শনিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

গল্পঃ একজন বলরাম এবং কিছু কথা


ferry in the river.jpg
আজ ছুটির দিন। ছুটির দিনটি আনন্দেই কাটে অমিয়র। দিনের বেশীরভাগ সময়ই কেড়ে নেয় একমাত্র মেয়ে আদৃতা। ছুটির দিনের এই অলস বিকেলে রুপা ও একমাত্র মেয়ে আদৃতাকে নিয়ে ফ্যামিলি এলবাম দেখছে। অমিয়র তিন বছরের মেয়ে এটা ওটা প্রশ্ন করছে, অমিয় উত্তর দিচ্ছে। এটা আমার দাদা, এটা দাদী। আচ্ছা বাবা, দাদী তোমার কি হয়? তোমার দাদী তো আমার মা হয়, অমিয় বলে। আদৃতা বাবার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, আমি তোমার মা না? অমিয় উত্তর দেয়- হ্যাঁ, তুমি তো আমার মা। আদৃতা দুহাত প্রসারিত করে বলে, আমি তোমাকে এতগুলো ভালবাসি। অমিয়র বুক ভরে যায় আনন্দে। দুহাতে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আর মনে মনে ভাবে আমার কোন দুঃখ নেই, এই তো আমার সব। এর জন্যে তো আমি যে কোন কিছু ত্যাগ করতে পারি। মেয়েকে আদর করতে করতেই অমিয়র মনে পড়ে বাবার কথা। বাবা বলতেন- আগে বাবা হ, বুঝবি সন্তানের জন্য কেমন লাগে। তখন বোঝেনি, আজ এত বছর পর মনে হয় বাবা ঠিকই বলেছিলেন।
 
বাবা দেশের কথা বলতেন। তিনি প্রায়ই একটি কথা বলতেন- নিজেকে যতটা ভালবাসবি, দেশেকে ঠিক ততটাই ভালবাসবি। আমি কিংবা তোর মা একদিন হারিয়ে যাব, কিন্তু এই দেশমাতা চিরকাল তোকে আগলে রাখবে। বাবার সেই কথাগুলো অমিয় আজও ভোলেনি। আজও পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাক, দেশের জন্য কেবলই প্রাণটা পোড়ে। যখনই মন খারাপ হয়, বাবার কথা মনে পড়ে, গাঁয়ের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে ধূলোমেখে বড় হয়ে ওঠা গাঁয়ের কথা। মাঝে মধ্যেই ওর মনে উঁকি দেয় একটা ফেরী। বাবা, গ্রাম, ফেরী- ও প্রায়ই আনমনা হয়ে যায়। কত কথা ভেসে ওঠে মনে! গ্রামের কথা ভাবলেই চোখে ভেসে ওঠে ওর ছেলেবেলার নায়কের মুখচ্ছবি। হ্যা, নায়কই তো। এমন লম্বা, সুঠাম দেহের ত্যাগী মানুষটিকে নায়ক না ভেবে কোন উপায় আছে?
 
অমিয় প্রায়শই অবাক হয়ে লোকটির কথা ভাবে, মনে ভিড় করে নানা প্রশ্ন। সন্তানের জন্যে মানুষ সবকিছুই করতে পারে কিন্তু দেশের জন্যে সবকিছু ত্যাগ করতে পারে এমন মানুষের সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য। আর যারা পারে তারা অনেক উঁচু মনের মানুষ। অমিয় ডুব দেয় ভাবনার সাগরে। ভাবতে ভাবতে চলে যায় বহু বছর পিছনে –
 
অমিয় তখন অনেক ছোট। প্রাইমারির গন্ডিও পেড়োয়নিসবুজ শ্যামল মেঠোপথে শৈশবের দস্যুপনায় কাটছিল দুরন্ত সময়গুলো। ছবির মত গাঁয়ের বন-বাদাড় আর ছিল প্রিয় নদী। স্রোতস্বিনী নদীর ঢেউয়ের তালে তালে নেচে উঠত মন। গাঁয়ের এক পাশ দিয়ে বয়ে চলা বড় নদী থেকে একটি ছোট্ট শাখা নদী এঁকেবেঁকে গাঁয়ের মধ্যে দিয়েই উলটা দিকে চলে গেছে। সেই ছোট্ট নদীটি দিয়ে যানবাহন পারাপারের জন্যে চলাচল করতো একটি ছোট ফেরি। ফেরিটির বিশেষেত্ব ছিল টিতে কোন ইঞ্জিন ছিল না। কাঠের তৈরি সেই ফেরিটি দিয়ে একসঙ্গে দুটি বাস ও দু একটি রিকশা পার হতে পরত। অমিয়র মনে পড়ে, এটি চালাত কয়েকজন মানুষ। একটি মোটা দড়ি নদীর দুই পাড়ে বাঁধা থাকত আর ফেরিতে দাঁড়িয়ে দু’জন মানুষ দড়িটিকে একদিকে টানত আর বলতো–
সবাই বল
জোরসে বল
আরও জোরে!!
 
ফেরিটি একটু একটু করে এগিয়ে যেত নদীর এপার থেকে ওপারে। যারা ফেরিটিকে পারাপারের কাজে নিয়োজিত ছিল তাদের মধ্যে একজনের নাম ছিল বলরাম। অমিয়র ছেলেবেলার নায়ক। লম্বা, সুঠাম দেহের অধিকারী, রোদে পোড়া তামাটে বর্ণের এক সুপুরুষ ছিল এই বলরাম। বাড়ি থেকে খুব কাছে হওয়াতে অমিয় যখন তখন চলে যেত ফেরিঘাটে। গাড়ি ভরা হয়ে গেলে বন্ধুরা ফেরিতে উঠে যেত।
বলরামকে সবসময়ই দেখা যেত ফেরিতে। সকাল, দুপুর কিংবা সন্ধ্যায়। সবসময় মুখে হাসি লেগে থাকতো। ওকে দেখলেই বলত- কি খোকা ফেরি চালাবে? অমিয় হাসত। অমিয় মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করত, আপনের বাড়ি কোথায়? বলরাম হেসে বলত- কেন খোকা, এটাই তো আমার বাড়ি। আসলেই তাই। ফেরিই ছিল বলরামের ঘরবাড়ি, খেয়ে না খেয়ে ওখানেই পড়ে থাকতো। প্রচন্ড শীতের রাত কিংবা তুমুল বর্ষণেও দেখা যেত বলরাম ফেরি টানার কাজে ব্যস্ত। খুবই সাদামাটা জীবন যাপন। তিন বেলা ঠিকমত খেতে পেত কিনা সন্দেহ। সকালের দিকে গেলে কখনো কখনো দেখা যেত একটা সিলভারের থালায় পান্তা ভাত পিয়াজ কাঁচামরিচ দিয়ে খাচ্ছে। কারো কাছে তেমন কোন চাহিদা ছিল নেই, কারও বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেইশান্তিপ্রিয় নির্ভেজাল একজন মানুষ।
বলরাম সম্পর্কে আর তেমন কিছু জানা ছিল না অমিয়র। গ্রাম থেকে চলে আসার পর ফেরি, বলরাম সবকিছুই মন থেকে মুছে গিয়েছিল।
 
মাঝখানে পার হয়ে গেছে বেশ কয়েক বছর ছেলেবেলার অনেক স্মৃতিই ধূসর হয়ে এসেছে। অনেকদিন পর গ্রামে বেড়াতে গিয়েছে অমিয়। নদীতে সেই ফেরিটা আর নেই, পাকা সেতু হয়েছে রাতে সোডিয়াম লাইটের আলোয় ঝলমল করে বলরামদের আর কারো প্রয়েজন হয় না।
 
একদিন নদীর পাড়ে একটা চায়ের দোকানে বসে ছিল অমিয়। বন্ধুদের সাথে পুরানো দিনের আলোচনায় মুখর হঠাৎ মনে পড়ল এখানেই তো ফেরিটা ছিল। তখনি বলরামের প্রসঙ্গ আসলো। গ্রামের এক বন্ধুর কাছ থেকে জানা গেল বলরাম কয়েক বছর আগে মারা গেছে। খুব খারাপ লাগল। অমিয়র ছেলেবেলার নায়ককে মনে পড়ে গেল সেই লম্বা সুঠাম দেহী লোকটা আর তার সেই কোরাস-
সবাই বল !
জোরসে বল !
আরও জোরে !!
 
ওদের পিছনের টেবিলে বসা ছিল অমিয়র দূর সম্পর্কের এক চাচা তিনি বলে উঠলেন,
-অমি, বলরামের কথা তোর মনে আছে ?
অমিয় বলল- হ্যাঁ, মনে থাকবে না! কতবার আমি ওর সাথে ফেরি পার হয়েছি! খুব ভাল লোক ছিল।
-তোরা কি জানিস বলরাম একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিল ?
বলরাম মুক্তিযোদ্ধা ছিল! অমিয় খুব অবাক হয়েছিল সেদিন। এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটা জানত না!
আসলে সেই ছোটবেলায় যখন বলরামকে দেখতো ও, মুক্তিযুদ্ধ কি তখন কিছুই বুঝতো না। সেই ছেলেবেলায় এত কিছু জানার প্রয়োজনও হয়নি শুধু ফেরি পার হওয়াতেই ছিল সব আনন্দ।
এত বছর পর সেদিন বলরামের ইতিহাস নতুন করে জানতে পেরে অবাক হয়েছিল অমিয়অমিয় ভেবে অবাক হচ্ছিল সেই ছোটবেলায় বহুবার দেখেছে বলরামকে, কেউ কখনো বলেনি যে বলরাম একজন মুক্তিযদ্ধা। কখনো দেখেনি গ্রামের কাউকে একজন মুক্তিযোদ্ধা তাকে এতটুকু সম্মান করতে ওর যতটুকু মনে পড়ে এলাকার লোকজন তাকে অনেকটা তুচ্ছ তাচ্ছিল্যই করতো।
অমিয় আবার জিজ্ঞেস করল– তাহলে উনি ওভাবে জীবন যাপন করতেন কেন? কেন দিনরাত ফেরিতেই পরে থাকতেন ?
-কি করবে ? এখানে ওর আর কেউ তো ছিলনা।
-কেন ওনাদের ঘরবাড়ি, আত্বীয়-স্বজন?
-কেউ ছিল না। ওরা দুই ভাই ছিল। বলরাম আর গৌতম। ওদের মা যুদ্ধের আগেই মারা গিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ওরা দুই ভাই যুদ্ধে চলে যায়। স্থানীয় রাজাকার আর পাক বাহিনীর অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে ওর বাবা আর চাচারা সপরিবারে প্রাণভয়ে ইন্ডিয়া পালিয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধ শেষ হল। গৌতম যুদ্ধে মারা যায়, বলরাম ফিরে এসে ওর পরিবারের কাউকে পায়নি। ওদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল।
-এত বড় অন্যায় হল আর এলাকার লোকজন কেউ কিছু করল না, কেউ ওনার পাশে দাঁড়ালো না!
-বাবা, তখনকার পরিস্থিতি খুব খারাপ ছিল, ক্ষমতা যাদের হাতে ছিল তারা সবাই যার যার নিজের আখের গোছাতে ব্যাস্ত ছিল। কে কি বলবে? একে তো ছিল হিন্দু তার উপর গরিব।
-উনি তাহলে ওনার পরিবারের কাছে চলে গেলেন না কেন ?
-অনেকে বলেছিল চলে যেতে, ও যায়নি। বলত যে দেশের জন্যে যুদ্ধ করেছি, যে দেশের মাটিতে আমার মা ভাই শুয়ে আছে সে দেশ ছেঁড়ে কোথায় যাব? দেশের টানে, মাটির টানে এখানেই থেকে গেল।
অমিয় বলরামের গল্প শুবে সেদিন বারবার অবাক হচ্ছিল আর এই ভেবে ভাল লাগছিল যে, র ছোটবেলার নায়ক আসলেই একজন সত্যিকারের নায়ক ছিলেন। সেদিনের পর থেকে লোকটার উপর শ্রদ্ধা আরও কয়েকগুন বেড়ে গিয়েছিল ওর।
বলরামের কাহিনী ওকে অনেকদিন ভাবিয়েছিল। ঘুরে ফিরে একটি প্রশ্ন মনে উদয় হয়েছিল, হয়ত এরকম আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা নীরবে নিভৃতে চলে গেছে আমরা তার খবরও রাখিনা। বলরামের মত মুক্তিযোদ্ধারাই খাঁটি মানুষ। ওরা কোন কিছু পাওয়ার আশায় যুদ্ধ করেনি। ওঁরা যুদ্ধ করেছে মাটির টানে, দেশকে ভালবেসে। একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক, একজন খাঁটি মুক্তিযোদ্ধা যুগে যুগে জন্মায় না  
স্যালুট বলরাম ! স্যালুট !!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উপন্যাসঃ ফেরা (পর্বঃ ২১ - ২৫ - শেষ পর্ব)

এ ই উপন্যাসটিতে সম্মুখ সমরের কোন ঘটনা তুলে ধরা হয়নি।  ওয়ারফ্রন্টের কোনও দৃশ্য নেই। তবে এই লেখায় মূলত যে গল্পটি বলার চেষ্টা ক রা হয়েছে  তা মু...