হঠাৎ করেই যেন লুবনার আকাশটা কালো মেঘে ঢেকে গেল। এক ধরনের
অদ্ভুত শূন্যতা ভেতরে-বাহিরে বিষণ্ণ হাহাকার তুলে তার সবকিছু এলোমেলো করে দিল। কয়েকদিন
নিজের সাথে বোঝাপড়া হল খুব। তারপর একসময় মনে হল- ‘ভালই হল, এখন আর কোন আড়াল নেই’। মাঝরাতে
ঘুম ভেঙে জেগে ওঠা দুঃস্বপ্নময় মূহুর্তগুলো আর তাড়িয়ে বেড়াবে না তাকে। এ ক’টা দিন
কী নির্মম আর দুর্বিষহ ছিল! একদিকে বাবা-মা আর অন্যদিকে নিজের অস্তিত্ব, মাঝখানে
পড়ে হাসফাস করেছে শুধু। তারেক অবশ্য ভালই করেছে। তার এইটুকু বয়সের পুরো সময়টাই
একটা ভুলের মধ্যে কেটেছে। তারেক সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
এক ঝটকায় তাকে স্বর্গ থেকে ভুমিতে এনে ফেলেছে। এটাই ভাল
হয়েছে- আজ সে নিজেকে ফিরে পেয়েছে। এখন নিশ্চিন্ত মনে তার শেকড়ের কাছে যাবে।
তখন মাঝরাত। হাইওয়ের উপর দিয়ে
দ্রুতবেগে ছুটে চলেছে রাতের বাস। বাইরে পৌষালি হিম নেমেছে। সেখানে
ধোঁয়াটে অন্ধকার গ্রাস করেছে সবকিছু। অন্ধকারের সাথে পাল্লা দিয়ে শীতল হাওয়া
নাচে, তারপর শো-শো বেগে ধেয়ে এসে জানালার কাঁচে আওয়াজ তোলে। চাদরটা ভালমত গায়ে
জড়িয়ে নেয় লুবনা। আশে-পাশে তেমন কিছুই চোখে পড়ে না, কেবল মাঝে মধ্যে গাড়ির হেড লাইটের আলোয় ক্ষণিকের
জন্য দৃশ্যমান হয় সামনের ফাঁকা রাস্তাটা। তাতে বোঝা যায় কুয়াশার জালটা
কেমন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে এই হিমেল রাতটাকে। তারপর
আবার সেই অন্ধকার। বাসের ভিতরেও রাত্রির সুনসান নিরবতা। বেশীর ভাগ যাত্রীরা ঘুমিয়ে
পড়েছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে লুবনা।
ঘড়ির কাঁটায় রাত
একটা। ঘুম আসছে না লুবনার। পাশের সিটের মহিলা ঘুমিয়ে
পড়েছে সেই কখন! লুবনা বাইরে তাকায়। জানালার কাঁচে শিশির জমেছে খুব। রাস্তার পাশের অস্পষ্ট গাছের ভৌতিক অবয়বগুলো ক্রমশ অদৃশ্য হচ্ছে পেছনে। রাত্রির এই
নিস্তব্ধতা আর চারপাশের অদ্ভুত পরিবেশ লুবনার কাছে কেমন যেন অস্বস্তিকর লাগে। এই প্রথম অচেনা অজানা কোন গ্রামের পথে যাচ্ছে সে, তা-ও একা এবং রাতের
বাসে! কিছুটা ভয় ও অস্বস্তি নিয়েই আজ এই অনিশ্চিত
যাত্রা।
নির্ঘুম রাতের প্রহর, কত কথা পড়ে মনে যায়! বাবা-মার করুণ মুখগুলো চোখে
ভাসছে। কী আকূতি ছিল তাদের দু’চোখে!
রাজ্যের শূন্যতা যেন ভর করেছিল সেখানে। ভেতরে ভেতরে লুবনাও কী কষ্ট পায়নি! বাবা-মার দুঃখটা ও বোঝে।
কিন্তু কী করার আছে? তার পায়ের নিচ থেকে যে মাটি সরে গেছে। শক্ত মাটির উপর দাঁড়াতে
হবে। সব কথা মনে আসছে আজ, চোখের দু’কোণ নোনা জলে ভিজে ওঠে নিজের অজান্তেই।
ধনাঢ্য পরিবারে অনেক আদর যত্নে মানুষ। কষ্ট কাকে বলে বুঝতে হয়নি কোনদিন।
কিন্তু আজ কেন নিজেকে বড় নিঃস্ব লাগে? সবকিছুই বড় মিথ্যে মনে হয়? কি অদ্ভুত
মানুষের মন। জীবনে যার আর কিছুই চাওয়ার ছিল না, তার ভিতরে আজ এত হাহাকার! লুবনার
ভাবনাগুলো আজ ডানা মেলেছে। কত কিছু মনে আসছে! বাবা, মা, তারেক- এতদিন এই ছিল ওর
জগৎ। অথচ সবাইকে ছাপিয়ে একজনের অস্তিত্বই আজ বড় সত্য হয়ে উঠেছে। যাকে খুঁজে বের করাই
এখন একমাত্র ভাবনা।
গাড়ি চলতে চলতেই এক সময় স্থির হয়ে গেল। পেছন থেকে একজন বলে উঠলো,
পৌঁছে গেছি ফেরিঘাটে। লুবনা জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল সামনে লম্বা লাইন। বাসের ভেতরে হালকা আলো, বাইরে
জমাট অন্ধকারের মাঝে হঠাত হঠাত উল্টোদিক থেকে আসা গাড়ির হেডলাইটের আলো চোখ ধাঁধিয়ে
দিচ্ছে। অনেকক্ষণ পর একটু একটু করে গাড়ি এগুচ্ছে সামনের দিকে।
দূরে দেখা যাচ্ছে নদী। কতক্ষন যে লাগবে কে জানে! এই অপেক্ষার প্রহর বড় একঘেয়ে।
লুবনার জন্য এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা।
বাসের যাত্রীরা জেগে উঠেছে। কেউ কেউ নিচে নেমে দেখছে আর
কতদূর ফেরিঘাট। পাশের মহিলাটির ঘুম ভেঙেছে একটু আগে। সে জিজ্ঞেস করলো- ফেরি আর
কতদূর? লুবনা হেসে বলল- আমি ঠিক জানি না, ঐ তো নদী দেখা যাচ্ছে। মহিলা কিছুটা
আস্বস্ত হল।
আরও
প্রায় আধঘণ্টা পর গাড়ি ফেরিতে উঠলো। লোহা-লক্করের
ঝনঝন, গাড়ির হর্ণ, লোকজনের চেঁচামেচি- সব মিলিয়ে এক বিচ্ছিরি অবস্থা। কিছুক্ষণ পর
ভোঁ-ভোঁ শব্দ ভেসে আসল। পাশের মহিলা বলে উঠল- এই তো, ফেরি ছেড়ে দিল। লুবনা জানালার
বাইরে তাকালো। একটু দূরে কয়েকটি যুবক- রেলিঙে হেলান দিয়ে সিগারেট ফুঁকছে। আরেকজন তাদেরকে
পাশ কাটিয়ে ফেরির কার্ণিশে দাঁড়িয়েই নদীর দিকে ফিরে সারছেন প্রাকৃতিক কর্ম। লুবনা
অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো- কী অদ্ভুত! আফা, জালমুড়ি খাইবেন? জানালার পাশ থেকে বলছিল
অল্প বয়সী একটি ছেলে। লুবনা হেসে বলল- না। ছেলেটি চলে গেল। হঠাৎ লুবনার মনে হল- সে
কেন না বলল! নিলেই পারতো! ছেলেটি কত আশা করে এসেছিল। আরও কত ফেরিওয়ালা আসে-যায়!
কেউ কমলা, কেউ সফেদা, কলা, চা; কেউ হঠাৎ চেঁচিয়ে বলে ওঠে- খাইবেন হট-পেটিস।
জানালার পাশে বসে লুবনা দেখে কত বিচিত্র মানুষ! জীবিকার জন্য তাদের কত কিছু করতে
হয়! কিছুক্ষণ পর এ-পাশটা ফাঁকা হয়ে গেল। লুবনা
জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে বাইরে। নদীর দিকে। অন্ধকার রাতের চাঁদহীন আকাশ, নদীটাকে
কেমন যেন অদ্ভুত মনে হয়। যতদূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। বহু দূরে গাছগুলোকে
চোখে পড়ে ধোঁয়াটেভাবে। একটা
থমথমে পরিবেশ। লুবনা প্রতীক্ষা করে- কখন ফেরি পৌছাবে নদীর ওপারে।
অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় প্রায় ঘন্টাখানেক পর। ঘাটে ভেড়ে ফেরি। গাড়ি আবার চলতে শুরু করে, তবে ড্রাইভারের
বেপরোয়া গতি দেখে লুবনার ভয় আরও বেড়ে যায়। কয়েকবার
ড্রাইভার, সুপারভাইজারকে বলেও কোন লাভ হয়নি দেখে
চুপ করেই থাকে সে। বাসের প্রায় সব যাত্রীই
ঘুমিয়ে পড়েছে কিন্তু লুবনার চোখে ঘুম নেই। এভাবেই কেটে যায় অস্থির মুহূর্তগুলো।
অবশেষে
একসময় দীর্ঘ বাসযাত্রার অবসান হল। গাড়ি পৌঁছে গেল গন্তব্যস্থলে। লুবনা জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল পূব আকাশে ভোরের আলো সবে ফুটতে শুরু করছে। বাস থেকে নেমে চারিদিকে চোখ বোলালো একবার। রাস্তায় লোকজনের
আনাগোনা তেমন একটা নেই। দু-একটা চায়ের স্টল সবেমাত্র খুলতে শুরু করেছে। অল্পকিছু
রিকশা টুং-টাং বেল বাজিয়ে এদিক-ওদিক করছে। লুবনা রাস্তার একপাশে চায়ের স্টলের দিকে
এগিয়ে যায়। মধ্যবয়স্ক একজন লোক চুলা জ্বালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।
এক্সকিউজ
মি! একটু শুনবেন?
চায়ের
স্টলের লোকটি ঘুরে তাকাল। আমারে কইতাছেন?
লুবনা
ছোট্ট করে উত্তর দেয়- জ্বি। এখান থেকে সুবর্ণপুর কতদূর?
লোকটি
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে- সুবর্ণপুর তো মেলা দূর। এখান থেকে পাঁচ মাইল পশ্চিমে গেলে
একটা নদী। তার ঐ-পাড়ে আরও কিছুদূর গেলে সুবর্ণপুর গ্রাম। লুবনাকে কিছুটা চিন্তিত
দেখে লোকটি আবার বলল- চিন্তার কিছু নাই। গৌরিপুর খেয়াঘাটে গেলেই নৌকা পাইবেন। ঐ
সামনের তিন রাস্তার মোড় থেইকাই রিকশা যায়- লোকটি সামনের রাস্তার দিকে ইশারা করলো।
অনেক ধন্যবাদ। লুবনা হেসে সেদিকে এগিয়ে গেল।
ছায়াঢাকা
ছোট্ট বাড়ীটার উঠোনে পা দিতেই লুবনার ভীষণ ভাললাগল। পুরো বাড়িটায় একটা নির্জন
স্নিগ্ধতা। লুবনা চারিদিকে চোখ বোলায়। দুই কামরার ছোট্ট বাসাটির সামনে এক চিলতে
উঠোন, সেখানে কিছু ফল-ফলাদির গাছ, একপাশে একটি ছোট্ট সবজী বাগান। সবখানেই যত্নের
ছাপ স্পষ্ট। ঘরের জানালা ঘেঁষে একটি শিউলি গাছ- সাদা ফুলে ছেয়ে আছে। রাতভর শিশিরে
ভেজা পাতাগুলো থেকে টপটপ জল ঝরে পড়ছে ফোঁটায় ফোঁটায়। ভেজা মাটি সে-জল শুষে নিয়ে
আরও আর্দ্র হয়ে উঠছে ক্রমশ। উঠানের পাশেই একটা ছোট্ট পুকুর, পানিতে গাছের ছায়া
পড়েছে। সেখানে কালচে-খয়েরি পানিতে ছোট ছোট মাছগুলো লালচে-রূপালি মুখ আর লেজ দেখিয়েই
টুপটাপ জলে ডুব দিচ্ছে। লুবনাকে পথ দেখিয়ে আনা ছেলেটি সামনের ঘরটির দিকে এগিয়ে
গেল।
একাকী জীবনে তাড়াহুড়ার কোন বালাই নেই জাহানারার। সারাদিন স্কুলে চাকরির
বাইরে তার অফুরন্ত অবসর। নিজের দু’বেলা
খাবার জন্য রান্নাবান্না আর ঘর সামলানো- এ আর এমন কী! নির্ঝঞ্ঝাট দৈনন্দিন জীবনযাপন। স্কুলের সময়টুকুই বরং ভাল
কাটে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সান্নিধ্য চমৎকার লাগে তার। বাকি সময়টাতে ভাবনায় শুধুই
একজন।
সকালে তেমন কোন তাড়া নেই জাহানারার। ধীরে সুস্থে স্কুলে যাবার জন্যে তৈরি
হচ্ছিল। বাইরে পাশের বাড়ির ছেলেটির কন্ঠ শুনতে পেল।
খালা, একজন মহিলা আপনার খোঁজ করতাছে।
জাহানারা
দরজার দিকে আসতে আসতেই জিজ্ঞেস করলো- কে রে তোতা ?
আমি তো চিনি না, কইল আপনার আত্মীয় লাগে।
জাহানারা ঘর থেকে বেরিয়ে দরজার সামনে এসেই থমকে দাঁড়াল। দু’চোখে বিস্ময় নিয়ে সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির দিকে
তাকিয়ে রইলো। লুবনার কোনদিকে খেয়াল নেই। সে দরজায় দাঁড়ানো মহিলার দিকে তাকিয়ে যেন নতুন করে আবিস্কার করল জাহানারাকে। পথের ক্লান্তি, সারা রাতের অনিশ্চয়তা,
সব যেন ঘুচে গেছে এক লহমায়। সেই ছেলেবেলা থেকে স্কুলের গণ্ডিতে দেখে আসা জাহানারা
যেন ইনি নন, সম্পুর্ন নতুন রূপে ভিন্ন মহিমার একজন মানুষ আজ তার সামনে দাঁড়িয়ে।
জাহানারাও অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে লুবনার দিকে। ওকে বিদায় দিয়ে বুকের ভিতরে একটা
শূণ্যতা তৈরি হয়েছিল- যা তাকে ওই শহর থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য করেছিল। আজ লুবনাকে তার সামনে দাঁড়ানো দেখে নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। লুবনা কী করে এখানে এল?
ও কানাডা চলে যাবার পর ঢাকা থেকে একরকম পালিয়ে বেঁচেছিল জাহানারা।
ঢাকা তার কাছে অসহ্য লাগতো। মনে হত এই শহর আর তার জন্যে নয়। সুতা ছিঁড়ে গেছে, এখানে আর কোন বন্ধন নেই। এতদিন যাকে চোখে চোখে রাখার
জন্য স্কুলের চাকরি নিয়ে থেকে গিয়েছিল অচেনা শহরে, লুবনা চলে যাবার পর তার আর কোন
প্রয়োজন থাকলো না। ঢাকা থেকে অন্য কোথাও চলে যাবার জন্যে কেবল ছটফট করেছিল সে। অনেক চেষ্টা আর প্রিন্সিপাল আপার সহায়তায় একদিন মিলল বদলির অনুমতি। ঠাঁই হল এই সবুজ শ্যামল গাঁয়ে। কিন্তু আজ এখানে লুবনার উপস্থিতি
তাকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। তারপরও
মনে প্রশ্ন জাগে– লুবনা এখানে কেন? ওর তো এখন তারেকের
সাথে কানাডা থাকার কথা। আর জাহানারার ঠিকানা কিভাবে পেল?
জাহানারাই প্রথম নিরবতা ভাঙলো।
অস্ফুট স্বরে বলল- লুবনা, তুমি এখানে!
লুবনা নিরুত্তর।
হঠাৎ লুবনার খেয়াল হয় ব্যাগে তার সেলফোনটি বাজছে। বের করে দেখল একটি
অপরিচিত নাম্বার।
হ্যালো
অপর প্রান্ত থেকে কোন সাড়া নেই।
হ্যালো, কে বলছেন?
কেমন আছ লুবনা?
কিছুক্ষণ
চুপ করে থাকলো লুবনা।
তারেক! অনেকদিন পর আবার সেই কন্ঠ। একসময় দিনের পর দিন যে কন্ঠ মনের কোণে রিনিঝিনি
সুর তুলতো, যে কণ্ঠ শোনার জন্য সারাদিন আকূল হয়ে অপেক্ষা করতো, আজ সেই কন্ঠ ওর মনে
কোন আলোড়ন তুললো না। অনেকগুলো প্রশ্ন জাগে
মনে। ও কেন ফোন করলো? কানাডা থেকে কবে ফিরলো? আর নাম্বার পেল কোথায়? সাথে সাথেই
উত্তর মিলে- নিশ্চয়ই বাসা থেকে সংগ্রহ
করেছে।
লুবনা!
কেন ফোন করেছ?
তোমার সাথে কিছু কথা আছে।
আমার তো কোন কথা নেই। তোমার পেপারস তো আমি সাইন করে পাঠিয়ে দিয়েছি কানাডার ঠিকানায়।
জানি, আমি তোমার সাথে সামনা-সামনি কিছু কথা বলতে চাই।
আমি তো চাই না।
তাও জানি। আমি তোমার সাথে অনেক বড়
অন্যায় করে ফেলেছি কিন্তু আজ বুঝতে পারছি আমি শুধু তোমাকেই ভালবাসি। তোমার পরিচয় নিয়ে আমার মনে আর কোন দ্বিধা নেই। আমরা কি আবার এক হতে পারি না?
সেটা আর সম্ভব নয় তারেক। তোমার আমার পথ আজ
ভিন্ন। আমি আমার ঠিকানা পেয়ে গেছি।
জাহানারা শঙ্কিত হয়। তার মনে আশঙ্কা জাগে- লুবনা কি
ওর নিজের পরিচয় জেনে গেছে! সে বুঝতে পারে লুবনার সামনের
কন্টকময় পথটা আরও দুর্গম হয়ে উঠছে ক্রমশ। যে কাঁটা বিছানো পথে এতটা বছর দুঃসহ
অন্ধকারের স্মৃতি বুকে বয়ে চলেছে সে নিজে,
কিছুতেই চায় না লুবনার জীবনে তেমন সময় আসুক। আজ এত বছর পর পুরনো ভয়টা আবার জেগে
ওঠে জাহানারার মনে। লুবনার ভবিষ্যত চিন্তায় অস্থির হয়ে ওঠে।
সে জানে- এ সমাজে একাকী একটি মেয়ের
টিকে থাকা কত কষ্টের।
জাহানারা একসময় হারিয়ে যায় ফেলে আসা দিনগুলোতে। মনের পড়ে পিছনের ভয়ঙ্কর নির্মম
সময়গুলোর কথা। ভাবলে এখনো গায়ে কাঁটা দেয়! তার চোখে ভেসে ওঠে একাত্তর। যুদ্ধের শেষ তিন মাসের ক্যাম্পের কথা। মানুষের বেশে পশুরুপী কিছু
কুৎসিত মুখের ছবি যা সমস্ত পুরুষজাতির প্রতি তার মনে ঘৃণা ধরিয়ে দিয়েছিলো। যুদ্ধ শেষ হলেও চেনাজানা,
এমনকি আপন মানুষগুলোর তীর্যক দৃষ্টিও তার ভিতরটা ক্ষতবিক্ষত করে দিত। কতবার আত্মহত্যা করতে
চেয়েছে! পারেনি। সাহস হয়নি। অনেকে বলেছিল মুক্ত হয়ে যেতে, তা-ও পারেনি। অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল। সেই কঠিন সময়ে তার পাশে এসে দাড়িয়েছিল জামিল সাহেব, সাবেরা আহমেদ আর কলেজের প্রিন্সিপাল আপা। লুবনা পেল একটি নিরাপদ আশ্রয় আর জাহানারা
পেয়েছিলো সমাজের তীর্যক দৃষ্টি থেকে মুক্তি।
হঠাৎ খেয়াল হয় লুবনা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। জাহানারার বড় মায়া
হয়। একবার মনে লোভ জাগে, খুব ইচ্ছে হয় কাছে গিয়ে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে। সেই
ছেলেবেলার মত। স্কুলের ছোট মাঠের কোণে যেমনি করে
ওকে আদর করত সে। পরক্ষণেই
আবার সামলে নেয় নিজেকে। লুবনা যে পথের সন্ধানে এসেছে, সে পথ এখনও ওর জন্য তৈরি
হয়নি। এই সমাজ ওকে কখনই মেনে নেবে না। যে দুঃস্বপ্নের
ঘুণপোকারা এখনও তাকে
কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে- জাহানারা চায় না তার ছায়া পড়ুক লুবনার জীবনে। যে করেই হোক ওকে ফেরত পাঠাতে হবে জামিল সাহেবদের কাছেই।
জাহানারা লুবনার কাছে এগিয়ে যায়। লুবনার উদ্দেশ্য বলে,
তুমি তোমার বাবা-মার কাছে ফিরে যাও মা।
আমি তো ফিরে যেতে আসিনি। যদি যেতেই হয় তবে তোমাকে সাথে নিয়েই ফিরবো।
সে হয় না মা। তোমার জীবন সবেমাত্র শুরু হয়েছে, এভাবে নষ্ট করে দিও না। আমাদের
সমাজে একা একটি মেয়ের বেঁচে থাকা যে কত কঠিন- সে তুমি বুঝবে না মা।
আজ আমি সবকিছুর জন্যই প্রস্তুত। জানি, সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে সেই সত্যই
একদিন নির্মমভাবে সামনে এসে দাঁড়ায়। সত্যর মুখোমুখি হওয়াই সমাধানের একমাত্র পথ।
আমি সবকিছু জেনেশুনেই এসেছি। পিছু হটতে নয়, বরং আমরা মাথা উঁচু করে দাড়াবো।
গর্বভরে বলব- আমরা কোন অভিশাপ নই, আমরাও
এদেশের মুক্তির সারথি।
জাহানারা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে লুবনার দিকে। একসময় নিকষ
কালো আঁধারে ঢেকে গিয়েছিল তার
পৃথিবী।
কী প্রবল
আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সেই
অন্ধকারের প্রাচীর ভেদ করে আলোকিত হতে চেয়েছে বার বার! কী লাভ হয়েছে? সে তো ক্রমশ
ডুবে গিয়েছে আরো অতলে। সেই অন্ধকার গহ্বর হতে বের হতে গিয়ে
প্রাণপণে ছুটে বেড়িয়েছে- আলো খুঁজেছে নিজের
অস্তিত্ব রক্ষায়। পায়নি, আলোর
দেখা পায়নি সে। জাহানারা সামনে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। লুবনা যেন দু’হাতে আলোর মশাল
নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর দৃঢ়তা, আত্মবিশ্বাস জাহানারার মনে সাহস জোগায়।
অনেকদিনের তৃষ্ণার্ত বুকে স্নেহ-মমতা নতুন
করে প্রাণ পায়। জাহানারা দু’হাত বাড়িয়ে দেয়-আলোর দিকে।
লুবনা যেন এই ক্ষণের অপেক্ষাতেই ছিল। জাহানারার কাছে এগিয়ে আসে- বুকে মাথা রেখে খোঁজে ভালবাসার আশ্রয়। দু’চোখ অশ্রু
জমে, আনন্দ অশ্রু।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন