
পুরানো সেই দিনের কথা
ভুলবি কিরে হায়
ও সেই চোখের দেখা
প্রাণের কথা সে কি ভোলা যায়...
ভুলবি কিরে হায়
ও সেই চোখের দেখা
প্রাণের কথা সে কি ভোলা যায়...
পুরানো দিনের কথা মনে হলেই নিজের অজান্তেই স্মৃতিরা উঁকি দেয় মনের অলিতে গলিতে, মনটা হারিয়ে যায় সেই সোনালী অতীতে। ইট কাঠ পাথরে ঠাসা এই শহর ছেঁড়ে মনটা চলে যায় সেই চির চেনা সম্রাজ্যে, নস্টালজিক হয়ে যাই।
ছবির মত সুন্দর বলতে যা বোঝায় ঠিক সে রকম একটি গ্রামে আমার ছেলেবেলাটা কেটেছে। গাঁয়ের ধুলো মাটি মেখে বড় হয়ে ওঠা। গ্রামের দুই দিকে দুটি নদী, ছোট নদীটি সর্পিল গতিতে এঁকেবেঁকে গ্রামের ভিতর দিয়ে বয়ে গেছে। জোৎস্না রাতে নদীর পানিতে যখন চাঁদের আলো পড়ত, অদ্ভুত মায়াময় এক পরিবেশ তৈরি হত। কৈশরের সেই স্মৃতি আজ আমার মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, আজও তাই শহুরে জোৎস্না দেখলেই আমার মনটা চলে যায় সেই স্মৃতি বিজরিত নদীর পাড়ে।
ভরা বরষায় চারিদিক পানিতে থৈ থৈ করত। ফসলি জমি সব তলিয়ে যেত, চারিদিকে শাপলা শালুকের মেলা বসতো। বন্ধুরা মিলে কলা গাছের ভেলা বানিয়ে চলে যেতাম দূরে, বহু দূরে। শাপলা তোলার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠতাম। কত যে জোঁকের কামড় খেয়েছি তাঁর হিসেব নেই । আহ! কি সব চমৎকার দিন ছিল সব ! দুরন্ত, বাঁধন হারা।
ঘরের চালে ঝুম ঝুম বৃষ্টির শব্দ অপূর্ব সুরের মূর্ছনা তুলত। ঘরের পেছনের জানালা দিয়ে দেখা দূরের মাঠে বৃষ্টির মধ্যে একা দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছটা আমায় কখনো কখনো বিষণ্ণ করে তুলত। ঘরের পিছনে পুকুর পাড়ে হেলে পড়া হিজল গাছটা ফুলে ফুলে ভরে যেত, পুকুরটা হিজলের ফুলে যেন রঙিন সাজে সাজত। ছোট ছোট লাল ফুল আর মাতাল করা গন্ধ আমায় ভিন্ন এক আবেশে জড়িয়ে রাখত। কখনো পুকুরে ভাসমান কচুরীপানার ফুল কিংবা জলে ভেসে থাকা কলা গাছে ছোট ছোট কচ্ছপদের রোদ পোহানোর দৃশ্য - এইসব ছোট ছোট স্মৃতিগুলো মনের কোণে হানা দেয় যখন তখন। কদম গাছটায় কি সুন্দর হলুদ ফুল ফুটত ! থোকা থোকা !
বৃষ্টিতে ভেজা ছিল দৈনন্দিন ব্যাপার, ঘরের চালে টুপ টাপ আম পড়লেই হল, দে ছুট ! এক ছূটে আমতলায়, বন্ধুদের সাথে কাড়াকাড়ি করে কখনো ভাগাভাগি করে খাওয়ার আনন্দটা আজও মনে ভাসে। রাত হলে ব্যাঙ ডাকা কিংবা ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা শব্দ মনে অপূর্ব সুরের আবেশ জাগাত- এসব এখন কেবলি অতীত। মনে মনে ভাবি ইস! যদি আবার ফিরে পেতাম মনের মধ্যে সযত্নে লালিত সোনা ঝড়া দিনগুলি আমার ! রবি ঠাকুরের গান তাই তো আজ জীবনের এক অবিচ্ছ্যেদ্য অংশ, কখন যে নিজের মনে গেয়ে উঠি - দিন গুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না, সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি...
শীতের সকালে কুয়াশায় ঢাকা গ্রামটাকে অচেনা লাগতো। শিশির মাখা দূর্বা ঘাসের উপর দিয়ে খালি পায়ে হেঁটে যাওয়ার আমেজটাই ছিল অন্যরকম! ঝোপের পাশে ফুটে থাকত থোকা থোকা লজ্জাবতী ফুল, একটু ছুঁয়ে দিলেই নব বধূর মত লজ্জায় নিজেকে গুটিয়ে নিত। রাস্তার পাশে ফুটে থাকা নানা রকম ঘাস ফুল কিংবা স্বর্ণলতা - এ সবই এখনো আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকে। শীতের সময় খেজুরের রস ছিল অন্যতম আকর্ষণ। নদী থেকে বয়ে যাওয়া খালের পাড়ে সাড়ি সাড়ি খেজুর গাছে ঝুলে থাকা হাঁড়ি থেকে খেজুরের টাটকা রস খাওয়া কিংবা রাতে খেজুরের রসের পায়েসর স্বাদ কতকাল পাইনা !
তাল গাছে ঝুলন্ত বাবুই পাখির বাসার নিখুঁত শিল্পায়ন আমাকে বিমোহিত করে রাখতো। কতদিন আম গাছের ডাল থেকে পাখির ছানা পেড়ে আনতে গিয়ে বাবার বকুনি খেয়েছি ! একদিন তো পাখির কামড় খেয়ে হাতের অনেকটা কেটেই গেল, সেই স্মৃতি চিহ্নে যখনি হাত বুলাই অন্য রকম অনুভূতি হয়। এ রকম কত স্মৃতি আসে মনে ! বাড়ির প্রবেশ মুখে কৃষ্ণচূড়া শিমুলের গাছে যেন আগুন লেগেছ। টকটকে লাল ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে সারা গাছ।
নদীর চরে পিকনিক ছিল আমাদের প্রতি বছরের বিনোদন। দল বেঁধে নৌকা করে নদীর ওপাড়ে নল খাগড়া, হোগল কিংবা ছন খেতে সবাই মিলে দাপাদাপি আর নদীতে চলা লঞ্চ-ট্রলারের বড় বড় ঢেউয়ের সাথে খেলা করা এ সবই এখন শুধুই অতীত। আজ ক্ষণে ক্ষণে মন চলে যায় নদীর সেই ধু ধু বালু চরে, যেথায় ছিল সাদা সাদা বকের ঝাঁক আর বালি হাঁসদের নিত্য আনাগোনা।
গাঁয়ে বৈশাখ আসতো নতুন বারতা নিয়ে, বৈশাখী মেলার নানা আয়োজনে মত্ত থাকত গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা । দূর দূরান্ত থেকে দোকানীরা আসতো রকমারি খাবারের পসরা নিয়ে, শিশু কিশোরদের জন্য খেলনা আর থাকত আকর্ষণীয় সব খেলার আয়োজন-ঘোড়া দৌড়, মোরগ লড়াই আরও কত কি !
আমাদের বাড়ির অদূরে বহু বছরের পুরনো বিশাল রেইন ট্রি গাছটি আজ আর নেই, ওই গাছটাকে ঘিরে আমাদের কত স্মৃতি ! গাছতলাটাই ছিল আমাদের হেড কোয়ার্টার, যতসব দুষ্টুমির প্ল্যান হত ওইখানেই। হাজী সাহেবের ছাড়া বাড়িতে (বড় বাগান) হানা দেয়াটা ছিল আমাদের নিত্যদিনের রুটিন। কি গাছ ছিল না সেখানে! আম, জাম, নারিকেল, জামরুল, গাব, ডেউয়া, আমড়া, পেয়ারা, কাঠলিচু, কাঠবাদাম, সফেদা আরও কত কি ! কতদিন হাজীর বোনের তাড়া খেয়েছি !
সারাদিন শেষে সন্ধ্যা নামে। বাঁশ বনে পাখ-পাখালীর যেন হাট বসে, নানা রকম পাখীদের কিঁচিরমিঁচির শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে যেত। বয়স্করা বিরক্ত হলেও আমি যেন এই ক্ষণটির অপেক্ষায় থাকতাম। আঁধার নামলে জোনাকিরা ভিড় জমাতো, তাদের মিটি মিটি আলোয় নিঃস্তব্দ আঁধারে প্রানের সঞ্চার হত। ভেসে আসতো হাস্না হেনার মাতাল করা গন্ধ।
আজ এই ব্যাস্ত সময়ের সামান্য অবসরে কিংবা কোন বর্ষণ মুখর সন্ধ্যায় মনটা
হারিয়ে যায় সুদূর অতীতে। মন পবনের নাওয়ে রঙ্গিন পাল তূলে দেই, ভাবনাগুলো
ডানা মেলে নীল আকাশে । চেনা মাটির গন্ধ মনকে ব্যাকুল করে দেয়, মন চায় এখুনি
ছুটে যাই সেই ছেলেবেলায়। গাছে গাছে হরেক রকম পাখির কিচির মিচির অথবা
পুকুরের জলে হাঁসদের জলকেলি আমার চিন্তা চেতনাকে এলোমেলো করে দেয়। আকাশে
রঙ্গিন ঘুড়ি, প্রজাপতি, ঘাস ফড়িঙের উড়া উড়ি -সব, সব মনে পড়ে। ঝিঁঝিঁ
পোকাদের একটানা সুরের মুর্ছনা কিংবা টুপ করে পুকুরের জলে ডুব দিয়ে মাছ তূলে
নেওয়া মাছরাঙ্গাটা হাতছানি নেয়, আরও হাতছানি দেয় উদাসী দুপুর, রাঙ্গা
গোধূলি কিংবা বিষণ্ণ বিকেলে অবিরাম রিমঝিম বৃষ্টির শব্দ। অবচেতন মন তাই গুন
গুন করে গেয়ে ওঠে ...
উঠোনটা আজ পুকুর যেন
মনে পড়ে শীল কুড়োনো
পা ডুবিয়ে হাঁটু জলে
খুঁজি সে দিন নতুন করে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন