সেই
ছেলেবেলায়, প্রাইমারীর গণ্ডি শেষ করেছি কি করিনি ঠিক মনে পড়ছে না। প্রতিদিন দুপুরে
বাসার সবারই নিয়ম করে ঘুমানোর আদেশ ছিল, আমার কখনই দুপুরে ঘুম হত না। মন উদাস করা
গ্রীষ্মের সেই দুপুরে একা একা ঘরের কোণে বসে ‘আরব্য রজনীর দেশে’ নামক
একটি বই পড়ছিলাম। সেই-ই প্রথম শুরু পাঠ্য বইয়ের বাইরে বই পড়া। মামা ঘুম থেকে উঠে
বইটা হাতে দেখে বলে উঠল-এখনই উপন্যাস পড়া শুরু করেছো! কণ্ঠে অনেকটা তাচ্ছিল্যের
সুর। আমি বুঝতে পারিনি কি এমন ভুল করলাম, মনে মনে ভাবছিলাম-এটা
পড়া কি নিষেধ নাকি!
ধীরে
ধীরে মাথার ভিতরে সেই যে বইয়ের পোকা ঢুকে পড়ে আর বের হয় না। ছেলেবেলায় আমি একটু
ঘরকুনো টাইপের ছিলাম। গ্রাম থেকে চলে আসার পর শহরটাকে নিজের করতে বেশ কিছুটা সময়
পার হয়ে গিয়েছিল। তারপর শুরু হল নতুন স্কুল জীবন। নতুন বন্ধু, নতুন জগৎ! একসময় বন্ধুদের
কল্যাণে পেয়ে গেলাম বিশাল বইয়ের খনি! ‘সেবা প্রকাশনী’
আমার সামনে উন্মোচিত করে দিল এক নতুন দিগন্ত! শুরু হল আমার নতুন
অভিযান, অসাধারণ এক এডভেঞ্চার!
মামা
লেখাপড়া ছাড়া যেন আর কিছুই বুঝতেন না এবং তার দৃষ্টিতে লেখাপড়া বলতে শুধুই
পাঠ্যপুস্তক। তাই বলে কি গল্পের বই পড়া আটকে থাকে! শুরু হল গল্পের বই পড়া নিয়ে
মামা ভাগ্নের অদ্ভুত লুকোচুরি খেলা। পড়ার টেবিলের নিচেই তৈরি করে নিলাম এক
গুপ্তকুঠুরি, যেটা
ছিল আমার বইয়ের ভান্ডার। ওখানে লুকিয়ে রাখা হত বন্ধুদের কাছ থেকে আনা বইগুলো।
কত
যে বই পড়েছি তার হিসেব নেই। পারলে প্রতিদিনই একটা করে পড়তাম, নিত্য নতুন বই, ভিন্ন স্বাদ! স্কুলেই অনেকটা শেষ
করে ফেলতাম, তারপর বাসায় এসে ক্লাসের পড়া দ্রুত শেষ করেই
শুরু হয়ে যেত আমার এডভেঞ্চার! সে সময় কোন প্রাইভেট টিভি চ্যানেল ছিল না। বিটিভি’তে অনেক ভাল ভাল নাটক হত- বৃহস্পতিবারে সাপ্তাহিক নাটক, মঙ্গলবারে ধারাবাহিক নাটক, চমৎকার সব
ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, মুভি অফ দ্যা উইক এ অনেক ভাল ভাল ইংরেজী
ছবি দেখানো হত। বেশির ভাগই দেখা হত না আমার। তখন পড়ার সময়, অতএব রুমে বন্দী। মামার রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে টিভি দেখার উপায়ও ছিল
না! প্রথম প্রথম মন খারাপ হত, তবে আমার এডভেঞ্চারের খনি ভুলিয়ে দিত সব মনকষ্ট।
মামা অন্য পাশ থেকে দরজা বন্ধ করার সাথে সাথেই আমার রুমের ভিতর দিক থেকেও উঠে যেত অরেকটা
ছিটকিনি। ব্যাস! তখন আমাকে আর পায় কে? আমার গুপ্তকুঠুরির
দ্বার খুলে যেত। সবাই যখন নাটক কিংবা অন্য টিভি প্রোগ্রাম দেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়ত
আমি তখন চলে যেতাম অন্য ভুবনে! বিচিত্র এক জগতে। যেখানে আমাকে বাধা দেয়ার জন্য ছিল
না কেউ। ভিতর থেকে শব্দ পাওয়ার সাথে সাথেই গল্পের বই আবার চালান হয়ে যেত গুপ্ত কুঠুরিতে!
মনে
আছে প্রথম সেবা প্রকাশনীর যে বইটা দিয়ে পড়া শুরু করেছিলাম সেটা ছিল তিন গোয়েন্দা
সিরিজের একটি বই, নামটি সম্ভবত- রক্তচক্ষু। তারপর একে একে নতুন পুরাতন কোন বইই বাকি
রাখিনি। সেই রোমাঞ্চকর গোয়েন্দা অভিযানের কাহিনীগুলোতে যে কি পরিমাণ আসক্তি ছিল!
কিশোর, মুসা, রবিনকে তখন মনে হত আইডল
আর রকিব হাসানকে মনে হত সেরা লেখক। সেই দিনগুলোর কথা মনে হলে এখনো অনেক মজা পাই!
আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া অর্থের পুরাটাই ব্যয় হত বই কেনার
পিছনে। বাসায় না জানিয়ে, টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে বই কিনতাম। পরীক্ষার আগের রাতেও
লুকিয়ে লুকিয়ে কতদিন বই পড়েছি!
কখনো
বন্ধুদের কাছ থেকে নিয়ে, কখনো ভাড়া করে এনে পড়তাম। আর কোনভাবে যদি কিছু টাকা হাতে আসতো তার
বেশির ভাগই ব্যয় হত বই কেনায়। এগুলো বিনিময় করে আরও অনেক বই পড়া হয়ে যেত। অনেক সময়
বন্ধুরা মিলে বুদ্ধি করে কিনতাম, দশজন মিলে দশটা বই কিনলে
পালা করে সবগুলোই সবার পড়া হয়ে যেত।
তিন
গোয়েন্দা প্রায় সব বইই পড়া হয়ে গিয়েছিল,
তারপর ধীরে ধীরে হাতে আসতে থাকল অন্যান্য কিশোর ক্লাসিক ও
বিশ্বের নামী দামী লেখকের অসামান্য সব বইয়ের অনুবাদ। দুঃসাহসী টম সয়্যার, এডভেঞ্চার অফ হাকলবেরী ফিন, জুল ভার্নের বিভিন্ন
সিরিজ, যেমন- দ্য মিস্ট্রিয়াস আইল্যান্ড, মাস্টার অব দি ওয়ার্ল্ড, এরাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড
ইন এইটি ডেজ, টুয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্যা সী এর মত
বইগুলো কি চুম্বকের মত টানত!
আর্নেস্ট
হেমিংওয়ের দ্য ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্যা সি এবং আ ফেয়ারয়েল টু আর্মস, রবার্ট লুই স্টিভেনসনের
কিডন্যাপড, স্যার ওয়াল্টার স্কটের আইভানহো, তালিসমান, চার্লস ডিকেন্সের অলিভার টুইস্ট
কিংবা ডেভিড কপারফিল্ড এর অনুবাদ পড়ে নিয়াজ মোর্শেদের কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ ছিল না।
আইভানহো কিংবা তালিসমান সেই ষোড়শ শতকের ক্রুসেডকে চোখের সামনে যেন ভাসিয়ে তুলত।
অরেকটি চমৎকার অনুবাদ ছিল স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের বাস্কারভিলের হাউন্ড। ভয়াল
রাতে কুকুরের জ্বলজ্বলে চোখ আমার মনের পর্দায় ভাসত অনেকদিন!
কত
বই যে পড়া হয়েছে! অনেক নাম ভুলে গেছি। মিউটিনি অন দ্য বাউন্টি, ম্যান এগেনেস্ট দ্য সী,
পিটকোয়ার্ন্স আইল্যান্ড- এই তিনটি বই মনে এতটাই দাগ কাটে যে পরবর্তীতে
মিউটিনি অন দ্য বাউন্টি ছবিটা ডাউনলোড করে দেখেছিলাম কিন্তু ছবিটা আমাকে সেই
অনুবাদের মত আনন্দ দিতে পারেনি। ক্যাপ্টেন ব্লাইকে যতটাই অপছন্দ করতাম আবার অকূল
সমুদ্রে তার জীবন সংগ্রাম, ধৈর্য থেকে অনেক কিছুই
শিক্ষানীয় ছিল।
আরও
দুইটা বইয়ের কথা খুব মনে পড়ে। রেনে জুইও’র চিতা এবং ফারলে মোয়াটের তিমির প্রেম। একটাতে ফুটে ওঠে চিতাদের মনোজগতের অদ্ভুত
চিত্র আর অন্যটিতে সভ্যতার এক অপুর্ব নিদর্শন- যেখানে দেখানো হয় একদল
সভ্য মানুষ একটি লেগুনের ভিতরে একটি প্রেগন্যান্ট তিমিকে নির্মমভাবে হত্যা করে,
ঠিক তার বিপরীতে আরেকদল বর্বর মানুষ বরফ কেটে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করে
অনেকগুলো তিমিকে।
আরও
কত চমৎকার সব বইয়ের অনুবাদ পড়ার সুযোগ হয়েছে! কাউন্ট অফ মনট্রিক্রিস্টো, ম্যান ইন দ্য আয়রন মাস্ক,
থ্রি মাস্কোটিয়ার্স, মেরী শেলীর থ্রি
কমরেডস, রাফায়েল সাবাতিনির লাভ অ্যাট আর্মস, লর্ড লিটনের
দ্যা লাস্ট ডেজ অফ পম্পেই, শেখ আবদুল হাকিম এর অনুবাদে
মারিয়ো পুজো’র অনবদ্য সৃষ্টি গডফাদার- সব যেন গোগ্রাসে
গিলতাম! কাজী মাহবুব হেসেনের অশুভ সংকেত, অশুভ সংকেতের পর
এবং শেষ অশুভ সংকেত- তিনটি পর্বই ছিল অসাধারণ। আর কাজী আনোয়ার হোসেনের বদৌলতে
শেরউড জঙ্গল চষে বেড়িয়েছি রবিনহুডের সাথে।
রবিনসন
ক্রুসো তো অনেকবার পড়া হয়েছিল। একাকী দ্বীপে রবিনসন ক্রুসোর জীবন সংগ্রাম এডভেঞ্চারের
ইচ্ছেটা মনে জাগিয়ে তোলে। মেরী শেলীর ফ্রাঙ্কেন্সটাইনের দুঃস্বপ্নভরা ভয়াল কাহিনী
খসরু চৌধুরীর অনুবাদে যেন প্রানবন্ত হয়ে উঠত। মনে আছে এই বইটা আর ব্রাম স্টোকারের
ড্রাকুলা পড়ার পর অনেকদিন আমি রাতে আলো নিভিয়ে ঘুমাতে পারিনি।
বঙ্কিম
চন্দ্রের দুর্বোধ্য ভাষা কিশোরদের জন্য অনেক সহজ করে তোলেন নিয়াজ মোর্শেদ। তাইতো
সেই কিশোর বয়সেই কপালকুণ্ডলা আর দুর্গেশনন্দিনীর মত বই পড়া হয়ে যায়। বার বার পড়া
অল কোয়ায়েট অন দ্যা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট,
স্বপ্ন মৃত্যু ভালবাসা’র মত বইগুলোকে
কখনো মন থেকে মুছে ফেলা যায় না। অল কোয়ায়েট অন দ্যা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট বইটি পড়ে
কখন যে মনের অজান্তে দুচোখ ভিজে উঠেছিল বুঝতেই পারিনি। পল, কাট কিংবা মুলারের অপরিসীম কষ্ট, হাসি,
কান্নার ছবিগুলো যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে বইটিতে।
টান
টান উত্তেজনায় ভরা ওয়েস্টার্ন সিরিজের বইগুলো খুব মিস করি, বিশেষ করে কাজী মাহবুব
হোসেনের লেখাগুলোর প্রচণ্ড ভক্ত ছিলাম। আলেয়ার পিছে, আর কতদূর,
আবার এরফান, রক্তাক্ত খামার, ডেথ সিটি বইগুলোর কথা ভোলা যায় না। আর রওশন জামিলের লেখা বাথান,
ফেরা, কুহকিনী, ওয়ান্টেড, স্বর্ণতৃষা এর মত চমৎকার বইগুলো মনে
লেগে থাকবে আরও অনেকদিন।
একটু বড় হতেই শুরু হল রানা সিরিজ। কাজী আনোয়ার হোসেনের অনবদ্য
সৃষ্টি মাসুদ রানা। মাসুদ রানা নামটি মনে আসলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে কিছু কথা- বাংলাদেশ
কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের সেই দুঃসাহসী স্পাই, যে গোপন
মিশন নিয়ে ঘুরে বেড়ায় দেশ-বিদেশে, কোমলে-কঠোরে মেশানো
নিষ্ঠুর অদ্ভুত সুন্দর মনের অধিকারী, টানে সবাইকে কিন্তু
বাঁধনে জড়ায় না। কোথাও অন্যায় অত্যাচার দেখলে রুখে দাঁড়ায়... রানা সিরিজের প্রতিটা
বই পড়তে বসলে এই কথাগুলো মনে বাজতো। একেকটা বই নিমেষেই নিয়ে যেত অন্য জগতে! ধ্বংস
পাহাড়, ভারত নাট্যম, অগ্নিপুরুষ, চারিদিকে শত্রু, আই লাভ ইউ ম্যান, স্বর্ণমৃগ, অপহরণ, এসপিওনাজ, সেই
উ সেন, দুর্গম দুর্গ, পাগল বৈজ্ঞানিক, মরন কামড়, জাপানী ফ্যানাটিক, অন্ধকারে চিতা- এ রকম আরও কত বই যে পড়েছি নাম মনে করতে পারছি না।
একবার
বন্যার সময় বাইরে থেকে এসে দেখি বাসায় হাঁটুর উপরে পানি জমে আছে আর আমার টেবিলের
প্রায় অর্ধেকটা পানিতে ডুবানো, টেবিলের নিচের পাল্লার ভিতরে তালা দিয়ে রাখা ছিল আমার সংগ্রহে রাখা
বাছাই করা পছন্দের প্রায় শ খানেক বই। পাল্লা খুলে দেখি বইগুলো ভিজে এমনভাবে ফুলে
আছে যে ওগুলো বের করা সম্ভব না। পানি কমে গেলে দেখলাম ওগুলো আর পড়ার অবস্থায় নেই।
সেদিন এতটাই কষ্ট পেয়েছিলাম যে আরও অনেক বড় কিছু হারালেও হয়ত এত কষ্ট পেতাম না!
সেবা
প্রকাশনী সেই সময়ে আমাদের বয়সী কিশোরদের জন্য খুলে দিয়েছিল এক নতুন দিগন্ত। সেবার
বাইরে অন্য প্রকাশনীর বইগুলোর প্রতি কেন যেন অতটা টান অনুভব করিনি। তৎকালীন সময়ে
অবসর কিংবা লিনা প্রকাশনী থেকেও বের হত পেপারব্যাক, কিছু কিছু পড়াও হয়েছে কিন্তু সেবা’র বইগুলোর মত এমন আকর্ষন বোধ করিনি কখনো।
সেবার
অনুবাদগুলোর কল্যানে পরিচয় হয়েছিল বিশ্ব সাহিত্যের সাথে। তখনকার দিনে সেবার বইয়ের
নাম শুনলেই অনেককেই দেখতাম নাক সিটকাতে। ভাবখানা এমন যে এই সব বই পড়ে ছেলেমেয়েরা
সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যে যাই বলত আমি আমার কাজটি করে গেছি নিজের ইচ্ছেমতই। সে সময়
সেবা না থাকলে কি করে পরিচয় হত আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, রবার্ট লুই স্টিভেনসন, স্যার ওয়াল্টার স্কট, মার্ক টোয়েন, চার্লস ডিকেন্স, স্যার আর্থার কোনান ডয়েল,
হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড, রাফায়েল সাবাতিনি,
লর্ড লিটন, মারিয়ো পুজো, মেরী শেলী’র মত রাইটারদের সাথে! তাই তো চির
কৃতজ্ঞ সেবা প্রকাশনীর কাছে। আজও আমি ফিরে ফিরে যাই কিশোরবেলায়, ক্ষণে ক্ষণে আস্বাদন করি আমার ফেলে আসা সোনালী দিনগুলোর নির্জাস!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন