জানালা
ও বেড়ার ফাঁক-ফোকর দিয়ে বিচ্ছিরি গন্ধটা ঘরময় ছড়িয়ে পড়লে পেটের ভেতরে গুলিয়ে উঠলো।
বৃষ্টি হলেই উৎকট একটা গন্ধ
ঝিল থেকে ডানা মেলে আকাশে, তারপর দৈত্যের মত ছুটে এসে আশপাশের পুরো এলাকা গ্রাস
করে নেয়। তখন টিকে থাকাই দায়। ঘরের ভেতরে গুমোট অন্ধকার। কেমন যেন আষ্টেপৃষ্ঠে
মিশে আছে ঘরের কোণে কোণে, চারপাশের টিনের বেড়া আর চালের সাথে। বৃষ্টি থেমে
গেলেই একটা ভ্যাঁপসা গরম ছাড়ে। কী অসহ্য! ইলেক্ট্রিসিটি নেই এক
ঘণ্টা হল। বাঁশের সাঁকোর মোড়ে দু’টো কুকুর একটানা চেঁচাচ্ছিল।
কে যেন ধমকে উঠল- অ্যাই চুপ, যাহ!
উফ! আর
তো পারা যায় না- মহিদুলের কণ্ঠে বিরক্তি।
কী
পারা যায় না? মহিদুলের দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করল জয়নাব। ছেলেকে তালপাখায় বাতাস করছিল
সে।
গন্ধে
তো বমি হওয়ার দশা। এইহানে আর থাকা যাইবো না।
যাইবা
কই? ভাল জায়গায় থাকনের ক্ষ্যামতা আছে? জয়নাব খেঁকিয়ে উঠলো। পরক্ষণেই আবার মোলায়েম
স্বরে বলল- থাউক, পোলাডার চিকিতসায় কত টাকা লাগবো! এইটুকুন কষ্ট করলে আমগো কিছু
অইবো না।
চৌকিতে
ঘুমিয়ে থাকা ছেলের দিকে তাকায় মহিদুল। শীর্ণদেহী ছেলেটির গায়ে হালকা চাঁদের আলো
পড়েছে জানালা গলে। জানালার ও-পাশে ঝিল, কচুরিপানায় ভরা। ওখানে অদ্ভুতুরে অন্ধকার
চাঁদের আলোর সাথে লুকোচুরি খেলে। সড়সড় করে কী যেন
ছুটে গেল কচুরিপানার উপর দিয়ে। বিড়াল কিংবা বেজী হবে হয়ত। পাশের ঘরে মতির বাপ অনবরত
কেশেই চলেছে। মহিদুলের মনে হচ্ছিল- ওর বুকের পাঁজরের হাড় ক’খান আজ ভেঙেই যাবে। শেষে
বিরক্ত হয়ে বলল,
দিনরাইত
এই লোকটা কাশে তবুও বিড়ি ফোঁকা বন্ধ হয় না। কতদিন কইছি, এইসব ছাইপাশ খাইও না।
শরিলে তো হাড্ডি ছাড়া আর কিচ্ছু নাই!
যার
ভাল হেয় না বুঝলে তুমি বইলা কী করবা? জয়নাব বলল।
আমার
আর কী? চোখের সামনে দেখি, তাই মানা করি।
আধো-অন্ধকারে
জয়নাব ঘুরে তাকায় মহিদুলের দিকে। মহিদুলের শরীর ঘামে চিকচিক করছে।
একটু
চকিডার কাছে আগাইয়া আস। বাতাস লাগবে।
মহিদুল
চৌকির গা-ঘেঁষে বসে। জয়নাব তালপাখা দিয়ে জোরে বাতাস দেয়। স্বামী-ছেলে দুজনকেই আরাম
দেয়ার চেষ্টা।
জানু!
মহিদুল জয়নাবের দিকে তাকিয়ে ছোট করে ডাক দেয়।
কি
কইবা কও, গরমে ভাল লাগতাছে না। মলিন আঁচলে মুখ মুছে উত্তর দেয় জয়নাব।
মহিদুল
সান্ত্বনার সুরে বলে- তুই চিন্তা করিস না। আমগো দিন এমন থাকবো না। তৈয়ব আলী কইছে ও
রোজ সন্ধ্যায় আমারে ড্রাইভিং শিখাইবো। ড্রাইভিংটা শিইখা নিতে পারলে আয়-রোজগার
ইনশাল্লাহ বাইড়া যাইবো।
আগে
ড্রাইভিং শিইখা কাজ পাও তো, তারপর দেখা যাইবো। জয়নাব দায়সায়রা উত্তর দেয়।
হঠাৎ
আলো জ্বলে উঠলো তখন। ঘরের ভেতরে জমানো অন্ধকারের আবরণটা আচমকাই ছুটে পালালো যেন।
মহিদুল অস্পষ্ট স্বরে বলল- বাঁচলাম। মাথার উপর পুরনো সিলিঙ ফ্যানটা একবার কঁকিয়ে
উঠে মৃদু গতিতে ঘুরতে শুরু করলো। সেদিকে তাকিয়ে মহিদুল মনে মনে ভাবল একটা নতুন
ফ্যান কেনা দরকার কিন্তু জয়নাবের ঝামটা খাওয়ার ভয়ে কথাটা মুখে আনলো না।
পাশ
ফিরিয়ে শোয়াতে যেতেই উঠে বসল শান্ত। জয়নাব ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
কি
হইছে বাবা? হিসু করবা?
শান্ত
মাথা নেড়ে বলল- হ।
মহিদুল
বলল- আসো বাবা, আমি তোমারে নিয়া যাই।
মহিদুল
পাঁজাকোলে করে ছেলেকে ঘরের বাইরে নিয়ে যায়। স্যাঁতসেঁতে পথ। পিচ্ছিল আর ছায়া-ছায়া।
সরু করিডোরের শেষ মাথায় টয়লেটের টিনের চালের সাথে টিমটিমে আলো জ্বলে। মহিদুল
শান্তকে কোলে নিয়ে সেদিকেই যায়।
জয়নাব
নিজেই নিজেকে বলে- পোলাডা কবে যে আবার হাঁটতে পারবো! পেছন থেকে মহিদুল জবাব দেয়-
দেখিস, একদিন শান্ত ভাল হইয়া যাইবো।
অস্থির
হয়ে ওঠে জয়নাব। আর কবে ঠিক হইবো? আগে তো ক্রাচে ভর দিয়া হাঁটতে পারতো, এখন তো তা-ও
পারে না।
মহিদুল
কোন জবাব দেয় না। জানে, এরপর কিছু বললে জয়নাব ভাসবে। সে বাধ না মানা ঢল থামানোর
সাধ্য নেই মহিদুলের।
জয়নাব মহিদুলের
দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মহিদুল অন্যদিকে ফিরে নিজের অসহায়ত্ব ঢাকার
চেষ্টা করে মাত্র। জয়নাব বোঝে। মহিদুলের ভেতরেও কষ্ট জমে আছে। সে কাউকে বলতে পারে
না।
মহিদুল
নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলো- এহন জ্বর আছে?
জয়নাব
উত্তর দেয়- না। সন্ধ্যার পর আর আসে নাই।
মহিদুল
আলতো করে ছেলের বাম পা’টায় হাত বোলায়। বিড়বিড় করে বলে- কী যে হইলো পোলাডার পা’য়!
তারপর জয়নাবের দিকে ফিরে বলে- তুই চিন্তা করিস না জানু, আমি ওরে একজন বড় ডাক্তার
দেহামু। আমগো শান্ত ভাল হইয়া যাইবো।
জয়নাব
বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে বলে- তাই যেন হয়।
জয়নাবের
হঠাৎ নদীর কথা মনে পড়ে। জোয়ার-ভাটা, খেয়াঘাটের কথা। সাঁঝের বেলা গফুর মাঝির দরাজ
গয়ায় গান ধরা। আর, নদীর ঐ-পাড়ে টকটকে লাল সূর্যটার ওঠা-নামার কথা।
একটা
ঘর আর উঠোন ছিল। নদীর ঠিক পাড়েই। ঘরের সামনে সবজী মাচা- ঝিঙে-শশা-লাউ। কত কী!
বুকের ভেতর হু-হু করা একেকটা জোনাক-জ্বলা সন্ধ্যার কথাও মনে আসে। আরেকটা কথা কখনো
ভোলে না জয়নাব- উথাল-পাথাল ঢেউ। নদী-পাড়ের হেলে পড়া নারিকেল গাছটা যেদিন ভেঙে
পড়লো, শান্তর সে-কী কান্না! কিছুই তো নেই এখন আর। জয়নাব জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে
থাকে- অন্ধকারের দিকে।
জানু!
হুম।
কী
ভাবতাছোস?
কিছু
না।
তুই
দুই রাত ধইরা ঘুমাস নাই, আইজ একটু ঘুমা। রাইত তো অনেক হইল।
ঘুমানের
কী উপায় আছিলো? দুইডা রাইত ধইরা পোলাডা জ্বর আর ব্যথায় চিক্কইর পাড়ছে, তুমি কী
ঘুমাইতে পারছিলা? আমি ওর পাশে আছি, তুমি ঘুমাও। বিহান বেলা গাড়ি নিয়া বাইর হইতে
অইবো না?
মহিদুল
মেঝেতে পাটি বিছিয়ে শুয়ে পড়ে। পাশ ফিরে শোয়ার আগে একবার জয়নাবের দিকে ঘুরে তাকায়।
জয়নাব জিজ্ঞেস করে- কিছু কইবা?
শ্যাষ
রাইতের দিকে আমারে তুইল্যা দিস। আমি ওর পাশে থাকুম, তুই একটু ঘুমাইয়া নিতে পারবি।
আচ্ছা
দিমুনে, তুমি এহন ঘুমাও।
একটু
পর আবার ঘুরে জিজ্ঞেস করলো- কাইল তুই কামে যাবি?
হ।
কাইল না গেলে কামডা মনে হয় আর থাকবো না।
তাইলে
তাড়াতাড়ি ফিরা আসিস।
হ।
তাড়াতাড়িই ফিরুম।
সারারাত জেগে থেকে ভোরের
দিকে মাথাটা বালিশে রাখতেই রাজ্যের ঘুম এসে ভর করলো জয়নাবের চোখে। মহিদুল তাকে আর
ডাকলো না। রাত পোহাতেই সে বেরিয়ে পড়লো। ঘরে বসে থাকার উপায় আছে? একদিন ঘরে বসে
থাকলে পেটে ভাত জুটবে না। ছেলেটার মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে নিঃশব্দে ঘর থেকে
বেরুলো। দরজাটা আলতো করে ভেজিয়ে রাখলো।
বাঁশের
সাঁকোটা পেরুলেই মহাজনের গ্যারেজ। মহিদুল রিকশা
নিয়ে গ্যারেজের মুখে আসতেই দেখতে পেল তৈয়ব হনহন করে হেঁটে আসছে। মনে হচ্ছে মেজাজ
তিরিক্ষি। কাছাকাছি আসলে মহিদুল জিজ্ঞেস করলো-
কী
ব্যাপার, তোমারে এমন লাগতাছে কেন?
তৈয়ব
তর্জন-গর্জন করতে করতে বলল- দিলাম হালারে মুখের উপর না কইরা। তৈয়ব কারো হুকুমের
গোলাম না।
মহিদুল
হেসে জিজ্ঞেস করে- কী হইছে? কারে না করছ?
তৈয়ব
সমান তেজ দেখিয়ে বলে- কারে আবার? যেই হালার গাড়ি চালাইতাম। হুমুন্দির পুত মনে করছে
আমারে কিইনা নিছে!
এত রাগ
হইলে চলে? চাকরি করতে হইলে মালিক তো কিছু কথা হুনাইবোই।
দুরো
মিয়া! এত-পুতু পুতু করলে সবাই তোমার মাথায় কাঠাল ভাইঙা খাইবো। মনে জোর রাখবা মিয়া,
তুমিও কম কিসে!
রাগের
মাথায় বললেও তৈয়বের কথাগুলো বড় ভাল লাগলো মহিদুলের। সে হাসলো এবং একই সঙ্গে তৈয়বের
কথার সমর্থনেই যেন টুং-টাং বেল বাজিয়ে রাস্তায় নামলো। তখন ধূলো উড়ছে। পরিচ্ছন্ন
কর্মীরা রাস্তা ঝাট দিতে নেমেছে। মহিদুল গামছা দিয়ে ধূলো তাড়ায় আর একটু দূরে ইশারা
করে দাঁড়িয়ে থাকা সওয়ারীর দিকে এগিয়ে যায়।
আজ ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়ে গেল জয়নাবের। গত দু’দিন কাজে যেতে
পারেনি সে। বেগম সাহেবের ফোন এসেছিলো। কেউ কী আর জয়নাবের কথা শুনবে! তারা প্রতিদিনের কাজের জন্য টাকা দেয়, কামাই দিলে মানবে কেন? জয়নাব ছেলের
কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বরটা আর নেই। কিছুটা স্বস্তি পায়। বাইরে তাকিয়ে দেখে
ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। এই বৃষ্টিতে কোনভাবেই যাওয়া যাবে না। জয়নাব ছেলেকে খাবার
খাইয়ে বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় বসে থাকে।
শ্রাবণ মাস। সকাল থেকেই অঝোর ধারায় ঝরছে। এখন দিনের বেশির ভাগ সময়ই ঝরে। মাঝে মধ্যে একটু কমে
মাত্র। চৌকির উপরে বসে বৃষ্টি দেখছে শান্ত। জানালার ফাঁক গলে বৃষ্টির ছাট এসে লাগে ওর চোখে-মুখে। লতানো
কলমি আর হেলেঞ্চায় ছাওয়া ঝিলটার মাঝখানে কিছুটা ফাঁকা জায়গা। বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে সেখানে।
সেদিকেই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে
শান্ত। ঝিলটির ওপাশেই শহরের অভিজাত এলাকা, বড় বড় অট্টালিকায় ঠাঁসা।
ঘরের পাশ-ঘেঁষা ঝিল আর তার উপরে বর্নীল আকাশটাই
শান্তর জগত। ঝিলের ও-পাড়ে সারি সারি উঁচু-নিচু ভবন থেকে নির্গত সব মলমূত্র এসে মিশে এই
ঝিলেই। প্রায় সবসময়ই দুর্গন্ধ ছড়ায়। এখানে যখন
ওরা প্রথম আসলো, খুব কষ্ট হত। এখন অভ্যেস
হয়ে গিয়েছে। টিনের তৈরি দশ বাই আট এই ঘরটিতে আসবাব পত্র বলতে কেবল মাত্র একটি পুরনো কাঠের চৌকি, কয়েকটি অতি প্রয়োজনীয় রান্নার পাত্র,
বাসন-কোসন আর বাঁশের বেড়ার সাথে ঝুলানো তিন জনের কাপড়চোপর।
বাবা বেরিয়ে গেছে সেই কাকভোরে। প্রতিদিনই যায়; রিকশা নিয়ে শহরময় ঘুরে বেড়ায় জীবিকার সন্ধানে। আর মা, সে-ও চলে যায় একটু বেলা গড়ালে।
ফিরে আসতে দুপুর পেরিয়ে যায়। এই পুরো সময়টা জুড়ে শান্তর একরকম বন্দী জীবন। বয়স আর কত? নয় কি
দশ। ওর বয়সী ছেলে-মেয়েরা মাঝে মধ্যে উঁকি দেয় ঘরে। ও পর্যন্তুই। কেউ ওর সাথে খেলে না। ওদের সাথে খেলার মত শারীরিক সক্ষমতা
নেই শান্তর। হাঁটতে পারে না। ওর বাম পা’টায় শক্তি
নেই একেবারেই। ওঝা-বদ্যি-ঝাড়ফুক কম করেনি বাবা-মা। কিছুতেই কিছু হয়নি। প্রায় রাতেই
মা কাঁদে। বাবা কিছু বলে না, কেবল গুম মেরে বসে থাকে।
বাঁশের
সাঁকোর মোড় থেকে ছোট্ট ডিঙি নৌকা নিয়ে ঝিলের মাঝ বরাবর এগিয়ে যাচ্ছিল মতি। শান্তকে
জানালার পাশে বসে থাকতে দেখে নৌকাটা বস্তি লাগোয়া পাড়ে ভিড়ালো। মতি প্রতিদিনই ঝিলে মাছ
ধরে। শান্তদের ঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় জানালার পাশে নৌকা ভিড়িয়ে কিছুক্ষণ ওর সাথে
সময় কাটায়। শান্তও যেন ঠিক এই সময় মতির প্রতীক্ষায় থাকে। মতি ঝিলে মাছ ধরে আর
শান্ত জানালার পাশে বসে ওর মাছ ধরা দেখে। তিনদিন পর আজ মতিকে দেখে শান্তর মুখে
হাসি ফুটলো।
আইজক্যা
তোর জ্বর নাই?
শান্ত
হেসে বলল- না।
তাইলে
ঘরের মধ্যে একলা একলা কি করস? নৌকায় যাবি আমার লগে?
আমি
ক্যামনে যামু, আমি তো এহন ক্রাচ দিয়াও হাটতে পারি না!
মতি
অভয় দেয়, আমি তোরে নৌকায় উঠাইয়া নিমু, কোন সমস্যা হইবো না।
শান্ত
ম্লান হাসে। না-রে! তুই যা, আমি এইহানে বইসাই তোর মাছ ধরা দেখুম।
মতি
হেসে বলে- ঠিক আছে, আইজ বেশি মাছ পাইলে তোরেও কিছু দিমুনে।
শান্ত
হেসে বলে- আচ্ছা।
মতি ডিঙি
নৌকা নিয়ে ঝিলের মাঝখানের খোলা জায়গার দিকে এগিয়ে যায়। কাল রাতের বৃষ্টিতে পানি
বেড়েছে তবুও কচুরিপানা সরিয়ে নৌকা নিয়ে এগিয়ে যেতে বেশ কসরতই করতে হচ্ছে ওকে।
কালচে পানির দুর্গন্ধটা অবশ্য গা-সওয়া হয়ে গেছে। শান্ত ওর গমন পথের দিকে তাকিয়ে দেখে
মতি ওর ছোট্ট শরীর বাঁকিয়ে কেমন করে ডিঙিটা ব্যালেন্স করে। একটু আগে বৃষ্টি থেমেছে।
রাতের বিচ্ছিরি গরমটা এখন আর নেই। রোদহীন পরিষ্কার ঝকঝকে আকাশ। ঝিলের মাঝের
তারখাম্বায় ঝুলন্ত তারে কয়েকটি কাক বসে আছে অসলভাবে। বৃষ্টি শেষে মানুষের ব্যস্ততা
ক্রমশ বাড়ছে। ওপারে ঝিলের পাড় ঘেঁষা রাস্তায় লোকজনের চলাচল শুরু হয়েছে। সুউচ্চ
অট্টালিকাগুলোর বারান্দায় ঝুলছে সদ্য ধোয়া রঙ-বেরঙের কাপড়। শান্তর মার কথা মনে
পড়ে। কাজ শেষে মা কখন ফিরবে?
জানালার
ধারে বসে শান্ত দেখে ঝিলের মাঝখানে পৌঁছে গেছে মতির ছোট্ট
নৌকাটি। ঝিলের স্বচ্ছ পানিতে নীল
আকাশের ছায়াটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। মতি বড়শি ফেলেছে
ঝিলের জলে। মাঝে মধ্যেই শান্তর দিকে তাকিয়ে হাসে। ইশারায় কথা বলে। বড়শিতে বড় কোন
মাছ পেলেই মতি উপরে তুলে ওকে দেখায়, শান্তও হাততালি দিয়ে মতিকে উৎসাহ দেয়। এভাবেই
কেটে যায় শান্তর অলস সময়গুলো। মতি দূর থেকে ওকে সঙ্গ দেয়।
প্রায়
ভেজা কাপড়েই সাহেবদের বাসায় পৌঁছাল জয়নাব। বেগম সাহেব তাকে দেখেই তেলেবেগুনে জ্বলে
উঠলেন। গত দু’দিন কাজ কামাই দেয়ার জন্য একচোট নিলেন। জয়নাব চুপচাপ শুনে নিজের কাজে
মন দেয়। দু’দিনের জমানো কাজ, একটু বেশিই সময় লাগছে কিন্তু কিছুতেই আজ কাজে মন বসে
না তার। ছেলেটা ঘরে একা। তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরার জন্য ছটফট করে। সে জানে সব কাজ শেষ
না হলে বেগম সাহেব কিছুতেই ছাড়বেন না। জয়নাব দ্রুত হাত চালায়। মনে মনে ভাবে কবে যে
ভাগ্যের চাকা ঘুরবে! কাজ শেষে বেগম সাহেবের কাছে
গিয়ে দাঁড়ায় জয়নাব।
আফা,
সব কাম শেষ, আমি এহন যাই?
বেগম
সাহেব কিছুটা রাগত স্বরেই বললেন-
গতকাল
আসোনি, ডিপে অনেকগুলো মাছ জমে আছে। ওগুলো কেটে দিয়ে যাও।
কাইল
কাইটা দিমুনে। আইজ একটু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হইবো। ম্লান হেসে বলল জয়নাব।
বেগম
সাহেব আবার ধমকে উঠলেন। কাল কেন? আজ রান্না করতে হবে না? তোমাদের সমস্যার কথা আর
কত শুনবো?
বেগম
সাহেব মোবাইলে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। দূরের মসজিদ থেকে তখন ভেসে আসছিলো জোহরের আযান।
জয়নাবের দুশ্চিন্তা আরও বাড়ে। সে বেগম সাহেবের সামনে গিয়ে আবার দাঁড়ায়।
আফা,
আমি বিহালে আইসা আপনের মাছ কাইটা দিমুনে। পোলাডারে ঘরে একলা রাইখা আইছি, ও-তো একলা
চলতে পারে না।
জয়নাবের
দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই গৃহকর্ত্রীর। সে মোবাইলে কথা বলায় ব্যস্ত। জয়নাব বুঝে গেল খুব
সহজে মুক্তি মিলবে না। তার ছেলের কি হল তাতে বেগম সাহেবের কী যায়-আসে? কিছুক্ষণ
দাঁড়িয়ে থেকে মাছ কাটতে বসে যায় জয়নাব কিন্তু মনটা পড়ে থাকে বস্তির ছোট্ট ঘরে।
সরকারী
জমিতে স্থানীয় প্রভাবশালীদের তোলা এই বস্তিতে একশ’র বেশি ঘর আছে। কিছু কিছু ঘর ঝিলের উপরেই তৈরি। কাঠের মেঝে। গায়ে গা লাগানো ঘরগুলোতে শতাধিক পরিবারের
বসবাস। কেউ রিক্সা চালায়, কেউ
বা সবজী বিক্রেতা আর কেউ কেউ কাজ করে পোষাক কারখানাগুলোতে। প্রায় সময়ই এখানে হৈ-হট্টগোল লেগে থাকে। সামান্য বিষয় নিয়েও খিস্তি-খেউড়, অশ্রাব্য
ভাষায় গালাগালি- এটা এই
বস্তিবাসীদের কাছে অতি স্বাভাবিক বিষয়। এলাকার মাস্তানদের
নিয়মিত আখড়াও এই বস্তি। নেশা দ্রব্য বেচাকেনার এক অভয়াশ্রম। প্রায়ই বিভিন্ন
গ্রুপের মধ্যে মারামারি বাধে। কখনও কখনও আগ্নেয়াস্ত্রের মহড়া।
মাঝে মধ্যে পুলিশের আনাগোনাও দেখা যায়, তবে নিয়মিত বখরা পেলে তেমন একটা ঝামেলা করে
না পুলিশ।
ঠিক
দুপুর বেলা পেছনের গলি দিয়ে বেশ কিছু যুবক এসে জড়ো হল বস্তিতে। একজন-দু’জন করে লোকসংখ্যা আরও বাড়ে। একসময় গুঞ্জন ওঠে- বস্তি ভেঙে দেয়া
হবে। গুঞ্জন থেকে হৈচৈ- হুমকি- অস্ত্রের ঝঙ্কার; তারপর ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। বস্তির
বাসিন্দারা দিগ্বিদিক ছোটে; যে-যার মত ঘরের মালামাল সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
বস্তিতে
হঠাৎ হৈচৈ আর চিৎকার শুনে কান পাতলো শান্ত। মনে মনে ভাবলো- বোধহয় বড় ধরনের ঝামেলা
হয়েছে। হয়তো পুলিশ কাউকে ধরে নিয়ে গেছে কিংবা কারো সাথে মারামারি। এগুলো তো
হরহামেশাই হচ্ছে। যা হচ্ছে হোক! মতির মাছ ধরা দেখায় আবার মন দেয় শান্ত। চেঁচামেচির
শব্দটা ধীরে ধীরে আরও বাড়ে, লোকজনের ছোটাছুটি আর গুড়ুম-গুড়ুম শব্দ-যেন
সবকিছু ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে। শান্ত একটু একটু করে এগিয়ে যায় চৌকির
কর্ণারের দিকে, কী ঘটছে দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু ঘরের দরজা ভেজানো থাকায় কিছুই
দেখতে পায় না। আবার ফিরে আসে জানালার কাছে। মতির বড়শিতে মনে হয় একটা বড় মাছ আটকা
পড়েছে!
বড়শিতে
টান পড়তেই চিৎকার করে ওঠে মতি। ‘খাইছে, এইবার ধরা খাইছে। কই যাইবা বাছাধন?’
শান্ত
খুশিতে হাততালি দেয়। মতি একবার ঘুরে শান্তকে দেখে, আবার মন দেয় মাছের দিকে। বড়
মাছ, মতি মাছটাকে খেলায়। মাছটা এদিক-ওদিক ছুটে যায়, মতিও ওর সাথে নৌকা ঘুরিয়ে
ভারসাম্য রক্ষা করে। শান্ত ঝিলের দিকে তাকিয়ে মতির মাছ নিয়ে খেলা করা বেশ উপভোগ
করে।
বড়শিতে
গাঁথা মাছটার গতিবিধি বোঝার ফাঁকেই কানে ভেসে আসলো ভাঙচুরের শব্দটা। পেছনে ফিরে
তাকিয়েই কিশোর মতি মনে মনে বিশাল এক ধাক্কা খেল। মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে কেবল
বেরিয়ে এলো একটি শব্দ- শান্ত!
মতি
ছিপ ফেলে দিয়ে দ্রুত ঘুরিয়ে দিল নৌকার মুখ। বড়শিটা পড়ে থাকলো
পানিতেই। মাছটা প্রাণপণে চেষ্টা করে মুক্তি পেতে। কিন্তু গলায় আটকে
পড়া বড়শির হুক ক্রমশ আরও শক্ত করে বিঁধে যায়। মাছটা হাঁসফাঁস করে, কিন্তু মুক্তি
মেলে না।
সাহেবের বাসা থেকে বেরুতেই জয়নাব দেখতে পেল- মতি হন্যে ছুটে
আসছে তারই দিকে। কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল- খালা, বস্তি ভাইঙা দিছে, তুমি
তাড়াতাড়ি চল। জয়নাবের তখন দিশেহারা অবস্থা। সে মতির পিছু-পিছু প্রায় দৌড়ে ছুটে
চলে।
মহিদুল
আজ রিকশা নিয়ে অনেক দূর চলে গিয়েছিল। সাধারণত এতদূর যায় না সে, এলাকার মধ্যেই
রিকশা চালায়। আজ একজন বৃদ্ধ মানুষের অনুরোধ ফেলতে পারলো না। দু’দিন ধরে ছেলেটার
অসুখটা বেড়ে গেছে, ট্রিপ নিয়ে বস্তির কাছাকাছি ফিরলেই ছেলেটাকে দেখে যায়। আজ ফিরতে ফিরতে প্রায় দুপুর গড়িয়ে গেল। রিকশা নিয়ে
এলাকার রাস্তায় আসতেই তৈয়ব আলী তাকে দেখে বলে উঠল-
এই
মহি, তুই এখনও এইহানে কী করস! তোগো বস্তি তো ভাইঙা দিছে। কালু আর রঙ্গু গ্রুপ
একঘণ্টা ধইরা তাণ্ডব চালাইছে।
মহিদুল
চমকে ওঠে। ওর অসুস্থ ছেলেটা ঘরে একা। ওর পক্ষে ঘর থেকে একা বেরুনো সম্ভব নয়। জয়নাব
এখনও ফিরেছে কি-না সে কে জানে। মহিদুল দ্রুত প্যাডেল মারে।
সকালে
মানুষে গিজগিজ করা বস্তিটা এখন প্রায় ফাঁকা। গুটি কতক লোক তাদের ভেঙে পড়া ঘর থেকে
কিছু কিছু গৃহস্থালির সরঞ্জাম বের করার চেষ্টা করছে। জয়নাব বিহ্বল হয়ে তার ভাঙা
ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকে। পাশে এসে দাঁড়ায় মতির মা। সে জিজ্ঞেস করে- গণ্ডগোলের সময়
তুই কই আছিলি? শান্তরে বাইর করস নাই?
জয়নাবের
মুখে কথা সরে না। ঠিক তখনই ছুটে আসে মহিদুল। সামনের ধ্বংসস্তুপের দিকে তাকিয়ে
জয়নাবকে বলে- শান্ত কই জানু?
জয়নাব
নিশ্চুপ। দু’চোখ বেয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ে।
মহিদুল
সামনে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে যায়। তার ঘর কোথায়? ওখানে তো শুধু ধ্বংসস্তুপ। আশপাশ থেকে
কয়েকজন তখনই ছুটে যায় মহিদুলের ভাঙা ঘরের দিকে। সেও এগিয়ে যায় কিন্তু তার পায়ে যেন
শক্তি নেই! বুকের ভেতরটা দুরু-দুরু করে। শক্ত পায়ে প্যাডেল মেরে সে সওয়ারি নিয়ে কত
দূরদূরান্তে চলে যায়! কিন্তু আজ তার সেই জোর কোথায়? সে কান খাড়া করে শুনতে চেষ্টা
করে শান্তর গলার স্বর। ওখানে কোন সাড়া নেই।
সামনের
জঞ্জাল সরিয়ে মহিদুলের ঘরের দিকে যেতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল যুবকদের। প্রায় আধা ঘণ্টা
পরিশ্রমের পর সবাই ধরাধরি করে শান্তর দেহখানি এনে শুইয়ে দিল সামনের খোলা জায়গায়।
শান্তর শোয়ানো দেহের পাশে ধপ করে বসে পড়লো মহিদুল। দু-হাতে মুখ ঢাকলো।
মতি দৌড়ে
এসে হাঁটুভেঙে বসে পড়লো শান্তর পাশে।
শান্ত,
কথা ক। তোরে আইজ সবচাইতে বড় মাছটা দিমু।
জয়নাব
স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বহুদূর থেকে শুনতে পায় ভাঙনের শব্দ। বুকের মধ্যে যমুনার
কলকল ধারা বয়ে চলে, স্রোতের তোড়ে তার সবকিছু ধুয়ে মুছে যায়। সে হারায় তার
অতীত-বর্তমানের শেষ অবলম্বনটুকুও।
জয়নাব
তাকিয়ে দেখে তার শান্ত শুয়ে আছে। সুস্থ্য সবল দু’টি পা। কে বলবে- গত কয়েকদিন ধরে
বা-পা’টায় ভর দিয়ে দাঁড়াতেই পারেনি ছেলেটি!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন