শনিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

উপন্যাসঃ ধূসর গোধূলি (পর্বঃ ১১ - ২০)














নাহিদের ছুটি শেষ হয়ে এসেছে। তাকে ফিরে যেতে হবে কর্মক্ষেত্রে। সাত্তার মাস্টারের কথায় আরও কয়েকদিন শ্যামলপুরে থাকার সুযোগ পেল শিউলি। ঠিক হয় এক সপ্তাহ পর দেবর শিপন এসে শিউলিকে নিয়ে যাবে। বড়দিকে পেয়ে অয়ন যেন আর কাছ ছাড়া হতে চায় না। একমাত্র ছোট ভাইটির প্রতি শিউলিরও অনেক টান। ছোটবেলা থেকে শিউলিই ওকে কোলে-পিঠে করে বড় করে তুলেছে। মা ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকত, তাই বেশিরভাগ সময় অয়নকে সামলাতে হত তাকেই।
বড়দি, তুমি কী শহরে চইলা যাইবা?
কেডা কইলো তোরে?
আমি হুনছি। ভাইয়া বাবারে কইতেছিল। আর কয়মাস পরই শহরে বাসা ঠিক কইরা তোমারে নিয়া যাইব।
তাই নাকি? তুই তো অনেক কিছু জাইনা ফেলছস অনু!
, আমি ঠিকই হুনছি। আইচ্ছা বড়দি, শহর কী অনেক দূরে?
না রে, বেশি দূরে না। বেশি দূরে অইলে লোকজন কী এত তাড়াতাড়ি আসা-যাওয়া করতে পারতো?
বড় বড় গাড়িতে কইরা যাইতে অয়, না?
হুম।
কতক্ষণ লাগে?
এই ধর পাঁচ ছয় ঘণ্টা।
এত্ত সময়! তাইলে তো অনেক দূর।
তোর কী শহরে যাইতে খুব ইচ্ছা করে অনু?
, করেই তো। আমি তো কোনোদিন শহর দেহি নাই।
শিউলি হাসে।
তুই দেখবি কোত্থেইকা? তুই তো অইলি হেইদিন। বড় হ, তোরে আমি আমার কাছে লইয়া যামু।
সত্য কইতাছ বড়দি? তাইলে তো অনেক মজা অইবো।
অনু, তুই একটা কাম করতে পারবি?
তুমি কইলে সব করতে পারুম, খালি কও কী কাম?
অয়নের উচ্ছ্বাস দেখে শিউলি হাসে। তেমন কিছু না, হরি কাকাগো বাড়ি গিয়া একটু খবর নিতে পারবি মালতি শ্বশুরবাড়ি থেইকা ফিরছে নাকি?
, হেই কথা? এইডা তো আমি আগে থেইক্যাই জানি। মালতিদি তো কাইলকাই আইছে।
তাই নাকি? তুই ক্যামনে জানলি?
আমি জানুম না! সুবল আর আমি একলগে পড়ি তো। তুমি কী এহনই হরিকাকাগো বাড়ি যাইবা?
দাঁড়া, মা’র কাছে কইয়া আসি।
ওদেরকে রাস্তার দিকে এগুতে দেখে বকুলও পিছু নেয়। অনেকদিন পর বড়দির সাথে আবার হরিকাকাদের বাড়ি যাচ্ছে অয়ন। দুই বোনকে পেছনে ফেলে দৌড়ে ব্রিজের কাছে চলে আসে ও। ঘুরে তাকিয়ে দেখে বড়দি আর ছোটদি এখনো অনেক দূরে। খালের ও-পাড়ে তাকিয়ে দেখে সুবলদের বাড়ির সোজাসুজি ঘাটে জাল ধুচ্ছে গোপাল। খালের দুই পাড়েই কিছুদূর পর পর নারিকেল গাছ দিয়ে বানানো ঘাট। যাদের বাড়ি খালের কাছাকাছি এগুলো তাদেরই বানানো। অনেকেই এই ঘাটে গোসল করে। কিছুক্ষণের মধ্যে ব্রিজের কাছে পৌঁছে যায় শিউলি আর বকুল। শিউলিকে দেখে অয়ন বলে,
বড়দি দ্যাহো, খালের পানিগুলান কেমন কইরা গড়গড়াইয়া ঐদিগে ছুইটা যাইতাছে! আইচ্ছা বড়দি, এই পানিগুলান কই যায়?
এইগুলান উজানগাঙে গিয়া পড়ে। ভাটার সময়ে পানিগুলান এই খাল দিয়া সব নদীতে গিয়া পড়ে আবার জোয়ার আইলেই নদী থেইকা পানি আইসা খাল বিল সব ডুইবা যায়।
, আইচ্ছা।
মূল ফটক দিয়ে ঘোষ বাড়িতে ঢুকতেই শিউলির চোখে পড়ে বিজয়া বাড়ির উঠোনে নানান ধরনের আচার শুকাতে ব্যস্ত। শিউলির দিকে চোখ পড়তেই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। মুখে চিরচেনা সেই স্বভাবসুলভ হাসি। শিউলি কাছাকাছি পৌঁছালে তাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
আরে, এ কারে দ্যাখতাছি! নতুন মানুষ আমগো বাড়ি?
আমি নতুন মানুষ কাকী? আমারে এতো তাড়াতাড়ি পর কইরা দিলা?
আমরা পর করুম ক্যান? বিয়ার পর মাইয়ারা আর নিজেগো থাহে না রে মা! শ্বশুরবাড়িই তার আপন হইয়া ওডে। এই দ্যাখ, আমি তো বাপের বাড়ির কতা ভুইলাই গ্যাছি। একটা সত্যি কতা কমু?
শিউলি হেসে বলে- কও।
তুই আগের চাইতে অনেক সুন্দর অইয়া গ্যাছোস।
শিউলি লজ্জা পায়। চারদিকে তাকিয়ে বলে- আচ্ছা মালতি কই?
উত্তর বাগানে। সুবলরে দিয়া চাইলতা পাড়াইতাছে।
সুবল বাগানে- শুনতে পেয়েই অয়ন সেদিকে ছোটে। ওদের বাগানের প্রতিটা জায়গাই অয়নের চেনা, অনেকটা নিজেদের বাড়ির মতোই। কিছুদূর গিয়ে দেখতে পায় বাগানের মধ্যে ছোট পুকুরটার পাড়ে চালতা গাছের অনেক উপরে উঠে সুবল কচি ডালে ঝুলন্ত চালতা পাড়ছে। অয়নের মন খারাপ হয়। মনে মনে ভাবে, ও কখনো এমন করে পারবে না। আসলে ও অনেককিছুই পারে না, যা সুবল আর মিরাজ পারে।
অয়নকে দেখেই মালতি বলে ওঠে,
আরে, অনু যে! কহন আইলি?
এই তো এহনই আইলাম।
শিউলি কেমন আছে রে?
ভালো, বড়দি আমার লগে আইছে তো।
শিউলি আইছে? আমগো বাড়ি?
অয়ন মাথা নাড়ে। মালতির চোখ দু’টোতে খুশির ঝিলিক খেলে যায়। গাছের উপর দিকে তাকিয়ে সুবলকে বলে- আর লাগব না, এহন নাইমা আয় সবু’। চালতার ঝুড়িটা ওখানে ফেলে রেখে ভেতর বাড়ির দিকে দৌড় দেয় মালতি। উঠানের প্রান্তে এসে দেখে ঘরের সামনের সিঁড়িতে বসে মায়ের সাথে গল্প করছে শিউলি। মালতি নিঃশব্দে এগিয়ে এসে পেছন থেকে শিউলির চোখদু’টো চেপে ধরে। শিউলি বেশ বুঝতে পারে এটি কার কাজ। হাত দু’টো ধরে একটানে মালতিকে সামনে নিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে।
অনেকদিন পর দেখা। দু’জনের মুখেই যেন খই ফোটে। গত ছয় মাস ধরে কত না বলা কথা জমে আছে মনে!
চালতার ঝুড়ি নিয়ে উঠানে এসে সুবল দেখে বড়দি শিউলিদি’র সাথে গল্পে মশগুল। ঝুড়িটা উঠানে ফেলে রেখেই অয়নকে বলে,
অনু, ল আমরা ডোঙা নিয়া বিল থেইক্যা ঘুইরা আহি। যাবি?
ডোঙা বাইবো কেডা?
ক্যান? আমি বামু।
তুই পারোস?
পারুম না ক্যান? আমি একলা একলা ডোঙা নিয়া কতদূর চইলা যাই! তুই যাবি আমার লগে?
ল যাই।
সুবল দখিন-দ্বারের পাশের খাড়ির কাছে এসে দেখে ডোঙাটা ঘাটেই ভিড়ানো। গোয়ালঘরের মাচা থেকে লগিটা নিয়ে ডোঙায় গিয়ে ওঠে। অয়ন উঠে পড়লেই লগি দিয়ে পাড় থেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে নিয়ে আসে ডোঙা। তারপর লগিটাকে উল্টোদিকে নিয়ে এসে ডোঙার মুখটা ঘুরিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকে ভরা বিলের দিকে। প্রথম দিকে দুলুনিতে অয়নের দাঁড়িয়ে থাকতে কিছুটা অসুবিধা হয়; তবে অল্পক্ষণের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়। অয়ন বেশ অবাক হয়ে লক্ষ করে সুবল কেমন বড় মানুষদের মতো লগি দিয়ে ডোঙাটাকে সামলে নিল, আর এখন দক্ষতার সাথেই এটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সুবল আর ও সমবয়সী হলেও সুবল অনেক কাজেই ওর থেকে এগিয়ে। অনেক বেশি সাহসী। অয়ন মনে মনে ঠিক করে এখন থেকে ওকেও এগুলো শিখতে হবে। দু’পাশে লম্বা ঘাস আর ভেসে থাকা কচুরিপানার মধ্যে দিয়ে ছুটে চলে ওদের তরী। বড়দের ছত্রছায়া ছেড়ে এই প্রথম অয়ন মুক্ত স্বাধীনতার স্বাদ পাচ্ছে।
সুবল, আমারে লগি বাওয়া শিখাবি
, শিখামু না ক্যান? আয়, আমার কাছে আগাইয়া আয়।
অয়ন সুবলের কাছে এগিয়ে আসে। সুবল লগিটা অয়নের হাতে দিয়ে দেখিয়ে দেয় কীভাবে পানির মধ্যে ডুবন্ত মাটিতে খোঁচা দিলে ডোঙাটা সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। অয়ন অবশ্য সেভাবেই চেষ্টা করে কিন্তু বুঝতে পারে না কেমন করে যেন ডোঙাটা ঘুরে যায়। সুবল আবার দেখিয়ে দেয় এমন হলে লগিটা অন্য পাশে নিয়ে আবার সামনের দিকে ধাক্কা দিতে হয়। অয়ন আবারও চেষ্টা করে কিন্তু এবার ডোঙাটা অন্যদিকে ঘুরে যায়। শেষমেশ বলে ওঠে, না রে! আমি মনে অয় পারুম না, আমি আসলে কিচ্ছু করতে পারিনা। সুবল বলে, প্রথম প্রথম এমনই অইবো, আরও চেষ্টা কর দেখবি ঠিক অইয়া গ্যাছে। আমিও তো অনেকদিন পারি নাই, কাকা আর গোপালদার লগে ডোঙায় চইড়া একটু একটু কইরা শিখছি। তুই মাঝে মধ্যে আমগো বাড়ি আহিস, আমি তোরে শিখাইয়া দিমু। এরপর বেশ কয়েকবার চেষ্টার পর কিছুটা উন্নতি হয় অয়নের। সুবল অয়নের চেষ্টা দেখে অনেকটা বড়দের মতো করে বলে,
আইজ থাউক। আইজক্যা তো প্রথম, আস্তে আস্তে দেখবি একদিন পুরাপুরি শিইখা গেছস।
, আইজ আর না। ল, ফিরা যাই।
মালতির সাথে গল্পে মশগুল শিউলি। বকুল এসে বাড়ি যাবার কথা বলতেই শিউলির খেয়াল হয়- কখন যে দুপুর গড়িয়ে গেছে টের পায়নি কেউ। এখন যাওয়া দরকার।
অয়ন কই রে? বাড়ি যাওয়া দরকার তো।
সুবলের লগে খেলতাছে মনেহয়। মালতি বলে।
অয়নকে বাড়ির ভিতরে কোথাও খুঁজে না পেয়ে বকুল খুব অস্থির হয়ে ওঠে। শেষমেশ ওর চোখে পড়ে বিলের পানিতে ডোঙায় করে সুবলের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাড়ি থেকে বেশ দূরে চলে গেছে ওদের ডোঙা। অয়নকে কখনো একা ছাড়ে না, তাই বকুল বেশ ভয় পেয়ে যায়। শিউলি কাছে এসে দাঁড়াতেই বকুল বলে,
দ্যাখ বড়দি, অনু কতদূর চইলা গ্যাছে!
চারু বকুলকে আশ্বস্ত করে বলে,
সুবল ভালোই ডোঙা বাইতে পারে, ডরানের কিছু নাই।
তোরা অনুরে এতডা ঘরকুনা কইরা রাহস ক্যান? ও তো একটা ছেলে, অর সবকিছু শিখন লাগবো না? বকুলের অস্থিরতা দেখে মালতি বলে।
ও অনেক চঞ্চল মালতিদি। চারদিগে এত পানি, জোঁক- তাই ডর লাগে।
গাঁয়ের ছেলে, চঞ্চল হওয়াই ভালো। অরে ছাইড়া দে, দেখবি নিজেই সবকিছু শিইখা নিবে।
বকুলের অস্থিরতা তবুও দূর হয়না দেখে গোপালকে ডেকে চারু বলে,
ও গোপালদা, সুবলরে একটু ডাইক্যা দাওনা, বকুলরা অনু’রে নিয়া বাড়ি ফিরব।
গোপাল বেশ জোরে সুবলের নাম ধইরা কয়েকবার ডাক দেয়। সুবল বিলের মাঝে থেকে বাড়ির দিকে ফিরে তাকিয়ে দেখতে পায় চারু হাতের ইশারায় ওদেরকে ফিরে আসতে বলছে।
, আমরা দখিন-দ্বারে গিয়ে বসি। শিউলিকে বলে মালতি।
দখিন-দ্বারের কথা শুনে মুখে হাসি ফোটে শিউলির।
তোগো দখিন-দ্বারে বসার লোভ আমার কোনোদিনই শ্যাষ অইবো না।
আমারও। বাড়ি থেইক্যা যাওনের পর এই জায়গাডার লইগ্যা মনডা খুব কান্দে রে শিউলি। মালতি বলে।
বাড়ির দক্ষিণ দিকে ছোট-বড় গাছপালায় ঘেরা একটুকরা সবুজ চত্বর। এই জায়গাটির তিনদিকেই খোলা জমি। মাথার উপরে ডালপালা ছড়ানো বড় একটা রেইন-ট্রি আর একেবারে বাড়ির কিনার ঘেঁষে কৃষ্ণচূড়া গাছটা ছায়া দিয়ে ঢেকে রেখেছে ছোট্ট চত্বরটিকে। সকাল বিকাল দক্ষিণের খোলা জমির উপর দিয়ে হু-হু হাওয়া এসে জায়গাটিকে শীতল করে রাখে। গ্রীষ্মের প্রচ- দাবদাহেও এখানে প্রশান্তির আবেশ ছড়িয়ে পড়ে। এ বাড়ির বাসিন্দারা এই চত্বরটির নাম দিয়েছে ‘দখিন-দ্বার’। বাড়ির প্রত্যেকের কাছেই এই স্থানটি বিশেষ প্রিয়।
দখিন-দ্বারে গাছের ছায়ায় বাঁশের তৈরি বেঞ্চে বসে ওরা চারজনে গল্প-কথায় মেতে ওঠে আবার।
পুকুরের পাড় ধরে শিখাকে হেঁটে আসতে দেখেই দুষ্টুমিটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো চারুর। ও হঠাৎ বলে উঠলো,
ঐ যে আমার মাস্টার মশাই আইসা গেছেন।
শিখাদি আবার 'মশাই' অইলো ক্যামনে? চারুর কথার রেশ ধরে বলে উঠলো বকুল।
তুই বুঝবি না, সিক্রেট ব্যাপার। 
শিউলিকে দেখে হাসিমুখে তার দিকেই এগিয়ে গেল শিখা।
আরে শিখা যে! আইজ ভাগ্যটা অনেক ভালো, সবার লগে দেখা হইয়া গেল। শিখাকে দেখে বলে উঠলো শিউলি।
শিউলিদি তুমি কবে বাড়ি আইলা?
এই তো, তিন দিন অইলো আইছি।
তোমারে অনেক সুন্দর লাগতাছে।
ক্যান, তুই কী কম সুন্দর?
তুমি যে কী কওনা! তোমার লগে কী আমার তুলনা চলে? আশেপাশে দুই-চার গ্রামে তোমার ধারে-কাছে কেউ আছে?
তূলনা করতে অইবো ক্যান, তোর চোখ দুইটা কখনো আয়নায় দেখছোস? আমার বিশ্বাস, তোর একটা সুন্দর বর জুটবো।
শিখা হাসে। চারুর দিকে তাকাতেই ওর সাথে চোখাচোখি হয়। চারুর চোখেমুখে দুষ্টুমি, কিছু বলতে গিয়ে দেখে শিখা কড়া চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। দু'হাতে মুখ ঢেকে হাসি লুকায়। শিউলি কিংবা মালতি কিছু লক্ষ করে না, তবে বকুল বোঝে কিছু একটা লুকাচ্ছে চারু। ও স্মিত হেসে চারুর উদ্দেশ্যে বলে,
কি রে, তুই তখন থেইক্যাই শিখাদি'র লগে এমন করতাছস ক্যান, কী হইছে?
কইছি না তোরে কওয়া যাইবো না, সিক্রেট ব্যাপার। বকুল কপট রেগে বলে।
কথায় কথায় সময় যেন উড়ে চলে। এর মধ্যেই ডোঙা নিয়ে ফিরে এসেছে অয়ন আর সুবল। শিউলি সবার উদ্দেশ্যে বলে,
বেলা অনেক অইছে, এইবার গেলাম, তোরা বিকালে আসিস।
অয়নকে দেখে অনেক খুশি মনে হয়। শিউলির কাছে এগিয়ে এসে বলে,
জানো বড়দি, সুবল অনেক ভালো ডোঙা বায়। আমরা তো অনেকদূর চইলা গেছিলাম।
হুম, খুব মজা লাগছে না? এহন বাড়ি লও।
দুপুর ঘনিয়ে গেছে বেশ আগেই। প্রতিদিন মন্টু মামার সাথে গোসল করে অয়ন। আজ বাবাকে পুকুরে আসতে দেখে তাঁর সাথে নেমে পড়ল। মন্টু সাঁতার শিখিয়েছে ওকে, তবে এখনো একটানা বেশিক্ষণ ভেসে থাকতে পারে না। একটি কলাগাছ কেটে পুকুরে ভাসিয়ে রেখেছে মন্টু, অয়ন গোসলের সময় ওটাকে আঁকড়ে ধরে সারা পুকুরজুড়ে সাঁতরে বেড়ায়। এই পুকুরের মাঝখানটা অনেক গভীর। অয়ন অনেকদিন ডুব দিয়ে মাটি তুলে আনার চেষ্টা করেছে, পারেনি। কোনোদিন মাটি ছুঁতেই পারেনি। যত নীচে যাওয়া যায় পানি ততই ঠা-া। গরমের সময় ও অনেকক্ষণ ধরে পানির নিচে ডুব দিয়ে থেকেছে। মন্টু মামা অনেক ভালো সাঁতার জানে। এক ডুবে একেবারে পুকুরের মাঝখানে চলে যায়। ডুব দিয়ে মাছও ধরতে পারে। একদিন ঘাটের নিচ থেকে খালি হাতেই শিং মাছ ধরেছিল।
অনেকক্ষণ সাঁতার কাটার পর বাবা বললেন-এইবার উইঠা আস বাজান, বেশিক্ষণ পানিতে থাকলে ঠা-া লাইগা যাইব।
সকাল থেকে অস্থির হয়ে আছে অয়ন। সুবল এসে পড়েছে সেই কখন! দুজনে মিলে ছাড়াবাড়ির মধ্যে মৌমাছির বাসাটা আরেকবার দেখে এসেছে। পুকুরঘাটে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো ছমির আর মালেকের জন্য। অয়নদের ছাড়াবাড়ির মধ্যে একটি আমগাছে মৌমাছির বাসা। অয়ন আর সুবল অনেকদিন ধরেই বাসাটা দেখে আসছে। আজ ওটা কাটা হবে। মন্টু মামা বলেছে ওরা এসে পড়লেই মধু কাটতে যাবে।
সুবল বলেÑ জানোস, মৌমাছির ঘাই খাইলে জ্বর আইসা যায়। গ্যাছেবার আমগো গোপালদা’র হইছিল। ধোঁয়া দিলে মৌমাছিগুলান উড়তে থাহে, তহন মাটিতে বইসা পড়তে হয়।
দু’জনে কথা বলার ফাঁকে ছমির আর মালেক এসে হাজির হয়। বাগানের পথ ধরে মন্টুর পেছনে পেছনে এগিয়ে গিয়ে বড় আমগাছটার নিচে দাঁড়ায় ওরা। উপরে তাকিয়ে দেখে চাকের চারপাশে মৌমাছিগুলো ভনভন করে উড়ে বেড়াচ্ছে। ছমির গাছের কাঁচা পাতা, ডাল আর খেড় দিয়ে তৈরি আটিটাতে আগুন ধরিয়ে ধোঁয়া তৈরির কাজটা শুরু করে দেয়। অয়ন কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে দেখে ধোঁয়াটা কেমন ফণা তোলা সাপের মতো কু-লী পাকিয়ে উপরদিকে উঠে যাচ্ছে আর ছড়িয়ে পড়ছে মৌমাছির চাকের আশেপাশের অনেকটা জায়গা জুড়ে। মৌমাছিগুলো মৌচাক ছেড়ে আকাশের দিকে ছড়িয়ে পড়ে, কয়েকটা কাছাকাছি আসতেই দৌড়ে একটু দূরে গিয়ে মাটিতে বসে পড়ে ওরা। কিছুক্ষণের মধ্যে বাসা ছেড়ে অনেক দূরে উড়ে যায়। অয়নের খারাপ লাগে ওদেরকে বাসা থেকে তাড়িয়ে দেয়ার জন্য। মন্টু মামা খেজুরগাছ কাটার বড় ধারালো দা’টা দিয়ে কেমন কচ করে কেটে দিল চাকটা, নিচে মালেকের ধরে রাখা বড় পাত্রটা পুরোটাই ভরে গেছে। কেটে ফেলা চাকটার সাথে তখনও কয়েকটা মৌমাছি লেগে ছিল।











বটতলা ঘাটের উত্তর পার্শ্বে উজানগাঙের পাড় ঘেঁষে হারু গাজীর চালের আড়ত। এখান থেকে নদীর পাড় ধরে বড় নদীর মোহনার দিকে ছুটে চলা বেড়িবাঁধের অনেকটাই চোখে পড়ে। বটতলা ঘাট ছাড়িয়ে উজানপুর গ্রামে ঢোকার রাস্তার মুখেই তার স-মিল। হারু গাজীর ছোট ভাই মজনু স-মিলটা দেখাশোনা করে। তবে চতুর হারু গাজী নিজেও তার আড়তে বসে স-মিলে গাছ ওঠানামা লক্ষ করে। দেখতে কিছুটা স্থূলকায় ছোটোখাট গড়নের হারু গাজীর শারীরিক গড়নের মতোই চরিত্রের স্থূলতা সদা প্রকাশ্যমান। কোনো রাখঢাক নেই। পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই বয়সে ঘরে দুইটি বউ থাকতে মেয়েমানুষ দেখলে এখনো তার শরীরে উথাল-পাথাল ঢেউ খেলে যায়। চালের আড়তে কাজ করা মধ্যবয়স্কা মহিলাদের ঘর্মাক্ত শরীরও তার দৃষ্টি এড়ায় না।
প্রতিদিন বস্তায় বস্তায় ধান ভ্যান-নৌকা করে আড়তে আসে। পাঁচ ছয়টা মেশিনে ধান ভেঙে তুষ আলাদা করে বস্তায় চাল ভরা চলছে। নারী-পুরুষ মিলে দশ পনেরো জন লোক সবসময় কাজ করে। যদিও আগে থেকেই হারু গাজীর বাবা হাশেম গাজীর আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো ছিল, তবে স্বাধীনতার পর হারু গাজীর ব্যবসা যেন আরও ফেঁপে-ফুলে উঠেছে। শোনা যায়, মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকে এরা আশেপাশের গাঁয়ের হিন্দু পরিবারগুলোর উপর অত্যাচার শুরু করে। তারপর অনেক হিন্দু পরিবার গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেলে ওদের ধন সম্পদ লুট করতেও দেখেছে কেউ কেউ। যুদ্ধের শেষদিকে হাসেম গাজীকে মুক্তিযোদ্ধারা মেরে ফেলে। তখন কিছুদিন হারু গাজী মোটামোটি আড়ালেই ছিল, তারপর একসময় আবার বাড়তে থাকে তার প্রভাব প্রতিপত্তি। ধীরে ধীরে স-মিল, ধান-চালের আড়ত, হাটের ইজারা; এসব করে গ্রামে বেশ শক্ত অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে মেম্বার হতে না পারলেও নিজের নামের সাথে মেম্বর কথাটি জুড়ে যায়। সেই থেকে কারো কারো কাছে হারু গাজী হয়ে যায় হারুন মেম্বার ওরফে হারু মেম্বর।
দিনের শেষ ভাগে চালের আড়তে বসে আছে হারু গাজী। গদিতে বসে পান চিবাতে চিবাতে হাঁক দেয়Ñ এই তোরা তাড়াতাড়ি কর। সন্ধ্যার আগে কাম শ্যাষ করতে না পারলে সবগুলার হাজিরা কাটুম।
সবাই তাড়াতাড়ি কাজে হাত লাগায়। জানে, হারু গাজী সারাক্ষণ হাজিরা কাটার ধান্ধায় থাকে, সুযোগ পেলে ঠিকই টাকা কেটে রাখবে হারামিটা। সন্ধ্যার একটু আগে আড়তের দরজায় এসে দাঁড়ায় বিভা। তাকে দেখে হারু গাজীর মুখে কপট হাসি দেখা যায়।
এই যে পুন্নিমার চাঁন, আপনে আইছেন? যহন কামে হোগগলের দম বাইর হইয়া যায় তহন আপনারে দেহা যায় না, এহন বুজি টাকা পয়সায় টান পড়ছে? তাই এইহানে ধরনা দিতে আইছেন। পান চিবাতে চিবাতে বলে হারু গাজী।
না মেম্বরসাব, এ কয়দিন ঘরডা ঠিক করনের লইগ্যা বাড়ি থেইক্যা বাইর অইতে পারি নাই।
নতুন ঘর তোলেন, তাইলে তো আপনের মেলা টাকা! কামের দরকার কি?
বিভা ম্লান হেসে বলে- মেম্বরসাব, আমি টাকা পামু কই? বৃষ্টিতে ঘরের চালডা নষ্ট অইয়া গ্যাছিলো। মাস্টারচাচায় কয়ডা খ্যাড় দিছে আর ছমির ভাই মাগনা চাল ছাইয়া দিছে।
আইজকা দিন শ্যাষ, আর কামে নেওন যাইব না। কাইলকা আইও।
আইচ্ছা। বলে বাড়ি ফেরে বিভা।
সকালে উঠেই কাজে যাবার জন্য তাড়াহুড়া শুরু করল বিভা। সময়মত চালের আড়তে যেতে না পারলে কাজে নিবে না হারু গাজী।
এই প্রভা ওঠ। আমার এহনই বাইর হইতে অইবো।
তুমি একদিনও আমারে ঠিক মতোন ঘুমাইতে দেও না।
খালি ঘুমাইলেই অইবো? স্কুলে যাওন লাগবো না?
স্কুলের এহনও দেরী আছে।
আমি মেম্বরের আড়তে কামে যাইতেছি, পাতিলায় কয়ডা ভাত আছে, তুই খাইয়া স্কুলে যাইস। আমার আইতে দেরী অইলে কয়ডা মুড়ি খাইয়া নিস।
আইচ্ছা, তুমি যাও।
ঝটপট কিছু মুখে দিয়েই বাজারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে বিভা। বাড়ির পাশের সরু রাস্তা থেকে বড় রাস্তায় উঠতেই চোখে পড়ে মনু মিয়া মসজিদের সামনে থেকে হেঁটে এদিকেই আসছে। পেছনের মাদ্রাসা থেকে উচ্চস্বরে ছেলেমেয়েদের আরবি পড়ার শব্দ ভেসে আসে। তাড়া থাকায় কিছুটা জোড়েই হাঁটে বিভা। হঠাৎ মনু মিয়ার কণ্ঠ শুনে ঘুরে তাকায়।
এইভাবে মাথার কাপড় ফালাইলা এত্ত জোরসে হাঁটতে নাই মেয়েছেলেদের।
ভুল হইয়া গ্যাছে ছোড হুজুর। বিভা মাথার কাপড় ঠিক করে নেয়।
এত্ত ভোরে ছোটাছুটি কইরা কই যাও?
মেম্বরের আড়তে যামু, দেরী হইলে মেম্বার আবার রাগ করে।
ওইহানে সব বেগানা পুরুষগো লগে মেয়েছেলেরা কাম করে, যত্তসব বে-শরিয়তি কাজ!
হুজুর, ঠেকায় পইড়া ওইহানে কাম করি। কাম না করলে খামু কি? আমার তো আর আয়-রোজগারের কেউ নাই।
আল্লার উপর তোমগো ভরসা নাই, তোমগো বুঝাইয়াও কোনো লাভ নাই।
বিভা মাথা নিচু করে বাজারের দিকে হাঁটে। হারু গাজীর আড়তে গিয়ে দেখে দিনের কাজ কেবল শুরু। হাসু’র মা ঝাড়ু দিতে ব্যস্ত আর জয়নাল গতকালের জমানো ধান ভাঙানোর প্রস্ততি নিচ্ছে। বিভাকে দেখে হাসুর মা হেসে বলে,
বিভা আইছস? আয়, হেই কহন ঘর খুলছে আর এহন পর্যন্ত কারো দেহা নাই। আমি একলা কত কাম করুম, ক’? টাকার বেলায় তো হগগলেই সমান! আয়, আমার লগে একটু হাত লাগা।
ঠিক আছে চাচি; ঝাড়ুটা আমারে দেও।
নে, সাবধানে কাম করবি, মেম্বরের কিন্তু নজর ভালো না।
বিভা হেসে বলেÑ আমি জানি চাচি, এই ব্যাডার এইহানে কাম করতে মন চায় না, কিন্তু কী করুম কও? ঘরে এক মুঠ চাউলও নাই।
বলা আর একটু গড়ালে লোকজনের ভিড় বাড়ে, বাড়ে ব্যস্ততা। ভ্যান, নৌকা করে ধান এসে আড়তে জমে। রুস্তম গদিতে বসে পুরানো হিসাব দেখছে, এমন সময় হারু গাজী দোকানে ঢুকে হাঁক দেয়।
কী রে, হগগলে আইছে তো ঠিক মতোন?
হ মেম্বরসাব, হগগলেই আইছে। খালি বারেক মিয়া আহে নাই, হের জ্বর হইছে। কইছে হের একটু দেরী অইবো।
ওরে কইয়া দিস, আইজকা ওর হাজিরা কাটা। হালার পুতগুলান কামের সময় খালি ফাঁকি মারনের ধান্ধায় থাকে।
তুমি দেহি আইজকা ঠিক সময় মতোনই আইয়া পড়ছ। ঠিকমত কাম কর, ফাঁকি মারনের চেষ্টা কইরো না। বিভাকে দেখে বলে ওঠে হারু গাজী।
না মেম্বর সাব, ফাঁকি মারুম ক্যান?
হারু গাজী গদিতে বসে হিসাব দেখে আর কিছুক্ষণ পর পর ঘরের মধ্যে চোখ বুলায়, দেখে কী কি করে। একটু পর পর গদির পাশে রাখা চিলমচিতে পানের পিক ফেলে। মাঝে মধ্যেই লালচে তরল ঠোঁট বেয়ে নেমে কাঁচাপাকা দাঁড়িতে মিশে যায়।
কাপড় ঠিক কর। কানের কাছে ফিসফিস করে বলে হাসুর মা।
বিভা ঘুরে তাকিয়ে দেখে- কাজের এক ফাঁকে আঁচলটা শরীর থেকে খসে পড়েছে। কাপড় ঠিক করতে করতে গদির দিকে চোখ পড়ে বিভার। দেখে হারু গাজী সোজা তাকিয়ে আছে ওর শরীরের দিকে। লালচে দাঁত বের করে দাঁড়িতে হাত বোলায়। নির্লজ্জ দু’চোখে লোভী দৃষ্টি। বিভা চোখ ফিরিয়ে নেয়। হাসুর মা’র দিকে ফিরে ফিসফিস করে বলে,
দ্যাহো চাচি, ইতরডা কেমন কইরা চাইয়া আছে।
জানি। তোরে তো আগেই কইছি, সাবধানে চলবি।
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একনাগাড়ে কাজ করে সবাই ক্লান্ত। আজকের মতো কাজ শেষ করে বাড়ি ফেরার জন্যে তৈরি হয় বিভা। হারু গাজীর কাছে গিয়ে বলে,
মেম্বরসাব, আমি এহন যাইতে পারি?
এহনি যাবা?
বাড়িতে মাইয়াডা একলা থাকে, ওরে কইয়া আইছিলাম আইজ তাড়াতাড়ি ফিরুম।
আচ্ছা যাও।
হাজিরার টাকা নিয়া বাড়ির পথে পা-বাঁড়ায় বিভা।
বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে গেল বিভার। ঘরে ঢুকে দেখে প্রভা চুপ করে চৌকির উপর বসে আছে।
ভাত রান্ধছিলি ?
প্রভা কোনো জবাব দেয় না দেখে ধমক দেয় বিভা- কী রে, কী কইতেছি হুনস না?
হ রান্ধছি। বলে আবার চুপ করে যায় প্রভা।
প্রভা, কী অইছে তোর? এই রহম ভূতের লাহান গুম মাইরা বইয়া ক্যান?
কিছু অয় নাই, এমনেই।
দু’জনেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।
এই প্রভা খাইতে আয়। ভাত বেড়ে ডাক দেয় বিভা।
প্রভা চুপ করে বসে থাকে। বিভা রেগে বলে,
কি রে, তোরে কী কোলে কইরা আনতে অইবো? সারাদিন কাম কইরা শরিলডা ব্যাতা করতাছে, তারপর নবাবজাদীরে আবার সাইধা খাওয়াইতে অইবো!
প্রভা চৌকির উপর থেকে নেমে আসে, চুপচাপ খেয়ে উঠে যায়। মুখটা তেমনি আগের মতোই ভার। বিভা কিছুটা নরম হয়ে বলে,
-প্রভা, কী অইছে আমারে কইতে পারস না?
মা, আমার বাবায় মইরা গ্যাল ক্যান? দু’চোখে পানি টলমল করে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিভা।- কী করুম মা, আমগো কপাল খারাপ, না অইলে আমগো নিজেগো বাড়ি ক্যান নদীতে ভাইংগ্যা যাইবো আর তোর বাপ ক্যান অকালে মইরা যাইবো? আইজক্যা তোর বাপের কতা মনে পইড়া খারাপ লাগতাছে মা?
বাপ নাই তাই হগগলেই আমগো দূর দূর করে।
প্রভা, তোরে কেউ কিছু কইছে?
বিহাল বেলা দীঘির পাড়ে নানার লগে দ্যাহা। হেয় আমারে কয়- থাকতে দিছে দেইখা আমরা নাকি তার সব দহল কইরা লইছি। একদিন লাত্থি মাইরা খ্যাদাইয়া দেবো। মায়ের বুকে মুখ লুকায় প্রভা।
বিভা বোঝে, ওদের তাড়াতে পারলেই চাচা খুশি। কিন্তু মেয়েটাকে নিয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সে? কত কষ্ট করে জীবন কাটাচ্ছে। কখনো চালের আড়তে, কখনো মানুষের বাড়িতে কাজ করে খেয়ে না খেয়ে কোনো রকম দিনগুলি পার করছে। কোনোদিন চাচাকে বিরক্ত করেনি, শুধু থাকার জন্যে একটু জায়গা দিয়েছে। জানে, বাবা কিছুই বিক্রি করে যায়নি। বলতে গেলে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে সে। ওর বিয়েতেও তেমন কিছু খরচ করেনি চাচা। কোনো রকম বিদায় করেছে তাকে। সবই তো সে দখল করছে। আজ এই আশ্রয়টুকুও কেড়ে নিতে চায়!
প্রতিদিন সকালে, সূর্য ওঠার পর পরই মসজিদের সাথে লাগোয়া ছোট্ট ঘরটায় ছেলেমেয়েরা উচ্চস্বরে আরবি পড়ে। মসজিদের পাশে একটি আলাদা ঘর। বাঁশের খুঁটির উপরে গোলপাতার ছাউনি দেয়া ঘরটার চারপাশে কোনো বেড়া নেই। ঘরের মেঝেতে খেজুর পাতার পাটিতে বসে সকাল থেকে বিভিন্ন বয়সী ছেলেমেয়েরা আরবি পড়ছে। বয়সে বড় ছেলেমেয়েরা কোরান আর অপেক্ষাকৃত ছোটরা পড়ছে আমপারা। পৌষের হাড় কাঁপানো শীতে কিংবা গ্রীষ্মের মাঠঘাট ফেটে চৌচির হওয়া গরমে, কখনই বন্ধ হয়না মাদ্রাসা। সবাই এতটাই উচ্চস্বরে পড়ছে যে কারো উচ্চারণই স্পষ্ট করে বোঝা যায় না। লম্বা একটা বেত নিয়ে মনু মিয়া মাঝখানে বসে আছে। মাঝে মাঝে ক’গাছা দাড়িতে হাত বুলায় আর হাতের বেতটা ব্যবহার করে কোমলমতি ছেলেমেয়েদের উপর।
উজানগাঙের শেষ মাথায় ছোট্ট একটি গ্রাম কমলডাঙা, যার বেশির ভাগই এখন নদীগর্ভে। মঈনুদ্দিন মিয়া ওরফে মনু মিয়া শ্যামলপুরে এসেছে বেশ ক’বছর আগে। নদীভাঙ্গা কমলডাঙা এলাকার মানুষ। নিজের বাড়িঘর নদীতে বিলীন হবার পর জীবিকার তাগিদে শ্যামলপুরেই বসতি গেড়েছে।
মসজিদ সংলগ্ন এই মাদ্রাসার গোড়াপত্তন হয়েছিলো মাওলানা ইউসুফ আলীর হাতে। বয়োজ্যেষ্ঠ ইউসুফ মাওলানার যে কোনো আহ্বানে গ্রামের মানুষ সাড়া দিতো। তখন মনু মিয়া ছিল মসজিদের মোয়াজ্জিন। কিন্তু রহিম হাওলাদারের মৃত্যুর পর মফিজ মিয়ার স্বেচ্ছাচারিতার কারণে মাওলানা ইউসুফ আলী চলে গেলে মফিজ মিয়া ছোট হুজুর মনু মিয়াকেই মসজিদ এবং মাদ্রাসার দায়িত্ব দেন। মসজিদের পাশেই সপরিবারে তার বসবাস। মফিজ মিয়ার শ্বশুরপক্ষের দূর সম্পর্কের আত্মীয় হওয়ায় মসজিদের পাশে এক টুকরা জমিতে মনু মিয়ার বসবাসের ব্যবস্থা করে দিয়েছে সেই-ই। মসজিদের এই জায়গাটা মফিজ মিয়ার বাবা আজিমুদ্দিন হাওলাদারের দান করা। তাই মসজিদ কমিটি প্রধানের পদটির অধিকার উত্তরাধিকারসূত্রেই মফিজ মিয়াই বহন করে চলেছে বছরের পর বছর।
বড় ভাই রহিম হাওলাদার মারা যাবার পর মফিজ মিয়া তার বাবার সমস্ত সহায় সম্পত্তি নিজের দখলে নিয়ে নেয়। রহিম হাওলাদার মৃত্যুর আগে তাঁর একমাত্র মেয়ে বিভাকে মফিজ মিয়ার হাতে তুলে দিয়ে গিয়েছিলেন। কিছুদিন ভালোই চলছিলো সবকিছু। তারপর একসময় ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে মফিজ মিয়া। বছর খানেকের মাথায় মা মারা গেলে সম্পূর্ণ একা হয়ে যায় বিভা। বিভার বয়স তখন মাত্র তের কী চৌদ্দ। শুরু হয় চাচা চাচির কাছে তার কষ্টের জীবন। এক সময় সে নিজেকে আবিষ্কার করে চাচা-চাচির কাজের মেয়ে হিসেবে। সকাল সন্ধ্যা চাচি পেয়ারা বেগমের গাল-মন্দ আর মারধর খেয়ে বছর তিনেক পার করার পর উজানিচরে এক গরীব ঘরে তাকে বিয়ে দিয়ে আপদ বিদায় করে চাচা মফিজ মিয়া।
শহরে যাবার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় উঠতেই মফিজ মিয়া দেখে দূর থেকে খালেক তালুকদার তাকে ইশারা করে থামতে বলছে। মফিজ মিয়া কিছুক্ষণ দাঁড়ায়। কাছে এসে খালেক বলে,
চাচামিয়া, আমি তো কয়দিন ধইরা আপনেরে খুজতাছি।
ক্যান, কী অইছে? আমার কাছে তোমার আবার কী কাম?
জমিজমা নিয়া কিছু সমস্যায় পড়ছি। ফুপাতো ভাইরা তাগো ফরাজ বুইঝা নিতে চায়। তয়, তাগো হিসাবে কিছুডা গড়মিল দেখতে পাইতাছি। তাই আপনের লগে একটু বুঝতে আইছিলাম।
এ তো অনেক সময়ের ব্যাপার, এইহানে দাঁড়াইয়া তো এতসব কাগজপত্র দ্যাহা যাইব না। রাইতে বাড়ি আইও। আরেকটা কাম অবশ্য করতে পার, তুমি তো শহরে যাও, অইহানেও দ্যাহা করতে পারো।
আইজ একবার অবশ্য শহরে যামু। শহরে আপনেরে ঠিক কোনো জায়গায় পাওয়া যাইব?
তহসিল অফিসের সামনেই তো সারাদিন থাকি। ভুবন পালের গদির সামনে খোঁজ করলেই পাইবা।
আইচ্ছা, আমি ঐহানেই আমুনে।
মফিজ মিয়া বাজারের দিকে পা বাড়াতে গিয়ে দেখে মনু মিয়া তার দিকে এগিয়ে আসছে। কাছাকাছি এসে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
মিয়াভাই কেমন আছেন?
ভালো, আপনের সব খবর ভালো তো? মাদ্রাসায় ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা মনে হয় বাড়ছে।
, ছাত্র-ছাত্রী ভালোাই আইতেছে এহন, তয় সবাই তো টাকা পয়সা দিতে পারে না তেমন!
হাতের পাঁচ আঙ্গুল কী সমান অয়? একটু পরে আমগো বাড়ি যাইয়েন। আপনের লইগা একবস্তা ধান রাখা আছে। সাজুর মা’রে কইয়া রাখছি।
জে মিয়াসাব, আপনের দয়ার শরিল।
মফিজ মিয়া বাজারের পথে চলে যায়। মনু মিয়া তিন রাস্তার মাথায় এসে মফিজ মিয়ার বাড়ির দিকে মুখ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তার দৃষ্টি মফিজ মিয়ার বাড়ির দিকে নয়। সে আসলে তাকিয়ে আছে বাগানের একপাশে বাবলাতলার ছোট্ট কুঁড়েঘরটির দিকে। অনেকদিন থেকেই এই জায়গাটুকুর স্বপ্ন দেখছে মনু মিয়া। মসজিদের পাশের ঐ ছোট্ট জমিটুকুতে ছেলেমেয়ে নিয়ে বেশ কষ্ট হয় তার। মফিজ মিয়ার স্ত্রী পেয়ারা বেগম তাকে একরকম কথা দিয়ে রেখেছে কোনোভাবে বিভাকে তাড়াতে পারলে এই জায়গাটুকু তাকেই দেয়া হবে। সেই থেকেই সে এই জায়গাটুকু পাবার জন্য অধীর অপেক্ষায় আছে।
সাত সকালে ঘুম থেকে উঠে বাংলাঘরে গিয়েই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল পেয়ারা বেগমের। কাল বিকেলে মাড়াই করে রাখা ধানের বস্তাগুলো থেকে একটা উধাও! বুঝতে আর বাকি থাকেনা কাজটা কার। ঘরে ঢুকে বড় ছেলে সাজুকে ঘুম থেকে তুলেই গালাগালি শুরু করে সেÑ
এই হারামজাদা ওঠ।
চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে যায় সাজুর। উঠেই মায়ের অগ্নিমূর্তি দেখে প্রথমে ঘাবড়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশ্য সামলে নিয়ে স্বভাবসুলভ আচরণে ফিরে আসে সে।
কি অইছে? চিল্লাইতাছো ক্যান?
