শনিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

স্মৃতিচারণঃ স্মৃতিতে অম্লান, অন্যরকম জোছনা!

আমার বড় হয়ে ওঠা ঢাকা শহরেই কিন্তু সেই ছেলেবেলা থেকেই গ্রামের প্রতি মনে এক অদম্য আকর্ষন অনুভব করতাম। এর কারণ হয়ত সেই কিশোর বয়সের শুরুতে, যখন থেকে বুঝতে শিখেছি গ্রাম বাংলার সৌন্দর্য বিশেষ করে কীর্তনখোলা, গ্রামের মাঠ-ঘাট-বন, ভরা বর্ষায় থৈ থৈ করা পানি, সবুজ প্রকৃতি মনে গেঁথে গিয়েছিল। তাইতো শহরে বাস করলেও মনটা পড়ে থাকতো গ্রামে। প্রতি বছর পরীক্ষা শেষে যখনই গ্রামে যেতাম নিজেকে যেন ফিরে পেতাম। যতদিন গ্রামে থাকতাম আনন্দটুকু নিংড়ে নিতাম পুরোমাত্রায়, তারপর সময় ফুরিয়ে গেলে মন খারাপলাগা নিয়ে আবার ফিরে আসতাম ইট কাঠ পাথরের মাঝে। এই কারণেই হয়ত আমার লেখায় ঘুরে ফিরে উঠে আসে সেই গ্রামেরই কথা। কারো কারো কাছে একঘেয়ে লাগাটাও স্বাভাবিক, কিন্তু কি করব এগুলোই যে আমার জীবনের সাথে ওতপ্রেতভাবে জড়িয়ে আছে! এখনও নাগরিক জীবনে নানা ব্যাস্ততার মাঝে ফেলে আসা দিনগুলোর কিছু কিছু স্মৃতি মাঝে মাঝে মনকে আন্দোলিত করে। এগুলো ভেবে প্রায়ই নস্টালজিক হয়ে যাই।
ঢাকায় বসবাসকারী আমাদের কাজিনদের একটা বড় গ্রুপ ছিল। প্রতি বছরই পরীক্ষা শেষ হলে সবাই মিলে একসাথে গ্রামে বেড়াতে যেতাম। গ্রামে যাওয়া মানেই আনন্দ। মেজখালা, ছোটখালা, দুই মামা- কয়েক ফ্যামিলি মিলে দলবেধে একসাথে লঞ্চে করে যাওয়া হত। আগে থেকেই কেবিন বুকিং দেয়া থাকতো। সবার বাসা থেকেই আসতো মজার মজার সব খাবার আর লঞ্চে একসাথে বসে খাওয়া, অনেকটা পিকনিকের আমেজে। কমপক্ষে পনের দিন গ্রামে থাকা হত, সবাই মিলে দারুণ এনজয় করতাম।
তখন আমি ক্লাস সেভেন কি এইটে পড়ি, ফাইনাল পরীক্ষা শেষে গ্রামে বেড়াতে গেছি। একদিন সন্ধ্যার পর আমরা ঠিক করলাম রাতে খেঁজুরের রসের পায়েস খাব। নানাদের খেঁজুর গাছ তখনও কাটা শুরু করেনি, তাই মামাত ভাই শ্যামলকে নিয়ে খেঁজুরের রসের সন্ধানে নেমে পরলাম। ও বলল নদীর ওপাড়ে ওর এক বন্ধুদের বাড়ি থেকে রস পাওয়া যাবে তবে রাত একটু বেশি না হলে হাঁড়িতে তেমন রস জমে না। আমরা ঠিক করলাম রাত দশটার পরেই যাব, তবুও খেঁজুরের রসের পায়েস খাওয়া চাই।
রাত দশটা, শুরু হল আমাদের খেঁজুরের রস সংগ্রহের অভিযান। ডিসেম্বের মাসের কনঁকনে ঠাণ্ডা, কয়েক প্রস্থ জামাকাপড় গায়ে চাপানোর পরও শীত মানছে না। আমি, তমাল আর শ্যামল নদীর ওপাড়ে যাচ্ছি। নানাবাড়ি লাগোয়া খালেই নৌকা রাখা থাকে। এই খাল দিয়ে মিনিট দশের মত নৌকা চালালেই নদীতে পৌছা যায়। শ্যামল নৌকায় বসার জন্য বাড়ি থেকে একটি পাটি নিয়ে এসেছে। আমরা নৌকায় গিয়ে বসলাম। আজ সম্ভবত পূর্ণিমা, আকাশ বেশ পরিষ্কার। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের নৌকা নদীতে পৌঁছে গেল। খাল থেকে নৌকাটা যেই নদীতে পড়ল, আমার মনে হল আমি এক অন্য জগতে এসে পড়লাম! মনে হল সারা নদীটা একটা জোছনার চাঁদর দিয়ে ঢাকা। এমন জোছনা আমি আগে কখনও দেখিনি। আকাশে পূর্ণ চাঁদ, চাঁদের আলোয় নদীর পানি চিঁক চিঁক করছে। সে এক অসাধারণ দৃশ্য!
শ্যামল গ্রামেই থাকে, তাই ওর কাছে এ জোছনার আলাদা কোন বিশেষত্ব নেই। আমি নৌকায় পাটির উপর শুয়ে আছি। তমাল আর শ্যামল নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল আর আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম অন্য এক জগতে। কখন যে নৌকা নদীর ওপাড়ে পৌঁছে গিয়েছিল আমি টেরই পাইনি। নৌকাটা নদীর পাড়ে ভিড়িয়ে শ্যামল বলল ভাইয়া আমরা চলে এসেছি, চলেন যাই। আমার আর উঠতে ইচ্ছে করছিল না, আমি বললাম তোরা দুজন যা আমি নৌকা পাহাড়া দেই। ওরা একটু অবাকই হল, কারণ ওরা জানত অন্ধকারে আমার অনেক ভয়, রাতে একা আমি দশ পা জায়গাও চলতে পারি না। আমি বললাম কোন অসুবিধা নাই, তোরা যা। আমার তখন একটুও ভয় করছিল না, কেবলই মনে হচ্ছিল এখান থেকে চলে গেলে এই চমৎকার জোছনার সৌন্দর্যটা হারাবো। ওরা চলে গেলো।
নৌকার ওপর আমি একা শুয়ে আছি মাথার উপর এক অদ্ভুত সুন্দর আকাশ। চারপাশটা জোছনায় ঝলমল করছে। আকাশে পূর্ণ চাঁদের জোছনা আর আমার চারপাশে নদীর রূপালি পানি মিলে এক অপূর্ব পরিবেশ তৈরি করেছে, মনে হল যেন এক অচেনা জায়গায় চলে এসেছি। নৌকাটা যে জায়গাটায় রাখা এখান থেকে নদীটা দুই দিকেই বাঁক নিয়েছে, দূর থেকে দেখতে অনেকটা বাঁকা রূপালি চাঁদের মত লাগছে। চাঁদের আলোয় চারিদিক বেশ পরিষ্কার, এই ভয়ঙ্কর সুন্দর পরিবেশে আমি একা, মন থেকে ভয় ডর কখন যে দূর হয়ে গেছে আমি নিজেই টের পাইনি। পূর্ণিমার জোছনার কথা আগেও শুনেছি কিন্তু তা যে এত সুন্দর হতে পারে তা আমার জানা ছিল না। আমার নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হচ্ছিল। সেই সুন্দরের রাজ্যে আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম, সম্ভিত ফিরে পেলাম তমালের ডাকে। ওরা খেঁজুরের রস নিয়ে চলে এসেছে। দুজনের হাতে দুইটা হাঁড়ি। ওরা নৌকায় উঠে এলো। শ্যামল নৌকা ছেড়ে দিল, কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা নদীর এই পাড়ে চলে এলাম। নৌকা আবার খালের মধ্যে ধুকে পড়লো। আমার কাছ থেকে সেই অপূর্ব সুন্দর জোছনার রাজ্য হারিয়ে গেলো।
অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা বাড়ি চলে এলাম। সেই রাতে খেঁজুরের রসের পায়েস খাওয়া তো হলই সেই সাথে আমার জন্য বাড়তি পাওয়া হয়ে থাকল সেই অসম্ভব সুন্দর জোছনার স্মৃতি। এরপর অনেকবার জোছনা দেখেছি কিন্তু আজ থেকে বহু বছর আগে দেখা সেদিনের সেই অপূর্ব জোছনার সৌন্দর্য আজও আমার স্মৃতিতে অম্লান।

নিভৃত স্বপ্নচারী
রচনাকালঃ এপ্রিল ২১, ২০১২

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উপন্যাসঃ ফেরা (পর্বঃ ২১ - ২৫ - শেষ পর্ব)

এ ই উপন্যাসটিতে সম্মুখ সমরের কোন ঘটনা তুলে ধরা হয়নি।  ওয়ারফ্রন্টের কোনও দৃশ্য নেই। তবে এই লেখায় মূলত যে গল্পটি বলার চেষ্টা ক রা হয়েছে  তা মু...