সবেমাত্র এইচ এস সি পরীক্ষা শেষ করেছি। অফুরন্ত অবসর। আর ক’দিন পর ভর্তি
কোচিং এ ব্যাস্ত হয়ে পড়তে হবে। তাই কোচিং এ ভর্তির আগে কিছুদিন বেড়ানোর
উদ্দেশ্যে বাড়িতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আমার এই বেড়ানোর সাথে বাবা
তাঁর কিছু কাজ আমার কাঁধে চাপিয়ে দিলেন। বাবার সেই বিশেষ কাজে আমাকে
পটুয়াখালী যেতে হয়েছিল । অনেক দিন পর ওখানে গেলাম ! একটা সময় বাবার চাকুরীর
সুবাদে কয়েকটা বছর আমাদের ওখানে থাকতে হয়েছিল। ছোট্ট শহর, পরিষ্কার
পরিচ্ছন্ন, ছিমছাম। তখন ছিল, এখন চেহারা বদলে গেছে অনেকটাই। পটুয়াখালীতে
আমার অনেক ভালো লাগা স্মৃতি আছে, যেগুলো মনে পড়লে প্রায়শঃই নস্টালজিক হয়ে
যাই। মনে আছে শহর ঘেঁসে দক্ষিণ পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট্ট নদীটা, নামটা ঠিক
মনে নেই কিন্তু ভাল লাগা রয়ে গেছে এখনও।
সেদিনের মত বাবার অফিসের প্রয়োজনীয় কাজগুলো শেষ করে বিকালে ঘুরতে বেড়িয়েছি,
স্মৃতি জাগানিয়া স্থানগুলো দেখব বলে। নদীর পাড়ে যেতেই হঠাৎ মনে পড়ল আজিম
স্যারের কথা ! কি যে আদর করত আমায় ! ছেলেবেলায় ছাত্র হিসেবে খারাপ ছিলাম
না, তাই অনেক শিক্ষকদেরই প্রিয় ছিলাম। তেমনি একজন শিক্ষক ছিলেন আজিম স্যার।
হালকা পাতলা গড়নের খুব হাসিখুশি মানুষ। মনে পড়ে ওখানে থাকতে স্যারের
বাড়িতে যাওয়া হত মাঝে মাঝেই। স্যারের বাড়িটা ছিল এই নদীটির ও পাড়ে, নদী পার
হয়ে যেতে হত। মনে আছে, নৌকা দিয়ে পার হয়ে যেতাম। হঠাত মনে হল- এত কাছেই
যখন এলাম, যাই স্যারের সাথে দেখা করে আসি!
অনেকক্ষণ ঘুরে খুঁজে পেলাম স্যারের বাড়িটা। অনেক বছর আগে দেখা বাড়িটাও এখন
আর আগের মত নেই। আশে পাশে নতুন নতুন বাড়িঘর উঠে এলাকার চিত্র বদলে দিয়েছে
বেশ!
ভিতরে ঢুকে মনে হল কেমন জানি নীরব। উঠানে এসে অনেকক্ষণ দাঁড়ানোর পর দশ-এগারো বছরের একটি ছেলে এসে জানতে চাইল
-কার দারে আইছেন ?
-এটা আজিম স্যারের বাড়ি না !
ছেলেটি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়তেই আমি বললাম – স্যার কি আছেন ?
-জে আছে, আফনে আয়েন
আমি ভিতরে গেলাম। ভেতরে ঢুকে মোটামোটি একটা ধাক্কা খেলাম। অনেক পুরানো
ধাঁচের একটা খাটের উপর শীর্ণ দেহী যে মানুষটি শুয়ে আছে তাঁকে আমি কিছুতেই
সেই ছেলেবেলায় দেখা আজিম স্যারের সাথে মেলাতে পারলাম না ! স্যার আমাকে
চিনতে পারলেন না, অবশ্য চেনার কথাও না! কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে
থেকে জিজ্ঞেস করলেন- আফনে কেডা বাবা !
আমি আমার নাম বলে জানালাম এক সময় আমি তার ছাত্র ছিলাম। উনি কিছুক্ষণ চুপ
করে থাকলেন, মনে হল স্মৃতি হাতড়ে চেনার চেষ্টা করলেন ! কিন্তু চিনতে পারলেন
কিনা বোঝা গেল না !
ছেলেটার সাথে কথা বলে জানতে পারলাম -প্রায় এক বছর ধরে স্যার প্যারালাইসড
হয়ে বিছানায়। চিকিৎসা প্রায় হচ্ছেই না ! পেনশনের টাকায় কোন রকম জীবন চলছে।
আমার কাছে তেমন টাকা পয়সা ছিল না দেখে খুব আফসোস হচ্ছিল, তখনো ছাত্র, কিই
বা করার ছিল আমার! আমার যতটুকু মনে পড়ে তাঁর দুই ছেলে ছিল, দু’জনই আমার
থেকে বেশ বড় ছিল। জানা গেল তারা দুজনই এই শহরেই ছোট খাট চাকুরী করে যা আয়
করে তা দিয়ে নিজেরা কোন রকম জীবন যাপন করে। বাবার চিকিৎসার সামর্থ্য তাদের
নেই! কিছু করতে না পারার কষ্ট নিয়ে আমি ফিরে আসি।
ঢাকায় ফিরে কোচিং এ এমন ব্যস্ত হয়ে পড়ি যে কয়েক মাস কোন সুযোগ মেলেনি
নড়বার। বেশ কিছু সময় অতিক্রান্ত হবার পর বাবার অফিসের অসমাপ্ত কাজটা শেষ
করার জন্যে আবার আমাকে ওখানে যেতে হল। এবার অবশ্য আমি বেশ খুশি মনে রাজি
হয়ে গেলাম আর সেই সাথে নিজের কিছু সম্বল আর বন্ধুদের কাছ থেকে কিছু সাহায্য
নিয়ে ফিরে চললাম স্যারের জন্যে কিছু করার উদ্দেশ্যে।
দুপুরের মধ্যে বাবার অফিসের কাজ শেষ হয়ে গেলে স্যারের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা
হলাম। স্যারের বাড়িতে পৌছে দেখলাম আগের সেই নীরবতা। কিছুক্ষণ ডাকা ডাকি
করে কাউকে না পেয়ে বের হয়ে আসলাম। অনেকক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করার পর অল্প
বয়সী একটা ছেলে দেখে ডেকে জিজ্ঞেস করতেই জানলাম-স্যার আর নেই ! মাস খানেক
আগেই চলে গেছেন ! মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল, দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আমি
ফিরে আসার পথ ধরি।
আমি বসে আছি লঞ্চের বারান্দায়, আমার সামনে শুধু পানি আর পানি, আকাশে পূর্ণ
চাঁদের জোছনা, নদীর বুকে চাঁদের ছায়া পড়ে চিক চিক করছে। কোন কিছুই আমার
মনকে আন্দোলিত করতে পারে না। ছেলেবেলায় স্যারের সাথে কাটানো দিনগুলির কথা
খুব মনে পড়ছে। আরও মনে পড়ছে যেদিন আমরা ওখান থেকে একেবারে চলে আসলাম, আমার
মাথায় হাত বুলিয়ে স্যার বলেছিলেন- তুমি একদিন অনেক বড় হবে ! আরও কত কি মনে
পড়ে ! স্যারের গানের গলা বেশ ভাল ছিল, স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে
তিনিই ছিলেন সবার মধ্যমণি !
সবাই চলে যাবে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু একজন মানুষ গড়ার কারিগর এভাবে বিনা
চিকিৎসায় মারা যাবেন এটা মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়েছিল। বিশেষ করে আজিম
স্যারের মত একজন আলোকিত মানুষ !
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন