শনিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

গল্পঃ নিঃসঙ্গ অশ্বারোহী


বাবাকে খুঁজতে খুঁজতে বড় পুকুরের দিকে এগিয়ে গেলাম। বাবা ঘাটের সিঁড়িতেই বসে ছিলেন। পুকুরের শান্ত জলে ভাসমান সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে লাল শাপলা ফুলগুলোতেই যেন নিবদ্ধ ছিল তাঁর দৃষ্টি। ক্র্যাচটা পাশেই রাখা ছিল। আমি তাঁর অলক্ষ্যে নিঃশব্দে পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাবা তন্ময় হয়ে তাকিয়ে ছিলেন সামনের দিকে। পুকুরের পাড়ে পানির দিকে হেলে পড়া হিজলের ডাল থেকে মাছরাঙাটা ঝুপ করে ডুব দিলো জলে, একটু পরই উঠে গিয়ে আবার বসলো গাছের ডালে। দুই ঠোঁটের মাঝে ছটফট করা ছোট্ট মাছটি তখন রোদে চিকচিক করছিল। বাবা মিটিমিটি হাসছিলেন আর বিড়বিড় করে বলছিলেন, কি অসাধারণ নৈপুণ্য!
-কি দেখছ বাবা? আমার কণ্ঠ শুনে ঘুরে তাকালেন। হাসিমুখে বললেন,
-তুই কখন এলি?
-এই তো এখনই এলাম। বাবা, একা একা হাসছ কেন?
-দেখলি, এতটুকুন একটা পাখি অথচ কি নিখুঁত তার নিশানা। কেমন চিলের মতন ছো মেরে ডুব দিয়ে মাছটা তুলে নিলো!
-বাবা, এটাই তো ওর কাজ। জন্মের পর থেকে ওরা এভাবেই ট্রেনিঙ পায়।
-ট্রেনিঙ তো অনেকেই পায়, সবাই কি ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারে?
বাবা হঠাৎ চুপ হয়ে গেলেন। একটু আগের হাসিখুশি ভাবটা নিমিষেই যেন মিলিয়ে গেল। তাঁর এই রূপটা আমার খুব চেনা। শুধু আমার নয়, আমাদের ভাই-বোনদের সবারই চেনা।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, পারে না। এই আমি কি পেরেছি?
বাবা এমনই। যে কোন বিষয়ে নিজের ব্যার্থতাকে সামনে নিয়ে আসেন। বাবার মুখে মুক্তিযুদ্ধে ব্যর্থতার কথা কতবার শুনেছি! এ নিয়ে তাঁর আক্ষেপের শেষ নেই। যেন যুদ্ধে আহত হওয়াটা তার অপরাধ।

বাবা খুব চাপা স্বভাবের মানুষ। ছেলেবেলা থেকে দেখছি একমাত্র মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া নিজের আর কোন কষ্টের কথা কারো সাথে শেয়ার করতেন না। মন খারাপ থাকলে এই ঘাটে এসে বসেন।
যুদ্ধ-মৃত্যু-নিষ্ঠুরতা- একেবারে ছেলেবেলা থেকেই বাবার মুখে শুনে শুনে এসব শব্দের অর্থ জানা হয়ে গিয়েছিলো আমাদের। একাত্তরে সাড়া বাঙলা জুড়ে যে তাণ্ডব চলেছিল, ছেলেবেলা থেকেই বাবার মুখে সেই গম্প শুনে আমাদের তিন ভাই বোনের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চিত্রটা অনেক পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিলো। আর শুনতাম একজন বিশাল মনের মানুষের কথা। তার ত্যাগের কথা। ৭ই মার্চ আসলেই বাবা খুব অস্থির হয়ে যেতেন। তাঁর মুখে প্রায়ই শোনা যেত-
রাজপথের জনস্রোত-মিছিল-স্লোগানের কথা,
রাইফেল-গুলি-আগুন-ধ্বংসজজ্ঞের ইতিহাস।
সেই প্রবাদ পুরুষের স্বাধীনতার অমর বানী।
অতঃপর ঢাকা থেকে তাঁর পলায়ন-ট্রেনিঙ- প্রতিরোধ গড়ে তোলার ইতিহাস।
আর, সবশেষে তার স্বপ্নভঙ্গের স্মৃতি। অসম্পুর্ণ শরীর নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসা। গৃহকোণে এই নিঃসঙ্গ জীবন।

বাবা তাঁর পায়ের হাঁটুতে হাত রাখলেন। চার দশক ধরে বয়ে চলা এই অসম্পুর্ণ পা’টা তাঁকে খুব কষ্ট দেয়।  বাবার কাঁধে হাত রেখে বললাম,
-বাবা, তোমাকে না বলেছি এই বিষয়টা নিয়ে আর মন খারাপ করবে না। তুমিই তো আমাদের বলেছ- যুদ্ধে কত মানুষ তাদের সর্বস্ব হারিয়েছে। একবার ভাবো তাদের মনের অবস্থা। তোমার কাছে তো আমরা আছি। এখন তোমার আর দুঃখ কি?
বাবা তাঁর সহজ সরল হাসিতে আমার দিকে তাকালেন।
-ঠিক আছে, আর মন খারাপ করবো না। আজ কত তারিখ রে?
-৫ই আগষ্ট।
-ও। তুই ঢাকা যাবি কবে?
-দু-একদিনের মধ্যেই যেতে হবে। ভার্সিটি খুলেছে।
-আমি কতবার ঢাকা যেতে চাইলাম, মাইনুলকে বললাম, নিলো না। তুই একবার আমাকে নিবি?
-তুমি ঢাকা গিয়ে কি করবে বাবা?
-সেই কত বছর আগে ফিরে আসলাম! আর যাওয়া হয়নি। একবার দেখতে ইচ্ছে করে এই সময়ের ঢাকাকে।
-ঠিক আছে, আগামীবার এসে তোমাকে নিয়ে যাব।
-আচ্ছা, ৩২ নম্বর বাড়িটাতে তুই কি কখনও গিয়েছিস?
-হ্যাঁ, গিয়েছিলাম কয়েকবার। ওটা তো এখন বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর।
-আমার একবার যাওয়ার খুব ইচ্ছে।
-আচ্ছা, তোমাকে একবার নিয়ে যাব আমি। সন্ধ্যা হয়ে এলো, এখন ঘরে চল।
-তুই যা বাবা, আমি একটু পরে আসছি।
আমি জানি, বাবা এখন কেবল বঙ্গবন্ধু আর আগষ্ট মাস নিয়ে ভাববেন।

তিন মাস পর...
বাবাকে নিয়ে গেলাম সেই ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর বাড়িটিতে। দর্শনার্থীরা বাড়ির ভিতরে আসছে-যাচ্ছে। বাবা আর আমি দাঁড়িয়ে আছি অগ্নিপুরুষের প্রতিকৃতির সামনে। বাবার কাছে যিনি মহান আদর্শের প্রতীক। ক্র্যাচের উপর ভর করে বাবা তাকিয়ে আছেন বঙ্গবন্ধুর ছবির দিকে। অনেকক্ষণ এভাবেই কেটে গেল। হঠাৎ বাবা ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-জানিস, এই লোকটা না থাকলে তুই আজ স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক বলে নিজেকে দাবী করতে পারতি না। সারা জীবন যে লোকটা এ জাতির মুক্তির জন্য জেল-জুলুম সহ্য করে দেশটাকে স্বাধীন করলো, তাঁকে কিভাবে হত্যা করলো জালিমরা, বলতে পারিস?
আমি বাবার কথার উত্তর দিতে পারিনি। আসলে এ কথার কোন উত্তর আমার জানা নেই। বলতে গেলে আমার নিজের ভিতরেও এই প্রশ্নটা বার বার ঘুরে ফিরে আসে। বাবাই আবার বলে চললেন,
-৭ই মার্চ এই লোকটার সে-ই ভাষণ আমি কোনদিন ভুলতে পারিনি। প্রতিটা বাঙালির মনে স্বাধীনতার বীজ বপন করে দিয়েছিলো সে ভাষণ। আমার এই পঙ্গু জীবনটা নিয়ে যতটা আক্ষেপ তাঁর চেয়ে অনেক বেশী আক্ষেপ বঙ্গবন্ধুর হত্যা নিয়ে।
বাবার ডায়রীতে মুক্তিযুদ্ধের তাঁর অনেক স্মৃতিকথা লেখা আছে। আমাদের সব ভাই-বোনের কয়েকবার করে সেই লেখা পড়া হয়ে গেছে। বড় ভাইয়া খুব যত্ন করে ডায়রিটা রেখে দিয়েছে। ওখানে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ নিয়ে অনেক কথা লেখা আছে। একটা কবিতাও আছে। বঙ্গবন্ধুর ছবির দিকে বাবার তাকিয়ে থাকা দেখে সেই কবিতাটা আজ মনে পড়ে গেল-
 
মাত্র একটি চাওয়া- মাতৃভূমির মুক্তি;
জনতার ঢল ছুটে আসে রেসকোর্সে,
ঘর্মাক্ত শরীরগুলো সব; মুষ্টিবদ্ধ হাত ওঠে-নামে,
বয়সের ব্যবধান নাই কোন, ছেলে-বুড়ো-যুবা,
মিছিলে-মিছিলে ভরে গেছে রাজপথ,
তারপর সবকিছু এসে থেমে গেছে
একটি জনস্রোতে; অগনিত কণ্ঠের ধ্বনি-
কিছু স্লোগান; অধীর প্রতীক্ষা, কখন আসবেন কবি,
কখন শোনাবেন তাঁর বাণী?
কবি আসলেন, শোনালেন তাঁর সেই অমর বানীটি
গর্জে ওঠা বজ্রকণ্ঠে- একটি আহ্বান,
কবি’র কণ্ঠে উচ্চারিত হয় একটি অমর কবিতা-
“এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”।

বাবার কণ্ঠ শুনে আমার ঘোর কেটে গেল। ‘এ বঙ্গভূমে মীর জাফরেরা বার বার জন্মায়, বার বার তারা এ জাতির ইতিহাসে কলঙ্ক লেপন করে’। আমি বাবার অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। তারপর বললাম- চল ভিতরে যাই...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উপন্যাসঃ ফেরা (পর্বঃ ২১ - ২৫ - শেষ পর্ব)

এ ই উপন্যাসটিতে সম্মুখ সমরের কোন ঘটনা তুলে ধরা হয়নি।  ওয়ারফ্রন্টের কোনও দৃশ্য নেই। তবে এই লেখায় মূলত যে গল্পটি বলার চেষ্টা ক রা হয়েছে  তা মু...