আমিও ছিলাম তোমাদের মুক্তির মিছিলে-
সেই কালরাত্রির বিভীষিকাময় প্রহরে,
যখন নিভে গিয়েছিলো শহরের সবটুকু আলো,
জলপাই রঙের ট্যাঙ্কের গর্জনে কেটেছে
নগরবাসীর উৎকন্ঠিত রাত- শঙ্কিত, দিশেহারা,
মেশিনগান আর কামানের গোলার আঘাতে
ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলো প্রিয় নগরীর বুক।
বাতাসে পোড়া মাংসের গন্ধ,
লাশের স্তূপ থেকে নেমে আসা রক্তের ধারা
লাল সিঁদুরের রেখা টেনে দিয়েছিল পিচঢালা পথে,
চেনা জনপদ থমকে ছিল মৃত্যুপুরীর নিরবতায়;
জানো- সেদিন আমার বুকেও কান্না জমেছিলো।
গাঁয়ের মেঠোপথে ছুটে বেড়ানো উচ্ছ্বল কিশোরী-
যার চোখে একদিন প্রজাপতির রঙিন স্বপ্ন ছিল,
তারও স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিলো;
প্রিয় সন্তানের মৃতদেহ কাফনে মোড়ানো হয়নি,
চিতায় হয়নি মুখাগ্নি কোন প্রিয় মানুষের হাতে,
শকুনে ছিড়ে খুবলে তুলে নিয়েছে চোখের মণি,
দেখেছি বাকরুদ্ধ জননীর অশ্রুশূণ্য বিস্ফোরিত চোখ।
সোনালি স্বপ্নে বিভোর নববধূর মেহেদীরাঙা হাত
আরও গাঢ় হয়ে উঠেছিলো সীসার আঘাতে,
ঘটি-বাটি-বালিশ আর কাপড়ের পুটুলিটা হাতে নিয়ে
বেরিয়ে পড়েছিল ওরা বাঁচার আশায়;
জানো- সেদিন আমিও ওদের বুকের গভীরে
স্বপ্নভাঙার আর্তনাদ শুনেছিলাম।
পশ্চিমা হায়েনাদের অট্টহাসি শুনেছি নিস্তব্ধ আঁধারে,
দেখেছি এদেশীয় দালালদের নগ্ন উল্লাস,
লুটপাট আর মৃত্যুর উৎসবে মেতে ওঠা।
সেই তমসাঘন দুঃস্বপ্নময় প্রহরে মৃত্যু আর
ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকেও একটি নতুন দেশ
নবজাতকের মত চিৎকার করে কেবল জানান দিচ্ছিলো-
তার ভুমিষ্ট হবার প্রবল আকাঙ্ক্ষার কথা।
সেই রক্তাক্ত সময়, ধর্ষিতার আতঙ্কিত দৃষ্টি,
আর দুঃখিনী মায়ের করুণ চোখের আর্তি
আমার বুকের ভিতরেও জাগিয়েছিলো প্রতিহিংসার আগুন।
আমি তোমাদেরই একজন-
এক নিষ্ঠুরতম মহাযজ্ঞের আগ্নিসাক্ষী,
আমি সেই সময়ের এক- মহাকালের যাত্রী।
ফিরবোনা আর কোনদিন তোমাদের মাঝে,
তবুও থাকবো মিশে এদেশের প্রতিটি ধুলিকণায়;
ঐ লাল-সবুজ পতাকায়।
হে আমার সংগ্রামী নবপ্রজন্ম-
এ দেশ তোমাদের পূর্বপুরুষের রক্তেভেজা;
এ পতাকা রক্ষার ভার কেবল তোমাদেরই।
সেই পুরনো শ্বাপদ নতুন করে জেগে উঠেছে আবার,
চিরচেনা নরপিশাচেরা খামচে ধরেছে
আমার প্রিয় লাল-সবুজ,
ফণা তোলা বিষাক্ত নাগীন ছোবল দিতে সদা প্রস্তুত;
রুখে দাড়াও ওদের।
হে আমার উত্তরসূরীরা, তোমরা জেনে রেখো-
ত্রিশ লক্ষ প্রাণের ত্যাগের ইতিহাসের উপর দাঁড়িয়ে
রক্ত আঁখরে লেখা নাম- বাংলাদেশ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন