুমে পানি শুকিয়ে কমে গেলে এখানকার প্রায় ২৪টি বিলের পাড় জেগে ওঠে, যাকে  স্থানীয় ভাষায় ‘কান্দা’ বলেতখন শুধু কান্দা'র ভিতরের অংশেই আদি বিল থাকেতাইতো স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে এই হাওরটি ‘নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল’ নামেও পরিচিত বর্ষায় থৈ-থৈ পানিতে নিমগ্ন হাওরের জেগে থাকা উঁচু কান্দাগুলোতে আশ্রয় নেয় হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি— রোদ পোহায়তাই শীত মৌসুমে এই হাওরের রূপ সম্পুর্ণ বদলে যায়।  

এ রকম সারি সারি হিজল করচের বনের মধ্য দিয়ে নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি আমরা

নাস্তা শেষ। আমাদের নৌকা সামনে এগিয়ে চলছে। সবাই গল্প আর ছবি তোলায় মশগুল। হঠাৎ সামনে তাকাতেই চোখে পড়লো পানিতে মাথা উঁচু করে থাকা হিজল-করচের দৃষ্টি নন্দন সারি। সে এক অভাবনীয় দৃশ্য। সামনে ওয়াচ টাওয়ার। ধীরে ধীরে আমাদের নৌকা এগিয়ে গেলো সেদিকে। আমাদের নৌকা ভিড়লো ওয়াচ টাওয়ারের পাশে। জলের বুকে ভাসমান ছোট বড় বেশ কিছু ডিঙি আমাদের নৌকার দিকে ছুটে এলোসাত্তার জোরে হাঁক দিলো। আমরা ওয়াচ টাওয়ারে চলে এসেছি। কে কে গোসল করবা রেডি হও। সাত্তার, আলমগীর, মান্নান, আনোয়ার, সোহেল, বেলাল, আলম সবাই হাফ প্যান্ট পড়ে পানিতে নামার জন্য তৈরি। বৃষ্টি থাকায় কিছুটা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব, আমি জলে নামবো কি নামবো না ভাবতে ভাবতে শেষে নেমেই পড়লাম। এই সুযোগ হয়তো আর পাবো না। এখানে পানির উচ্চতা একেক জায়গায় একেক রকম। কোথাও বুক সমান পানি, কোথাও গলা সমান আবার কোথাও কোথাও ঠাঁই মেলে না। পানি বেশ ঠাণ্ডা তাই খুব বেশি সময় আমি জলে থাকলাম না। তবে সাত্তার, আলমগীর আর মান্নান আরও অনেকক্ষণ পানিতে দাপাদাপি করলো। আমার গোসল শেষ। সাত্তার আলমগীরের ফেরার অপেক্ষায় বসেছিলাম। ছোট ছোট শিশু কিশোররা ডিঙি নিয়ে আমাদের নৌকার আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এগারো-বারো বছরের একটি ছেলে হঠাৎ গান গেয়ে উঠলো। এখানকার আঞ্চলিক একসেন্টে নিজস্ব সুরে একেবারে মাটির গান। গানের কথা শুনে আমরা খুব মজা পাচ্ছিলাম, অবশ্য ভালও লাগছিলো। গানের কথাগুলো ছিল অনেকটা এরকম-
অন্তরে না রাখিলে, অন্তরে না রাখিলে
মনে মনে রাইকো,
আমি তো বালা না, বালা লইয়া থাইকো।

সাথে আরও কয়েকটি কিশোর এসে গলা মিলাচ্ছিলো। আমাদের মাকসুদ গানটি ভিডিও করে রাখলো। ছেলেটির গানের রেশ থাকতে থাকতেই আমাদের নৌকা ছেড়ে দিলো। আমি নৌকার ছাদে দাঁড়িয়ে চারিদিকে একবার চোখ বোলালাম। যেদিকে তাকাই সারি সারি হিজল-করচের বন, জলের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকটা রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্টের মত। এটা আসলেই অসাধারণ এক দৃশ্য। ছোট ছোট স্থানীয় শিশু-কিশোর ডিঙি নিয়ে সেই গাছগুলোর ফাঁকে ফাঁকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সোয়াম্প ফরেস্টের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে করতে আমরা ফিরে চললাম তাহিরপুরের দিকে।
নৌকা চলছে তো চলছেই। পথ যেন আর শেষ হচ্ছে না। তবে আমাদের কারো খারাপ লাগার কোন কারণ নেই। এই হাওরের একেক প্রান্তে একেক রূপ। কোথাও অবারিত জলের আধার আবার কোথাও বা আঁকাবাঁকা নদীপথ দিয়ে আমরা ছুটে চলছি।



বিস্তীর্ণ জলরাশির মাঝে মাঝে দ্বীপের মতো ছোট ছোট গ্রাম কিংবা প্রায় ডুবন্ত রাস্তায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো হাওরের প্রকৃতিতে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। এই বহুমাত্রিক সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে আমরা পৌঁছে গেলাম তাহিরপুরে। তবে তাহিরপুরে আমরা নৌকা থেকে নামলাম না। গতকালের পানি ভাঙার অভিজ্ঞতার কথা আমরা কেউ ভুলিনি। তাই আজ নৌকা নিয়ে আরও সামনের দিকে এগিয়ে চললাম। উদ্দেশ্য গতকাল যেখানে রাস্তায় পানি ভেঙেছি সেটা পার হয়ে নৌকা নিয়ে আমাদের গাড়ির কাছে চলে যাওয়া। আরও কিছুদূর যাওয়ার পর আমি মাঝিকে জিজ্ঞেস করলাম- এটাও কি টাঙ্গুয়ার হাওর? মাঝি বললো- না, এটা শনির হাওর। লক্ষ্য করলাম এই হাওরে পানি কিছুটা কমে এসেছে বলে মনে হচ্ছে। তবে এখানে পানির উচ্চতা কম হলেও টোটাল এরিয়া কিন্তু কম নয়। সামনে বহুদূর পর্যন্ত শুধু পানি আর পানি। মাঝে মধ্যে ছোট বড় হিজল গাছ পানিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। লোকজন ছোট ছোট ডিঙি নিয়ে মাছ ধরছে। বর্ষা শেষে আশেপাশের বেশির ভাগ অংশই শুকিয়ে যায়, তখন এখানে চাষাবাদ হয়। আরও প্রায় ঘণ্টাখানেক চলার পর নৌকা পৌঁছে গেলো আমাদের গন্তব্যে। সবাই নৌকা থেকে নেমে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো গাড়ির অপেক্ষায়।
আমাদের হাওর যাত্রার এখানেই ইতি ঘটছে। গত দুই দিনের এই ভ্রমণে পাওয়া না পাওয়ার হিসেব করা অর্থহীন। এই দুইদিন ২৩ জন বন্ধু একসাথে যে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিলাম সেটাই বা কম কীসে! আমরা জ্যোৎস্না রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারিনি, যাদুকাটা নদী কিংবা নীলাদ্রি লেকে যেতে পারিনি, তবে গতকাল সন্ধ্যা থেকে হাওরের যে বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্য উপভোগ করলাম, হাওর-নির্ভর মানুষের জীবনযাত্রার যে রূপ দেখলাম- সেটাও এক অনন্য অভিজ্ঞতা। আগামী দিনে সময় সুযোগ হলে আবার কখনও আসবো এখানে, তখন হয়তো দেখতে পারো ভিন্ন এক টাঙ্গুয়ার হাওর।
আমাদের গাড়ি চলে এসেছে। আমরা একে একে গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। আমাদের বহনকারী সেই নৌকাটি ফিরে যাচ্ছে তার চেনা গন্তব্যে। এখন আর বৃষ্টি নেই। রোদ উঠেছে, চারিদিক সোনালি আলোয় ঝলমল করছে।    


উপন্যাসঃ ফেরা (পর্বঃ ২১ - ২৫ - শেষ পর্ব)

এ ই উপন্যাসটিতে সম্মুখ সমরের কোন ঘটনা তুলে ধরা হয়নি।  ওয়ারফ্রন্টের কোনও দৃশ্য নেই। তবে এই লেখায় মূলত যে গল্পটি বলার চেষ্টা ক রা হয়েছে  তা মু...