শনিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

উপন্যাসঃ ধূসর গোধূলি (পর্বঃ ৫১ - শেষ)





      

মাগরিবের নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বাড়ি ফিরছিলো মফিজ মিয়া। রাস্তায় দাঁড়িয়েই ভেতর বাড়ি থেকে পেয়ারা বেগমের চিৎকার কানে ভেসে আসে। মফিজ মিয়া মনে মনে ভাবে- এই অদ্ভুত মেয়েমানুষটার সাথে এতো বছর সে কি-করে যে সংসার করলো! দিনের মধ্যে তার বেশিরভাগ সময় কাটে চিৎকার-চেঁচামেচিতেই। বাড়িতে ঢুকেই হাঁক দেয় মফিজ মিয়া।
কী হইলো? এই রহম গলা ফাটাইয়া চিল্লাইতেছ ক্যান?
সুখে চিল্লাইতেছি। ঐ দ্যাহেন, আপনের সাধের মাইয়া আবার আইসা হাজির। এইবার ঘর বেইচা হেরে সুখী করেন। তারপর দুইদিন পর আমরা ঝোলা লইয়া রাস্তায় নামুম।
মফিজ মিয়া দেখে শেফালি ঘরের সামনের সিঁড়িতে বসে কাঁদছে। শেফালির দিকে এগিয়ে যায় সে।
কী রে মা, কী অইছে?
রাসুর বাপে এক্সিডেন্ট করছে। এহন হাসপাতালে।
কহন অইলো?
কাইল রাইতে।
এহন কী অবস্থা?
বাম পায়ের হাড্ডি ভাইঙা গেছে। অপারেশন করতে অইবো, হাসপাতাল থেইক্যা কইছে অনেক টাকা লাগবো।
গাড়ির কী অবস্থা?
গাড়ি গ্যারেজে।
মফিজ মিয়া হঠাৎ চুপ হয়ে যায়।
পাপ! এই জীবনে অনেক পাপ করছি। এইডা অইলো আমার পাপের শাস্তি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে মফিজ মিয়া। তারপর বড় বড় পা ফেলে ঘরের ভেতর ঢুকে যায়।
খাটের উপর গুম মেরে বসে আছে মফিজ মিয়া। রাত বাড়ার সাথে সাথে কাশিও বাড়ে। থেকে থেকে কেঁপে উঠছে তার শরীর। প্রতিবার কাশির সাথে মনে হয় বুকের পাঁজর ভেঙে যাবে। মেয়ে-জামাই আর তার বাবা-মার উপর ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে আছে মন। বাপের পায়ের কাছে বসে কাঁদছে শেফালি।
তোর পোলাপান কই?
ওগো দাদীর কাছে রাইখ্যা আইছি।
আমারে এহন কী করতে কস?
আপনে কিছু একটা করেন আব্বা, আপনেগো জামাইর কিছু অইলে আমি ঐ বাড়িতে টিকতে পারুম না।
এই কয়েকমাস আগেই জমি বন্ধক রাইখ্যা কতগুলা টাকা দিলাম, হেই জমি বেইচ্যা সাজুর ব্যবসার টাকা জোগান দিতে হইল। এহন আমি টাকা পামু কই?
তহন আমি আপনেরে কইছিলাম একলগে এতগুলান টাকা দিয়েন না। আপনে সব টাকা দেওনে তার বাপ-ভাইরা কেউ আর টাকা দেয় নাই।
হেরা তহন দেয় নাই, তো এহন দেউক। কিছু অইলেই তোরে এইহানে পাঠাইয়া দেয় ক্যান?
হেরা বুইঝে গেছে আমার সুখের লইগ্যা আপনে সবকিছু করবেন।
তাইলে এইবার তাগোরে দেখতে ক।
ভর্তি কইরা দেবার পর হেরা টাকা খরচের ডরে কেউ আর হাসপাতালে যায় নাই।
মফিজ মিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে- দেহি কী করতে পারি।
টাকা যোগাড়ের জন্য হারু গাজীর কথা ভাবতেই মেজাজটা চড়ে গেল মফিজ মিয়ার। গতবার বন্ধকী জমি বেচার সময় বাজার দরের প্রায় অর্ধেক দামে তার কাছে জমি বেচতে হয়েছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে সাত্তার মাস্টারের কথা একবার ভাবলো সে। দীঘির পাড়ের রাস্তা ধরে এগিয়ে চলার মুহূর্তে বিভার পরিত্যক্ত ঘরটির দিকে চোখ পড়ে। মাত্র কয়েকদিন আগেও ভাবতে হয়নি বিভা নেই, আজ ভেতরটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এই অল্প সময়ের মধ্যেই বাড়িটার রূপ কেমন যেন বদলে গেছে, যেন মৃতপুরী! এ পথ দিয়ে প্রতিদিন আসা যাওয়া করতো সে কিন্তু কখনো এমন হয়নি, ইদানীং বিভার কথা ভেবে তার খুব খারাপ লাগে। হঠাৎ মনে হলো মেয়েটার প্রতি বড় অন্যায় করা হয়েছে। একমাত্র ভাইয়ের মেয়েটির জীবনের করুণ পরিণতির জন্য সে-ই দায়ী। স্ত্রীর কথামত কাদের জন্য এতোকিছু করছে সে? আজ খুব আফসোস হয়, ছেলেগুলো একটাও মানুষ হলো না। যাদের জন্য একমাত্র ভাইয়ের মেয়েটাকে ঠকিয়ে তার সম্পত্তি হাত করলো আজ সেই ছেলেরাই তার অবাধ্য। এ তার পাপেরই শাস্তি।
প্রতিদিন দুপুরে খাবার পর সাত্তার মাস্টার কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন। বিকেলে বেলা পড়ে এলে ধীরে ধীরে পা বাড়ান বাজারের দিকে। অন্যদিনের মতো আজও বারান্দায় শুয়ে আছেন। হঠাৎ কানে ভেসে আসে বাইরে থেকে কেউ তার নাম ধরে ডাকছে। ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। উঠানে মফিজ মিয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা অবাক হলেন। এই অসময়ে মফিজ তার বাড়িতে!
তুমি এই সময়ে? তোমার শরীর তো দেখি এখনো বেশ খারাপ। ডাক্তার দেখাও নাই?
আর শরীর! একটা বিপদে পইড়া তোমার কাছে আইছি।
তা তো বুঝতে পারছি।
মাইয়াডার জামাই এক্সিডেন্ট করছে।
কেডা? শেফালির জামাই?
হ। এহন হাসপাতালে। তুমি আমার একটা উপকার করতে পারবা?
কও। আমার সাধ্যের মধ্যে থাকলে করুম।
আমার রাস্তার পাশের ভিটাবাড়িটা বন্ধক রাইখ্যা কিছু টাকা দিতে পারবা?
রাস্তার পাশের ভিটাবাড়ি! মানে, বিভার ভিটাটার কতা কইতাছো?
হ। বিভা তো এহন আর নাই। আমি ছয়মাসের মধ্যে তোমার টাকা ফেরত দিয়া দিমু।
সাত্তার মাস্টার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর বলেন- মফিজ, বিভা মরণের পর থেইক্যা আমি রাস্তা দিয়া যাওনের সময় ওর ভিটাটার দিকে তাকাইতে পারিনা। ক্যান, জানো? ঐদিকে তাকাইলে মাইয়াডার করুণ মুখের ছবিটা চোখে ভাইসা ওঠে।
আমারে আর লজ্জা দিও না সাত্তার। হেই যন্ত্রণা এহন আমার সব সময়ের সঙ্গী। আমি আমার পাপের শাস্তি পাইতাছি। তুমি আমার ছোডোবেলার বন্ধু, বিপদের দিনে তুমি ছাড়া আর কারো কাছে যাইতে মন চাইলো না।
তোমার বিষয়ডা বুঝছি, কিন্তু ঐ ভিটা আমি রাখতে পারুম না মফিজ। টাকা লাগলে কিছু ধার নিতে পারো, সেইটা ঐ জমির বদলে না। তুমি অবশ্য কাজেমের কাছে যাইয়া দ্যাখতে পারো। ওর এহন অবস্থা ভালো, চাইলে ও রাখতে পারে।
মফিজ মিয়া চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর বলে- আচ্ছা, সন্ধ্যায় তোমার দোকানের সামনে আমুনে। মফিজ মিয়া চলে যায়। সাত্তার মাস্টার ঘরের সিঁড়ির উপর বসে তাকিয়ে থাকেন তার গমনপথের দিকে। মনে মনে বলেন- মফিজ, এই বুঝটা তোমার হইলো, তয় বড় দেরী কইরা ফ্যাললা।
কোণঠাসা খালেক তালুকদার কিংবা হারু গাজীদের মতো লোকেরা এখন নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। কলাবতী বাজারে বটতলার দক্ষিণ দিকে নদীর পাড়ের ক্ষমতা আর লোভের লড়াইটা এখন আরও জোরালো হচ্ছে দিন দিন। এমনিতেই হারু গাজী ভাই হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য সুযোগ খুঁজছিল, গিয়াসের সাথে বাদলের নিত্য কলহের জের সেটাকে আরও উস্কে দিচ্ছিলো কেবল।