ঐ হারামির বাচ্চা, বাংলাঘর থেইক্যা ধানের বস্তা সরাইছস ক্যান? খাওন কী এমনি এমনি আহে?
আমি সরাইনাই। দ্যাহো তোমার ছোড পোলা সরাইছে নি!
রাজু সরায় নাই। ও কাইল সারাদিন ঘরেই আছিলো। তুই ছাড়া কেউ সরায় নাই। এক্কেরে ঝাড়ু দিয়া বাইড়াইয়া ঘর থেইক্যা বাইর কইরা দিমু বাদাইম্যার বাচ্চা বাদাইম্যা। দুই পয়সা আয় করার মুরোদ নাই, খালি বাপের গোলা খালি করার তালে আছে!
, নিলে আমার বাপেরডা নিছি, তোমার কি?
আহারে! বাপের লইগ্যা যেন দরদ উথলাইয়া উঠছে। এত কইরা কইতাছি বাপের লগে গিয়া সবকিছু শিখ্যা নে, হ্যার লগে দ্যাহা নাই। খালি ঘরে বইস্যা গিলন আর বাদাইম্যার লাহান ঘুইরা বেড়ানো! 
তোমারে কইছি না হ্যার অই কাম আমি শিখুম না। তুমি জানো, হ্যারে পেছনে পেছনে হগগলে দালাল কয়? জমির দালাল।
ও আইচ্ছা! বাপেরে দালাল কয় হেতে তোমার খারাপ লাগে না, তোমারে কইলে মান-সম্মান যাইব, না?
তুমি কী এইহান থেইক্যা যাইবা? বলে কাঁথা গায়ে দিয়ে আবার শুয়ে পড়ে সাজু।
তিনডা মাইয়া পোলা আমার হাড্ডি মাংস জ্বালাইয়া খাইলো’। পেয়ারা বেগম গজগজ করতে করতে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।











প্রতিদিন কোটাখালী খালের পাড়ের রাস্তা ধরে বাড়ি ফেরে প্রভা। বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব খুব বেশি নয়, তবে সমস্যা কেবল তালুকদারের হাটখোলায় বখাটেদের ক্লাবঘরটা। জায়গাটা পার হবার সময় বুকের ভেতর দুরু দুরু ভয় লাগে প্রভার। লোকগুলো কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে আর আজেবাজে কথা বলে। মা’র কথা ভেবে প্রবল ভয়কে উপেক্ষা করে প্রতিদিন এ পথেই স্কুলে আসা-যাওয়া করে সে। মায়ের কষ্ট দেখে তাঁর জন্য কিছু করতে না পেরে ভীষণ মন খারাপ লাগে প্রভার। বাবার মুখটা ভালো করে মনে পড়ে না ওর। বড় হওয়ার পর থেকে দেখে আসছেÑ মা একাই লড়ে যাচ্ছে বাঁচার জন্য। নিজে না খেয়ে হলেও ওর জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেছে। কত গঞ্জনা সহ্য করে ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কখনো মানুষের বাড়ি, কখনো চালের কলে কাজ করে চলেছে। এসব ভাবলে মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় ও নিজে মা’র জন্য কিছু একটা করে। কিন্তু কী করবে? মা চান ও লেখাপড়াটা শিখুক। এইসব মানুষের কু-দৃষ্টি এড়িয়ে মায়ের স্বপ্নের বাস্তবায়ন কতটুকু সম্ভব জানে না প্রভা।
আজও স্কুল থেকে ফেরার সময় তালুকদারের হাটখোলার কাছে আসতেই একই অবস্থা হলো প্রভার। খালের পাড়ের ঘরটায় বসে তাস খেলায় ব্যস্ত হারিছ, পলাশ, কাসেম আর গিয়াস। জায়গাটা পার হবার সময় লক্ষ করে হারু গাজীর ছেলে গিয়াস ওর দিকে তাকিয়ে আছে। প্রায়দিনই এমন করে তাকিয়ে থাকে। তার এই চাহনি দেখে আজও বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে প্রভার। কয়েকদিন আগেও গিয়াস ঐ ঘরের বাইরে এসে পেছন থেকে ওকে ডাকছিল। কোনোদিকে না তাকিয়ে জোরে হেঁটে চলে এসেছিল সেদিন।
প্রভা অনেকটা নিঃশব্দে নিচের দিকে তাকিয়ে হেঁটে চলে কোটাখালী ব্রিজের দিকে। হঠাৎ পেছন থেকে ডাক শুনতে পেয়ে তাকিয়ে দেখে গিয়াস আজও ক্লাবঘর থেকে বের হয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। ভয়টা যেন জাপটে ধরে প্রভাকে! না থেমে জোরে পা ফেলে এগিয়ে চলে। চেষ্টা করে দ্রুত হাঁটার জন্য কিন্তু সময়টা যেন স্থির হয়ে আছে। এই অল্প পথটুকুকে মনে হয় যোজন-যোজন দূর। পেছনে গিয়াসের গলাটা আরও চড়া হচ্ছে। চারিদিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে ভয়ের মাত্রা ধীরে ধীরে চরমে পৌঁছায়। ওর ভেতর থেকে কে যেন বলে, ‘প্রভা পালা। বাঁচতে হলে পালা।’
প্রভা দৌড়ায়। প্রাণপণে দৌড়ায় কোটাখালী ব্রিজের দিকে। মনে মনে বলে, এইতো আর একটু পথ!
হঠাৎ পেছন থেকে একটা শক্ত হাতের থাবা ওর কব্জি চেপে ধরে। থমকে দাঁড়ায় প্রভা।
এই, তোরে না খাড়াইতে কইলাম?
ক্যান, আমার লগে আপনের কী কাম?
তোর লগে কতা আছে।
আমার লগে আপনের কী কতা আবার?
এইহানে কওয়া যাইবো না, ঐদিকে ল। ক্লাবঘরের দিকে দেখিয়ে বলে গিয়াস।
হাত ছাড়েন, ব্যথা লাগতাছে।
গিয়াস হাত ছেড়ে দিয়ে সামনে এসে প্রভার পথ আগলে দাঁড়ায়।
পথ ছাড়েন, আমারে যাইবার দেন।
যাইবার দিমু, আগে আমার লগে ল।
ক্যান, আপনের লগে যামু ক্যান?
গিয়াসের ক্রুদ্ধ দৃষ্টি দেখে কেঁদে ফেলে প্রভা। আমি আপনের কী করছি?
কইছি না ঐদিকে ল, কতা শ্যাষ অইলেই চইলা যাবি।
না, আমি কোনোহানে যামু না।
শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে প্রভা। এদিক-ওদিক তাকায়, কাউকে দেখতে পায় না। আবার প্রভার হাত চেপে ধরে গিয়াস। একরকম টেনে-হিচড়ে নেবার চেষ্টা করে ক্লাবঘরের দিকে। প্রভা জোরে জোরে চিৎকার করে। অকস্মাৎ ব্রিজের দিক থেকে কারো কণ্ঠস্বর শুনে সেদিকে ঘুরে তাকায় প্রভা। চোখে পড়ে তারাপদ ঘোষ ব্রিজের ঢাল থেকে নেমে এইদিকেই আসছে। প্রভা আরও জোরে চিৎকার করে তাঁকে ডাকে। সেদিকে দৃষ্টি পড়তেই ওর হাত ছেড়ে ঘুরে হাটখোলার দিকে হাঁটা দেয় গিয়াস। যাবার সময় বলে- আইজক্যা বাইচা গেলি, একদিন তোরে দেইখ্যা নিমু।
প্রভার পা-দু’টো যেন আটকে যায় মাটির সাথে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারাপদ কাছে এসে জিজ্ঞেস করে,
কি অইছিল রে? ঐ বদমাইশটা তোর লগে এমন করতাছিল ক্যান? কী কয় ও?
আমারে জোর কইরা ঐ ক্লাবঘরে নিতে চাইছিল। আপনে না আইলে যে আইজ কী অইতো!
দেশটা শিয়াল-কুকুরে ভইরা গ্যাছে, যা বাড়ি যা। একলা এইপথে আর আইস না।
প্রভা আর দেরী করে না। নিজেকে রক্ষা করার একটা তাগিদ অনুভব করে। দ্রুত হেঁটে কোটাখালী ব্রিজটা পার হয়। মনে মনে ঠিক করে, এবার মা’কে না বলে আর পারা যাবে না। মায়ের কথা ভবতে ভাবতে বাকি পথটুকু পেরিয়ে বাড়ি পৌঁছে প্রভা।
কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল বিভার। ঘরে ঢুকে দেখে মন খারাপ করে বসে আছে প্রভা। কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
কি হইছে প্রভা? মুখটা এত কালা কইরা বইসা আছোস ক্যান?
মা’কে দেখে সারাদিনের জমিয়ে রাখা কষ্টগুলো বাইরে বেরিয়ে আসে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে,
আমি আর ইশকুলে যামু না, মা।
ক্যান, কী অইছে?
তালুকদারের হাটখোলার ঘটনা মায়ের কাছে খুলে বলে প্রভা।
তুই এতদিন আমারে কস নাই ক্যান?
তুমি চিন্তা করবা হেই লইগ্যা এতদিন তোমারে কই নাই।
ভাবনায় পড়ে যায় বিভা। মনে পড়ে, প্রভার বাবা বলতেনÑ আমার একটা মাত্তর মাইয়া, অরে আমি লেহাপড়া শিখাইয়া মানুষ কইরা তুলুম। প্রভার বাপ আজ নেই, কিন্তু লোকটার স্বপ্ন বাস্তবায়নে বিভা কোনো ত্রুটি রাখেনি এতদিন। নিজে যত কষ্টই করুক, প্রভার গায়ে তার কোনো আঁচ লাগতে দেয়নি। আজ এই বখাটেদের কারণে মেয়েটার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে! কী করবে ও? হারু গাজী নিজে যেমন বদলোক তার ছেলেটাও তেমন। বিভা ভালো করেই জানে হারু গাজীকে বলে কোনো লাভ নেই। সে কিছু করবে না। উল্টা তার আড়তের কাজটা হারাতে হবে তাকে। ভেবে কোনো কূল কিনারা পায়না বিভা।
নির্ঘুম রাতের প্রহর এগিয়ে চলে। নিজেদের অস্তিত্বের সংকট থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজে বেড়ায় অসহায় এক মা। রাতের অন্ধকার কেটে গিয়ে নতুন প্রভাত আসে কিন্তু বিভার মনের অন্ধকার আর কাটে না। বুঝতে পারে জীবিকার তাগিদে তাকে ছুটতে হবে মানুষের বাড়ি কিংবা ঐ হারু গাজীদের মতো লোকদের কাছেই। গরিব মানুষের স্বপ্নপূরণ অনেকটা দুরাশাই বটে, আর অভিভাবকহীন মানুষের অসহায়ত্ব দেখে অনেকেই করুণা করতে পারে কিন্তু তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসার লোকের সংখ্যা অতি নগন্য এই সমাজে। বিভা খুব সহজেই বুঝে যায়- মেয়েটার স্কুল জীবনের এখানেই ইতি ঘটলো।
গত কয়েকদিনের ঘটনাবলি প্রভাকে কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি এনে দাঁড় করায়। ওকে বদলে দেয় অনেকটাই। মাত্র তের বছরের প্রভা যেন হঠাৎ করেই বড় হয়ে যায়। স্কুল বন্ধ হয়ে যাবার পর প্রভার জগতটা অনেক ছোট হয়ে পড়ে। চলাফেরার গ-ি ওদের ঘরের চারপাশটাতেই সীমাবদ্ধ থাকে। এতদিনের চেনাজানা পরিবেশও মনে কেমন ভয় ধরিয়ে দেয়। ঘরের পাশে ঘন জঙ্গল আর দীঘির পাড়ের নির্জনতায় সেই ভয়গুলো যেন আরও গাঢ় হয়ে ফিরে আসে মনে।
আজ তিনদিন ধরে শয্যাশায়ী মমিন। কাল সারারাত জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকেছে। স্বামীর অসুস্থতায় ঘুমহীন রাত কেটেছে পারুলের। মাথায় পানি আর জলপট্টি দেয়ার পর শেষ রাতের দিকে কমে এসেছে কিছুটা। ক্লান্তিতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে টের পায়নি। ছোট ছেলেটার কান্না শুনে ঘুম ভেঙ্গে যায়। উঠে বসতেই দেখে রতন কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ঢুকছে। ‘কী অইছে রে রতন?’ পারুল জিজ্ঞেস করতেই রতন বলে, ‘রাজু মামায় আমগো ছোড ঘরের ধানের বস্তা ধইরা টানাটানি করতাছিল, আমি বারণ করতেই আমারে গলা ধাক্কা দিয়া ফালাইয়া দিল’। পারুল বাহিরে নেমে কোথাও রাজুকে দেখতে পায়না। পেয়ারা বেগমকে জানিয়ে আসে তার নিজের ছেলেদেরকে যেন সামলে রাখে। পেয়ারা বেগমও একচোট নিতে ছাড়ে না, তবে খুব বেশি কথা বাড়ায় না। সে বেশ বোঝে, বিভার মতো পারুলকে কিছু বলে দমিয়ে রাখা সম্ভব না। তাই তাকে বেশি ঘাঁটাতে যায় না।
মমিনের ঘুম ভেঙে গেলে ক্লান্তদেহে উঠে বসে। কয়েকদিনের জ্বরে বেশ দুর্বল হয়ে পরেছে। পারুল ভেজা কাপড় দিয়ে গা মুছিয়ে দিতে দিতে ভাবে, অভাবের সংসারে অসুখ-বিসুখ আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরে। ক’দিন আগেই ছোট ছেলেটা বিছানা ছেড়েছে।
মতি মিলে গ্যাছে?
, সেই সক্কালেই তো চইলা গ্যাছে।
এমন সময় অসুগে পড়লাম, ছ্যাড়াডা একলা কত করবো?
চিন্তা কইরেন না। ভালো অইলে কামে গ্যালেই সব ঠিক অইয়া যাইবো।
পারুল স্বামীকে আশ্বস্ত করলেও নিজে বোঝে মমিন আর আগের মতো কাজ করতে পারে না। শরীরে বাসা বেঁধেছে হাঁপানি। মাসের অর্ধেক সময় কাজ করলে বাকি দিনগুলো বিছানায়ই কাটে। বছরে সামান্য যা ফসল হয় তা কয়েক মাসের মধ্যেই শেষ। তারপর মতির আয়ের উপরই নির্ভর করতে হয়।
পেয়ারা বেগমের চড়া গলা শুনতে পেয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই পারুল দেখে ছেলেমেয়ে নিয়ে রাস্তা থেকে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করছে শেফালি। পেয়ারা বেগম উঠান ঝাড়ু দেয়া বন্ধ রেখে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে। ছেলেমেয়েসহ শেফালিকে দেখে সে বলে ওঠে,
কী অইলো? পনরো দিন যাইতে না যাইতে আবার আইসা হাজির অইছোস!
বিয়া দেবার সময় দেইখ্যা দেও নাই, এহন তো ভুগতে অইবোই। ঘরের দিকে যেতে যেতেই উত্তর দেয় শেফালি।
এইবার আবার কী দাবি লইয়া আইছোস?
এইহানে খাড়াইয়া কইতে অইবো, না-কি ঘরে যাইতে দিবা?
পেয়ারা বেগম গজগজ করতে করতে ঘরে ঢুকে যায়। পারুল ওর ঘর থেকেই শুনতে পায় তার গলা। সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি। ‘তিনডা পোলা মাইয়া আমার হাড্ডি-মাংস জ্বালাইয়া খাইল’। একপোলা জুয়া খেইলা টাকা উড়াইবো, আরেকজন হেই পথেই হাটতাছে আর উনি কয়দিন পর পরই বাপের গোলাত্তন ধন সম্পদ উদ্ধারের জন্য হাজির হন’! পারুল মনে মনে হাসে। পেয়ারা বেগমের কণ্ঠে এই কথাগুলো দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবারই শোনা হয় ওর।
মায়ের অবিরাম শব্দবর্ষণ থেকে মুক্তি পেতে পারুলের ঘরে এসে বসে শেফালি। বিভার মতো শেফালির সাথেও পারুলের সম্পর্কটা চমৎকার ছিল। বয়সে ছোট হলেও একসাথেই চলাফেরা ছিল ওদের। পারুল মনে মনে ভাবে মফিজ মিয়ার তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে একমাত্র এই শেফালিই বাবা-মা’র মতো হয়নি। কিন্তু ওর কপালেই বেশি দুঃখ।
কি কর পারু’বু?
কি আর করুম, তিনদিন ধইরা তোর দুলাভাইর জ্বর। কয়দিন আগে ছোডো পোলাডা বিছানা থেকে উডলো।
দুলাভাই তো অসুগে পইড়া ঘরে থাকে, কিন্তু আমগো জন তো সুস্থ থাইক্যাও কাম করে না। বাপের বাড়ি থেইক্যা হেরে খালি নিয়া দিমু।
জামাইর বাপ-মা কিছু কয় না?
কয় না আবার! সবাই কয়, হের কানে কিছুই ঢোকে না। হের নাকি কাম করতে ভালো লাগে না।
এইডা ক্যামন কতা, পুরুষ মানুষ এমন ধারা হয়? তাইলে সংসার চলবো ক্যামনে?
হেয় এহন গাড়ি কিনবো। আব্বার কাছ থেইক্যা টাকা নিবার কইছে।
তোমগো বিয়ার আগে আমি চাচা মিয়ারে সাবধান করছিলাম, হেয় তো আমার কতার কোনো দামই দিলো না। মমিন বলে উঠলো।
আব্বা তো চিরকালই বেশি বুঝলো। এহন আমি ভুগতাছি।
পেয়ারা বেগমের ডাক শুনে ঘরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল শেফালি।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরে মফিজ মিয়া। শেফালির মুখে জামাইয়ের নতুন বায়নার কথা শুনে মেজাজ চরমে উঠে যায় তার। মেয়েকে বলে,
কয়েকমাস আগেই তো দোকান দেবার লইগা টাকা দিলাম। এরে মধ্যে আবার টাকা?
দোকানে লস খাইছে, এহন হেয় গাড়ি কিনবো।
লাট সাবের ব্যাটা গাড়ি কিনবো না কী করব হেইডা কী আমার দ্যাখতে অইবো?’ আমি এহন কিচ্ছু দিমুনা, হেরে আমার লগে দ্যাহা করতে কইস।
মফিজ মিয়া বারান্দায় চুপচাপ বসে থাকে। বিয়ের পর থেকে এই কয়েক বছরে মেয়েজামাইকে কম দেয়া হয়নি। এর আগেও দু’বার ওদের যৌতুকের দাবি মিটানো হয়েছে। মফিজ মিয়া ভালো ঘর দেখে মেয়েটার বিয়ে দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু মেয়েটা সুখী হয়নি। আজ এটা, কাল ওটা করে টাকা পয়সাও কম দেয়নি। যৌতুকের লোভ যেন আর মেটেনা ওদের। এবার একটা বোঝাপড়া করেই ছাড়বে সে। ঠিক করে জামাই না আসা পর্যন্ত শেফালিকে আর শ্বশুরবাড়ি পাঠাবে না।











স্কুলে আসার পর থেকেই উৎসবের আমেজে থাকে অয়ন। বন্ধুদের সাথে হেসে খেলে আনন্দে মেতে থাকে পুরোটা সময়। স্কুলের মাঠের পাশের ডালপালা ছড়ানো একটা বিশাল পাকুড় গাছ। গাছটা ছায়া দিয়ে ঢেকে রেখেছে মাঠটা। এই গাছটার নিচে একটা লোক প্রতিদিন আইসক্রিম বেচে। ও প্রতিদিনই দাঁড়িয়ে দেখে লোকটা মিহি করে বরফ কেটে ছাঁচে পুরে কেমন লম্বা আইসক্রিম বানিয়ে ফেলে, তারপর তাতে লাল, সবুজ রঙ লাগিয়ে দেয়। আজ বাবার থেকে পয়সা নিয়ে কিনেছিল ও।
স্কুলের উল্টোদিকে ছুটে চলা উঁচু রাস্তাটা অনেকদূর এগিয়ে গিয়ে বিজয় পুলের কাছে পাকা রাস্তার সাথে মিশেছে। ওখান থেকে কলাবতী বাজার খুব কাছে। আশেপাশের কয়েক গ্রামের গ্রামবাসীর কাছে ছোট্ট এই ব্রিজটার একটা বিশেষ গুরুত্ব আছে। অয়ন বাবার মুখে শুনেছে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এখানেই প্রথম পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে এই এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা। সেই প্রথম অপারেশনে বেশ কিছু পাক আর্মিকে খতম করে দিয়েছিলো তারা। দেশ স্বাধীন হবার পর এই ব্রিজের নামকরণ করা হয় ‘বিজয় পুল’।
ওদিকটায় কখনো যায়নি অয়ন। খুব ইচ্ছে ছিল একদিন যাবে। আজ স্কুল একটু তাড়াতাড়িই ছুটি হয়ে গেলে মিরাজ আর সুবলকে বলল। ওরা দু’জনেই সানন্দে রাজী হয়ে গেল। তিনজন মিলে নতুন রাস্তা ধরে ছুটে চলল অজানার পথে। বাঁধনহারা মনটা খুশিতে নেচে ওঠে অয়নের। রাস্তার দু’পাশই অসংখ্য বুনো ঝোপ, লতা গাছে পরিপূর্ণ। গ্রামের লোকজন এগুলোকে বলে রায়ড লতা। এরা এমনভাবে বেড়ে ওঠে যে একসময় মূল গাছটাকে ঢেকে ফেলে পুরোপুরি, অনেকটা স্বর্ণলতার মতো। অয়ন দেখেছে কারো হাত-পা কেটে গেলে এই লতার রস লাগিয়ে দিলে ভালো হয়ে যায়। অযতেœ বেড়ে ওঠা বুনো ঝোপ আর ঘাসের মধ্যে অবহেলায় ফুটে আছে রঙ বেরঙের ফুল। কলাবতী, ঘেটু, আকন্দ, ছোট ছোট সাদা উচুন্টি, চোরকাঁটা, কাঁটায় ভর্তি বুনো বেগুন আরও নাম না জানা কত বনফুল! রাস্তা থেকে জমির দিকে পানিতে শুয়ে থাকা লতানো গাছে ফুটে আছে প্রচুর ঢোল-কলমি। তিনজনে ছুটতে ছুটতে একসময় রাস্তাটার শেষ মাথায় চলে আসে। সামনে একটি উঁচু বাঁশের সাঁকো। বাঁকানো সাঁকোটা দেখে বেশ ভয় হয় অয়নের। ধরণিটা এতটাই উপরে যে অয়নরা ওটার নাগালই পাবে না। দমে যায় ওরা। সাঁকোর ওপারে তাকিয়ে দেখে দূরে পাকা রাস্তা ধরে টুং টাং বেল বাজিয়ে ছুটে চলেছে সাইকেল, রিকশা আর ভ্যান গাড়ি। অয়ন পাকারাস্তার দিকে তাকিয়ে ‘বিজয় পুলটা’ খোঁজে। অনেকক্ষণ পর চোখে পড়ে গাছপালার আড়ালে ছোট্ট সেতুটিকে। ও মনে মনে ঠিক করে- একদিন ওখানে ও ঠিকই-যাবে।
কাজ শেষ হয়ে গেলে স্কুল থেকে বের হলেন সাত্তার মাস্টার। দরজায় তালা লাগিয়ে মাঠের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন। মনে মনে ভাবেন, সকালবেলায় ছেলেমেয়েদের কোলাহলে মাঠটা সরগরম হয়ে ছিল আর এখন কেমন নিস্তব্ধতায় ঢাকা! কচি কচি মুখগুলোর মাঝে সময়টা খুব ভালো কাটে মাস্টারসাবের। মানুষ গড়ার এই কাজটা করতে পেরে বেশ আনন্দিত তিনি। আবার মাঝে মাঝে ভাবেন সবাই কী মানুষ হয়? তাই যদি হতো তাহলে সমাজটা সত্যিই অন্যরকম হতো। মাঠের পাশের পাকুড় গাছটার নিচে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়ান। এখানে এসে দাঁড়ালে কেমন শান্তি লাগে মনে। আজ পঁচিশ বছর ধরে এই গাছটার সাথে সম্পর্ক তাঁর। ঠিক পঁচিশ বছর নয়, আরও বেশি। যখন এই স্কুলে পড়তেন তখন থেকেই। প্রতিদিন স্কুল থেকে বের হয়ে গাছটার নিচে কিছুক্ষণ দাঁড়ান, যেন শান্তির পরশ বুলিয়ে নেন গায়। তারপর ধীরে ধীরে গাছের নিচে রাখা সাইকেলটা নিয়ে এগিয়ে চলেন বাড়ির দিকে।
কোটাখালী খালের পাড় ধরে সাইকেলে চেপে বাড়ি ফিরছেন সাত্তার মাস্টার। বাড়ুই বাড়ির ব্রিজ ছাড়িয়ে তালুকদারের হাঁটখোলার কাছ দিয়ে যাবার সময় প্রতিদিনের মতো আজও চোখে পড়ে বখাটে ছেলেদের জুয়ার আড্ডাটা। খালপাড়ের এই ঘরটায় হৈ-হল্লা নিয়মিত ব্যাপার। দূর থেকে তাঁকে দেখে অবশ্য দরজা জানালা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আজ হয়তো তাঁকে আসতে দেখেনি কেউ।
মাস্টারসাবের খারাপ লাগে। এদের কেউ কেউ তার স্কুলের ছাত্র ছিল একসময়। প্রথমদিকে এদের অভিভাবকদের জানিয়েছিলেন তিনি। কাজ হয়নি কোনো। অবশ্য কাজ হওয়ার কথাও নয়। ভালো ফলের জন্য ভালো গাছও দরকার, এ সত্যটা অনুধাবন করার পর এখন আর এদের ব্যাপারে কিছু বলেন না তিনি। তার নির্মোহ জীবনে কোনোকিছুর বাড়াবাড়ি ছিলনা কখনো। নিজের প্রাপ্তিটুকু নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন সবসময়। এখন তার চিন্তা ভাবনা কেবলমাত্র অয়নকে ঘিরে, একমাত্র চাওয়া তার ছেলেটি যেন মানুষের মতো মানুষ হয়।
গ্রামের অনেকেই এই ঘরটা এখান থেকে সরিয়ে দেবার জন্য দাবি জানাচ্ছিলেন অনেকদিন থেকেই, কিন্তু সিরু তালুকদারের নিজস্ব জায়গায় তোলা ঘর বলে খালেক-বাদল এখনো টিকিয়ে রেখেছে। তবে এদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দিক থেকে যেভাবে অভিযোগ শোনা যাচ্ছে, অচিরেই এটি সরিয়ে নিতে বাধ্য করা হবে।
ঝরঝরে বিকেল। নদীর দিক থেকে ছুটে আসা ঠা-া বাতাসে দোকানের সামনের কৃষ্ণচূড়ার তলায় বসে দাবা খেলায় মগ্ন সাত্তার মাস্টার আর হামিদ শেখ। পাশে দর্শকের ভুমিকায় বসে আছেন জগানন্দ, ইসমাইল মোল্লা, হেলালউদ্দীন, জয়নাল হাওলাদার, হরিপদ, কাজেম মাঝি। কেউ কেউ দু’জনকেই নানারকম পরামর্শ দিতে ব্যস্ত।
মাস্টার, এইবার তোমার মন্ত্রী সামলাও। সাত্তার মাস্টারের উদ্দেশ্যে বলেন হামিদ শেখ।
এই নাও, বলে একটা সৈন্যকে সামনে এগিয়ে দেন মাস্টার।
এইবার চেক, মন্ত্রীকে বামদিকে সরিয়ে রাজা বরাবর নিয়ে এসে বলেন হামিদ শেখ।
হাতির চালে তুমি সবসময়ই দুর্বল, তোমার চোক্ষেই পড়ল না এই জায়গাডা আমার হাতির পাহাড়ায় আছে! নাও, এইবার মাত!
নাহ! তোমার লগে খেলতে অইলে হাতির চালডা আমার ভালো কইরা শিখতেই অইবো।
এই হামিদ, এহন সবাইরে চা খাওয়াও, হেলালউদ্দীন বলে ওঠেন।
হামিদ শেখ হরিপদর দোকানের গোপালের উদ্দেশ্যে সবাইকে চা দিতে বলে গল্পে মশগুল হয়ে পড়েন। এঁদের সবার নিয়মিত আড্ডার জায়গা এটাই। উজানগাঙের উপর দিয়ে আসা প্রাণ জুড়ানো ঠা-া বাতাসে এইখানটাতে কিছুটা স্বস্তি পান এঁরা। সন্ধ্যার পর বইয়ের দোকানে বেচাকেনা তেমন একটা থাকে না, তাই পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ আর গল্পকথায় কাটিয়ে দেন সময়টা। বিভিন্ন বিষয় উঠে আসে আলোচনায়। কথায় কথায় রাত বাড়ে। একসময় উঠে পড়েন সবাই।
সাত্তার মাস্টার দোকান বন্ধ করে বাড়ির দিকে ফিরে চললেন। অনেকদিন পর আকাশে তারার দেখা পাওয়া গেল আজ। নদীর পাড় ধরে কাজেম মাঝির সাথে এগিয়ে চললেন।
আর তো পারা গ্যালো না মাস্টার। কাজেম মাঝি বলে উঠলেন।
ক্যান, কী অইছে?
আবার ঘাডের ভাড়া বাড়াইয়া দিছে বাদইল্যা। ঘাটের মাঝিরা তো খালি আমারে ধরে।
কতাডা আমার কানেও আইছে। কী করবা, এই মাঝিরা তোমারে খুব মানে; তাই তাগো যে কোনো সমস্যায় তোমার কাছেই ছুইটা আসে।
কাইল থেইকা হগগলে আবার নাও বাওয়া বন্ধ কইরা দেবো। আমি ঠিক করছিলাম এইগুলান থেইকা দূরে থাকুম, পোলাডা একলা দোকান সামলাইতে পারতাছে না, অরে কিছুডা সময় দেওন দরকার। কিন্তু পারতাছি না।
নাও বাওয়া বন্ধ করা কোনো সমাধান না। নাও না বাইলে কারো কারো না-হয় চলবো, অন্যদের কী অইবো?
হেইডাই তো চিন্তা করি মাস্টার। এত্তোদিন ধইরা সুখে-দুক্ষে একলগে আছিলাম, অগো প্রত্যেকের অবস্থা জানি। খুব কষ্ট অইয়া যাইবো।
তার চাইতে বাদল্যাগো লগে বইয়া দ্যাহো কোনো সমাধান করতে পার কিনা।
ঘাডের ওরা এহনও খুব ক্ষ্যাপা। তাছাড়া মোক্তারের বিষয়ডা নিয়া পাটোয়ারী কয়দিন সময় নিছে, এইডাও একটা কারণ। দোষ আমগোই বুঝলা? আমরাই সুযোগ দিছি, নাইলে ওরা এত সাহস পায় কই?
সবাই মিল্যা কিছু একটা করণ দরকার। নাও বাইয়া যাগো জীবন চলে তাগো তো আর কোনো গতি নাই! বুড়া বয়সে এই মানুষগুলানের মান-সম্মান নিয়া তো বাঁচতে অইবো।
ইজারা নিছে দেইখ্যা সবকিছু তো অগো ইচ্ছামত চলবো না।
আমরা সুযোগ দিলে তা-ই অইবো।
ঠিক আছে, সবাই মিল্যা আবার বইতে অইবো। একটা উপায় বাইর অইবোই, তুমি চিন্তা কইরো না। আগে দ্যাহো পাটোয়ারী কি করে।
কথায় কথায় কাজেম মাঝির বাড়ির সামনে এসে পৌঁছায় দুজন। কাজেম মাঝি বিদায় নিলে সোজা পথে এগিয়ে চলেন সাত্তার মাস্টার। পাঁচ ব্যাটারীর টর্চের উজ্জ্বল আলোয় অন্ধকার দূর হয়ে কাঁচা রাস্তাসহ আশপাশের অনেকটা জায়গা পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। কিছুদূর এগিয়ে মসজিদের কাছাকাছি যেতেই তাঁর হঠাৎ মনে হলো মফিজ মিয়ার দীঘির পাড়ে একটা ছায়ামূর্তি যেন সরে গেল গাছের আড়ালে। টর্চটা নিভিয়ে দিয়ে হাঁটার গতি কিছুটা কমিয়ে দিলেন তিনি। একটু এগিয়ে গিয়ে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন, যেখানে মফিজ মিয়ার বাড়ি থেকে সরু পথটা এই রাস্তার সাথে মিশেছে। অকস্মাৎ দীঘির পাড়ের দিকে টর্চের আলোটা ফেলতেই দেখলেন দিঘীর পাড়ঘেঁষে গাব গাছটার নিচে বিভার ঘরের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে একজন মানুষ।
কেডা অইহানে? মাস্টারসাব চড়া গলায় বলে উঠলেন।
লোকটা কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, বোধহয় বোঝার চেষ্টা করছে কণ্ঠস্বরটি কার।
সাত্তার মাস্টার আবার বলে ওঠেনÑ কেডা ঐহানে, কতা কয়না ক্যান?
একটু পরই নিচুস্বরে একটা পুরুষ কণ্ঠের জবাব শোনা যায়- আমি স্যার।
আমি কেডা? মাস্টারসাব ধমকে উঠলেন।
মানুষটি এবার আস্তে আস্তে রাস্তার দিকে এগিয়ে আসে। কাছাকাছি আসতেই তিনি দেখলেন লোকটা হারু গাজীর ছেলে গিয়াস।
তুই এইহানে কী করস?
কিছুনা স্যার, এই পথ দিয়া আইতেছিলাম।
এইডা তো তোগো বাড়ির পথ না, এই বাগানে এত রাইতে তোর কী কাম?
সাজুগো বাড়ি গেছিলাম, এহন বাড়ি যামু।
সাত্তার মাস্টার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে গিয়াসের দিকে তাকান। টর্চের আলোটা সোজা গিয়াসের মুখের উপর ধরে রেখেছেন। গিয়াস চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
আমি অনেকক্ষণ ধইরা তোরে এইহানে খাড়ানো দ্যাখতাছি, ঐদিকে কি? বিভার ঘরের দিকে ইশারা করে জানতে চাইলেন?
গিয়াস চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। সাত্তার মাস্টার আবার জিজ্ঞেস করেন- কী রে কতা কস না ক্যান?
কিছু না স্যার, এমনিই খাড়াইয়া আছি। এহন চইলা যামু।
সাত্তার মাস্টার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন- ঠিক আছে, যা।
গিয়াস তাঁকে পাশ কাটিয়ে ওদের বাড়ির দিকে চলে যায়। মাস্টারসাব আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করেন ওখানে। গিয়াসের পায়ের শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার পর ফিরে চলেন নিজের পথে।











বটতলার হাটের ইজারা নিয়ে হাঙ্গামা আজ নতুন নয়। গত কয়েক মাস ধরেই ঘাটের মাঝি আর হাটের দোকানদারদের সাথে বাদলের বাক-বিত-া নিত্য নৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিনা নোটিশে ঘাটের টোল বাড়ানোর প্রতিবাদে খেয়া নৌকা আর মাছ ধরার নৌকার মাঝিরা কয়েক দফায় নৌকা বাওয়া বন্ধ রেখেছিল। এই নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে ইজারাদার বাদল আর হারু গাজীর ভাই মজনুর রেষারেষি চলছে। ইদানীং কালে তাদের সম্পর্কটা তিক্ত হতে হতে চরম শত্রুতায় পরিণত হয়েছে। কেউ কারো ছায়াও সহ্য করতে পারে না। ঘাট আর হাটের টোল বাড়ানোকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে মজনু। সুযোগ নেয় সে; মাঝিদের পক্ষ হয়ে বাদলের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়। উদ্দেশ্য গ্রামবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠা।
ঘাটের মাঝিরা তাদের দাবিতে অনড়। তারা বাড়তি টোলের দাবি মানবে না। দরকার হলে নৌকা বাওয়া ছেড়ে দেবে।
অনেকদিন ধরে জমাটবাধা বরফ গলাতে আজ দু’পক্ষকে একসাথে বসানো হয়েছে। বর্তমান চেয়ারম্যান বশিরুল্লাহ পাটোয়ারী এসেছেন একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান করতে। নৌকার মাঝিদের অভিযোগ জানতে চাইলে কাজেম মাঝি বলে ওঠেন,
চল্লিশ বছর ধইরা ঘাডে নাও বাইছি, কোনোদিন কেউ বেয়াদবি করে নাই। কতদিন পয়সা ছাড়া কত মানুষরে পার কইরা দিছে এই ঘাডের মাঝিরা। এই মানুষগুলার মান-সম্মান নিয়া টিইকা থাকাই এহন চিন্তার বিষয়। হেইদিনের পোলা বাদইল্যা বাপের বয়সী এই মানুষটার লগে যে ব্যবহার করছে তার বিচার না অওয়া পর্যন্ত এই ঘাডে কেউ নাও বাইবো না। মোক্তার মাঝিকে সবার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেন কাজেম মাঝি।
বাদল, তোর কী কওনের আছে? চেয়ারম্যান বলেন। 
এরা সবাই য্যামনে আমার উপর ক্ষেইপা গেছিল, আমি মাথা ঠিক রাখতে পারি নাই, ভাইসাব।
মাথা ঠিক থাকবো ক্যামনে? শরিলের শক্তি দেহাইতে অইবো না? এগো রক্ত ঝড়ইন্যা পয়সা পকেডে না ঢুকলে শক্তি বাড়বো ক্যামনে? দর্শকের সারি থেকে মজনু বলে।
গাঁটের পয়সা খরচ কইরা ইজারা নিছি কী তামশা দেহার লইগ্যা? বাদল চিৎকার করে ওঠে।
তুই কী প্রথম ইজারা নিছোস? তোর আগে আর কেউ এই ঘাডের ইজারা নেয় নাই? এরাম কইরা যহন তহন টোল বাড়াইয়া দিছে কেডা? আবারও মজনু বলে।
দিন বদলাইয়া গ্যাছে, সবকিছুর দাম বাড়ছে। আমারও তো টাকা উডাইয়া নিতে অইবো।
সবকিছুর দাম বাড়ছে আমরাও জানি কিন্তু নাও ভাড়া তো বাড়ে নাই। ওরা দেবো কোত্থেইক্যা? কাজেম মাঝি আবার বলেন।
দর্শকদের মধ্য থেকে হইচই ওঠে। চেয়ারম্যান হাত তুলে সবাইকে থামান। সভার কয়েকজনের সাথে পরামর্শ করে বলেন, সবার দিকটাই দেখতে হইব। যারা দীর্ঘদিন ধইরা এই ঘাডে নাও বায় তাগো স্বার্থ যেমন ঠিক রাখতে অইবো, তেমনি যারা টাকা খরচ কইরা ইজারা কিনছে তাগো ব্যাপারডাও দেখতে অইবো।
সর্বশেষে সিদ্ধান্ত হয় এ বছর নদীর ঘাট কিংবা হাটের দোকানের কোনো ভাড়া বাড়বে না, আগামী বছর থেকে বাড়তি ভাড়া কার্যকরী হবে। সভা শেষ হবার ঠিক আগেই মজনু উঠে দাঁড়ায়।
বাদল্যা যে এই মুরুব্বির গায়ে হাত তুলল হের কী অইবো?
মনে অয় তোর দরদ উথলাইয়া উঠছে, তুই কী সাধু-পুরুষ? বাদল বলে ওঠে।
আমি সাধুপুরুষ না, তয় তোর মতোন জুলুমবাজও না।
মুখ সামলাইয়া কথা কইস মজনু, ভালো অইবো না কইলাম। বাদল তেড়ে আসে মজনুর দিকে। মজনুও উঠে সমানভাবে তেড়ে যায় বাদলের দিকে। দু’পক্ষের লোকজনই মারমুখী অবস্থানে দাঁড়িয়ে যায়। ব্যাপারটা হাতাহাতির পর্যায়ে চলে গেলে খালেক তালুকদার উঠে এসে বাদলকে ফেরায়। তারপর মজনুর উদ্দেশ্যে বলে,
বিষয়ডার একটা সুরাহা চলতেছিল, তুই মাঝখান থেইক্যা বাগড়া দিয়া ঝামেলা বান্ধাইলি ক্যান?
ব্যাপারডা একপেইশা হইতেছিল, তোমার ভাই যে এই বুড়া মানুষটারে মারলো তার তো কোনো বিচার অইলো না, কাউরে না কাউরে তো পরতিবাদ করতে অইবো। 
মাঝিদের পক্ষ থেকে এবার একটা শোরগোল ওঠে। হ, মোক্তার মাঝির গায় হাত তোলার বিচার না অইলে আমরা কেউ বইডা হাতে তুলুম না।
চেয়ারম্যান এবার ধমকে ওঠেন। তারপর ক্ষেপে গিয়ে বলেন- এতগুলা মানুষের মতামতের কোনো দাম যহন তোরা দিবি না তাইলে আমগো ডাকলি ক্যান?
চরকমলের আরজ আলী মাঝি এবার বলে ওঠে- চেয়ারম্যান সাব, আমরা আপনেরে সম্মান করি। আপনে ন্যায় বিচার করেন, আমগো মান সম্মানের ব্যাপারডাও দেখেন।
ঠিক আছে, এই ব্যাপারডারও ফয়সালা হইব। তারপর বাদলের উদ্দেশ্যে বলেন,
তুই এই মুরুব্বির কাছে মাপ চা। আর সবার সামনে ওয়াদা কর এরপর আর এমন ঘটনা ঘটবো না।
বাদল উঠে মোক্তার মাঝির কাছে মাপ চেয়ে নেয়। তারপর মজনুর দিকে কটমট করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সভা ছেড়ে চলে যায়।
শালিসের পর নৌকার মাঝি আর হাটের দোকানদারদের মধ্যে ফিরে আসে আগের সেই কর্মচাঞ্চল্য। অনেকদিন পর মানুষের পদভারে আবার মুখরিত হয়ে ওঠে কলাবতী ঘাট। কাজেম মাঝি তার সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন। অন্য মাঝিরা অবশ্য আরও কিছুদিন তাকে ওদের মধ্যে চায়। মোক্তার মাঝি কাজেমের উদ্দেশ্যে বলে,
তুমি আমগো ফালাইয়া চইলা যাইতেছ?
আমি আর কই যামু? তোমগো লগে তো সবসময়ই দ্যাহা অইবো।
তুমি থাকলে আমরা অনেক বল পাই, তাই তোমারে আরও কিছুদিন আমগো মধ্যে চাইছিলাম।
পোলাডা একলা দোকান সামলাইতে পারতাছে না, অরে একটু সময় দেয়া দরকার। আমি তো এলাকায়ই থাকুম, তোমরা ডাকলেই আমারে পাইবা। তাছাড়া এহন তো অনেকেই তোমগো সাহায্যে আগাইয়া আসতাছে, আইজ দ্যাহো মজনুই তো তোমগো পাশে আইসা খাড়াইলো।
, আমরা সবই বুঝি। সময় বদলাইয়া গ্যালে এই মজনুই আবার আমগো উপরে অস্ত্র ধরতে ছাড়বো না। বাদইল্যার লগে ওর কাইজ্জার লইগাই আইজ অর বিরুদ্ধে কথা কইছে। বলে ওঠে বলাই শীল।
এই চিত্র ওদের জন্য নতুন কিছু নয়। আজকের ঘটনার জন্য যদিও অনেকেই মজনুকে বাহাবা দিয়েছে, কিন্তু তারা জানে মজনু নিজের স্বার্থেই আজ মাঝিদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। দুদিন পর নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব মিটে গেলে বাদলের সাথে এক সুরেই কথা বলবে।
আমাবস্যা রাত। ঘুটঘুটে অন্ধকারে কোটাখালী খালের পাড়ের রাস্তা ধরে তালুকদারের হাটখোলার দিকে হেঁটে চলেছে খালেক তালুকদার আর বাদল। বাদল মনে মনে ভেবেছিল আজকে মজনুরে একটা শিক্ষা দিয়ে ছাড়বে। আর তাই ওর দলের লোকজনকে কাছাকাছি থাকতে বলে দিয়েছিল। পারল না কেবল বড় ভাইয়েরর জন্য। 
ভাই, তুমি আমারে থামাইলা ক্যান? আইজ অরে একটা শিক্ষা দিয়া ছাড়তাম।
আরে বলদা, সবাই এহন তোর বিরুদ্ধে। হাডের হগগলের সামনে কিছু করলে বিচারে তুই তো হাইরা যাইতি। সামনে ইলেকশন। শুনতাছি এইবার মজনু মেম্বর পদে খাড়াইবো। এই সময় খুব সাবধানে চলতে অইবো। এমন কাম করতে অইবো যেন সাপও মরে কিন্তু লাডিও না ভাঙে।
পড়ন্ত দুপুর। সূর্যের কড়া তেজ কমে গেছে অনেকটাই। জানালা দিয়ে তাকিয়ে সুবলকে আসতে দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে অয়ন। আজ স্কুল থেকে ফেরার পথে মিরাজ বলছিল- উজানগাঙের ওপারে অনেক কাশফুল ফুটেছে। বিকালে ঝাঁকে ঝাঁকে বকের মেলা বসে। তখনই ওরা ঠিক করেছিল আজ নদীর ওপারে যাবে। কাজেম মাঝির বাড়ির সামনে এসে দেখে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে মিরাজ। তিনজনে আবার ছোটে নদীর দিকে। কোটাখালী খালের পাড় ধরে রাস্তার দু’পাশের বুনো ঝোপঝাড় ছাড়িয়ে মাথার উপর বড় বড় গাছের ছায়ায় ছায়ায় ওরা এগিয়ে চলে উজানগাঙের দিকে। ছুটতে ছুটতে তেমাথার পুলের কাছে এসে থামে।
সামনেই উজানগাঙ। নদীতে জোয়ার এসেছে মাত্র। মিরাজ যেন কিছুটা আনমনা হয়ে যায়। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তেমাথার পুলের ওপার দিয়ে ছুটে চলা রাস্তাটার দিকে। এখানটায় আসলেই ওর এমন হয়। মনটা চলে যায় নিজের গ্রাম গৌরীপাশায়।
অয়ন তাকিয়ে আছে নদীর ওপারে। যতদূর চোখ যায় চরজুড়ে সফেদ-শুভ্র কাশের বন আর তার উপর দিয়ে মনের সুখে উড়ে বেড়াচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে সাদা বক।
ইস! দ্যাখ কী সুন্দর! কিন্তু আমরা ঐ পাড়ে যামু ক্যামনে? অয়ন বলে।
অয়নের কথা শুনে ফিরে তাকায় মিরাজ। ও বলে- আমগো ছোট্ট একটা নাও আছে, কিন্তু আমি কোনোদিন নদীতে নাও বাই নাই।
ল’ আমরা দুইজনে মিল্লা বামুনে, সুবল মিরাজকে বলে।
আমার ডর লাগতাছে, যদি ডুইবা যায়?
অয়নের ভয় দেখে ওরা আর সাহস করে না।
তখনই মিরাজ বলে- ল’ আমরা বটতলার ঘাট থেইক্যা নৌকায় পার হইয়া ঐ পাড়ে যাই। ঘাটের সবাই আমারে চিনে, পয়সা লাগবো না।
অয়ন আর সুবল রাজি হয়ে যায়।
নদী পার হয়েই চরকমল। বেড়িবাঁধ ধরে তিনজনে ছুটে চলে কাশের বনের দিকে। যতদূর চোখ যায় শুধু ধূ-ধূ বালুচর, আর সেই চরের বিস্তীর্ণ প্রান্তরজুড়ে কেবল শুভ্র কাশের বন। নিচের দিকে চরে আটকে আছে কচুরীপানা; সেখানে ফুটে আছে রাশি রাশি বেগুনী ফুল। কিছুদূর এগিয়ে রাস্তা ছেড়ে নেমে পড়ে নদীর চরে।
শরতের আলো ঝলমল নির্জন বিকেলে তিনটি উচ্ছ্বল বালক ছুটে বেড়ায় ওদের স্বপ্নের বালুকাবেলায়। বাঁধনহারা হয়ে নেচে বেড়ায় কাশবনের ছায়ায় ছায়ায়। নরম বালুর চরে ওদের কচি পা’গুলো ডেবে যায়। মাথার উপরে নীল আকাশজুড়ে উড়ে বেড়ানো সাদা মেঘের ভেলা। বন্ধনমুক্তির এই ডাক উপেক্ষা করার সাধ্য ওদের নেই। গুভ্র কাশের বন, নীরব নিথর পরিবেশ আর ধবল বকের ঝাঁকের সাথে মিলেমিশে ওরা প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যায়।
পূজা শুরু হতে আর বেশি দেরী নেই। হরিপদর বাড়িতে জোর প্রস্তুতি চলছে। প্রতিবারের মতো এবারও ওদের ভিটাবাড়িতে আয়োজন করা হয়েছে দুর্গাপূজার। পাশাপাশি বসবাসকারী বেশ কয়েকটা হিন্দু পরিবার একসাথে পূজার আয়োজন করায় এবারের উৎসবের মাত্রাটা একটু বেশি। প্রতিমা গড়ার জন্য আনা হয়েছে যতীন পালকে। প্রতিবছর পূজায় ওদের প্রতিমা গড়ার কাজটা যতীনই করে থাকে। হালকা পাতলা গড়নের এই মানুষটির হাতে যেন যাদু আছে। ওর হাতে গড়া প্রতিমা বরাবরই অসাধারণ হয়। এ বছর ওর সহকারী হিসেবে এসেছে ছোট ছেলে নির্মল।
প্রতিদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় অয়ন আর মিরাজ সুবলের সাথে ওদের বাড়িতে পূজার আয়োজন দেখতে যায়। ভিটেবাড়ির খোলা জায়গাটুকুতে নতুন ঘর তোলা হয়েছে, সেই ঘরে প্রতিমা গড়ার কাজ চলছে। উপরে টিনের ছাউনি দেয়া ঘরটির কেবল পেছন দিকে টিনের বেড়া দেয়া আর তিন দিকই খোলা। গত কয়েকদিন ধরেই চলছে মূর্তি গড়ার কাজ। আজ সকালেও ওরা এসেছিল। তখন দেখেছে বাঁশের কাঠামোগুলোর মধ্যে খড়কুটো দিয়ে মানুষের আকৃতি তৈরি করছিল কারিগররা। এখন তার উপর মাটির প্রলেপ দিচ্ছে। ধীরে ধীরে ঢেকে যাচ্ছে বাঁশের কঞ্চি আর খড়কুটোগুলো। সুবল বলে- দুইদিন পর দেহিসÑ পুরোপুরি মূর্তি অইয়া যাইব।
তারপর রঙ কইরা সুন্দর কাপড় পড়াইয়া দেবে, তাইনা রে? অয়ন জিজ্ঞেস করেছিলো।
সুবল মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে। ‘শুক্কুরবার মায়ের বোধন অইবো, তহন অনেক মজা অইবো। তোরা আইবি?’
অয়ন আর মিরাজ ঘাড় কাত করে সায় জানায়।
পূজার ছুটিতে বাড়িতে এসেছে শ্যামল আর তাপস। দুই দাদাকে একসঙ্গে পেয়ে ভীষণ খুশি সুবল। দাদারা যখন যা বলছে করে দিচ্ছে সানন্দেই। এটা-ওটা নানান প্রশ্ন করে অতিষ্ঠ করে তুলছে দুজনকেই।
সবার আনন্দের কেন্দ্রস্থল ওদের ভিটাবাড়ির পূজা ম-পকে ঘিরে। ম-পের টিনের ঘরটার সামনের জায়গাটা সামিয়ানা টাঙিয়ে রঙিন কাপড়ের বেড়া দিয়ে আটকে দেয়া হয়েছে। পূজায় আগত লোকজনের বসার জন্য। বাড়ির প্রবেশপথে বসানো হয়েছে গেট। গেট থেকে ম-প পর্যন্ত বাহারি রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানো হয়েছে। সন্ধ্যার পর আলোর ব্যবস্থার জন্য তৈরি রাখা হয়েছে হ্যাজাক বাতি।
সারা বাড়ি জুড়ে উৎসব উৎসব রব। দিনের বেশির ভাগ সময়ই ব্যস্ততায় কাটছে শ্যামলের। পূজার আয়োজনের তদারকির ফাঁকে ফাঁকে একটা মুখ মনে উঁকি দেয়। চোখ দু’টি মাঝে মধ্যেই পুকুরের পাড় ছাড়িয়ে খালপাড়ের রাস্তায় ঘোরাফেরা করে।
পুজা ম-পের কাজে মঞ্চে দাঁড়িয়ে শ্যামল। চারু এসে পেছনে দাঁড়ায়।
দাদা, উডানে আলপনা করবা না?
পূজা তো এইহানে, বাড়ির ভিতরে আলপনার দরকার আছে?
করি না! তোমার কিছু করতে অইবো না। ঐ দায়িত্ব আমি আর শিখাদি নিলাম।
শ্যামল ঘুরে তাকায়।
ঠিক আছে, কর!
আবার কিছু বলার জন্য মুখ খুলেই চুপ করে যায়। চারু মিটিমিটি হাসে।
কিছু কইবা?
শিখা আইছে?
হ। হেই কহন থেইক্যা আমগো সিঁড়িতে বইসা আছে! তোমার তো সময়-ই নাই। চারু মুচকি হেসে ঘুরে চলে যায়।
বাড়ির ভিতরে ঢুকে সিঁড়ির দিকে তাকাতেই শিখার সাথে চোখাচোখি হলো শ্যামলের। শিখার কোনো ভাবান্তর নেই, চারুর সাথে গল্পে মশগুল।
শ্যামল উল্টাপাশের সিঁড়িতে বসে। চারু উঠতে উঠতেই বলে,
দাদা, চা খাবা?
হুম, তা খাওয়া যায়।
তোমরা কথা কও, আমি চা কইরা আনতাছি।
কি রে! তুই কখন আইলি?
শিখা শ্যামলের দিকে তাকায়।
অনেকক্ষণ। তুমি তো ব্যস্ত মানুষ, তাই বিরক্ত করি নাই।
তোরে কী কইছি আমি ব্যস্ত মানুষ?
মুখে কইতে অইবো ক্যান? গ্রামে ফিরা একবার দেখা করার সময়ও পাইলা না। তাইলে তুমি ব্যস্ত না?
শ্যামল হাসে। -খাইছে! এত্ত রাগ? এতবড় পূজার আয়োজন, এইহানে সময় দেওন লাগে না? আইজকাই তো যাইতাম। তুই বড় আসোস এদিকে!
আমি আসি কি-না তুমি তার খবর রাখো? কাইলকাও তো আইলাম, তোমারে দেখলাম মহাব্যস্ত, কোনোদিকে তাকানোর সময় নাই।
একবার ডাকলেই পারতি।
ভাবলাম ব্যস্ত মানুষরে বিরক্ত করনের কাম নাই। 
বাহ! রাগলে তো তোরে দারুণ লাগে!
আমি আবার রাগলাম কই?
রাগোস নাই? তাইলে এই রকম গুম মাইরা রইছোস ক্যান?
শিখা চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। শ্যামল অনেকক্ষণ শিখার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ বলে ওঠে,
শোন একটা গল্প বলি; আমি তখন খুব ছোট, একদিন আমগো বাড়িতে এক বৈষ্ঠমী আইছিলো। আমারে দেইখ্যা কী কইছিলো জানোস?
শিখা চোখ তুলে তাকায়। শ্যামল হাসে।
আমার বউ খুব লক্ষ্মী অইবো।
তাই নাকি?
তোরে দেইখ্যা আইজ মনে অইলো কতাডা সত্যি।
ক্যামনে?
যাগো নাক ঘামে তারা নাকি...
থাউক, আর কইতে অইবো না।
শ্যামলকে থামিয়ে দেয় শিখা। তারপর অজান্তেই নিজের হাতটা চলে যায় নাকের উপর। হাসতে হাসতেই বলেÑ ছেলেদের ভালোবাসার নমুনা কি?
হেইডা তো কেউ আমারে কয়নাই। তুই খুইজা বাইর কর।
আমার আর খাইয়া দাইয়া কাম নাই!
তোরে নিয়া একদিন উজানগাঙে নাও ভাসাইতে ইচ্ছা করে। যাবি আমার লগে?
শিখা অনেকক্ষণ কিছু বলে না। আনমনে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। তারপর হঠাৎ শ্যামলের দিকে তাকিয়ে বলেÑ শ্যামলদা, তুমি লগে থাকলে আমি যেহানে খুশি যাইতে পারি।
শ্যামল শিখার চোখে চোখ রাখে। শিখা আবার বলে,
আমি জানি না আমার ক্যান এমন অয়, তুমি গ্রামে না থাকলে আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না। সবসময় খালি একা একা লাগে।
শিখার চোখে জল। শ্যামল স্মিত হেসে বলে,
দূর পাগলী, কান্দোস ক্যান? আমারও তো এমন অয়। আর তো মাত্র দেড়টা বছর। তারপর আমি গ্রামে চইলা আমু।
চারুর পায়ের শব্দ শুনে চোখ মুছে শিখা।
চায়ের কেটলি রাখতে রাখতে চারু বলে,
তোমগো আবার বিরক্ত করলাম না তো?
মারবো এক চড়; খালি পাকামি করোস! কপট ধমকের সুরে শ্যামল বলে ওঠে।
আমি আবার কী করলাম কও তো শিখাদি! দাদা খালি আমারে ধমকায়। যার লইগ্যা করি চুরি হেয় কয় চোর।
তোরা আলপনা-টাল্পনা কী করবি কর, আমি গেলাম।
শ্যামল চায়ের কাঁপে চুমুক দিতে দিতে ভিটাবাড়ির দিকে চলে যায়।
মহা-অষ্টমীর মহা আয়োজনে সরগরম হয়ে উঠেছে সারা বাড়ি। ঢাক-ঢোল বেজে চলেছে বিরামহীন ভাবে। ঢাক-ঢোলের সাথে সাথেই অনুষ্ঠানটিকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলেছে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ঢুলীদের নৃত্য। ঘণ্টার শব্দ আর উলুধ্বনি শোনা যাচ্ছে থেমে থেমেই। গ্রামের হিন্দু মুসলমান শ্রেণিভেদাভেদ ভুলে হাজির হয়েছে পূজা-ম-পে। কেউ এসেছেন মায়ের আশীর্বাদ নিতে আর কেউ এসেছেন পূজার আনুষ্ঠানিকতা উপভোগ করতে। অয়নের জন্য এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। দুপুরের পর থেকেই সুবলদের বাড়িতে মিরাজকে সাথে নিয়ে পূজা দেখতে হাজির হয়েছে অয়ন। সুবলদের ভিটাবাড়িতে বিশাল সামিয়ানার নিচে টিনের ঘরটির একপাশের দেয়াল জুড়ে কয়েকটা মূর্তি দাঁড় করানো। মাঝখানে দাঁড়ানো একটি নারীমূর্তি, যার দশটি হাত। অয়ন অবাক হয়ে দেখে নারীমূর্তিটির কোনো হাতে শোভা পাচ্ছে খড়্গ, বর্শা, ত্রিশূল, চক্র, আবার কোনো কোনো হাতে পদ্ম কিংবা শঙ্খ। তাঁর পায়ের কাছে একটি সিংহ। তিনি তার হাতের বর্শাটা দানবীয় চেহারার একটি লোকের দিকে তাক করে রেখেছেন। তার দু’পাশে আরও দু’টি নারীমূর্তি। একজন রাজহংসের উপর দাঁড়ানো, আরেকজনের সাথী একটি পেঁচা। তাঁদের দু’দিকে দু’জন পুরুষের মূর্তি। একজনের মাথাটা মানুষের বদলে হাতির। তাঁদের সামনের জায়গাটিতে নানান ধরনের জিনিসপত্র সাজানো। একটা কাসার পাত্রে ধান, দূর্বা, জবা ফুল, বেলপাতা রাখা আছে। বিভিন্ন বাড়ি থেকে আনা হচ্ছে নানা ধরনের খাবার। ডালায় সাজিয়ে। একজন পৈতা পড়া বয়স্ক লোক মন্ত্র পড়ছেন আর মাঝে মধ্যে ঘণ্টা বাজাচ্ছেন। তাঁর পড়নে ধবধবে সাদা ধুতি আর গায়ে পেচানো নামাবলি। নামাবলির ফাঁক দিয়ে মাঝে মধ্যে পৈতাটা চোখে পড়ছে। তিনি ডালা থেকে ফুল নিয়ে ছিটিয়ে দিচ্ছেন মূর্তিগুলোর গায়, আবার কখনো প্রদীপ হাতে নিয়ে আরতি করে চলেছেন ওদের সামনে। ঘণ্টা বাজানোর সাথে সাথেই পাশে থেকে মহিলাদের কণ্ঠ থেকে ভেসে আসছে উলুধ্বনি। পুরোহিতের এই আরতি পর্বটি মূর্ত করে তুলছে বাদকদলের চমৎকার বাদন।
সন্ধ্যা হয় হয়। অয়ন বাড়ি ফেরার আগেও দেখে বাদক দলের সাথে মিশে গিয়ে শ্যামলদা আর তাপসদা ঢোল বাজাচ্ছেন আর তাদের সাথে অজিত সাহা ধুপদানি নিয়ে নেচে নেচে আরতি করছে।
সন্ধ্যার পর ধীরে ধীরে আঁধার নেমে আসে। মা আর ছোটদি’র সাথে ঘরের সিঁড়িতে বসে গল্প শুনতে শুনতে বেশ রাত হয়ে যায়। বাবা, মন্টু মামা পূজার অনুষ্ঠান থেকে তখনও ফেরেনি। সিঁড়িতে অনেকক্ষণ বসে থেকে মায়ের সাথে ঘুমাতে চলে যায় ও। প্রতিদিনের মতো মায়ের কোলে মুখ রেখে শুয়ে পড়ে। মায়ের গা থেকে মা-মা গন্ধটা না পেলে যেন ওর ঘুমই হয়না ঠিকমত। মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। দু’চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছিল অয়নের। তখনও পূজার অনুষ্ঠান থেকে ক্রমাগত ভেসে আসছিলো ঢাক-ঢোলের শব্দ। 










শিউলির শহরে যাওয়ার দিন ঠিক হয়ে গেছে। আর মাত্র এক সপ্তাহ। তারপর সবাইকে ছেড়ে চলে যাবে বহুদূরে। শ্যামলপুরের আলোছায়ায় শেষ ক’টা দিন কাটিয়ে তবেই বিদায়। সাত্তার মষ্টার আর সালমা বেগমের মন খুব খারাপ। এতদিন মেয়েটা শ্বশুরবাড়িতে ছিল, ইচ্ছে হলেই গিয়ে দেখে আসতে পারত। দূরে চলে গেলে মনটা বড় কাঁদবে।
বড়দি আসার পর থেকেই অয়ন বলে আসছেÑ ওকে সাথে নিয়ে যেতে হবে। ওর কথার উত্তর দিতে গিয়ে শিউলিকে হিমসিম খেতে হচ্ছে।
বড়দি, তুমি কবে শহরে যাবা?
এই তো আগামী সপ্তায়।
তুমি একলা যাবা শহরে?
না, তোর ভাইয়া আইবো। আমারে লগে কইরা নিয়া যাইব।
আমারেও কিন্তু তোমগো লগে নিতে অইবো।
ভাইয়ের আবদার শুনে শিউলি হাসে। তারপর বলেÑ বাবা, মা, বকুলরে ছাইড়া তুই থাকতে পারবি অনু?
আমি তো শহরে ঘুইরা আবার চইলা আমু।
ও আইচ্ছা, শুধু শহর দেখতে যাবি, আমার লইগা তোর কোনো মায়া নাই, তাইনা?
আমি কী তাই কইছি? তোমার কাছে কয়দিন থাইক্যা বাড়ি চইলা আমু, আমার স্কুল আছে না?
হুম, আমি তো ভুইলাই গ্যাছিলাম আমার ভাইটা প্রতিদিন স্কুলে যায়। আমি শহরে চলে গ্যালে তোর খারাপ লাগবে অনু?
, খারাপ তো লাগবোই। শহর তো অনেক দূর। তুমি তো তহন অনেকদিন বাড়ি আইতে পারবা না। জান? হেদিন বাবা-মা তোমারে নিয়া কতা কইতাছিল। তুমি চইলা যাইবা তাই বাবার খুব মন খারাপ। তোমার খারাপ লাগবো না বড়দি?
শিউলি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। ছোট ভাইটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে- মেয়েদের অনেক কষ্ট, সবকিছু ছাইড়া চইলা যাইতে অয়। তুই বড় হ, তহন বুঝবি।
হেমন্তের সুবাতাসে শরতের বিদায় ঘণ্টা বাজছে চারিদিকে। শরতের শেষদিকে এসে গ্রামের ঘরে ঘরে আশ্বিনের বিদায়ের প্রস্তুতি চলছে। মনে প্রাণে উৎসব পাগল গ্রামের মানুষ কার্তিককে বরণ করে নেবার উৎসবে মেতে উঠেছে। সবার মুখে একই কথা- ‘আজ গাশ্বির রাত’। গাশ্বির রাতে আনন্দ উৎসব করে আশ্বিনকে বিদায় জানাবে এরা।
সুবলদের বাড়িতে গাশ্বি উৎসবের জন্য বিকেল থেকেই সাজ সাজ রব। শ্যামল, তাপস চারুকে নিয়ে দিনভর উঠানে আলপনা একেছে, যে কোনো উৎসবেই এটা করে থাকে ওরা। সুরবালা আর বিজয়া নানা ধরনের পিঠা পায়েসের আয়োজনে ব্যস্ত। বিকেলে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে চারু জোগাড় করেছে উৎসবের বিভিন্ন ধরনের উপকরণ। উঠোনের এক পাশে বসে সবগুলো পিষতে ব্যস্ত সে। চারুদির প্রতিটা কাজে অত্যন্ত আনন্দের সাথেই সহযোগিতা করে চলে সুবল।
শেষ বিকেলে অয়ন সুবলদের বাড়িতে এসে দেখে ওদের সারা বাড়ি জুড়ে উৎসবের আমেজ। সিঁড়ির উপরে বড় একটা কাঁসার থালায় কয়েক ধরনের জিনিস বেটে সাজিয়ে রাখা। ও সুবলের খোঁজে সিঁড়ির কাছে যেতেই তাপসদা এগিয়ে আসে। ‘অনু, ক্যামন আছিস রে?’ বলেই থালা থেকে হলুদ নিয়ে ওর গালে মাখিয়ে দেয়। চারুদি উঠানের মাঝে দাঁড়িয়ে জোরে হেসে ওঠে। বলে- দাদা, অরে এহনই মাখাইয়া দিলা? অয়ন সেদিকে ঘুরে তাকিয়েই অবাক হয়ে যায়। সারা উঠানজুড়ে আঁকা সাদা আল্পনার মাঝখানে লাল ফ্রক পরা চারুদি’কে অসাধারণ লাগছিলো।
অয়নকে নিয়ে দখিন দ্বারে হিজল গাছের সাথে ঝোলানো দোলনায় গিয়ে বসে সুবল। দু’জনে গল্পে মশগুল হয়ে পড়ে। সুবল বলে,
জানোস, কাইল খুব বিহানে আমরা সবাই মিইল্লা খালে নাইমু, তোরা খালে আইবি না?
না রে! বড়দি কইছে কাইল বিহানে আমরা আমগো পুকুরে নাইমু।
পুকুরে তো আমরা প্রতিদিনই নাই; কাইল দেখবি সব বাড়ির মানুষেরা খালে নাইতে আইবো।
তোরা অনেক মজা করবি, না?
হুম, অ-নে-ক মজা!
অয়নদের বাড়িতেও গাশ্বি উৎসবের ছোঁয়া লেগেছে। শিউলিকে শহরে নিয়ে যেতে নাহিদ এসেছে আজ। এই দিনটির জন্য সালমা বেগম অপেক্ষা করছিলেন। রান্নাঘরের পেছনে জমানো শুকনো তালের আঁটিগুলোর ভিতরে শাঁস হয়ে গেছে এতদিনে। আজ মন্টুকে দিয়ে ওগুলো কাটিয়ে শাঁস বের করে নিচ্ছেন। প্রতিবছর এই সময় তালের আঁটির ভিতরের শাঁস দিয়ে মিষ্টান্ন তৈরি হয়। নারিকেল-গুড়ের কুলি পিঠার জন্য চালগুড়া করে রাখা ছিল আগেই। গাশ্বির রাত উপলক্ষে নানান রকম খাবার তৈরি হবে আজ। নাহিদের সাথে শিউলির দেবর-ননদ আসায় বকুলদের জন্য এবারের উৎসবের মজাটা অন্যবারের তুলনায় কিছুটা বেশি। দীপাকে সাথে নিয়ে একে একে সব ধরনের উপকরণ সংগ্রহ করে বেটে উঠোনে শিশিরে ভেজানোর উদ্দেশ্যে রেখে দেয় বকুল। সবাই মিলে আজ শেষ রাত্রে গোসলের আগে এগুলো গায়ে মাখবে ওরা।
রাত নামার সাথে সাথে বাড়িটা কেমন যেন নিরব হয়ে যায়। নির্জন রাতে চাঁদের মায়াবী আলোচ্ছটাকেও ম্লান মনে হয়। ঘন গাছপালার আড়ালে জমে থাকা ছোপ-ছোপ অন্ধকার পরিবেশটাকে আরও গম্ভীর করে তুলেছে। ঘরের সামনের সিঁড়িতে বসে আছে শিউলি। শিপন, দীপা, অয়ন ঘুমিয়ে পড়েছে একটু আগেভাগেই। অয়ন বলে রেখেছে, শেষরাতে গোসলের আগে ওকে অবশ্যই তুলে দিতে হবে। সুবলদের বাড়িতে গাশ্বি উৎসবের আয়োজন দেখে ও বেশ উচ্ছ্বসিত। আগামীকালের কথা ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে যায় শিউলির। এ বাড়িতে আজকেই ওর শেষ রাত। কাল সকালে চলে যাবে শ্বশুর বাড়ি। তারপর সেখান থেকে শহরে। আবার কবে আসবে কে জানে! একে একে সবার মুখ ভেসে ওঠে মনেÑ বাবা, মা, অয়ন, বকুল। চাইলেই যখন তখন আর ছুঁটে আসতে পারবে না ওদের কাছে। কিছুক্ষণ পর বকুল এসে পাশে বসে। বড়দিকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। শিউলির মনটা আরও খারাপ হয়ে যায়। নিজেকে সামলে নেয়। বকুলের চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলে- ‘অনুরে দেইখ্যা রাখিস। ও তো অবুঝ, ওর লগে রাগারাগি করিস না। বাবার দিকে খেয়াল রাখিস আর মা’রে কামে সাহায্য করিস। আমি শহরে গিয়েই চিঠি দিমু, তুইও আমারে চিঠিতে সবকিছু জানাবি। আমার অবস্থাটা চিন্তা কর, তোগো সবাইরে ছাইড়া আমি ঐ অচেনা শহরে ক্যামনে থাকুম?’ বকুল বোঝে একমাত্র বোনটির মনের অবস্থা। ‘বড়দি, তুই মন খারাপ করিস না, বাবা তো কইছে কয়দিন পরই তোগো দ্যাখতে যাইবো।’
হরিপদ ঘোষের বাড়িতে রাতটি যেন আনন্দের বন্যায় ভাসছে। গাঁয়ের অন্যান্য বাড়ি থেকে সমবয়সী ছেলেমেয়েরা এসে জমা হয়েছে ওদের বাড়ির উঠোনে। আজ রাতভর গান বাজনা আর আনন্দে মেতে থাকবে সবাই। চারুর গানের গলা বেশ। আশেপাশে কয়েক গ্রামে ওর কণ্ঠের প্রশংসা শোনা যায়। এলাকায় যে কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তাই চারুর উপস্থিতি থাকবেই। উঠানের মাঝখানে বিছানো পাটিতে বসে সুরেলা কণ্ঠে গান ধরেছে চারু। শ্যামল আর তাপস চারুর গানের সাথে তাল মিলিয়ে হারমোনিয়াম-তবলা বাজিয়ে চলেছে। শিখা বসেছে শ্যামলের উল্টা পাশে। আকাশে রূপালী চাঁদ ঝলমল করে, সেই আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ঘোষ বাড়ির আঙিনা। শ্যামল অপলক তাকিয়ে ছিল মুখোমুখি বসা শিখার দিকে। শিখাও গান করে। যদিও চারুর মতো সুমধুর কণ্ঠের অধিকারিণী সে নয়, তবে আজকের অনুষ্ঠানে বিশেষ কারো কাছে তার আলাদা গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। চারুর সুললিত কণ্ঠের জাদুময়ী দ্যুতির রেশ কাটতে না কাটতেই শিখার কণ্ঠে বেজে ওঠে ‘চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে, অন্তরে আজ দেখব, যখন আলোক নাহি রে’। ঠিক সেই মুহূর্তে দূর আকাশের চাঁদের রূপের আলোচ্ছটা ছাপিয়ে আরেকটা মোহনীয় রূপ শ্যামলের অন্তরে দীপ্তি ছড়াচ্ছিলো।
গান, গল্প আর আনন্দ আয়োজনে রাত্রি গভীর হয়, গাশ্বির মজাটাও জমে ওঠে। সুবলের জন্য আজকের রাতটা অনেক বেশি আনন্দের। গতবারের গাশ্বির রাতে এতটা মজা পায়নি সে। তাপসদা ওকে জিজ্ঞেস করে- একটা মজার খেলা দেখবি?
তাপসদা’র সবকিছুই সুবলের ভালো লাগে। প্রবল আগ্রহ নিয়ে ও ঘাড় কাত করে সায় দেয়।
তাইলে খেজুরের ডালের গোড়া থেইক্যা শুকনা জাল্লি আর বড় কচুপাতা নিয়া আয়।
গোয়ালঘরের পাশেই শুকনো খেজুরের ডালপালা স্তূপ করে রাখা। সুবল কাঁটা এড়িয়ে খেজুরের ডগার গোড়া থেকে সরু শলাকাযুক্ত কিছু পাতলা জাল আর কিছু কচুপাতা এনে জড়ো করে। তাপস শুকনো জালগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ অপেক্ষা। পাতলা জালগুলো পুড়ে ছাই হলেও শলাকাগুলোতে তখনো আগুন জ্বলছিলো। তাপস কিছুটা আধোনিভু ছাই বড় কচু পাতায় মুড়িয়ে রশি দিয়ে মুখটা আটকায়, তারপর পাতার বলটায় ছোট ছোট ছিদ্র করে রশিটা সুবলের হাতে ধরিয়ে দেয়। সুবল রশি হাতে ধরে বলটা সাঁই সাঁই করে মাথার উপরে ঘোরায়। সবাই অবাক হয়ে দেখে- কচুপাতার ছোট ছোট ছিদ্র দিয়ে জ্বলন্ত শলাকাগুলো বের হয়ে চারিদিকে ছুটছে। যেন আগুনের ফোয়ারা।
গান-আড্ডায় মাঝরাত পেরিয়ে যায়। রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মেয়েরা, অনেকটা পিকনিকের আমেজে। আশ্বিনের শেষরাতে গোসল শেষে কার্তিকের সকালে শুরু হবে ভোজন পর্ব। এটি যেন গ্রামবাংলার চিরাচরিত প্রথা।
রাত্রি অন্তিম প্রহরে পৌঁছে গেলে শুরু হয় অন্যরকম খেলা। শিশিরে রেখে দেওয়া তরল একে অন্যের গায়ে মাখিয়ে দেয়। শ্যামল বসেছিলো উঠনের মাঝে, পাটিতে। হঠাৎ সুবল ছুটে এসে দাদার গায়ে হলুদ আর পাতার তরল মাখিয়ে দেয়। শ্যামল সহাস্যে কাঁধে তুলে নেয় ছোট ভাইটিকে। ওর গায়ে মাখিয়ে দিতে দিতে চোখ পড়ে শিখার দিকে। ডালা থেকে মাখানো হলুদ নিয়ে নিঃশব্দে শিখার পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। আচমকা দু’গালে ভেজা তরলের স্পর্শে চমকে উঠে ঘুরে তাকায় শিখা। সামনে শ্যামলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই দৌড়ে পালায় ঘরের সিঁড়ির দিকে।
সূর্য ওঠার আগেই কোটাখালী খালের দু’পাড়ে শুরু হয় ভিন্ন রকম এক উৎসব। আশ্বিনের বিদায় লগ্নে খালের দু’পাড়ের ঘাটগুলোতে যেন মানুষের মেলা বসে যায়। এই খালে একসাথে এত মানুষের সমাবেশ এই একটি দিনেই হয়ে থাকে। নতুন দিনের আগমনের প্রত্যাশায় শ্যামলপুরের মানুষেরা এভাবেই স্মরণীয় করে রাখে আনন্দের এই রাতটিকে।










কলাবতী বাজারে উদয়ন সবুজ সঙ্ঘ নামের ক্লাবঘরটা প্রায় সারাদিনই তরুণদের পদভারে মুখরিত থাকে। গ্রামের শিক্ষিত তরুণেরা দিনের বেশির ভাগ সময় এখানেই কাটায়। নিজেদের উদ্যোগে ক্লাবঘরের ভিতরে একটি পাঠাগার গড়ে তুলেছে। প্রতি বছরই ক্লাবের ছেলেরা স্বাধীনতা দিবস-বিজয় দিবসে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। বছরের অন্যান্য সময়ও বিভিন্ন খেলাধুলার প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করে।
ক্লাবঘরটিতে তরুণদের আনাগোনা শুরু হয় বিকাল থেকেই। বিজয় দিবসের খুব বেশি দেরী নেই। প্রত্যেকেরই মধ্যেই বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য তাড়া লক্ষ করা যায়। শ্যামল আর তাপসের গ্রামে আসার খবর পেয়ে আজ একটু আগেই ক্লাবে এসেছে আসাদ আর তপু। ক্লাবের সব অনুষ্ঠানের মধ্যমণি হলো শ্যামল। ও না থাকলে কোনোকিছুই যেন জমে না ঠিকমত।
পড়ালেখার কারণে শ্যামল আর তাপসের বাড়িতে আসা হয় কম। গত পূজার ছুটিতে যে ক’দিন বাড়িতে ছিল নানা ব্যস্ততায় কেটে গেছে। এদিকটায় আসা হয়নি তেমন। তাই এবার কিছুদিন বেশি সময় নিয়ে এসেছে। আজ দীর্ঘদিন পর কলাবতী বাজারের দিকে যাচ্ছে শ্যামল। বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান নিয়ে অনেক কাজ করতে হবে। একসময় এই ক্লাবটিই ছিল শ্যামলের প্রাণ। ক্লাবের এসব কাজের মূল দায়িত্বটা পালন করতে হত তাকেই। তাপস, রিয়াজ, আসাদ, সজল, তপন, অপু, কাজল, তপু, রঞ্জু- সবাই মিলে ক্লাবের লাইব্রেরীটা গড়ে তুলবার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে। গ্রামের ঘরে ঘরে ছুটে বেড়িয়েছে ফান্ড কালেকশনের জন্য। ওদের এই পরিশ্রমের ফলে আজ দাঁড়িয়ে গেছে লাইব্রেরিটা।
গ্রাম থেকে বাজারে ঢোকার মুখেই চোখে পড়ে ঝকঝকে একটা স্টেশনারি দোকান। এটা নতুন উঠেছে। আগে এখানটাতেই ছিল হারান দাদুর হোমিও ফার্মেসীটা। আজ অনেকদিন পর হারান দাদুকে খুব মনে পড়ছে ওর। ছেলেবেলায় ওঁর ফার্মেসিতে গেলেই এক ধরনের সাদা দানার মতো মিষ্টি ওষুধ খেতে দিতেন। ওটা খাবার জন্যই ওঁর ওখানে যেত শ্যামল। হারান দাদু চলে যাবার সময়টা খুব কষ্টকর ছিল শ্যমলের জন্য।
ক্লাবের কাছাকাছি যেতেই ভেতর থেকে হই-হুল্লোড় কানে ভেসে আসে। দরজা দিয়ে তাকে ঢুকতে দেখেই আসাদ ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে।
ইস! কতদিন পরে তোরে পাইলাম! এইবার কিন্তু অনেকদিন থাকতে অইবো।
, এইবার বেশ কয়েকদিন থাকুম, তোদের খবর কি?
খবর ভালো, তোরে আর তাপসরে আমরা সবাই অনেক মিস করি।
তোরা তো সবাই একসঙ্গেই থাকস, আমি আর তাপস তো তোগো সবাইরে মিস করি।
সামনেই তো বিজয় দিবস, এইবার তোগো কিন্তু আগেই গ্রামে আইতে অইবো। তুই না থাকলে আমরা সবকিছু সামলাইতে পারুম না।
পরীক্ষাটা শেষ হইলেই আমি চইলা আসুম, তয় তার আগ পর্যন্ত কাজটা কিন্তু তোগোই আগাইয়া নিতে অইবো।
ওদের কথা বলার মাঝেই আরও অনেকে এসে হাজির হয়। অনেকদিন পর সবাই মিলে গল্প আড্ডায় মেতে ওঠে।
এইবার নাটকটা করতে চাই, তোগো কী মতো? বলে ওঠে তপু।
গল্প নির্বাচন, নাট্যরূপ দেয়া, অনেক সময়ের ব্যাপার! এত অল্প সময়ে পারবি? শ্যামল বলে।
গতবার যে নাটকটা আমরা করতে চাইছিলাম, হেইডা করলে ক্যামন অয়?
হুম, তা করা যায়। তয় নাট্যরূপের কাজটা তহন তো শেষ করা অয়নাই। আগে শেষ কইরা নিতে অইবো। পুরনো স্ক্রিপ্টটা নিয়া ইসমাইল স্যারের লগে বইতে অইবো, শ্যামল বলে।
তাইলে কাইল থেইক্যাই আরাম্ভ করি, তুই কয়দিন আছস? রিয়াজ জিজ্ঞেস করে।
আমরা আরও সপ্তাহখানেক আছি, তাপস উত্তর দেয়।
তোরা থাইক্যা শুরু কইরা দিয়া যা, আমরা কাজটা আগাইয়া নিমুনে। শ্যামল, তোর কিন্তু কমপক্ষে বিশ দিন আগেই আইতে অইবো। তপু বলে ওঠে।
সবচেয়ে বড় যে ব্যাপারটা, সেটা হলো ফান্ড কালেকশন। এই ব্যাপারে মাস্টার চাচা, হামিদ চাচা আর সাঈদ চাচার লগে আলাপ করতে অইবো। ফান্ডের ব্যাপারে ওনারা আগাইয়া না আইলে কামডা অনেক কঠিন অইয়া যাইব। সিরিয়াস ভঙিতে বলে উঠলো কাজল।
তো চল আইজক্যাই কতা কই! ভালো কামে দেরী করণ ঠিক না। কাজলের কথার পিঠে বলে সজল।
শ্যামল ঢাকা থেকে ওর নতুন আনা বইগুলো লাইব্রেরির সেলফে সাজিয়ে রাখতে রাখতে বলে,
বইয়ের কালেকশন কী রকম বাড়ছে রে?
কিছু বাড়ছে, তয় আরও বই দরকার। তপু উত্তর দেয়।
এইবার অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে ফান্ড কালেকশনের সময় বইয়ের জন্য কিছু বাজেট রাখতে অইবো। আশেপাশের সব গ্রামের ঘরে ঘরে যাইয়া ধান তুলতে অইবো, হাটে বেচতে অইবো, অনেক কাজ। জুনিয়র পোলাপানের একটা লিষ্ট কর। এই সময় ওগোই বেশি কামে লাগবো।
এইবার কোনো জায়গায় আয়োজন করবি? রিয়াজ জিজ্ঞেস করে।
ক্যান? বটতলায়। শ্যামল জবাব দেয়।
বাদইল্যারা আবার ঝামেলা করতে পারে, মনে নাই গতবারের কথা?
আমরা ইচ্ছা করলে ক্লাবের মাঠেও করতে পারি কিন্তু প্রতি বছর বটতলাতেই করে আসছি, অগো কারণে জায়গা বদল করতে অইবো? ওরা যা চাইবে তাই অইবো নাকি? এই ব্যাপারে মাস্টার চাচাগো লগে আলোচনা করতে অইবো।
, আইজকেই মাস্টার চাচাদের লগে বইসা ব্যাপারটা ঠিক কইরা নেই। সন্ধ্যার মধ্যেই সবাইরে আইতে ক’। ঐ সময় মাস্টার চাচার দোকানে সবাইরে একলগে পাওয়া যাইব। আসাদ বলে ওঠে।
সাত্তার মাস্টারের লাইব্রেরির সামনে জড়ো হয়েছে সবাই। উঠতি বয়সী তরুণদের অনেকেই বেশ উত্তেজিত। শ্যামল সবাইকে থামায়।
বটতলাতেই অনুষ্ঠান অইবো। এইডা আমাগো ঐতিহ্যের ব্যাপার, প্রত্যেক বছর বটতলাতেই আমরা বিভিন্ন অনুষ্ঠান কইরা আইতাছি। এহন হঠাৎ কইরা জায়গা বদল করার কতা উঠতাছে ক্যান? সাত্তার মাস্টার বলেন।
চাচা, গতবার বাদইল্যারা ঝামেলা করছিলো। আসাদ বলে।
কেডা বাধা দেবো? ঘাট-হাটের ইজারা হইছে, বটতলা কাউরে ইজারা দেওয়া হয় নাই। তোরা অইহানেই আয়োজন কর। সমস্যা অইলে আমরা দেখুম। ক্ষুব্ধকণ্ঠে বলে ওঠেন হামিদ শেখ।
চাচা, খরচের ব্যাপারটাও দেখা দরকার। গ্রামের সবার কাছেই যাইতে অইবো। কিন্তু মূল ফান্ডিং এর বিষয়টা আপনাদের উপরই নির্ভর করবে, শ্যামল বলে।
তোরা একটা বাজেট কর, তারপর আলোচনা কইরা ঠিক করন যাইব। সাঈদ খান বলেন।
সাইদ খানের কাছ থেকে আভাস পেয়ে আসাদ বলে- এ বছর আমরা একটা নাটক নামাইতে চাই।
ছেলেদের উজ্জীবিত দেখে হামিদ শেখ বলেন- এইডা তো খুব ভালোা কতা। পারফরমার কী তোরাই থাকবি নাকি বাইরে থেইক্যা আনবি?
বাইরে থেইক্যা আনলে অনেক খরচ, ভাবতাছি আমরা নিজেরাই করুম। রিয়াজ বলে।
ঠিক আছে, তোরা শুরু কর, আমরা তোগো পাশে আছি। ইসমাইল আর আতিকরে সাথে রাখিস। বলে ওঠেন সাঈদ খান।
নাটকের জন্য তো ইসমাইল স্যারের সাহায্য লাগবোই। আবৃতির জন্য আতিক ভাইরে। আসাদ বলে।
শ্যামল বলে- তাইলে চাচা, আমরা একটা বাজেট রেডি করি, তারপর আপনাগো লগে বমুনে।
আচ্ছা ঠিক আছে, তোরা কাম আগাইয়া নে। সাত্তার মাস্টার বলেন।
কলাবতী বাজারের উদয়ন সবুজ সংঘ আয়োজিত অনুষ্ঠান সম্পর্কে আশেপাশের মানুষের বেশ উচ্চাশা। এবারও প্রত্যেকের মধ্যে সেই সুনাম অক্ষুন্ন রাখার চেষ্টা। এলাকার মুরুব্বীদের কাছ থেকে আশ্বাস পেয়ে ওরা সবাই বেশ উৎফুল্ল। আজ থেকেই আয়োজনের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে সবাই। নিজেদের মধ্যে কাজগুলো ভাগ করে নেয়। কেউ ব্যস্ত হয়ে পড়ে নাটক, কেউ গান, কবিতা নির্বাচন নিয়ে। আবার কয়েকজন স্টেজ তৈরি, আলোকসজ্জার ব্যবস্থা অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের লিস্ট করার কাজে।
কয়েকমাস পর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন। নির্বাচনের সময় যত কাছে এগিয়ে আসছে মানুষের মধ্যে আগ্রহ যেন ততই বাড়ছে। বিকেল থেকে কলাবতী বাজারের সর্বত্র সরগরম থাকে। সবার মুখে একই আলোচনাÑ ভোট। সম্ভাব্য প্রার্থী আর তাদের ব্যক্তিগত ইমেজ নিয়ে আলোচনা সমালোচনায় মুখর হয় বিভিন্ন বয়সী লোকজন। শোনা যাচ্ছে এবারের নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে বর্তমান চেয়ারম্যান বশিরুল্লাহ পাটোয়ারী আবার দাঁড়াবেন। উজানপুরের সাঈদ খানের নামও শোনা যাচ্ছে। মেম্বার পদে খালেক তালুকদারের পাশাপাশি অন্য যে নামটা বেশি আলোড়ন তুলছে সে হলো হারু গাজীর ভাইÑ মজনু। মজনুর নামটা আসার সাথে সাথেই সচেতন হয়ে উঠেছে খালেক তালুকদার। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চিন্তার কারণ তার ভাই বাদল। মজনুর সাথে বাদলের রেষারেষি তাকে বেশ সংকটে ফেলে দিয়েছে। মনে মনে ফন্দি আঁটে কী করে মজনুকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা যায়।
উজানগাঙের পাড়ে বটতলার হাট থেকে কিছুটা সামনে এগিয়ে নদীর পাড় ঘেঁষে খালেক তালুকদারের স-মিল। স-মিলের পাশেই ছোট একটা ঘর তুলে নিয়েছে বাদল। এই ঘরটাকেই ওরা ব্যবহার করে আড্ডার স্থান হিসেবে। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর থেকে শুরু করে অনেক রাত অবধি এখানে বসেই তাস-জুয়ার আসর চলে। বাদলের সাথে এই ঘরের প্রতিদিনের নিয়মিত সদস্য হলো মজনু, গিয়াস, মনা, জব্বার, রইস, পলাশ, সাজু আর কাসেম। তবে ঘাট নিয়ে বিরোধের কারণে বাদলের সাথে কিছুটা দূরত্ব হবার পর মজনু, গিয়াস, সাজু, পলাশদের এদিকে দেখা যায় না আর।
খালেক তালুকদার তার বর্তমান মেম্বার পদটা যে কোনো মূল্যে ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর। নির্বাচনে জয়লাভে পথ পকিষ্কার করার সব রকম চেষ্টা করে চলে সে। স-মিলের ছোট ঘরে আলোচনায় ব্যস্ত বাদল আর খালেক তালুকদার।
ভালো কইরা খবর নে তো হাছা-হাছাই মজনু এইবার ভোটে খাড়াইবো কিনা। বাদলের উদ্দেশ্যে বলে খালেক তালুকদার।
তুমি কোনো চিন্তা কইরো না, অর দৌড় আমার জানা আছে। অর ব্যবস্থা আমিই করতাছি।
, তোর উপর ভরসা কইরা আরও ভরাডুবি হউক! তোর লইগাই মজনুর প্রতি গ্রামের মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। না অইলে অরে ডরানোর কোনো কারণ আছিলো না। কী দরকার ছিল এই সময় নদীর ঘাট নিয়া এত বাড়াবাড়ি করনের?
তুমি যদি কও তয় অরে সরাইয়া দেই?
, কী বুদ্ধির ঢেকি! এহন এমন কাম কইরা ষোলোকলা পূরণ কর আর কি!
তইলে এহন কী করবা?
ওর লগে খাতির জমা। আবার আগের মতোই স্বাভাবিক অইয়া যাবি। এমনভাবে চলবি যেন কিছুই অয়নাই।
তারপর?
সময়মত কমু তারপরে কী করতে অইবো।
আইচ্ছা। ভাইয়ের কথায় সম্মতি প্রকাশ করে বাদল।












হেমন্ত এসে আসন গেড়েছে প্রকৃতিতে। বিকেলগুলো সব দ্রুত ফুরিয়ে যায়। দুপুরের পর থেকেই ছায়ারা ছুটে পালাতে থাকে। গোধূলির লালাভ আভাগুলো ছড়িয়ে পড়ে দিগন্তজুড়ে। শেষ বিকেলে অয়ন বাবার লাইব্রেরির সামনে বসে আছে। হঠাৎ ওর দৃষ্টি চলে যায় দূরে। বটতলার নদীর ঘাট ছাড়িয়ে আরও দূরে। ওখানে নদীর পাড়ে ভিড়িয়ে রাখা অনেকগুলো নৌকা। অয়ন অবাক হয়ে ভাবে, ওখানে এত নৌকা এলো কোথা থেকে? মন্টু মামাকে জিজ্ঞেস করতেই সে বলে- ঐগুলান বাইদ্যার নাও। অয়নের কৌতূহল বেড়ে যায়। বাবা এসে ওর পাশে বসতেই জানতে চায়,
আইচ্ছা বাবা, অতগুলান নৌকা অইহানে কী করে?
ওরা অইহানে কয়েকদিন থাকবো।
ক্যান, অইহানে থাকবো ক্যান?
বেদেদের কোনো ঘরবাড়ি নাই, নৌকাতেই বসবাস করে ওরা। এক জায়গায় বেশিদিন থাকেনা, নৌকা কইরা বিভিন্ন জায়গায় ঘুইরা বেড়ায়। যখন যেখানে নৌকা ভিড়ায় সেখানে সাপ ধরে, সাপের খেলা দেখায়। কখনো চুড়ি-ফিতা বেঁচে, দাঁতের পোকা তোলে। এভাবেই ওরা জীবিকা নির্বাহ করে।
ওরা সাপ ধরে! ডর লাগে না?
না, ওরা ছোডবেলা থেইক্যাই এই কাম করে, তাই অগো ডর লাগে না।
অগো কাছে গ্যালে কী ডর দেহাইবো?
না, তা ক্যান? ওরা তো খারাপ মানুষ না। সাপ ধরে, সাপের খেলা দেখাইয়া ওরা জীবন ধারণ করে।
বাবা, আমি মন্টু মামার লগে অইহানে যামু?
যাও, তয় সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিইরা যাইও।
আইচ্ছা।
অয়ন মন্টু মামার সাথে উজানগাঙের পাড়ে ভিড়িয়ে রাখা বেদে নৌকাগুলোর দিকে এগিয়ে চলে।
মাস্টারসাব কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন নদীর পাড়ে ভিড়ানো বেদে বহরের দিকে। মনে মনে ভাবেন, কী অদ্ভুত এদের জীবন! যুগ যুগ ধরে এরা যাযাবর জীবনযাপন করে আসছে। কোথাও স্থায়ী আবাস মেলেনা। বিষধর সাপ নিয়ে খেলা করেই কেটে যায় সারাটা জীবন। কখনো সাপের কামড়ে মারাও যায় কেউ কেউ। কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। গাঁয়ের পথে পথে মাথায় সাপের ঝুড়ি আর কাঁধে কাপড়ের পুটুলি নিয়ে হেঁটে বেড়ায় বেদে মেয়েদের দল। কেউ কেউ তাদের শিশু সন্তানকে পিঠে ঝুলিয়ে বয়ে বেড়ায়। সাপের খেলা দেখানো, কখনো কখনো শিঙা টানা, দাঁতের পোকা বের করাÑ কত অদ্ভুত ধরনের কাজ করতে হয় বেঁচে থাকার তাগিদে। যদিও বেশির ভাগ মানুষই জানে এগুলোর কোনো ভিত্তি নেই, অনেকে নিছক মনোরঞ্জনের জন্য এদেরকে ডাকে।
এই যূথচারী মানবগোষ্ঠীর যাযাবর জীবনেও থাকে নানা ঘাত প্রতিঘাত। বিভিন্ন এলাকায় সমাজপতি কিংবা বখাটেদের খপ্পরে পড়ে এদের হারাতে হয় অনেক কিছুই। বেদে বহরের তরুণী বেদেনীদের সৌন্দর্যের মাদকতায় অনেক তরুণের মাথা ঘুরে যায়। আর তখনই বেদে মেয়েরা এদের লোলুপ দৃষ্টির শিকার হয়। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়না।
নদীর পাড়ের স-মিলের ছেলেগুলোর দৃষ্টি পড়ে এই বহরের মেয়েদের উপর। গতকালই বেদে বহরের বৃদ্ধ সর্দারকে দেখা গেল স-মিলে এসে খালেক তালুকদারের কাছে নালিশ জানাতে। “বাবুরা, আমরা দুই দিনের লাই তোমগো ঘাটে আইছি। দয়া কইরা আমগো মেয়েছেলেদের দিকে নজর দিও না”। খালেক তালুকদার বাদলকে ডেকে শাসিয়ে দেয়। নির্বাচনের আগে আর কোনো রকম ঝামেলা যাতে না হয়।
বটতলার হাট ছাড়িয়ে নদীর তীর ধরে কিছুদূর এগিয়েই অয়ন দেখতে পায় উজানগাঙের পাড়ে বেশ কিছু রঙ-বেরঙের নৌকা ভিড়ানো। নৌকাগুলো দেখতে অন্যরকম। ওরা যে ছই-ওয়ালা নৌকায় চড়ে, তেমন না। প্রতিটা নৌকার সামনের দিকে দরজা লাগানো। সামনের খালি জায়গাটুকুতে চুলা বসানো আছে, সেখানে রান্নায় ব্যস্ত পুরুষ বেদেরা। মহিলাদের দেখা যায় না আশেপাশে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খেলা করছে ডাঙায়, তাদের অনেকের পরনে নেই কোনো জামাকাপড়।
কিছুক্ষণ পর মাথায় গোল ঝুড়ি নিয়ে কয়েকজন মহিলা ফিরে আসে নৌবহরের দিকে। ওদের কথা বলার ধরনটাও অন্যরকম। অয়ন মন্টু মামাকে জিজ্ঞেস করে,
মামা, অগো মাথার টুকড়িতে সাপ আছে?
মন্টু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। তারপর ওকে জিজ্ঞেস করে, সাপ দেখবা?
না, আমার ডর লাগে। যদি কামড় দেয়?
মন্টু হাসে।
এই সাপে বিষ নাই। অগো বিষদাঁত ভাইঙ্গা দেওয়া অইছে।
তবুও, আমি দেখুম না। ওরা সাপ ধরে ক্যান?
সাপ না ধরলে অগো চলবো ক্যামনে? এইডাই তো অগো কাম।
ওরা খুব গরীব না?
, খুব গরীব।
অয়ন অনেকক্ষণ রাস্তার ধুলাবালির মধ্যে উলঙ্গ বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। ওদের জীবনযাত্রা দেখে ছোট্ট অয়নের মনেও প্রশ্ন জাগে-মানুষের জীবন এত কষ্টের কেন?
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। আগুনরঙা গোধূলি আর পশ্চিম আকাশে ডুবন্ত লাল সূর্যটাকে ক্রমশ ঢেকে দেয় হালকা কুয়াসা আর অন্ধকারের চাদর। নদীর পাড় ধরে ওরা আবার ফিরে আসে বাবার দোকানে।
অন্ধকার নেমে এসেছে চারিদিকে। মন্টু মাস্টারসাবের দোকান থেকে টর্চটা নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। অয়ন মন্টু মামার সাথে কলাবতী বাজার ছাড়িয়ে নদীর পাড় ধরে এগিয়ে চলে। সন্ধ্যার নির্জনতায় একটা ছমছমে ভাব, আশেপাশের অনেকটা জায়গা জুড়েই অন্ধকারটা জমাট বাঁধতে শুরু করেছে মাত্র। বাজারের শেষ মাথায় তেঁতুল গাছটির কাছাকাছি আসতেই পেছন থেকে জামায় টান পড়ে মন্টুর।
মামা!
কি মামা?
অয়ন নিশ্চুপ। মন্টু মামার হাত ধরে দাঁড়িয়ে পড়ে।
ডর লাগতাছে?
অয়ন নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকায়। মন্টু দেখতে পায় না, তবে বুঝতে পারে যখন অয়ন মন্টুর আরও কাছে ঘেঁষে আসে। সামনের দিকে নির্দেশ করে মন্টু বলে,
ও বুঝছি; ওঁনার কথা মনে কইরা ডর লাগতাছে?
তেঁতুল গাছের মাথায় আবছা অন্ধকারের দিকে চোখ পড়তেই অয়নের সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে। মন্টুর জামার কোণটা খামচে ধরে সে। মন্টু অয়নের পিঠে হাত রেখে বলে,
ডর কী মামা? আমি তো তোমার লগেই আছি।
অয়ন জোর করে গাছ থেকে চোখ সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। নিজের অজান্তেই চোখ দু’টো চলে যায় গাছের ডালপাতায় জমে থাকা অন্ধকারের দিকে। সন্ধ্যার পর বাজারটা জমজমাট হয়ে উঠেছে কেবল। আরও কিছু সময় অতিবাহিত হলে ধীরে ধীরে ঘর-ফেরত মানুষের দল বাড়ির পথ ধরবে। এই মুহূর্তে পুরো জায়গাটা একদম ফাঁকা। অয়ন ধীরে ধীরে মন্টু মামার শরীরের সাথে সেঁটে থাকে। তেঁতুল গাছের নিচে আসতেই বাতাসে ডাল-পাতার ঘর্ষনের শব্দ আর পাখিদের কিছুটা অদ্ভুত ডাকাডাকি ওর ভয়ের মাত্রাটাকে বাড়িয়ে দেয় আরও। মন্টু মামাকে জাপটে ধরে বলে,
মামা, অনেক ডর লাগতাছে।
হুনো, উনি হইলেন আমগো গেরামের মুরুব্বী। উঁনি মানুষের কোনো ক্ষতি করেন না। ওঁনারে ডরানোর কিছু নাই। 
টর্চটা জ্বেলে দিতেই সামনের পথটাতে আলো ছড়িয়ে পড়ে, তবে গাছের উপরের অন্ধকারটা কাটে না। কথায় কথায় ছোট্ট অয়নকে ভুলিয়ে রাখতে চেষ্টা করে মন্টু। তেঁতুল-তলার পথটুকু পেরিয়ে আরও সামনে এগিয়ে গেলে অয়নের ভয়ের মাত্রা কিছুটা কমে। ৩ মাথার মোড়ে এসে বাড়ির দিকের রাস্তায় নামতেই গাঢ় অন্ধকার এসে গ্রাস করে ওদের। ঘাসে ছাওয়া রাস্তার মাঝখান দিয়ে মাথার সিঁথির মতো সরু সাদা মেঠোপথটা আবছায়াভাবে দেখা যায়। মন্টু টর্চের আলোটা ছড়িয়ে দিতেই নিমেষে উজ্জ্বল আলোটা সামনের পথটাকে চোখের সামনে ভাসিয়ে তোলে। আলো নিভে গেলে আবার সব অন্ধকার। মামার হাত ধরে অয়ন হেঁটে চলে। কিছুটা শীত শীত লাগে। হঠাৎ দেখতে পায় কালো একটা অবয়ব এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। অয়ন মন্টু মামার হাতটা শক্ত করে ধরে আবার।
মামা! দ্যাহো, অইডা কি?
মন্টু টর্চ জ্বালায়। টর্চের চোখ ধাঁধানো আলো গায়ে পড়তেই বিড়ালটা রাস্তার মাঝখান থেকে দৌড়ে পাশের ঝোপের মাঝে হারিয়ে যায়।
কলেজ থেকে বাড়ি ফিরছিলো শিখা। নিজের নাম ধরে কয়েকবার ডাক শুনে পেছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখলো সুশীল তার দিকে এগিয়ে আসছে।
কী রে! তোরে কতক্ষণ ধইরা ডাকতাছি!
শুনতে পাইনাই রে! কেমন আছোস সুশীল?
ভালো, তোর একটা চিঠি আছে।
আমার চিঠি! কোত্থেইক্যা আইছে?
ঢাকা থেইক্যা।
দে তো দেখি!
শিখা চিঠিটা হাতে নিয়েই বুঝতে পারে এটা শ্যামলের চিঠি। কিছুটা অবাক হয়, ভেতরে ভেতরে অবশ্য খুশিও হয়। পরক্ষণেই আবার আশঙ্কাটা জাগে, সুশীল যদি জানতে চায়Ñ কার চিঠি। সামনে চোখ পড়তেই দেখে সুশীল তার দিকে তাকিয়ে আছে। শিখা না বোঝার ভান করলো। তখনই সুশীল জিজ্ঞেস করলো,
কার চিঠি রে!
শিখা ত্বরিৎ জবাব দেয়- বুঝতে পারতাছি না, কোনো আত্মীয়ের হইতে পারে। তোর কী অবস্থারে সুশীল? শিখা দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টায়।
এই একরকম চইলা যাইতাছে।
লেখাপড়াটা একেবারেই ছাইড়া দিলি!
একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুশীল বলে,
সবকিছু সবার লইগ্যা না রে! আইচ্ছা যাই, ভালো থাকিস।
সুশীল চলে যায়। শিখা সেদিকে তাকিয়ে ভাবে, সুশীলও এখন কলেজে পড়তে পারতো। স্কুলে একই ক্লাসে পড়তো ওরা, ছাত্র হিসেবেও খারাপ ছিল না; কেবল অভাবের তাড়নায় পড়ালেখাটা আর হলো না তার। এখন পোস্ট অফিসের চাকরিটাই একমাত্র ভরসা।
দুপুর হলে ঘুমে জড়িয়ে আসে দু'চোখ। একটু আগে এক পসলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। কিছুটা ঠা-া ঠা-া ভাব। শিখা নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে ভাবছে শ্যামলের এভাবে চিঠি পাঠানো ঠিক হয়নি। দাদা কিংবা বাবার হাতে পড়তে পারতো! তখন কী হতো? তবে চিঠিটা হাতে নিতেই একটা পুলক জাগে মনে। দরজার খিলটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে বালিশে উপুর হয়ে শুয়ে ধীরে ধীরে চিঠিটা খুলল সে। এই প্রথম শিখা কারো চিঠি পেলো, তাও আবার তার প্রিয় মানুষটির! শ্যামলের সুন্দর হাতের লেখায় ছোট্ট একটি চিঠি।
প্রিয় শিখা,
চিঠিটা পেয়ে খুব অবাক হয়েছিস তাই না? একবার ভেবেছিলাম চিঠি পাঠানোটা বোধহয় ঠিক হবে না, শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে নিজের মনের কাছে হেরে গেলাম। তুই হয়তো রেগে যাবি, কিন্তু বিশ্বাস কর- আমার কিছুই করার ছিল না। তোকে না লেখা পর্যন্ত কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলাম না।
এবার বাড়িতে গিয়ে আমার বেশ ক্ষতি হয়ে গেলো। ফিরে আসার পর থেকে কোনো কিছুতেই আর মন বসাতে পারছি না। চোখের সামনে কেবল তোর মুখটাই ভেসে ওঠে। কাজল-কালো দু'টি চোখের মায়া আমি ভুলতে পারছি না, এক মুহূর্তের জন্যও না।
এই প্রথম অনুভব করলাম, কাউকে ভালোবাসতে হলে নিজেকে উজাড় করে দিতে হয়। বিশ্বাস কর, তোকে ভালোবেসে আমি আজ নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি। সামনে পরীক্ষা, কিন্তু তুই যে আমার পড়ার সময়টাতে ভাগ বসিয়ে দিলি! পড়তে পড়তে প্রায়ই তোর ভাবনায় ডুবে যাই। তখন আমার ভীষণ মন খারাপ হয়, আমি ছাদে গিয়ে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। আকাশের তারাগুলোর মাঝে একটা তারা খুব উজ্জ্বল। আমি ওর মধ্যে তোকে খুঁজি। যখন বৃষ্টি হয়, ঢাকার সবকিছু যেন ভেসে যায়। তখন আমিও হারিয়ে যাই, শুধু তোর ভাবনায়। আকাশে যখন গুম গুম মেঘ ডাকে, তখন মনে হয় তুই যেন আমায় ডাকছিস। তোকে নিয়ে একদিন উজানগাঙে নাও ভাসানোর খুব ইচ্ছে আমার। তুই আমার সামনে বসে থাকবি আর আমি বৈঠা বেয়ে তোকে নিয়ে বহুদূর চলে যাবো।
আমার কোনোকিছু ভালো লাগছে না রে শিখা! মন চাইছে, তোর কাছে ছুটে আসি। আমি আসবো, সত্যিই আসবো। শুধু পরীক্ষাটা শেষ হওয়ার অপেক্ষায় আছি, তারপর তোর কাছে ছুটে আসবো, শুধু তোর কাছে। ভালো থাকিস।
শ্যামল













আপন গৃহকোণে বন্দী থেকেও মুক্তি মেলে না প্রভার। যে কারণে ওর শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি ঘটলো, তার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে এখানেও। ক’দিন ধরে গিয়াস ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের দেখা যায় দীঘির পাড়ে ঘুরাঘুরি করতে। ওদের দৃষ্টি এই ছোট্ট কুটিরের দিকে। জীবিকার তাগিদে বিভাকে বের হতেই হয়। মা কাজে চলে গেলে একাকী ঘরে প্রবল ভয় ও উৎকণ্ঠা নিয়ে সময় কাটে প্রভার। ঘরের পাশের বাগানে শিয়ালের ডাক শুনে ছেলেবেলায় যেমন ভয় পেত, ঠিক তেমনি। মূল বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে হওয়ায় এদিকটায় লোকজনের আনাগোনা দেখা যায় না তেমন একটা। একমাত্র পারু’ই মাঝে মাঝে খোঁজ খবর নেয়।
বিভা কী কামে গ্যাছে? প্রভাকে জিজ্ঞেস করে পারু।
হ খালা, হেই সক্কাল বেলা বাইর অইয়া গ্যাছে।
কি করবি, তোর মা কাম না করলে খাবি কী ?
সবই বুঝি খালা, আমার একলা ঘরে ডর লাগে।
ক্যান? ডর লাগে ক্যান ? ছোডবেলা থেইক্যাই তো তুই একলা থাহস।
আইজ বিহানে মা কামে চইলা গ্যালে দেহি- ঐ ছ্যাড়াগুলান দিগির পাড়ে ঘোরাগুরি করতাছে।
চিন্তায় পড়ে যায় পারু। মনে মনে ভাবে বিভাকে এখন আরও সাবধান হতে হবে। প্রভাকে বলেÑ তোর মা কামে চইলা গ্যালে একলা ঘরে থাকনের দরকার নাই। আমার ঘরে চইলা আইবি।
বাইরে পেয়ারা বেগমের কণ্ঠ শুনে ঘর থেকে আবার বাইরে আসে প্রভা।
প্রভা, তোর মা কই গ্যাছেরে?
মা তো কামে গ্যাছে নানী।
বিহানে দ্যাখলাম দীঘির পাড়ে কতগুলান ছ্যাড়া তোগো বাড়ির দিকে উঁকি মারতাছে-ব্যাপারডা কী ?
আমি কী জানি, কাইল বিহাল থেইক্যাই দেহি ছ্যাড়াগুলান দিগির পাড়ে ঘোরাগুরি করে।
ছ্যাড়াগুলানরে তুই চিনস ?
সবগুলানরে চিনি না। ক্যাবল একটারে চিনি, হারু মেম্বারের পোলা গিয়াস।
এত্তবড় মাইয়া ঘরে রাইখা বিভা বাইরে যায় ক্যামনে?
নানী, মায় কাম না করলে আমরা খামু কি?
পেয়ারা বেগম কোনো উত্তর দেয় না। নিজের পথে ফিরে যায়।
সবকিছু শুনে আবারও বিচলিত হয় বিভা। সারা জীবন কষ্ট করলেও এমন মনের অশান্তি কখনো ছিল না। গত কয়েকদিন ধরে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলি বড় ভাবনায় ফেলে দেয় তাকে। কোনো কাজে ঠিকমত মন বসাতে পারে না। শত অভাব অনটনও যতটা টলাতে পারেনি, প্রভার ভবিষ্যৎ চিন্তা তাকে অনেক বেশি বিপর্যস্ত করে তোলে।
সকাল হতেই হাজির হয় পেয়ারা বেগম। বিভার ঘরের সামনে এসে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে গলা ফাটিয়ে চিৎকার! চাচির গলা শুনে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে বিভা।
এমন দামড়ি মাইয়া একলা ঘরে রাইখ্যা বাইরে যাস ক্যামনে? মাইয়া দিয়া ব্যবসা করবি না কি?
বিভা কিছুক্ষণ হা-করে তাকিয়ে থাকে পেয়ারা বেগমের দিকে। তারপর বলে,
এইগুলি কী কন চাচি? আমি কী এমনি এমনিই বাইরে যাই? কাম না করলে আমগোরে খাওন দেবো কেডা?
তোরা তো খাওন ছাড়া দুনিয়াতে আর কিছুই বোঝোস না, মান-সম্মান গেলে তো আমগো যাইবো।
বিভা কিছু বলার আগেই পারুল পেয়ারা বেগমের সামনে এসে দাঁড়ায়। পেয়ারা বেগমের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
এত চেচান ক্যান? ও কাম না করলে আপনেরা কী অগোরে খাওন দেবেন?
আমি খাওন দিমু ক্যান, আমার কী ঠ্যাকা?
হেইডা তো আমি জানি, তাইলে এত ফাল পারেন ক্যান?
কাম করুক আর যা-ই করুক, ওর মাইয়া য্যান সামলাইয়া রাখে, কইয়া দিস।
ওর মাইয়া কী কারো কাছে গেছে?
না গেলেও ওর ঘরের সামনে জোয়ান ছ্যাড়ারা ঘুইরা বেড়ায়, একটা অঘটন ঘটলে আমগো বদনাম অইবো।
কারা এইহানে ঘুরঘুর করে আপনে তো ভালো কইরাই জানেন, তাইলে নিজে দেইখ্যাও ঐ হারামজাদাগুলারে খেদাইয়া দেন নাই ক্যান? কই আছিলেন আপনে?
এত কতা কস ক্যান? আমি কী অগো পাহারা দিবার ঠিকা নিছি?
না, আপনে অগো পাহারা দিবার ঠিকা নেন নাই, তয় বিভার ঘরে সিঁধ কাটনের ব্যবস্থা কইরা দিতাছেন।
কী কইতে চাস তুই?
ঐ শয়তানডারে আপনের ঘরে জায়গা দেন ক্যান? আপনার ঘরে আইসাই ওরা এত সাহস পায়।
পারুল, তোর সাহস দিন দিন বাড়তাছে। মুখ সামলাইয়া কতা কইস।
সাহসের কী দ্যাখছেন? আমি কী আপনাগো ডরাই? আমি বিষয়ডা মাস্টার চাচারে আইজই জানাইতাছি। আপনেরা সবাই মিইল্যা বিভার জীবনডা লইয়া ছিনিমিনি খ্যালতাছেন। গ্রামের আরও দশজন আছে।
পারুলের ধমকে বেশ কাজ হয়। পেয়ারা বেগম গজগজ করতে করতে নিজের ঘরের দিকে ফিরে যায়।
নির্বাচনের হাওয়া লেগেছে খালেক তালুকদার-মজনু দুই শিবিরেই। এই প্রতিযোগিতা বেশ কয়েক বছর থেকেই চলে আসছে। খালেক তালুকদারের বাবা বজলু তালুকদারের সময় থেকেই। বজলুর সাথে হারু গাজীর যে রেষারেষির শুরু হয়েছিল কয়েক বছর আগে, তা এখন সংক্রামিত হয়েছে খালেক তালুকদার আর হারু গাজীর মধ্যে। স্বাধীনতার পর গ্রামের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষগুলো এই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে রাখে। সেই সুযোগটা কাজে লাগায় বজলু-হারু বাহিনী। শুরু হয় ক্ষমতা নিয়ে নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি, যা এখনো বিদ্যমান। বজলু মারা যাওয়ার পর খালেক, বাদল, হারু তালুকদার আর মজনুদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয়ে ওঠে। আর সেই সাথে হাওয়া বুঝে গা ভাসায় খন্দকারদের মতো কিছু পরিবার।
মজনু ভালোভাবেই বুঝে যায় গ্রামবাসীর কাছে খালেক তালুকদারের জনপ্রিয়তা তলানিতে এসে ঠেকেছে। তার মনে একটা বিশ্বাস জন্মেছে- খালেক তালুকদারকে হারাতে গ্রামবাসী তাকেই ভোট দেবে। সেই সুযোগটাই কাজে লাগাতে চায় মজনু। কিছুদিন আগেও যাদের মধ্যে ছিল গলায় গলায় ভাব, স্বার্থের কারণে তা উবে যেতে সময় লাগে না। খালেক তালুকদার কিংবা বাদলের যে কোনো দুর্বল মুহূর্তে তাদের বিরুদ্ধে এখন সোচ্চার হয়ে ওঠে মজনু। ঘাটের মাঝিদের পক্ষে দাঁড়িয়ে এলাকার মানুষের সহানুভূতি কাড়ে এভাবেই।
বাদলের সাথে মনোমালিন্যের পর থেকে খালেকের স-মিলের আড্ডাখানায় আর যাওয়া হয়না মজনুর। হারু গাজীর স-মিলে সন্ধ্যার পর সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে বসে। প্রতিদিনের মতো মজনু, হারিছ, গিয়াস, সাজু, পলাশ এসে হাজির হয়েছে স-মিলের ঘরে। আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু- আগামী মেম্বর ইলেকশনে দাঁড়াবে মজনু। সবার উদ্দেশ্যে মজনু বলে ওঠে- খালেইক্যারে য্যামনেই অউক ডীফিড দিতে অইবো। তোরা সবাই আমার লগে থাকবি না? হারিছ অবাক হওয়ার ভান করে। ‘এইডা কী কইলা তুমি গুরু? আমরা তো সবসময়ই তোমার লগে আছি’।
মজনুর মুখে হাসি ফোটে। ‘আমি জানি। এহন সবাই মিইল্লা একলগে কাম করতে অইবো। গ্রামের হগগলতেরে অগো বিরুদ্ধে নিয়া আইতে অইবো। এই ব্যাপারে তোগো সাহায্য আমার দরকার’।
তুমি একটুও চিন্তা কইরো না তো চাচা। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষই এহন অগো বিরুদ্ধে। আমগো বেশি কিছু করন লাগবো না। গিয়াস বলে।
মজনু মনে মনে খুশি হয়। পাশ করতে পারলে তোরাও কিছু কাম পাবি। এছাড়াও পুরষ্কার দিমুনে।
সাজু বলে ওঠেÑ পুরষ্কার লাগবো না। তুমি পাশ করলেই আমরা খুশি।
মজনু আরও কিছু বলতে নিয়ে হঠাৎ থেমে যায়। গিয়াস নিচুস্বরে বলে- বাদইল্যা আইতাছে।
সবাই চুপ হয়ে যায়। ঘরে প্রবেশ করে সোজা মজনুর দিকে এগিয়ে যায় বাদল।
কীরে মজনু, তুই আমার থেইক্যা এক্কেরে আলাদা অইয়া গ্যালি? আমি তোর কী ক্ষতি করছি?
আলাদা হওনের কী আছে? তুই তোর মতোন আছোস আর আমি আমার মতোন। বলে ওঠে মজনু।
এহন আর আমার ঐহানে যাস না। বাদলের কণ্ঠে অনুযোগ।
এতদিন তোর ঐহানে বইছি। আমার তো নিজের ব্যবসাও সামলাইতে অইবো। মজনু বলে।
হেইডা ঠিক আছে, তয় আমগো মধ্যের এতদিনের সম্পর্কডা তুই নষ্ট করতে পারোস না। 
সম্পর্ক কী আমি নষ্ট করছি? মজনু পাল্টা প্রশ্ন করে।
নষ্ট করোস নাই? তুইই তো আমার বিপক্ষে গ্যাছস। 
হেইডা তুইই বাধ্য করছোস। আমারে তো তুই শত্রু মনে করোস।
না। আমি তোরে কখনই শত্রু মনে করি নাই। আর এহনো মনে করিনা। তুই নিজেই আমার থেইক্যা দূরে চইলা গ্যাছোস।
মজনু কোনো কথা বলে না। বাদল একসময় বলে- কী রে, আমারে তোর এইহানে কী বইতেও কইবি না?
মজনু গিয়াসকে একটা চেয়ার এগিয়ে দিতে বলে।
ভাইয়ের কথামত বাদল খুব স্বাভাবিকভাবেই মিশে যেতে চেষ্টা করে মজনুদের সাথে। যেন কিছুই ঘটেনি। সবকিছুই আগের মতোই আছে। তবে দু’জনের মনেই চলে অন্যরকম খেলা।











নিরিবিলি ছোট্ট শহর মুক্তনগর। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। লোকজনের ভিড়ভাট্টা তেমন একটা নেই। শহরের পাশ ঘেঁষেই বয়ে চলেছে ছোট্ট নদী- কাঁকন। এদেশের বেশির ভাগ শহরের পাশেই বোধহয় নদী থাকে। হয়ত নদীর পাড়েই গড়ে ওঠেছে শহরটি। মুক্তনগরে এসে নতুন জীবনে প্রবেশ করেছে শিউলি। নতুন সংসার, টুকিটুকি কতকিছুই প্রয়োজন হয়! অফিস ছুটির পর তাকে নিয়ে বের হয় নাহিদ। প্রতিদিনই দুজনে মিলে ঘুরে বেড়ায়। সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনে। দুজনের ছোট্ট সংসার মনের মতো করে সাজিয়ে নেয়।
দুই কামরার ছোট্ট বাসা ওদের। ঘরের সামনে এক টুকরো উঠোন। উঠোনটির চারিপাশে কয়েকটি আম, পেয়ারা আর নারিকেল গাছ। শোবার ঘরের দক্ষিণের খোলা জানালা দিয়ে বিকাল-সন্ধ্যায় চমৎকার ফুরফুরে হাওয়া খেলে যায়। এলাকাটিতে বাড়িঘরের সংখ্যা খুব বেশি না। তবে একজনের সাথে অন্যজনের যেন যোজন যোজন দূরত্ব। সবাই কেমন নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। গ্রামে কখনো এমনটি দেখেনি শিউলি। শহরের ছকেবাধা জীবনে অভ্যস্ত হতে কিছুটা সময় তো নেবেই। গ্রামীন জীবন হরহামেশাই হাতছানি দিয়ে ডাকে তাকে। নাহিদ অফিসে চলে গেলে যখন আর কোনো কাজ থাকে না। মনটা নিজের অলক্ষ্যেই চলে যায় বাড়িতে। মা, বাবা, অয়ন, বকুল- ঘুরেফিরে ওদের কথাই মনে পড়ে কেবল। স্মৃতিময় বাড়ির কোণে কোণে ঘুরে বেড়ায় পিয়াসী মনটা। নাহিদ বোঝে গ্রামে সবাইকে ছেড়ে নতুন শহরে এসে শিউলির বেশ মন খারাপ হয়। একটু তাড়াতাড়িই ফেরার চেষ্টা করে ও। ছুটির দিনগুলোতে বিকেলে ওরা একসাথে বের হয়। রিকশা করে দুজনে ঘুরে বেড়ায়।
শহরের মাঝামাঝি বয়ে চলা কাঁকন নদী এখানকার বাসিন্দাদের বিনোদনের কেন্দ্রবিন্দু। নদীর পাড় ঘেঁষে পাকা রাস্তার পাশে বিকেলে বেশ লোকজন জড়ো হয়। বেশি বয়সী বায়ু-গ্রস্তদল ঠা-া বাতাসে শরীরটাকে জুড়িয়ে নিতে এখানে আসে। আর আসে শিউলি-নাহিদের মতো দম্পতিরা। জড়ো হয় তরুণ-তরুণীরাও। বিকেলের বাতাসে নদীর বুকে ভেসে বেড়ায় ছোট ছোট ডিঙি নৌকা। বিভিন্ন বয়সী মানুষেরা বিনোদনে মাতে। 
নদীর পাড়ে বাঁধানো ঘাট। কাকঁনবালার ঘাট। কথিত আছে মুক্তনগরের অপরূপ সুন্দরী রাজকন্যা কাঁকনবালার নামানুসারেই নদীর নাম রাখা হয়- কাঁকন। ঘাটের আশেপাশে মানুষের ভিড় ছাড়িয়ে একটু নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে বসে ওরা। ওদের সামনে নদীর টলটলে পানি। বিকেলের জোয়ারে কানায় কানায় পূর্ণ। এই নদীটাতে উজানগাঙের মতো স্রোত নেই। শান্ত ছোট্ট একটা নদী। শিউলি নাহিদকে বলে,
তুমি আগে কখনো এখানে এসেছ?
হ্যা, এত কাছে নদী, আসব না!
একাই?
তো, দোকা পাব কোথায়?
তোমাদের পুরুষদের বিশ্বাস আছে? শিউলি মিটিমিটি হাসে।
হুম! যত অবিশ্বাস শুধু পুরুষদের প্রতি, তাই না? মেয়েরা দুধে ধোয়া তুলশি পাতা?
তা তো বলি নাই, তোমার সাথে কেউ আসলে সে তো একটা মেয়েও হতে পারে।
হুম! ধর হলো এমন, তো কী আর করা? গায়ে তো তোমার সিল পড়ে গেছে। এখন তো আর চেঞ্জ করতে পারবে না। নাহিদ হেসে বলে।
এখন আর সেই দিন নাই জনাব। এসব সিল কেউ আর গায়ে মাখে না। মেয়েদের এখন আর অবলা ভাববেন না। শিউলিও হেসে জবাব দেয়।
তাই নাকি? পুরুষরা তো তাইলে তোমাদের ভয়ে পালাবে. নাহিদ হাসতে হাসতে বলে।
কেন? এত অল্পতেই ভয় পেয়ে গেলে?
না। ঐ যে বললে মেয়েরা সবলা।
কেন, মেয়েরা সবলা হলে তোমাদের কোনো অসুবিধা আছে?
না! কোনো অসুবিধা নেই, বরং সুবিধা। তোমরা গুন্ডা-মাস্তানদের সাইজ করতে পারবা। 
আহারে বীরপুরুষ! মেয়েরা মাস্তান সাইজ করবে আর তোমরা পুরুষরা মেয়েদের আঁচলের নিচে লুকাবে? শিউলির কণ্ঠে বিদ্রূপ।
নাহিদও খোঁচা দিতে ছাড়ে না। -কি কথার কী যে মানে করো! এইজন্যই তো বলে মেয়েমানুষ।
শিউলি ফোঁড়ন কাটে। -কথায় তোমার সাথে পারা যাবে না, ঠিক আছে মানলাম তোমার কথা। কিন্তু পুরুষদের কী কোনো ভূমিকা থাকবে না? তোমরা কী হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে?
তা কেন? এমন কী কেউ করে? আসলে আমি বলতে চেয়েছি- তোমরা যদি নিজেদের দায়িত্ব নিজেরাই নিতে পারো, তবে আমরা কর্মক্ষেত্রে নিশ্চিন্ত থাকতে পারি।
বুঝলাম জনাব। তুমিই ঠিক। ঐ বাদাময়ালাকে ডাকো, বাদাম খাব।
নদীর পাড়ে আরও কিছুক্ষণ সময় কাটায় ওরা। সূর্য ডুবে গেলে উঠে পড়ে।
সান্ধ্যভ্রমণ শেষে নবীন-যুগল গৃহে ফিরে দেখে বিদ্যুৎ নেই। অন্ধকারে নিমজ্জিত চারিদিক। মোমের হালকা আলোয় কাপড় চেঞ্জ করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ায় শিউলি। চুলগুলো ঠিক করে নেয়ার ফাঁকে চোখে পড়ে নাহিদ সোজা তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে সেই চেনা দুষ্টুমির আভাস। শিউলির দিকে তাকিয়ে বলে,
এই তোমার চুলে এগুলো কি?
কেন, কী আবার? শিউলি মাথায় হাত দিয়ে দেখে ছোট ছোট পাতা চুলে আটকে আছে।
নদীর পাড়ের গাছ থেকে পড়েছে বোধহয়।
দাঁড়াও আমি ঝেড়ে দিচ্ছি।
শিউলি কিছু বলার আগেই কাছে এগিয়ে আসে নাহিদ। আলগা পাতাগুলো ঝেড়ে দেয়, একটু যেন বেশিই সময় নেয়। তারপর ধীরে ধীরে হাত দু’টি মাথা থেকে নেমে কোমরের কাছে এসে স্থি’র হয়; শিউলি নাহিদের দু’হাতের বাঁধনে জড়িয়ে যায়। বাঁধনটা শক্ত হবার আগেই কপট রাগের ছলে বলে ওঠে- এই হচ্ছেটা কি? তুমি একটা ডাকাত।
নাহিদের কবল থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে পালায় শিউলি। পেছন থেকে হাসতে হাসতে নাহিদ বলে- এই, সবলারা কিন্তু এভাবে ভয়ে পালায় না।
রাতের খাবার বানাতে ব্যস্ত শিউলি। নাহিদ শোবার ঘরে কিছুক্ষণ একা একা কাটিয়ে রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়।
কি এত রান্নাবান্না করছ গিন্নি?
খেতে হবে না? তুমি যাও, আমি চা নিয়ে আসছি।
নাহিদ একটা সিগারেট ধরিয়ে খোলা বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। এখান থেকে খেলার মাঠের পুরোটাই দেখা যায়। ছোট ছোট ছেলেদের কোলাহলে সারাটা বিকেল জমজমাট হয়ে থাকে মাঠটা। এখন নিস্তব্ধ নিঝুম। অন্ধকারের মাঝে কেমন যেন ছমছমে একটা ভাব। শহরের এই এলাকাটি বেশ ফাঁকা। বাড়িগুলো একটু দূরে-দূরে। অন্ধকার ভেদ করে আশেপাশের বাড়িঘর থেকে মাঝে মধ্যেই উঁকি দিচ্ছে বিদ্যুতের আলো। মাঝখানের ফাঁকা জায়গাগুলোর গাছপালার ছায়ারা একটা ভৌতিক আলো-আঁধারি পরিবেশ তৈরি করেছে। একটু পর শিউলি আসে বারান্দায়।
তুমি আবার সিগারেট ধরিয়েছ?
আজকের জন্য এটাই শেষ। নাহিদ হেসে জাবাব দেয়।
ইদানীং তোমার সিগারেট খাওয়া বেড়ে যাচ্ছে। ঘরে চল, একসাথে চা খাব।
চল।
চা খেতে খেতেই দু’জনের খুনসুটি চলে। শিউলি বলে, তুমি তো সারাদিন অফিসে কাজে ব্যস্ত থাকো, আমার একা সময় কাটে না। কোনো স্কুলে একটা চাকরীর ববস্থা কর না।
জান, আজকাল ইয়ং ছেলেরা স্কুলে কেন চাকরি করে?
কেন আবার, প্রয়োজন তাই। যার যার যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি করবে, তাতে সমস্যা কি?
উহু, সুন্দরী মেয়েদের সাথে প্রেম করার জন্য।
খালি ফাজলামি! তোমার বউ কারো সাথে প্রেম করবে না।
সুন্দরী মেয়েদের বিশ্বাস নেই। জি-না মেমসাহেব, আমি আমার একমাত্র বউটাকে হারাতে চাই না।
বউয়ের প্রতি দেখি তোমার একদম বিশ্বাস নেই। আহারে! তোমার ভবিষ্যৎ তো অন্ধকার।
সরি মেমসাহেব, আমি বর্তমান নিয়েই ভালো আছি, ভবিষ্যতের কথা পরে ভাবলেও চলবে।

বর্তমানটা ভালোই কাটে তাদের। একেকটা দিন আসে। সকাল-দুপুর ঘুরে রাত্রি আসে; আবার চলেও যায়। সকালে নাহিদ অফিসে চলে যায়, বিকেলেই ফিরে আসে। দুজনে মাঝে-মধ্যেই বেরিয়ে পড়ে। ছোট্ট শহরটায় ঘুরে সময় কাটায়। মাঝে মাঝে সিনেমায় যায়। কখনো কখনো রিক্সা নিয়ে বহুদূরে চলে যায়। খুনসুটি-গল্প-আড্ডায় সময়টা কেটে যায় দুজনের।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উপন্যাসঃ ফেরা (পর্বঃ ২১ - ২৫ - শেষ পর্ব)

এ ই উপন্যাসটিতে সম্মুখ সমরের কোন ঘটনা তুলে ধরা হয়নি।  ওয়ারফ্রন্টের কোনও দৃশ্য নেই। তবে এই লেখায় মূলত যে গল্পটি বলার চেষ্টা ক রা হয়েছে  তা মু...