শনিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

উপন্যাসঃ ধূসর গোধূলি (পর্বঃ ১ - ১০)


প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৬
প্রকাশক : র‌্যামন পাবলিশার্স
প্রচ্ছদ : নাসিম আহমেদ
গ্রন্থস্বত্ব : লেখক

উৎসর্গ-
মা-কে
যাঁর মুখচ্ছবিটা কোনদিন মনে করতে পারিনি।



ভোরের আলো ফুটতে এখনো ঢের দেরী। গুমোট মেঘলা রাতটা শেষ প্রহরে পৌঁছে গেলেও থমথমে আলো-আঁধারির একটা অদৃশ্য জাল ছড়িয়ে আছে শ্যামলপুরের বিস্তীর্ণ জনপদ জুড়ে। বৃষ্টিভেজা পথের দু-ধারে বুনোঝোপ, বাঁশঝাড় আর লতানো গাছপালার আড়ালে-আবডালে ছোপ-ছোপ জমাটবাঁধা অন্ধকার। কাঁচারাস্তার দু-পাশের পানিতে ভাসমান আগাছার ফাঁকফোকরে, বৃষ্টিতে জবজবে ভেজা খড়ের পালার চূড়ায় আর পুকুর-ঘাটের পিচ্ছিল সিঁড়ির ধাপে-ধাপে; এমনকি গোয়ালঘরের মাচায় গাদাগাদি করে রাখা কাঠের স্তূপের মধ্যেও তার রাজত্ব। এই ছায়া-ছায়া অন্ধকারের নিবিড় নিস্তব্ধতায় উজানগাঙের দিক থেকে হু-হু হাওয়া মেঠোপথ-ধানক্ষেত ছাড়িয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বয়ে চলেছে আধো-অন্ধকারে ছাওয়া গ্রামটির ঘুমন্ত বসতির দিকে। রাতভর দাপিয়ে বেড়ানো কালচে-ছাই রঙের চাপ-চাপ মেঘেদের দল এখন কেউটে-কু-লী পাকিয়ে ঘুমায় শ্যাওলা পড়া স্যাঁতসেঁতে দেয়ালের মতো মস্ত আকাশটার বুকে। গতরাতে মুষলধারে ঝরেছে; রাতের শেষদিকে এসে একটানা ঝুমঝুম ধারা কিছুটা কমে এলেও থেমে যায়নি পুরোপুরি। ঠিক এমন সময় শেষ রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে শ্যামলপুরের মসজিদ থেকে ভেসে আসে ফজরের আজান। মসজিদের পাশ ঘেঁষে প্রকা- শিমুল গাছটার ভারী ডালপালার আচ্ছাদন ভেদ করে মনু মিয়ার কাঁপা-কাঁপা ক্ষীণ কণ্ঠের সেই আজানের ধ্বনি বেশিরভাগ ঘুমন্ত গ্রামবাসীর কানেই পৌঁছায় না।
বৃষ্টি থামুক আর না-ই থামুক, অন্ধকার কেটে যাবার আগেই দিঘির পাড়ের ছোট্ট কুঁড়েঘরটিতে দিনের শুরু হয়ে যায়। আর যা-ই হোক দু-দুটো পেটের জন্য অন্ন যোগাতে হবে তো! যাদের দিন আনতে পান্তা ফুরায় তাদের কী এই বৃষ্টি-জলের কথা ভাবলে চলে? কোনোকিছুই আটকায় না। না ঝড়-বাদল, না হাড়-কাঁপানো শীত; পেটের জ্বালা মেটাতে কিংবা আব্রু রক্ষার প্রয়োজনে তারা ছোটে। কিছুকাল আগেও অবস্থাটা কিন্তু অন্যরকম ছিল। এ ঘরের হাসি-আনন্দে মুখর সেই সময়গুলো হারিয়ে গেছে বহু আগে। বাপ-মা মরে গেল সে-ই কবে! তারপর স্বামীও চলে গেল একদিন; এখন বাঁচার জন্য যুদ্ধ করা ছাড়া বিভা’র আর কি-ই বা করার আছে?
অন্ধকারের আবরণটা একটু একটু করে ফিকে হয়ে আসছে। আকাশ মেঘলা থাকায় আবছা ভাবটা কাটেনি এখনো, বৃষ্টি পুরোপুরি থেমেও যায়নি। ভরা শ্রাবণের থৈ-থৈ পানি আর আউশের ক্ষেতের মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাড়িগুলো একেকটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। বর্ষাভোরের এমনই আলো-আঁধারিতে গ্রামের সরু-পিচ্ছিল কর্দমাক্ত রাস্তা দিয়ে গুটি-গুটি পায়ে হেঁটে চলেছে বিভা।
পাশের মসজিদ থেকে মুসুল্লিদের কথা বলার শব্দ ভেসে আসছে। মসজিদের বারান্দা থেকে মফিজ মিয়ার কণ্ঠ শোনা যায়।
কেডা যায়?
আমি বিভা, চাচাজান।
বৃষ্টির মধ্যে এত্ত বিহানে কই যাও?
মাস্টার চাচাগো বাড়ি যামু। চাচি বিহান বেলা যাইতে কইছে।
ও আইচ্ছা।
মুসুল্লিদের সাথে দাঁড়ানো মনু মিয়া বলে ওঠে,
এই মেয়েছেলেগুলানরে আর ঠিক করন গেল না। সূর্য ওঠার আগেই এরা রাস্তায় নাইমা পড়ে।
বিভা তো কহনও খারাপভাবে চলে না ছোড হুজুর! ওরে তো আমি ছোডবেলা থেইক্যাই দ্যাখতাছি। কাজেম মাঝি বলে উঠলেন।
আরে ভাই, মেয়েছেলেরা থাকবো পর্দার আবডালে। হেরা যহন-তহন বেগানা পুরুষের সামনে আইবো ক্যান?
যাগো মাথার উপরে কেউ নাই তারা তো বাঁচনের লাইগ্যাই বাইরে বাইর অয়। এইডা তো দোষের বইলা মনে অয় না! কাম না করলে অগোর খাওন জুডবো ক্যামনে? কাজেম মাঝি বেশ ঝাঁঝের সাথেই বললেন।
এইডা কোনো কতা না ভাইসাব, এইগুলান মাইনা চলন ছাড়া কোনো উপায় নাই।
আলোচনা থেমে যায় ওখানেই। মফিজ মিয়া আড়চোখে কাজেম মাঝির দিকে তাকায়। তার তীর্যক দৃষ্টি আর মুখভঙ্গিই বলে দেয় কাজেম মাঝির কথাগুলো তার ভালো লাগেনি। লাগবে কী করে? মনু মিয়া যে তারই মুখপাত্র! কাজেম মাঝি তার মনোভাব বোঝেন। তিনি এও বোঝেন এই মনু মিয়া কিসের আশায় মফিজ মিয়ার মন জুগিয়ে একই সুরে কথা বলে। চারদিকে লোভী আর দখলবাজ মানুষগুলো রক্তচোষা জোঁকের মতোই কিলবিল করে। জমি-জিরতের লোভ বড় কঠিন জিনিস। হাঙরের হাঁ-করা মুখে যতই খাবার দাও নিমিষেই নিঃশেষ হয়ে যায়; তারপর আরও চাই। কী ভাই কী বোন, কী ভাতিজিÑ এই লোভের কাছে তাদের সর্বস্ব হারিয়ে পথে নামলেও লোকগুলোর ক্ষুধা মেটে না। খাই-খাই স্বভাবের এইসব মানুষের সর্বগ্রাসী থাবা এড়িয়ে সহায় সম্বলহীনা এতিম মেয়েটা তার মরা বাপের ভিটেয় কতদিন টিকতে পারবে?
ফসলি জমিগুলোর মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে ছুটে চলা কাঁচা রাস্তার কাদা-পানি ভেঙে মাস্টার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে প্রায় ভিজে গেল বিভা।
কি রে বিভা, তুই তো পুরাই ভিজা গেছস। বিভাকে দেখে বলে ওঠেন সালমা বেগম।
হ চাচি, বৃষ্টিতে ভিজা গেছি। কলার ডেগা দিয়া কী বৃষ্টি আটকান যায়?
কয়ডা ধান সেদ্ধ করণের দরকার আছিল। হেই লইগ্যাই তোরে আইতে কইছিলাম। দ্যাখ তো! এই বৃষ্টির মধ্যে সেদ্ধ করলে ধানগুলান শুকাইমু ক্যামনে? উডানে পানি জইমা কাদা হইয়া গ্যাছে। মরার সূর্য মনে অয় আইজও উডবো না।
বৃষ্টি থামার তো কোনো লক্ষণ দ্যাখতাছি না চাচি। মনে অয় আরও বাড়তাছে!
তাইলে আইজ থাউক, বৃষ্টি না থাকলে কাইল আইস।
আইচ্ছা।
একটু খাড়া।
সালমা বেগম ঘরের ভিতরে চলে যান, কিছুক্ষণের মধ্যে ছোট্ট একটা ঝুড়ি হাতে ফিরে আসেন। সেদিকে তাকিয়ে বিভার দু’ চোখে জল টলমল করে।
কী রে, কানতাছস ক্যান?
আপনে আর মাস্টার চাচা না থাকলে আমি গ্রামে টিকা থাকতে পারতাম না চাচি। আমার আপন চাচা বাপের সবকিছু কাইড়া নিয়াও শান্তি পায় নাই। আইতে-যাইতে কতা হুনায়।
তোরে না কইছি কোনোকিছু দরকার অইলে আমার কাছে আইবি, এত শরম কীসের?
আপনাগো আর কত জ্বালাইমু? বাপ-স্বামী মরছে আর আমার কপাল পুড়ছে। নিজের লইগ্যা আর চিন্তা করি না চাচি, খালি মাইয়াডার ভবিষ্যৎ নিয়াই ভাবি।
এত ভাইবা কী অইবো? ভাইবা কী ভাগ্য বদলান যায়? তোর কিছু লাগলে আমার কাছে চইলা আইবি।
ঠিকই কইছেন চাচি, ভাইবা কোনো লাভ নাই।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিভা ঘরের সিঁড়িতে বসে বৃষ্টি থামার জন্য অপেক্ষা করে। সালমা বেগম রান্নাঘরে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। 
বৃষ্টি থেমে গেলে সাত্তার মাস্টার ঘরে ঢুকে বিছানার কাছে এসে দাঁড়ালেন। অয়ন তখনও ঘুমে। মাস্টারসাব ঘুমন্ত ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। পেছনে এসে নিঃশব্দে দাঁড়ান সালমা বেগম। হেসে জিজ্ঞেস করেনÑ কী দ্যাহেন এমন কইরা?
ঘুরে তাকালেন মাস্টারসাব। ও, তুমি! অনু এহনও ওঠে নাই, ওরে তুইল্যা দাও। সকাল সকাল ঘুম থেইক্যা ওঠা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।
থাউক, একটু ঘুমাউক। বাইরে রাস্তাঘাট সব কাদায় ভরা, উইঠাই তো কাদার মধ্যে ছুডাছুডি করবো! আপনারে নাস্তা দিমু এহন?
হ দাও।
আপনে খাইবার ঘরে যান, আমি আইতাছি।
পাশের ঘর থেকে বকুলের পড়ার শব্দ ভেসে আসছে। সাত্তার মাস্টার সামনের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন। উত্তরের ছাড়া বাড়ির দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল বাগানে ঢোকার মুখে গাছের মাথায় বেশ কিছু ভাঙা ডাল ঝুলছে। বড় রাস্তা থেকে আরও কিছু ডাল-পাতা টেনে নিয়ে বাড়ির ভিতরে আসছে মন্টু। গতরাতে ঝড়ের চিহ্নটা আবারও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বকুল খাইছে? খেতে খেতেই জিজ্ঞেস করেন সাত্তার মাস্টার।
না। এহন পড়তাছে, কইলো পরে খাইবো।
তুমিও খাও।
আপনে খান। আমি বকুল আর অনুর লগে খামুনে। আইজ কয়ডা ধান সেদ্ধ করতে চাইছিলাম, কিন্তু ঝড়-বৃষ্টি থামলেও উডান তো ভিজা। ধানগুলান এমনে থাকলে তো ভাপাইয়া যাইব। কী করণ যায় কন তো?
, এই জন্যই বিভারে আইতে কইছিলা?
হ। আমি একলা তো পারুম না, তাই ওরে আইতে কইছিলাম।
দ্যাখো কাইল বৃষ্টি থামে কীনা; না হইলে একটা ব্যবস্থা করন যাইবো।
সাত্তার মাস্টার শ্যামলপুর হাই স্কুলের হেডমাস্টার। একজন ভালো মানুষ হিসেবে গ্রামে তাঁর বেশ সুনাম আছে। বয়স পঞ্চাশ ছাড়িয়েছেন কেবল। উচ্চতা মাঝারি, গায়ের রঙ ধবধবে ফরসা। চেহারায় বনেদি ভাবটা পূর্বপুরুষের কাছ থেকেই প্রাপ্ত। তাঁর আরেকটা পরিচয় হচ্ছে তিনি এই অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। একাত্তরে শ্যামলপুরসহ আশেপাশের কয়েকটি গ্রাম নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের যে শক্ত ঘাঁটি তৈরি হয়েছিল, মূল কেন্দ্রে থেকে তার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেছেন তিনি। এখনো এই অঞ্চলে কুসংস্কার-অবক্ষয়-অনাচার মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করে চলেছেন।
পৈত্রিক-সূত্রে প্রাপ্ত জমিজমার পরিমাণ নেহায়েত কম নয়; বাজারে একটা বইয়ের দোকানও আছে। তিন ছেলেমেয়ে আর স্ত্রী সালমা বেগমকে নিয়ে বেশ সুখীই বলা যায়। বড় মেয়ে শিউলির বিয়ে হয়েছে কয়েক গ্রাম পরেÑ সুজাপুরে। অবস্থাসম্পন্ন পরিবার। জামাই এম এ পাস, মুক্তনগরে একটি ব্যাংকে ভালো চাকরি করে। ছোট মেয়ে বকুল শ্যামলপুর হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী আর একমাত্র ছেলে অয়ন বেশ ছোটÑ আট বছর মাত্র।
বৃষ্টিভেজা ঠা-া সকালে একটু দেরীতেই ঘুম ভাঙল অয়নের। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল বৃষ্টি থেমে গেছে; তবে আকাশটা তখনও মেঘ থমথমে। পেছনের দরজা দিয়ে বাইরে নেমে আসল ও। মা ছোট পুকুরের ঘাটে কাজে ব্যস্ত। বাড়ির একেবারে পশ্চিম পাশ ঘেঁষে যে হিজল গাছটা, ওটার নিচে গিয়ে দাঁড়াল। আজ গাছে কোনো পাখির ডাক নেই। নিশ্চুপ চারদিক। এখান থেকে পশ্চিম দিকের বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়। দূরের ঝাপসা বাড়িগুলোর উপরে চাপ চাপ মেঘে ঢাকা আকাশটাকে দেখে মন কেমন করে ওঠে অয়নের।
পাড়ে দাঁড়িয়ে হিজল গাছটার নিচে তাকাতেই উজ্জ্বল হয়ে উঠলো দু-চোখ। গাছের নিচের পানি আর আশপাশের অনেকটা জায়গা জুড়ে ছোট ছোট লাল ফুলে ছেয়ে আছে। যেন একটা লাল চাঁদর বিছিয়ে রেখেছে প্রকৃতি। অয়ন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। ভেজা স্যাঁতসেঁতে অবস্থার মধ্যেও ছোট্ট অথচ অসম্ভব সুন্দর এই ফুলগুলো মন ভালো করে দেবার জন্য যথেষ্ট। মাটিতে পড়ে থাকা কিছু ফুল হাতে তুলে নেয় অয়ন। টকটকে লাল কোমল হিজল ফুলগুলোর গন্ধ দারুণ লাগে ওর।
ঘরের পাশের আতা গাছটার দিকে এগিয়ে যায় অয়ন। উপরে তাকিয়ে দেখে নেয় গাছের ডালে তৈরি পাখির বাসায় পাখিগুলো এখনো আছে কিনা। মন্টু মামা বলেছে ওরা ওখানে ডিম পাড়বে, তারপর বাচ্চা ফুটলে এখান থেকে চলে যাবে অন্য কোথাও। ও প্রতিদিনই একবার করে দেখে ডিমগুলোর অবস্থা।
ঘরে এসে বাবাকে কোথাও দেখতে পায় না অয়ন। উঠান পেরিয়ে পুকুরের পাড় ঘেঁষে বড় রাস্তার দিকে এগিয়ে যায়। পিচ্ছিল কাদা এড়িয়ে দু-পাশের ঘাসের উপর দিয়ে খালি পায়ে হাঁটে। জুতা ছাড়া বাইরে নামলে মা আর ছোটদি ভীষণ বকে। মা আজ ওকে এদিকে আসতে দেখেনি, ছোটদি এখন পড়ার ঘরে। বাড়ির একেবারে শেষ মাথায় এসে দেখে বাবা মন্টু মামাকে নিয়ে রাস্তার পাশে নতুন লাগানো গাছগুলো ঠিক করে দিচ্ছে। কাল বৃষ্টিতে বেশ কিছু গাছ নূয়ে পড়েছে।
কি বাজান, উইঠা পড়ছ? অয়নকে দেখে মাস্টারসাব জিজ্ঞেস করেন।
হ বাবা, তুমি এইহানে
ক্যান, আমারে খুঁজতেছিলা?
আমি তোমার লগে হাঁটতে চাইছিলাম।
আইচ্ছা খাড়াও, এই গাছগুলান ঠিক কইরা নেই। বুঝলা, গাছ অনেক উপকারী। তাই ওদের যতœ নিতে অয়।
গাছ আমগো কী উপকার করে বাবা?
গাছ আমগো ছায়া দেয়, অক্সিজেন দেয়, ফল দেয় আবার দরকারী কাঠও দেয়।
আবার অনেক গাছে সুন্দর ফুলও ফোটে, তাই না বাবা? আমগো ঘরের পেছনের হিজল গাছে কী সুন্দর লাল ফুল ফুটছে!
, হিজল ফুল অনেক সুন্দর। তুমি একটু খাড়াও, আমি হাতের কামটা শেষ কইরা নেই, তারপর তোমারে নিয়া হাঁটতে যামু।
আইচ্ছা।
বাবার হাত ধরে বড় রাস্তায় হাঁটে অয়ন। দু’পাশের ভরা পানির মাঝে আধো-ডুবন্ত গাছগুলো একাকী পথিকের মতো দাঁড়িয়ে। দূরের চেনা বাড়িগুলো এখন অনেকটাই অচেনা। জমিগুলোকে অয়নের কাছে নদীর মতো লাগে। বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া উজানগাঙের চেয়েও যেন বড়।
অয়ন ভেজা রাস্তা ধরে ছোটে। ছুটতে ছুটতে একেবারে শেষ মাথায় কোটাখালী খালের উপর কাঠের যে ব্রিজটার কাছে গিয়ে থামে। ব্রিজের উপর শ্যামলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দৌড়ে কাছে যায়।
কি খবর অনু, এত্ত সকালে এইখানে? শ্যামল হেসে জিজ্ঞেস করে।
আমি তো প্রত্যেকদিন বিহানে বাবার লগে হাঁটি।
তাই নাকি? খুব ভালো কথা তো!
সুবল এহনও ঘুম থেইক্যা অডে নাই শ্যামলদা?
উঠছে তো দেখলাম, বাড়িতেই আছে।
তুমি কী আবার শহরে যাইবা?
হুম, কয়েকদিন পরই যামু। ক্যান তুই কী শহরে যাবি? শ্যামল হাসে।
এহ! আমি তো ছোট। এহন তো যাইতে পারুম না, তয় বড় অইলে ঠিকই যামু। তোমার মতো অনেক বড় কলেজে পড়ুম।
তোরে কে কইছে আমি বড় কলেজে পড়ি?
আমার বড়দি তো কলেজে পড়তো, তুমি তো বড়দি থেইক্যাও বড়!
আরে! তুই তো অনেক বুদ্ধিমান। শ্যামল হাসতে হাসতে বলে।
অয়নের সাথে কথা বলার ফাঁকে শ্যামলের চোখে পড়ে সাত্তার মাস্টার ব্রিজের উপরে উঠে আসছেন। শ্যামল এগিয়ে এসে সালাম দেয়।
কাকা কেমন আছেন?
ভালো। তোর বাবার অবস্থা এখন কেমন?
আগের চাইতে কিছুটা ভালো। কারো কথা শুনতে চায় না কাকা। ঠিকমত খাবার ঔষধ না খাইলে চলবো?
দেখি, কাইল একবার দেখতে যামু।
সাত্তার মাস্টার চলে গেলে ব্রিজের উপর কিছুক্ষণ দাঁড়ায় শ্যামল। খালপাড় ছাড়িয়ে পূর্বদিকে ছুটে চলা রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে হাসে। এই ছায়াঘেরা চেনা প্রান্তর জুড়ে কত স্মৃতি লুকিয়ে আছে! অথচ এখন এ-সবকিছু ছাপিয়ে একজন মানুষের মুখ অনেক বেশি জায়গা করে নিয়েছে মনে। একবার ভাবে তপনদের বাড়িতে গেলে কেমন হয়? শিখার সাথে দেখা হয়ে যেত! ব্রিজ থেকে রাস্তায় নেমে আসে শ্যামল। হঠাৎ কালিখোলার পাশ দিয়ে ডাবের কাঁদি কাঁধে তপনকে এদিকে আসতে দেখে ওখানেই দাঁড়িয়ে পড়ে। তপন কাছাকাছি আসলে জিজ্ঞেস করেÑ কই যাস?
তোগো বাড়ি যামু, বাবা ডাবগুলা কাকার লইগ্যা পাঠাইলো।
কথা বলতে বলতে তপনকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে শ্যামল।



মফিজ মিয়ার দীঘির পাড়ের নিচু সরু-পথটা এখন পানিতে তলিয়ে আছে। এই বর্ষায় উজানের পানি এসে সবকিছু ভাসিয়ে দিয়ে গেছে। বানের পানি ছোট্ট দীঘিটা ছাপিয়ে হানা দিয়েছে ডাঙায়। পাড়ের বেশ কিছু জায়গাজুড়ে ছনক্ষেত আর পথের দু-ধারে গুল্মলতার মাঝে বসবাসকারী পোকামাকড়ের দল শুকনো জায়গার খোঁজে ক্রমশ উপরের দিকে ছোটে; বানভাসি মানুষের মতো। তারপর মানুষের বসতিতে এসে ভাগ বসায়। এই দীঘির পাড়ঘেঁষে ঘন জঙ্গলের এক কোণে বুড়ো বাবলা গাছটার তলে ছোট্ট কুঁড়েঘরটিই বিভার বসতি। ঘরটির সামনে এক-চিলতে জায়গা, বর্ষার পানি থেকে রক্ষা পেতে গত বছর মাটি ফেলে কিছুটা উঁচু করা হয়েছে। কুঁড়েঘরটি আর এই উঁচু জায়গাটুকু বাদ দিলে আশেপাশের অনেকটা স্থান জুড়েই থকথকে কাদা আর পানিতে ডুবে আছে। এইসব কাদা-পানি, লিকলিকে জোঁক-কেঁচো-আরশোলাদের মাঝেই একমাত্র মেয়েটাকে নিয়ে কোনোরকমে দিন কাটায় বিভা। দীঘির দক্ষিণ পাড়ে মফিজ মিয়াদের মূল বাড়ি। এই বাড়িতে মাত্র দু’টি পরিবারের বসবাস। মফিজ মিয়া আর তার চাচাতো ভাইয়ের একমাত্র মেয়ে-পারুল।
মাস্টার বাড়ি থেকে ফিরে বিভা দেখে তখনো ঘুম ভাঙেনি প্রভার। ঘরের চালা থেকে বৃষ্টির পানি পড়ে মেঝের বিভিন্ন স্থানের গর্তে পানি জমেছে আর তার আশেপাশে বেশির ভাগ জায়গাই জবজবে ভেজা।
ইস! বিছনাডা এক্কেবারে ভিইজা গ্যাছে, মাইয়াডা কিছুই দ্যাহে না। এই প্রভা, ওঠ!
চোখ মুছতে মুছতে উঠে বসে প্রভা।
তুই দ্যাহস না খাতাগুলান ভিইজা গ্যাছে? পইড়া পইড়া খালি ঘুমাস। পায়ের কাছে ভেজা কাঁথাটা দেখিয়ে বলে বিভা।
আমি কী করুম? চালের সব জায়গা থেক্কাই তো পানি পড়ে। খাতাগুলান সরাইয়া রাখছিলাম, বৃষ্টিতে ভিজা গ্যাছে।
বিভা ঘরের চালের দিকে তাকায়। পুরনো ছনের চালার মাঝে অসংখ্য ছিদ্র- তার ফাঁকফোকরে সূর্য উঁকি দেয়, এত বছরের ক্ষয়িষ্ণু চালা কত আর সহ্য করবে? একটু জোরে বাতাস বইলেই ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ে ছনের পচে যাওয়া অংশ। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিভা নিজেই নিজেকে বলে, 'আটটা বছর! প্রভার বাপ মরণের আগের বছর ছন দিয়ে ছাওয়া চালা; আর কত টিকবো? কবে যে মাথার উপ্রে ভাইঙা পড়বো আল্লায়ই জানে!'
বিভার বেঁচে থাকার যুদ্ধটা একমাত্র মেয়ে প্রভাকে নিয়ে। মেয়েটা দিন দিন বড় হচ্ছে আর সেই সাথে সহায় সম্বলহীনা বিভার দুশ্চিন্তাও যেন বাড়ছে। নদী ভাঙনের শিকার হয়ে একদিন স্বামী-সন্তান নিয়ে আশ্রয় খুঁজেছিলো বাপের ভিটেয়, কিন্তু সেখানেও কাল কেউটের ফণা। বাপের সব সম্পত্তি গ্রাস করে নিয়েছে একমাত্র চাচা মফিজ মিয়া। একসময় স্বামীও হারিয়ে যায় রাক্ষুসে নদীগর্ভে। সেই থেকে একাকী সংগ্রাম। এখন তার শেষ আশ্রয়স্থলটুকুর দিকে শকুনি দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে মনু মিয়া। ভয় হয় কখন টিকে থাকার এই অবলম্বনটুকু ছেড়ে মেয়ে প্রভাকে নিয়ে পথে নামতে হয়। একমাত্র ভরসার স্থল মাস্টার চাচা। বিপদে-আপদে সবসময় তাঁর কাছেই ছুটে যায় বিভা।
নিজের এই অসহায়ত্ব জীবনের অরেকটা করুণ ছবিকে আরও বেশি করে মনে করিয়ে দেয়। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাতে ঘর-বাড়ি-স্বপ্ন বিলীন হওয়ার দৃশ্য বার বার দুঃস্বপ্নের মতোই ফিরে আসে মনে। অনেক বছর আগের ক্ষতটাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। মনে পড়ে- স্বামীর বাড়ির কথা। গভীর রাতের উজানিচর; সর্বগ্রাসী উত্তাল নদী আর ভাঙন। তারপর সব হারিয়ে উদ্বাস্তু। অতঃপর বাপের ভিটেয় ফেরা। চাচার রাক্ষুসে ক্ষুধার কাছে এখানেও হারায় সবকিছু; অবশেষে ঠাঁই হয় বাড়ি থেকে দূরে এই জঙ্গলের ভিটেয়। স্বামী অসীমের অক্লান্ত পরিশ্রমে সেই জঙ্গলেই স্বর্গ পেতেছিল ওরা। খুব বেশি কিছু না হলেও বিভা পেয়েছিল বাগানের এক চিলতে জমিতে হোগলের বেড়া আর ছনের তৈরি চালের একটা কুঁড়েঘর। সে ঘরে যদিও অঢেল সম্পদ ছিল না, কিন্তু শান্তি ছিল, সুখ ছিল।
বিভা, ও বিভা; কী করস?
পারুলের কথায় ঘোর কেটে যায় বিভার।
কি আর করুম, সবই আমার কপাল।
এত্ত বিহানে কই গেছিলি?
মাস্টার চাচার বাড়ি। চাচি ধান সেদ্ধ করনের লইগা যাইতে কইছিল, মেঘলা দিন, উডান ভিজা, তাই আইজ আর করল না। আমার ঘরের অবস্থাডা দ্যাহো পারুবু, বৃষ্টিতে খেতাগুলান সব ভিইজা গেল!
, তোর ঘরের যা অবস্থা যে কোনো সময় ভাইঙা পড়তে পারে। ঘরটা ঠিক করন দরকার।
ক্যামনে করুম কও? দুই বেলা ঠিকমত খাওনই জোডে না, তায় আবার ঘর ঠিক করা। চাচারে কইছিলাম কয়ডা খ্যাড় দিতে। চাচি কয়Ñআমারে খ্যাড় দিলে নাকি হের গরু না খাইয়া মরবো।
তোর চাচা-চাচি যে দেবো না তা তো জানি। হেরা তো চায় না তুই এইহানে থাহস। আপন ভাবলে বাপের সব সম্পত্তি কাইড়া নিয়া তোরে এই বাগানের মধ্যে ফালাইয়া রাখত? বুঝোস না?
বুঝুম না ক্যান পারু’বু। আমি তো হেগোরে ছোডোবেলা থেইক্যাই চিনি। এহন তো চিন্তা করি কোনোদিন জানি এইহান থেইক্যাও লাত্থি দিয়া খেদাইয়া দেয়। প্রভার বাপ তো মইরা বাঁচছে আর আমারে ভাসাইয়া গ্যাছে সমুদ্দুরের মধ্যে। আইজ দুইডা ভাতের লইগা মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে অয়। সাতটা বছর ধইরা মানুষের লাত্থি-গুতা খাইয়া মাইয়াডারে লইয়া যে রহম বাঁইচা আছি, এইডারে কী বাঁচন কয়
আমগো মতো গরিব মানুষগো বাইচা থাকা বড় কষ্টের! মতির বাপে এহন আর তেমন কাম করতে পারে না। মতির মিলের চাকরিডা না থাকলে আমগোও চলতে খুব কষ্ট অইতো।
, তোমার তো দুইডা পোলা আছে, একটা তো কামাই করতে পারে। আমার মাইয়াডারে লইয়া তো আরও চিন্তা অয়। আর কয়ডা বছর গেলেই তো অরে বিয়া দিতে অইবো। ক্যামনে যে কী অইবো আল্লাই জানে!
হেইডা যহন অইবো তহন দেহা যাইব, এহন চিন্তা কইরা কী অইবো?
পারুবু, চিন্তা করন লাগে না, এমনিতেই চইলা আহে।
বুঝি, সবই বুঝি। কিন্তু কী করবি, আমগো জীবনটাই এমন। এহন ল, বিল থেইক্যা কয়ডা শাপলা তুইলা আনি।
, লও। আমারও ঘরে রান্ধনের কিছু নাই। মাস্টার চাচি কয়ডা ডাইল-চাউল দিছে, আইজক্যার দিন চইলা যাইব। 
ধানক্ষেতের ভরা পানির মধ্যে দিয়ে ওরা এগিয়ে চলে পশ্চিমের দিকে। ওদিকেÑবিলের একেবারে শেষ প্রান্তে নদীর পাড় ধরে ছুটে যাওয়া রাস্তাটা, যেটা তেমাথার পুল ছাড়িয়ে সুবর্ণপুর হয়ে কমলডাঙার দিকে চলে গেছে। তার ও-পাশেই নদী। কলাবতী বাজারের পাশ ধরে ছুটে আসা উজানগাঙের শাখা নদী। বিলে এখন থৈ-থৈ পানি। একমাত্র বর্ষাকালে এখানে পানি জমে, পৌষ মাসে সারাটা জমি জুড়ে সোনালি ধান হাসে; ধান ওঠা হয়ে গেলে একে একে অন্যান্য শস্যÑ ডাল, সরিষা, তিল, যার যা প্রয়োজন ফলিয়ে নেয়। বর্ষায় যখন পানি জমে তখন এই জমিকে চেনাই যায় না। এত পানি যে লোকে তখন এই পুরো অঞ্চলকে বিল বলেই চেনে। পানি কমতে শুরু করলেই জমে ওঠে মাছ মারার উৎসবটা। কোঁচ-যুঁতি-পলো-জাল সবকিছু নিয়ে নেমে পড়ে হাঁটু কিংবা কোমর পানিতে। সেই সময় সবাই যেন জেলে। তরুণ-যুবা-বুড়ো কেউ বাদ যায় না। এমনকি কাইতন পড়া নেংটো ছেলেটাও নেমে পড়ে অপেক্ষাকৃত কম গভীরের কাদাপানিতে।
বৃষ্টি থেমে গেছে বেশ কিছুক্ষণ। সূর্য ওঠেনি এখনো, তবে মেঘ কেটে যাওয়ায় চারপাশ পরিষ্কার হয়ে এসেছে অনেকটা। বিভা আর পারুলের ডোঙাটা অনেক দূর চলে এসেছে। অপেক্ষাকৃত গভীর পানিতে গিয়ে ডোঙা ভিড়ায়। এখানে অগণিত শাপলা-কলমি ভাসে। দু’জনে বেশ কিছু তুলে নেয় ডোঙায়, সেইসাথে বিভার হাঁসের জন্য কিছু শামুক। তারপর ডোঙার মুখ ঘুরিয়ে দেয় বাড়ির দিকে।
বেলা বাড়ে। স্কুলে যাওয়ার সময় পার হয়ে যাচ্ছে। প্রভা চুপচাপ বসে আছে ঘরের দরজায়। মেয়ের উপর বিরক্ত হয় বিভা। এই প্রভা, স্কুলে যাবি না? বেলা তো অনেক অইয়া গেল।
প্রভা চুপ করে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে।
কি রে! কতা কস না ক্যান?
স্কুলে যাইতে আমার ভালো লাগে না।
কি কইলি তুই?
প্রভা কোনো জবাব দেয় না। বিভা আবারও ধমকে ওঠে।
প্রভা তখনও চুপ। তাকিয়ে আছে মাটির দিকে। পায়ের আঙুলগুলো আনমনে আলগা করে চলে ঘরের সামনের ভেজা মাটি। অন্যমনস্ক চোখ দু’টো ওখানে কী যেন খোঁজে নিবিড়ভাবে; বিভা বোঝেÑ ওখানে কিছু না, তার চাপা স্বভাবের মেয়েটির কিছু একটা হয়েছে। প্রাভার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে শান্ত কণ্ঠে বলে,
তোর বাপের অনেক শখ আছিলো তোরে লেহাপড়া শিখাইয়া মানুষ বানাইবো। দ্যাখ মা, আমি কত কষ্ট করতাছি কিন্তু তোরে কিছু করতে দেই না। তুই তোর বাপের ইচ্ছাডা পূরণ কর। তোর বই-খাতা তো মাস্টার চাচায় দিতাছে, চিন্তা কি? স্কুলে যাওয়া বন্ধ করিস না মা।
মাকে খুশি করার জন্য স্কুলে যাবার জন্য তৈরি হয় প্রভা। মনে মনে মায়ের উদ্দেশ্যে বলেÑ ‘আমি তো স্কুলে যাইতে চাই মা, কিন্তু আমগো চারিদিক তো খাডাশে ভইরা গ্যাছে, তোমার প্রভার দিকে অগো নজর পড়ছে’।
প্রভার চোখে ভাসে কিছু মানুষের লোভী দৃষ্টি। স্কুলে যাবার পথে তাদের চোখগুলো সদ্য প্রস্ফুটিত ওর কোমল শরীরের উপর ঘুরতে থাকে। মাঝে মাঝে ওখান থেকে ভেসে আসে নানা ধরনের অশ্লীল বাক্য।
লোকটার চাহনিটা জানি কেমন!
ভাবতে ভাবতেই দ্রুত হেঁটে জায়গাটা পেরিয়ে যায় প্রভা।
স্কুলে যাবার পুরো পথটুকুর মধ্যে এই জায়গাটাই ভয়ের। বখাটেদের আখড়া। সারাদিন কাজ নেই কোনো; বাপের হোটেলে খায় আর যত্তসব অ-কাজ করে বেড়ায়। তালুকদারের হাটখোলায় কোটাখালী খালের পাশে টিনের ঘরটায় সবগুলো মিলে আসর জমায়। প্রতিদিনই। কী সকাল, কী বিকেল; এমনকি ভর-দুপুরেও। সন্ধ্যার পর উজানগাঙের পাড়ে; খালেক তালুকদারের স-মিলের ঘরে।
কাজ আর কি?
তাস, জুয়া, আর একলা কোনো মেয়ে দেখলে উত্যক্ত করা।
প্রতিদিনই লোকটার অদ্ভুত দৃষ্টি দেখে ভয় হয় প্রভার। দশাসই শরীর, যেন একটা কালো হাতি। স্বভাবটাও একেবারে বাপের মতো। কুতকুতে চোখে তাকিয়ে থাকে, ধূর্ত শেয়ালের দৃষ্টি যেন। দেখলে শরীরটা কেমন গুলিয়ে ওঠে। মায়ের মুখে শুনেছে ওর বাপ হারু গাজীর কু-কীর্তির কথা। মা সবসময় বলে, গাছগুণে ফল। তাই এই এতটুকুন বয়সেই প্রভা বুঝে গিয়েছে এই গিয়াসদের কাছ থেকে নিজেকে রক্ষা করেই চলতে হবে।
মা’কে এখনো বিষয়টা বলতে পারেনি ও। বললে কী করবে মা? ওর লেখাপড়া বন্ধ করে দেবে? হয়ত না। মায়ের অনেক সখ-ও লেখাপড়াটা চালিয়ে যাক; বাবার শেষ ইচ্ছাটা পূরণ করুক। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? স্কুল থেকে ফেরার পথে ভাবছিলো প্রভা।  




শ্যামলপুর গ্রামটিকে ঠিক অজ পাড়া-গাঁ বলা যায় না, আবার শহর অঞ্চলের সুযোগ সুবিধাও তেমন পৌঁছেনি এখানে। শহর থেকে আসা পাকা রাস্তাটি কলাবতী বাজার পর্যন্ত এসে শেষ হয়েছে। তারপরই নদী। শান্ত, স্নিগ্ধ একটি নদী। এ নদীটি এমন ছিল না আগে। শোনা যায় অনেক বড় আর খরগ্রোতা ছিল। একসময় এটির বেশ বদনামও শোনা যেত। তখন নাকি কুমিরের বসবাস ছিল এ নদীতে। লোকে কাউকে ভয় দেখাতে বলতোÑ ‘তোরে উজানগাঙের কুমির দিয়া খাওয়ামু’। লোকে যদিও এই নদীটিকে উজানগাঙ নামেই চেনে, তবে এটি মূল উজানগাঙ নয়। শাখা নদী। উজানপুর গ্রামের দক্ষিনে- একেবারে শেষ প্রান্ত ঘেঁষে বয়ে গেছে প্রমত্তা উজনগাঙ। বাজারের পাশঘেঁষে শ্যামলপুরের দিকে বয়ে যাওয়া এ-অংশটি যদিও ভাঙেনি তেমন কিন্তু উজানপুর গ্রামটির বেশির ভাগ অংশই আজ উজানগাঙের গর্ভে চলে গেছে।                      
কলাবতী বাজারের উদয়ন সবুজ সংঘ এই অঞ্চলের তরুণদের বিনোদনের প্রাণকেন্দ্র। বিকাল হলেই ক্লাবে এসে হাজির হয় সবাই। ক্লাবের লাইব্রেরিতে ঢুকে বইয়ের কেলেকশন দেখে শ্যামল বলল,
বইয়ের সংখ্যা তো আর বাড়ে নাই দ্যাখতাছি, মাঝে মধ্যে তোরা কিছু কিছু বই কিনতে পারোস না?
তুই না থাকলে আমগো পক্ষে এই কাম করা সম্ভব না। তোর কতা তো সবাই শোনে, মাষ্টার চাচারে কইয়া একটা ফা-ের ব্যবস্থা কর না! আসাদ বলে উঠলো।
আমি না থাকলে তোরা কী লাইব্রেরিটা বন্ধ কইরা দিবি? তোগো আরও একটু একটিভ হইতে অইবো।
রঞ্জু হাসে। হাসতে হাসতেই শ্যামলের উদ্দেশ্যে বলে,
ভবিষ্যতের মাষ্টার মশাই, এই দায়িত্বটা আপনার উপরেই থাকবে। আপনে একটা বইয়ের লিষ্ট কইরা দিয়া যান, বড়জোর আমরা সেইগুলি সংগ্রহ করতে চেষ্টা করবো।
তপু বলে উঠলো- তুই না থাকলে আমরা কোনো কামে উৎসাহ পাই না।
শ্যামল মৃদু হেসে বলল- ঠিক আছে, আমি মাষ্টার চাচার লগে আলাপ কইরা দেখি একটা ফা-ের ব্যবস্থা করা যায় কিনা। আচ্ছা, এবারের ক্যারাম আর দাবার টুর্নামেন্টটা কবে করতাছোস?
আমরা তো চাইছিলাম আগামি সপ্তায় করার জন্য কিস্তু সুবর্নপুর আর গৌরিপাশার পোলাপান একটু সময় চাইছে। অরা বর্ষাটা আরেকটু কমলে শুর“ করতে চায়। তপু উত্তর দিলো।
দেখিস, চ্যাম্পিয়নশীপটা যেন আমগো গ্রামেই থাকে।
হেই ব্যাপারে তুই চন্তা করিস না। ফুটবল-ব্যাডমিন্টনের মতন ক্যারাম-দাবাও আমগো গ্রামেই থাকবো। রঞ্জুর কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস।
বাইরে ঝমাঝম বৃষ্টির শব্দ শুনে লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে এলো ওরা। এমন সময় ক্লাবঘরে এসে ঢুকলো রিয়াজ, কাজল আর তপন। অনেকদিন পর আবার  আড্ডাটা জমে উঠলো ওদের।
বাজার ছাড়িয়ে বামে মোড় নিলেই উজানগাঙের পাড়ে বয়সী বটগাছটি চোখে পড়ে। কেউ কেউ বলে শতবর্ষী গাছ। এ গাঁয়ের সবচেয়ে বৃদ্ধ যে লোকটি, সেও বলে তার ছেলেবেলা থেকে এমনই দেখে এসেছে। গাছটাকে ঘিরে নদীর ঘাটে আজ বিকাল থেকেই থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। সন্ধ্যার পর দু’পাড়ের মাঝিরা সবাই এসে জড়ো হয়েছে বটতালায়। একেকজন ক্ষোভে ফেটে পড়ছে। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে মোক্তার মাঝির গায়ে হাত তোলার বিচার না হওয়া পর্যন্ত কেউ বৈঠা হাতে নিবে না। কাজেম মাঝি সবাইকে আশ্বস্ত করে বললেন,
মোক্তারের গায়ে হাত তোলার বিচার অবশ্যই অইবো, কিন্তু তোমরা যদি নাও বাওয়া বন্ধ কইরা দ্যাও তাইলে তোমগো চলবে ক্যামনে? সংসার চালাইতে অইবো না?
আমরা এতকিছু বুঝি না, বাদইল্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত উজানগাঙে কোনো নাও চলবো না। ক্ষোভের সাথে বলে উঠলো ছমির।
মোক্তার মাঝির কোনোদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে নৌকার গলুইয়ে চুপচাপ বসে আছে। মাঝে মাঝে মনে হয় নৌকা বাওয়া ছেড়ে দেয়, কাজেম মাঝির মত; কিন্তুসংসারের টানাটানির কথা ভেবে পারে না। অবশ্য উজানগাঙের দিকে তাকালেও বড় মায়া লাগে। এই ঘাটের বড় মায়া! এই বটতলায় এসে দাড়ালে বড় শান্তি লাগে মনে। কতটা বছর! তার জীবনের বেশির ভাগ সময়ই পার হয়েছে এই বটতলা ঘাটে। এই গাছে বসবাসকারী অসংখ্য পাখ-পাখালির মত তার জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ যেন এটি। একে ছেড়ে কী করে কাটবে তার দিন?
সবাইকে শান্ত করতে কাজেম মাঝি বললেন,
ঠিক আছে, লও কাইলক্যা বশির পাটোয়ারীর কাছে যাই।
পাটোয়ারী কী আমগো পক্ষে কতা কইবো? হেয় তো ঐ শয়তানগুলার দলেই। চড়া গলায় বলল বলাই শীল।
চেয়ারম্যান হিসাবে পাটোয়ারীরে কওয়া, হেয় এর একটা সুরাহা না করলে আমরা কী মইরা গ্যাছি
ছমির বলল- ঠিক আছে, বিচারের পরই আমরা গাঙে নাও ভাসামু।
কাজেম মাঝি বুঝে গেলেন এদের উপর জোর খাটিয়ে লাভ নেই। তিনি বাজারের দিকে পা বাড়ালেন। বটতলায় হাটের অস্থায়ী দোকানগুলো এখন ফাঁকা পড়ে আছে। শনি আর মঙ্গলবার হাটবার, দুর-দুরান্ত থেকে দোকানিরা রকমারি পশরা নিয়ে হাজির হয়, তখন এই দোকানগুলোয় অনেক রাত অবধি লোকজনের আনাগোনা থাকে। নদীতে ডুবন্ত বটগাছের শিকড়ের সাথে যেন নৌকার মেলা বসে যায়, কিন্তুওরা ঘাট বন্ধ রাখলে হাট বসবে কিভাবে? তিনি বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। যেভাবেই হোক এদের শান্ত করতে হবে। সাত্তার মাষ্টারের বইয়ের দোকানের দিকে এগিয়ে চললেন কাজেম মাঝি।
সন্ধ্যা হলেই কলাবতী বাজার জমজমাট হয়ে ওঠে। বাজার ঘেঁষে উজানগাঙের পাড়ে সাত্তার মাষ্টারের বইয়ের দোকানটা। লোকে বলে মাষ্টার সাবের লাইব্রেরী। বইয়ের দোকানের সামনের খোলা চত্বরে শেষ বিকেলের আড্ডাটা ইদানীং আর জমে না। বৃষ্টি এসে যখন তখন বাগড়া দেয়, তাই মাষ্টার সাবের লাইব্রেরিতেই দাবা খেলার আসরটা বসেছে আজ। সাত্তার মাষ্টারের নিত্যদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী হামিদ শেখকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে। পাশে থেকে ইসমাইল মোল্লার বুদ্ধিও কোনো কাজে দিচ্ছে না। সাঈদ খান হাসতে হাসতে বলে উঠলেন,
ক্যান যে রোজ রোজ মাষ্টারের লগে খ্যালতে বও হামিদ! একদিনও তো জিততে পারলা না।
সবুর কর, একদিন ঠিকই মাষ্টাররে হারামু।
এমন সময় থমথমে চেহারায় দোকানের সামনে এসে দাড়ালেন কাজেম মাঝি। সাত্তার মাষ্টার তার দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারলেন গুরুতর কিছু একটা হয়েছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
কি হইছে কাজেম, তোমারে এমন লাগতাছে ক্যান?
কি অইবার বাকি আছে কও? এইরহম কইরা চুপ কইরা বইসা থাকলে কয়দিন পর তোমগোও মনে অয় গ্রাম ছাড়তে অইবো।
কি হইছে খুইলা কও না! সাইদ খান বললেন।
সিরুর নাতি বাদইল্যা মোক্তাররে থাপ্পড় মারছে।
কি কইলা কাজেম, বাদইল্যা মোক্তারের গায় হাত তুলছে? চিৎকার করে উঠলেন হামিদ শেখ। দাবা খেলার কথা বেমালুম ভুলে গেছেন তিনি।
হ। অগো সাহস অনেক বাড়ছে, আইজ মোক্তাররে মারছে, কাইল আরেকজন মাইর খাইবো। এভাবে চলতে থাকলে একদিন দ্যাখবা তোমার-আমার পোলাপাইনও অগো দাপটে টিকতে পারবো না। হতাশ কণ্ঠে বললেন কাজেম মাঝি।
ইসমাইল মোল্লা রাগে ফেটে পড়লেন। একাত্তরে তিন বুইড়া সিরু-হাসেম-বদরের লগে এই বীজগুলিরেও মাইরা ফালাইন্যা দরকার আছিলো। এইডা না করনে এহন মাশুল দিতে অইতাছে।
যুদ্ধের সময় পলাইয়া গিয়াও তো পার পায় নাই হারামিগুলা, তিন বুইড়ার আ-াগুলিরেও উচিত শিক্ষা দেওন লাগবো। আমার রামদাটায় আবার ধার দিতে অইবো দ্যাখতাছি। ক্ষোভের সাথে বলে উঠলেন হামিদ শেখ।
বদর খন্দকারের পোলাপাইনগুলা এহন কিছুডা দমন অইছে কিন্তু এই সিরু তালুকদার আর হাসেম গাজীর বংশের ছাওয়ালগুলা একেকটা হাড়ে-হারামি। গ্রামডারে এক্কেবারে নষ্ট কইরা ফ্যালতাছে। কিছু একটা করন দরকার। হেলালুদ্দীন বলে উঠলেন।
সবগুলাই কালসাপ, খালি সুযোগের অপেক্ষায় আছে। বাদইল্যা এহন কই আছে? কাজেম মাঝির উদ্দেশ্যে বললেন সাত্তার মাষ্টার।
বাদইল্যার খবর জানিনা, তয় ছমিররা সবাই খুব ক্ষেইপ্যা আছে। এর বিচার না অইলে অরা নাও বাইবো না কইছে। আমি অনেক বুঝাইছি কিন্তু অরা কেউ রাজি না। কাইল অগো লইয়া পাটয়ারীর কাছে যামু। দেহি হেয় কী করে।
পাটোয়ারী কী করবো? ঐ ব্যাডা তো একটা বিলাই, অর কোনো হ্যাডম আছে? রেগেমেগে বললেন হামিদ শেখ।
দ্যাহো পাটোয়ারী কী করে, তয় এই ঘটনার ঠিক বিচার না অইলে আমগো অবশ্যই কিছু একটা করন লাগবো। সাত্তার মাষ্টারের উদ্দেশ্যে বললেন সাঈদ খান।
সবাই তার সাথে সায় জানায়।
হরিপদ ঘোষের বন্ধ দোকানটার দিকে চোখ পড়তেই ইসমাইল মোল্লা হঠৎ বললেন,
আইচ্ছা হুনলাম হরি খুব অসুস্থ, এহন কী অবস্থা কেউ জানো?
আমি কাইল গেছিলাম, এহন একটু ভাল তয় খুব মর্জি করে। হেসে জানাল জগানন্দ।
বাইরে খুব কঠিন দেহাইলেও ভিতরে ভিতরে হরি কিন্তু খুব নরম মনের মানুষ।
সাঈদ খানের কথায় সায় জানিয়ে সাত্তার মাষ্টার বললেন, আমি কাইল একবার যামু ভাবতাছি।
আমারেও নিয়া যাইও। কাজেম মাঝি বললেন।
আইজ আর তোমারে হারতে অইলো না হামিদ!
সাঈদ খানের কথায় হেসে উঠলো সবাই।




সারারাত বৃষ্টি শেষে মেঘলা সকাল। অয়ন বিছানা ছেড়ে বাইরে এসে দেখে সূর্য ওঠেনি তখনো। ঘরের পেছনের বাঁশঝাড়ে পাখিরা জেগে উঠেছে অনেক আগেই। সকাল আর সন্ধ্যায় এখানে প্রচুর পাখি এসে ভিড় করে। ওদের নিরবচ্ছিন্ন ডাকাডাকির শব্দে চারিদিক মুখরিত হয়ে ওঠে। অয়নের ভীষণ ভালোলাগে পাখিদের এই মিলন মেলা।
প্রতিদিন সকালে পাখি ডাকার শব্দেই ঘুম ভাঙে অয়নের। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। খাবার ঘর থেকে বাবা-মা'র কথা ভেসে আসছে। ছোটদি’র ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো তখনো ঘুমিয়ে আছে বকুল। ঘর থেকে বেরিয়ে উঠানে নেমে এলো। রাতের বৃষ্টিতে উঠানটায় কাদা জমে স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে। ঘাসের উপর দিয়ে ছোট ছোট পা ফেলে ঘরের পাশের ছোট ফলের বাগানে চলে আসলো অয়ন। ছোট্ট বাগানটায় বেশকিছু ভালো জাতের ফলের গাছ লাগিয়েছেন সাত্তার মাস্টার। মন্টু গাছগুলোর বেশ যতœ নেয়, তাইতো বাগানটা সবসময়ই বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে। অয়ন বাগানের মাঝখানে আতা গাছটার নিচে এসে দাঁড়াল। গত পরশু নতুন ফোটা পাখির বাচ্চাগুলো খাবারের জন্য কেমন শব্দ করে ডাকছে। দুটো বাচ্চা ফুটেছে, কী সুন্দর! তুলতুলে। কাল বিকেলে ছোট গাছটায় উঠে একবার ধরে দেখেছিল অয়ন। একটু পরই দেখতে পেল মা-পাখিটা কোত্থেকে যেন উড়ে এসে বাচ্চাদের কাছে চলে আসলো, যেন বুঝতে পেরেছে ওর বাচ্চাদের কেউ ক্ষতি করতে পারে। মন্টু মামা পাখির ছানা ধরতে বারণ করে দিয়ে বলেছিল মা পাখি দেখতে পেলে ঠোঁকর দেবে। ও ধীরে ধীরে সরে আসে ওখান থেকে।
অয়ন পুকুরের পাড় ছাড়িয়ে আরও সামনে এগিয়ে গেল। হঠাৎ চোখে পড়ে মন্টু মামা বেশকিছু চাই নিয়ে খালের ঢাল থেকে উপরে উঠে আসছে। দৌড়ে গিয়ে খালের পাড়ে দাঁড়াল।
কি মামা, মাছ দেখবা? অয়নকে দেখে মন্টু বলে ওঠে।
, আইজ কেমন মাছ পাইলা মামা?
দেহি, আগে সবগুলান খুইলা নেই।
অয়ন খোলা জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায়। মন্টু মামা চাইগুলো হাত থেকে মাটিতে রাখতেই অয়নের চোখে পড়ে একটা চাইয়ের মধ্যে বড় একটা সাপ।
মামা দ্যাহো, একটা সাপ! ঐ সামনের চাইডার মধ্যে। অয়ন চিৎকার করে ওঠে।
মন্টু তাকিয়ে দেখে সাপটা চাইয়ের মধ্যে কু-লী পাকিয়ে আছে। অয়নকে শান্ত করতে বলে,
ডরের কিছু নাই মামা, এই সাপ কামড়ায় না।
অয়ন তবুও চাইগুলোর কাছ থেকে দৌড়ে পালায়। পুকুরের শান বাঁধানো ঘাটের উপর এসে বসে। পানিতে ছোট ছোট পোনা মাছগুলো সাঁতার কাটে। নতুন ফোটা লালচে পোনাদের ঝাঁক যখন একসাথে পুকুরের পাশে ভেসে ওঠে কী যে ভালো লাগে ওর! একটু লক্ষ করলে পোনামাছের ঝাঁকের নিচেই মা মাছটাকে দেখা যায়, যেন নিজের বাচ্চাগুলোকে আগলে রাখার জন্য আশে পাশেই থাকে। কিছুদিন আগে কচুরিপানা পরিষ্কার করার পর পুকুরের পানি যেন টলটল করছে। ছোট ছোট ঢেউগুলো তিরতির করে পুকুরের এদিক থেকে ওদিকে বয়ে যাচ্ছে, মুক্ত আকাশে নির্বিঘেœ উড়ে চলা বাঁধনহারা পাখির ঝাঁকের মতো। রোদ উঠলেই কেমন চিকচিক করবে পানিগুলি। মনে হয় আজ আর রোদ উঠেবে না।
সকালের নাস্তা শেষ করে অয়ন মন্টু মামাকে খুঁজতে লাগলো আবার। কাল মন্টু মামা বলেছিল আজ ওকে কলাগাছের ভেলায় চড়িয়ে শাপলা তুলতে নিয়ে যাবে। বাড়ির পূর্ব পাশের জমিগুলো সব পানিতে ডুবে আছে। অয়ন অনেকদিন ধরে দেখছে ঐ পানিতে প্রচুর শাপলা ফুটেছে। কতদিন মন্টু মামাকে বলেছে ওকে নিয়ে যেতে! মন্টু মামার যেন সময়ই হয়না। আজ আর ছাড়াছাড়ি নেই। অয়ন অনেক খোঁজাখুঁজি করে ছাড়াবাড়ির ভিটায় তাকে পেল। এদিকটায় সহসা আসেনা ও। ঘন জঙ্গলে ভরা। বাবা বলেছে এদিকটায় না আসতে, এখানে নাকি সব বিষধর সাপ আছে। মন্টু মামার কোনো ভয় নেই। তাকে সন্ধ্যার পরও এদিকে আসতে দেখেছে অয়ন। সন্ধ্যা হলে এদিকে তাকালেই ভয় লাগে অয়নের, কেমন যেন গা ছমছম করে। এই বাগানের মধ্যে দিনের বেলায়ও বেশ অন্ধকার! অয়নকে দেখে মন্টু লাকড়ি কাটা বন্ধ করে ওর দিকে ফিরে তাকায়।
কি রে মামা, এই জঙ্গলের মধ্যে ক্যান আইছো?
তোমারে খুঁজতে। তুমি না কইছিলা আইজ আমারে ঐ বিলে শাপলা তুলতে নিয়া যাইবা?
হ যামু তো, এই গাছগুলান চইলা নেই। দুফুরের আগেই যামুনে।
কলা গাছের ভেলা বানাইবা কহন?
যাওনের আগেই বানামুনে, তুমি এহন যাও। এইহানে বেশিক্ষণ থাইকো না, অনেক জোঁক আছে।
জোঁককে অয়নের ভীষণ ভয়। একবার বাড়ির পাশের ছোট নালায় নেমে মন্টু মামার চাঁই পাতা দেখছিল। পানি থেকে উপরে ওঠার পর পায়ের গোড়ালি থেকে প্রায় হাঁটুর কাছাকাছি পর্যন্ত সেঁটে থাকা লম্বা জোঁকটা দেখে ভয়ে সে কী চিৎকার আর হাত-পা ছোড়াছুড়ি! মন্টু মামা ছুটে এসে লবণ দিয়ে সেই জোঁকটাকে ছাড়িয়ে দিয়েছিল। সেই থেকে আর নালায় নামেনি ও।
বাগানের ভেজা পথ ধরেই আবার ফিরে চললো ও। হঠাৎ পথের ধারের সরু লম্বা আমগাছটার মাঝামাঝি জায়গায় ওর দৃষ্টিটা আটকে গেল। গাছের সাথে প্যাচানো লকলকে বেত গাছের ঝোপের মধ্যে থোকা থোকা বেতফল। পেকে একেবারে হলুদ হয়ে আছে। এগুলো পেলে ছোটদি কী যে খুশি হবে!
মামা দেইখা যাও, ঐখানে অনেকগুলান বেতফল পাইকা আছে, আমারে কয়ডা পাইড়া দেওনা। ফিরে গিয়ে মন্টু মামার কাছে আবদার জানায় অয়ন।
তুমি ঐ ফল খাইবা? ওগুলা তো জংলা ফল, কষে ভরা। কাপড়-চোপড় নষ্ট অইবো।
না অইবো না, আমি ছোটদি’র লাইগ্যা নিমু।
আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি এইহানে খাড়াও।
মন্টু বেত লতাগুলোকে টেনে নামিয়ে বেশ কিছু পাকা বেতফল পেড়ে দেয়। অয়ন খুশিমনে ভেতর বাড়ির দিকে ফিরে চলে।
ছোটদি খাবি?
অয়নের কণ্ঠ শুনে পড়ার টেবিল থেকে ঘুরে তাকায় বকুল। ওর দুহাতে পাকা বেতফলের ছড়া দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
কী রে! এগুলান তুই কই পাইলি?
ছাড়াবাড়ির জঙ্গলে। আরও অনেক আছে।
তুই একলা ওইহানে গেছিলি?
, মন্টু মামা আছে তো ওইহানে; লাকড়ি চলতাছে। ছোটদি জানোস, আইজ মন্টু মামা আমারে নিয়া শাপলা তুলতে যাইবো। খুব মজা হইব, তাইনা রে?
, মজা তো হইব, আবার পানিতে পইড়া যাইস না। এই পানিতে কিন্তু অনেক জোঁক আছে।
জানি, মন্টু মামা কইছে অনেক বড় ভেলা বানাইবো। আমি ভেলার মধ্যেহানে বইয়া থাকুম। ছোটদি তুই যাবি আমগো লগে?
না রে! তুই যা, তয় সাবধানে থাকিস।
মন্টুর ভেলা বানানোর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত অস্থির হয়ে পুকুরঘাটে বসে থাকে অয়ন। বাগান থেকে ফিরে অয়নের অস্থিরতা দেখে মন্টু হাসে।
কী রে মামা, এহনই ভেলা বানাইতে অইবো?
, দেরী অইয়া যাইতাছে তো।
তাইলে লও, আমরা ভেলা বানাই।
পাঁচটি কলাগাছের তৈরি মজবুত ভেলাটা যখন পুকুরের পানিতে ভাসিয়ে দিল মন্টু, অয়নের মুখে তখন বিজয়ীর হাসি। এক দৌড়ে ঘরের সামনে থেকে লম্বা বাঁশের লগিটা নিয়ে ভেলার চড়ে বসল। মন্টু মাছ মারার কোঁচটা নিয়ে ভেলায় উঠে বসতেই অয়ন হেসে জিজ্ঞেস করে- মামা, মাছ মারবা? মন্টু জবাব দেয়- দেহি, পাইলে মারুম।
পুকুরের জান দিয়ে বের হয়ে খোলা জায়গায় চলে আসে ওরা। পানির গভীরতা এখানে খুব বেশি না। আউশ ধান কেটে নেয়ার পর আশপাশের জমিগুলো সব পানির নিচে; সেখানে শাপলার মেলা বসেছে যেন। নলখাগড়া আর বুনো লতাগাছগুলোকে এড়িয়ে মন্টু ভেলা নিয়ে এগিয়ে চলে সামনের দিকে। কাঁচা ঘাস আর এই নতুন পানির গন্ধে এক ধরনের মাদকতা আছে। কেমন যেন মাতাল করা গন্ধ! ভেলায় চড়ে এই এডভেঞ্চারের স্বাদ পেয়ে অয়নের চোখে মুখে যেন রাজ্য জয়ের আনন্দ। জমিগুলো পানিতে ডুবে থাকায় কেমন অবাক লাগে। এই তো কিছুদিন আগেও এখানে কোনো পানি ছিল না। পাকা ধানে ভরে ছিল সব জমি। অয়নের মনে পড়ে সেবার যখন মন্টু মামার সাথে ওদের ধান ক্ষেতে এসেছিল, অনেক ইঁদুরের বাসা দেখেছিল। মন্টু মামা যখন জমি কেটে ওদের বাসা থেকে অনেক যতেœ সাজিয়ে রাখা ধানগুলো বের করে এনেছিল, ওর বেশ খারাপ লেগেছিল। ঘন সবুজ ঘাস আর নল খাগড়ার মধ্য দিয়ে তিরতির করে এগিয়ে যায় ওদের ভেলা। অয়ন ভাবে, মন্টু মামা কী সুন্দর করে ভেলাটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে! ও কী কখনো পারবে এমন করে?
একটু আগে সূর্য উঠেছে আকাশে। তাপ অতটা প্রখর নয়, তবু চারিদিক আগের চেয়ে বেশ আলোকিত হয়ে উঠেছে। অয়ন উজানগাঙের পাড়ে দাঁড়িয়ে অনেকদিন দেখেছে নদীর পানির ঘূর্ণি। প্রবল স্রোতের তোড়ে একদিক থেকে আরেকদিকে বয়ে চলে পানি। নদীতে ভাসমান সবকিছু কেমন করে যেন সেই ঘূর্ণি টেনে নিয়ে যায়। কিন্তু এখানকার পানিতে কোনো নড়াচড়া নেই। একেবারে স্থির।
এর মধ্যেই অনেকগুলো শাপলা তোলা হয়ে গেছে। মন্টু বলে- মামা, অনেক শাপলা তুলছি, লও এইবার কিছু মাছ মারি। অয়ন সানন্দেই রাজি হয়ে যায়। লম্বা ঘাস আর ভাসমান আবর্জনা এড়িয়ে মন্টু অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছ পানির খোলা জায়গা খুঁজতে লাগলো। একটু পর ভেলাটা নিঃশব্দে অনেকটা খালি জায়গায় চলে আসে। এখান থেকে পানির নিচের লালচে মাটি দেখা যায়। মন্টু অতি সন্তর্পণে কোঁচটা হাতে তুলে নেয়। চুপচাপ অনেকক্ষণ ধরে ভেলার উপর দাঁড়িয়ে থাকে। সাবধানী চোখ সামনের পানিতে স্থির। একটু পর পানির নিচে একেবেঁকে ছুটে চলা কালচে প্রানিটার দিকে চোখ পড়তেই হাতের কোঁচটা সজোরে ছুড়ে মারে। লগি মেরে কাছে গিয়ে দেখে কিছুই বাঁধেনি। ইস, পলাইয়া গেল! ঘাস আর আগাছার জঙ্গল কাটিয়ে খুব ধীরে ধীরে আরও সামনে এগিয়ে যায়। কিছুটা খোলা জায়গা পেয়ে একেবারে স্থির হয়ে যায় ভেলা। এখানে পানির গভীরতা একটু বেশি। আবার ধৈর্যের পরীক্ষা। মন্টুর সন্ধানী চোখ পানির নিচে আতিপাতি করে খুঁজে ফেরে লক্ষ্যবস্তু। একসময় সচল হয়ে ওঠে ডানহাত, বাজপাখির ক্ষিপ্রতায় পানির মধ্যে ছুটে যায় কোঁচটা। মন্টু কাছে গিয়ে কোঁচটা তুলতেই অয়ন অবাক হয়ে দেখে সূচালো কাঁটার মধ্যে প্রাণপণে ছটফট করছে শোলমাছটা। যেন ছুটে গিয়ে আবার ওর ঠিকানা পানিতেই নামতে চাইছে। বেশ কিছুটা সময় কেটে যায়। ভেলাটা আবারও ধীর গতিতে এগিয়ে গিয়ে একসময় স্থির হয়। এখানে গভীরতা অনেক কম। পানিটা এতোটাই স্বচ্ছ যে ছোট ছোট প্রাণীর নড়াচড়ায় কাদামাটি ঘোলা হয়ে যাওয়াও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। হঠাৎ আঙুল দিয়ে পানির নিচে দেখিয়ে অয়ন চিৎকার করে উঠে বলল, মামা দেখ ঐ যে একটা সাপ! মন্টু ইশারায় ওকে চুপ থাকতে বলে। তারপর কোঁচটা সপাং করে ছুড়ে মারে সেই খোলা পানিতে; মুখে তৃপ্তির হাসি। ভেলাটাকে কাছে এগিয়ে নিয়ে যায়, আলগোছে কোঁচটা তুলে আনে। কোঁচটার মাথায় বেশ লম্বা একটা বাইন মাছ; সাপের মতো দেখতে মাছটা মাথা ও লেজ দিয়ে কাঁটাগুলোকে পেঁচিয়ে ধরে আছে। লও, এইবার বাড়ি যাই। মন্টুর কথাতে ঘাড় কাত করে সায় জানায় অয়ন। শাপলা তোলা আর মাছ মারার আনন্দ নিয়ে ওরা যখন বাড়ি ফিরে সূর্য ততক্ষণে পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে।




একটানা শুয়ে-বসে থেকে সময়টা যেন আর কাটতে চায় না হরিপদ ঘোষের। এমনিতে বসে থাকার মানুষ নন তিনি। এক সপ্তাহ ধরে বাড়ির মধ্যে একরকম বন্দী। আজ সকাল থেকেই মেজাজটা খিঁচরে আছে তার। ভেবেছিলেন একবার বাজারে যাবেন, দোকানে গিয়ে বসবেন। বড় ছেলে আর ভাইয়ের জন্য যাওয়া হলো না।
সাত্তার মাস্টারের সাথে কাজেম মাঝিকে ঘরে ঢুকতে দেখে মুখে হাসি ফুটে উঠলো। শোয়া থেকে উঠে বসলেন তিনি। সাত্তার মাস্টার হরিপদর শিয়রের পাশের চেয়ারে বসলেন। মাত্র কয়েকদিনের অসুস্থতায় শীর্ণকায় মানুষটিকে আরও ক্লান্ত-বিধ্বস্ত লাগছে এখন। কাজেম মাঝিকে চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বাবার বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো শ্যামল। কাজেম মাঝি বললেন,
কি খবর হরি, এ ক'দিনে খুব রোগা হইয়া গ্যাছো, ঔষধ-পথ্য ঠিকমত খাইতেছ না হুনলাম।
খাইতেই তো চায় না, জোর কইরা খাওয়ানো হয়। শ্যামল বলল।
ছেলের উপর গতরাত থেকেই রেগে আছেন হরিপদ ঘোষ। অন্য সময় হলে বাড়ির কেউ তাঁর কথার বিরোধিতা করার সাহস পায় না, অথচ এখন তাঁর অসহায়ত্বের সুযোগ নিচ্ছে যেন সবাই। সবাই এক হয়ে জোর খাটাতেও দ্বিধা করছে না। বিশেষ করে বড় ছেলে শ্যামল আর ভাই তারাপদ। হরিপদকে সুবোধ বালকের মতো এদের মতামত মেনে নিতে হচ্ছে, কিন্তু ভেতরের বিদ্রোহী ভাবটা প্রায়ই প্রকাশ হয়ে পড়ে। তবে এই মুহূর্তে রাগের কথা প্রকাশ করলেন না তিনি। কেবল সাত্তার মাস্টারদের উদ্দেশ্যে বললেন,
কী খামু কও, কিছুই ভালো লাগে না, সবকিছুতেই গন্ধ পাই।
জ-িসে এমন হয়। কষ্ট কইরা হইলেও খাইতে অইবো। তোমার ভালো হইতে হইবো না? টাইম মতো ঔষধ-পথ্য না খওয়া মানে রোগকে প্রশ্রয় দেওয়া, আর রোগকে প্রশ্রয় দিলেই সে তোমারে পাইয়া বইবো। এইজন্যই রোগ-বালাই হইলে আগে থেইক্যা সাবধান হওয়া জরুরি । বললেন সাত্তার মাস্টার।
তাঁদের এই কথোপকথনের মাঝেই এসে ঘরে ঢোকে তারাপদ ঘোষ। ভাইয়ের পাশে গিয়ে বসে। তারও সেই এক অভিযোগ।
দেখেন তো মিয়াভাই, এই অবস্থা নিয়া কেউ কী বাইরে যাইতে পারে? দাদা আমগো কতা একদম হুনতে চায় না। হেয় দোকানে যাইবো। আপনেরা একটু বুঝাইয়া কন।
তারা তো ঠিকই কইছে হরি, তোমার এখন কমপ্লিট রেস্ট দরকার। জ-িস খুব খারাপ রোগ, ভালোমত চিকিৎসা না হইলে ঘারাইয়া যাইতে পারে। পুরাপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত বাজারে যাওনের দরকার কি?
কাজেম মাঝির কথার ক্ষীণ প্রতিবাদ করে হরিপদ বলেন,
ঐ গোপাল ছ্যাড়াডা কী একলা দোকান সামলাইতে পারে? আমি ক্যাশে বইসা থাকলেও ওর কিছুটা কষ্ট কমে। কানু শীলের ঝাড়নের পর থেইক্যা আমি তো এহন অনেক সুস্থ। এমনে ঘরে শুইয়া থাকলে তো আরও অসুস্থ হইয়া পরুম।
ঢাকা যাওনের আগ পর্যন্ত দোকানে বইবো তাপস। পুরাপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তুমি বাড়ির বাইরে যাইতে পারবা না, এই আমার এক কতা। ভাইয়ের উদ্দেশ্যে সমন জারি করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় তারাপদ।
স্বভাববিরুদ্ধ হলেও অনেকটা গোবেচারা ভাব নিয়ে হরিপদ বললেন,
বুঝলা মাস্টার, ওরা সবাই মিইল্যা আমারে পঙ্গু বানাইয়া দিবো।
ওরা সবাই তোমারে অনেক ভালোবাসে হরি, তুমি সুস্থ অইলে তো কেউ আর বারণ করবো না। কাজেম মাঝি বলেন।
কোন ডাক্তাররে দেহাইছোস? শ্যামলকে জিজ্ঞেস করলেন সাত্তার মাস্টার।
মধুপুরের হুমায়ূন কবীররে দেখানো অইছে, কিন্তু উঁনি কানু শীলের ঝাড়ফুঁক ছাড়া আর কোনো ঔষধ খাইতে চান না। কন তো কাকা, ঔষধ ছাড়া শুধু ঝাড়ফুঁকে কী এই রোগ ভালো অইবো?
সাত্তার মাস্টার হাসলেন।
তোর বাপের লগে আমার অনেক বিষয়েই খুব মিল, কিন্তু যে অল্প কয়েকটা বিষয়ে অমিল, তার একটা হইল এই চিকিৎসা ব্যবস্থা। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর তোর বাপের আস্থা বরাবরই কম।
তোমরা তো ঝাড়ফুঁকে বিশ্বাসই করো না, ছোডবেলা থেইক্যাই তো দেখতাছি, এই ঝাড়ফুঁকে কত কাওলা রোগী ভালো হইয়া গ্যালো?
সাত্তার মাস্টার হরিপদর কথা যেন মেনে নিলেন, তাঁর কথার রেশ ধরেই বললেন,
ঠিক আছে হরি, কানু শীলের ঝাড়ফুঁক চলুক; তয় তার লগে ডাক্তারের দেয়া ঔষধগুলাও খাও। হুমায়ূন খুব ভালো ডাক্তার, তুমি তাড়াতাড়ি ভালো হইয়া যাইবা।
আরও কিছুক্ষণ বসে সাত্তার মাস্টার আর কাজেম মাঝি উঠলেন। শ্যামলও তাঁদের পিছু পিছু ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। উঠান পেরিয়ে পুকুরের পাড় দিয়ে যাবার সময় চোখে পড়ল বকুলের সাথে ঘাটে বসে আছে শিখা। একবার চোখাচোখি হলো। সামনে এগিয়ে গিয়ে আবার ঘুরে তাকালো শ্যামল। কিছু একটা ইশারা করতে গিয়ে দেখলো চারু সোজা তাকিয়ে আছে তার দিকে। মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে সাত্তার মাস্টারদের সাথে হেঁটে চলল কোটাখালী ব্রিজের দিকে।
শ্যামল, তুই আর কয়দিন? ব্রিজে উঠতে উঠতে সাত্তার মাস্টার জিজ্ঞেস করলেন।
চার পাঁচ দিন থাকতে পারুম। সামনে পরীক্ষা তো, বেশিদিন থাকনের উপায় নাই।
যে কয়দিন বাপের দিকে খেয়াল রাখ। খুব স্বাধীনচেতা মানুষ তোর বাপ, কারো হুকুম তামিল করা ওর ধাতে নাই। তাই এইসব মাইনা নিতে পারে না।
সবই বুঝি কাকা, কিন্তু ওনার ভালো হইতে হইবো না? গ্রামে থাকি না, এতদূরে থাইক্যা আমগো তো টেনশন হয়।
আমার মনে হয় সপ্তাখানেকের মধ্যেই সব ঠিক হইয়া যাইবো। তোর লেখাপড়া কেমন চলতাছে?
ভালো।
এসএসসি, এইচএসসির মতো অনার্সেও যেন ফার্স্টক্লাস থাকে এইডাই আমগো চাওয়া।
আশির্বাদ কইরেন কাকা।
তা তো করিই। তুই হইলি আমগো গ্রামের উজ্জ্বল নক্ষত্র। তোরে নিয়া আমগো অনেক আশা।
শ্যামল আর কোনো কথা বলে না, চুপচাপ তাঁদের সাথে হাঁটে। কিছুক্ষণ পর বলে,
কাকা, একটা কথা আছিলো।
কি কথা, বল।
আমগো ক্লাবের লাইব্রেরির জন্য কিছু বই কেনা দরকার। গ্রামের ছেলেমেয়েদের মানসিক বিকাশের জন্য বই পড়ার প্রতি আগ্রহী কইরা তোলা জরুরি । লাইব্রেরিতে ভালো বই থাকলে সবার উপকার হইবো। এ ব্যাপারে আপনাগো সাহায্য খুব দরকার।
এইডা তো খুব ভালো কথা। সবাই মিইল্যা চেষ্টা করলে কিছু বইয়ের ব্যবস্থা করা তো ব্যাপার না!
আপনে কইলে সবাই আগাইয়া আইবো।
ঠিক আছে, সন্ধ্যায় দেখা করিস। সাইদ, হামিদের লগে আলাপ কইরা একটা ব্যবস্থা করুম।
আইচ্ছা।
হাঁটতে হাঁটতে প্রায় সাত্তার মাস্টারের বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছিলো শ্যামল। এবার বিদায় নিয়ে বাড়ির পথ ধরলো।
পুকুরের বাঁধানো ঘাটে বসে চারুর সাথে কথা বলছিল শিখা, শ্যামলকে সাত্তার মাস্টারদের সাথে বেরিয়ে যেতে দেখে উঠে পড়ল। চারু হঠাৎ বলল,
বস না শিখাদি! বড়দা তো জ্যাঠারে নিয়া ব্যস্ত, তুমি আমারে কয়ডা অংক দেহাইয়া দেও না!
শিখা বসে। কিছুটা অন্যমনস্কভাবে বলে- আইজ থাউক, কাইল আইসা কইরা দিমুনে।
চারু মুচকি হেসে বলে- বুঝছি। চিন্তা কইরো না, বড়দা এহনই চইলা আইবো।
শিখা সচকিত হয়। চারুর ইঙ্গিতটা সে বোঝে। ওকে থামাতেই বলে,
তোরে কেডা কইলো আমি চিন্তা করতাছি?
চারু ফিক করে হেসে ফেলে। দ্যাহো, আমার কাছে কিছু লুকাইয়ো না। আমি কিন্তু সব জানি।
শিখা মৃদু হেসে বলে- কী জানোস তুই?
তোমরা ডুইবা ডুইবা জল খাইবা আর আমি চোখ বন্ধ কইরা রাখুম? তার চাইতে আমার লগে হাত মিলাও। আমি তোমগো সাহায্য করুম, বিনিময়ে তুমি আমারে অংক দেহাইয়া দিবা।
তুই একটা মহা-ফাজিল। হাত মিলা-মিলির কিছু নাই, আমি তোরে এমনিই অংক দেখাইয়া দিমুনে। আইজ যাই রে, কাইল আবার আমুনে।
তাইলে ঐ কথাই রইলো, বড়দা'র অনুপস্থিতিতে তুমি আমার মাস্টার মশাই।
শিখা হাসে। ’আমি গেলাম।’
পুকুরের পাড় ছাড়িয়ে খালপাড়ের রাস্তায় আসতেই শিখার চোখে পড়ল কোটাখালী ব্রিজের উপর দিয়ে জোর-পায়ে হেঁটে আসছে শ্যামল। শ্যামলের ওভাবে ছুটে আসা দেখে শিখার হাসি পেলো। কারণটা বুঝতে দেরি হলো না তার। ব্রিজ থেকে নামতেই দু'জনের চোখাচোখি। শিখা ওখানেই দাঁড়িয়ে পড়ল। শ্যামল আরও কাছাকাছি আসতেই বলে উঠলো,
কী ব্যাপার, সাহেবের ট্রেন মিস হইয়া গ্যালো না কি?
শিখার কথার উত্তর না দিয়েই শ্যামল বলেÑ কী রে, তুই কই যাস?
বাড়ি যাই!
ক্যান? একটু আগেই তো আইলি। আমার লগে দেখা না কইরাই যাইতাছোস কই?
বাড়িতে কাম আছে।
তাইলে আইছিলি ক্যান?
এমনিই, মন চাইলো তাই!
শ্যামল হাসে।
আইসাই যখন পড়ছোস, আর কিছুক্ষণ থাক! তোর লগে কথা আছে।
শিখা কিছু বলে না। শ্যামল শিখার চোখের দিকে তাকায়। শিখা চোখ নামিয়ে নেয়। শ্যামল জিজ্ঞেস করেÑ কী রে! তোর কোনো কথা নাই?
শিখা কিছুক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর হেসে বলে- জানি না।
তোর চোখ কইতাছে ভেতরে অনেক কথা জইমা আছে!
আচ্ছা! তাইলে চোখের কাছ থেইক্যাই জাইনা লও।
তাই লমু। আমি যে কয়দিন বাড়িতে আছি, তুই প্রতিদিন একবার কইরা আইবি।
তুমি ঢাকা যাইবা কবে?
শনিবার।
শিখা কিছুটা আনমনা হয়ে যায়। খালের ঘোলা পানির দিকে তাকিয়ে থাকে। পানিগুলো দ্রুত বেগে নেমে যাচ্ছে এখন। সেই পানিতে ভাসমান কচুরিপানা, শ্যাওলাও ভেসে চলেছে অজানা গন্তব্যের দিকে। শিখা চলে যাবার জন্য পা বাড়ায়।
এখনই চইলা যাবি?
অনেকক্ষণ হইলো আইছি, মা খুঁজবো।
আচ্ছা যা, আবার কখন আইবি?
কী জানি!
শিখা চলে যায়। পেছনে দাঁড়িয়ে শ্যামল মনে মনে হাসে। নিজেই নিজেকে বলেÑ আমি জানি।




সন্ধ্যা হলেই ঝুপ করে আঁধার নামে শ্যামলপুর গ্রামে। কোনো ঘোষণা ছাড়াই গাঢ় অন্ধকার এসে ঢুকে পড়ে গাছপালায় ঘেরা জঙ্গল আর ঘরবাড়ির ঘুলি-ঘুপচিতে। ধীরে ধীরে শুষে নেয় দিনের শেষবেলার সবটুকু আলো। এ সময় বিদ্যুতের দেখা মেলে না বেশিরভাগ দিনই। তাই এখানকার জীবনযাত্রায় হারিকেন বা কুপিবাতি অপরিহার্য্য। চাপ চাপ অন্ধকার ভেদ করে গাছপালার ফাঁক গলে বিচ্ছিন্ন বাড়িগুলোতে হারিকেনের টিমটিমে আলো চোখে পড়ে থেকে থেকেই। পথের পাশের ঝোপে একটানা ঝিঁঝিঁপোকার ডাক কিংবা গাছের পাতার ফাঁকে নিশিজাগা পাখির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ অন্ধকারের সাথে মিলেমিশে রাতের পরিবেশকে আরও ভৌতিক করে তোলে। ঘন আঁধারের নির্জনতায় ভয় কাটাতে গ্রামের মেঠোপথ ধরে চলতে গিয়ে নিঃসঙ্গ পথিক নিজের মনেই গেয়ে ওঠে- ‘হলুদিয়া পাখি সোনারই বরণ, পাখিটি ছাড়িল কে...’। নিশুতি রাতে অনেকদূর থেকে ভেসে আসা দূরাগত পথিকের এসব গানের রেশ কারো কারো মনে হয়ত বেজে চলে দীর্ঘসময় ধরে। চারিদিকে পানি থাকায় আঁধার নামলে লোকজন বাইরে বের হয়না তেমন একটা। কিছুটা সময় ধরে কলাবতী বাজারে লোকসমাগম থাকে, তারপর ধীরে ধীরে সবাই ফিরে যায় বাড়িতে।
অন্ধকার নামলেই অয়নের ভয় যেন বেড়ে যায় বহুগুণ। দূরের বাড়িগুলো আর বড় বড় গাছের ছায়া মনে কেমন ভয় ধরিয়ে দেয়। পুকুরের উত্তর পাড়ে ছাড়াবাড়ির দিকে তাকালেই ভেতরটা যেন কেঁপে ওঠে। শুকনো পাতা মাড়িয়ে ইঁদুর-বিড়ালের হেঁটে যাওয়া কিংবা নাম না জানা কোনো পাখির অদ্ভুত ডাক ভয়ের মাত্রাটাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। তাই এই সময়ে একা বের হয়না অয়ন। এমনকি ঘরের পাশের ছোট্ট বাগানটা যেটা ওর খুব প্রিয়, রাত হলে সেখানেও একাকী যাওয়া হয়না কখনো। রাতে বাইরে যাবার প্রয়োজন হলে মন্টু মামা কিংবা ছোটদিকে অবশ্যই সাথে যেতে হয়। মন্টু মামার কোনো ভয় নেই। মন্টু মামা অন্ধকার রাতে একা একা ছাড়াবাড়িও যেতে পারে। তবে যখন বড়দি ছিল, সন্ধ্যাগুলো অনেক আনন্দের ছিল। জোছনা রাতে যখন আকাশে বেশ বড় চাঁদ উঠতো পুকুরের টলটলে স্বচ্ছ পানিতে তার ছায়া পড়তো। সারা আকাশ জুড়ে থাকতো তারার মেলা। সেই মায়াময় জোছনার আলোয় উঠোনে মাদুর বিছিয়ে কিংবা পুকুরের শান বাঁধানো ঘাটে বসে বড়দি, ছোটদি, মন্টু মামার সাথে গল্প করার সময় কোনো ভয় লাগতো না। বড়দির কোলে মাথা রেখে শুয়ে শুয়ে আকাশের তারা গুণতে আর গল্প শুনতে কী যে ভালো লাগতো অয়নের। বড়দি চলে যাবার পর এখন আর তেমন করে গল্প শোনায় না কেউ। মন্টু মামার অনেক সাহস কিন্তু ভালো গল্প বলতে পারে না। আর ছোটদি যে ক’টা গল্প জানে সবই তো ওর শোনা হয়ে গেছে।
অন্ধকারকে ভয় পেলেও বর্ষার সময়ে ঝিঁঝিঁপোকার ডাক আর থেমে থেমে ব্যাঙ ডাকার শব্দ বেশ লাগে ওর। রাতে হিসু করতে যাওবার সময় ও দেখেছে ব্যাঙগুলোর গায়ে হলুদ রঙের লম্বা লম্বা দাগ। মন্টু মামা একবার পা দিয়ে চেপে একটা ব্যাঙ মেরেছিল। অয়নের একদম ভালো লাগেনি। মরে যাবার আগে ওটা কেমন ছটফট করছিলো। তারপর একসময়ে স্থির হয়ে গেল। অয়ন বাবাকে বলেছিল। বাবা বলেছেন, ওগুলো মারতে নেই। মন্টু মামার অনেককিছুই ওর খুব ভালো লাগে। অনেক বড় বড় গাছ বেয়ে কেমন তরতর করে উঠে যায়। ওদের পুকুরপাড়ে যে বড় নারিকেল গাছটা, যেটার মাথা অনেকটা আকাশের কাছাকাছি, সেটাতেও অনেক তাড়াতাড়ি উঠে যায় মন্টু মামা। শীতের সময়ে রাস্তার পাশের সারি সারি খেজুর গাছে উঠে ধারালো দা দিয়ে কী সহজেই গাছগুলো কাটে, তারপর সেখানে হাড়ি বেঁধে রাখে। গাছের সাথে সাঁটানো বাঁশের কঞ্চির নল বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা রস হাড়িতে জমা হয় আর সকাল বেলা ঘন কুয়াশার মাঝেও মন্টু মামা ওগুলো নামিয়ে আনে। অয়ন অবাক হয়ে মন্টু মামার কাজগুলো দেখে। মাঝে মাঝে ভাবে বড় হয়ে এগুলো কী ও করতে পারবে?
শুকনো মৌসুমে ওদের বাড়ির পশ্চিম পাশের ভিটাবাড়িতে নানান ধরণের সবজির চাষ করে মন্টু মামা। অয়ন অনেকদিন দেখেছে ঝাঁকে ঝাঁকে সবুজ টিয়াপাখি এসে বসে মরিচক্ষেতে। মামা ওগুলো তাড়াতে বাঁশ আর ভাঙা মাটির হাড়ি দিয়ে কাকতাড়ুয়া বানিয়ে বসিয়ে দেয় ক্ষেতের মাঝে। মাথায় কালো মাটির হাড়ি আর সাদা জামা গায়ে দিয়ে কাকতাড়ুয়াটা লাল-সবুজ মরিচ গাছের মাঝে কেমন প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে। সাদা জামাটা পতাকার মতো বাতাসে উড়ে। টিয়া পাখির ঝাঁক ভয়ে কাছেই আসে না। অয়ন ওটার পাশে নিজেও কাকতাড়ুয়া হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে কতদিন!
বাবা গাছ কাটা একদমই পছন্দ করেন না। কেবল আগাছা পরিষ্কার করে দিতে বলেন মন্টু মামাকে। বাগানে অনেক গাছ আছে যেগুলোতে কখনই ফল ধরেনি অথচ ওগুলোও কাটা নিষেধ। তিনি বলেন, ফল না দিক ছায়া তো দেয়, অক্সিজেন দেয়। তাই সারা বাড়িতে ছড়ানো ছিটানো প্রচুর গাছপালা। মা বাবার অজান্তে মন্টু মামাকে দিয়ে অনেক গাছ কাটিয়ে লাকড়ি বানিয়ে নেন। মন্টু মামাকে বাবা কখনো কিছু বলেন না, এমনকি তুই করেও না। মা মাঝে মাঝে বকেন। মামা অবশ্য হাসিমুখে সবকিছু মেনে নেয়। মাকে ভীষণ ভালোবাসে মন্টু মামা। মা বলেন, ছোটবেলা থেকেই মামা মায়ের সাথে ছায়ার মতো লেগে থাকতো। মার কোনো ছোট ভাই ছিলনা, তাই মন্টু মামাকে মা অনেক আদর করতেন। মন্টু মামার আপন কেউ নেই। ওর বাবা নানাদের বাড়িতে আশ্রিত ছিলো। মামাকে বিয়ে দিয়েছিলেন নানা। তবে বিয়ের ছয়মাস পর মামী সাপের কামড়ে মারা যায়। মামা আর বিয়ে করেনি। মায়ের সাথে এখানে চলে এসেছে। সেই থেকে মন্টু মামা এ বাড়ির একজন স্থায়ী বাসিন্দা।
সন্ধ্যার পর দু’ভাই-বোনে একসাথে পড়তে বসে। অয়নের খুব তাড়াতাড়িই পড়া শেষ হয়ে যায়। ও তখন ঘরের সিঁড়িতে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে শুয়ে গল্প শোনে। মা আদর করে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেন, মাঝে মাঝে ওর ঘুম এসে যায়। মা শুধু নানাবাড়ির গল্প করেন। গোলাভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ। নানাবাড়ির এসব গল্প অনেকবার শোনা হয়ে গেছে অয়নের। নানাকে ওর মনে নেই। মা বলেছেন অয়নের বয়স যখন দুই বছর তখন নানা মারা গেছেন। তবে ও বাড়িতে গেলে নানী খুব আদর করেন ওকে। ছৈওয়ালা নৌকায় করে যেতে ওর বেশ লাগে। নৌকায় উঠলে নৌকার মাথাটা দখল করা ওর চাইই, আর এ নিয়ে প্রতিবারই ছোটদি’র সাথে লেগে যায়। নৌকার মাথায় বসে উজানগাঙের দু’পাশের গ্রামগুলোকে কেমন অপরিচিত মনে হয়। নদীর বুকে ছোট ছোট ঢেউ তুলে নৌকাটা তিরতির করে এগিয়ে চলে সামনের দিকে আর সেই ঢেউয়ের মধ্যে নীল আকাশের বুকে ভেসে থাকা মেঘের ছায়ারা কেমন কেঁপে কেঁপে ওঠে।
সামনের বারান্দা থেকে মন্টু মামার রেডিওর গান ভেসে আসছে। সন্ধ্যার পর থেকে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত তার সবসময়ের সঙ্গী এই রেডিওটা। সারাক্ষণ ওটা সাথে করে ঘুরে বেড়ায়। প্রায় রাতেই এন্টেনা নিয়ে নানা কসরত করতে দেখা যায় আর রেডিওটা যেন তার সাথে রাগ করে শো-শো শব্দ করে চলে। মাঝে মধ্যে অবশ্য ওটা থেকে ভরাট কণ্ঠের গান ভেসে আসে। তখন মন্টু মামাও রেডিওর সাথে সাথে গেয়ে ওঠে- আমার হাড় কালা করলাম রে ওরে আমার দেহ কালার লাইগারে... ।
আজও মন্টু মামা রেডিওটা নিয়ে বারান্দায় বসে আছে। মামার হাতের আঙ্গুল দিয়ে রেডিওটার উপরে তবলার মতো তাল দেয়া দেখে অয়ন হাসে।
কি মামা, হাসো ক্যান? মামার গান শুইনা হাসি পাইতাছে?
না, এমনেই। তোমারে আইজ খুব খুশি খুশি লাগতাছে।
আমি তো ভালো গাইতে পারি না, মামা।
মন্টু মামার গানের গলা তেমন ভালো না, তবুও আজ অয়নের বেশ লাগছে।
মামা, আইজ তোমার গান ভালো লাগতাছে।
হাঁচা কইতাছো মামা?
অয়ন মাথা নাড়ে। মন্টু আবার বলেÑ তয় তোমার মামীর গলা খুব ভালো আছিলো। হেয় চিকন সুরে খুব সুন্দর গান করতো।
মন্টু মামা সুযোগ পেলেই মামীর প্রশংসা করে। এ নিয়ে ছোটদি মুখটিপে হাসে। মামা কিছুই বোঝে না। মামীর গুণের কথা বলতে বলতে একসময় দু’চোখ ভিজে ওঠে মন্টু মামার। অশ্রু লুকাতে অন্যদিকে তাকায়। বকুলরা বুঝেও না বোঝার ভান করে।
বাংলাঘরে এখন আর কেউ থাকে না। আগে ওখানেই থাকতো মন্টু মামা। তখন বারান্দায় দাদা থাকতেন। দাদা হাঁটতে পারতেন না। সারাক্ষণ বারান্দার খাটের উপরে শুয়ে বসে সময় কাটতো তাঁর। ফর্সা শীর্ণদেহী দাদার মাথায় কাশফুলের মতো সাদা চুল ছিলো। কাউকে কাছে পেলে কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেন; দেখে খুব মায়া লাগতো অয়নের। একটু পর পরই শিউলি, বকুল, অয়নের নাম ধরে ডাকতেন। ছোটদি মাঝে মাঝে রেগে গেলে মা বলতেন, ‘বুড়া মানুষ একলা একলা ভালো লাগেনা, একটু দ্যাখনা কী কয়’। শীতের সময় প্রতিদিন সকালে বাবা কোলে করে উঠানে রোদে বিছানো পাটিতে বসিয়ে দিতেন, রোদের তেজ বেড়ে গেলে মন্টু মামা আবার ঘরে উঠিয়ে রাখতো। গত বছর দাদা চলে গেলেন। বাবা তখন অনেক কেঁদেছিলেন। অয়ন সেদিনই প্রথম বাবাকে কাঁদতে দেখেছিলো। বুঝেছিল, বাবা দাদাকে অনেক ভালোবাসতেন। ও যেমন ভালোবাসে বাবাকে।
মায়ের কোলে শোয়া দেখলেই ছোটদি ওকে ক্ষেপায়। ছোটদি’র গলা শুনতে পেয়েই মায়ের কোল থেকে উঠে বসলো অয়ন।
কি রে পুচকি, এতক্ষণ মা’র কোলে বসছোস, এহন সর। আমি একটু বসুম।
এই ছোটু, ভালো অইবো না কিন্তু। তুই মা’র কাছে আইবি না।
ক্যান, মা কী তোর একলার?
হ। যা, দূরে যা।
সালমা বেগম হাসেন, পাগল পোলা-মাইয়া। বকুলের উদ্দেশ্যে বলেন- আয়, তুই আমার এইপাশে আয়, ওরে ক্ষ্যাপাইসনা।
মায়ের কোলে শুয়ে পুরনো দিনের গল্প শুনতে শুনতে বেশ রাত হয়ে যায়। হঠাৎ অয়নের চোখে পড়ে বড় রাস্তা থেকে একটা উজ্জ্বল আলো বাড়ির দিকে দ্রুত এগিয়ে আসছে। একটু পরই উঠানের অপরপ্রান্ত থেকে পাঁচ ব্যাটারির টর্চের আলো এসে ওদের গায়ে পড়তেই অয়ন নিচের সিঁড়িতে নেমে দাঁড়ায়, আর তখনই একজন দীর্ঘদেহী মানুষ সাইকেল থেকে নেমে ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেন।



দিনের প্রারম্ভে কোটাখালী যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়। পূর্ণ যৌবনা নদীর মতো ফুলে ফেঁপে ওঠা খালটি শ্যামলপুরের মধ্য দিয়ে সর্পিল গতিতে একেবেঁকে ছুটে গিয়ে উজানগাঙের মাঝে নিজেকে সঁপে দেয়। যেন নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ। তবে ওর বুকে নদীর মতো তীর ভাঙা ঢেউ ওঠে না। উজানগাঙের মতো স্বার্থপর হয়ে কারো সর্বস্ব কেড়েও নেয় না, বরং এই খালের দু’পাড়ের মানুষের জন্য বয়ে আনে আশীর্বাদ।
কোটাখালী ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে সকালের নির্মল হওয়া সেবন করতে করতে চারিদিকে চোখ বোলায় শ্যামল। রাতভর ঝমঝম বৃষ্টিতে সবকিছু ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। রাস্তার দু-ধারে থৈ-থৈ পানি, সেই পানির উপর মাথা উঁচু করে থাকা কচি সবুজ ধানের শীষ আকাশ ছুঁতে চায়, আর ধানগাছের ফাঁকে ফাঁকে রাশি রাশি শাপলা ফুল হাসে। বৃষ্টিভেজা পথের পাশে ঝোপঝাড়, লতাগুল্মতে যেন নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। এই শ্যামলপুর যেন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। সে যেখানেই থাকুক, যত দূরেই যাক- কোটাখালী-উজানগাঙের জোয়ার-ভাটা তাকে যেন চুম্বকের মতো টানে। আর মাত্র দু’দিন; তারপর অনেকদিন দেখা মিলবে না এই কোটাখালীর, এই ধানক্ষেত-শাপলা শালুকের।
খালপাড়ের রাস্তা ছাড়িয়ে টইটম্বুর আউশের ক্ষেত জুড়ে সবুজ আর সবুজ। সেদিকে তাকাতেই চোখে পড়ল ধানক্ষেতের ভরা পানিতে কাকু ডোঙা নিয়ে ছুটে চলেছে। এই লোকটার অফুরন্ত প্রাণশক্তি। সকাল থেকেই সারাদিন খেটে চলে তারাপদ ঘোষ। কোনো ক্লান্তি যেন তাকে স্পর্শ করতে পারে না। ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে ছুটে চলা ডোঙাটা একটি বিন্দুতে পরিণত হলে তালুকদারের হাটখোলার দিকে চোখ পড়ে শ্যামলের। খালেক তালুকদারকে খালপাড়ের রাস্তা ধরে ব্রিজের দিকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখা যাচ্ছে। পেছনে পেছনে প্রায় দৌড়ে আসছে তার ছোট ভাই বাদল। ব্রিজের গোঁড়ায় এসে দু’জনে মিলিত হয়। ব্রিজটা অতিক্রম করার সময় খালেক তালুকদারের কিছু কথা কানে আসে শ্যামলের। ‘অগো জায়গার খায়েশ মিটাইতাছি, খালি দ্যাখ আমি কী করি’। বাদল বলে, ‘অরা যদি কেস করে?’। ব্রিজ থেকে নেমে দু’জনে কলাবতী বাজারের দিকে ছুটে চলা রাস্তায় হনহন করে হেঁটে চলেছে। শ্যামল মনে মনে হাসে। আবার কার সর্বনাশ করতে চলল সেরুর নাতিরা? এই লোকগুলোর জমির লোভ আর শেষ হবার নয়। ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছেÑ তালুকদার, গাজী আর খন্দকারদের মধ্যে জমিজমার বিরোধ লেগেই আছে। সবার মধ্যেই শুধু খাই-খাই ভাব। যা আছে তাতে ক্ষুধা মিটছে না, আরও চাই। 
তালুকদারের হাটখোলার একটু আগে একটা রাস্তা পূবদিকে বহুদূর পর্যন্ত চলে গেছে। এদিকে তপনদের বাড়ি। গ্রামে আসলে এই পথটা তাকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে। শুধু প্রাতঃভ্রমণের উদ্দেশ্যেই নয়, অন্যকিছু পাবার প্রত্যাশায় আজ মনটা আনচান করছে। বছরখানেক আগেও কিন্তু এমন হয়নি। তখন শৈশব-কৈশোরের এই চেনা পথটির আলাদা কোনো গুরুত্ব ছিল না শ্যামলের কাছে। নিজেদের বাড়ির মতোই মনে হতো সবকিছু। এই রাস্তায় ছুটোছুটি করে কত সকাল-সন্ধ্যা কেটেছে তপনের সাথে! কত রাত দু’জনে একসাথে পার করেছে! একই বিছানায়। তখন শিখাকে আর দশটা কিশোরীর মতোই মনে হত।
বছরখানেক আগের কথা, ঢাকা থেকে ফিরে তপনের জন্য ওদের বারান্দায় অপেক্ষা করছিলো শ্যামল, হঠাৎ মিষ্টির প্লেট হাতে শিখা ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। সেদিন শিখাকে দেখে একটা চমক লেগেছিল। এ যেন অন্য এক শিখা। এতদিনের দেখা মেয়েটা কখন কিশোরী থেকে তরুণী হয়ে উঠলো? ভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর গ্রামের সাথে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে বটে; বেশ লম্বা সময় পর ওকে দেখলো, তাই বলে এতটা বদলে গেল!
গভীর কালো দু’টি চোখ যেন স্বচ্ছ জলের নদী। সে নদীতে বয়ে চলেছে অসংখ্য তরঙ্গমালা, যেন উজানগাঙকেও হার মানায়। আর গোলাপী দুই ঠোঁটের হাসিতে কী এক জাদু ছিলÑ শ্যামল সেই মন্ত্রের বলে মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। কতক্ষণ শিখার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল বলতে পারবে না। চমক ভেঙেছিল শিখার কথায়। ‘কি হইল শ্যামলদা, কী দেখছ এমন কইরা?’ শ্যামল সেদিন কিছুটা লজ্জাই পেয়েছিলো। এভাবে বোকার মতো তাকিয়ে থাকা ঠিক হয়নি। শিখাও সেদিন শ্যামলের ভেতরের পরিবর্তনটা টের পেয়েছিল। তারপর অনেকদিন ঐ চোখে চোখ রাখতে পারেনি শ্যামল। তবে শিখার সেই শান্ত চোখের ভাষা আর উজ্জ্বল শ্যামলা টোল পড়া গালে মোহনীয় হাসির ঝিলিক তার বুকের ভিতরে চিরস্থায়ীভাবে আসন গেঁড়ে নিয়েছিলো। যখন এই পথ ধরে ফিরছিল মনের মধ্যে কেবল একটি সুরই গুনগুন করে বাজছিলÑ ‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে, দেখতে আমি পাইনি তোমায়, দেখতে আমি পাইনি’।
তারপর ঢাকায় ফিরে কিছুই ভালো লাগতো না শ্যামলের। কী ক্লাস, কী বন্ধুদের আড্ডা! যখন-তখন শিখা তার মনে বিনা নোটিশে হানা দিতো। সবকিছু ছাপিয়ে শিখার ভাবনাটা তার ভিতরে অদ্ভুত এক আলোড়ন তুলতো।
এ ক’বছরে ইউনিভার্সিটিতে অনেক মেয়ের সাথেই পরিচয় হয়েছে, একসাথে চলাফেরা, আড্ডাÑ সবই চলে, তবে কারো প্রতি কোনোদিন এতটা আকর্ষণ বোধ করেনি শ্যামল। অথচ নিজ গ্রামেরই অতি পরিচিত এক মেয়ে, যাকে ছেলেবেলা থেকে বড় হতে দেখেছে, সেই মেয়েটিই তাকে এমনভাবে বেঁধে ফেলতে পারে আগে কখনো বুঝতে পারেনি সে। ইদানীং প্রবলভাবে অনুভব করেÑ শিখাকে সে ভালোবাসে।
আজ তপনদের বাড়িতে ঢোকার পথে সেদিনের কথাগুলো খুব মনে পড়ছিলো। সেই বোকার মতো তাকিয়ে থাকার কথা বলে শিখা এখনো মাঝে মাঝে তাকে ক্ষেপায়।
রমেন সাহাকে হেঁটে আসতে দেখে বাড়ির প্রবেশমুখেই দাঁড়িয়ে পড়ল শ্যামল।
আদাব কাকা, কেমন আছেন?
ভালো। আমি তো তোগো বাড়ির দিকেই যাইতেছিলাম। হরি’দা কেমন আছে?
আগের চাইতে ভালো।
তারা কী বাড়িতে আছে এহন?
কাকুরে তো ডোঙা নিয়ে বিলের দিকে যাইতে দেখলাম।
তুই ঢাকা যাবি কবে?
পরশু।
ও।
বাড়িতে ঢোকার মুখে বিশাল পুকুরের চওড়া দু’পাড়ে সারি সারি নারিকেল, সুপারি আর মেহগনি গাছ। এ বছর পুকুরে কয়েক জাতের মাছ ছেড়েছে রমেন সাহা। মাঝপুকুরে কলা গাছের ভেলায় চড়ে মাছের খাবার দেয়ার কাজে ব্যস্ত তপনদের কাজের লোক ভুপেন। পানির উপরিভাগে ছোট ছোট মাছদের খেলা করার দৃশ্য বেশ উপভোগ্য লাগছিলো শ্যামলের কাছে। ঘাটের উপর দাঁড়িয়ে ভুপেনকে তপনের কথা জিজ্ঞেস করতেই সে বলল, ‘দাদা তো রজনীকান্তের দীঘির দিকে গেল। আপনে ঘরে গিয়া বহেন শ্যামলদা, দাদা চইলা আইবো’। শ্যামল মনে মনে কিছুটা খুশিই হয়। তপনের অনুপস্থিতে শিখাকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও একা পাওয়া যাবে।
আজ ঘুম থেকে উঠেই কোনো এক অজানা কারণে মন ভালো হয়ে গেল শিখার। বিরামহীন বৃষ্টিতে লম্বা একটা ঘুম হয়েছে কাল রাতে। অন্যদিনের চেয়ে আজকে একটু দেরীতেই উঠলো। দখিনের জানালাটা খুলে দিতেই একটা ঠা-া হাওয়া পরশ বুলিয়ে গেল ঘরটায়। শিখা বাইরে এসে দাঁড়ালো। ঘরের পাশের জামরুল গাছটার ডালে চড়ুই আর টুনটুনিগুলো লেজ উঁচিয়ে মনের সুখে তিড়িংবিড়িং করে লাফাচ্ছে। পেছনের পুকুরের ঘাটের দিকে এগিয়ে গেল সে। ঘাটের পাশেই মাচায় ঝুলছে কচি শশা, কোনোটাতে চিচিঙা আর ঝিঙা। পাশের মাচাটা সবুজ লতানো পুঁইয়ের ডগায় ছাওয়া। এটা তার মায়ের জগৎ। মা খুব যতœ করে তাঁর এই সবজী বাগানের। পরিবারের প্রয়োজনীয় সবজীর সিংহভাগই আসে এই বাগান থেকে। সব ঋতুতেই এখানে কোনো না কোনো সবজী থাকে।
আষাঢ়-শ্রাবণে এমনিতেই পানি বেশি থাকে, এখন জোয়ারের পানিতে পুকুরটা কানায় কানায় পূর্ণ। এই পুকুরটা খালের সাথে সংযুক্ত। কোটাখালির শাখা। এক পাড়ে ছোট একটি জান দিয়ে জোয়ার-ভাটায় পুকুরে পানি আসা যাওয়া করে। ঘাটের সিঁড়ির এক ধাপ নামলেই এখন পানির ছোঁয়া পাওয়া যায়। শীতের সময় একেবারে শেষ ধাপে নামতে হয়। বড় পুকুরের পাড় থেকে শ্যামল-ভুপেনের কথোপকথন কানে যেতেই ঘুরে সেদিকে তাকায় শিখা। শ্যামলকে পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মনে মনে হাসে। এত সকালে শ্যামলদা’র আসার কারণটা সে বোঝে এখন। যে ক’দিন বাড়িতে থাকে রোজ একবার হলেও শিখার সাথে দেখা হওয়া চাই-ই। কিন্তু আজ একেবারে সকাল হতেই হাজির! ঠিক এই সময় শ্যামলকে এখানে প্রত্যাশা না করলেও তাকে দেখে শিখার মনের আকাশেও রঙধনু হেসে ওঠে।
শিখা তখন কৈশোরের গ-ি পেরিয়েছে কী পেরোয়নি ঠিক করে মনে করতে পারে না, তবে ক্রমবর্ধমান চুলে বেণী-দুলিয়ে রঙিন ফ্রক পরে গাঁয়ের পথে ছুটে বেড়ানো বন্ধ হয়নি তখনও। সেই সময় থেকেই মাঝে-মধ্যে তার কল্পনায় ভাসতো লম্বা ছিপছিপে গড়নের উজ্জ্বল-শ্যাম বর্ণের তারুণ্যের দীপ্তি ছড়ানো এক নবীন যুবকের মুখচ্ছবি। সেই যুবকটি আর কেউ নয়, তার দাদার বন্ধু-শ্যামল। কখনো প্রকাশ করেনি সে, শুধু তাকে নিয়ে নিজের মনে একাকী স্বপ্ন বুনে চলেছিলো। তবে বছরখানেক আগের সেই-ঘটনায় শ্যামলের ভিতরের পরিবর্তনটা চোখে পড়ার পর শিখা আকাশে ঘুমন্ত মেঘরাশি থেকে ঝরঝর ধারায় নেমে এসেছিলো বৃষ্টি! শান্তির বারিধারা। সেদিন শ্যামল চলে গেলে অনেকক্ষণ রবিবাবুতে ডুবে ছিল সে, আর মনে মনে সাধছিলো- ‘আমারও পরান যাহা চায় তুমি তাই, তুমি তাই গো...।’
এই সাত সকালে তুমি আমগো বাড়ি! দাদা তো ঘরে নাই।’ ঘরের বারান্দায় শ্যামলকে দেখে বলে উঠলো শিখা। ঠোঁটের কোণে অন্যরকম একটা হাসির রেখা খেলা করছিলো। গভীর কালো চোখজোড়া নিজের অজান্তেই একটু নেচে উঠে স্থির হলো আবার। শিখার দাঁড়ানোর ভঙ্গি আর মুখে রহস্যময় হাসি দেখে শ্যামলের সংযমের বাঁধ ভেঙে গেল। সরাসরি তাকালো শিখার চোখের দিকে। তাকিয়েই থাকলো। সে চোখের দুর্বোধ্য ভাষা বোঝার আপ্রাণ চেষ্টায় বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল। তারপর শিখার চোখে চোখ রেখে মৃদু হেসে বলে উঠলো,
আইজ ঘুম থেইক্যা উইঠাই তোরে খুব দেখতে ইচ্ছা করলো।
আর গুল মারার জায়গা পাও না!
আমার কথা তোর বিশ্বাস অয় না?
শিখা আড়চোখে শ্যামলের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসে। শ্যামল আবার প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়Ñ কী রে, বিশ্বাস হয় না? হাঁ-সূচক মাথা নেড়ে ঘরের ভিতরে অদৃশ্য হলো শিখা। একটু পর ফিরে এসে বলল,
তুমি বও, আমি তোমার লাইগা নাস্তা নিয়া আইতাছি।
নাস্তা খাইতে পারি, তয় একটা শর্ত আছে।
নাস্তার আবার শর্ত কি?
আমি যতক্ষণ খামু, তুই আমার কাছে থাকবি।
ইস! আবদার। মানুষ কী ভাববে?
মানুষ আবার কী ভাববে? তোগো ঘরে মেহমান আসলে তারে কী আপ্যায়ন করোস না?
তুমি একটা পাগল।
সমস্যা কি? তুই এই পাগলের ডাক্তার হবি!
ইস! আমার বয়েই গেছে তোমার চিকিৎসা করতে।
তাইলে আর কী করা! এই পাগলের পাগলামি সহ্য করতে হবে।
আমার এত ঠেকা নাই। বলেই দৌড়ে ভিতরে পালালো শিখা।
শ্যামল খাচ্ছে, দরজার পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে শিখা। শ্যামল স্মিত হেসে বলল,
শোন, বাঙালি নারীদের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মেহমানদের যতœ করে আপ্যায়ন করা, পাশে বসে বাতাস দেয়া ইত্যাদি ইত্যাদি...
ইস! সাহেবের লোভ তো দেখি দিন-দিন বাড়তাছে। যাও, তাড়াতাড়ি খাইয়া ভাগো, আমার অনেক কাম আছে।
শ্যামল মৃদু হাসলো আবার।
তোর আবার কাম কি? সব কাম তো কাকীমাই করে। তুই তো খালি ফাঁকি মারোছ।
তোমারে কইছে!
তোর ক্লাস কেমন চলতাছে রে?
ভালো। শ্যামলদা, তুমি এইবার ঢাকা গেলে আবার কবে আইবা?
শ্যামল হাসে। প্রতিবার বাড়িতে আসলে শিখা এই প্রশ্নটা করবেই। হাসতে হাসতেই বললÑ পূজার ছুটিতে। আমার কথা তোর মনে পড়ে?
শিখা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর মৃদুকণ্ঠে বলল, -আমার মনে পড়া না পড়ায় তোমার কী আসে যায়, ঢাকায় তোমার আশেপাশে কত সুন্দরী মেয়েরা ঘোরে! তখন আমার কথা কী তোমার মনে থাকে?
হুম, ভার্সিটিতে অনেক সুন্দরী মেয়েই আছে। কিন্তু ভালোবাসার মানুষ তো ঐখানে নাই। তাই তো মনটা গ্রামেই পইড়া থাকে। তুই বুঝোস না?
শিখা কিছু বলতে নিয়েই আবার চুপ করে যায়। উঠান থেকে ঘরের দিকে হেঁটে আসছে তপন।
দাদা ফিরছে।
শ্যামল জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে দেখে একবার।
তুই বিকালে আমগো বাড়িতে আসিস।
আচ্ছা দেখি।
তপন ঘরে ঢুকে শ্যামলকে দেখে কিছুটা অবাক হয়।
কি রে, তুই এত্ত সকালে!
তোর লইগ্যা আধাঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করতাছি। কই গেছিলি?
রজনীকান্তের দীঘিতে গেছিলাম। আজকাইল চোরের সংখ্যা অনেক বাড়ছে রে শ্যালল। মাছ তো ধরেই, ইদানীং গাছও চুরি কইরা নিয়া যায়। আমি তো জঙ্গলের ভিতরে ঢুকি নাই, দীঘির পাড়েই অনেকগুলা কাটা গাছের গোড়া চোখে পড়ল। তোরা দুই ভাই বাড়িতে থাকোস না, আমি একলা তো সামাল দিয়া রাখতে পারতাছি না।
এইডা তো চিন্তার কথা! আমগো গোপাল আর তোগো ভুপেনরে মাঝে মধ্যে পাঠানো যায় না?
তা যায়, তয় অরা তো নানান কামে ব্যস্ত থাকে। সবসময় যাওয়ার সময় তো পাইবো না। যাইতে আসতেও তো আধাঘণ্টার বেশি সময় লাগে। 
বুঝছি, নিজেদেরকে আরও সতর্ক থাকতে অইবো। কাকুর লগে আলাপ কইরা দেখি।




সকাল থেকে ঘরের দরজায় চুপচাপ বসে আছে বিভা। প্রবল বৃষ্টিতে কাজে যেতে না পারায় গত কয়েকদিন অর্ধাহারে দিন কেটেছে ওদের। হারু গাজীর চালের আড়তেও কয়েকদিন ধরে কোনো কাজ নেই। নিজে না খেয়ে থাকলেও মেয়েটার দিকে তাকিয়ে পারু’র ঘরের দিকে পা বাড়ায়। বন্ধ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কয়েকবার ডাকাডাকির পর দরজা খুলে বেরিয়ে আসে পারু।
তোমার ঘুম ভাঙ্গাইয়া দিলাম পারু’বু, কী করুম? না ঠেকলে আইতাম না।
আরে এত কতা কইতে অইবোনা, কী হইছে খুইলা ক।
আইজ দুইদিন ধইরা ঘরে কিছুই নাই। নিজেরে নিয়া ভাবিনা; কিন্তু মাইয়াডার মুখের দিগে তাকাইতে পারি না।
আরে পাগলি, এমন কইরা কইতে অয়? তোরা না খাইয়া রইছস তয় আমার কাছে আইলি না ক্যান?
তোমারে আর কত জ্বালাইমু?
বিভা, এইডারে জ্বালান কয় না। আমিও তো চাচিরে অনেক জ্বালাইছি। তোর মা তোরে আর আমারে আলাদা কইরা দ্যাহে নাই। ভরা পেটে না পারি আধপেটা খাওয়াইতেও তো পারি!
মেম্বরের কলে ঘরের ভিডা হমান পানি উইঠা গ্যাছে, তাই হেয় কল বন্ধ রাখছিলো এতদিন। কাইল খুলবো। তুমি তো জান, কাম না করলে হেয় এক পয়সাও দেয়না। আইজ বিহালে হাডে যামু, দেহি একটা হাঁস বেচতে পারি কিনা। তাইলে কয়েকদিন চলন যাইব। 
এইভাবেই চলতে অইবো রে বইন। হাঁস মুরগিগুলান এই সময় তোর অনেক কামে দেবো।
, এইগুলান বেইচাই তো এই সময় চলি। ঘরের পাশেই তো জঙ্গল। গুইল, বেজি আর খাডাশের লইগা তো বেশি টেকে না।
অইগুলান তো তবুও নিজেরা বাঁচনের লইগা হাঁসমুরগির ছাও খায় কিন্তু মানুষের লোভ তো আরও বেশি। এগো যার যত বেশি আছে যেন আরও বেশি কইরা চায়। তুই ব’, আমি আইতাছি।
পারুবু, তুমি না থাকলে আমি কবেই ভাইসা যাইতাম!
আমরা একলগে বড় অইছি না? আমি থাকতে তুই ভাইসা যাইবি ক্যান? আমারও কেউ নাই, তোরও কেউ নাই। আমরা একলগেই যুদ্ধ কইরা বাইচা থাকুম।
প্রভা প্রতিনিয়তই দেখে ওকে নিয়ে মায়ের বেঁচে থাকার যুদ্ধ। মনে মনে ভাবে আজ বাবা বেঁচে থাকলে আমাদের এত কষ্ট হতো না। বাবার চেহারাটা অস্পষ্টভাবে মনে ভাসে। তখন ওর বয়সই বা কত? পাঁচ কী ছয়।
মা, তুমি কত কষ্ট কর! বাবা বাইচা থাকলে আমগো এত কষ্ট করতে অইত না, আমগো কপালডাই পোড়া।
সুখ ভাগ্যে না থাকলে মানুষের কী করনের আছেরে মা?
বিভা একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। চোখে ভেসে ওঠে সাত বছরের আগের দৃশ্যপটÑ
ঝড়, ভাঙন যেন ওকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে। উজানিচর থেকে শ্যামলপুর; এখানেও সেই ঝড় আবার ওর সর্বস্ব কেড়ে নিল। নদীভাঙা অঞ্চলের মানুষ; নদীকে অবলম্বন করেই বেঁচে থাকে। তাইতো অসীম উজানগাঙকেই বেছে নিয়েছিলো নিজের জীবিকা হিসেবে। মাছের কোনো কমতি ছিলনা নদীতে, কেবল প্রয়োজন ছিল পরিশ্রমের। অসীমের পরিশ্রমের বলেই টিকে ছিল ওরা। প্রতিরাতে লুঙ্গির কোচায় গুজা টাকা আর খালুই ভর্তি মাছ নিয়েই ফিরতো অসীম। বিভার সংসার সুখে ভরে উঠেছিলো। কিন্তু সেই সুখ বেশিদিন স্থায়ী হলো না। কথায় আছে, সুখ যার ভাগ্যে নেই তাকে সুখী করে সাধ্য কার? আবারও ঝড়, নদী- সর্বগ্রাসী! সবকিছু কেড়ে নেয়।
সে রাতে প্রচ- ঝড় ছিল। বিভার বুকের ভেতরটা কেবলই কেঁপে কেঁপে উঠছিল। ফুঁসে ওঠা উজানগাঙ যেন এক নিষ্ঠুর খেলায় মেতে উঠেছিল। ধ্বংস, ভাঙন, সব হারানো- এই যেন নিয়তি। যুগ যুগ ধরে চলে এই ভাঙনের খেলা। নদী ভাঙে, সেই সাথে ভাঙে নদী পাড়ের মানুষের বুক। ধুলিসাৎ হয় তাদের স্বপ্ন, বাঁচার আশা। জীবিকার সন্ধানে মানুষ ছোটে এখানে থেকে ওখানে, নতুন আশায় বুক বাঁধে। ঝড়, বন্যা, নদী ওদের সব কেড়ে নেয়। কিছুই করার থাকে না, শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
নির্ঘুম সে রাতের শেষে বিভা ফিরে পেয়েছিল একটি বিধ্বস্ত সকাল। গ্রামের সর্বক্ষেত্রেই শুধু ধ্বংসের চিহ্ন। বড় বড় গাছ উপড়ে পড়ে আছে, কারো ঘর ভেঙে গেছে। কারো ঘরের চাল, টিন উড়ে গেছে অন্য কোথাও। নদীর পাড়েও ঝড়ের ধ্বংসলীলা। এক রাতে নদীর চেহারা বদলে গেছে একেবারেই। সকাল হতেই বিভা ছুটে গিয়েছিল নদীর পাড়ে।
অনেকে বলছিল, ‘কাইল রাইতে নদীতে অনেক নাও ডুইবা গ্যাছে’। বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠেছিল বিভার। প্রভার বাপের কিছু হয় নাই তো! কাজেম মাঝিকে দেখে বুকে একটু সাহস পেয়েছিল।
চাচা, কাইল নাকি নদীতে অনেক নাও ডুইবা গ্যাছে?
, হুনলাম তো। তুই চিন্তা করিস না, অসীমের কিছু অইবো না। ওরা সবাই খুব ভালো নাও বায়। এর আগেও অনেকবার এইরহম ঝড়ের মধ্যে মাছ ধরছে। নিশ্চয়ই কোনোহানে নাও ভিড়াইয়া রাখছে। এহন তো ঝড় থাইমা গ্যাছে, ফিরা আইবো। যা, বাড়ি যা।
বাড়ি ফিরে এসেছিলো বিভা। সারাদিন কেটে যায়, চিন্তার জায়গায় ভর করে ভয়। একে একে গফুর, ছমির, পরান ও মালেকের বাড়িতে খোঁজ নিয়ে দেখে কেউ ফেরেনি। সন্ধ্যার একটু আগে খবর আসলো ছমির ফিরেছে। প্রচ- উৎকন্ঠা নিয়ে ছুটে গিয়েছিল ছমিরের বাড়ি। ছমির উঠানে পা ছড়িয়ে বসে ছিলো, বিধ্বস্ত চেহারা। ছমিরের সামনে গিয়ে বসে পড়েছিল বিভা।
ছমির ভাই, তুমি একলা! প্রভার বাপ কই?
ছমির জবাব দিতে পারেনি কোনো। নির্বাক বসেছিলো কাঠের খোঁদাই করা মূতির্র মতো- স্থির দৃষ্টিতে। কয়েক মুহূর্ত পর ভাষাহীন দু’চোখ দিয়ে শুধু গড়িয়ে পড়েছিলো কয়েক ফোঁটা অশ্রু।
বিভা বুঝে গিয়েছিল এতদিনের দেনা পাওনা কড়ায়গ-ায় উশুল করে নিয়েছে উজানগাঙ। আবার সেই ঝড়! সর্বনাশা নদী! দুই চোখে অন্ধকার নেমে এসেছিল সেদিন; টলতে টলতে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। সবাই ধরাধরি করে নিয়ে গিয়েছিল ছমিরের ঘরে। জ্ঞান ফিরে এলে প্রভাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল বিভা। তারপর অসীমের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
একরাশ বেদনার অকূল-পাথারে বিভাকে ভাসিয়ে চলে যায় অসীম। হতদরিদ্র এক মা তার একমাত্র কন্যার জন্য দু’মূঠো অন্ন যোগাতে ছোটে মানুষের দ্বারে দ্বারে। ঝড় আসে, ঝঞ্ঝা আসে; ফিকে হয়ে আসা স্বপ্নগুলো একেবারেই হারিয়ে যায় জীবন থেকে। সহায় সম্বলহীনা বিভা সাত বছর ধরে মেয়েটাকে নিয়ে নিরন্তর সংগ্রাম করে টিকে আছে। সম্পূর্ণ একা।




কোটাখালী খালের উপরে কাঠের ব্রিজটা অয়নের ভীষণ প্রিয়। ওদের বাড়ির ভেতর থেকে বেরুনো পথটা বড় রাস্তার সাথে মিশে সোজা এই ব্রিজের কাছটায় এসে শেষ হয়েছে। রাস্তাটার দু’পাশে রেইন-ট্রি, কড়ই, কৃষ্ণচূড়া, চাম্বল, তাল, খেজুর আর কলাগাছের সারি। এই বর্ষায় দু’দিকের বাড়িগুলো আর রাস্তার মাঝখানের ফাঁকা জমিতে থৈ-থৈ পানি, যেন উজানগাঙকেও হার মানায়। সেই দিগন্ত বিস্তৃত ফাঁকা জায়গা জুড়ে সবুজের ছড়াছড়ি আর বক-সারসের মেলা। এতকিছুর মাঝে অয়নের মন কী ঘরে থাকে? সকাল-বিকেল ছোটদি’র সাথে ছুটে যায়। ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে দেখে খালের ঘোলাজলের ঘূর্ণির মধ্যে কেমন হারিয়ে যায় সবকিছু। খালের ওপারে হরিপদ ঘোষের বাড়িটাও ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। ও-বাড়ির সুবলের সাথে যে ওর খুব ভাব।
এখন শ্রাবণ মাস। কখনো কখনো সারাদিন ঝরে, আবার একটু পরই দেখা যায় ঝলমলে রোদ হেসে উঠেছে। এই রোদ-বৃষ্টির খেলাটা অয়নের দারুণ লাগে। আজ সকাল থেকেই মেঘলা আকাশটা বলে দিচ্ছে যে কোনো সময় ঝুপ করে নামবে। এই সময় অয়নের ঘর থেকে বেরুনো একদম বারণ। ছোটদি’র কড়া চোখের দৃষ্টি এড়িয়ে মাঝে মধ্যেই বেরিয়ে পড়ে ও। সুযোগ বুঝে ছোটদি’র মন গলিয়ে সঙ্গে নিয়ে নেয়।
বেলা পড়ে এলে মেঘ কেটে যায়। অয়ন ছোটদি’কে খোঁজে। বকুল বুঝে যায় ছোট্ট ভাইটির তাকে খোঁজার কারণ। তারপর আর কি? দু’জনে মিলে ছোটে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা কোটাখালী ব্রিজ।
বিকেল হলেই সূর্যটা যেন খুব দ্রুত নেমে যেতে থাকে পশ্চিমে। বেলা শেষের দিকে জোয়ারের পানি এসে কোটাখালী খালটা কানায় কানায় ভরে ওঠে। ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে অয়ন প্রায়ই ভাবে এত পানি কোথা থেকে আসে? ছোটদি’কে জিজ্ঞেস করলে বলেÑ নদী থেকে; কিন্তু অয়ন ছোটদি’র কথায় ঠিক ভরসা পায়না। ভাবে, একদিন বাবাকে জিজ্ঞেস করে ঠিকই জেনে নেবে ও।
স্কুলজীবন শুরু করার পর থেকে অয়নের ছোট্ট জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আগের চেনাজানা ক্ষুদ্র গ-িটা বড় হয়েছে ডালপালা ছড়িয়ে। ওর পরিচিত মানুষের তালিকায় যোগ হয়েছে অনেক নতুন মুখ। স্কুলে বন্ধুদের সংস্পর্শে এসে সময়টুকু কখন যে শেষ হয়ে যায় টেরই পায়না। হেড স্যারের ছেলে হওয়ায় বড় ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীরা ওকে নিয়ে আড়ালে আবডালে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে, ও ঠিকই শুনতে পায়। তখন মা’র কথা খুব মনে হয়। মনে আছে ও যেদিন প্রথম স্কুলে এলো, মা ওকে কাজল পরিয়ে দিয়েছিলেন। ছোটদি’র একটা কাজলদানি আছে, পিতলের। দুইদিক দিয়ে চাপ দিয়ে ওটা খোলা ও বন্ধ করা যায়। মা কাজল পরিয়ে দিতে দিতে বলেছিলেন- ‘আমার বাছার যেন কারো নজর না লাগে’। সেদিন খুব সকালে উঠে ওর জন্য খেজুরের রসের পায়েস করেছিলেন মা। সেই পায়েস খেয়ে বাবার হাত ধরে স্কুলে এসেছিল ও।
ওদের ক্লাস টিচারের নাম জগানন্দ বসু। সবাই বলে বসু স্যার। অয়নকে খুব আদর করেন। স্কুলে ভর্তির আগে বাবার কাছে ওদের বাড়িতে যখন যেতেন, অনেক মজার মজার গল্প শোনাতেন। ইসমাইল স্যারকে স্কুলের সবাই খুব ভয় পায়। পিটির সময় মাঠের মধ্যে জোড়া বেত নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। স্যারের ভয়ে কেউ পিটিতে অনুপস্থিত থাকে না। বড় ক্লাসের ছাত্ররা যখন স্যারদের সামনে গিয়ে জাতীয় সঙ্গীত গায়- আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি, চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস... বাবা কেমন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন। তখন দেশকে নিয়ে বাবার কথাগুলো খুব মনে পড়ে ওর। বাবা সবসময়ই বলেন- দেশকে ভালোবাসবে, দেশ হচ্ছে মা।
অয়নদের ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা মোট পঁচিশ জন। একপাশে ছেলেরা আর অন্যপাশে মেয়েরা বসে। ইসমাইল স্যার ক্লাসে আসলে রুমের ভেতর নেমে আসে পিনপতন নীরবতা, একটু আগের হই-হুল্লোড় এক নিমেষেই বন্ধ হয়ে যায়। ওদের ক্লাসে স্যার কখনো বেত নিয়ে আসেন না, তবুও সবাই স্যারকে খুব ভয় পায়। সামনের ব্লাকবোর্ডের সংখ্যাগুলো সব খাতায় লিখে ফেলেছে অয়ন। রাজু সুবলের সাথে ফিসফিস করে কথা বলছে। ও স্কুলের জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। স্কুলঘরের ঠিক উল্টাদিকে একটা উঁচু রাস্তা সোজা সামনের দিকে চলে গেছে। অয়নের খুব জানতে ইচ্ছে করে ওদিকটায় কী আছে। একদিন ও ঠিকই যাবে ওদিকে।
বাড়ি থেকে অয়নের স্কুল বেশি দূরে নয়। এটুকু পথ হেঁটে আসা যাওয়া করতে ওর বেশ লাগে। স্কুলে যাওয়া শুরু করার পর ওর বেশ কিছু বন্ধু জুটে গেছে। ক্লাসের বন্ধুদের মধ্যে সুবল আর মিরাজের সাথেই ভাব বেশি। তিনজনের বাড়ি কাছাকাছি; স্কুল ছুটি হলে ওরা কোটাখালী খালের পাড়ের সরু রাস্তা ধরে একসাথে বাড়ি ফেরে। মেঠোপথ ধরে যখন হাঁটে, ওর চোখে পড়ে খালের ঘোলা জলের মধ্যে হাঁসগুলি ভেসে বেড়ায় মনের আনন্দে। অদ্ভুত সুন্দর মাছরাঙাটা জলের মধ্য থেকে একডুবে মাছ তুলে নিয়ে বসে পড়ে পাশের ঝোপঝাড়ের কচি ডালে।
এই খালটা উজানগাঙ থেকে শ্যামলপুর আর সুবর্ণপুর গ্রামের মাঝখান দিয়ে ঢুকে পড়েছে। তারপর শ্যামলপুরের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেকে গ্রামের শেষ প্রান্তে চলে গেছে। এখানটায় খালটি বেশ চওড়া, গভীরতাও অনেক বেশি। মাঝে মাঝে বেশ স্রোত থাকে খালে। বর্ষার সময়ে দু’পাড়ের সরু কাঁচা রাস্তা দুটি বাদ দিলে খাল আর ধানী জমিগুলো সব পানিতে একাকার হয়ে যায়। মাছ আটকানোর জন্য কিছুদূর পর পরই খালের পাড়ঘেঁষে বাঁশের ঘের দিয়ে তার মধ্যে বেশ কিছু ডালপালা ফেলে রাখা হয়েছে। স্থানীয় ভাষায় একে বলে- ঝাউ; দেখতে অনেকটা আধখানা চাঁদের মতো। শুকনো মৌসুমে যখন খালের পানি কমে যায়, তখন এই ঘেরের চারপাশে জাল দিয়ে আটকে মাছ ধরা হয়।
স্কুল থেকে এই রাস্তা ধরে বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেলে খালের পাড় ঘেঁষে তালুকদারের হাটখোলা। এটা নিয়মিত কোনো হাট নয়। কয়েকটা ছোট টং দোকান আর একটা ধান ভাঙানোর কল থাকায় এখানে প্রায় সময়ই লোকজনের আনাগোনা থাকে। শোনা যায়, খালেক তালুকদারের দাদা সিরু তালুকদার এখানে প্রথম একটা ধান ভাঙানোর কল বসায়। আশেপাশের এলাকার লোকজন এই কোটাখালী খাল দিয়ে নৌকায় করে ধান এনে এখানে ভাঙাতো। ধীরে ধীরে লোক সমাগম বাড়তে থাকে; অতঃপর ধানের কলের চারপাশে কয়েকটি চা-পানের দোকান গড়ে উঠলে অবসর সময়ে গ্রামের কিছু লোক এখানে এসে বসতো। এভাবেই একসময় লোকমুখে এই জায়গাটা তালুকদারের হাটখোলা নামে পরিচিতি পায়। খালের পাড়ে ছোট্ট একটি টিনের ঘর, লোকে বলে ক্লাবঘর। স্কুল থেকে ফেরার সময় প্রায় প্রতিদিনই ঐ ঘরটা থেকে অয়ন চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পায়। মাঝে মাঝেই খোলা দরজা দিয়ে দেখে কিছু লোক ওখানে বসে তাস খেলে।
হাটখোলা ছাড়িয়ে কোটাখালী ব্রিজের কাছাকাছি পৌঁছুতেই পূজা ম-পটি চোখে পড়ে অয়নের। বাঁশের খুঁটির উপর ছনের ছাউনি আর দু’পাশে চাটাইয়ের বেড়া দেয়া ম-পটিতে কয়েকটি মূর্তি সবসময়ই থাকে। আশপাশের হিন্দু বাড়ির লোকজন সকাল-সন্ধ্যা এখানে পূজা করে। এলাকার লোকজন এই ম-পের জায়গাটিকে বলে কালীখোলা। কালীখোলার কাছাকছি আসতেই অয়নের খুব ভয় লাগে। ছোটদি একদিন বলেছিল সাঁঝবেলা একলা কালীখোলার কাছাকাছি না আসতে। ও কখনো এখান দিয়ে একা যেতে পারে না। ওদিকে তাকালেই মনে হয় ম-পের বেড়ার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড় করানো মূর্তিগুলি ওর দিকেই তাকিয়ে আছে, যেন এখনই তেড়ে আসবে। বিশেষ করে যে কালো মূর্তিটি খড়্গ হাতে নিয়ে একটি লোকের বুকের উপর পা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। সুবলকে মূর্তিগুলো দেখিয়ে অয়ন বলে,
দ্যাখ, ঐ মূর্তিডা জিব্বা বাইর কইরা ক্যামন হা-কইরা চাইয়া আছে! তোর এইগুলি দেইখা ডর লাগে না?
ক্যান? ডর লাগবো ক্যান? ইনি তো আমগো মা! আমি তো মাঝে মধ্যেই কাকীর লগে সাঁঝের বেলা এইহানে আহি, কাকী মায়ের পূজা দেয় আর আমি দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া দেহি।
তোর ডর লাগে না মিরাজ? এবার মিরাজকে জিজ্ঞেস করে অয়ন।
সবাই একলগে থাকলে লাগেনা, তয় একলা স্কুলে যাওনের সময় একটু একটু ডর লাগে।
সুবল বেশ অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বলে- তোরা কী যে কস! আমি তো এইহানে সন্ধ্যার পরও একলা আইতে পারুম।
তোর অনেক সাহস!
এইহানে সাহসের কী অইলো? উনারা তো আর ভূত-পেতœী না যে ডরামু? কাকু কইছে যহনই ডর লাগবো মা কালীর নাম নিবি, দেখবি ভগবানের কৃপায় কিছু অইবো না।
থাউক ভাই, আমার এত সাহসের দরকার নাই। আমি এইহান দিয়া কোনোদিনও একলা একলা যামু না। অয়ন বলে।
তোরা এহনও পোলাপানই রইয়া গেছস। অনেকটা বড়দের মতো করে বলে সুবল।
, তুই তো বুইড়া হাবড়া অইয়া গেছস! তাইলে হাফ প্যান পরস ক্যান?
আমি হাফ প্যান পরি আর যাই পরি তোগো মতোন ডরাই না।
আরে থামতো তোরা। বড় অইলে দেখবি কাউরও ডর লাগবো না। অয়ন আর সুবলের ঝগড়া থামাতে মিরাজ বলে ওঠে।
তিনজনে হেঁটে কোটাখালী ব্রিজের কাছে চলে আসে। সুবল ডান দিকের রাস্তায় নেমে বাড়ির পথে চলে গেলে অয়ন আর মিরাজ কাঠের ব্রিজ পার হয়ে কাঁচা রাস্তা ধরে সোজা অয়নদের বাড়ি বরাবর এগিয়ে চলে। অয়নদের বাড়ি পার হয়ে আরও বেশ কিছুটা পথ সামনে এগোলেই মিরাজের মামাবাড়ি। গতবছর ওর মা মারা গেছে, তারপর থেকে মামাবাড়িতেই থাকে মিরাজ।
তোর মা’রে মনে পড়ে না? মিরাজের উদ্দেশ্যে বলে অয়ন।
মিরাজ কিছুটা আনমনা হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর বলেÑ , খুব মনে পড়ে। দুফুরবেলা মায়ের লগেই তো ঘুমাইয়া আছিলাম, ঘুম থেইক্যা উইঠা দেহি মায় নাই।
তোর বাবা তোরে দ্যাখতে আহে না?
বাবার প্রসঙ্গ আসতেই মিরাজ হঠাৎ চুপ হয়ে যায়। অনেকক্ষণ পর গম্ভীরভাবে বলে- ‘না’। এরপর বাকি পথটুকু নিঃশব্দেই পার হয়ে যায়, কেউ আর কোনো কথা বলে না। 
সুবল বাড়িতে ঢুকে মা’কে খুঁজতে লাগলো। বড় ঘর, পাকের ঘর, ঠাকুর ঘর, কোথাও খুঁজে না পেয়ে শেষমেষ গোয়াল ঘরের পাশে এসে পেল। ওখানে দাঁড়িয়ে ভাসানির মা’র ঘুটে বানানো তদারকি করছেন মা।
তুমি এইহানে? তোমারে কত জায়গায় খোঁজ করলাম!
ক্যান বাবা, কী অইছে? একবেলা মা’রে দেখতে না পাইয়াই এত অস্থির হইলি, মা না থাকলে কী করবি?
দূর, তুমি কী যে কও না! তুমি আবার কই যাবা? মা ক্ষিদা লাগছে, খাইবার দাও।
একটু দাঁড়া বাবা, এই ঘুইটে কয়ডা বানানো শ্যাষ হউক।
ডানদিকে চোখ পড়তেই সুবল দেখে বাড়ির পাশের নালায় কচুরিপানা আর নল-খাগড়ার মধ্য দিয়ে গরুর জন্য ঘাসভর্তি ডোঙাটা গোয়ালঘরের কিনারে ভিড়াচ্ছে কাকু। শুকনো মৌসুমে পানি শুকিয়ে গেলে এই নালায় অনেক মাছ পাওয়া যায়। এখন বর্ষার সময়ে পাশের জমিগুলোর সাথে মিলেমিশে কেমন একাকার হয়ে আছে। সুবল ছুটে গিয়ে পাড়ে দাঁড়ায়।
কিরে ব্যাডা, খালি বাড়ি বইয়া থাকলে অইবো? কাম করন লাগব না? হাসতে হাসতে বলে তারাপদ।
আমি তো এহন স্কুল থেইক্যা আইলাম। আমি কী এইগুলান পারি? বড় হইয়া নেই, দেইখো তোমার মতোন সব পারুম।
ও আইচ্ছা, আমার বাজানের তো আবার স্কুল আছে। থাউক, তোর এইগুলান করতে অইবো না। তুই অনেক বড় হ, বাপ।
হরিপদ আর তারাপদর যৌথ সংসারে হরিপদ পারিবারের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্নের ব্যবসাটা অব্যাহত রেখেছেন, আর তারাপদ পৈত্রিক-সূত্রে প্রাপ্ত জমিজমাতে চাষবাসের কাজটা দেখাশোনা করে বেশ ভালোভাবেই। দু’ভাইয়ের মধ্যে বেশ মিল। তারাপদ দাদা বলতে অজ্ঞান। আজ পর্যন্ত হরিপদর অবাধ্য হয়নি কোনোদিন। হরিপদও ছোট ভাইকে নিজের থেকে আলাদা করে দেখেননি কখনো। হরিপদর দুই ছেলে শ্যামল আর সুবল। একমাত্র মেয়ে মালতির বিয়ে হয়েছে দু-মাস হলো মাত্র। তারাপদর একটি মাত্র ছেলে তাপস; শ্যামলের সাথে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে শ্যামলের দু-ক্লাস নিচে, আর মেয়ে চারুলতা শ্যামলপুর হাই স্কুলে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী। দুই জায়ের মধ্যেও দারুণ ভাব। ছোট-জা বিজয়া বড়-জা সুরবালাকে আজও বড় বোনের মতোই শ্রদ্ধা করে। ব্যবসা আর জমিজমার কল্যাণে তাদের আর্থিক স্বচ্ছলতার কমতি হয়নি কোনোদিন।
এ বছর আউশ ধানের ফলন বেশ ভালো হয়েছে। উঠানের অনেকটা স্থান জুড়ে ধানের স্তূপ জমে আছে যেগুলো মাড়ানো খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। বাংলাঘরে বলতে গেলে হাঁটার জায়গা নেই। কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে এগুলো সময়মতো মাড়ানো হয়নি। আজ অনেকদিন পর রোদ উঠেছে। তারাপদ ঠিক করে আজ বিকালে ধান মাড়ানো শুরু করবে।
বিজয়া ভাসানির মাকে দিয়ে গোবর আর ধানের কুড়া দিয়ে উঠানটিকে ধান মাড়ানোর উপযোগী করে তুলছে। কিছুক্ষণ পর সুবল এসে জিজ্ঞেস করে,
কাকী এইগুলান দিতাছ ক্যান? এইহানে কী করবা?
আইজ তোরে বিয়া দিমু, বিজয়া দুষ্টুমি করে বলে।
যাও! তুমি খালি ফাইজলামী কর।
ক্যান, তুই কোনোদিন বিয়া করবি না?
হেইডা তো অনেক বড় অইয়া।
হুম, তোর তো অনেক বুদ্ধি! তাইলে চিন্তা কইরা বাইর কর আইজ এইহানে কী করা অইবো। বিজয়া হাসে।
সুবল লজ্জা পেয়ে দৌড়ে পালায়। বিজয়া এভাবেই সবাইকে হাসি ঠাট্টায় মাতিয়ে রাখে সারাক্ষণ। একমাত্র ভাসুর হরিপদ ছাড়া অন্য সবার সাথে ওর সম্পর্কটা এমনই। এজন্য এ বাড়ির প্রত্যেকের কাছে একজন প্রিয় মানুষ- বিজয়া।
সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়লে গোপাল উঠানের মাঝে একটি বাঁশ গেড়ে দেয়। শুরু হয়ে যায় ধান মাড়াইয়ের কাজ। ছমির আর জগাই ঘরের সামনের স্তূপ থেকে ধান এনে বাঁশের চারপাশে ছড়িয়ে দেয়। গোপাল চারটা গরুকে একসাথে বেঁধে ধান মাড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করে। সুবল খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করে ওদের কাজ। ওর মনে পড়ে গত শুকনো মৌসুমে এভাবেই কয়েকদিন ধান মাড়াই করা হয়েছিল। সে-বার রাতে হ্যাজাক বাতি জ্বালিয়ে চলেছিল ধান মাড়াইয়ের কাজ। গরুর পিছু পিছু ও অনেকক্ষণ হেঁটেছিল।
উঠানে ছড়ানো ধানের উপর দিয়ে গরুগুলো বাঁশটির চারপাশে ঘুরতে থাকে। ছমির ও জগাই ধানের ছড়াগুলোকে উল্টেপাল্টে দেয় বার বার। সুবল যেন ওর আসল মজাটা পেয়ে যায়। গরুগুলোর পেছন পেছন ছুটতে থাকে। সন্ধ্যার মধ্যে উঠানে রাখা ধানের স্তূপগুলো শেষ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ বিশ্রাম দিয়ে শুরু হয় বাংলাঘরের ধান মাড়ানির কাজ। ঘরের সামনে ঝোলানো বাল্বটি বাড়তি তারের সাহায্যে উঠানের মাঝখানে আনার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
যতই বিদ্যুতের বাতি জ্বালানো হোক, রাতের অন্ধকার দূরীভূত হয় সামান্যই। এই স্বল্প আলোতেই আবার শুরু হয় ধান মাড়াইয়ের কাজ। কিছুক্ষণ পর যথারীতি বিদ্যুৎ চলে যায়; এটা যেন নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। গোপাল আগে থেকেই হ্যাজাক বাতিটা তৈরি রেখেছিল। এবার ওটা জ্বালিয়ে দেয়। সুবলের কাছে এই হ্যাজাক বাতির ঝলমলে আলোটা খুব ভালো লাগে। দেখতে হারিকেনের চেয়ে বেশ বড় আর কাঁচের ভিতরের ধবধবে উজ্জ্বল আলোটা কেমন চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। এখন চারদিকটা যেন আরও বেশি উজ্জ্বল। খড়ের মধ্যে সুবলের লাফালাফি দেখে তারাপদ বলে- বাজান, খ্যাড়গুলান গায়ে মাইখো না, শরিল চুলকাইব। সুবল উঠে দাঁড়ায়। কাকু’র যে কোনো উপদেশ সে বিনা দ্বিধায় মেনে নেয়। সামনে তাকিয়ে দেখে ঘরের সিঁড়ির উপর বসে আছে চারুদি। সুবল চারুর পাশে গিয়ে বসে। ঘরের সামনের হাস্নাহেনা গাছটা থেকে ভেসে আসছে মাতাল করা সুন্দর গন্ধ। এই গাছটা চারু লাগিয়েছে। নিয়মিত যতœও নেয় ও। চারু বাড়িতে না থাকলে অবশ্য বিজয়া যতœ নেয়। অন্ধকার আকাশে তারার দেখা নেই কতদিন! সুবল চারুকে বলে,
দ্যাখ ছোটদি, আকাশটা ক্যামন ঘুডঘুইটে অন্ধকার।
হুম, এহন আমাবস্যা চলতাছে তাই অন্ধকার; চারু জবাব দেয়।
সুবল কান পেতে শোনে গোয়ালঘরের পাশের গাছগুলোর মধ্যে থেকে থেকে ব্যাঙ ডেকে চলেছে, আর তুলশী তলার পাশের পাতাবাহার গাছগুলোর ভেতর থেকে একটানা ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁপোকার ডাক।





ভোরের প্রথম আলোর ছোঁয়ায় প্রকৃতি জেগে উঠছে নতুন করে। আশপাশের গাছপালা সবুজ রঙ ছড়াতে শুরু করেছে মাত্র। সকালের এই চমৎকার ঠা-া বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। সূর্য ওঠার আগের এই সময়টাতে বেড়াতে ভীষণ ভালো লাগে বকুলের। শ্রাবণের আকাশের মতো মেঘের ঘনঘটা আর দিনভর ঝুমঝুম বৃষ্টি এখন আর দেখা যায় না, তবে শেষরাতে যে হালকা বৃষ্টি হয়ে গেছে প্রকৃতিতে তার রেশ রয়ে গেছে এখনো। আশেপাশের গাছপালা আর ঝোপঝাড়গুলো এখনো ভেজা, অনেকটা সদ্য স্নান শেষে গ্রাম্য কিশোরীর ভেজা চুলের মতো। প্রতিদিনের মতো আজও ঘুম থেকে উঠে মন ভালো হয়ে গেল বকুলের। এই নির্মল ঠা-া বাতাসে রোজই বেড়ানো হয় তবুও সবসময়ই যেন নতুন করে অনুভব করে এই স্নিগ্ধ সকালটাকে। কখনোই পুরনো লাগে না। ঘর থেকে বেরিয়ে উঠানে এসে দাঁড়াল বকুল। বড় রাস্তার দিকে দৃষ্টি পড়তেই দেখতে পায় অনেকগুলো চাঁই হাতে মন্টু মামা ভেতর বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। বকুল পুকুরের ঘাটে গিয়ে বসে। মন্টু মামা কাছাকাছি আসতেই দেখে প্রতিটা চাঁইয়েই ভালো পরিমাণ মাছ আটকা পড়েছে। বকুলকে দেখে মন্টু বলে ওঠে,
কী ছোডো বুড়ি, উইঠা পড়ছ
হুম, আইজ অনেক মাছ উঠছে তো মামা!
আইজ কয়ডা বেশি মাছ পাইলামরে মা।
দেহি তো কী কী মাছ পাইলা।
তোমার পছন্দের বাইলা ও ইচা মাছই বেশি উঠছে আইজ।
রাস্তায় কী অনেক কাদা মামা?
না খুব বেশি না, পাশের ঘাসের উপর দিয়া হাঁটন যায়। তুমি কী বড় রাস্তার দিগে যাইবা?
হ যামু, খাড়াও অয়ন এহনও ওডে নাই, ওরে তুইলা নেই।
তুমি তুলতে গেলেই তো ক্ষ্যপব!
ক্ষ্যাপুক, একটু পরেই আবার ঠিক অইয়া যাইব।
মন্টু হেসে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। দিনের বেশির ভাগ সময়ই লেগে থাকে ওদের খুনসুটি। একটু পর পরই অয়ন বোনের বিরুদ্ধে নালিশের ঝুড়ি নিয়ে হাজির হয় মায়ের কাছে। তারপর মায়ের বকুনি খেয়ে মান-অভিমানের পালা শুরু হয় দু’ভাই-বোনের। অবশ্য বেশিক্ষণ না, কিছুক্ষণ পর আবার স্বাভাবিক। অয়নকে ঘুম থেকে জাগাতে শুরু হয়ে যায় বকুলের স্বভাবসুলভ দুষ্টুমি।
অয়নের ঘুম ভেঙ্গে গেছে কিছুক্ষণ আগে। বিছানা থেকে নামার কথা ভাবতেই ছোটদি’র ডাক শুনতে পেল। ইচ্ছে করে ঘুমের ভান করে শুয়ে আছে ও। একটু পরই পানির ফোটা এসে লাগে চোখে মুখে। এক লাফে বিছানা থেকে নেমে ছোটদি’কে তাড়া দেয়। ঘরের দরজায় আসতেই দেখে ছোটদি পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। অয়নও ছাড়ার পাত্র নয়, বাইরে এসেই চেলাকাঠ নিয়ে তেড়ে যায় বকুলের পিছু পিছু। দুজনেই পুকুরের পাড় ধরে বড় রাস্তার দিকে দৌড়ায়। সালমা বেগম পেছনে দাঁড়িয়ে হাসেন, এ তো ওদের নিত্যদিনের চিত্র!
বকুলের সাথে তাল মিলিয়ে ছুটতে গিয়ে একসময় হাঁপিয়ে ওঠে অয়ন। হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায়।
ছোটদি খাড়া।
আমারে আর মারবি?
না, মারুম না। এই দ্যাখ, লাডি ফালাই দিলাম।
বকুল ভাইয়ের কাছে এগিয়ে আসে। দু’জনের পায়ে গতরাতে বৃষ্টিতে ভেজা রাস্তার কাদা লেগে আছে। ঘাসে কাদা মুছে দুই ভাই বোনে সামনে এগিয়ে চলে। ঘন সবুজ গাছ-গাছালিতে ঢাকা বাড়িটার পুর্ব দিকে বের হওয়া বড় রাস্তাটা ধরে ওরা ছুটতে থাকে কোটাখালী ব্রিজের দিকে। অয়নের ভালো লাগার জায়গাটা বাড়ি থেকে এই ব্রিজ পর্যন্ত বিস্তৃত। সারা বাড়িময় ছড়ানো বড় বড় গাছ, পুকুর, উঠোন, আর এই সবুজ ঘাসে ছাওয়া চওড়া রাস্তাটাই ওর জগৎ। রাস্তার দু’পাশের সবুজের সারি ওর মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে সারাক্ষণ। খালের পাড়ে; একেবারে ব্রিজের পাশ ঘেঁসে লম্বা তালগাছটি অয়নের খুব প্রিয়। ওদের বাড়ির সামনের রাস্তা থেকেই দেখা যায় এটি। ওখানে দাঁড়িয়ে গাছটির উঁচু ডালে ঝুলন্ত বাবুই পাখির বাসাগুলোতে প্রায়ই ওর দৃষ্টি আটকে যায়। গাছ থেকে একদিন একটি বাসা নিচে খসে পড়েছিল। অয়ন ওটা হাতে নিয়ে দেখেছে কী সুন্দর নিখুঁতভাবে তৈরি করা হয়েছে ওগুলো! নরম, তুলতুলে।
প্রতিদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে এই কাঠের ব্রিজ পার হয়েই বাড়ি ফিরে অয়ন। সুবল আর মিরাজের সাথে ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে কতদিন খালের মধ্যে মানুষের মাছ ধরা দেখেছে! এখানটায় এসে দাঁড়াতেই মনে হয় যেন বাড়িতে পৌঁছে গেছে ও।
ব্রিজের কাছে আসতেই চোখে পড়ল খালে পাতা ভেসাল জাল দিয়ে মাছ ধরছে গোপাল। পাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন হরিকাকা। হরিকাকাকে দেখে অয়ন বড় রাস্তা থেকে নেমে তাঁর দিকে এগিয়ে যায়।
ও কাকা, অনেক মাছ পড়ছে বুঝি আইজকা?
অয়নের কণ্ঠ শুনে ঘুরে তাকান হরিপদ। আরে! অয়ন-বকুল যে। আইজকা জোবা তো, তাই মাছ ভালোই পড়ছে। এত বিহান বেলা তোমরা এইহানে?
এমনিই ঘুরতে আইছি।
, বিহান বেলা ঘুরন ভালোা। মাছ লাগবো?
না, লাগবো না কাকা। মন্টু মামা আইজ চাঁই’তে অনেক মাছ পাইছে। বকুল জবাব দেয়।
হরিপদ ঘোষকে খুব পছন্দ অয়নের। ওদের বাড়িতে হরিপদ’র অবাধ যাতায়াত। অয়নকে ভীষণ স্নেহ করেন তিনি। খালের পূব দিকে তাকালে প্রথম যে বড় বাড়িটা চোখে পড়ে সেটাই হরিপদ ঘোষের বাড়ি। ওঁদের বাড়িতে অয়ন কতদিন গেছে বড়দি’র সাথে! হরিকাকার মেয়ে মালতিদি বড়দি’র ছোটবেলার বন্ধু। এখন যেমন সুবল ওর বন্ধু। আগে বড়দি যখনই ও-বাড়ি যেত অয়ন যেন আর পিছু ছাড়ত না। এখন সুবলের কাছে ও একাই যায়। ওঁদের সুন্দর সাজানো গোছানো বাড়িটার উঠোনের চারিপাশে ফুলের গাছগুলোর প্রতি অয়নের প্রবল আকর্ষণ ছিল। সুবলের মাকে অয়ন ডাকে কাকী। ও বাড়িতে গেলেই কাকী নাড়ু, পায়েস, বাতাসা খেতে দেন। হরিকাকার দোকানের মিষ্টি আর বাতাসাও ভীষণ পছন্দ ওর। হাটের দিন বাবার সাথে বাজারে গেলে হরিকাকার দোকানের মিষ্টি ওর চাই-ই। 
রাস্তার দু’পাশের ডুবন্ত জমির আলের উপর উঁচু আগাছার প্রাচীরের ফাঁকে ফাঁকে পেতে রাখা চাঁই তুলছে লোকজন। খালের পাড় থেকে রাস্তায় উঠে আসে ওরা। চারিদিক ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে আসছে। পূব আকাশে একটা লালচে আভা ছড়িয়ে পড়ছে ক্রমশ। ভোরের ঠা-া বাতাসে ব্রিজের উপর উঠে কিছুক্ষণ দাঁড়ায় দু’জনে। তারপর পূব দিকে তাকাতেই অয়ন দেখে হরিপদ ঘোষের বাড়ির উপর দিয়ে বড় গোল থালার মতো লাল সূর্যটা উঁকি দিচ্ছে কেমন রাজকীয় ভঙ্গিতে। যেন সবাইকে জানান দিয়ে যাচ্ছে ‘আমি এসে গেছি, এবার তোরা উঠে পড়’। ওরা আরও কিছু সময় ব্রিজের উপর কাটিয়ে ফিরে চলে বাড়ির দিকে।
অনেকদিন পর নাহিদকে নিয়ে বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসলো শিউলি। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ছুটির অভাবে দু’জন একসাথে আসা হয়নি বহুদিন। শ্বশুরবাড়ি থেকে একা একা বাবার বাড়িতে হুট করে আসা হয়না শিউলির। এবার ঠিক হয়েছে নাহিদ চলে গেলে বেশ কিছুদিন থেকে যাবে এখানে। দীর্ঘদিন পর ভাই-বোনকে কাছে পেয়ে খুব খুশি শিউলি। অয়নকে নিয়ে আশপাশটা ঘুরে এসে দেখে মা চাল ভিজিয়ে ঢেকিতে গুড়া করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কাছাকাছি আসতেই আবার শুরু হয়ে যায় বকুল আর অয়নের দুষ্টুমি।
এই পুচঁকি, আবার বান্দরের মতোন লাফাইতে কই গেছিলি?
এই ছোটু, তুই আমারে পুচঁকি কইলি ক্যান?
বকুলকে ধরার জন্য পিছু পিছু দৌড়ায় অয়ন। শিউলি ওদের দিকে তাকিয়ে হাসে। কিছুক্ষণ ছুটোছুটি, দৌড়ঝাপ; হাঁপিয়ে যায় অয়ন। হঠাৎ বকুল বলে- আমি বিভা’পুগো বাড়ি যামু, তুই কী আমার লগে যাবি? ব্যাস! সব রাগ শেষ। ছোটদি আমারে নিয়ে যা। বকুলের পেছনে ছোটে। উঠানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে শিউলির দিকে তাকিয়ে হাসে মন্টু।
বাড়িতে জামাই আসায় সালমা বেগমের ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। জামাইকে ভালো-মন্দ খাওয়ানোর চিন্তাতো তাকেই করতে হবে। মাস্টারসাব ব্যস্ত তার স্কুল আর লাইব্রেরী নিয়ে। লোকজন দিয়ে পিঠা তৈরির জন্যে চাল ভাঙানো, মন্টুকে দিয়ে পুকুর থেকে মাছ ধরানো, মুরগি ধরে জবাই করা- সব কাজ সালমা বেগমকেই তদারকি করতে হয়। বকুলের সাথে বিভাকে আসতে দেখে কিছুটা স্বস্তি পান তিনি।
বিভা আইছস? শিউলির জামাই আইছে। অনেক কাম, আমি একলা পারতাছি না রে মা!
কন চাচি, কী করতে হইব।
কয়ডা চাউল গুড়া করতে হইব, আমি চাউল ধুইয়া ভিজাইয়া রাখছি।
বিভা রান্নাঘরের এক পাশে পাতা ঢেঁকিতে চাল গুড়া করতে লেগে যায়।
রোদের তীব্রতা কমে গেলে বিকেলে নাহিদকে নিয়ে বেড়াতে বের হলো শিউলি। বাড়ির পূব দিকের বড় রাস্তাটা ধরে কোটাখালী খালের দিকে হাঁটে। এটা অয়নের মতো শিউলিরও প্রিয় জায়গা। বিয়ের পর এই প্রথম নাহিদকে নিয়ে এদিকটায় আসলো। নাহিদ গ্রামেরই ছেলে। চাকরির সুবাদে শহরে থাকতে হলেও গ্রামের প্রতি টানটা সবসময়ই অনুভব করে। ওদের গ্রামটাও সুন্দর কিন্তু শিউলিদের বাড়ির এ পাশটা যেন ছবির মতো সুন্দর। যে দিকে তাকায় চোখ জুড়িয়ে যায়।
নাহিদ আর শিউলি পাশাপাশি হাঁটে। রাস্তার দু’পাশে থৈ-থৈ পানি। একটা ফাঁকা জায়গা দেখে ঘাসের উপর দু’জনে বসে।
তুমি জানো এই জায়গাডা আমার অনেক পছন্দের।
জায়গাটা আসলেই অনেক সুন্দর।
আমরা জোছনা রাইতে দল বাইন্ধা এইহানে হাঁটাহাটি করতাম। খালের ঐ পাড় থেইক্যা মালতিরা আসতো। আমগো বাড়ি থেইক্যা ঐ খালের পাড়, এর মধ্যেই হাঁটতাম। কত গল্প আর দুষ্টামি চলত! সেই দিনগুলো অন্যরকম আনন্দের ছিল, এহন মনে পড়লে খুব খারাপ লাগে।
হুম, প্রেম করার জন্যেও চমৎকার জায়গা, নাহিদের চোখে দুষ্টুমি।
নাহিদের দিকে আড়চোখে তাকায় শিউলি। -কি ব্যাপার সাহেব, আপনার মতলবখানা কি?
নাহিদ চারিদিকে একবার চোখ বুলায়। বাম হাতটা ঘাড়ের উপর দিয়ে শিউলিকে কাছে টানার চেষ্টা করে।
এই হচ্ছেটা কি? প্রেম করার আর জায়গা পাওনা না? মুখে কপট রাগ। শিউলি হাতটা সরিয়ে দিয়ে নাহিদের বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেয়।
ইস! এদিকটায় এমন সুন্দর জায়গা আছে জানলে বিয়ের আগেই তোমার সাথে প্রেম করতাম।
আহা! সেই সুযোগ আপনি পাইতেন না জনাব। শিউলি হেসে বলে।
এত আত্মবিশ্বাস?
জি, সাহেব। সাত্তার মাস্টারের মেয়ের দিকে হাত বাড়ানোর সাহস এ তল্লাটে কারো নেই।
যাক, সুরক্ষিত রাজকন্যাকে শেষ পর্যন্ত নিজের করে তো পেলাম।
দু’জনে সামনের অথৈ পানির দিকে তাকায়। দলবেঁধে হাঁসদের জলকেলি দেখে। দূরে ভরা পানির মাঝখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট ছোট গাছগুলোর উপর ধবল বকের বিচরণ মন ভরিয়ে দেয় শিউলির। মনে মনে ভাবে, শহরে চলে গেলে প্রাণ জুড়ানো এই দৃশ্যগুলো আর দেখা হবে না। শ্যামলপুরের শ্যামল ছায়া থেকে নির্বাসনে চলে যেতে হবে। আবার যদি কোনো বর্ষায় ফেরা হয় গ্রামে, তখন কী এমন করে ফিরে পাবে এই ভালোলাগার মুহূর্তগুলোকে? কে জানে! হয়তো দেখা হবে; কিংবা এগুলো কেবলই স্মৃতির ঘরেই থেকে যাবে।
অয়নের গলা শুনে দুজনেই বাড়ির দিকে তাকায়। অয়ন হাঁপাতে হাঁপাতে পেছনে এসে দাঁড়ায়।
বড়দি, মা তোমারে ডাকছে।
কেন রে?
আমি কী জানি? মা তোমারে ডাকতে কইলো।
আচ্ছা চল, বলে দুজনেই উঠে পড়ে।
বাড়ির সবাই নানান কাজে ব্যস্ত। অয়নকে নিয়ে কলাবতী বাজারের দিকে যায় নাহিদ। ওদের বাড়ি থেকে পূবদিকে বের হওয়া রাস্তাটা বাড়ির শেষ মাথায় এসে দু’দিকে ভাগ হয়ে গেছে। সোজা রাস্তাটা কোটাখালী খাল বরাবর চলে গেছে আর ডানদিকে ছুটে চলা রাস্তাটা গ্রামের মধ্যে দিয়ে একেবেঁকে কলাবতী বাজারে গিয়ে শেষ হয়েছে।
মাস্টার সাহেবের বইয়ের দোকানে আজ লোকজন নেই তেমন। দোকানের সামনে বেশ কিছুটা খোলা জায়গা, তারপর নদীর পাড় ঘেঁষে ডালপালা ছড়ানো ছোট একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়লে এই গাছটা ছায়া দিয়ে ঢেকে রাখে দোকানের সামনের জায়গাটুকু। দোকান খোলা থাকলে এখানে সবসময়ই কয়েকটা চেয়ার পাতা থাকে। কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় নদীর দিক থেকে আসা ঠা-া বাতাসে ফুসফুসকে ভরিয়ে তুলতে এখানে ভিড় করেন গ্রামের মাস্টারের সমবয়সী কিছু মানুষ। চায়ের দোকানগুলো ইদানীং এঁদের কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছে। উঠতি যুবকদের ভিড়ে নিজেদের ঠিক মানিয়ে নিতে পারেন না। নাহিদ একটা চেয়ার টেনে গাছতলায় বসে। সাত্তার মাস্টার হরিপদর দোকানের ছেলেটাকে ডেকে কিছু খাবার ও মিষ্টি দিতে বলেন।
এ আমাদের শিউলি-মা’র জামাই না? সাত্তার মাস্টারের পেছনে দাঁড়িয়ে বললেন হামিদ শেখ।
, তুমি জামাইরে দ্যাহো নাই আগে?
বিয়ার সময় দ্যাখছিলাম। তা বাবাজি কেমন আছ?
নাহিদ সালাম দিয়ে বলেÑ জি ভালো আছি, আপনি ভালো আছেন?
আমগো আর ভালো থাকা, বয়স অইছে না?
কিছুক্ষণ আলাপচারিতার পর আরও লোকজন এসে হাজির হয়। মুরুব্বিদের ভিড়ে নাহিদ বেশ অস্বস্তি বোধ করে। শ্বশুরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ক্লাবঘরের দিকে এগিয়ে যায়। এই এলাকায় আগেও এসেছে সে, অবশ্য বিয়ের আগে। তখন এখানে ওর কিছু বন্ধু-বান্ধব ছিল। এখন আর কাউকেই দেখা যায় না। জীবিকার সন্ধানে একেকজন একেকদিকে চলে গেছে। কিছুক্ষণ বাজারে ঘোরাঘুরি করে অয়নকে নিয়ে নদীর পাড় ধরে ফিরে চলল। একদিকে নদীর স্বচ্ছ টলটলে পানি, অন্যদিকে সবুজ শ্যামলিমা; মাঝখানের সরু রাস্তা দিয়ে হাঁটতে বেশ লাগে। পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবি-ডুবি করছে, শেষ বিকেলের মায়ায় গোধূলির লাল-রঙে আকাশটা যেন নববধূর সাজে সেজেছে। জোয়ার থাকায় নদীর পানি পাড় ছুঁই ছুঁই। তেমাথার পুলের কাছে গিয়ে নদীর পাড় ছেড়ে শ্যামলপুরের রাস্তায় নেমে গেল ওরা।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উপন্যাসঃ ফেরা (পর্বঃ ২১ - ২৫ - শেষ পর্ব)

এ ই উপন্যাসটিতে সম্মুখ সমরের কোন ঘটনা তুলে ধরা হয়নি।  ওয়ারফ্রন্টের কোনও দৃশ্য নেই। তবে এই লেখায় মূলত যে গল্পটি বলার চেষ্টা ক রা হয়েছে  তা মু...