প্রভার মৃত্যুর ঘটনায় ছেলেকে নিয়ে কিছুটা বেকায়দায় পড়লেও সামলে নিয়েছে হারু গাজী। সে যে ঝানু খেলোয়াড় তা তো সবাই বোঝে না। ক্লাবের পোলাপান যতই হৈচৈ করুক প্রমাণের অভাবে সাঈদ খান এমনিতেই কিছু করতে পারতো না, তবুও হারু গাজী নিজে যেচে তাদের সাথে নত হয়ে সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এখন বিভার মৃত্যুর পর এই বিষয়টা কিছুটা চাপা পড়ে গেছে। হারু গাজী তবুও সাঈদ খান আর সাত্তার মাস্টারের সাথে সু-সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে।
উজানগাঙের পাড়ে বটতলার হাট আর কলাবতী ঘাটের ইজারা নিয়ে নতুন খেলা শুরু হয়েছে অনেক আগেই। বর্তমান ইজারার সময়কাল শেষ হয়ে এসেছে। খুব শীঘ্রই নতুন ইজারাদার নির্ধারণ করা হবে। গিয়াসের স-মিলে আসা গাছের নৌকার টোল আদায় নিয়ে বাদলের সাথে বাকবিত-া মাঝে মধ্যেই হাতাহাতিতে গিয়ে শেষ হয়। এর রেষ খালেক তালুকদার আর হারু গাজী পর্যন্ত পৌঁছে যায়। গিয়াস সর্বত্রই বলে বেড়ায়, ‘এইবার বাদইল্যারে ঘাডের ইজারা নেওয়াইতাছি’। বাদলও পণ করেছে যে করেই হোক ইজারার দখল তার কাছেই রাখবে।
খালেক তালুকদার কখনো সরাসরি এসব ঝামেলায় নিজেকে জড়ায় না। কিন্তু হারু গাজী জানে এলাকায় যা কিছু ঘটছে তা খালেকের হাতের ইশারায়ই ঘটছে। বাদল তার ভাইয়ের সাথে পরামর্শ ছাড়া এক পা’ও সামনে বাড়াবে না। হরিপদর পরিবারকে নিয়ে যে খেলা শুরু হয়েছে, হারু গাজী ঠিকই টের পায় এখানে অবশ্যই খালেকের বড় ধরনের একটা উদ্দেশ্য আছে। গিয়াসকে উদ্দেশ্য করে সে বলে, ‘বাদইল্যার উপর সবসময় নজর রাখবি। যা-ই ঘটুক, আমরা এহন হরিপদর পক্ষে’। হারু গাজীর চোখ দু’টো চকচক করে ওঠে। মনে মনে বলে, এহন কেবল সুযোগের অপেক্ষা।
বিভা-প্রভার মৃত্যুর পর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই চলছে এখন। হরিপদর পরিবারকে ঘিরে অনেকদিন আর কোন ঘটনা ঘটেনি। নিয়মিত কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তারাপদ। হরিপদ ওপারে যাবার কথা বলেন না আর। তারাপদ ভাবে, দাদা দেশত্যাগের চিন্তাটা মন থেকে বাদ দিয়েছেন হয়তো। বাড়ির এখানে-সেখানে স্তূপ করা ধান মাড়াই, সিদ্ধ, শুকনো শেষে গোলাভর্তি হয়ে বাংলাঘরে স্থান পেয়েছে। এখন বাংলাঘরের অর্ধেকটা জুড়েই ধানের গোলা, বাকি অর্ধেকে বিভিন্ন সরঞ্জাম দিয়ে ভরে রেখেছে গোপাল। আবার হাসি-আনন্দে ভরে উঠেছে হরিপদ-তারাপদর সংসার। শ্যামল আর তাপসের ছুটি শেষ হয়ে আসছে, ওরা ঢাকায় ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
সেদিন মাঝরাতে গ্রামবাসীর ঘুম ভেঙে যায় হঠাৎ। গভীর রাতে হরিপদ ঘোষের বাড়ি থেকে চিৎকার ভেসে আসে। গোপাল, শ্যামল আর তাপস ওদের গলার সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে সবাইকে জানান দেয়Ñ‘কে কোথায় আছেন, আমগো বাড়িতে আগুন লাগছে।’
হরিপদ ঘরের দরজায় স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। দাউদাউ করে জ্বলে। পুড়ে যায়- ঘর-মন, এক জীবনের স্বপ্ন-ভালোবাসা। আগুনের লেলিহান শিখা কেউটের ফণার মতো লকলকিয়ে উর্ধ্বপানে উঠে যায়। চোখ ধাঁধানো দগদগে উজ্জ্বল আগুন দেখে অদ্ভুত অস্পষ্ট একটা গোঙানি ওঠে হরিপদর বুকের ভেতর। সেই দুমড়ে-মুচড়ে দেয়া গোঙানিটা কেবল তিনিই শুনতে পান। সর্বগ্রাসী আগুনের নিষ্ঠুর আলোয় চোখে পড়ে তারাপদ উঠানের মাঝখানে নিশ্চল পাথরের মূর্তি’র মতো দাঁড়িয়ে। তার হাড়ভাঙা পরিশ্রমের সবটাই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। এ শুধু সম্পদ পোড়ার কষ্টই নয়, সেইসাথে আশা-আকাক্সক্ষা-স্বপ্ন ভাঙার এক অদ্ভুত যন্ত্রণা।
সেই রাত্রির মধ্যপ্রহরেও মানুষের চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘোষবাড়ি উত্তাল হয়ে ওঠে। রাতের নিকষ অন্ধকার চিরে উজ্জ্বল-লাল আগুনের শিখাটা চোখে পড়ে দূর- দুরান্ত থেকে। কোটাখালী খালের পাড় ধরে ‘আগুন-আগুন’ বলে চিৎকার করে ছুটে আসে মানুষ। প্রতিবেশীরা ছুটে আসে, ঝাঁপিয়ে পড়ে; দীর্ঘ সময় ধরে চলে আগুন নিভানোর প্রচেষ্টা। একসময় শেষ হয়ে আসে আগুন-মানুষের যুদ্ধটা। নিভে যায় সর্বগ্রাসী আগুন। হরিপদ-তারাপদর মনের ভিতরে একটা আগুন তখনও দাউদাউ করে জ্বলে।
তারাপদ তখনও উঠানের মাঝখানে স্থির দাঁড়িয়ে। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে বাংলাঘরের কিছু পোড়া খুঁটি দাঁড়িয়ে আছে শুধু। নিচে পোড়া চাল, ছাই আর কাঁদায় মাখামাখি। গোপাল কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এসে বলে,
ছোটকর্তা, সব তো পুইরা গ্যালো। একটা ধানের গোলাও আস্ত নাই।
তারাপদ যেমন ছিল তেমনই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। রমেন সাহা এসে হাত রাখে কাঁধে। বলে,
তারা, আরেকটা যুদ্ধ দরকার। আর একটা সুযোগ!
তারাপদ তখনও নিশ্চুপ।
কাদা আর কালিতে মাখামাখি হয়ে উঠানের মাঝে দাঁড়িয়ে বাবা-কাকার মৌনমূর্তি দেখে ভয় হয় শ্যামলের। এবার কীভাবে বাবাকে ঠেকিয়ে রাখবে সে
রাতের গাঢ় অন্ধকার ধীরে-ধীরে কেটে যায়। একটু পরই সকাল হয়ে যাবে। সাত্তার মাস্টার ঘরের সিঁড়িতে হরিপদর পাশে এসে বসেন।
মাস্টার, কইতে পারো আমি কী এমন অন্যায় করছিলাম? আমি তো তোমগো একজন হইয়াই থাকতে চাইছিলাম, এইডাই কী অপরাধ? সাত্তার মাস্টারকে দেখে বলে উঠলেন হরিপদ।
হরি, তোমারে সান্ত¡না দেবার ভাষা আমার জানা নাই। তোমার আবার অপরাধ কী? আইজ তো নিজেরেই অপরাধী মনে হইতাছে। ঐ ‘হারামির বাচ্চা’র একটা কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত আমার শান্তি নাই।
পুড়ে যাওয়া বাংলাঘরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন হরিপদ ঘোষ। কিছুক্ষণ পর সাত্তার মাস্টারের উদ্দেশ্যে বলেন,
আইজ নিজেরে বড় অসহায় লাগতাছে মাস্টার। মনে অইতাছে- ‘এই দেশ, এই মাটিÑ আমার না। আমরা তোমগো কেউ না’।
এমন কইরা কইওনা হরি। এই দেশ-এই মাটি, তুমি-আমি, আমরা সবাই কখনো নিজেদেরকে ভিন্ন ভাবতে পারি? তোমার মনের অবস্থা আমি বুঝি। একটু ধৈর্য ধর, এই দুঃসময় থাকবে না।
জানো, একাত্তরেও নিজেরে এতটা অসহায় মনে অয়নাই। তহন সবাই একসাথ অইয়া দেশি-বিদেশী শত্রুর বিরুদ্ধে রুইখ্যা দাঁড়াইছি, কান্ধে কান্ধ মিলাইয়া একলগে যুদ্ধ করছি। আইজ সবকিছুই মিথ্যা মনে অইতাছে। ছোডকাকু চইলা যাওনের সময় কতবার কইছিলো ‘ল, একলগে চইলা যাই’, তহন তাঁরে কইছিলাম- এই দেশ এই মাটি ছাইড়া কই যামু? আইজ মনে অইতাছে, হেইদিন ভুলই করছিলাম।
সকাল হতেই হরিপদ ঘোষের বাড়ি লোকজনে ভরে যায় আবার। কেউ কেউ তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করতে ছাড়ে না।
এইবার আপনে কী কইবেন চেয়ারম্যান সাব? আমরা আর কত ধৈর্য ধরুম? ক্ষোভের সাথেই বলে ওঠে রমেন সাহা।
তোমগো কী ধারণা আমি এর একটা সুরাহা চাই না? সাঈদ খান বললেন।
আমি তা কইতাছি না। কিন্তু প্রমাণের জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে হরি’দা তো সর্বস্বান্ত হইয়া যাইতাছে। এহনও কী বোঝার বাকি আছে এইডা কার কাম?
কাকা, এইডা তো আমার, আমার বাপ-ঠাকুদ্দার জন্মভূমি। এই দেশে স্বাধীনভাবে বাঁচনের অধিকার কী আমগো নাই? নিজেগো অস্তিত্ব বিপন্ন হইলে হেই মানুষ যে কোন অঘটন ঘটাইয়া ফেলতে পারে। তেমন কিছু হইলে আমগো দোষ দিতে পারবেন না। ক্ষুব্ধকণ্ঠে বলে ওঠে শ্যামল।
সাঈদ, আমগো পিঠ তো দেয়ালে ঠেইক্যা গেছে। কিছু একটা অবশ্যই করতে হইবো। সাঈদ খানের পাশ থেকে বলে সাত্তার মাস্টার।
কেউ একজন খালেইক্যা আর বাদইল্যারে ডাইক্যা আন তো।
সাঈদ খানের মুখের কথা শেষ হতে না হতেই দেখা যায় হরিপদ ঘোষের বাড়ির রাস্তা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করছে খালেক তালুকদার। তাকে দেখেই উপস্থিত সবার মধ্যে একটা গুঞ্জন ওঠে। খালেক তালুকদার সতর্ক হয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই উপস্থিত জনতার একজন হিসেবে দুঃখ প্রকাশ করে।
সাঈদ খান বলেন- খালেক, তোর ভাই কই?
বাদলের কথা কইতাছেন কাকা?
তোর তো একটাই ভাই, নাকি?
, ও তো কাইল বিহালে ইন্দ্রকাঠী গ্যাছে।
ক্লাবের ছেলেদের পক্ষ থেকে আসাদ চিৎকার করে ওঠে।
মিথ্যা কথা কাকা; কাইল সন্ধ্যায়ও শয়তানডারে স-মিলের সামনে ওর চ্যালাগুলার লগে ফুসুরফাসুর করতে দ্যাখছি। এইকাম ও ছাড়া আর কারও না।
হারামজাদারে ধইরা আইনা গাছের লগে বাইন্ধ্যা মান্দারকচা দিয়া পিডাইলে মুখ দিয়া সব সত্য কথা বাইর হইয়া যাইবো। ক্ষোভের সাথে বলে ওঠেন ইসমাইল মোল্লা।
কাজেম মাঝি বলেনÑ কোনো কথা নাই, তাই কর। সব সত্য বাইর হওন দরকার।
আইজক্যার ঘটনার জন্য মাস্টার দায়ী। একাত্তরে সেরুর বংশ খতম করনের কথা আছিলো। একমাত্র মাস্টারের কারণেই সেদিন এইগুলান বাইচা গেছে। ঐদিন এইগুলানরে শ্যাষ কইরা ফেললে আইজক্যা দেশে এই অরাজকতা তৈরি হইত না।
হামিদ শেখের কথাটা বাতাসে মিলিয়ে যাবার আগেই ক্লাবের ছেলেদের মধ্যে একটা শোরগোল ওঠে। অনেকেই বলে ‘এহন সবাই মিইলা অগো ঘরে আগুন দিলে উচিৎ শিক্ষা হইবো’।
খালেক তালুকদার এভাবে সবার রোষানলে পড়বে ধারণা করতে পারেনি। সে কারও দিকে না তাকিয়ে সরাসরি সাঈদ খানের উদ্দেশ্যে বলে,
কাকা, প্রমাণ ছাড়া কাউরে এইরকম ভাবে দোষ দেওন কী ঠিক? বাদল কাইল বিহালে বাড়ি থেইক্যা বাইর হইয়া গ্যাছে, হয়তো সন্ধ্যা পর্যন্ত বাজারে থাইক্যা ইন্দ্রকাঠী চইলা গ্যাছে। এই ঘটনার দোষ ওর উপর চাপানো কী ঠিক অইতাছে?
খালেক, তোর ভাই নিজেরে খুব চালাক মনে করে; তুইও তাই। এই ঘটনা বোঝার জন্য খুব বেশি বুদ্ধিমান হবার দরকার নাই। হরিপদর জমি ঘেইষ্যা মাটি কাটনের পর থেইক্যা একটার পর একটা ঘটনা ঘটতাছে। তুই কী মনে করস তোগো দুরভিসন্ধি কেউ বোঝে না? তাড়াতাড়ি তোর ভাইরে আননের ব্যবস্থা কর। মনে করিসনা, এই ঘটনা এইহানেই থাইমা যাইবো। এইবার আমি এর শ্যাষ দেইখ্যা ছাড়ুম। দরকার হইলে থানা-পুলিশ, যতদূর যাওন লাগে; দেখুম। তোরে পরশুদিন পর্যন্ত সময় দিলাম।
ও আনবো কোত্থেইক্যা? ও-ই তো পালের গোদা। ভাই আর লোকজনরে দিয়া আগুনডা লাগাইয়া নিজের ভাইরে পার কইরা দিছে। এই হারামিডারে ধইরা ধোলাই দেন খান সাব, সব আসল কথা বাইর হইয়া যাইবো। ভিড়ের মধ্যে থেকে হারু গাজী বলে ওঠে।
হারু গাজীর দিকে একবার আড়চোখে তাকায় খালেক তালুকদার। তারপর হনহন করে হেঁটে বের হয়ে যায় হরিপদর বাড়ি ছেড়ে।
সন্ধ্যার নিস্তব্ধ আঁধারে হরিপদর বুকের ভেতরটা ফাঁকা হতে হতে ক্রমশ হতাশার গভীরে হারিয়ে যায়। কোনো অবলম্বন খুঁজে না পেয়ে ডুবন্ত মানুষ যেমন তলিয়ে যেতে থাকে গভীর পানিতে, ঠিক তেমনি। সাত্তার মাস্টারের বইয়ের দোকানের সামনে বসে আছে দু’জন। হঠাৎ মাস্টারের হাতের উপর হাত রেখে হরিপদ বলেন,
মাস্টার, দোষ-ত্রুটি করলে মাপ কইরা দিও।
এই কথা কইতাছো ক্যান হরি? তুমি আবার কী দোষ করলা?
এক জীবনে কত কিছুই তো ঘটে। সবকিছু কী আর হিসাব কইরা হয়? আর তো বেশিদিন তোমগো মধ্যে নাই।
চট করে ঘুরে তাকান সাত্তার মাস্টার।
কী কইলা হরি? তুমি বেশিদিন নাই মানে?
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হরিপদ বলেন- হ, এইবার তোমগো মায়া কাটাইয়া চইলা যামু।
কই যাইবা তুমি?
ছোট কাকুরে চিঠিতে সব জানাইছিলাম, কয়দিন আগে দেবু উত্তর পাঠাইছে। ওইহানে ওরা সব ব্যবস্থা করতাছে। এহন জমি-জমাগুলান বেচনের ব্যবস্থা করন দরকার। তুমি সবার লগে একটু আলাপ কইরা দেহো না মাস্টার। বাজার দামের চাইতে না হয় কিছুটা কমেই দিলাম।
তুমি সত্য সত্যই চইলা যাইবা হরি? তাইলে তো ওরাই জিইতা গ্যালো। আমগো এত যুদ্ধ’র কী মানে থাকলো?
মাস্টার, তুমি তো আমারে চিনো। দেশ ছাইড়া যাওনের ইচ্ছা আমার কোনোকালেই আছিলো না। কিন্তু নিজের স্বার্থের লাইগ্যা পরিবারের সবাইরে তো আর বিপদের মধ্যে ফেলাইতে পারি না। আইজ আমার বাংলাঘরে আগুন দিছে, কাইল আমার থাকনের ঘরে দেবো। তোমরা আর কতকাল পাহারা দিয়া রাখবা কও?
সাত্তার মাস্টার লক্ষ করেন শেষদিকে হরিপদর গলা ভারী হয়ে আসে। তিনি বিচলিত হয়ে ওঠেন। এই আপাত গম্ভীর অথচ সহজ-সরল মানুষটিকে কোনোদিন কাঁদতে দেখেননি তিনি। ছেলেবেলা থেকে একসাথে বেড়ে উঠেছেন, কিন্তু হরিপদর এমন রূপ কোনোদিন চোখে পড়েনি তাঁর। সাত্তার মাস্টার হরিপদর হাত ধরে বলেন,
হুট কইরা এমন সিদ্ধান্ত নিও না হরি। এই সমস্যা থাকবো না। আমরা আবার ঘুইরা দাঁড়ামু। তোমার প্রতি অনুরোধ আরেকটু ধৈর্য ধর। সব ঠিক হইয়া যাইবো।
মাস্টার, এই দেশ ছাইড়া আমার কী যাইতে ইচ্ছা করে? আমার ভেতরটাও কী পোড়ে না? বড় কষ্টে দেশ ছাইড়া যাওনের সিদ্ধান্ত নিছি। ঠিক আছে তুমি যহন কইতাছো, আর কয়ডা দিন যাউক। দেখিÑ শ্যাষ পর্যন্ত কী সুরাহা হয়।
হইবো হরি, অবশ্যই সুরাহা হইবো। এইভাবে সবকিছু নষ্ট হইতে দেওন যাইবো না।
হরিপদ উজানগাঙের দিকে তাকিয়ে থাকে। অবিরাম ঢেউয়ের শব্দ, নদীর উপর থেকে বয়ে আসা হিম ঠা-া বাতাস হরিপদর বুকের ভিতরের আকুলতা বাড়িয়ে তোলে।




 

পরদিন বিকেলের দিকে নদীর পাড় থেকে একটা হুল্লোড় শোনা যায়। কেউ কেউ বলে, ‘ঠোডায় মারামারি লাগছে’। দুই নদীর মোহনাকে এলাকার লোকজন ‘ঠোডা’ বলে। সবাই জানে এই গ্রামে মারামারি করার মতো দু’টো দলই আছে। বাদল আর গিয়াসের দল। আগামী সপ্তায় ঘাট-হাটের নতুন ইজারাদার নির্ধারণ হবে। এখন ওদের ঝগড়া-মারামারি তো প্রতিদিনের ঘটনা। এ আর এমন কি! বাজারের কেউ এইসব কথায় কান দেয় না। লোকজন আড়ালে আবডালে বলে, ‘এ সবই পাপের ফল। এই দুইডা দাঙ্গাবাজ পরিবার কম মানুষ মারছে? গ্রামের মানুষরে কম জ্বালাইছে? আল্লাহ্র বিচার আছে না!’
পুরনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি তো আজকেই নতুন নয়। সেরু তালুকদার আর হাশেম গাজীর সময়কাল থেকেই নদীর পাড়ের মারামারির ইতিহাস তৈরি হয়ে এসেছে। তাই তাদের নাতিদের কৃতকর্মে মানুষ আর অবাক হয় না। তবে আজকের পরিস্থিতি কিছুটা আলাদা। হরিপদর বাড়িতে বাদলের আগুন দেয়ার বিষয়টা অনেকের কাছে পরিষ্কার। গ্রামের মানুষও এর একটা সুরাহা চাচ্ছিলো। লোকমুখে শোনা যায় বাদলকে তার স-মিলের কাছে দেখা গিয়েছে। সারা গ্রামে একটা খবর খুব ভালোমতোই রটে গিয়েছিলো যে আজ-কালের মধ্যেই হরিপদর বাড়িতে আগুন লাগানোর অপরাধে বাদলের বিচার হবে। তাই বাদলের এলাকায় ফেরাটা একটা খবরই বটে। হারু গাজীর ছেলে গিয়াস বাদলকে আটকাবার এমন মওকা হেলায় হারাবার পাত্র নয়। সেও তার দলবল দিয়ে তৈরি থাকে।
পশ্চিম আকাশ কালো করে মেঘ জমেছে। যে কোনো সময় ঝমাঝম বৃষ্টি নামবে। লোকজন আগেভাগেই আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে যায় দোকানে কিংবা গাছের নিচে। এমন সময় কালোমেঘকে পেছনে ফেলে নদীর পারের রাস্তা ধরে ছুটে আসে হারিছ। হাঁপাতে হাঁপাতে গিয়ে ঢোকে হারু গাজীর চালের আড়তে।
হারু গাজী হিসাবের খাতা থেকে মুখ তুলে তাকায়।
কী রে, এমন কইরা হাপাইতাছস ক্যান?
চাচা, বাদইল্যা গিয়াসরে মারছে।
কী কইলি?
একলাফে গদি থেকে নেমে দাঁড়ায় হারু গাজী। গদির পেছন থেকে ছো মেরে লম্বা বাঁশের লাঠিটি হাতে তুলে নেয়।
হারামজাদাডা আমার পোলার গায় হাত তুলছে? ওর হাত আমি ভাইঙা দিমু না!
দৌড়ে বেরিয়ে যায় আড়ত থেকে, তারপর ছুটতে থাকে নদীর পাড়ের দিকে। হারিছ পেছনে পেছনে ছোটে। হারু গাজীর যেন নতুন যৌবন এসেছে, তাঁর সাথে দৌড়ে পারে না। দুই নদীর মোহনায় এসে হাঁক দেয় হারু গাজী,
ঐ হারামির বাচ্চা, আমার পোলার গায় হাত তুলছস; সামনে আয়। 
বাদল কিংবা ওর সাঙ্গপাঙ্গকে আশেপাশে কোথাও দেখা যায় না। দেখা যায় না গিয়াসকেও। হারু গাজীকে দেখে এগিয়ে আসে সাজু।
কী রে, গিয়াস কই? হারু গাজী জিজ্ঞেস করে।
ও তো বাড়িতে চইলা গ্যাছে।
ওরে মারছে কেডা?
বাদইল্যা আর অর লগের পোলাপাইন। আমরা ঐ সময় কাছাকাছি আছিলাম না।
সেরুর নাতি হারামজাদাডা কই?
ওরা সবাই ভাগছে।
সামনে পাইয়া লই, ওর বাপ-দাদা চৌদ্দগোষ্ঠীর নাম ভুলাইয়া দিমু।
হারু গাজী রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ফিরে আসে আড়তে। মনে মনে ভাবে, ‘এইবার আর ছাড়ন নাই’।
তালুকদারের হাটখোলা থেকে কিছুটা দক্ষিণে এগিয়ে ছোট্ট একটা বাঁক। বাঁকের ঠিক মুখেই ব্রিজটা। বাড়ুই বাড়ির ব্রিজ; এভাবেই লোকমুখে প্রচারিত। কাঠের তৈরি। একসময় কোটাখালী খালের উপর এটাই ছিল খাল পারাপারের একমাত্র ব্রিজ, এখন পরিত্যক্ত। হরিপদ ঘোষের বাড়ির সোজাসুজি নতুন ব্রিজটা তৈরি হবার পর এ’টা আর কেউ ব্যবহার করে না। দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকা, যথাযথ মেরামতের অভাবে ব্রিজটি ভঙুর অবস্থায় পৌঁছেছে। খালের অপর প্রান্তে ঘন জঙ্গলে ভরা বাড়ুইদের ছাড়াবাড়ি। এই জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ছুটে চলা সরু রাস্তাটা শ্যামলপুর থেকে কলাবতী বাজারের দিকে যাওয়ার মূল রাস্তার সাথে মিশেছে। এ পথ দিয়ে দিনের বেলায়ও মানুষ চলাচল করতে ভয় পায়। তাই এ-পথে সচারাচর কাউকে আর চলাফেরা করতে দেখা যায় না। তবে মাঝে মধ্যে একজন অবশ্য এ পথটা ব্যবহার করে। সে আর কেউ নয়, খালেক তালুকদারের ভাই- বাদল।
ছাড়াবাড়ির মধ্যের সরু রাস্তা ধরে বাড়ুই বাড়ির ব্রিজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাদল। মনের মধ্যে ঝড় বয়ে চলছে। লোকজনের দৃষ্টি এড়াতেই আজ এই নির্জন রাস্তাটা বেছে নিয়েছে সে। অবস্থা দেখে মনে হয় সারা গ্রামের মানুষ তার বিরুদ্ধে চলে গেছে। হরিপদর বাড়িতে আগুন দেয়াটা শেষ পর্যন্ত কাল হয়েই দেখা দিলো! তার উপর হারু গাজীর ছেলে গিয়াস যেন আঠার মতো তার পেছনে লেগে আছে। কাল সকালেই সে কয়েক সপ্তাহের জন্য গা ঢাকা দেবে। একসময় সবকিছু আবার স্বাভাবিক হয়ে আসবে, তখন সুযোগ বুঝে আবার এলাকায় ফেরা যাবে। হাট-ঘাটের ইজারার ঝামেলাটা বড়ভাই একাই সামাল দিতে পারবে।
এই ভাঙা ব্রিজ দিয়ে অতি সাবধানে পার হতে হয়, আলো থাকতেই ব্রিজের কাছে যাওয়া দরকার। কোনোদিকে না তাকিয়ে হনহন করে ব্রিজের দিকে হেঁটে চলেছে বাদল। আচমকাই বনের ভেতর থেকে বিলাপ করে কান্নার শব্দটা কানে আসলো, বাদল গা করে না। সন্ধ্যার আগেই পৌঁছুনোর জন্য একটা তাড়া অনুভব করে সে। খুব জোরে হেঁটে চলে। সন্ধ্যার কিছুটা আগেই পৌঁছে যায় ব্রিজের কাছে; খাল পার হবার জন্য পা বাড়ায় ব্রিজের দিকে।
এই বাদইল্যা, খাড়া।
নিজের নাম শুনে থমকে দাঁড়াল বাদল। ঘুরে দেখল ঠিক ওর সামনে দাঁড়িয়ে গিয়াস। মুখোমুখি।
আমার লগে বোঝাপড়া না কইরা কই যাস? গিয়াসের চোখে প্রতিহিংসার আগুন।
গিয়াস, বাড়াবাড়ির একটা সীমা আছে; সইরা যা এইহান থেইক্যা।
সইরা তো যামুই; তার আগে তোর লগে বোঝাপড়াটা কইরা লই। আমারে একলা পাইয়া পোলাপান লইয়া মারছোস, মনে করছোস কী আমি এমনি-এমনিই ছাইড়া দিমু?
বাদল খালের ওপারে তাকায়। গিয়াস বাঁকা হাসি হেসে ঠা-া গলায় বলে,
ওপারে চাইয়া কোনো লাভ নাই চাচ্চু! এইহান থেইক্যা হাটখোলা ম্যা-লা দূর, কেউ কিচ্ছু শুনবো না।
তুই কী মনে করছোস পার পাইয়া যাইবি?
‘আমি কিচ্ছু মনে করিনাই, খালি তোরে একটু শিক্ষা দিতে চাই’ বলেই দ্রুত এগিয়ে এসে বাদলের মুখ-বরাবর ঘুসি ছুঁড়ে দিল গিয়াস। বাদল মুখটা সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে কিন্তু সজোরে ছোড়া আঘাতটা পুরোপুরি এড়াতে পারল না। থুঁতনিতে হাতুড়ির বাড়ি খেয়ে মাথার ভেতরটা ভোঁভোঁ করে উঠলো যেন! কিছু বুঝে ওঠার আগেই পেটে পর পর কয়েকবার আঘাত হানল গিয়াস। মাটিতে পড়ে গেল বাদল। গিয়াস কিছুটা সময় দেয়, যেন দক্ষ শিকারী শিকার নিয়ে খেলছে। বাদল নিজেকে সামলে নিয়ে পাল্টা আঘাত হানল কিন্তু সতর্ক গিয়াস সরে গিয়ে সহজেই এড়িয়ে গেল। গিয়াস সরে যেতেই বাদল ঘুরে তাকে জাপটে ধরল, কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি করতে করতে খালের পাড়ে চলে আসে দু’জনে। গিয়াস আবার পেটে আঘাত হানতেই বাদল খিস্তি ছাড়লÑ ‘এই বেজম্মার বাচ্চা, তুই আমার গায় হাত তুলছোস...!’ কথা শেষ হবার আগেই গিয়াস আবার আঘাত হানল মুখে। বাদল টলতে টলতে নিজেকে সামলে নিল কিছুটা; আচমকাই যেন মাথাটা বিগড়ে গেল তার। তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়তে পড়তেই বলল,
গিয়াইস্যা, তুই আমারে চিনোস নাই। তোর চাচা আমার লগে লাগতে আইছিলো, শেষ পরিণতি দেহস নাই? তোরও একই অবস্থা অইবো। সবুর কর, সিরু তালুকদারের নাতি হইলে এর প্রতিশোধ আমি নিমু।
অকস্মাৎ গিয়াসের চোখ দু’টো জ্বলে উঠলো যেন! বাদল কিছু বুঝে ওঠার আগেই পকেট থেকে বের করল ছুরি; সা-ই করে খাপ থেকে খুলে পরপর কয়েকটা আঘাত হানল বাদলের পেটে-বুকে।
হঠাৎ এমন আঘাতের জন্য মোটেও তৈরি ছিলনা বাদল। নিজের অবস্থা দেখে হকচকিয়ে গেল। গিয়াসকে ছুরি হাতে আবার এগিয়ে আসতে দেখে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে তাকে ধাক্কা দিল- পেছনেই খাল।
গিয়াসকে ধাক্কা দিয়ে বাদল নিজেও আছড়ে পড়ল খালপাড়ের শক্ত মাটিতে। পেটের কাছে হাত যেতেই আঠালো উষ্ণ তরলের ছোঁয়া পেল। দু’হাত সামনে তুলে ধরতেই আঁতকে উঠে বলল, ‘ঐ শালা গিয়াইস্যার বাচ্চা, তুই এইডা কী করলি? খাড়া আমি একটু ঠিক অইয়া লই, তোরে আমি ছাড়ুম না!’ বাদল চিৎকার করে ওঠেÑ ‘মিয়াভাই, তুমি কই? আমারে বাঁচাও।’ বাদলের সেই ক্ষীণকণ্ঠের আর্তনাদ শোনার জন্য খালের ওপারে তখন কেউ নেই। দু’হাতে ভর দিয়ে উঠতে চেষ্টা করল সে কিন্তু কে যেন পেড়েক দিয়ে তাকে আটকে রেখেছে মাটির সাথে! শরীরের সব শক্তি যেন নিঃশেষ হয়ে আসছে। বাদল খালের ওপারে তাকায়, কোনো সাড়া নেই। দু’পাশের জঙ্গলে ঘেরা পথটায় ক্রমশ আঁধার নেমে আসছে।
শরীরটা এমন ভারী লাগছে কেন? ‘এই! কোন শালা আমারে ধইরা রাখছে?’ পাশের জঙ্গল থেকে কানে ভেসে আসছে সেই বিলাপের সুর। ডানা ঝাপটানোর শব্দটা এখন আর শোনা যাচ্ছে না। তবে কি! বাদলের দু’চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। তার এমন ঘুম পাচ্ছে কেন? এখন তো ঘুমের সময় না! তার শরীর কোথায়? সে তো কিছুই টের পাচ্ছে না!
নাহ! দু’চোখ আর মেলে রাখা যাচ্ছে না। সে চলে যাচ্ছে; উজনগাঙের পাড় ধরে হেঁটে যাচ্ছে স-মিলের দিকে। এই শালা মনা, তুই কার্ড চুরি করলি ক্যান? শালা! ঘুসি মাইরা তোর বত্রিশ দাঁত ফালাইয়া দিমু। ‘উস্তাদ, তারাপদ ঘোষ তোমারে তো জমি দিলো না, এহন স-মিল কৈ করবা?’ ‘ঐ মালুর বাচ্চা মালুরে একদিন আমি দেইখ্যা নিমু।’ জব্বার বলে উঠলো, ‘তোমার ঘাটের ইজারা তো গিয়াইস্যা নিয়া নিলো! তুমি কই?’ ‘শালা গিয়াইস্যার এত্তবড় সাহস!’ কাসেম হাসতে হাসতে বলল, ‘বাদল আইজও তুই হারলি! এইরকমভাবে হারলি!’ ‘এই তোরা কেউ কতা কবি না, আমি এহন ঘুমাইতেছি, ঘুম... ঘুম... ঘুম...’
বাদলের ধাক্কায় তাল সামলাতে না পেরে ব্রিজের উপর চিৎ হয়ে পড়ল গিয়াস। ব্রিজের ধরণি ধরে কোনরকমে নিজেকে রক্ষার শেষ চেষ্টা করেছিল সে, কিন্তু দীর্ঘদিনের রোদ-বৃষ্টিতে প্রায় পচে যাওয়া কাঠের ধরণিটা গিয়াসের ভারীদেহ বহন করার শক্তি রাখে না। ভাঙা ধরণিটাসহ নিচে পড়ার ঠিক আগে খালে পোতা ঝাউয়ের খাড়া বাঁশগুলোর দিকে দৃষ্টি যায় গিয়াসের। সূচালো বাঁশগুলোর দিকে তাকিয়ে চোখ দু’টো বড় বড় হয়ে ওঠে, শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠা-া স্রোত নেমে যায়। পতনের সাথে সাথেই গিয়াসের কণ্ঠ থেকে গগনবিদারী চিৎকার ভেসে আসে।
তালুকদারের হাটখোলা থেকে লোকজন এসে জড়ো হয় খালপাড়ে। সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে সবাই দেখে খালের ঝাউয়ের বাঁশের মধ্যে গিয়াসের দেহটা আটকে আছে কেমন বীভৎসভাবে। একটা লাল রক্তের ধারা ক্রমশ মিশে যাচ্ছিলো কোটাখালী খালের ঘোলাজলের মাঝে।





 

হঠাৎ করেই সবকিছু থমকে গেল। আকাশে ঘন মেঘ জমে অন্ধকার হয়ে আসলে যেমন চারিদিক নীরব হয়ে যায়, ঠিক তেমনি। জোড়া খুনের ঘটনার পর গিয়াস কিংবা বাদলের সাঙ্গোপাঙ্গদের একবারও দেখা যায়নি এলাকায়। হারু গাজীর বাড়িতে শোকের মাতমটাও নিঃশব্দে চলে। কেবল খালেক তালুকদারকে ক্রোধে ফুঁসতে দেখা যায়। কলাবতী বাজারে চায়ের কাপের গুঞ্জন চলে যথা নিয়মে। এই মৃত্যু গ্রামবাসীর মধ্যে কোন প্রভাব ফেলে না। কাউকে ব্যথিত হতেও দেখা যায় না। এমনকি দুঃখ করে বলতেও শোনা যায় না- ‘আহারে! এমন পোলাগুলান অকালে চইলা গেল!’
সন্ধ্যা নাগাদ পুলিশ আসলো গ্রামে। মফিজ মিয়ার বাড়ির প্রবেশপথ দিয়ে পুলিশকে বাড়ির ভিতরে ঢুকতে দেখে পেয়ারা বেগমের চোখ কপালে ওঠে প্রায়। ঘরে ঢুকেই স্বামীর উদ্দেশ্যে বলল,
সাজুর বাপ, বাড়িতে পুলিশ আইছে ক্যান?
মফিজ মিয়া ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়। মনে পড়ে, সাজু পেছনের বারান্দায় ঘুমিয়ে আছে। ভাবতে ভাবতেই পুলিশের দলটি তার ঘরের একেবারে সামনে চলে আসলো।
সাজু কেডা?
আমার ছেলে।
তারে ডাকেন।
ক্যান? ও কী করছে?
তার নামে অভিযোগ আছে।
কিন্তু ওর অপরাধটা কী?
হেইডা থানায় গিয়া দারোগাসাবরে জিগান। আমগো প্রতি আসামী ধইরা নিয়া যাইবার হুকুম হইছে, এর বেশি কিছু আমরা জানি না।
ঘুম ভেঙে পুলিশ দেখে হকচকিয়ে গেল সাজু। পুলিশ যখন হাতকড়া পড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল কিছুই বলার সুযোগ পেল না, কেবল বাবার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল।
পেয়ারা বেগম বিলাপ করে কেঁদে উঠল।
সাজুর বাপ, আমার পোলাডারে নিয়া যাইতাছে, আপনে কিছুই করবেন না?
মফিজ মিয়া নির্বাক। সাজুকে নিয়ে পুলিশের দলটি উঠান পেরিয়ে রাস্তা পর্যন্ত যেতেই পেয়ারা বেগম টলতে টলতে উঠানে পড়ে গেল। পারুল ছুটে এসে চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে দিলে উঠে বসল সে। মফিজ মিয়াকে উঠানে স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবার চিৎকার করে উঠল,
আমার পোলাডারে পুলিশ ধইরা নিয়া গ্যালো আর আপনে এহনও খাড়াইয়া আছেন! এমন পাষাণ বাপ কী আর আছে?
মফিজ মিয়া নির্বিকার। বিষণœ সন্ধ্যার শেষ আলোটুকু নিভে গিয়ে চারিদিকে ধীরে ধীরে আঁধার ঘনিয়ে আসে। মফিজ মিয়ার দু’চোখে জল জমে।
মেঘলা সকাল। রাতের বৃষ্টিতে পথঘাট এখনো ভেজা। মনু মিয়া মাদ্রাসা থেকে বেরিয়ে সামনের রাস্তায় উঠে দাঁড়ায়। হাতে-কাঁধে ঝুলছে ব্যাগ। পেছনে বের হয়ে আসে কালো বোরখায় আবৃত তার স্ত্রী আর তিন ছেলেমেয়ে। মনু মিয়া গেটের বাইরে এসে একবার ঘুরে তাকায়, শেষবারের মতো দেখে নেয় কয়েক বছরের বসতিটুকু। তারপর আবার হাঁটা দেয় সামনের দিকে। মফিজ মিয়ার বাড়ির সোজাসুজি এসে আবার দাঁড়ায়। একটু দূরেই বাবলা গাছের নিচে জঙ্গলে আবৃত ভাঙাচোরা কুঁড়েঘরটি চোখে পড়ে। মনু মিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সামনের দিকে ঘুরে যায়; স্ত্রী-সন্তানদের তাড়া দেয়। 
সকালবেলা রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করে বাড়ি ফিরছিলো আতিক। সপরিবারে মনু মিয়াকে আসতে দেখে ওখানেই দাঁড়ায়। কাছাকাছি এসে আতিকের উদ্দেশ্যে মনু মিয়া বলে,
আতিক ভাই, চইলা যাইতাছি; দোয়া রাইখেন।
কই যাইতাছেন?
গ্রামে যাইতাছি।
বেড়াইতে?
মনু মিয়া হাসে।
না, একেবারেই চইলা যাইতাছি।
একেবারেই চইলা যাইতাছেন!
হ। সবই তো নদীতে ভাইঙা গ্যাছিলো। এহন নদীর ঐ পাড়ে চর জাগছে। বড়ভাই যাওয়ার জন্য খবর পাডাইছে। বোঝেনই তো, নিজেরা উপস্থিত না থাকলে চরে দখল পাওয়া যায় না।
ও আচ্ছা।
দোয়া কইরেন ভাই।
মনু মিয়া চলে যায়। আতিক তাদের চলে যাওয়া দেখে আর ভাবে- গ্রাম থেকে আপদগুলো একে একে দূর হচ্ছে। আর কাউকে গ্রামের পরিবেশ নষ্ট করার সুযোগ দেয়া যাবে না।
সাজুকে পুলিশ ধরে দিয়ে গেছে দু’দিন হলো। এই সময়ের মধ্যে মফিজ মিয়া একবারের জন্যও বাড়ি থেকে বের হয়নি। পেয়ারা বেগম অনবরত কেঁদে চলেছে। স্বামীকে ক্রমাগত অভিশাপ দেয়াও বন্ধ হয়নি তার। মফিজ মিয়া চুপচাপ বসে থাকে বারান্দায়। শেফালি এসে বাবার পাশে দাঁড়ায়। ভাইয়ের খবর শুনে ছুটে এসেছে সে।
আব্বা, আপনে এমন চুপ কইরা বইয়া থাকলে চলবে? মায় তো খাওন-দাওন ছাইড়া দিছে।
দেউক। মফিজ মিয়া নির্বিকার।
আব্বা একটা কিছু করেন! পুলিশ সাজুরে মারতাছে কি-না কেডা জানে।
এই সবকিছুর লইগ্যা তোর মায় দায়ী। আমার একটা পোলাও মানুষ অইলো না। আমার কারণে ভাইয়ের মাইয়াডা এমন কইরা মইরা গ্যালো! আইজ যা কিছু অইতাছে সব বিভার অভিশাপের ফল। আমি কোনোদিন আর নিজেরে মাপ করতে পারুম না।
বিভা’পুরে তার সম্পত্তি বুঝাইয়া দেওনের কতা আমি অনেক আগেই আপনেরে কইছিলাম, তহন হুনলেন না।
আমি হুনুম ক্যামনে? ঐ রাক্ষুসী আমারে শান্তিতে থাকতে দিছে? এহন কান্দে ক্যান? অন্যের মাইয়া যহন মইরা গ্যাছে তহন তো মনে মনে খুশি অইছিলো। অরে যাইয়া পোলারে ছাড়াইয়া আনতে ক’।
ঘরের ভেতর থেকে গুনগুন করে কান্নার একটানা সুর ভেসে আসছে। মফিজ মিয়া গুম মেরে চৌকির উপর বসে থাকে। শেফালি এসে আবার বাবার পাশে দাঁড়ায়।
আব্বা, এইবারের মতোন কিছু একটা করেন। এরপর আর কোনোদিন কিছু কমু না।
মফিজ মিয়া মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে- তোমরা আমারে খুব শান্তিতে রাখছ! তারপর ঘর থেকে সোজা বেরিয়ে যায়।
কাজেম মাঝি সামনের বারান্দার চৌকিতে বসেছিলেন। মফিজ মিয়াকে তার ঘরের দিকে আসতে দেখে উঠে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন।
কি খবর মফিজ, তুমি এত্ত সকালে?
মফিজ মিয়া কোনো ভুমিকা না করে সরাসরি বলল- তোমার কাছে বিভার যে ভিডাটা বন্ধক আছে অইডা আমি বেচুম। বাজার দরের চাইতে কিছু কমই দিও, কিন্তু জরুরি ভিত্তিতে আমার টাকাটা দরকার।
সাজুরে ছাড়ানোর লইগ্যা?
মফিজ মিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে- হ।
কাজেম মাঝি বললেন- শোন মফিজ, জমিডা না বেইচা আরও কিছু টাকা নিয়া যাও। একলগে ফেরত দিয়া ছাড়াইয়া নিও।
না দরকার নাই। ঐ জমি আমি আর রাখুম না। জমিডা তুমি নিয়া নেও। মফিজ মিয়া তার সিদ্ধান্তে অনড়।
ঠিক আছে তুমি যহন চাইছ, আমার আর কী করা! তাইলে দামডা ঠিক কর।
দামডা তুমি-আমি বইসা পরে ঠিক কইরা নিমুনে, আইজ কী তুমি আমারে কিছু টাকা দিতে পারবা
পারুম, তয় এহন না। বিহালে নিও।
আইচ্ছা ঠিক আছে, বিহালে কালামের দোকানে আমুনে।
মফিজ মিয়া ফিরে আসে। কাজেম মাঝি তার গমনপথের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
কলাবতী বাজারে নদীর পাড়ের মাঝিদের মধ্যে আনন্দের ঢেউ জেগেছে আজ। হরিপদ ঘোষের দোকানের মিষ্টির অবাধ বিতরণ চলছে নিজেদের মাঝে। আজ থেকে এই ঘাটের নতুন ইজারাদার- কাজেম মাঝি। বাদল-গিয়াসের মৃত্যুর কারণে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইজারাদার নির্বাচিত হয়েছে কাজেম মাঝি। অনেকদিন পর ঘাটের মাঝিরা একটা আনন্দের উপলক্ষ পেল। মোক্তার মাঝি বলল,
আমি জানতাম, কাজেম ভাই আমগো ছাইড়া থাকতে পারবো না। য্যামনেই হউক আমগো লগেই তো আছে।
কাজেম মাঝি ঘাটের মাঝিদের মনের অবস্থাটা বোঝেন। তিনি জানেন এরা তাকে কতটা ভালোবাসে। মোক্তার মাঝির কথার উত্তরে শুধু বললেন,
তোমগো কথা চিন্তা কইরাই তো আমি এই ঘাডের দায়িত্ব নিলাম। এই ইজারার অংশীদার তোমরাও। আইজ থেইক্যা এই ঘাডে আর কোনো অনাচার অইবো না। কোনো মাঝির উপর অন্যায়ভাবে কিছু চাপাইয়া দেওয়া অইবো না।
মাঝিদের মাঝে খুশির হুল্লোড় ওঠে। কয়েকজন কাজেম মাঝিকে কাঁধে তুলে নিয়ে আনন্দ মেতে উঠল।
পরানকে বাজারের দিক থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখে সবাইকে চুপ থাকতে বলে মোক্তার মাঝি। ও কাছে আসতেই কাজেম মাঝি জিজ্ঞেস করেন,
কী রে পরান, এমন করতাছস ক্যান, কী অইছে?
কাজেম ভাই, আমগো দিন নাকি শ্যাষ।
ক্যান? আমগো দিন আবার শ্যাষ অইবো ক্যান রে পাগলা? দিন তো শুরু। রহম আলী বলে ওঠে।
পরানের কথা শুনে অন্যরা ক্ষেপে যায়। কেউ একজন বলে ওঠে, ‘এমন খুশির সময় একটা আজগুবি খবর নিয়া আইছে পাগলডা।’
আমারে পাগল কন আর যাই কন আমি কিন্তু মিছা কইতাছি না। ঐ রাস্তার উপরের লোকজন কওয়া কওয়ি করতাছে। দরকার থাকলে হুইনা আহেন।
কাজেম মাঝি বাজারের দিকে তাকান। পাকা রাস্তাটা নদীর পাড়ে বাঁধানো ঘাটের কাছে যেখানে এসে শেষ হয়েছে, ঠিক সেখানেই জরিপ করার যন্ত্রপাতি নিয়ে কিছু লোক মাপামাপি করছে।
‘ছগির, যা তো উপর থেইক্যা ভালো কইরা খবর নিয়া আয়।’
ছগির চলে যায়। কিছুক্ষণ পরই ফিরে এসে বলে- সরকারি লোকজন মাপামাপি করতাছে। এই নদীর উপর নাকি পাকা সেতু অইবো। চরকমলের উপর দিয়া পাকা রাস্তা করা অইবো। মধুপুর থেইক্যা নীলগঞ্জ পর্যন্ত গাড়ি চলবো।
মোক্তার মাঝি কাজেমের দিকে তাকায়। চোখে-মুখে স্পষ্ট হতাশা।
তাইলে তো পাগলা হাছা কতাই কইছে। এইহান থেইক্যা আমগো ভাত উডলো, বাপ-দাদার পেশা এহন ছাইড়া দিতে অইবো।
রহম আলী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল- কাজেম ভাই, যুদ্ধে জিইতাও আমগো কোনো লাভ অইলো না।
কাজেম মাঝি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন- তোমরা এমন কইরা ভাবতাছো ক্যান? এই খবর তো কয়েক মাস আগে থেইক্যাই শোনা যাইতেছিলো। পাকা সেতু অইলে আমগো লইগাই ভালো অইবো। এলাকার উন্নয়ন অইবো। চিরদিন কী মানুষ এক পেশা ধইরা রাখতে পারে? এই ঘাট ছাড়া উজানগাঙে আর নাও চলবো না?
, বুঝছি। আমগো কাল হয়তো এমনেই কাইটা যাইবো। পোলাপানগুলারে এহন থেইক্যাই অন্য পেশায় নিয়া যাইতে অইবো। ছগির বলল।
সবাইরেই একসময় না একসময় নিজের জায়গাডা ছাইড়া দিতে অয়। এইডা তো সময়ের চাওয়া, যত তাড়াতাড়ি মাইনা নেওন যাইবো ততই ভালো। সবার উদ্দেশ্যে কাজেম মাঝি বললেন।
মাঝিরা বটতলায় গিয়ে বসে। কাজেম মাঝি জোয়ারে ভরপুর উজানগাঙের দিকে তাকিয়ে থাকেন। শেষ বিকেলের অস্তগামী আলোয় বিগত দিনের সুখ-দুখের সাথী অতিচেনা নদীটা এখনো তাকে অনেক টানে। মনে মনে ভাবেন- এই উজানগাঙ, এই কলাবতী ঘাট তাকে অনেক দিয়েছে। এই ঘাটের মায়া তিনি কোনোকালেই কাটাতে পারবেন না। ঘাটের মাঝিদের সান্ত¡না দিলেও নিজের মনের মধ্যে কোথায় যেন একটা বিষাদের হাহাকার শুনতে পান।





 

সকালে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। শরতের শেষ বিকেলে ঝকঝকে নীল আকাশে সাদা মেঘগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে এখন; পেঁজো তুলার মতো। বাবার দোকানে বসে আছে অয়ন। বার বার ফিরে তাকাচ্ছে শ্যামলপুর থেকে নদীর পাড় ধরে ছুটে আসা সরু রাস্তাটির দিকে। যেন কারো জন্য উদগ্রীব প্রতীক্ষা! মুক্তনগরের অনেক গল্প জমে আছে মনে। সুবল আর মিরাজকে বলার জন্য ছটফট করে অয়ন।
অয়ন চুপচাপ কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে এসে দাঁড়ায়। দুই নদীর মোহনার দিকে তাকাতেই দূরে দিগন্তরেখায় ওপারের গ্রামখানির একটি ধূ ধূ ছবি ভেসে ওঠে কেবল। ওদিকে কখনো যায়নি অয়ন। বাবার মুখে শুনেছে বড় নদীর ওপারে অনেক লম্বা একটা চর আছে। সে চরে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি এসে বসে। অয়নের খুব যেতে ইচ্ছে করছিলো ওখানে। মন্টু মামা বলেছে, একদিন নিয়ে যাবে। হঠাৎ শ্যামলপুরের দিকে ঘুরে তাকাতেই মুখে হাসি ফোটে অয়নের। নদীপাড়ের সরু রাস্তায় ছোট্ট দু’টি অবয়ব চোখে পড়ে। দ্রুত এগিয়ে আসছে এদিকে। অয়ন বাবার দোকানের চত্বর ছেড়ে নিচের রাস্তায় নেমে দাঁড়ায়। ওরা কাছাকাছি আসতেই তিনজনে ছোটে নদীর মোহনার দিকে। বটতলার হাট আর নদীর ঘাট ছাড়িয়ে বেড়িবাঁধ ধরে ছুটে চলে ওরা।
তুই কোনোদিন ঠোডায় গেছিলি অয়ন? ছুটতে ছুটতেই জিজ্ঞেস করে সুবল।
না-রে! আমি একবার মন্টু মামার লগে এই নদীর পাড়ে বাইদ্যার নাও দ্যাখতে আইছিলাম।
আমি ছালাম দাদার লগে কয়েকবার গ্যাছি। বাব্বাহ! কী বড় নদী! মিরাজ বলে। 
মন্টু মামা কইছে, আমারে একদিন ঐ পাড়ে নিয়া যাইবো।
সুবল সাথে সাথে বলে- অনু, তহন আমগোও নিয়া যাইস।
আইচ্ছা।
বড় নদীর মোহনায় এসে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে অয়ন। এতদিন ওর কাছে বাজারের পাশের নদীটাকেই মনে হতো অনেক বড়। আজ এই মূল উজানগাঙের পাড়ে এসে মনে হয় এই নদীর কাছে ওটা তো কিছুই না। এপারে দাঁড়িয়ে ওপারের গ্রামটাকে ঝাপসামত চোখে পড়ে। কী বড় বড় ঢেউ আর    শো-শো শব্দ! অনেক উঁচু একেকটা ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে তীরে। মাঝ নদীতে ছোট ছোট ডিঙি নৌকাগুলো দুলছে ঢেউয়ের তোড়ে। অয়ন সুবলের হাত শক্ত করে ধরে বলে,
দ্যাখ দ্যাখ, নাওডা ক্যামন দুলতাছে। একবার ঢেউয়ের মধ্যে তলাইয়া যায় আবার ভাইসা ওডে। ঐ নৌকার মানুষগো ডর লাগে না?
মনে অয় হেগো ডর লাগে না।
আমি কোনোদিন এই নদী পার হমু না।
মিরাজ হাসে। কিছুক্ষণ পর বলে,
অনু, তুই এত ডরাস ক্যান? নদীতে তো ঢেউ থাকবোই, এত ডরাইতে অয়? দ্যাখ, নাওডা ঐ পাড়ের কাছে চইলা গ্যাছে।
নদীর পাড়ের নরম ঘাসের উপর বসে ওরা। অয়ন তাকিয়ে দেখে একঝাঁক পাখি নদীর উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে ওপারের খোলা চরের দিকে। ঐ পাড়ে অনেকটা ফাঁকা জায়গা। একটা লম্বা চর, তারপর দূরে গ্রামের গাছপালা চোখে পড়ছে অস্পষ্টভাবে। ওপারের গ্রামটির নাম চর-আচিলা। বাবা একবার বলেছিলÑ তার এক ফুপুর বাড়ি ঐ গ্রামে। বড়দি আর ছোটদি একবার নাকি গিয়েছিল। ছোটদি বলেছে অনেক দূর হাঁটতে হয়।
নদীর এপারে ভাঙনের চিহ্ন প্রবল। এপাশটা ভেঙেই ওপাড়ে গিয়ে উঠেছে। প্রতি বছরই নদী ভাঙে। কত বাড়িঘর নদীতে চলে যায়! আবার নতুন বসতি গড়ে নদীপাড়ের বাসিন্দারা।
একটা পালতোলা নৌকা এগিয়ে এসে ওদের কাছ দিয়ে চলে গেল। দু’জন মাত্র মানুষ নৌকায়। দুই নদীর মিলনস্থল ছাড়িয়ে আরও দূরে দৃষ্টি যায় অয়নের। ওদিকে মাছ ধরার নৌকাগুলোয় জেলেরা ঢেউয়ের মধ্যে দুলতে দুলতেই জাল ফেলছে নদীতে। শেষ বিকেলের আলো ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসছে। একটু পরই সন্ধ্যা নেমে যাবে। তেজস্বী সূর্যটা শেষ বেলায় আত্মসমর্পন করবে দিগন্তরেখার কাছে। তখন গোধূলির লাল আভাটা ছড়িয়ে পড়বে নদীর পানিতে, ধীরে ধীরে বদলে যাবে নদীর রঙ। অয়ন বলে, এইবার বাড়ি ফিরা যাওন দরকার।
নদীর মোহনা ছেড়ে বেড়িবাঁধ ধরে বাজারের দিকে এগিয়ে চলে তিনজনে। বটতলার ঘাটের কাছাকাছি আসতেই মেঘের আড়ালে ঢেকে যায় দিন শেষের টকটকে লাল সূর্য। ধূসর আবছায়ায় হারিয়ে যায় অয়নের প্রিয় গোধূলির লালিমাটা। এমন সন্ধ্যাগুলো সবসময় অয়নের মন বিষণœ করে দেয়। ওরা বাজারের দিকে ছুটে চলে। পেছনে ক্রমশ এগিয়ে আসে অন্ধকারের দেয়াল।
সন্ধ্যার পর সাত্তার মাস্টারের দোকানের সামনের ছোট্ট চত্বরটা সরগরম হয়ে ওঠে। অনেকদিন পর আজ দাবা খেলার আসর বসেছে। আবার হাসি-ঠাট্টায় মেতে উঠেছেন সাত্তার মাস্টার আর তার সঙ্গী-সাথীরা। খেলার সাথে সাথেই নানান আলোচনা চলছে। সাঈদ খান তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হো-হো করে হেসে উঠছেন মাঝে মধ্যেই। এমন প্রাণখোলা আড্ডার লোভ সামলাতে না পেরে দোকান ফেলে হরিপদও এসে যোগ দেন। হরিপদ’র দিকে তাকিয়ে সাঈদ খান বলে ওঠেন,
-অনেকদিন পর তোমারে হাসিখুশি দেইখ্যা খুব ভালো লাগতাছে হরি।
-বুঝলা, মনে আনন্দ থাকলে বাইরে তার প্রকাশ ঘটবোই। এতদিন কী অশান্তির মধ্যেই না দিন কাটাইছে হরি! দাবার চাল দিতে দিতে বললেন সাত্তার মাস্টার।
পায়ের নিচ থেইক্যা মাডি সইরা গ্যালে মনে আর শান্তি থাকে না খান! হরিপদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন।
এহন থেইক্যা কেউ আর এই গ্রামের শান্তি নষ্ট করনের সাহস পাইবো না।
হামিদ শেখের কথা শেষ হতেই জগানন্দ বলে ওঠে,
আমি ভাবতাছি, বুড়া সারমেয় দুইডা না আবার কামড়াকামড়ি শুরু কইরা দেয়।
জগানন্দের দিকে ঘুরে তাকালেন কাজেম মাঝি।
কী কামড়াকামড়ি করবো কইলা জগানন্দ?
বুঝো নাই? বুড়া কুত্তা। ইসমাইল মোল্লা বুঝিয়ে দিলেন।
তোমার এই কঠিন কঠিন কিতাবি কতা আমগো লগে কইতে মানা করছি না জগানন্দ?
মৃদু হেসে জগানন্দ বলে, -ভুল অইয়া গ্যাছে ওস্তাদ। মনে আছিল না তুমি এইহানে আছো।
কাজেম মাঝির সাথে জগানন্দের সম্পর্কটা কিছুটা অন্যরকম। সেই যুদ্ধের সময় থেকেই। দীর্ঘসময় ধরে একসাথে যুদ্ধক্ষেত্রে কাটানোর ফলে সেই সম্পর্কটা দিনে দিনে আরও দৃঢ় হয়ে উঠেছে। বয়সে ছোট হওয়ায় জগানন্দ কাজেম মাঝিকে যেমন সমীহ করে তেমনি কাজেম মাঝিও খুব স্নেহ করেন জগানন্দকে।
জগানন্দ একমাত্র কাজেম ছাড়া আর কাউরে মনে হয় এত ডরায় না, এমন কী বউরেও না।
ইসমাইল মোল্লার কথায় হেসে ওঠে সবাই।
ডরামু না! যুদ্ধের সময় কাজেম ভাইর কাছে কত যে বকা খাইছি! তখন থেক্যাই উনি আমার ওস্তাদ। গহীন রাইতে এই উজানগাঙে পাক বাহিনীগো নৌকা ডুবাইয়া দেওয়ার কতা মনে আছে ওস্তাদ?
মনে থাকবো না! হেইদিন কী যে শান্তি পাইছিলাম! আইজও হেই কতা মনে পড়লে গায়ের রক্ত গরম অইয়া ওডে।
সাত্তার মাস্টার দাবার বোর্ডে চোখ রেখেই বললেন- বুঝলা কাজেম, এইডাই আমগো অহংকার। এই প্রজন্মের কাছে এইসব গল্প করবা। ওরা আমগো জীবন থেইক্যা শিক্ষা নিবো। দেখবা ওরা কখনো পথভ্রষ্ট অইবো না।
শোন, এই সারমেয়-টারমেয়’র দিন শ্যাষ। এইগুলান যাতে আর মাথাচাড়া দিয়া না ওঠতে পারে হেই ব্যবস্থা নেওয়া অইবো। তয়, ওরা নিজেরা কামড়াকামড়ি কইরা যত মরবো, আমগো লইগ্যা ততই মঙ্গল। সাঈদ খান বলে উঠলেন।
এই হামিদ চাল দাও। হামিদ শেখের দিকে তাকিয়ে বলেন সাত্তার মাস্টার।
জগানন্দের ফাইন অইছে, ও আইজ আমগো সবাইরে খাওয়াইবো।
কাজেম মাঝির কথা শুনে হরিপদও বলে উঠলেন,
ভাইবো না কাজেম, জগানন্দের অইয়া আইজ আমি খাওয়াইতাছি।
হরিপদর গোপালকে ডাকলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই কলাবতী মিষ্টান্ন ভা-ার থেকে আসা লোভনীয় খাবারের স্বাদ নিতে নিতে সবাই ভুলে যায় এমন আনন্দের উপলক্ষ তারা কতদিন পায়নি!












দুশ্চিন্তা আর অনিশ্চয়তার যে ভারী পাথর চেপে বসেছিল ঘোষবাড়ির সদস্যদের বুকে, এখন তার লেশমাত্র নেই। সুরবালার মনে কোনো সম্ভাবনার খেয়াল না এলেও বিজয়ার মনে একটা আশার বাতি টিমটিম করে জ্বলছিলো এতোদিন। তার কেবলই মনে হতোÑ এই অসময় থাকবে না। অন্ধকার কেটে গিয়ে আলোর রেখা দেখা দেবেই। আজ যখন তাদের চারপাশ থেকে ঘোর অন্ধকারের নির্মম দেয়ালটা সরে গেল, বিজয়া যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
ভাদ্র মাস শেষ হতে চলল, এখনো আকাশ ঝরে। যখন তখন বাতাস ছাড়ে। দৈত্যের মতো কালো মেঘগুলো উড়ে বেড়ায় আর গ্রাস করে নেয় মাথার উপরের নীল শামিয়ানাটাকে। ক্ষিপ্ত সিংহের গর্জনে মেতে ওঠে থেমে থেমেই, তারপর একদম আকাশ ভেঙে নামে। বাড়ির পাশের জমিগুলো সব পানিতে একাকার হয়ে যায়।
গ্রামের পথঘাট থকথকে কাদায় পরিপূর্ণ। বাইরে বেরুনোর কষ্টসাধ্য কাজটা আজ আর করতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না শ্যামলের। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পর ঘর থেকে বেরিয়ে দখিন-দ্বারের দিকে এগিয়ে যায়। দখিন-দ্বারের রেইন্ট্রিতলায় বাঁশের মাচার উপর বিজয়া আর চারুর সাথে গল্পে মশগুল শিখা। ওদের পাশ দিয়ে হেঁটে বাড়ির প্রান্তঘেঁষে কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়ায় শ্যামল। বিজয়া শিখার ভেতরে একটা আড়ষ্টতা লক্ষ করে মুচকি হেসে বাড়ির ভিতরে চলে যায়।
শিখা বসেছিল পূর্ব-পার্শে¦র খোলা জমির দিকে মুখ করে। সামনে বহুদূর পর্যন্ত ডুবন্ত জমিতে থৈ-থৈ পানি। ভরা নদীর মতো। অনেক দূরের গাছপালাগুলো যেন স্থির তটরেখা। শিল্পীর ক্যানভাসে আঁকা বিমূর্ত ছবির মতো। হালকা বাতাসে ছোট ছোট ঢেউ এসে মিশে যাচ্ছে পাড়ে। শ্যামল পেছনে এসে দাঁড়ায়। শিখা বুঝেও ফিরে তাকায় না। শ্যামল মৃদু কাশি দেয়। শিখা মনে মনে হাসে কিন্তু শ্যামলের দিকে ঘুরে তাকায় না। শ্যামল বলে,
কেউ মনে হয় চায় না আমি এইহানে বসি।
এবার ঘুরে তাকায় শিখা।
কিরে, ওদিকে কী দ্যাখতেছিলি?
কিছু না। এমনিই বইসা আছিলাম। তুমি আইসা সবাইরে ভাগাইয়া দিলা ক্যান?
কই? আমি তো কাউরে কিছু কই নাই।
কওন লাগে? তোমারে দেইখ্যাই তো কাকী, চারু চইলা গ্যালো। ওরা কী মনে করলো?
আমগো বাড়িতে কাকীই সবচাইতে বুদ্ধিমতী। তুই বুঝোস নাই, হেয় ইচ্ছা কইরাই আমগো সুযোগ দিল।
তুমি এহনই এইদিকে না আইলে কী অইতো? আমার বুঝি লজ্জা লাগে না?
শ্যামল মুখটিপে হাসে। ‘এহ! আবার লজ্জা লাগে। তাইলে কয়দিন পর যে বাড়িতে বউ হইয়া আইবি, হেই বাড়িতে যহন তহন ঘুরঘুর করস ক্যান?’
কেডা কইছে আমি এই বাড়িতে বউ হইয়া আমু?
ক্যান তুই কিছু জানোস না? আমগো বাড়ির গাছপালা-পশুপাখিও তো জানে। শ্যামলের চোখে-মুখে দুষ্টুমি।
কচু জানে।
শিখা মাটির দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে।
খাঁচায় বন্দী পাখিরা কী এমন কইরা হাসে?
বন্দী অবস্থা থেইক্যা মুক্তির স্বাদ পাইলে পাখির আর দুঃখ কী?
কেডা তোরে মুক্তি দিলো?
তুমি নিজেই তো দেখি কিছু জানোনা। এইবার তোমারে বন্দী করনের ব্যবস্থা অইতাছে।
শ্যামল হেসে জিজ্ঞেস করে- কেডা বন্দী করবো রে আমারে?
কাকাবাবু।
তাইলে তো সবই জানোস। ভাবখানা এমন যেন কিছুই বুঝোস না।
তুমি কবে ঢাকা যাইবা?
যামু না তো। আমিতো তোরে নিয়া উজানগাঙে নাও ভাসামু।
তোমার দেহি তর সহ্য অইতাছে না।
উহু। এহন অনুমতি পাইয়া গ্যাছি, আর ডর কীসের?
শিখা আনমনে তাকিয়ে থাকে ভরা পানির দিকে। মনটা ছুটে যায় দূরে, পানিতে ছোট ছোট ঢেউয়ের সাথে নেচে ওঠে। ক’দিন আগেও শিখার আকাশে যে ঘন মেঘ ভিড় করেছিলো, ঝড়ো হাওয়ায় সবকিছু তছনছ হবার আভাস ছিল, আজ তা কেটে গিয়ে ঝলমলে রোদ উঠেছে। সে রোদের কোমল স্পর্শ গায়ে লাগতেই অদ্ভুত এক ভালোলাগা ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীরে।
শ্যামলের চোখে চোখ রাখে শিখা। সে চোখে কেবল আত্মবিশ্বাস আর নির্ভরতার ছায়া। এখন সে একেবারেই ভারমুক্ত।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উপন্যাসঃ ফেরা (পর্বঃ ২১ - ২৫ - শেষ পর্ব)

এ ই উপন্যাসটিতে সম্মুখ সমরের কোন ঘটনা তুলে ধরা হয়নি।  ওয়ারফ্রন্টের কোনও দৃশ্য নেই। তবে এই লেখায় মূলত যে গল্পটি বলার চেষ্টা ক রা হয়েছে  তা মু...