কিছুদিন থেকেই শীত
বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। ঘন কুয়াশার চাঁদরে ঢেকে থাকা সকালটাকে অন্যরকম লাগে এখন। কয়েক
হাত দূরের জিনিসও ঝাপসা লাগে। বেশিরভাগ মাঠের ধান এখন কাটা হয়ে গেছে। ফাঁকা
জমিগুলোতে কেটে নেয়া ধানের অবশিষ্ট নাড়াগুলো পড়ে আছে শুধু। কোনো কোনো ক্ষেতে শুয়ে
পড়া নাড়াগুলোর উপর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে লকলকে সবুজ কলাইয়ের ডগা। শীতের সকালে লেপের
নিচের ওমটা ছেড়ে বের হতে মন চায় না অয়নের। তবুও মাঝে মাঝে বাবার ডাকে উঠে পড়ে।
শীতের সকালে সবুজ ঘাসের উপর স্বচ্ছ শিশিরবিন্দুগুলো সূর্যের আলোয় কেমন চিকচিক করে
ওঠে। সেই শিশির ভেজা নরম ঘাসে খালি পায়ে হাঁটতে খুব ভালো লাগে অয়নের।
ঘুম ভাঙলে অয়ন
জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল সকালের সোনারোদ ঝিলমিল করছে সারা উঠোন জুড়ে। ভারী সোয়েটার
গায়ে চাপিয়ে সামনের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। মিষ্টি-রোদে বারান্দায় পাটিতে বসে গরম
ভাত খাচ্ছেন বাবা। ওকে দেখেই বলে উঠলেন,
কী বাজান, আইজ এত দেরী অইল যে!
ঘুম ভাঙেনাই, তুমি আমারে তুললা না ক্যান?
দ্যাখলাম আমার
বাজান লেপ মুড়ি দিয়া ঘুমাইতেছে, তাই তুলিনাই।
বাবা, তুমি এহন বাইরে যাইবা?
হ বাজান, কিছু কইবা?
আমি তোমার লগে আইজ
মেলায় যাইতে চাইছিলাম।
আমি তো আইজ শহরে
যামু,
বাজান। তোমার মন্টু মামার লগে যাইও।
আইচ্ছা ঠিক আছে।
সুবর্ণপুরের শেষ
প্রান্তে গড়ের মাঠে মেলা বসেছে গতকাল থেকেই। গতবছর মন্টু মামার সাথে মেলায়
গিয়েছিলো ওরা। বড়দি, ছোটদিও গিয়েছিল। কাল সুবল আর মিরাজের সাথে কথা
হয়েছে, ওরাও আজ মেলায় যাবে। ইতিমধ্যে মন্টু মামাকে
কয়েকবার মনে করিয়ে দেয়া হয়ে গেছে। মন্টু মামা বলেছে, দুপুরে খাবার পরই ওকে মেলায় নিয়ে যাবে।
বড় রাস্তায় সুবলকে
দেখতে পেয়ে দৌড়ে ওর কাছে চলে আসলো অয়ন। সুবলকে জানিয়ে দিল, মন্টু মামার সাথে আজ মেলায় যাচ্ছে সে। সুবল বলে, ‘তাইলে আমিও তোগো লগে যামু। ল, মিরাজগো বাড়ি যাই’। দুজনে একসাথে ছোটে মিরাজদের বাড়ির দিকে।
সকালে উঠে চারটা
মুখে দিয়েই কাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাচ্ছিলো বিভা। পেছনে প্রভার কথা শুনে ফিরে
তাকায়।
মা, কাইল রাইতে তোমারে যা কইছিলাম মনে আছে?
বিভা কিছুক্ষণ চুপ
করে থাকে। মন খারাপ হয়। মেয়ের ছোট খাট আবদার পূরণ করার সামর্থ্যও তার নেই। কাল
রাতে মেলা থেকে চুড়ি, ফিতা কিনে দেবার জন্য আবদার করেছে প্রভা। বিভা
ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার সময় অনেকটা দায়সায়রাভাবেই বলে,
দেহি, টাকা পাইলে আনুমনে।
তোমার কাছে কিছু
চাইলেই খালি এমন কর। প্রভার কণ্ঠে অভিমানের সুর।
এত্তবড় মাইয়া, তুমি বুঝনা এইগুলান কিনতে টাকা লাগে। ভাতই জোডেনা, তায় আবার সখ পূরণ!
থাউক, লাগবে না।
কইছি না টাকা পাইলে
আনুমনে।
বাজারের উদ্দেশ্যে
হেঁটে চলে বিভা।
দুপুরের খাবার পর
থেকে অয়ন তৈরি হয়েই ছিল। সুবল চলে আসলে মন্টু মামার সাথে মেলার উদ্দেশ্যে বের হয়।
শীতের দিনগুলো যেন খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়, তাই একটু আগেভাগেই বেরিয়ে পড়ল ওরা। বড় রাস্তা ধরে এগিয়ে গিয়ে কাজেম মাঝির
বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। সুবল বাড়ির ভিতরে গিয়ে মিরাজকে ডেকে আনে। তিনজন মিলে
মন্টু মামার সাথে এগিয়ে চলে উজানগাঙের পাড়ে; তেমাথার পুলের দিকে। বাজারের দিকে থেকে ঘুরপথ হলেও তেমাথার পুলের কাছে আসতে
হলে এটাই সবচেয়ে কাছের রাস্তা। কিছুক্ষণের মধ্যে ওরা নদীর পাড়ে চলে আসলো।
ব্রিজ পার হয়ে
সুবর্ণপুরে ঢুকে নদীর পাড়ের রাস্তা ধরে ওরা মেলার পথে হেঁটে চলল। এই গ্রামের
একেবারে শেষ মাথায় বড় একটি খোলা জায়গা। অন্যান্য ধানি জমি থেকে জায়গাটি কিছুটা
উঁচু। এলাকাবাসী বলে গড়ের মাঠ। প্রতিবছর এখানে এই সময়ে মেলা বসে, পালাগান হয়। যাত্রাদলের তাঁবু খাটানো থাকে বেশ কিছুদিন
পর্যন্ত ।
পাকা ধান কেটে
নেবার পর আশেপাশের জমিগুলো বেশির ভাগই ফাঁকা। সেখানে এখন সবুজ শস্য হাসে। কোথাও
কলাই,
কোনো কোনো জমিতে চাষ করা হয়েছে মশুর কিংবা সরিষার।
রাস্তার দু’পাশে সারি সারি খেজুর গাছ, কিছুক্ষণের মধ্যেই ওগুলো কাটার কাজে লেগে যাবে লোকজন। সন্ধ্যার পর প্রতিটা
গাছে ঝুলবে ছোট ছোট রসের হাড়ি। পথের পাশের ছোট বরই গাছটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে
ধরেছে স্বর্ণলতা, সূর্যের আলোয় কেমন সোনালি দ্যুতি ছড়াচ্ছে।
মিরাজকে কিছু বলতে
গিয়ে অয়ন দেখল ও যেন কিছুটা অন্যমনস্ক। চুপচাপ হেঁটে চলেছে ওদের সাথে।
কি রে মিরাজ, তুই এই রহম চুপ মাইরা আছোস? কী অইছে?
কিছু না, এমনেই।
মেলায় যাওনের
লইগ্যা কেউ রাগ করছে?
না রে! কেউ কিছু
কয়নাই।
এখন রাস্তা থেকে
মেলার ভিড়টা দেখতে পাচ্ছে অয়ন। চোখে পড়ছে লাল-সবুজ রঙের বাহারি নাগরদোলাটা। গতবছর
ও নাগরদোলায় চড়েছিল।
অল্পক্ষণের মধ্যে
পৌঁছে যায় ওরা। দূর দূরান্ত থেকে এসে রকমারি সামগ্রীর পশরা সাজিয়ে বসেছে দোকানিরা।
মেলায় ঢুকতেই বাহারি সব খাবার দোকান, তারপর ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং এরপরই রয়েছে ওদের বয়সী ছেলেমেয়েদের জন্য
খেলনার দোকানগুলো।
মেলার একপাশে খালের
পাড় ঘেঁষে একটা মাঝারি আকারের বটগাছ। ওখানে গানের আসর বসেছে। গাছের নিচে একজন
বয়স্ক লোক একতারা হাতে গান গাইছে। বটতলায় কাছাকাছি গিয়ে মন্টু মামা অয়নদের বলল-
আমি ঐহানেই থাকুম, তোমগো ঘোরাঘুরি শ্যাষ অইলে গাছের নিচে চইলা
আইও। মন্টু মামা গানের আসরের মাঝে বসে পড়ে। ওরা তিনজনে মিলে নাগরদোলার দিকে এগিয়ে
যায়।
অয়ন-সুবলের
কেনাকাটার এক ফাঁকে মিরাজ খালের পাড়ে এসে দাঁড়ায়। ওপারে অনেকটা খোলা জমি ছাড়িয়ে
আবছায়াভাবে চোখে পড়ে ঘন সবুজ গাছপালায় ঢাকা একটা বাড়ি। মিরাজ সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
অয়ন আর সুবলের আনন্দ-উচ্ছ্বাস ওকে ছুঁতে পারে না তেমন। তেমাথার পুল পার হয়ে আসার
পর থেকেই ওর মনটা খারাপ হয়ে যায়। এটা সবসময়ই হয়। এখানে আসলেই ওর বাড়ির কথা মনে
পড়ে। হঠাৎ মায়ের মুখটা ভেসে ওঠে মনে। মিরাজের কাছে গত বছরের এই মেলার স্মৃতিটা
অন্যরকম। সেবার মা ওকে সুন্দর জামাকাপড় পড়িয়ে রফিক ভাইয়ের সাথে মেলায় পাঠিয়েছিলেন।
আজ মা নেই। চারপাশে কত মানুষ! তবু মায়ের অভাবটা ও ভুলতে পারে না। 'মিরাজ, আমার কাছে আয় বাবা' মা এভাবেই ওকে ডাকতেন। এখন আর কেউ ডাকে না। মায়ের শরীরের
মা-মা গন্ধটা আর পাওয়া হয় না। মিরাজের বুক ভেঙে কান্না আসে। দু'হাটুতে মুখ গুঁজে বসে থাকে।
আনন্দ উল্লাস আর
কেনাকাটায় সময়টা যেন দ্রুত চলে যায় অয়ন-সুবলের। হঠাৎ খেয়াল হয় মিরাজ ওদের সাথে
নেই। ভিড় থেকে বেরিয়ে দু’জনে ওকে খোঁজে। অয়নের চোখ পড়ে খালের পাড় ঘেঁষে বসে আছে
মিরাজ। দু’জনে এগিয়ে যায়।
কি অইছে মিরাজ? অয়ন জিজ্ঞেস করে।
কই, কিছু না তো!
তুই এইহানে চুপচাপ
বইসা আছোস ক্যান?
এমনেই। তোগো কেনা
শ্যাষ?
হ। তুই কিছু কিনবি
না?
না। আমি তো তোগো
লগে মেলা দ্যাখতে আইছি।
মিরাজ তোর কী অইছে
আমগো কইতে পারস না? সুবল বলে।
কিছু অয়নাই। ভালো
লাগতাছিল না তাই বইয়া আছি।
তোগো বাড়ি না
এইদিকে? সুবল জানতে চায়।
হ, খালের ঐ পাড়ে।
এইহান থেইক্যা দেহা
যায়?
ঐ যে দূরে বড় গাছটা
দেহা যাইতাছে, ঐডাই আমগো বাড়ি।
তোর বাড়ির লইগা
খারাপ লাগতাছে না? অয়ন জিজ্ঞেস করে।
মিরাজ কিছু বলে না।
উঠে দাঁড়িয়ে বলে- এহন বাড়ি যাবি?
হ, যামু তো! অয়ন জবাব দেয়।
তাইলে ল’।
বটতলায় পালাগানের
আসরটা জমে উঠেছে। গেরুয়া রঙের কাপড় পরা ষাটোর্ধ এক বৃদ্ধ গাছের তলায় দাঁড়িয়ে
একতারা হাতে একমনে গেয়ে চলেছে “চিরদিন পুষলাম এক অচিন পাখি"। মেলার দকানপাট
হৈ-হুল্লোড় থেকে কিছুটা দূরে এই সঙ্গীতের আয়োজন দর্শক-শ্রোতাদের মনে ভিন্নরকম এক
আবেশ সৃষ্টি করেছে। একতারার টুং-টাং শব্দ আর শ্মশ্রুম-িত সেই বৃদ্ধের কণ্ঠের
মনকাড়া গায়কী দর্শক-শ্রোতাদের যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো আটকে ফেলেছে। একতারার প্রতিটা
তারের শব্দ মন্টুর সমস্ত অনুভূতিকে গভীরভাবে নাড়া দিয়ে যায়। সে হারিয়ে যায় অন্য
ভুবনে। যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসা রিমঝিম বৃষ্টির ধারায় মন দুলতে থাকে। মন্টু
সঙ্গীতের প্রায় কিছুই বোঝে না, তবুও এই মুহূর্তে
গানের সুর-তাল-লয়ের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
মিরাজ আর সুবলকে
সাথে নিয়ে মন্টু মামার খোঁজে গানের আসরের দিকে এগিয়ে যায় অয়ন। দর্শকের সারিতে বসে
মন্টু মামা তন্ময় হয়ে শুনছে। অয়নরা পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। ওদের দেখে মামা বলে, তোমরা আরও কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি কর, আমরা একটু পরেই চইলা যামু।
বটগাছটা ছাড়িয়ে
একটু সামনে এগিয়ে একপাশে বড় তাঁবু টানানো দেখে অয়ন জিজ্ঞেস করে,
মামা, ঐহানে কী অয়?
ঐহানে যাত্রা অয়।
এহন অইতাছে?
না মামা, রাইতে অইবো। যাও, তোমরা আরও কিছুক্ষণ আনন্দ কর।
একটু দূরে একটি
জটলা দেখে এগিয়ে যায় ওরা। লোকজনের ভিড় ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়ে। দুটি বড় মোরগের লড়াই
চলছে। একদিক থেকে লাল ঝুটিদার মোরগটি রাজকীয় ভঙ্গিতে তেড়ে যায়, অন্যদিক থেকে ছাই-রঙের মোরগটিও সমান তেজে ঝাপিয়ে পড়ে
প্রতিপক্ষের উপর। উপস্থিত লোকজন দুই দলে ভাগ হয়ে গেছে। একদল চিৎকার করে বলছে
পাঞ্জা জিতবে, আরেকদল বলছে ঈগল। ওরা কিছুক্ষণ হাড্ডাহাড্ডি
মোরগের লড়াই দেখে বেরিয়ে আসে।
ভিড় ছেড়ে কিছুটা
ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়ায়। হঠাৎ পিঠে কারো হাতের ছোঁয়া পেয়ে ঘুরে তাকায় মিরাজ। রফিক
ভাই ওর ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে। রফিককে দেখে মিরাজের মুখে হাসি ফুটে ওঠে।
কেমন আছোস মিরাজ?
ভালো, তুমি ভালো আছ রফিক ভাই?
ভালো, তুই কার লগে আইছোস?
মিরাজ অয়নদের
দেখিয়ে দেয়; অগো লগে আইছি। ফুফু কেমন আছে?
মা’র শরিলডা বেশি
ভালো নাই, মায় কতদিন তোর কতা জিগাইছে! আমারে তোর খবর আইনা
দিতে কইছে। বাড়ি যাবি না মিরাজ?
মিরাজ চুপ করে
নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিচ্ছুক্ষণ পর বলে- কার কাছে যামু?
আমগো কাছে যাবি, মায় তোরে দেখবার চায়।
ফুফুর কী অইছে?
কইতে পারি না, কয়েকদিন ধইরা বুকে ব্যথা, পায়ের গিডে গিডে ব্যথা, ঠিকমত হাঁটতে পারে না।
ফুফুর কতা খুব মনে
অয়।
তোর বাপের কতা
জানতে মন চায় না?
না।
মিরাজ, আমার লগে যাবি? মায়রে দেইখ্যা চইলা আবি।
একটু পরই তো
সন্ধ্যা অইয়া যাইব, আমি একলা ফিরা যাইতে পারুম না।
তোর ডর নাই, আমি তোরে পৌঁছাইয়া দিমু। মায় খালি তোর লইগ্যা কান্দে।
অয়ন, সুবল বলে- তাইলে যা, তোর ভাই তো তোরে পৌঁছাইয়া দেবো, ডরের কী আছে?
মিরাজ কিছুটা
ইতস্তত করে, অবশেষে রাজী হয়ে যায়।
বাড়ির সামনে আসতেই
মিরাজের চোখ পড়ে বড় বাগানটির একপাশে অযতেœ অবহেলায় পড়ে থাকা মায়ের কবরটির দিকে। ডালপালা ছড়ানো কাঠবাদাম গাছটার নিচে
আগাছা আর জঙ্গলে ঢেকে থাকা কবরটিকে দেখে ওর কেবলই মনে হয়- এ বাড়িতে বেঁচে থাকতেই
যে মায়ের কোনো মূল্য ছিল না এখন কবরের আর কী যতœ হবে! তবুও মায়ের জন্য ছোট্ট মনে জমে থাকা কষ্টগুলো আরও বেড়ে যায়। মিরাজ
অনেকক্ষণ চুপচাপ রাস্তায় দাঁড়িয়ে মায়ের কবরের দিকে তাকিয়ে থাকে। রফিক কিছুটা এগিয়ে
গিয়ে আবার ফিরে আসে মিরাজের কাছে।
মা তো চইলাই গ্যাছে, খালি খালি কষ্ট বাড়াইস না মিরাজ।
একটি দীর্ঘশ্বাস
ছেড়ে মিরাজ বলে-মা’র কবরডা জঙ্গলে ভইরা গ্যেছে রফিক ভাই।
হ, এই জঙ্গল অনেকদিন পরিষ্কার করা অয়নাই। ল, বাড়ির মধ্যে যাই।
প্রায় এক বছর পর এ
বাড়িতে ঢুকছে মিরাজ। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে ওর পুরনো জগৎ। বাড়ির কোণে কোণে ছড়িয়ে
ছিটিয়ে আছে কত স্মৃতি! সবগুলোর সাথে জড়িয়ে আছে মা। মা’কে ছাড়া ওগুলো শুধু
কষ্টটাকেই বাড়িয়ে তোলে ওর।
মিরাজকে ঘরে ঢুকতে
দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন কুলসুম। অনেকদিন পরে ভাইয়ের ছেলেটাকে দেখে বুকের
ভেতরটা কেমন করে ওঠে। কাছাকাছি আসতেই বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন।
এতদিন পরে ফুফুরে
মনে পড়ল বাজান!
ফুফুর কান্না দেখে
মিরাজের চোখেও জল আসে।
আইজও আইতে চায়নায়
মা,
আমি অনেক বইলা মেলা থেইক্যা নিয়া আইছি। রফিক
বলে।
ফুফুরে ভুইলা
গ্যাছোস বাজান?
আমি একলা আইতে পারি
না তো! ফুফুর প্রশ্নের উত্তরে মিরাজ বলে।
মিরাজের গায়ে-মাথায়
হাত বুলিয়ে দেন কুলসুম।
পোলাডা কত শুকাইয়া
গ্যাছে! মায়ের মতো কেউ কী আর আদর করতে পারে? তোর মামীরা তোরে আদর করে তো বাপ?
হ, করে তো। মিরাজ ঘাড় কাত করে সায় জানায়। তোমার কী অইছে ফুফু?
আর কইস না বাপ।
বুড়া মানুষের কত রোগ বালাই অয়! আমার কতা থাউক, তোর মায়ের কতা মনে পড়ে না বাপ?
হ, পড়ে তো।
আহারে! এইটুকুন
পোলা,
মা ছাড়া কী থাকতে পারে?
মিরাজের চেহারার
দিকে তাকিয়ে কুলসুমের আজ কেবল হাসি’র কথা মনে পড়ছে। ছেলেটা দেখতে একেবারে মায়ের
মতোই হয়েছে। ভাইয়ের বউ হলেও হাসিকে তিনি ছোটবোনের মতোই দেখতেন। পাশাপাশি বাড়ি
হওয়ায় সময়ে অসময়ে তার কাছেই ছুটে আসতো হাসি। কতদিন তাঁকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে! তাঁর
ভাইটাই অমানুষ। নিজের এমন সুন্দর বউ রেখে বড় ভাইয়ের বউয়ের প্রতি যার আসক্তি থাকে
তাকে তো অমানুষই বলে। ঐ রাক্ষুসী শাহানার জন্য ফুলের মতো হাসির জীবনটা শেষ হয়ে
গেল। কুলসুমের মনে পড়ে শেষ দিনটির কথা। সেদিন সিরাজকে শাহানার সাথে অন্তরঙ্গ
মুহূর্তে দেখে নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারেনি হাসি। প্রায় পাগলের মতো ছুটে এসেছিল
তাঁর কাছে। অনেকক্ষণ কেঁদেছিল, তাঁর পা জড়িয়ে ধরে
বলেছিল- বুজি, আমার কিছু অইলে আমার মিরাজরে তুমি দেইখো। অরে
আমার ভাইগো হাতে তুইলা দিও। তারপর ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। কুলসুম তখন বুঝতে
পারেননি ওটাই ছিল হাসির সাথে তাঁর শেষ দেখা। সন্ধ্যার একটু আগে খবর এলো, হাসি বিষ খেয়েছে। ছুটে গিয়েছিলেন কুলসুম। হাসিকে নয়, ওর প্রাণহীন দেহটি পাওয়া গিয়েছিল ঘরের পেছনের খড়ের পালার
কাছে। পাশে পড়ে ছিল জমিতে ব্যবহারের জন্য আনা কীটনাশকের বোতল।
একটি দীর্ঘশ্বাস
ছেড়ে কুলসুম বলেন- আইজ আমার কাছে থাকবি বাপ?
না ফুফু, আমারে তাড়াতাড়ি ফিরা যাইতে অইবো। মামীরা খুঁজবো, তারা জানেনা আমি এইহানে আইছি।
ঠিক আছে যাইস, কিছু মুখে দিয়া যা বাজান। কুলসুম বড় ছেলের বউকে ডেকে
মিরাজকে কিছু খাবার দিতে বলেন।
মুড়ি আর খেজুরের
গুড় খেতে খেতে মিরাজের চোখে পড়ে উঠানের মধ্যে দিয়ে ফুফুর ঘরের দিকে হেঁটে আসছে বড়
চাচি। মিরাজ খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। মায়ের মৃত্যুর কারণ যে এই চাচি এটুকু ঠিকই
বুঝতে পারে ও। কতদিন চাচির জন্য মা’কে বাবার হাতে মার খেতে দেখেছে! মা লুকিয়ে
লুকিয়ে কাঁদতো। ফুফুর উদ্দেশ্যে বলেÑ ফুফু আমি এহন যামু।
ঘরে ঢুকে মিরাজকে
দেখে থমকে দাঁড়ায় শাহানা।
কি রে মিরাজ, কহন আইলি?
মিরাজ শাহানার
প্রশ্নের কোনো জবাব দেয় না। ফুফুর দিকে তাকায়।
এহনই যাবি বাজান?
হ।
একটু খাড়া, রফিক তোরে আগাইয়া দিয়া আইবোনে, বাপ।
শাহানা মিরাজের
দিকে এগিয়ে যায়। হাত ধরে ওকে কাছে টেনে নিতে চেষ্টা করে। মিরাজ এক ঝাটকায় হাত
ছাড়িয়ে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। কুলসুম চেঁচিয়ে রফিককে ডেকে বলেন,
ও রফিক, মিরাজ চইলা গ্যেলো, ওরে ওর মামাবাড়ি পৌঁছাইয়া দিয়া আয়।
বিভার শত চেষ্টা
সত্ত্বেও শেষরক্ষা হয়না প্রভার। নির্জন সন্ধ্যায় বিভার ছোট্ট কুটিরে হামলে পড়েছিল
মানুষরূপী এক হায়না। দীঘির পাড়ের জনমানবহীন ছোট্ট কুটিরে একাকী কিছুই করার থাকতো
না প্রাভার যদি সময়মত পারুল এসে না পড়তো। শেষ পর্যন্ত সর্বনাশ ঠেকানো গেলেও লোভী
মানুষগুলোর রোষানল থেকে বাঁচতে পারে না প্রভারা। মফিজ মিয়া আর মনু মিয়ার আঙুল ওদের
দিকেই তাক করে থাকে।
বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা
পেরিয়ে গিয়েছিলো বিভার। দুই দিনের হাজিরার টাকা পেয়ে আজ প্রভার জন্য মেলা থেকে
চুড়ি-ফিতা কিনতে গিয়ে কিছুটা দেরী হলো। ঘরের সামনে আসতেই ভেতর থেকে কান্নার শব্দটা
কানে আসছিলো। দৌড়ে ঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়ায় বিভা। চৌকির উপর বসে হাঁটুতে মুখ লুকিয়ে
কাঁদছে প্রভা। পারুল ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছে। প্রভার
কান্নার দৃশ্য দেখে বিচলিত হয়ে ওঠে বিভা।
কি অইছে? প্রভা কান্দোস ক্যান? ওর কী অইছে পারু'বু?
কিছু অয়নাই, তয় আমি সময়মত না আইলে আইজ সর্বনাশ অইয়া যাইতো।
বিভা পারুলের দিকে
তাকায়।
ঐ হারামজাদা ওরে
একলা পাইয়া ঘরে ঢুকছিলো। প্রভার ভাগ্য ভালো আমি তহনই মেলা থেইক্যা ফিরতেছিলাম। ওর
চিৎকার হুইনা তোর ঘরের দিকে তাকাইয়া দেহি ঐ বদমাইশটা দরজা দিয়া ঢুকতাছে। আমি
দৌড়াইয়া আইসা তোর ঘরে ঢুকলাম। আমারে দেইখ্যা বদমাইশটা বাগানের দিকে পলাইয়া গ্যাছে!
বিভার মুখে
অনেকক্ষণ কোনো কথা ফোটে না। একসময় পারুলের হাত ধরে বলেÑ আমার চাচা-চাচি জানতে পারলে এই সুযোগে আমগো ভিডাছাড়া করবো, তহন কই গিয়া থাকুম? ডাঙ্গর মাইয়া, অরে লইয়া কার দ্বারে গিয়া খাড়ামু?'
পারুল কিছুটা
ক্ষেপে গিয়ে বলেÑ তুই এত নরম ক্যান রে বিভা! একটু শক্ত হ, নইলে দুনিয়াতে টিকতে পারবি না। বুঝলি, দুনিয়াডা বড় কঠিন!
বিভা দীর্ঘশ্বাস
ফেলে বলেÑ মাতার উপর কেউ না থাকলে শক্ত হওয়ার জোর পাওয়া
যায় না পারু'বু। আমার যে আপন কেউ নাই! বিভার চোখ ভিজে অঠে।
পারুল বলেÑ এহন কান্দনের সময় না বিভা। তোর চাচিও কিন্তু ব্যাপারডা
জানে। আমার পিছে পিছে হেয়ও আইছিলো। ঘরের মধ্যে একবার উঁকি দিয়া চইলা গ্যাছে। আমার
মনে হয় হেগো মনে অন্য মতলব আছে। হেরা তো তোরে খেদানোর সুযোগ খুঁজতেছিলো।
চমকে ওঠে বিভা।
পারুল আবার বলে- তোরে এহন অনেক শক্ত অইতে অইবো। হেরা বাড়ি ছাইড়া চইলা যাইতে কইলেই
তুই যাবি ক্যান? এইডা তোরও বাপের বাড়ি।
হেগো লগে কী আমি
পারি! আমার হেই শক্তি কই?
ক্যান, গ্রামে আর মানুষ নাই? অরা বাড়াবাড়ি করলে আমরা মাস্টার চাচার কাছে যামু। চিন্তা করিস না, গ্রামের আরও অনেকে তোর পক্ষে খাড়াইবো।
বিভা খুব ভালো করে
জানে,
মফিজ মিয়া এমন একটা সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল।
বিভাকে তাড়ানোর এমন মোক্ষম হাতিয়ার সে কিছুতেই হাতছাড়া করবে না। সাথে আছে মনু
মিয়া। অনেকদিন থেকেই ওর ভিটাটির দিকে নজর তার। দু’চোখে অন্ধকার দেখে বিভা।
কেরোসিন পুড়বে বলে
পিদিমটা নিভিয়ে দিতেই ঘরটা অন্ধকারে ছেয়ে যায়। বাইরে থেকে ছায়া-ছায়া প্রেতাত্মারা
হুড়মুড় করে ভেতরে ঢোকে, ঘরময় ছুটে বেড়ায়। অন্ধকারটা চোখে সয়ে এলে নিবিড়
নির্জনতায় সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে একটা হাহাকার ওঠে। সেই বুক তোলপাড় করা হাহাকারের
করুণ সুর কেউ শুনতে পায় না। আজ অসীমের কথা খুব মনে পড়ছে বিভার। অসীম ছিল বটবৃক্ষের
মতো,
ছায়া দিয়ে ঢেকে রেখেছিলো ওদের। মাথার উপর সেই
ছায়াটা এখন আর নেই, আজ শেয়াল-কুকুরে ছিঁড়ে খুবলে নিতে চায় ওদের
শরীর। রাত বাড়ে, বিভার দু'চোখে ঘুম
নেই। মাথার ভিতরে জট পাকানো চিন্তাগুলো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখে। নির্ঘুম সময়টা
ভারী পাথরের মতো সেঁটে থাকে বুকে।
এশার নামাজ শেষে
মুসুল্লিরা চলে গেলে মসজিদের আশেপাশের এলাকা গভীর নিস্তব্ধতায় ডুবে যায়। মাঝে
মধ্যে গাছপালার ফাঁক গলে গৃহস্থের ঘরের টিমটিমে আলোর রেখা চোখে পড়ে থেমে থেমে, যা বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে বাহিরে আসার পথ পায় না। ঘর-ফেরত
মানুষের আনাগোনাও কমে গেছে এখন। মসজিদ-সংলগ্ন ছোট্ট ছাউনি ঘরটায় নিচু স্বরে কথা
বলছে মনু মিয়া আর মফিজ মিয়া। কিছুক্ষণ পর নিঃশব্দে এসে ঢোকে খালেক তালুকদার।
মুখম-ল চাদরে আবৃত। কেবল চোখ দু’টো খোলা।
কামডা খুব সকাল
সকাল সারন লাগবো। বেশি লোকজন জানাজানির আগেই বিচার শ্যাষ করতে অইবো।
তুমি ঠিকই কইছো
খালেক। শুনলাম সাত্তার এলাকায় নাই। ও ফিরা আহনের আগেই কামডা শ্যাষ করন লাগবো।
আপনে ঠিক জানেন? বিহালে তাঁর লাইব্রেরির সামনে অনেকরে দ্যাখছি। হেয় না থাকলে
তো ঐহানে এত লোকজন থাকে না!
আমি খবর নিছি, সাত্তার এলাকায় নাই।
তাইলে ফজরের
নামাজের পর পরই কামডা সারতে হইবো।
খেজুর পাতার পাটিতে
বসে তসবি জপে আর দাড়িতে হাত বোলায় মনু মিয়া। বিভার ভিটাটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে
একবার। হারিকেনের নিস্তেজ আলোয় ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে ওঠা চোখ দুটো সবার অলক্ষ্যে নেচে
উঠেই নিভে যায় আবার। একটা আশংকা জেগে ওঠে মনে। বিভার প্রতি সারা গ্রামের মানুষের
সহানুভূতি আছে, উল্টাপাল্টা কিছু হলে সে গ্রামে টিকে থাকতে
পারবে তো!
আমার ক্যামন জানি
লাগতাছে মিয়াভাই। মাস্টারসাব, সাঈদ খা, ইসমাইল মোল্লা, হামিদ শেখ, কাজেম মাঝি, আতিক ভাই একজোট অইয়া কিছু করলে সামলাইতে পারবেন তো?
আরে হুজুর, আপনে এত চিন্তা করতাছেন ক্যান? আমরা আছি না! কাকপক্ষী টের পাওনের আগেই কামডা সাইরা ফেলমু।
একবার বিচার অইয়া গ্যালে আর কেডা কী করবো? আমগো মাইরা ফ্যালবো? তাছাড়া আমগো ধর্মে জেনাকারীর শাস্তির বিধান
আছে। খালেক তালুকদার বলে ওঠে।
ধর্মে শাস্তির
বিধান আছে, তয় ধর্মের মতে দেখলে এই মাইয়াডা কিন্তু দোষী
না। আর মাইয়াডা যে জেনা করছে তার কোনো প্রমাণ নাই।
মফিজ মিয়া বলে-
হেইডা আপনে প্রকাশ করবেন ক্যান? আপনে কইবেন, মাইয়াডা জেনা করছে। বিধান অনুযায়ী তার শাস্তি অইতে অইবো।
ব্যাস।
ঠিক আছে, আপনেরা য্যামনে কইবেন।
খবরটা চারিদিকে
ছড়ানোর আগেই মফিজ মিয়া এবং তার দলবল অত্যন্ত গোপনে সালিশের বেশ যুতসই ব্যবস্থা করে
ফেলে। বিপক্ষের কেউ যদি উপস্থিত হয়েই পড়ে, এমন পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য খালেক তালুকদার আর তার ভাই বাদল তাদের পক্ষের
লোকজনকে হাজির থাকার ব্যবস্থা করে রাখে।
কুয়াশার চাঁদর
জড়ানো থমথমে একটি সকাল। একটু দূরের ঝোপঝাড়-গাছপালা বেশ ঝাপসা লাগে। ঘুম থেকে উঠে
বাসি ঘর ঝাড়ু দিয়ে উঠানে এসে দাঁড়ায় পারুল। বাড়ির প্রবেশ পথের দিকে চোখ পড়তেই দেখে
একজন দু’জন করে লোকজন এসে জড়ো হচ্ছে মফিজ মিয়ার বারান্দায়। জানালা দিয়ে ভিতরে
তাকিয়ে চেনা চেহারাগুলো দেখে আঁতকে ওঠে পারুল। মনু মিয়ার সাথে খালেক তালুকদারের
লোকজন সব। পারুলের বুঝতে বাকি থাকে না এত লোকজন জড়ো হবার উদ্দেশ্য। ঝাড়–টা উঠানে
ফেলে রেখেই বিভার ঘরের দিকে দৌড় দেয় সে।
কী কইলা পারু’বু!
এহন আমি কী করুম?
ল, মাস্টার চাচাগো বাড়ি যাই।
মাস্টার চাচায় তো
বাড়ি নাই, শিউলিরে দ্যাখতে মুক্তনগর গেছে।
আমি কাজেম চাচা আর
আতিক ভাইরে ডাকতে যাইতাছি। হামিদ চাচার কাছে রতনরে পাডাইতাছি। তুই চিন্তা করিস না
বিভা,
যা করনের হেরাই করবো।
আমার মাথায় কিছু
খেলতাছে না পারু’বু। তুমি যা ভালো বোঝ কর।
মফিজ মিয়ার ঘরের
সামনে সভা বসেছে। বিচারকের আসনে ছোট হুজুর মনু মিয়া। তার দুই পাশে চেয়ারে বসা মফিজ
মিয়া আর খালেক তালুকদার। সামনে দর্শকের সারিতে বাদলের সাথে দাঁড়ানো জনা পনেরো উঠতি
বয়সী তরুণ। মফিজ মিয়ার ঘরের সিঁড়িতে মায়ের পাশে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে প্রভা।
‘একশ দোররা। লগে
মাথা ন্যাড়া কইরা দেওয়া হউক।’
ছোট হুজুরের ঘোষণা
শুনে বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে বিভার। ছুটে গিয়ে মফিজ মিয়ার পা জড়িয়ে ধরে। 'চাচাজান আমার মাইয়াডারে বাঁচান। ওরে এত বড় শাস্তি দিয়েন না, ও বাঁচবো না।'
আমি কী করমু কও? আমার মান সন্মান তো মাটিতে মিশাইয়া দিছো তোমরা। ভাইয়ের
মাইয়া বইলা থাকতে দিছিলাম, তার ভালোই মূল্য দিছো। বিচারে সবাই যা ঠিক করবো
তাই হইবো। আমার কিছু কওনের নাই।
এমন সময় ছুটতে
ছুটতে সভার মধ্যে এসে দাঁড়ায় পারুল। বিভার হাত ধরে টেনে তুলে বলেÑ তুই কার কাছে সাহায্য চাইতাছোস? যে এই সাজাইন্যা বিচার বসাইছে হেয় তোর মাইয়ারে বাচাইবো, কিছু বুঝোস না? এই বিচার বন্ধ করার লোকজন আইতাছে। চুপ কইরা খাড়া এইহানে, দেহি কার এত সাহস প্রভারে দোররা মারে!
পারুলের কথা শেষ
হতে না হতেই সভায় উপস্থিত হয় কাজেম মাঝি আর আতিক।
এইহানে কীসের শালিস
বইছে?
মনু মিয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন কাজেম
মাঝি।
মনু মিয়া চুপ করে
থাকে। মফিজ মিয়া বলে ওঠে- এইহানে জেনাকারীর বিচার হইতাছে।
কেডা বিচার করতাছে?
তুমি-আমি ধর্মের কী
জানি?
ধর্মের বিধান অনুযায়ী মনু হুজুর বিচার করবেন!
তাইলে এইহানে
আপনেরা সবাই ধর্ম উদ্ধার করতাছেন! কিন্তু কার বিচার হইতেছে? শ্লেষ মেশানো কণ্ঠে আতিক প্রশ্ন করে।
কাইল সন্ধ্যায় বিভা
ঘরে আছিলো না, তহন বিভার যুবতী মাইয়ার ঘরে একজন বেগানা পুরুষ
ঢুকছিলো। খালেক তালুকদার বলে।
তুই দ্যাখছোস? কাজেম মাঝি ধমকে ওঠেন।
আমি দেখুম ক্যামনে, আমি কী এইহানে থাকি?
তাইলে তুই বিচার
বসাইছোস ক্যান?
আমি এই এলাকার
জনপ্রতিনিধি, আমার একটা দায়িত্ব আছে না?
আইচ্ছা! এইজন্যই
কাউরে কিছু না জানাইয়া সূর্য ওঠার আগেই গোপনে কামডা সাইরা ফেলাইতে চাইছিলা? আতিক বলে।
এইহানে এত মানুষ
থাকতে গোপন বিচার অইলো ক্যামনে?
এইসব শিয়াল-কুত্তা
আবার মানুষ অইলো কবে? বাদলের সাথের লোকজনকে দেখিয়ে বলে আতিক।
কিছু বলতে গিয়ে
খালেক তালুকদারের চোখে পড়ে আশেপাশের বাড়ি থেকে দশ-বারোজন তরুণ লাঠিসোঠা নিয়ে কাজেম
মাঝির পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। কালাম এসে পাশে দাঁড়াতেই কাজেম মাঝি জিজ্ঞেস করেন- আর
সবাই আইছে?
ইসমাইল স্যার, হামিদ চাচা, হেলাল চাচা আর হুমায়ুন চাচা আইতাছে, ছমিররে আরও লোকজনরে খবর দিতে পাঠাইছি। সাঈদ কাকারেও খবর পাঠানো হইছে।
একটাও এইহান
থেইক্যা নড়বি না, আইজ কেডা কার বিচার করে দেখুম। মফিজ মিয়া আর
খালেক তালুকদারের দিকে তাকিয়ে বলেন কাজেম মাঝি।
মনু মিয়া মফিজ
মিয়ার দিকে তাকায়। মফিজ মিয়া না দেখার ভান করে কাজেম মাঝির দিকে ফিরে আমতা আমতা
করে বলেÑ তোমরা বিচারে থাকতে চাইলে থাকবা, কিন্তু এমন বে-শরিয়াতি কামের বিচার তো হওয়া দরকার।
হামিদ শেখের পেছনে
পেছনে ইসমাইল মোল্লা, হেলাল উদ্দিন আর হুমায়ুন হাওলাদার এসে হাজির
হয়। সভার চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে হামিদ শেখ জানতে চাইলেনÑ হুনলাম এইহানে সালিশ বসছে, কেডা কার বিচার করতাছে?
আতিক বলেÑ চাচা, এইহানে কতগুলা
শিয়াল-কুত্তা ভাড়া কইরা আইনা মফিজ চাচা আর খালেইক্যা বিচার বসাইছে। মনু হুজুর রায়
দিছেÑ
বিভার মাইয়ার মাথা ন্যাড়া কইরা একশ দোররা মারা
হইবো!
কাহিনী কী মফিজ? বিভার মাইয়ার অপরাধ কি?
বিভার মাইয়া জেনা
করছে। মফিজ মিয়া বলে ওঠে।
কেডা দ্যাখছে? ইসমাইল মোল্লা জিজ্ঞেস করেন।
কাইল সন্ধ্যায়
ভাবীসাবে বিভার ঘর থেইক্যা একজন জোয়ান মানুষরে বাইর হইয়া যাইতে দ্যাখছে। খালেক
তালুকদার উত্তর দেয়।
কাজেম মাঝি পারুলের
দিকে তাকালে সামনে এগিয়ে আসে সে। সভায় উপস্থিত লোকজনের উদ্দেশ্যে বলে, ‘চাচা এই ঘটনার একমাত্র সাক্ষী হইলাম আমি। হারু গাজীর ঐ
বদমাইশ পোলাডারে বিভার ঘরে ঢুকতে দেইখ্যাই দৌড় দিয়া অগো ঘরে যাই আমি। আমারে
দেইখ্যা লুইচ্চাডা বাগানের মধ্যে দিয়া পলাইয়া যায়। পেয়ারা চাচি তার অনেক পরে
অইহানে যায়, তাইলে হেয় ক্যামনে আসল ঘটনা জানলো?’
তো মফিজ, ঘটনা তো ভালোই সাজাইছিলা! বলে মনু মিয়ার দিকে ফিরলেন হেলাল
উদ্দিন। ’এহন দোররা কেডা মারবো মনু মিয়া?’
হঠাৎ এমন প্রশ্ন
শুনে হকচকিয়ে গেল মনু মিয়া। মফিজ মিয়া আর খালেক তালুকদারের দিকে তাকিয়ে বুঝলো
তাদের সাহায্য আশা করা বৃথা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য বলে উঠলো,
আমি তো আসল ঘটনা
জানতাম না ভাইসাব, উপস্থিত সবাই ঘটনার য্যামনে বিবরণ দিছে সেই মতে
বিচারের সিদ্ধান্ত অইছে। এহন আপনেরা সবাই মিল্লা যা ভালো মনে করবেন তাই হইবো।
কাজেম মাঝির পেছন
থেকে তীব্র প্রতিবাদ করে ওঠে লোকজন। ‘এই মৌলভি একটা ভ-, এইডারে ঠেঙাইয়া গ্রামছাড়া করতে অইবো।’ দু’একজন লাঠি নিয়ে
তেড়ে যেতেই আতিক তাদের থামায়। ‘তোগো কিছু করার দরকার নাই, মনু হুজুরের বিচার অবশ্যই অইবো’
বাড়ির প্রবেশ পথের
দিকে চোখ পড়ে মফিজ মিয়ার। সাঈদ খানের সাথে বিশ-পচিশজন লোককে বাড়িতে ঢুকতে দেখে উঠে
দাঁড়ায়।
তুমি কই যাও? হামিদ শেখ বলে ওঠেন।
আমি আর কই যামু? তোমরা হগগলে আইছো, এহন সবাই মিইল্যা যা ভালো মনে করবা তাই হইবো। নরম গলায় বলে মফিজ মিয়া।
সাঈদ খানকে দেখে
বাদলের লোকজনকে উদ্দেশ্যে সবার বসার জন্য চেয়ারের ব্যবস্থা করতে বলে খালেক
তালুকদার। হামিদ শেখ বলেন- না না মেম্বারসাব, আপনে মানি মানুষ চেয়ার থেইক্যা উঠলেন ক্যান? বিচারকের আসন থেইক্যা ওঠোন ঠিক না, আপনে বসেন। আমরা তো বিচার দ্যাখতে আইছি, বিচার করেন।
সাঈদ খানকে সব ঘটনা
খুলে বলেন কাজেম মাঝি। সাঈদ খান বলেন- ও আইচ্ছা! ঘটনা তাইলে এই? সাত্তার এলাকায় নাই, হেই সুযোগে এরা কামডা সারতে চাইছিলো। পারুল না থাকলে তো কাম হইয়াই গ্যাছিলো!
সাঈদ খান বাদলের
লোকজনের দিকে ইঙ্গিত করে জানতে চাইলেন- এরা কারা? এগোরে তো চিনলাম না! কেউ কোনো কথা বলে না। ইসমাইল মোল্লা সামনে দাঁড়ানো একটি
তরুণকে জিজ্ঞেস করেনÑ তোর বাড়ি কই?
সুবর্ণপুর।
কার পোলা তুই?
রহম আলী সরদার।
এইহানে ক্যান?
তরুণটি চুপ করে
থাকে।
তুই কেডা? পাশের ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করেন হামিদ শেখ।
ও সুবর্ণপুরের
জামাল বিশ্বাসের পোলা। বাদল জবাব দেয়।
তোগোরে এইহানে
ডাকছে কেডা? ইসমাইল মোল্লা জিজ্ঞেস করলেন।
কোন উত্তর নেই।
কয়েকজন বাদলের মুখের দিকে তাকায়। খালেক তালুকদারের ধূর্ত চোখের ইঙ্গিতটা ধরে ফেলে
বাদল। কিছুক্ষণ পর বাদল বলে- অরা মাঝে মধ্যেই রাইতে আমগো বাড়িতে থাকে, কাইলক্যাও আছিলো। এমনিই আমার লগে আইছে।
কিছু বুঝলা? সাঈদ খানের দিকে তাকিয়ে বললেন কাজেম মাঝি।
সাত্তার তো আইজকাই
ফিরা আইবো, তাই না?
হ, আইজই তো আহনের কতা।
তাইলে কাইল বিকালে
ক্লাবঘরে বিচার বইবো, আইজকার এই ঘটনারও বিচার হইবো। যারা যারা এইহানে
আছে সবাইরে য্যান বিচারে হাজির দেখি। আর হারু’র বদমাইশ পোলাডারে অবশ্যই হাজির করন
চাই। খালেইক্যা, এই দায়িত্ব তোর। খালেক তালুকদারের দিকে আঙুল
তুলে বলেন সাঈদ খান।
খালেক তালুকদার
মৃদু কণ্ঠে বলেÑ কাকা আমার কতা কী হেরা হুনবো?
ক্যান হুনবো না? আইজক্যা তাগো পক্ষ লইয়া তুই এই বিচার বসাইছোস না? কাইলক্যা অগো তুই-ই হাজির করবি।
সবাই চলে গেলে মফিজ
মিয়া উঠানের মাঝে গম্ভীর মুখে বসে থাকে। পেয়ারা বেগম সামনে এসে দাঁড়ায়।
আমি যে এত কইরা কই
তা তো হুনেন না! যত নষ্টের গোড়া এই পারু।
মফিজ মিয়ার মেজাজ
এমনিতেই খিঁচড়ে আছে, তার উপর বউয়ের এই গজর-গজর ভালো লাগে না। নিজেকে
আর সামলাতে পারে না। ধমকে উঠে বলে- তুই যাবি এইহান থেইক্যা না ঝাড়ুর বাড়ি খাবি!
যামু। আপনের চেহারা
দেখতে এইহানে আহি নাই। তয় আমিও কইয়া রাখলাম, বিভারে যদি আমি ঐ ভিডা থেইক্যা না খেদাইছি তো আমিও জামশেদ মাতুব্বরের মাইয়া
না!
বিকালের হু-হু
হাওয়া উজানগাঙের উপর দিয়ে বয়ে যায় দক্ষিণ থেকে উত্তরে। প্রবল স্রোতের তোড়ে পানিতে
ভেসে যায় কচুরিপানা-গুল্মলতার দল নিতান্ত অবহেলায়। ভেসে যাওয়াই যেন এদের পরিণতি।
কাজেম মাঝি বিরস মনে সেদিকে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
ভাবতাছিলাম আইজ
সময়মত খবরটা না পাইলে শয়তানগুলা সর্বনাশটা ঘটাইয়া ফেলতো। এইগুলার বিরুদ্ধে কিছু
একটা করা খুব জরুরি।
অনেকটা ক্ষোভের
সাথে সাঈদ খান বলে উঠলেন- তোমগো ঐ মনু মিয়ারে আমার কোনোদিনই পছন্দ হয় নাই। আমগো
বাজারের ইমামসাবরে দেখো, সাচ্চা মানুষ। কিন্তু ঐ মনু ব্যাটারে দেখলেই
আমার ক্যান জানি মতলববাজ মনে অয়।
কতা তুমি মিছা কও
নাই। মনু মিয়া হইলো মফিজের দালাল। মফিজ আর তার-বউ ঐ ব্যাটারে বিভার ভিডার লোভ
দেখাইয়া এই কাম করাইতাছে। বলদা ব্যাটা বুঝতেই পারতাছে না যে মফিজ জীবনেও তারে ঐ
ভিডা দেবে না।
খালেইক্যার
ব্যাপারডা ঠিক বুঝতাছি না চাচা। হারু-মজনুর লগে তো অগো দা-কুড়াল সম্পর্ক, কিন্তু হারুর পোলারে বাচানের লইগ্যা অর এত গরজ ক্যান? ভিতরে নিশ্চয়ই অন্য কোনো ব্যাপার আছে। আতিক বলে।
এইডা কিন্তু আমিও
ভাবছি। নিশ্চয়ই খালেইক্যার কোনো মতলব আছে। সাঈদ খান বলেন।
কাজেম মাঝি বলে
ওঠেন- পিয়াজ-রসুনের গোড়া সব এক জায়গায় বুঝলা?
এমন সময় হামিদ শেখ
আর ইসমাইল মোল্লা এসে আসরে যোগ দেয়। হামিদ শেখ বলেন- দোষটা কিন্তু আমগোই। ঐগুলান
অইলো সব হাড়-বজ্জাত। আমরা চুপ থাকনেই অরা এত সাহস পাইছে। এহনো কী চুপ কইরা থাকুম
নাকি সবাই মিল্লা কিছু করবা?
কাজেম মাঝি বলে
উঠলেন- এর একটা বিহিত অবশ্যই করণ লাগবো। সাত্তার ফিরা আসুক। কাইল মিটিঙের পর এই
ব্যাপারে সবাই বইসা একটা সিদ্ধান্ত নিতে অইবো।
সন্ধ্যার বেশ
কিছুটা আগে বাড়িতে ঢুকলেন সাত্তার মাস্টার। কয়েক ঘণ্টার পথযাত্রায় ক্লান্ত। কাপড়
বদলে ঘরের সিঁড়িতে এসে বসলেন। বাবাকে দেখতে পেয়েই দৌড়ে এসে কোলে ঝাপিয়ে পড়ল অয়ন।
বড়দি কেমন আছে বাবা?
ভালো।
আমার কতা কিছু কইছে?
হুম! তোমার কথা না
কইয়া পারে! বড়দি তো সারাক্ষণই অনুর কথা কয়। অনু কেমন আছে, কত বড় হইছে, লেখাপড়া ঠিকমত করে কি-না!
আমি তো ঠিকমতই
লেখাপড়া করি। বড়দি কইছিলো ফার্স্ট হইলে আমারে পুরষ্কার দেবে। আমি তো আগের পরীক্ষায়
ফার্স্ট হইছি, দেইখো এইবারও হমু।
সাত্তার মাস্টার হাসেন।
বড়দি তো কইছে তোমারে পুরস্কার দেবে। তাইলে আর চিন্তা কি?
সালমা বেগম পাশে
এসে বসলেন। শিউলির খোঁজখবর নেয়ার পর বিভার প্রসঙ্গটা তুললেন। শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে
উঠলেন সাত্তার মাস্টার। ‘এইডা কী মগের মুল্লুক নাকি? এত্তো বড় অবিচার!’ প্রতি-উত্তরে সালমা বেগম বলেন- অরা তো তা-ই মনে করে। আপনে
গ্রামে না থাকায় অগো সাহসটা আরও বাইড়া গেছিলো। পারুল সময়মত সাবাইরে খবরটা না
জানাইলে ঐ হারামিগুলা প্রভারে মনে হয় মাইরা ফালাইতো!
মন্টুকে ডেকে
সাত্তার মাস্টার জিজ্ঞেস করলেন। মন্টু সকালের পুরো ঘটনা খুলে বলল। আচ্ছা! দেখি
খালেইক্যার এত্ত সাহস কোত্থেইকা হয়।
সন্ধ্যা হয় হয়।
সালমা বেগম সন্ধ্যাবাতি জ্বেলে মূল ঘরের মাঝে এসে দাঁড়াতেই চোখে পড়ে আবছা অন্ধকারে
উঠানের মধ্য দিয়ে হেঁটে আসছে বিভা। তিনি সামনের বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন।
কি-রে, এই সন্ধ্যাবেলায় তুই! আবার কোনো ঝামেলা হইছে না কি?
ঝামেলার কী আর শ্যাষ
আছে চাচি! আমি মরলে যদি ঝামেলা কমে।
তুই মরলে কারো কোনো
ক্ষতি অইবো না রে বিভা, তোর মফিজ চাচার আরও লাভ অইবো। হেয় বিনা
আপত্তিতে তোর সম্পত্তি ভোগ করতে পারবো।
সম্পত্তির চিন্তা
কইরা আর কী অইবো? সম্পত্তি নিয়াই তো এতকিছু। আইজ-হউক কাইল-হউক এই
সম্পত্তি হেয়-ই ভোগ করবো। চাচি নাকি কইতাছে আমি ক্যামনে এই ভিডায় থাকি হেয়
দ্যাখবো।
চিন্তা করিস না।
তোর মাস্টার চাচায় ফিরছে। কাইল তো বিচার বইতাছে, এই জুলুমের একটা হেস্তনেস্ত অবশ্যই হইবো।
প্রভার গায় জ্বর
উঠছে চাচি। আবোল-তাবোল কইতাছে। চাইরদিকে আন্ধার দ্যাখতাছি, তাই পারু’বুরে ঘরে রাইখ্যা আপনের কাছে ছুইটা আইছি।
নামাজ শেষে ঘরে
ঢুকে বিভাকে দেখে এগিয়ে এলেন সাত্তার মাস্টার। বিভা তখন মাটির দিকে তাকিয়ে চুপ করে
দাঁড়িয়ে। দু’চোখে জল টলটল করে। পিদিমের মৃদু আলোয় তা চোখ এড়ায় না সাত্তার
মাস্টারের। হঠাৎ মাস্টারের দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় বিভা বলল,
চাচা, বাবার কাছে হুনছিলাম আমার নামডা আপনে রাখছেন। আমার নামের
অর্থ নাকি ‘সূর্যের আলো’। সূর্যের আলোয় তো চোখ ধাঁধাইয়া যায়, কিন্তু আমার জীবনে এত আন্ধার ক্যান চাচা?
সাত্তার মাস্টার
স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। এ প্রশ্নের কী উত্তর দেবেন তিনি? কী করে বোঝাবেন যে বিভা আজ সামাজিক অবক্ষয় আর কিছু লোভী
মানুষের প্রতিহিংসার শিকার। এর শেকড় আরও গভীরে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌঁছে
গেছে। যে প্রত্যাশা নিয়ে তাঁরা স্বাধীনতার জন্য লড়েছিলেন, এত বছর পর এখন মনে হচ্ছে তা আজও অসম্পুর্ণ রয়ে গেছে। যতদিন
এইসব লোভী মানুষগুলোকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে না পারবেন, ততদিন প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার সুফল পাওয়া যাবে না।
এই কথাগুলো বিভাকে
আর বলা হয় না সাত্তার মাস্টারের। তিনি বললেন- তুই চিন্তা করিস না, এই ঘটনার বিচার অবশ্যই অইবো। আমরা থাকতে তোর মাইয়ার গায়ে
কেউ হাত তুলতে পারবো না।
শেফালির মা নাকি
কইছে বিভা ক্যামনে ঐ ভিডায় থাকে হেয় দেইখ্যা ছাড়বো। সালমা বেগম বলে ওঠেন।
মফিজ আর তার বউয়ের
ইচ্ছামতো সবকিছু অইবো নাকি? গ্রামে আরও দশজন আছে।
থাউক চাচা, মাইয়াডার জ্বর ভালো অইলে আমি অন্য কোত্থাও চইলা যামু।
ক্যান, তোর বাপের ভিডা ছাইড়া তুই যাবি ক্যান? আমরা আছি না!
এই জায়গার লইগ্যাই
তো আমার জীবনে এত লালত! ঐহানে থাকনের আর সাধ নাই।
ঠিক আছে, ঐহানে থাকতে না চাইলে আমার ভিটাবাড়িতে ঘর তুইলা দিমু। তোর
যতদিন খুশি এইহানে থাকিস। নে, এই টাকাটা দিয়া তোর
মাইয়াডারে ডাক্তার দেখা। সাত্তার মাস্টারের বাড়ানো হাতটার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে
থাকে বিভা।
নে, এহন শরম পাওয়ার সময় না। মাইয়াডারে অসুধ-পথ্য খাওয়া। সালমা
বেগমের কথা শুনে সাত্তার মাস্টারের হাত থেকে টাকাটা নিয়ে বিভা অন্ধকারের মধ্যে
বাড়ির দিকে ফিরে চলে।
সাত্তার মাস্টার
গিয়াসের দিকে সরাসরি তাকিয়ে রইলেন। সে জ্বলন্ত চোখের ভাষা গিয়াসের অজানা নয়, তবুও এই মুহূর্তে সেদিকে তাকানোর শক্তি বা সাহস কোনোটাই তার
নেই। সাত্তার মাস্টারের দিকে একবার চেয়েই চোখ নামিয়ে নিল। হারু গাজীর মধ্যে কোনো
ভাবান্তর নেই। চুপচাপ বসে সবকিছু অবলোকন করছে। ক্লাবঘরে গিজগিজ করছে মানুষ। সে আঁচ
করতে পারছে সবার ক্ষোভ তার ছেলের প্রতি; মফিজ মিয়া-খালেক-মনু মিয়ার পক্ষে আজ কিছুই করা সম্ভব নয়। তারা আজ নিজেদের
সামলাতেই ব্যস্ত থাকবে।
সাঈদ খান খালেক
তালুকদারকে লক্ষ করে বিদ্রুপমাখা কণ্ঠে বলে উঠলেন,
মেম্বারসাব, এত প্ল্যান কইরা কাইলক্যা সালিশ বসাইছিলেন, তো এহন বিচারটা শুরু করেন!
হঠাৎ এমন কথায়
খালেক হকচকিয়ে যায়, সে আমতা আমতা করে।
হ, শুরু করেন মেম্বারসাব! শীতল গলায় যোগ করলেন কাজেম মাঝি।
খালেক একবার মফিজ
মিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখে সে নির্বিকার। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে সাঈদ খানের উদ্দেশ্যে
মৃদু কণ্ঠে বলে- আপনেরা সবাই যহন আছেন তাইলে আমি আর কী কমু?
ক্যান, আপনের কিছুই কওনের নাই? হামিদ শেখ ফোঁড়ন কাটেন।
আপনেরা থাকতে আমার
কী কওয়ার আছে? আপনেরা যা করবেন তা-ই সই।
এই কথা কইলক্যা মনে
আছিলো না? এলাকার মানুষ হইয়াও আমরা কিছু জানলাম না, অথচ সূর্য ওঠার আগেই সুবর্ণপুরের যদু-মদুর আন্ডা বাচ্চারা
সালিশে হাজির হইয়া যায়! এইগুলা কার কাম আমরা বুঝি না? খালেকের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন ইসমাইল মোল্লা।
খালেক কোনো রা’ করে
না।
সাত্তার মাস্টার
মনু মিয়ার দিকে ফিরলেন।
তো ছোড হুজুর, আপনের কী খবর? একশ দোররা! মাথা ন্যাড়া কইরা গ্রাম ঘুরানোর রায় না-কি দিছিলেন হুনলাম; কাহিনী কী খুইলা কন তো!
মনু মিয়ার কণ্ঠ
থিতিয়ে যায়। মৃদু কণ্ঠে সে বলে- মিয়াসাব আমি তো সবকথা জানতাম না। আমি শুনছি বিভার
মাইয়ার ঘরে একজন বেগানা পুরুষ ঢুকছে, এবং এতে তারও সায় আছিলো।
আপনে খালি
হুনছিলেন! কিছু দ্যাহেন নাই? কাইলক্যার গলার সুর
দেখি আইজক্যাই বদলাইয়া গ্যালো, ঘটনা কি? শ্লেষ মাখানো কণ্ঠে বললেন কাজেম মাঝি।
কাইলক্যা তো খুব
লাফালাফি করতাছিলেন, আইজক্যা এমন চুপসাইয়া গ্যালেন ক্যান? কৌতুকপূর্ণ হাসি হাসে আতিক।
মনু মিয়া কিছুক্ষন
চুপ থেকে নিচু স্বরে বলল- মিয়াসাব, আমি আসলে বুঝতে পারিনাই। এহন সবাই মিল্ল্যা যা ভালো মনে করেন তা-ই সিদ্ধান্ত
নিবেন।
স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে
সাঈদ খান হো-হো করে হেসে উঠলেন। ’মনু মিয়া আইজক্যাই সাবালক হইছে!’
দর্শকের মধ্যেও
হাসির রেশ ছড়িয়ে পড়ল।
সাত্তার মাস্টার
মনু মিয়ার দিকে ফিরলেন। তার রক্তচক্ষু দেখে উপস্থিত সবাই চুপ হয়ে গেল।
আপনেরে এই গ্রামের
বিচারক নিয়োগ করছে কেডা?
মনু মিয়া নিরুত্তর।
সাত্তার মাস্টার ধমকে ওঠেন আবার।
এইবারের মতো মাফ
কইরা দিলাম, ফের যদি এমন মাতব্বরি করতে দেখি ঘাড় ঘইরা গ্রাম
থেইক্যা বাইর কইরা দিমু। এই মফিজের সাধ্য নাই আমারে ঠেকায়। সাবধান।
মফিজ মিয়া কিছু
বলতে গিয়েও চুপ হয়ে যায়। হামিদ শেখ বলে উঠলেন- মফিজের দালালি কইরা পার পাইবেন না
মৌলভিসাব। সাবধান অইয়া যান।
মনু মিয়া মাথা নিচু
করে চুপচাপ বসে থাকে। তার ফর্সা মুখে নিমেষেই যেন আঁধার নেমে আসে। বেশ কিছুক্ষণ
কেউ কোনো কথা বলে না। হঠাৎ সামনে তাকিয়ে গিয়াসকে ইশারায় কাছে ডাকলেন সাত্তার
মাস্টার। বাপের পাশ থেকে সাত্তার মাস্টারের সামনে এসে দাঁড়ায় গিয়াস। তিনি সরাসরি
প্রশ্ন করলেন,
বিভার ঘরে ঢুকছিলি
ক্যান?
আমি ঢুকি নাই ছার।
আবার মিথ্যা কতা
কস!
আমি সত্য কইতাছি।
মিথ্যা কতা চাচা।
অরে বিভার ঘরে ঢুকতে দেইখ্যাই আমি দৌড়াইয়া যাই। এই শয়তানডা আমার সামনে ঘর থেইক্যা
বাইর হইয়া গ্যাছে। ক্ষুব্ধকণ্ঠে বলে পারুল।
একদিন রাইতের
অন্ধকারে তোরে আমি বিভার ঘরের সামনে খাড়াইয়া থাকতে দেখছি না? হেইডাও কী মিছা কতা? সাত্তার মাস্টার ধমকে ওঠেন।
গিয়াস মাথা নিচু
করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তারাপদ ঘোষ উঠে দাঁড়ায়। স্কুল থেইক্যা ফেরনের সময় বিভার
মাইয়ার পথ আটকাস নাই তুই? তারপর উপস্থিত সবার দিকে ফিরে বলে, খাল-পাড়ের রাস্তায় কালীখোলার পাশে থেইক্যা প্রভারে জোর কইরা
তুইল্যা নেবার চাইছিলো এই হারামজাদা। আমি সময়মত ঐহানে হাজির না অইলে হেদিনই
মাইয়াডার সর্বনাশ হইতো।
কি, এহন কতা কস না ক্যান হারামির বাচ্চা! ইসমাইল মোল্লা গর্জে
ওঠেন।
গিয়াস নিশ্চুপ।
দর্শকের মধ্যে থেকে শোরগোল ওঠে। অরে জুতার মালা গলায় দিয়া সারা গ্রাম ঘুরানো হঊক।
সাত্তার মাস্টার
উঠে দাঁড়ালেন। হঠাৎ পা থেকে একপাটি জুতা খুলে পরপর কয়েকটা বাড়ি হাকালেন। ছেলের উপর
এমন আক্রমনে হারু গাজী থ’ বনে গেল। বসা অবস্থায়ই থরথর করে কাঁপতে লাগলো। কিছুটা
থিতু হয়ে হতাশ কণ্ঠে বলে উঠলো- আমার পোলা বইলাই গায়ে হাত তুলতে পারলেন মাস্টারসাব, এই বয়সে সবাই টুকটাক এমন কইরা থাকে।
হামিদ শেখ ক্ষিপ্ত
কণ্ঠে বলে উঠলেন- গাছ খারাপ হইলে ফল কী আর ভালো হয়? এই বুইড়া হারামজাদারে ধইরা পেটানো দরকার আছিলো। তাইলে অর পোলা গ্রামের পরিবেশ
নষ্ট করার সাহস পাইতো না।
হারু গাজী ফাটা
বেলুনের মতো চুপসে যায়।
সাত্তার মাস্টার
বললেনÑ এরপর এমন হইলে তা-ই করা হইবো। তারপর গিয়াসের
দিকে ফিরে বললেনÑ তোরে যদি আর কোনোদিন বিভা কিংবা মফিজের বাড়ির
আশেপাশে দেখি তাইলে পিটাইয়া হাড়গোড় ভাইঙা দিমু। মনে রাখিস।
সাঈদ খান খালেক
তালুকদারের দিকে ফিরলেন। ’ভিন-গাঁয়ের পোলাপান ডাইক্যা গোপনে বিচার বসাও!
মেম্বরগিরি ফলাও? গ্রামের কোনো উন্নয়ন তো দেখি না। এরপর থেইক্যা
এমন মাতব্বরি করতে দেখলে থাবড়াইয়া তোর বত্রিশ দাত ফালাইয়া দিমু শুয়োরের বাচ্চা।’
খালেক তালুকদার
ভেতরে ভেতরে গোখরা সাপের মতো ফোঁসফাস করলেও বাইরে বিষহীন ডোরা সাপের মতোই কুঁকড়ে
যায়। দর্শকের সারিতে দাঁড়িয়ে ভাইকে এমন হেনস্থা হতে দেখে নিঃশব্দে সভা ছেঁড়ে
বেরিয়ে যায় বাদল।
সাত্তার মাস্টার
এবার মফিজ মিয়ার দিকে ফিরলেন। তো মফিজ, তোমার কী কওনের আছে?
আমি আবার কী কমু? ধর্মে জেনাকারীর বিচারের কথা বলা আছে, আমরা কেউ এর বাইরে না।
কেডা জেনা করছে?
হেইডা নতুন কইরা
কইতে অইবো ক্যান?
অবশ্যই কইতে অইবো। একটা
নির্দোষ মাইয়ারে শাস্তি দেওনের তুমি কেডা? গ্রামের মানুষ কী মইরা গ্যাছে? চিৎকার করে উঠলেন হামিদ শেখ।
আমি কী একলা বিচার
বসাইছি, অইহানে কী আর কেউ আছিলো না?
হ, তোমার লগে কতগুলা কুকুরছানা আছিলো, যেইগুলা রাস্তাঘাটে ঘেউঘেউ করে। তুমি য্যামন, ঐগুলাও তেমন! উত্তেজিত হয়ে ওঠেন হুমায়ূন হাওলাদার।
সাঈদ খানের গলায়
ঘৃণার আভাষ স্পষ্ট। ছিছি মফিজ! এই বয়সে ভরা মজলিশে এমন মিথ্যাচার করতে তোমার লজ্জা
করে না?
মফিজ মিয়া ভেতরে
ভেতরে ফুঁসতে লাগলো তবে বাইরে তার প্রকাশ নেই। সে জানে খালেক-মনু মিয়ার মতো তার
পক্ষেও কেউ কথা বলবে না। তবুও নিজের স্বভাবসুলভ গোয়ার্তুমি বজায় রাখে।
সাত্তার মাস্টার
বললেন- সবাই যদি সময় দাও তাইলে আমি একটু ঘটনার পেছনে ফিরা যাইতে চাই।
সময় কোনো ব্যাপার
না,
তোমার যা কওয়ার কও। সাঈদ খান সায় জানালেন।
সাত্তার মাস্টার
মফিজ মিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন- রহিম ভাই আমগো সবারই খুব চেনা মানুষ আছিলেন। আমি
ছোডবেলা থেইক্যাই তাঁরে বড় ভাইয়ের মতোই সম্মান করছি। সারা গ্রামে কেউ তাঁর নামে
খারাপ কিছু কইতে পারবো না। সহায়-সম্পত্তি তাঁরও কম আছিলো না, কিন্তু তাঁর মাইয়া বিভার আইজ এই দশা ক্যান? তিনি তো কারো কোনো ক্ষতি করেন নাই, তাঁর মাইয়াও না। তাইলে আইজ অরে এত কষ্ট সহ্য করতে অইবো
ক্যান? অর বাপের সম্পত্তি কই গ্যালো?
কাজেম মাঝি বলে
উঠলেন- আমরা সবাই এর কারণ জানি। বিভার এই অবস্থার লইগ্যা কেডা দায়ী তাও জানি। এই
মফিজ বিভারে শুধু সহায় সম্পত্তি থেইক্যা বঞ্চিত কইরাই ক্ষান্ত হয় নাই, আইজ ওর নির্দোষ মাইয়াডারে মাইরা ফেলানের ষড়যন্ত্র করছিলো।
এর কী বিচার হওয়া উচিৎ না?
দর্শকের সারি থেকে
চিৎকার শোনা যায়Ñ হ, তারও বিচার হওন চাই।
কি মফিজ মিয়া, এই ব্যাপারে তোমার কী কতা? বিভার সম্পত্তি কই? সাঈদ খান জিজ্ঞেস করলেন।
এইডা আমার
পারিবারিক ব্যাপার, এই বিষয় নিয়া এইহানে কোনো কতা হইবো না।
মফিজ মিয়া উঠে
দাঁড়ায়। ঘুরে সভা ছেঁড়ে যেতে উদ্যোগ নেয়। সাত্তার মাস্টার বলে ওঠেনÑ খাড়াও মফিজ।
মফিজ মিয়া পেছনে না
ফিরে ভিড়ের মাঝেই দাঁড়িয়ে পড়ে। সাত্তার মাস্টার দৃঢ়কণ্ঠে বলেনÑ স্পষ্ট কইরা শুইনা রাখো, বিভা অর ভিটায় থাকবো। অরে ঐখান থেকে উঠানের চেষ্টা করলে তার ফলাফল ভালো হইবো
না।
এবার ঘুরে দাঁড়ায়
মফিজ মিয়া। হুমকি দিতাছো? মারবা না-কি?
প্রয়োজন হইলে তা-ই
করুম।
সাত্তার মাস্টারের
কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই মফিজ মিয়া সভাকক্ষ ছেঁড়ে বের হয়ে যায়। দর্শকের মধ্য থেকে
একটা গুঞ্জন ওঠেÑ মফিজ মিয়া পলাইতেছে!
অপ্রত্যাশিত
বিপত্তিটা এড়ানো গেলেও সাত্তার মাস্টারের মনে একটা আশঙ্কা থেকেই যায়। মফিজ মিয়ার
মতো লোভী মানুষের কাছে বিভারা সারা জীবনই মার খায়। তাঁর ধারণা এখন বিভিন্নভাবে
বিভার জীবনটাকে অতিষ্ট করে তুলবে সে। গ্রামের মানুষ ক্ষেপে আছে ঠিকই, কিন্তু এও সত্য এতে মফিজ মিয়ার কিচ্ছু যাবে-আসবে না। একসময়
সবাই ভুলে যাবে সবকিছু। সাত্তার মাস্টার অনেক কিছুই ভুলতে পারছেন না। সেদিন বিকেলে
বিভার কথাগুলো বার বার বিদ্ধ করছে তাঁকে।
হামিদ শেখ, সাঈদ খান আর কাজেম মাঝিকে এগিয়ে আসতে দেখে লাইব্রেরীর
সামনের খোলা জায়গায় এসে বসলেন সাত্তার মাস্টার। একটু পরই হরিপদ ঘোষ, জগানন্দ বসু, ইসমাইল মোল্লা আর আতিক এসে হাজির হয়। হামিদ শেখ বলে ওঠেন,
এইগুলার বিরুদ্ধে
আরেকটা যুদ্ধ করতে অইবো দেখছি।
তুমি ঠিকই কইছো, কিছু একটা করা জরুরি অইয়া পড়ছে। দিন দিন অগো অনেক বাড়
বাড়তাছে। পোলাপানগুলাও একেটা হাড়ে-হারামি। এতদিন আমগো চুপ কইরা থাকন ঠিক অয়নাই।
সাঈদ খান বললেন।
কাজেম মাঝি গম্ভীর
গলায় বলে উঠলেন- আমি একটা বিষয় চিন্তা করতাছি।
খুইলা কও। হামিদ
শেখ বেশ আগ্রহী হয়ে উঠলেন।
সামনের ইলেকশানে
চেয়ারম্যান পদে তো আমগো সাঈদ খাড়াইবো, মেম্বার পদে আতিকরে খাড়া করাইয়া দিলে ক্যামন অয়?
আতিকের দিকে তাকায়
সবাই। সাঈদ খান কাজেম মাঝিকে প্রস্তাব সমর্থন করলেনÑএইডা একটা কামের কথা কইছো তুমি কাজেম। এই সময় আতিকের মতো একজনকেই দরকার।
এইসবের মধ্যে
নিজেরে আর জড়াইতে ইচ্ছা করে না কাকা। অন্য কাউরে এই দায়িত্ব দেন। সাঈদ খানের
উদ্দেশ্যে বলে আতিক।
কাজেম ঠিক কতাই
কইছে। তুমি ছাড়া গ্রামে যোগ্য আর কেউ নাই। শহীদ আরিফ ভাইয়ের পোলা তুমি।
মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তোমার নিজেরও একটা পরিচয় আছে। আশেপাশের দশ গ্রামে তোমার সামনে
খাড়ানোর মতো কেউ আছে? আতিকের উদ্দেশ্যে বললেন ইসমাইল মোল্লা।
নির্বাচনের অনেক
খরচ;
আমি এহন পারুম না কাকা।
সাত্তার মাস্টার
আতিককে অভয় দেন। -তোমার ডর নাই। খরচ আমরা সবাই মিল্লা চালামু। এই হারামিগুলারে আর
সুযোগ দেওন যাইবো না। এহন নিজেদেরই দায়িত্ব নিতে হইবো। তুমি আর না কইরো না আতিক।
আতিকের কাঁধে হাত
রাখে জগানন্দ। -সাঈদ ভাই আর তুমি নির্বাচিত হইলে গ্রামের চেহারা পাল্টাইয়া যাইবো।
তুমি না কইরো না, আমরা তো তোমগো লগেই আছি।
ঠিক আছে, আপনারা যহন এত কইরা চাইতাছেন চিন্তা কইরা দেহি। তয়, আগে মা’র লগে একটু আলাপ করতে হইবো।
ভাবীসাব’রে আমি
বুঝাইয়া কমুনে। সাত্তার মাস্টার বললেন।
এহনি ব্যাপারডা
ফাঁস করনের দরকার নাই। একেবারে শেষ মুহূর্তে নমিনেশন সাবমিট করা হইবো। তার আগে যেন
কেউ জানতে না পারে। সবার উদ্দেশ্যে সাঈদ খান বলেন।
চার দিন গ্রামের
বাইরে কাটিয়ে গতরাতে ফিরেছে মনু মিয়া। এ ক’দিন মাদ্রাসা বন্ধ থাকার পর আজ খুলেছে, তবে কোনো ছাত্রছাত্রী আসেনি। মনু মিয়া ফাঁকা ঘরে চুপচাপ বসে
আছে। সামনে ঘোর অনিশ্চয়তা। গত কয়েকদিন ধরে খালেক তালুকদারকে বাজারে দেখা যায়নি।
মফিজ মিয়াকেও না। গ্রামের লোকজন তাকেও এড়িয়ে চলছে। মফিজ মিয়ার বাড়িতে বিচার বসানোর
পর থেকে গ্রামের লোকজন তাদের উপর ক্ষ্যাপা। আজ সকালে ফজরের নামাজ একাই পড়েছে সে।
মনু মিয়া ভেবে পায় না সে এখন কী করবে। দীর্ঘদিন ধরে যে সুনাম সে অর্জন করেছিলো তা
আজ ধূলোয় লুটিয়ে গেল!
গায়ে শাল জড়িয়ে
মসজিদ থেকে বের হয় মনু মিয়া। মফিজ মিয়ার বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটে। কপালে চিন্তার
রেখা। দীঘির পাড়ের সরু রাস্তার মুখে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। ছোট্ট কুঁড়েঘরটিতে কোনো
সাড়াশব্দ নেই। মনু মিয়া ভাবে- আপাতত এ ভিটার ভাবনা বাদ। কিভাবে নিজের সুনাম ফিরিয়া
আনা যায় সেটাই এখন চিন্তার কথা। বাড়ি ফিরে গিয়ে লাভ নেই। সে খবর নিয়েছে তাদের
গ্রামে ভাঙনের মাত্রা আরও বেড়েছে। মানুষ আশ্রয় আর কাজের সন্ধানে বিভিন্ন জায়গায়
ছুটছে।
মফিজ মিয়ার বাড়িতে
ঢুকে দেখে বাইরে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে সে। ঘরের সামনের বারান্দায় উঠে বসে মনু
মিয়া। মফিজ মিয়া জিজ্ঞেস করে,
কি খবর?
মিয়াভাই, অবস্থা তো ভালো না! আইজ মাদ্রাসায় পোলাপাইন আহে নাই।
গ্রামের মানুষ এহনো আমগো উপরে ক্ষ্যাপা।
ক্ষেপুক। কয়দিন পরে
এমনেই ঠিক হইয়া যাইবো।
আমার মনে হয় এত তাড়াতাড়ি
কিছুই ঠিক হইবো না, মাদ্রাসায় কেউ তো পোলাপান পাঠাইলো না!
আপনেই তো গ্রামে
ছিলেন না, পাঠাইবো কি?
তাও হইতে পারে।
চিন্তা কইরেন না, বিভা আর বেশিদিন এই ভিটায় থাকতে পারবো না।
মনু মিয়া এ
প্রসঙ্গে আর কিছু বলে না। মফিজ মিয়া বাইরে বেরিয়ে গেলে সেও ফিরে যায় ঘরে।
দিগন্ত বিস্তৃত
জমির পরে’ সোনা রঙের ধান কাটার কাজে ভিন-গাঁয়ের পরবাসীদের পদচারণা শেষ হয়েছে
কিছুদিন হল। এখন গৃহস্থের উঠানে উঠানে কাটা ধানের আঁটির স্তূপ জমে আছে। হারু গাজীর
আড়তে বিভার আর কাজ করা হবে না তা সে ভালোভাবেই বোঝে। তবে এই ধানের মৌসুমে কাজের
অসুবিধা হবে না, কেবল ধান-শস্য তোলা হয়ে গেলে আবার সেই উপোষী
সময়!
প্রভাকে নিয়ে
পারুলের ঘরের দিকে যায় বিভা। এখন সে বাইরে গেলে প্রভা পারুলের ঘরেই থাকে।
কই যাস? পারুল জিজ্ঞেস করে।
মাস্টার চাচি খবর
পাঠাইছে, যাইয়া দেহি!
দীঘির পাড়ের রাস্তা
ছাড়িয়ে বড় রাস্তার উঠতেই দেখে মনু মিয়া মসজিদের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে। বিভা পাশ
দিয়ে হেঁটে যায়। মনু মিয়া নিশ্চুপ। অন্য সময় হলে এতক্ষণে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে নানা
ছবক দেয়া শুরু হয়ে যেত। বিচারের ঘটনার পর থেকে বিভাকে মোটামোটি এড়িয়ে চলে সে। বিভা
মনে মনে হাসে। এতদিন ধরে মনু মিয়ার প্রতি যেটুকু ভক্তি অবশিষ্ট ছিল তার লেশমাত্র
এখন আর নেই। সেখানে জন্ম নিয়েছে ঘৃণা।
আমারে ডাকছিলেন
চাচি?
ঘরের পাশের খোলা
জায়গায় ধান সেদ্ধ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ছালমা বেগম। বিভার কণ্ঠস্বর শুনে পেছনে
ফিরে তাকালেন।
হ। তোর মাস্টার
চাচায় কইছে তোর আর বাজারে হারুর আড়তে কাম করনের দরকার নাই। এহন থেইক্যা তুই
সারাদিন আমার লগে থাকবি, খাওয়া-দাওয়া আমার এইহানেই করবি। বিভা কিছু বলতে
যাচ্ছিলো, তখনই ছালমা বেগম বলে উঠলেন,
প্রভা কই?
পারু’বুর কাছে
রাইখ্যা আইছি।
অরেও লগে নিয়া আসবি, বকুল-অয়নের লগে থাকবো। সন্ধ্যার আগে তোর লগেই বাড়ি ফিরা
যাইবো।
বিভা মাথা নিচু করে
রাখে। সালমা বেগম জিজ্ঞেস করেন,
তোর চাচি আর কিছু
কয়?
না। এই দুইদিন ধইরা
চুপ আছে। তয় চাচি, এই মানুষ কী চুপ থাকনের বান্দা? কয়দিন গ্যালেই আবার শুরু হইবো।
করুক। তোর কিছু
কওনের দরকার নাই। নে এইহানে একটু ব’, আমি যাইয়া রান্না-বান্নার ব্যবস্থা করি।
সালমা বেগম চলে
গেলে বিভা ধান সেদ্ধ করার কাজে লেগে পড়ে।
বছর শেষ হয়ে আসছে।
কলাবতী বাজারের ক্লাবের ছেলেদের মধ্যে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান আয়োজনে বেশ ব্যস্ততা
পরিলক্ষিত হয়। শ্যামল, তাপস, রিয়াজ, আসাদ, তপু, রঞ্জুদের দিনের বেশির ভাগ সময় কাটে ক্লাবঘরেই।
সকাল বিকাল ক্লাবঘরে চলছে রিহার্সেল আর সেই সাথে বটতলায় অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য
স্টেজ তৈরির কাজ এগিয়ে চলেছে জোরেশোরেই। সামনে নির্বাচনের ঝামেলা এড়াতেই এবার
বটতলায় অনুষ্ঠান আয়োজনে কোনো বাধার সৃষ্টি করেনি বাদল আর মজনুরা। বরং যেচে আসছে
সাহায্য করার জন্য।
দুপুরের পর থেকেই
বটতলায় স্টেজ বানানোর কাজ তদারকি করছে আসাদ আর তাপস। বিভিন্ন বাড়ি থেকে জোগাড় করা
হয়েছে বাঁশ, কাঠ ও অন্যান্য সামগ্রী। বটতলার সামনের খোলা
জায়গায় দর্শকদের বসার জন্য মাটি ফেলে সমান করা হচ্ছে। বাজারে যাবার পথে বটতলার
সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন সাঈদ খান। হেলে পড়া গাছের ডাল থেকে নেমে আসা কিছু ঝুরি
ছেঁটে দিতে দিতেই আসাদের চোখ পড়ে সাঈদ খানের দিকে। কাজ থামিয়ে সাঈদ খানের দিকে
এগিয়ে যায় সে।
চাচা, দর্শকের বসার জায়গাটা আরও বড় করতে পারলে ভালো হইত। সাইদ
খানের উদ্দেশ্যে বলে আসাদ।
তো কর। সমস্যা কি?
ঐ দোকান দুইটা
সরাইলে আরও অনেক জায়গা বাড়ত।
খোলা জায়গার এক
পাশে হাটের দিনে ব্যবহারের জন্য অস্থায়ী দুটো টং দোকানের দিকে ইশারা করে আসাদ বলে।
ঐ দোকানগুলা তো
খালেকের। আলগা দোকান, সরানো তো কোনো সমস্যা না।
আমরা সরাইতে
কইছিলাম কিন্তু খালেক তালুকদার নাকি মানা করছে। আপনে কইলে কাম অইবো।
ওরা কেউ আছে বাজারে?
হ, একটু আগেই তো বাদইল্যারে মজনুর লগে হারু মেম্বারের দোকানের
দিকে যাইতে দেখলাম।
বাদইল্যারে ডাক।
স্টেজের কাজে
ব্যস্ত ছমিরকে বাদলের খোঁজে পাঠায় আসাদ।
বাদল আর মজনুর
মধ্যে সম্পর্ক এখন আগের মতোই স্বাভাবিক। ইদানীং দুজনকে বিভিন্ন জায়গায় একসঙ্গে
দেখা যায়। কেবল নির্বাচন প্রসঙ্গে দু’জনকে একসাথে কথা বলতে দেখেনি কেউ।
ছমিরের পিছু পিছু
বটতলার দিকে এগিয়ে আসে বাদল আর মজনু। ওরা সামনে এলে সাঈদ খান বলেন,
দর্শকদের বসার জন্য
মঞ্চের সামনের জায়গাটা বড় করন দরকার। তোগো ঐ দোকান দুইডা একপাশে সরাইরা দে।
অনুষ্ঠান শেষ অইলে আবার জায়গামতো বসাইয়া দিস।
বাদল সাঈদ খানের
মুখের উপর না করতে পারে না। আসাদের দিকে তাকিয়ে বলে- ঠিক আছে আপাতত সরাইয়া রাখ।
আসাদের ইশারায় ছমির
অন্য লোকজন নিয়ে দোকান সরানোর কাজে লেগে পড়ে। মজনু চালের আড়তের দিকে চলে গেলে সাঈদ
খানের কাছে এগিয়ে আসে বাদল।
কাকা, হুনতাছি এইবার আপনে চেয়ারম্যানে খাড়াইবেন?
কার কাছে হুনলি?
না, নির্দিষ্ট কারো কাছে না, লোকজন কওয়া-কওয়ি করতাছে।
খাড়াইলে তো জানতে
পারবি।
কাকা, আপনে অইলেন আমগো নিজেগো মানুষ। আপনে খাড়াইলে আমরাও খুশি।
হগগলে মিল্লা আপনার লইগ্যা কাম করুম।
মেম্বারে কেডা কেডা
খাড়াইবো?
ভাই তো কইলো
খাড়াইবো। আর কারো খবর কইতে পারি না কাকা, এহনও তো অনেক দেরী আছে। তয় কয়েকদিনের মধ্যেই জানন যাইবো।
সাঈদ খান বাজারের
দিকে চলে যান। বাদল কিছুক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে লোকজনের দোকান সরানোর কাজ দেখে।
এই ছমির্যা, অনুষ্ঠান শ্যাষ অইলে দোকান যেন আবার জায়গা মতো দেখি। বেশ
চড়া গলায় ছমিরদের উদ্দেশ্যে বলে বাদল। তারপর এগিয়ে যায় নদীর পাড় ধরে স-মিলের দিকে।
আজ কয়েকদিন ধরে
দ্বিধার মধ্যে আছে আতিক। শুভাকাক্সক্ষী কাছের মানুষজন খুব চাচ্ছে সে নির্বাচনে
প্রার্থী হোক। আতিক নিজে এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। প্রথমত নির্বাচনী খরচ একটা
ভাবনার বিষয়। যদিও অনেককেই তার জন্য খরচ বহন করতে প্রস্তুত, কিন্তু কারো কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে নির্বাচন করতে আতিকের
আত্মসম্মানে বাঁধছে। সেইসাথে আরেকটা বিষয় তার ভিতরে কাজ করছে, সেটা হচ্ছে তার বাবার ইমেজ। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে
আশেপাশের কয়েক গ্রামের সর্বস্তরের মানুষের কাছে তার বাবার স্থান অনেক উঁচুতে। আতিক
প্রার্থী হলে যে জিতে যাবে এ ব্যাপারেও তার পূর্ণ আস্থা আছে কিন্তু নির্বাচিত হলে
সবার জন্য ঠিকমত কাজ করতে না পারলে অনেক প্রশ্ন উঠবে। অবশ্য সাঈদ খান চেয়ারম্যান
হলে তার সাথে কাজ করা অনেক সহজ হবে। তবে সবকিছু নির্ভর করবে তার মায়ের উপর। মায়ের
অনুমতি না থাকলে সে কিছুতেই নির্বাচনে দাঁড়াবে না।
বিকালে কলাবতী
বাজারে সাত্তার মাস্টারের দোকানের সামনে বসে আছে সবাই। আলোচনার বিষয়বস্তু ইউনিয়ন
পরিষদ নির্বাচন। সবার লক্ষ্য একই- সমস্ত অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে
তোলা,
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সবাইকে উদ্বুদ্ধ করা এবং
গ্রামের সার্বিক উন্নয়ন। এজন্য চেয়ারম্যান এবং মেম্বার পদে সাঈদ খান আর আতিককে জয়ী
করতে সবাই এক হয়ে কাজ করবে। ঠিক হয়, এই মূহূর্তে ব্যাপারটা গোপন রাখবে সবাই, আরও কিছুদিন পরিস্থিতি যাচাই করে মাঠে নামবে।
ক্লাবঘরে বিকাল
থেকেই রিহার্সেলে ব্যস্ত তরুণ-তরুনীরা। লাইব্রেরি রুমে নাটকের রিহার্সেল চলছে।
অফিস কক্ষটিতে আবৃতি আর খেলার রুমটিতে গানের অনুশীলন। শ্যামলপুর, উজানপুর আর সুবর্ণপুরের তরুণ ছেলেমেয়েরা নিরলসভাবে চেষ্টা
করছে একটি সফল অনুষ্ঠান আয়োজনের। সন্ধ্যা থেকে আতিক, শ্যামল আর তপু ভরাট কণ্ঠে আবৃতি করছে। নাটকের পারফর্মাররা শেষ মুহূর্তে
নিজেদের সংলাপ ঝালাই করে নিচ্ছে। পাশের রুমে শ্যামল, শিখা, আসাদ, রঞ্জু, চারু, বকুল, শিমু গাচ্ছে দেশাত্মবোধক গান। কেউ কেউ ব্যস্ত
স্টেজ আর অন্যান্য বিষয়গুলো তদারকিতে।
সাত্তার মাস্টারের
দোকানের সামনে থেকে ক্লাবঘরের দিকে আসার পথে ইসমাইল মোল্লার কানে ভেসে আসে চারুর
সুরেলা কণ্ঠে দেশাত্মবোধক গান- এ কী অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী....।
মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। মনে মনে ভাবেন, এরাই তো দেশের ভবিষ্যৎ। এরাই গড়বে আগামী দিনের সোনার বাংলাদেশ। ইসমাইল মোল্লা
ক্লাবঘরে ঢুকতেই শুরু হয়ে যায় নাটকের মূল রিহার্সেল। সন্ধ্যার অনেক পর অবধি চলে
ওদের এই অনুশীলন।
রিহার্সেল শেষে
অনেকেই ফিরে গেছে। শিখাও যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। শ্যামল পাশে এসে দাঁড়ায়। শিখার
উদ্দেশ্যে নিচু স্বরে বলে,
অ্যাই, তুই কই যাস?
ক্যান? রাইত অইয়া যাইতাছে, বাড়ি যামু না!
পরে যা। আমি তোরে
আগাইয়া দিমুনে।
শিখা একবার চারপাশে
তাকায়। বকুল আর চারু এসে বাড়ি যাবার কথা জিজ্ঞেস করলে বলে ‘তোরা যা, আমি একটু পরে আইতাছি’। চারু আড়চোখে শ্যামলের দিকে তাকিয়ে
মুচকি হেসে বকুলের উদ্দেশ্যে বলে, ‘ল, আমরা যাই, শিখাদি’র জরুরি কাম
আছে’।
বকুল, চারু, তাপস চলে যায়। শিখা
নাটকের স্ক্রিপ্টটা নিয়ে ঘরের এক কোণে বসে পড়ে। কিছুক্ষণ পড়ার চেষ্টা করে। মূলত সে
শ্যামলের কাজ শেষ হবার জন্যই অপেক্ষা করে। শিখাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না।
শ্যামল দ্রুত সবকিছু রঞ্জু আর আসাদকে বুঝিয়ে দিয়ে শিখাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
কুয়াসা জড়ানো শীতের
রাতে নদীর পাড় ধরে হেঁটে চলেছে দু’জন। উজানগাঙের উপর দিয়ে উত্তরের শীতল হাওয়া বয়ে
যায় এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে। কৃষ্ণপক্ষের ঘোলাটে অন্ধকারে চলমান জলরাশির উপরে
ধোঁয়া ধোঁয়া কুহেলীর এলোমেলো আসা-যাওয়া; শ্যামলের দু’চোখে এই চেনা রূপের সবটাই ধরা পড়ে। বাতাসে কান পাতে- ছলাৎ ছলাৎ ছল, ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে তীরে। কলকল স্রোতের ধারা বয়ে চলার শব্দটাও
কানে বাজে। উজানগাঙের উপর দিয়ে ও-পাড়ে তাকায়, দূরে চরকমলকে যেন আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়েছে এই আলেয়ার জালটা। শিশির ভেজা পথে
ঝাপসা প্রাচীর ভেঙে এগিয়ে চলে আর দু’পাশের ঝোপঝাড়ে ঝিঁঝিঁপোকার অবিরাম সুরের
মূর্ছনায় জীবনের মানে খুঁজে বেড়ায় আগামীদিনের স্বপ্নে মগ্ন দু’টি মানব-মানবী।
শিখার ভিতরে কাঁপন লাগে। শালটা ভালোভাবে জড়িয়ে নেয় গায়। তবে এই শীতের রাতেও এক
অজানা ভালোলাগার আবেশ ছড়িয়ে পড়ে তার চঞ্চল প্রাণে। শীতের তীব্রতা শ্যামলও অনুভব
করে,
তবে উজানগাঙে নাও ভাসানোর অদম্য ইচ্ছাটা আবারও
মনে জাগে তার।
ইস! কবে যে তোরে
নিয়া এই গাঙে নাও ভাসামু!
ভাসাও না ক্যান? তোমারে মাঝি অইতে কেডা মানা করছে? শিখা হেসে বলে।
কেউ মানা করে নাই, খালি তোর বদনাম অইবো দেইখ্যা দেরী করতাছি। দেখিস! একদিন
সত্যই তোরে নিয়া চইলা যামু অনেক দূরে।
শিখা হাসতে হাসতেই
আবার বলে- কত দূরে যাইবা মাঝি?
এই নদীটা উত্তরে কই
গিয়া মিশছে জানোস?
আমি ক্যামনে জানুম, আমি কী কোনোদিন ঐদিকে গেছি?
শোন, এই নদীটা কমলডাঙার মাথায় গিয়া ফুলেশ্বরীর লগে মিলছে। কারো
লগে যাওয়ার দরকার নাই, তুই আমার লগে ঐহানে যাবি।
অন্য কারো লগে গেলে
কী তোমার খারাপ লাগবে?
শিখা আড়চোখে
শ্যামলের দিকে তাকায়। শ্যামল কপট রাগের ছলে বলে,
গিয়েই দেখনা একবার!
শিখা শব্দ করে হেসে
ফেলে।
ডর নাই মাঝি, আমি কেবল তোমার লগেই ভাসুম। উত্তরে দক্ষিণে যেইহানে নিয়া
যাও।
তেমাথার পুলের কাছে
এসে নদীর পাড় থেকে শ্যামলপুরের রাস্তায় নামতেই গাঢ় অন্ধকারের রাজ্যে প্রবেশ করে
ওরা। তবে মাথার উপরে গাছের ছাউনি থাকায় এখানে কুয়াশার প্রকোপ কম।
নাটকটা তোর কাছে
কেমন লাগতাছে?
ভালো, তয় আমার চরিত্রটা খুব কঠিন। ডর লাগতাছে, শ্যামলদা- পারুম তো?
আরে পারবি, পারবি। প্রথম প্রথম একটু কঠিন লাগবো; কয়েকদিন রিহার্সেল কর, দেখবি ইজি অইয়া গেছে।
আচ্ছা তোরে একটা
চিঠি দিছিলাম, উত্তর দিলি না ক্যান?
রাগ কইরা দেই নাই।
তুমি আমার নামে ডাকে চিঠি পাঠাইলা ক্যান? সুশীল আমারে চেনে না? কার চিঠি, কোত্থেইক্যা আইছে, কত প্রশ্নের জবাব দিতে হয়! তাছাড়া সুশীল যদি
বাবা কিংবা দাদার হাতে চিঠিটা দিতো?
দিলেই বা কি? আমি কী পাত্র হিসাবে তোর যোগ্য না? কাকা কী আমারে পছন্দ করবো না?
কথা সেইটা না
শ্যামলদা, বিষয়ডা নিয়া একটু হইলেও হৈচৈ অইতো।
ব্যাপারডা তো একদিন
জানাজানি হইবোই, এত চিন্তার কী আছে?
না, এহন দরকার নাই, তোমার পরীক্ষার আগে যেন কেউ জানতে না পারে। এরপর থেইক্যা চিঠি দিলে চারুর কাছে
পাঠাইও।
অইডা তো আরেক পাকনা, খালি খোঁচাইবো।
শিখা হাসে। -তুমি
ক্ষ্যাপো তো, তাই দুষ্টামি করে। ও কিন্তু মনে প্রাণে আমগো
সম্পর্কটা চায়।
হুম।
এইবার গেলে আবার
কবে বাড়ি আইবা?
আমার তো মন চায়
সপ্তায় সপ্তায় বাড়ি আসি, কিন্তু কী করুম ক’! সামনের পরীক্ষাটা শেষ কইরা
বিজয় দিবসের আগেই ফিরুম।
শিখা চুপ হয়ে যায়। অনেকক্ষণ
কেউ কথা বলে না। কোটাখালী ব্রিজের উপর আসতেই দেখে তপন খালপাড়ের রাস্তা ধরে ব্রিজের
দিকে হেঁটে আসছে।
কী রে! তোগো এত
দেরী অইলো ক্যান? শ্যামলের উদ্দেশ্যে বলে তপন।
আরে! সবকিছু
বুঝাইয়া দিয়া আসতে অইবো না! তোগো চিন্তা করার কী আছে, শিখারে তো আমিই পৌঁছাইয়া দিতাম।
রাইত অনেক অইছে তো, তাই চিন্তা অইতাছিলো।
শিখা তপনের সাথে
চলে গেলে বাড়ির পথ ধরলো শ্যামল। অনেকদিন পর আজ নিজের অজান্তেই শীশ বাজাতে বাজাতে
এগিয়ে চলল। একটুক্ষণ আগেও স্বল্প দূরত্বের পথযাত্রার সঙ্গিনীটি তার মনের অলিতে
গলিতে কী এক আশ্চর্য্য আবেশ ছড়িয়ে দিয়ে গেল! এত আনন্দময় মুহূর্ত বহুদিন আসেনি তার
জীবনে। আজ রাতের ঘুমটা চমৎকার হবে।
সন্ধ্যার পর কাজ
শেষে বেশিরভাগ লোকজন চলে যায়। এই সময় হারু গাজীর আড়তটা প্রায় ফাঁকা হয়ে পড়ে। মজনু
আড়তে ঢুকে দেখে হারু গাজী হিসাবের খাতা খুলে বসে আছে। ভাইয়ের পাশে গিয়ে বসে। মজনুকে
দেখে হারু গাজী নির্বাচনের বিষয়ে খোঁজ-খবর নেয়।
কেডা কেডা খাড়াইবো
খবর পাইছোস? হিসাবের খাতা থেকে মুখ না তুলেই জিজ্ঞেস করে
হারু গাজী।
খালেইক্যা তো
হুনতাছি এইবারও খাড়াইবো।
হেইডা আমার কানেও
আইছে। চেয়ারম্যান পদে হুনলাম সাঈদ খা খাড়াইবো?
লোকজন কওয়া-কওয়ি
করতাছে, তয় এহনও সিওর না।
পাটোয়ারী কী কয়?
হেয়ও তো হুনলাম
খাড়াইবো।
তুই খালেইক্যার
ভাইয়ের লগে হারাদিন ঘুরোছ ক্যান?
ও আগাইয়া আইলে আমি
তো আর মানা করতে পারি না। তাছাড়া বিভার মাইয়াডার বিচারের সময় ওরা আমগো লইগ্যাই
আগাইয়া আইছিলো। এহন ওগো লগে খারাপ ব্যবহার করন কী ঠিক অইবো?
তুই খালেইক্যারে
চিনস না। ও অইলো একটা কালসাপ। ওর ভাইডাও তেমন। কোনো মতলব ছাড়া এমনি এমনি ও এই কাম
করে নাই।
ঠিক আছে, আমি আস্তে আস্তে বাদইল্যার লগে ঘুরন কমাইয়া দিমু। এহন
ক্যামনে সামনে আগাইতে অইবো হেইডা নিয়া আমগো বইতে অইবো।
আস্তে আস্তে
গ্রামের সবার লগে মেলামেশা করতে থাক। তাগোরে জানা যে তুই ভোটে খাড়াইতাছস। সবাইর
লগেই খুব ভালোা ব্যবহার করবি।
ঠিক আছে ভাইজান।
তুমি বাড়ি যাইবা কহন?
আমার দেরী অইবো, তোর বেশি রাইত পর্যন্ত বাইরে থাকনের দরকার নাই, এহন বাড়ি যা। আবারও কইতাছি, খালেইক্যা-বাদইল্যার থেইক্যা সাবধান।
বড়ভাই হারু গাজীর
কথামত ইদানীং মজনু নির্বাচনী প্রচারণার অংশ হিসেবে গ্রামের সকল শ্রেণির মানুষের
সাথে মেলামেশা শুরু করে। যদিও গ্রামবাসীর কাছে হারু গাজীর পরিবারের স্বরূপ অজানা
নয়,
আর মজনুকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবারও কিছু
নেই;
তবুও আগামীদিনের জনপ্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে
সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে চেষ্টার ত্রুটি করে না সে।
বাদল আর খালেক
তালুকদারের চোখে মজনুর এই নতুন রূপ চিন্তার কারণ হয়ে দেখা দেয়। আসছে নির্বাচনে
খালেক তালুকদার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ধরে নেয় মজনুকেই। নিজের অস্তিত্ব
রক্ষায় পথের কাঁটা দূর করার উপায় খোঁজে সে। নদীর পাড়ের স-মিলে এই মুহূর্তে খালেক
তালুকদার আর বাদল ছাড়া আর কেউ নেই। স-মিলের পাশেই ছোট্ট ঘরটায় আলোচনায় ব্যস্ত
দুজনে। খালেক তালুকদার বলে,
মজনুর ভাবসাব তো
সুবিধার মনে অইতাছে না, কী কস?
হ। ইদানীং আবার
আমারে এড়াইয়া চলতাছে। দেহা অইলে দুই একটা কতা কইয়া অন্যদিগে চইলা যায়। হুনতাছি, মানুষের লগে ভোটে খাড়ানো নিয়া আলাপ-আলোচনা করে। লোকজনরে দলে
ভিড়াইবার চেষ্টা করে।
ওর ভাইয়ের
কু-কীর্তি তো সব মানুষেই জানে, তবুও ওর সম্বন্ধে
মানুষের কী ধারণা তা জানার চেষ্টা কর। আমগোও মাঠে নামতে অইবো। য্যামনেই হউক
খোনকারগো আমগো লগে ভিড়াইতে অইবো।
খোনকারগো লইয়া তুমি
চিন্তা কইরো না। গাজীরা অগো পুরানা দুশমন, ওরা আমগো লগেই থাকবো।
তবুও, তুই মজনুর লগে ছায়ার মতোন লাইগা থাকবি। য্যামনেই হউক অরে
ফিল্ড থেইক্যা সরাইতে অইবো। খালেক তালুকদারের চোখে-মুখে অন্যরকম অভিব্যক্তি।
কি করবার চাও?
হেইডা আমি সময়মত
তোরে কইমু।
তুমি কও তো আমিই
অরে ছাইজ কইরা দেই।
এহনি কিছু করনের
দরকার নাই, সময় অইলে আমি তোরে কমু।
ঠিক আছে, তুমি যেমনে কইবা তেমনিই অইবো।
আমি একটা বিষয় নিয়া
ভাবতাছি। তুই এহন ওর লগে কোনো খারাপ ব্যবহার করবি না। সবাই যেন বুঝতে পারে ওর লগে
তোর সম্পর্ক খুব ভালো। আইচ্ছা ক্লাবের ঐ অনুষ্ঠানডা কবে অইবো?
বুধবারে। ক্যান?
ওইদিন তুই ওর লগে
ছায়ার মতোন লাইগা থাকবি। চোক্ষের আড়াল করবি না। আর চেষ্টা করবি অরে অন্য সবার
থেইক্যা আলাদা রাখনের। বাকিডা আমি তোরে পরে কমু।
আচ্ছা ঠিক আছে।
দুজনে স-মিল থেকে
বের হয়ে বাজারের দিকে এগিয়ে যায়।
মাস্টার বাড়ি থেকে
ফিরতেই বিভা দেখে দীঘির পাড়ে তার ঘরে প্রবেশের রাস্তার উপরে খেড়ের পালা তুলছে লোকজন।
ইতিমধ্যে এক-মানুষ সমান উঁচু করে তুলে ফেলেছে। বিভা সামনে এসে জিজ্ঞেস করে- কী
ব্যাপার, আপনেরা আমার ঘরে যাওনের পথের মধ্যে নাড়ার মেই
তুলতাছেন ক্যান?
আমরা ক্যামনে কমু
বাপু?
তোমার চাচারে জিগাও। আমরা কইছিলাম একটু ডাইনে
সরাইয়া তুলতে, তোমার চাচায় কইলো এইহানেই তুলতে অইবো।
বুঝছি। আমারে
তাড়ানোর নতুন ফন্দি পাতছে চাচা।
খেড়ের পালা আর
বিভার ঘরের মাঝখানে এক চিলতে জমিতে ছোট্ট একটি সিমের মাচা তুলেছিল বিভা; মাচাটি সরিয়ে ঘরে প্রবেশের পথ করে নেয়।
বিভার গলার আওয়াজ
শুনে প্রভাকে নিয়ে আসে পারুল।
দ্যাখলা পারু’বু, চাচার কামডা দ্যাখলা?
দ্যাখলাম তো!
বিহানে তুই চইলা যাওয়ের পর আমার লগে তোর চাচির একচোট হইয়া গ্যাছে। তুই সবাইরে
ডাইক্যা দেহা, দেখবি এইডা সরাইয়া নিতে বাধ্য হইবো।
থাউক, আর লাগবো না। হেয় যে এমন কিছু একটা করবো আমার আগেই মনে
হইছিলো।
পিদিমের আলোটা
ক্ষীণ হয়ে এসেছে। কেরোসিন শেষে হয়ে এলে সলতে পোড়া গন্ধ নাকে আসতেই আলোটা নিভিয়ে
দিল বিভা। অন্ধকার ঘরে শুয়ে শুয়ে কত ভাবনা আসে! অসীমের কথা বড় বেশি মনে পড়ছে আজ।
প্রভা, ঘুমাইছোস?
ঘুম আইতাছে না মা।
ছোডবেলায় ঘুম না
আইলে তোর বাপে গান গাইয়া তোরে ঘুম পাড়াইতো।
প্রভা মায়ের দিকে
ঘুরে জিজ্ঞেস করে- হাছাই মা?
হুম! দুনিয়া কিচ্ছু
না-রে মা! কিচ্ছু না। কতকাল আগের কতা! মানুষটা আইজ ছায়ার মতোন মনের মধ্যে আসে-যায়!
ক্ষণে-ক্ষণে মনে অয় হাতের নাগালের মধ্যে কিন্তু ছোঁওন যায় না। অনেক দূরের
বাসিন্দা।
প্রভা মায়ের শরীরের
সাথে মিশে যায়। মা লও আমরা উজানিচরে চইলা যাই।
ঐহানে তো আমগো
থাকনের কোনো জায়গা নাইরে মা, থাকবি কই?
ক্যান দাদীর ঘরে
থাকুম!
তোর দাদীর নিজেরই
তো খাওন জোডে না, আমগো ক্যামনে চলবো?
প্রভা কিছুক্ষন চুপ
করে থাকে। তারপর বলেÑ এইহানেও তো খাওন নাই, তোমারে কত কষ্ট করতে হয়! মা, আমার এইহানে একটুও ভালো লাগে না। লও চইলা যাই।
বিভা দায়সায়রাভাবেই
বলেÑ
দেহি!
একদিন সন্ধ্যায়
সাত্তার মাস্টারের সামনে এসে দাঁড়ায় বিভা। চাচা, আমি কাইল উজানিচরে চইলা যাইতাছি।
ক্যান? উজানিচরে যাবি ক্যান, মফিজ তোরে কিছু কইছে?
কিছু কয় নাই, তয় যা করতাছে তাতে ঐ ভিডায় তো আর থাকন যায় না।
ক্যান কী করছে?
আমার ঘরে যাওনের
পথের উপরে নাড়ার মেই তুলছে। তার পাশেই এহন গরু বান্ধন শুরু করছে। ঘর থেইক্যা বাইর
হইলেই গরুর চেনার গন্ধ। কন, ঐহানে কী থাকন যায়?
সাত্তার মাস্টার
ভাবলেন তার অনুমানই ঠিক হল। মফিজ মিয়া বিভাকে তাড়িয়ে দেয়নি ঠিক কিন্তু নানাভাবে
তার জীবনটাকে অতিষ্ট করে তুলছে। তিনি বললেনÑ আমি তোরে আমার ভিডায় আইসা থাকতে কইছিলাম, তুই তো রাজি হইলি না।
আইজ কতডা বছর ধইরা
এই ভিডায় পইড়া রইছি! প্রভার বাপ কী কষ্ট কইরা জঙ্গল কাইটা ভিডা বানাইছে, আমার মরা বাপের জায়গা ছাইড়া অন্য কোত্থাও যাইতে ইচ্ছা করতাছিলো
না।
ঠিক আছে, আমি আইজই মফিজের লগে কতা কমু।
লাগবো না চাচা। আমি
এইহানে থাকলে চাচা-চাচির পরাণ জ্বলে, কয়দিন আমারে না দেখলে হেরা শান্তিতে থাকবো।
সালমা বেগম বলে
ওঠেন- মফিজ মিয়ার তো তাইলে সুবিধাই হইলো।
হেগোরে কিছু কইয়া
যামু না। ঘরটায় তালা লাগাইয়া যামু। মাইয়াডা এইহানে আর থাকতে চাইতাছে না। আমারও
মনডা ভালো লাগতাছে না চাচি। কয়দিন ঐহানে কাটাইয়া আহি।
সাত্তার মাস্টার
বললেন, বেড়াইতে গ্যালে অসুবিধা নাই, তয় নিজের অধিকার ছাইড়া যাওনটা কী ঠিক হইবো?
আর অধিকার! বাপ
মরণের লগে লগে আমার সব অধিকার শ্যাষ।
ঠিক আছে যা। কোনো
সমস্যা অইলে জানাইস। চিন্তা করিস না, তোর থাকনের জায়গার অসুবিধা অইবো না।
ভোরের আলো ফুটতে
শুরু করেছে কেবল। কোটাখালী খালের মুখে তেমাথার পুলের কাছে নৌকাটা ভিড়ায় মোক্তার
মাঝি। আজ ভীষণ ঠা-া পড়ছে। মোক্তার মাঝি ছইয়ের ভেতরে বসে হুক্কাতে কয়েকটা টান দেয়।
শরীরটা কিছুটা গরম হলেও খুকখুক করে কাশে। মাটির শানকিতে জমিয়ে রাখা আগুনটা উসকে
দিয়ে তার উপর হাত দু’খানা রাখে। ওমটা ভালো লাগে। একটু পর খালপাড়ের রাস্তার দিকে
তাকাতেই দেখে কুয়াশায় ঢাকা গাছপালা ঘেরা পথে কাঁপতে কাঁপতে তেমাথার দিকে এগিয়ে
আসছে বিভা। ওদের এগিয়ে দিতে পারুলও আসছে পিছু পিছু।
তাড়াতাড়ি ওঠ-রে মা, তোগরে পৌছাইয়া দিয়া আমার আবার ফিরন লাগবো। বিভার উদ্দেশ্যে
বলে মোক্তার মাঝি।
নদীর পাড়ের
কাদাপানি ভেঙে মেয়েকে নিয়ে নৌকায় চড়ে বসে বিভা। পাড়ে দাঁড়িয়ে পারুল। বিভা সেদিকে
তাকায়, চোখ দু’টো টলটল করছে।
পারুবু, আমার ঘরডার দিকে একটু খেয়াল রাইখো।
তুই চিন্তা করিস না, আমি থাকতে তোর চাচা-চাচি ঐ ঘরের কিছু করতে পারবো না।
গ্রামের সব মানুষ এক কইরা ফালামু না!
আমি জানি। তাইতো
তোমার উপর আমার এত ভরসা।
বেশিদিন উজানিচরে
থাকনের দরকার নাই, তাড়াতাড়ি চইলা আহিস বিভা।
আইচ্ছা।
নৌকা ছেড়ে দেয়।
নদীতে স্রোত নেই। ভাটা শুরু হয়নি এখনো। বিভা ছইয়ের ভিতরে গিয়ে বসে। প্রভা বাইরে
বসে আঁজলা ভরে নদীর পানি দেয় চোখেমুখে।
মা দেহো, পানি কী ঠা-া!
প্রভা ঠা-া লাগাইস
না,
ভিতরে আয়।
প্রভা ছইয়ের ভেতরে
ঢোকে। তেমাথার পুলের দিকে তাকাতেই বিভা দেখে পারুল তখনও নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে। পেছনে
শ্যামলপুরের আকাশে তখন সূর্যটা উঠি-উঠি করছে।
ধীরে ধীরে শহুরে
জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে শিউলি। দু’জনের ছোট্ট সংসারে ঝক্কি-ঝামেলা নেই বললেই চলে।
দুপুরের পর একাকী ঘরে শিউলির অফুরন্ত অবসর যেন আর ফুরোতেই চায় না। সময় কাটানোর
সঙ্গী রেডিও কিংবা বইও একসময় একঘেয়ে মনে হয়। তখন শুরু হয় নাহিদের জন্য দীর্ঘ
অপেক্ষা। বেশির ভাগ দিন সন্ধ্যা নাগাদ ঘরে ফেরে নাহিদ। টোনাটুনির ছোট্ট সংসার তখন
হাসি গল্পে ভরে ওঠে। নাহিদের ফিরতে দেরী হলেই একা ঘরে অস্থির হয়ে ওঠে শিউলি।
অজান্তেই মনটা তখন চলে যায় শ্যামলপুরে। বাবা ফিরে যাবার পর ইদানীং বাড়ির কথা আরও
বেশি মনে পড়ে; সবুজ শ্যামল গ্রামটা তাকে প্রায়ই হাতছানি দিয়ে
ডাকে। মায়ের হাস্যোজ্জ্বল মুখচ্ছবি, বকুল আর অয়নের খুনসুটি, আর বাড়ির আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা
অসংখ্য স্মৃতির মধ্যে ঘুরে বেড়িয়েই পার করে অলস সময়গুলো। মাঝে মাঝে মনে হয় একটা
সঙ্গী হলে বেঁচে যেত এই একাকীত্ব থেকে। প্রায়শঃই সে স্বপ্ন দেখে কচি দু’টি হাত, নরম তুলতুলে গাল, বড় বড় দু’টি চোখ আর খিলখিল হাসির ঝংকার। নাহিদ বেশ চাপা স্বভাবের, নিজের চাওয়া পাওয়াগুলো কখনো প্রকাশ করে না। শিউলিই বরং
অস্থির হয়ে ওঠে।
শহরে ওদের পরিচিত
মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা কয়েকজন। সবাই নাহিদের কলিগ। তাই অনাকাক্সিক্ষতভাবে কোনো
অতিথির আগমনও ঘটে না তাদের ঘরে। কলিগদের মধ্যে কালেভদ্রে আসা যাওয়া চলে। তবে, ছুটির দিনে দু’জনে একসাথে ঘুরতে বেশ ভালোই লাগে। কিন্তু
বেড়ানোর জায়গাও সীমিত। ঘুরেফিরে সেই নদীর পাড়, পুরোনো রাজবাড়ি কিংবা কালেভদ্রে সিনেমা দেখতে যাওয়া।
আজ খুব ভোরে উঠে
পড়ল শিউলি। শহরে আসার পর এত ভোরে ঘুম ভাঙে না তার। পাশে ঘুমন্ত নাহিদের দিকে চোখ
পড়তেই দুষ্টুমি মাথায় চাপে। একবার ভাবে সুড়সুড়ি দিয়ে ঘুমটা ভাঙ্গিয়ে দেয়, তারপর দু’জনে মিলে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে ভোরের ঠা-া
হাওয়ায়। পরক্ষণেই মতো বদলে ফেলে। রোজ অফিসে যাবার তাড়া থাকায় সকাল সকাল উঠে পড়তে
হয় বেচারাকে। কাল রাতে বলেছিল আজ দেরীতে অফিসে যাবে, একটু ঘুমাক। শিউলি ঘর থেকে বের হয়ে বাইরে এসে দেখে শিশিরে ভেজা সবুজ ঘাসগুলো
কেমন সতেজ হয়ে উঠেছে। ভেজা মাঠে কিছুক্ষণ খালি পায়ে হাঁটে। মনে পড়ে- শ্যামলপুরে
ভাই বোনের সাথে শীতের এই সময়টা চমৎকার কাটতো!
নাহিদ কিছু না বলেই
অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেল। শিউলি ওর গমনপথের দিকে তাকিয়ে ভাবলো, ও কী আজকের দিনটার কথা ভুলে গেল? মন খারাপ হয়ে গেল শিউলির। মনে মনে ঠিক করলো- নাহিদ ভুলে গেলে
ও কিছু মনে করিয়ে দেবে না।
অনেকদিন পর বাড়িতে
চিঠি লিখছে শিউলি। যখনই ও লিখে একসাথে তিনটি চিঠি লিখতে হয়। বাবা, মা এবং অবশ্যই অয়ন। এর ব্যতিক্রম হলে ছোট ভাইটির মান
ভাঙানোর জন্য একাধিক চিঠি লিখতে হয় তাকে। বকুলটা বেশ বুঝদার হয়েছে। ও-ই সবচেয়ে
ভালো বোঝে শিউলিকে।
বাবা সবসময়ই একজন
অগোছালো মানুষ। কিছুটা চাপা স্বভাবেরও। তাঁর কষ্ট কখনো কাউকে বুঝতে দেন না। তবে
বাবার মন খারাপ থাকলে শিউলি কেমন করে যেন বুঝে যেতো। আজ বাবাকে চিঠি লিখতে গিয়ে
চোখ ভিজে উঠলো। মা’র চিঠিটা সবসময়ই দীর্ঘ হয়। কত কথা যে মনে আসে! শিউলির খুব জানতে
ইচ্ছে করছে কেমন আছে ওরা সবাই!
অফিস থেকে একটু
আগেভাগেই বের হয়ে এলো নাহিদ। রিকশা নিয়ে সোজা চলে আসে নিউ মার্কেট। দুপুরের পর এই
সময়ে মার্কেটে লোকজনের ভিড় থাকেনা তেমন। শাড়ির দোকানগুলোতে ঘুরে পছন্দমত একটা শাড়ি
কিনে নেয়। আকাশী রঙের, শিউলির পছন্দের রঙ। তারপর চতুরঙ্গে ছ’টার শোর
দু’টো টিকিট কিনে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।
নাহিদ গেট দিয়ে
প্রবেশ করে দেখে শিউলির কোনো সাড়াশব্দ নেই। ভেজানো দরজাটা একটু ফাঁকা করতেই দেখতে
পায় খাটের উপরে শুয়ে আছে শিউলি। চুপি চুপি ঘরে ঢোকে। শিউলি টের পায় না।
গায়ে অন্য কারো
স্পর্শ পেতেই ধড়মড় করে উঠে বসলো শিউলি। অসময়ে নাহিদকে দেখে কিছুটা অবাক হলো।
তুমি কখন এলে?
অনেকক্ষণ। নাহিদের
চোখেমুখে রহস্যের হাসি।
ড্রেসিং টেবিলের
দিকে চোখ পড়ল শিউলির, নতুন কাগজে মোড়ানো প্যাকেটটা দেখে নাহিদের উপর
সকালের অভিমানটা নিমিষেই মিলিয়ে গেল। মনে মনে ভাবলো, কী ভুলটাই না ভেবেছিল ওকে! নাহিদ ঠিকই মনে রেখেছে আজ ওদের বিবাহ বার্ষিকী।
অনেকক্ষণ ধরে এসেছ, তো আমাকে তোলোনি কেন?
দেখছিলাম ঘুমালে
তোমাকে কেমন লাগে।
আমাকে ঘুমন্ত
অবস্থায় মনে হয় দ্যাখনি কেনদিন! তাই চোরের মতো লুকিয়ে দেখতে হবে?
উহু, চোরের মতো নয়, ডাকাতের মতো। নাহিদ শিউলিকে কাছে টেনে নেয়।
শিউলি হাসতে হাসতে
বলে-এই ভালো হবে না কিন্তু। সময় নেই অসময় নেই আবদার!
মুখে যতটা অভিযোগের
সুর বাঁধা দেওয়াতে জোর ততটা নয়; বরং সেখানে
পরিলক্ষিত হয় প্রচ্ছন্ন অনুমতি। হয়তো এটাই নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের ভাষা।
আজ বিজয় দিবস।
দিনের শুরু থেকে কলাবতী বাজারের সর্বত্র যেন উৎসবের সুর বেজে উঠেছে। সন্ধ্যায় শুরু
হবে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান। ডিসেম্বরের হিম শীতের রাতে অনুষ্ঠান উপভোগ করতে বাজার
সংলগ্ন বটতলা প্রাঙ্গণে বিকাল থেকেই জড়ো হতে থাকে বিভিন্ন বয়সী লোকজন। এটা যেন
গ্রামবাসীর প্রাণের আয়োজন। প্রতি বছর বিজয় দিবসটিতে হাসি আনন্দে মেতে ওঠে এরা; যেমনি করে উঠেছিল দশ বছর আগে একাত্তরের এইদিনে।
শীতের প্রকোপ থেকে
দর্শকদের কিছুটা আরাম দিতে মঞ্চের সামনের খোলা জায়গাটির উপরে সামিয়ানা আর চারপাশে
কাপড়ের ঘেরাও দিয়ে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাতে ইলেক্ট্রিসিটির অভাব দূর করতে
প্রস্তুত রাখা হয়েছে বেশ কিছু হ্যাজাক বাতি।
অনুষ্ঠানের শুরু
থেকেই গ্রামের সব শ্রেণির মানুষের সাথে মিশে যায় মজনু। এ অনুষ্ঠানটি অনেক বেশি
মানুষের সাথে মেশার সুযোগ করে দেয় তাকে। বাদল অবশ্য মজনুকে দৃষ্টির আড়াল করে না।
পুরোটা সময়জুড়ে ওর সাথে ছায়ার মতো লেগে থাকে। খালেক তালুকদার নিজেও মানুষের সাথে
অত্যন্ত আন্তরিকভাবে মিশতে চেষ্টা করে। দশ বছর আগে তাদের এবং তাদের পূর্বপুরুষের
ভুলত্রুটি শুধরে নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য নতুন সমাজ গড়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। সবাই দেখে
অন্য এক খালেক তালুকদারকে, নতুন এক মজনুকে। সাঈদ খান আর সাত্তার মাস্টার
দূর থেকে সবকিছু লক্ষ করেন আর মনে মনে হাসেন।
গ্রামবাসী সবাই
এদের চেনে। জানে সময় হলেই এরা স্বরূপে ফিরে আসবে। তবুও মানুষ দ্রুত সবকিছু ভুলে
যায়। আবার হয়তো ভোলে না, বিকল্প কোনো উপায় না থাকায় মেনে নেয়। এদেরকেই
নিয়োগ করে জনপ্রতিনিধি হিসেবে। বোঝে, এরা তাদের কাক্সিক্ষত জন নয়, তবুও এদের কাছেই
প্রত্যাশা করে নতুন সমাজ গড়ার। সাত্তার মাস্টার উপলব্ধি করেন- এ অবস্থা থেকে
উত্তরণ দরকার এবং এখনই সময়।
সন্ধ্যার আগেই
দর্শকদের জন্য নির্ধারিত আসনগুলো কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই
শুরু হবে অনুষ্ঠান। অয়ন দেখে- শ্যামলদা, তপু ভাই, আসাদ ভাই খুব ব্যস্তভাবে ছোটাছুটি করছে। মঞ্চের
সামনে পাতা চেয়ারগুলোর একেবারে প্রথম সারিতে বাবার সাথে ইসমাইল স্যার, হরিকাকা, জগানন্দ কাকু, হামিদ কাকা, সাঈদ কাকা, আরও অনেকে বসে আছেন। অয়ন, সুবল আর মিরাজের সাথে বাবার পেছনের সারিতে বসে অধীর আগ্রহে
অপেক্ষা করে কখন অনুষ্ঠান শুরু হবে।
কিছুক্ষণ পরই আসে
সেই কাক্সিক্ষত ক্ষণ। অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যায়। অয়ন খুব উৎফুল্ল হয়ে লক্ষ করে সামনে
রাখা টেবিলটার উপর হারমোনিয়ামের সামনে দাঁড়িয়ে চারুদি। তার দুই পাশে ছোটদি, শিখাদি আর শীলা আপু। ওদের পেছনে একসাথে দাড়িয়ে আছে শ্যামলদা, তপু ভাই, রঞ্জু ভাই, তপনদা। সবাই একসঙ্গে গেয়ে ওঠে জাতীয় সঙ্গীত। দর্শকরা সবাই
দাঁড়িয়ে যায়। অয়নও দাঁড়ায়। মনে পড়ে বাবার কথা। বাবা সবসময় বলেনÑ দেশকে ভালোবাসবে, দেশ হচ্ছে মা।
‘এই এলাকার কৃতি
সন্তানÑ যারা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহসী ভূমিকা
রেখেছিলেন, যাদের জন্য আজ আমরা স্বাধীনভাবে মাথা উঁচু করে
দাঁড়াতে পেরেছি, এখন তাদেরকে সম্মান জানানো হবে’Ñ তপু ভাইয়ের কণ্ঠে ভেসে আসে ঘোষণা। মঞ্চের মাঝখানে সাদা
কাপড়ে ঢাকা টেবিলটার উপরে অনেকগুলো ফুলের তোড়া রাখা আছে। শ্যামলদা আর আসাদ ভাই
দর্শকের সারিতে এসে অয়নদেরকে মঞ্চে ডেকে নেয়। তারপর এলাকার সূর্য-সন্তান
মুক্তিযোদ্ধাদের আহবান জানানো হয়। মঞ্চে উঠে আসেন সাত্তার মাস্টার, হামিদ শেখ, সাঈদ খান, হরিপদ ঘোষ, জগানন্দ বসু, তারাপদ ঘোষ, রমেন সাহা, ইসমাইল মোল্লা, জয়নাল হাওলাদার, আতিকুল ইসলামসহ বাকি মুক্তিযোদ্ধাগণ। অয়নদের
হাতে তুলে দেয়া হয় ফুলের তোড়াগুলো। ওরা একে একে সবার হাতে তুলে দেয় ওগুলো, মুহুর্মুহু করতালিতে ভরে ওঠে বটতলা প্রাঙ্গণ।
মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানানোর মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতার দশ বছর পরে দেশকে নতুন করে
গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বলিয়ান নতুন প্রজন্ম। এই অঞ্চলে
মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথা আশেপাশের অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। যে কোনো মূল্যে এই
গৌরব ও সম্মানকে ধরে রেখে দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য আজ নতুন করে শপথ নেয়া
হয়।
গতবারের অনুষ্ঠানের
কথা অয়নের অস্পষ্টভাবে মনে আছে। তবে এবারই প্রথম ও দারুণভাবে উপভোগ করছে বিজয়
দিবস। অয়ন আজ সবার সামনে বাবার হাতে ফুল তুলে দিয়েছে। বাবার জন্য খুব গর্ব হয় ওর।
বাবার কথা ভাবতে ভাবতেই মঞ্চ থেকে ভেসে আসে গান। ‘একি অপরূপ রূপে মা তোমার হেরিনু
পল্লী জননী’- চারুদি, ছোটদি আর শিখাপু মিলে গাচ্ছে। চারুদি’র গানের
গলাটা বেশ। ছোটদিও ভালো গায়, তবে চারুদির মতো
না। অয়ন তন্ময় হয়ে শোনে আর হারিয়ে যায় অন্য জগতে; চোখে ভেসে ওঠে- কোটাখালী ব্রিজ, নদীর চরে কাশের বন, সুবর্ণপুরের চৈত্র-সংক্রান্তির মেলা। ঠিক তখনই
মঞ্চ থেকে আতিক ভাইয়ের কণ্ঠে ভেসে আসে আবৃতি। সারা অনুষ্ঠানে জুড়ে নেমে আসে পিনপতন
নীরবতা। কেবল আতিক ভাইয়ের কণ্ঠটি শোনা যায় বহুদূর পর্যন্ত । অয়ন আজ নতুন করে যেন
উপলন্ধি করে দেশকে, দেশের সম্মানকে।
আতিক ভাইয়ের কণ্ঠের
রেশ কাটতে না কাটতেই তপু ভাই কী যেন বলে যায় দর্শকের উদ্দেশ্যে, অয়ন বুঝতে পারে না। তারপরই শ্যামলদা’র গলা থেকে বের হয়ে আসে
অন্যরকম এক হাহাকারের সুর। এক দুঃখিনী মায়ের করুণ আর্তি। খোকার জন্য এক মায়ের
অনন্ত প্রতীক্ষার কথা। দর্শকের আসন থেকেই কেউ কেউ বলে ওঠে বাহান্নই ছিল একাত্তরের
গোড়াপত্তন। একাত্তর কিংবা বাহান্ন- ছোট্ট অয়নের কাছে আলাদা কোনো বিষয় নয়; শুধু দেশটাকে মনে হতে থাকে অনেক বড়। অয়ন, সুবল কিংবা মিরাজদের কাছে আজকের দিনের অনুভূতি একটু
অন্যরকম। এই অনুষ্ঠান দেশের প্রতি ওদের ভালোবাসা বাড়িয়ে দিল অনেকগুণ।
গানে আবৃতিতে অনেক
রাত হয়ে যায়। সবাই বলাবলি করে- এহন শুরু অইবো নাটক। মন্টু মামা অয়নের কাছে এসে
জানতে চায়- এহন বাড়ি যাইবা মামা? অয়নের নাটক দেখতে
খুব ইচ্ছে করছিল। মন্টু মামাকে বলতেই মামা বলেÑ ঠিক আছে, যাওনের ইচ্ছা অইলে আমারে জানাইও; আমি পেছনের লাইনে আছি। নাটক শুরু হওয়ার আগেই বাদল অনুষ্ঠান
ছেড়ে বেরিয়ে যায়। সবার অলক্ষ্যে বাদলের পিছু নেয় একটা ছায়ামূর্তি।
বেশ কিছুক্ষণ পর
শুরু হয় নাটক। অয়ন মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকে মঞ্চের দিকে। মিলিটারীরা নিরীহ
মানুষকে ধরে পেটাচ্ছে দেখে মন খারাপ হয়। মঞ্চ থেকে ভেসে আসে চিৎকার চেঁচামেচি, দিগি¦দিক ছুটে চলেছে
মানুষজন, পেছনে তাড়া করে ফেরে মিলিটারী..., ছুটতে ছুটতেই মিলিটারির গুলি খেয়ে কিছু মানুষ মুখ থুবড়ে পড়ে
যায়। হঠাৎ দেখে আতিক ভাই গুলিবিদ্ধ হয়, সুবল আঁতকে ওঠে। অয়ন সুবলের হাত শক্ত করে ধরে রাখে। সন্তানের বুকে মাথা রেখে
বিলাপ করে কাঁদে এক মা...
কিছুক্ষণ নাটক দেখে
অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসে মজনু। বাইরে এসে দেখে তার সাথের লোকজন কেউ নেই। গিয়াসদের
কোথাও দেখতে পায় না। বাদল চলে যাওয়ার আগে অবশ্য তাকে বাড়ি যাবার কথা জিজ্ঞেস
করেছিলো। সে ইচ্ছে করেই থেকে গিয়েছিল।
গ্রামের রাস্তা ধরে
বাড়ির পথে এগিয়ে চলেছে মজনু। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আজ টর্চটা সাথে নেই।
প্রতিদিন বাড়ি থেকে ওটা নিয়েই বের হয়। আজ সকালে শহরে গিয়েছিল, ওখান থেকে সরাসরি অনুষ্ঠানে। অন্ধকারকে তার ভয় লাগেনি কখনো, তবে আজকের গাঢ় অন্ধকারের সাথে যোগ হওয়া হিম শীতল বাতাস হাড়
পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিচ্ছে। শালটাকে ভালোমতো গায়ে জড়িয়ে নেয়। বাড়ুইদের জঙ্গলের পাশের
চিতাখোলার কাছে দিয়ে যাবার সময় বাঁশঝাড়ের দিক থেকে বয়ে আসা শীষকাটা ঠা-া বাতাস
গায়ে লাগতেই কিছুটা ভয় লাগে।
জঙ্গলের ভেতর থেকে
রহস্যময় বিচিত্র শব্দ ভেসে আসে। হঠাৎ শো-শো বাতাসের সাথে ডানা ঝাপটানোর শব্দটা
শুনে বুকের ভেতর ধ্বক করে ওঠে। মজনু কিছুটা শঙ্কিত হয়। এ কীসের আওয়াজ! জোর পায়ে
হেঁটে পার হয়ে আসে ঐ জায়গাটা। এই পথটা বড় বেশি নির্জন। তাদের বাড়ি যাওয়ার নিজস্ব
রাস্তা, তাই এপথে অন্য লোকজনের আসা যাওয়া নেই বললেই
চলে। বাড়ির কাছাকাছি মরা পুকুরটার পাড়ে আসতেই হঠাৎ পেছনের ঝোপের মধ্যে কিছু একটা
পড়ার শব্দ শুনে ঘুরে তাকায়। অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না।
সামনে ঘুরতেই হঠাৎ
অতর্কিত আক্রমণে হকচকিয়ে যায় মজনু। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাটিতে পড়ে যায়। ষন্ডামতো
একজন তার চিৎ হওয়া শরীরের উপরে উঠে হাত দুটিকে মাটির সাথে ঠেসে ধরে শক্ত করে।
আরেকজন তার শরীর থেকে শালটি খুলে নিয়ে মুখম-ল এমনভাবে জড়িয়ে ফেলে যে হালকা পাতলা
গড়নের মজনু কোনোরকম শব্দ করা কিংবা নড়াচড়ার সুযোগ পায় না। শক্ত হাতগুলো সাঁড়াশির
মতো চেপে ধরে আছে তার মাথা। মজনু সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করে মুক্ত হতে কিন্তু তার
চেয়ে কয়েকগুন শক্তিশালী দুজনের বিরুদ্ধে কিছুই করার থাকে না। ধস্তাধস্তির মাঝেই
কানে ভেসে আসে সেই ডানা ঝাপটানোর শব্দটা। মজনু উপর দিকে তাকায়, একটা বিশালাকার ছায়া সরে যেতে থাকে শূন্যে, আকাশের দিকে; তারপর হারিয়ে যায় জোছনাবিহীন অন্ধকারের মাঝে। কিছুক্ষণের মধ্যেই টের পায় ক্রমশ
দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। বাতাসের জন্য হাঁসফাঁস করতে করতেই উপলব্ধি করে- মারা যাচ্ছে
সে। তখনই তার দিকে ঝুকে পড়া দু’জনের উপর চোখ পড়ে। একজনের মুখ তখনও কাপড়ে ঢাকা।
ধস্তাধস্তির কোনো এক ফাঁকে অন্যজনের মুখ থেকে কাপড়ের একপ্রান্ত খুলে পড়েছে, টের পায়নি কিংবা ঠিক করার সুযোগ হয়নি। অন্ধকারের মধ্যেও সেই
মুখের আদলটি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে ওঠে মজনুর কাছে। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে
অনেকদিনের চেনা মুখটির দিকে। তারপর ক্রমশ অবশ হয়ে আসা শরীরটি নিস্তেজ হয়ে পড়ে
একেবারেই।
কৃষ্ণপক্ষের
রাত্রির মধ্য প্রহরে দূর আকাশে ঘন কালো মেঘরাশি সরে যায় অলক্ষ্যে- সমস্ত বিরান
প্রান্তর জুড়ে বড় বড় গাছেদের ছায়ারা লুকোচুরি খেলে নিবিড় নিস্তব্ধতায়। বাঁশ
বাগানের পাশ ঘেঁষে হীম-শীতল ঠা-া বাতাস বয়ে যায় মরা পুকুরের উপর দিয়ে। নিরেট
অন্ধকারের মাঝে আততায়ী দু’জন আরেকবার পরীক্ষা করে শিকারের দেহ। মৃত্যু নিশ্চিত হলে
লাশটি ঠেলে ফেলে রাখে মরা পুকুরের পাড়ে। অতঃপর মিলিয়ে যায় জমাট কুয়াশায় ঢাকা
প্রাচীরের আড়ালে।
সাত সকালে গাজী বাড়ি
থেকে চিৎকার আর কান্নার রোল ভেসে আসে। আশেপাশে বাড়ি থেকে লোকজন ছুটে আসে হারু
গাজীর বাড়িতে, ধীরে ধীরে ভরে যায় বাড়ির আঙিনা। মজনুর নিথর
দেহটা শোয়ানো ঘরের সামনের উঠানে। সিঁড়িতে গম্ভীর হয়ে বসে আছে হারু গাজী। পাথরের
মূর্তি যেন। অন্দরমহল থেকে ভেসে আসা মহিলাদের বিলাপ আর কান্নার শব্দে ভারি হয়ে
উঠেছে সারা বাড়ি। উপস্থিত লোকজন সবারই প্রশ্ন- কী হয়েছিল? সুস্থ সবল যুবকটির এই অকাল মৃত্যু অনেকের কাছেই রহস্যজনক
লাগে।
গ্রামের অনেকেই
গাজীদের পছন্দ করে না। কারণ অবশ্য তাদের পারিবারিক পূর্ব ইতিহাস আর হারু গাজীর
ব্যক্তিগত ইমেজ। মজনু যদিও এর ব্যতিক্রম ছিল না, তবে অতি সম্প্রতি তার কিছুটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হচ্ছিলো। বিশেষ করে এলাকার
বর্তমান জনপ্রতিনিধি খালেক তালুকদারের ব্যর্থতা আর তার বিরুদ্ধে মজনুর সোচ্চার
হওয়া প্রতিপক্ষ হিসেবে মজনুকে কারো কারো কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলছিলো; অনেকটা মন্দের ভালো হিসেবে। আজ এই রহস্যজনক মৃত্যু মজনুকে
যেন আরও জনপ্রিয় করে তুললো।
হারু গাজী বেশ
বুঝতে পারে এটা কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। এই মৃত্যুর পেছনে কার ষড়যন্ত্র বুঝতে
বাকি থাকে না তার। প্রমাণের অভাবে কিছু করতে পারবে না, এটা ভেবেই চুপ করে থাকে। মনে মনে বলে- আমার ভাইয়ের মৃত্যুর
বদলা আমি নিমুই, সময় আমারও আইবো।
পুকুরের ঘাটে
গিয়াসকে সামাল দেয়ার চেষ্টা করে ওর সাথের লোকজন। গিয়াসের একটাই কথা- এই কাম
বাদইল্যা আর ওর ভাইয়ের। কয়েকদিন ধরে খালেক তালুকদার আর বাদলের গতিবিধি ওর কাছে
ভালো লাগছিলো না। মজনুকে ও বলেছিল সে কথা। হঠাৎ বাড়ির মূল রাস্তা দিয়ে বাদলকে
প্রবেশ করতে দেখে তৎক্ষণাৎ উঠে দাড়ায় গিয়াস। সাজু আর পলাশ মিলে তাকে থামায়। সবাই
বোঝায় ‘এই হিসাব আমরা পরেও করতে পারুম, এখন লাশ দাফনের ব্যবস্থা করতে অইবো’। গিয়াস গুম মেরে বসে থাকে পুকুরের ঘাটে।
ভিড়ের মাঝে হঠাৎ
উপস্থিত হয় বাদল। মজনুর লাশের কাছে গিয়ে বিলাপ করে কেঁদে ওঠে। ‘আমি ক্যান ওরে একলা
রাইখ্যা আগে আগে চইলা আইলাম, ক্যান ওরে জোর কইরা
নিয়া আইলাম না’। বাদলকে দেখে সামসু খন্দকার এগিয়ে এসে বলে, এমন কইরা কান্দিস না বাদল, ওর আত্মা কষ্ট পাইবো। মিয়াভাইয়ের মনের অবস্থা ঠিক নাই, আমগোর এহন অনেক কাম। দাফন কাফনের ব্যবস্থা করতে অইবো।
সকাল থেকে চুপচাপ
আর গম্ভীর হারু গাজী হঠাৎ গর্জে ওঠে,
ঐ হারামজাদারে আমার
ভাইয়ের লাশের কাছেত্তন সইরা যাইতে ক সবাই।
বাদল এই পরিস্থিতির
জন্য প্রস্তুত থাকলেও হারু গাজীর এমন রুদ্রমূর্তি দেখে কিছুটা ভড়কে যায়। কিছুক্ষণ
পর নিজেকে সামলে নিয়ে হারু গাজীর কাছে এসে বলে,
মিয়াভাই, আপনে হুদাই আমারে ভুল বুঝতাছেন। মাঝে মাঝে আমগো মধ্যে মন
কষাকষি অইলেও মজনু আছিল আমার প্রাণের দোস্ত। কাইলও আমরা একলগে অনুষ্ঠান দ্যাখছি, আমি বাড়ি আহনের সময় ওরে সাধছিলাম কিন্তু ও কইলো আরও পরে
আইবো। তাই আমি আগেই চইলা আইছিলাম। যদি বুঝতাম এমন অইবো তাইলে কী আর ওরে ফালাইয়া
আইতাম?
হাউমাউ করে কেঁদে
ওঠে বাদল।
ভাইয়ের মতোন অভিনয়
তো ভালোই শিখছোস। তোরা যে কালসাপ হেইডা আমার থেইক্যা ভালো আর কেডা জানে? মনে রাহিস, আমি তোগো ছাড়ুম না, তোর ভাইরেও কইয়া দিস। হেয় আমারে ভালোই চিনে, তুইও চিনবি আস্তে আস্তে। হারু গাজী একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে
বাদলের দিকে।
উপস্থিত লোকজন
বোঝে- বাদলের উপস্থিতি পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলবে। তাকে ওখান থেকে সরিয়ে দেয়
সবাই। বাদল চলে যাবার সময় চোখে পড়ে গিয়াস পুকুরঘাটে বসে আছে। কিছু বলার জন্য ঘাটের
দিকে এগিয়ে যেতে গিয়ে দেখে, ওর দিকে সোজা তাকিয়ে আছে গিয়াস। সে চোখে
প্রহিংসার আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে।
শীতের তীব্রতা
ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ঘন কুয়াশায় ঢেকে থাকে সূর্য; অনেক বেলা অবধি। রাস্তার দু’পাশের ক্ষেতে শিশিরে ভেজা গাঢ় সবুজ খেসারির ডগা আর
কাঁচা হলুদ রঙের সরিষা ফুলগুলোকে অনেক সতেজ লাগে এখন। শীত অয়নের সবচেয়ে প্রিয় ঋতু।
সকালে সদ্য ঝরানো খেজুরের রসের মজাটাই অন্যরকম। সেই সাত সকালে উঠে মন্টু মামা গাছ
থেকে খেজুরের রস নামিয়ে নিয়ে আসে। রান্নায় বসানোর আগে মা কিছুটা কাঁচা রস ওর জন্য
তুলে রাখেন। মা’র ব্যস্ততা সেই সকাল থেকেই। কাকভোরে উঠে কাজে লেগে পড়েন, প্রতিদিনই কোনো না কোনো পিঠা তৈরি করেন মা।
অয়নের ঘুম ভেঙ্গেছে
বেশ কিছুক্ষণ আগেই। লেপের ওম ছেড়ে বেরুতে ইচ্ছে করছিল না। অনেকক্ষণ ধরে ছোটদি’র
ডাকাডাকির পর উঠে পড়ল। সোয়েটার গায়ে জড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো। আজ
ঠা-াটা বেশ বেশি, হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিচ্ছে। অয়ন সোয়েটারের
সাথে মাফলারটাও গলায় জড়িয়ে নেয়। ঘরের পেছনের খোলা জায়গায় তৈরি নতুন চুলায়
রান্নাবান্নায় ব্যস্ত মা। বাবা, মন্টু মামা আর
ছোটদি চুলার পাশে আগুনের ওমে বসে খেজুরের গুড় দিয়ে পিঠা খাচ্ছে। ওকে দেখে মা বললেন,
যাও বাজান, হাতমুখ ধুইয়া আস। গরম গরম পিঠা খাইয়া লও। ঠা-া হইয়া গ্যালে
ভালো লাগবো না।
মা, আমার খেজুরের রস আছে তো? বকুলের দিকে আড়চোখে তাকায় অয়ন।
যারা কাঁচা রস
খাইবো, তারা কিন্তু রসের ফিন্নি পাইবো না। অয়নকে
ক্ষেপাতে বকুল বলে।
এই ছোটু, তুমি বেশি কতা কইও না। আমি জানি, মা আমারডা ঠিকই রাইখ্যা দিছে।
অয়নের কথা শুনে
সবাই হেসে ওঠে। সালমা বেগম ছেলেকে থামাতে বলেন-না, তোমার ফিন্নিও তুইল্যা রাখছি। আগে রস খাও, পরে দিমুনে।
কাঁচা রস খাওয়া শেষ
করার পর অয়ন দেখে মার হাতে একবাটি খেজুরের রসের ক্ষীর। রাতে রান্না করে রাখা
ক্ষীরটুকু শীতে জমে গিয়ে উপরে পুরু সর পড়ে আছে।
বিভার সেই
প্রহসনমূলক বিচারের ঘটনার পর দুই মাস কেটে গেছে। মা-মেয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার পর
বিভার শূন্য ভিটায় এখন আর সন্ধ্যাবাতি জ্বলে না। তবে মনু মিয়ার ভেতরটা এখনো জ্বলে, ছাইপোড়া আগুনের মতো। কারণ, বিভার ঘরের জায়গাটুকুর জন্য তার অপেক্ষা এখনো শেষ হয়নি। সে প্রতিদিনই আশায়
থাকে মফিজ মিয়া তাকে এই ভিটায় বসত করতে বলবে। কিন্তু তেমন কোনো লক্ষণ দেখতে পায়না।
বরং ইদানীং মনে হয় মফিজ মিয়া তার উপর অসন্তুষ্ট। তবুও মিনু ময়া ভাবে আজ মফিজ
মিয়াকে বিষয়টা মনে করিয়ে দেবে। না চাইলে কেউ কিছু দেয় না। মনু মিয়া ধীরে ধীরে মফিজ
মিয়ার বাড়ির দিকে হাঁটে।
আজ দু’দিন ধরে
শয্যাশায়ী মফিজ মিয়া। জ্বরে বেশ কাবু হয়ে পড়েছে, কাশির জন্য কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে তার। সামনের বারান্দার চৌকির উপর বসে প্রচ-
বিরক্তি নিয়ে তার একমাত্র মেয়ে জামাই মালেকের দিকে তাকিয়ে আছে। দু’দিন হলো শ্বশুর
বাড়িতে আসলেও আজই প্রথম তার সাথে দেখা করতে আসলো মালেক। দীর্ঘদিন ধরে শেফালি বাবার
বাড়িতেই পড়ে আছে, শেফালিকে বাড়িতে নিয়ে যাবার কোনো উদ্যোগ তার
মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। অথচ বৌ-মারফত টাকার কথা শ্বশুরের কাছে অনেকবারই বলানো
হয়েছে। আজ সে জামাইকে ডেকে পাঠিয়েছে।
শ্বশুর রেগে আছে
বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি কথা শেষ করে কেটে পড়ার উপায় খোঁজে মালেক। শ্বশুরের কাছে এসে
বসে;
খুব ভক্তি সহকারে কুশলাদি জিজ্ঞেস করে।
আব্বা, কেমন আছেন?
ভালো। তা তোমার খবর
কী কও তো? এইভাবে আর কয়দিন চলবে?
আমি একটু সমস্যার
মধ্যে আছি আব্বা, আপনে যদি একটু সহযোগিতা করতেন তয় এইডা কাটাইয়া
উঠতে পারতাম।
আর কত? আমার কী জমিদারী আছে? বিয়ার পর থেইক্যা তোমারে তো কম দেইনাই। কয়েকমাস আগে দোকান দিবা কইয়া টাকা নিলা, এহন আবার হুনতাছি গাড়ি কিনবা, আমি তো বারে বারে তোমার এইসব চাহিদা মিটাইতে পারুম না।
এইবার আর এমনে এমনে
দিতে অইবো না, আমারে ধার হিসাবে দেন। আমি প্রত্যেক মাসে
আপনারে শোধ দিয়া দিমু।
ধার করলে তোমার
বাপ-ভাইগো কাছ থেইক্যা কর। আমার এহন টানাটানি চলতাছে, এই মুহূর্তে আমি তোমারে কোনো টাকা দিতে পারুম না। আর
শেফালিরে এইহানে ফালাইয়া রাখছো ক্যান?
বাবার কাছ থেইক্যাও
নিমু,
তয় তাতে সবটা অইবো না। যেমনেই হউক এইবারের মতোন
আপনারে সাহায্য করতেই অইবো, আমি কতা দিতাছি ছয় মাসের মধ্যে আপনার টাকা শোধ
দিয়া দিমু।
মফিজ মিয়া আরও কিছু
বলতে গিয়ে দেখে মনু মিয়া উঠানের মধ্যে দিয়ে তার ঘরের দিকেই আসছে। থেমে যায় সে; বাইরের লোকের সামনে আর যাই হোক নিজের মেয়ে-জামাইকে ছোট
করাটা ঠিক হবে না। মনু মিয়া এসে পড়ায় মালেক শ্বশুরের কাছ থেকে মুক্তিলাভের সুযোগ
পেয়ে যায়।
আব্বা, আমি রাইতে আপনার লগে কতা কমুনে, এহন যাই?
যাও, রাইতে তুমি আমার লগে বইবা।
মনু মিয়ার দিকে
তাকিয়ে মনে মনে ভাবে, এ আরেক যন্ত্রণা! বউয়ের দিকের মানুষ বলে কিছু
বলতেও পারে না। বিভার জমি দখল করা নিয়ে গ্রামের লোকজন এখনো তার উপর বেশ ক্ষ্যাপা, বলতে গেলে সে একরকম একঘরে। তার উপর এই আলগা উৎপাত খুব
বিরক্তিকর!
মফিজ মিয়াকে অসুস্থ
দেখে মন খারাপ হয়ে যায় মনু মিয়ার। যে উদ্দেশ্যে সে এসেছিল এই অসুস্থতার মধ্যে
প্রসঙ্গটা তোলাটা ভালো দেখায় না। সে মফিজ মিয়ার কুশল জানতে চায়।
মিয়াভাইয়ের শরীর তো
দেখি অনেক খারাপ হইয়া গ্যাছে, আপনারে অনেক কাহিল
লাগতাছে।
হ, শরীরটা কয়দিন ধইরা ভালো যাইতেছে না। আপনের কী খবর?
ভালোই আছি। আপনের
লগে কিছু কতা আছিল, তয় এহন না। আপনে সুস্থ অইলে কমুনে।
আচ্ছা, ঠিক আছে। শরীরডা ভালো লাগতাছে না। আমি একটু ঘুমামু।
মনু মিয়া চলে গেলে
মফিজ মিয়া অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। সে জানে মনু মিয়া তার কাছে কী জন্য এসেছিলো।
মফিজ মিয়া উপলব্ধি করে ইদানীং মনু মিয়ার মোসাহেবী আচরণ তার কাছে অসহ্য লাগে।
ইদানীং প্রায়ই বিষণ্ন হয়ে পড়ে শিউলি। সারাদিনের বিরক্তিকর একঘেয়েমি আর কাটাতে যায়
না। নাহিদকে কতদিন বলেছে কোনো একটা স্কুলে চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে। ওটা হলেও
বেঁচে যেত। নাহিদ অনেকগুলো বই কিনে দিয়েছে। সবগুলো বই পড়া শেষ। দুপুরের পর বিছানায়
শুয়ে এপাশ ওপাশ করে কিছুটা সময় পার করে, তারপর বিভূতি নিয়ে বসে। এই লোকটার লেখাগুলো তাকে শ্যামলপুরের কথা আরও বেশি করে
মনে করিয়ে দেয়। গাঁয়ের সবুজ শ্যামল পথ-ঘাট, মাটির সোঁদা গন্ধ। সবকিছু!
জানালার পর্দা
সরিয়ে দিতেই ফাঁকা মাঠটার উপর দিয়ে ছুটে আসা ঠা-া বাতাসে ঘরটা ভরে গেল। মাঠের অপর
প্রান্তে চোখ পড়তেই দেখে বেলগাছটার নিচে দিয়ে রচনা দাশ এদিকেই আসছে। ইশারায় তাকে
ডাকলো শিউলি। রচনা এগিয়ে এসে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে হেসে বলে,
কী গো দিদি, কেমন আছো?
শিউলি হেসে উত্তর
দেয়Ñ
ভালো, অনেকদিন পর তোমাকে দেখলাম। এদিকে যে আর আসোই না!
আসবো গো দিদি, আসবো; তোমরা আগে একটা
সুখবর দাও! দেখবে সপ্তায় সপ্তায় আসবো।
আজ ভেতরে আসবে না?
হাতে সময় নেই রে
ভাই,
আরেকদিন এসে গল্প করে যাবো।
শিউলি আর কিছু বলে
না। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে তার বেশ খারাপ লাগে। কতই বা বয়স! তার থেকে দু-তিন বছরের
বড় হবে। রচনা ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ের একজন মাঠকর্মী। তার কাছে এসেছিল একদিন।
ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ের বিষয়ে শিউলিকে কিছু পরামর্শ দেবার পর নিজের জীবনের নানান
অভিজ্ঞতার কথা বলছিলো সেদিন। আমাদের দেশে ফ্যামিলি প্ল্যানিং-কে ভালো চোখে দেখে না
কেউ। যেসব মহিলা কর্মী এই পেশায় নিয়োজিত তাদের প্রতি এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব
পোষণ করে বেশির ভাগ মানুষ। তাদের মতে এরা সমাজবিরোধী গর্হিত কাজে লিপ্ত। কেউ কখনো
ভেবে দেখে না- এই মেয়েগুলো রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে মানুষের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে
দিচ্ছে।
রচনা চলে গেলে আবার
একাকীত্ব আঁকড়ে ধরে শিউলিকে। সময় যেন থমকে আছে। বাইরে এখনো আগুন রোদের প্রলয় নাচন।
রেডিওতে একটানা গান বেজে চলে। একটা শেষ হয়ে আরেকটা। রেডিও শুনতে শুনতে একসময়
ঘুমিয়ে পড়ে।
ঘুম ভাঙতেই দেখে
বাইরে সন্ধ্যা নেমেছে। ঘরের পাশের খোলা মাঠটা আঁধারে ঢেকে যাচ্ছে ক্রমশ। উঠে আলো
জ্বালায়। আগে নাহিদ সন্ধ্যার পর ঘরে ফিরতো, ইদানীং বেশ রাত করে ফেরে। নাহিদ না ফেরা পর্যন্ত চলে ওর দীর্ঘ অপেক্ষা। শিউলি
মনে মনে ভাবে- এভাবেই সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা গড়িয়ে একেকটা রাত আসবে। ওর একাকীত্বের সঙ্গী হবার জন্য কেউ নেই। মাঝে
মাঝে খুব কান্না পায় শিউলির।
প্রমোশনের পর থেকেই
কাজের চাপ বেড়ে গেছে নাহিদের। মুক্তনগরে প্রাইভেট ব্যাংক একটাই। অন্যান্য ব্যাংকের
তুলনায় গ্রাহকের চাপ অনেক বেশি। এই চাপ সামলানোর জন্য যে সংখ্যক লোকবল প্রয়োজন তা
নেই এখানে। বেশ কিছুদিন ধরে অফিস থেকে বেরুতে রাত নয়টা বেজে যায়। বের হবার সময়
প্রতিদিনই লক্ষ করে অফিস প্রায় ফাঁকা। বাসায় ফিরে শিউলির মনমরা চেহারাটা দেখে খুব
খারাপ লাগে। আজ ভেবেছিলো একটু আগেভাগেই ফিরবে, কিন্তু বসের অনুরোধে রিপোর্টটা শেষ করে বেরুতে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেল। একটা রিকশা
নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। নিউ মার্কেটের কাছে আসতেই হঠাৎ মনে হলো অনেকদিন
শিউলির জন্য কিছু কেনা হয় না। গত একমাস অতিরিক্ত কাজ করার জন্য বাড়তি কিছু টাকা
হাতে এসেছে আজ। আর কিছু না ভেবে মার্কেটে ঢুকে পড়ে।
বাইরে নক শুনে
এগিয়ে যায় শিউলি। গেট খুলতেই দেখে ওপাশে দাঁড়িয়ে নাহিদ। কিছু না বলে শোবার ঘরের
দিকে চলে আসে। নাহিদও আসে পেছনে পেছনে। ঘরে ঢুকে শিউলিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে
বলেÑ
মহারাণীর রাগের পরিমাণটা মনে হয় অনেক বেশি!
শিউলি অনেকটা
নিরসভাবে বলে-আজ এত তাড়াতাড়ি ফিরলে!
আজ একটু আগেই কাজ
শেষ হয়ে গেল। কেন আমি কী কখনো তাড়াতাড়ি ফিরি না?
ইদানীং অফিসই তোমার
সব,
বাসাটা তো রাত্রি যাপনের স্থান মাত্র। শিউলির
কণ্ঠে তাচ্ছিল্য।
আর মাত্র কয়েকটা
দিন,
তারপর কাজের ঝামেলা একদম কমে যাবে।
ছাই কমবে। আমার কথা
চিন্তা করে তোমার কী হবে? তুমি থাক তোমার অফিস নিয়ে। শিউলি অন্যদিকে মুখ
ঘুরিয়ে থাকে।
শিউলির হাতটা কাছে
টেনে নেয় নাহিদ, আংটিটা পরিয়ে দেয় অনামিকায়। শিউলি তাকিয়ে দেখে।
কি দরকার ছিল
এতগুলো টাকা খরচ করার?
আমার ইচ্ছা।
নাহিদ ওর হাতটা
নিয়ে ঠোঁটে ছোঁয়ায়। শিউলির তবুও মান ভাঙে না। কপট অভিমানে বলে,
থাক, আর আদিখ্যেতা দেখাতে হবে না।
শিউলির কাছে এগিয়ে
আসে নাহিদ। খুব কাছে। শিউলির কিছুক্ষণ রাগ, অভিমান; অতঃপর বাঁধ ভেঙে যায়। মিশে যায় নাহিদের মাঝে।
ভিতরে ভিতরে অদ্ভুত শিহরণ খেলে যায়। নাহিদের মধ্যেও বিদ্যুৎ চমকায়। ঘুমন্ত শরীর
জেগে ওঠে এক অদৃশ্য, তীব্র আকর্ষণে। দুর্বোধ্য ভাষায় রচিত হয় অনন্য
কাব্যগাঁথা। শিউলি লজ্জা পায়, লাল হয়। অতঃপর মুখ
লুকায় নাহিদের বুকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন