শনিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

উপন্যাসঃ ধূসর গোধূলি (পর্বঃ ৩১ - ৪০)





সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথেই খেলার পাট চুকিয়ে ঘরে ফেরে সুবল। পেছনের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে দেখে কেউ কোথাও নেই। মাঝখানের বড় ঘরের টেবিলের উপর টিমটিম করে জ্বলছে সন্ধ্যা-পিদিম। সুবল সামনের বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। বাহিরের দিকে চোখ পড়তেই দেখে উঠানের শেষপ্রান্তে আমগাছটার নিচে তাফালে খেজুরের গুড় জ্বাল হচ্ছে। মা, কাকু, কাকীমা উনুনের কাছে বসে আছে আর গোপালদা খরকুটো এগিয়ে দিচ্ছে। সুবল গরম কাপড় গায়ে জড়িয়ে উঠানে নেমে আসে। তাফালের আগুনের আলোয় উঠানের অনেকটাই আলোকিত। সুবল পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে কাকুর গলা জড়িয়ে ধরে। তারাপদ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়, প্রিয় ভাতিজাকে দেখে দু’হাত ধরে সামনে নিয়ে আসে। কাকুর কোলের মধ্যে ডুবে যেতেই সুবল হারিয়ে যায় ওমের রাজ্যে। তাফালের চারপাশ থেকে উঠে আসা টকটকে লাল আগুনের শিখা থেকে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে আশেপাশে।
হঠাৎ টুং-টাং শব্দ শুনে গলা উঁচু করে পেছনে তাকিয়ে দেখে ছোটদি চা-মুড়ি নিয়ে এদিকেই আসছে। চারু আরও কাছে আসতেই ও বলে ওঠে- খুব ক্ষিধা লাগছে, ছোটদি আমারে আগে দে। তারাপদ হেসে উঠে বলে- চারু মা, ওরেই আগে দে, ও তো আমগো মুরুব্বি। ধোয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে তাফালের উল্টাদিকে বসা মায়ের দিকে চোখ পড়ে সুবলের। কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। গনগনে আগুনের আভায় মায়ের ফর্সা রঙটা এখন আরও উজ্জ্বল হয়ে দ্যুতি ছড়াচ্ছে, যেন সাক্ষাৎ দুর্গা। 
নির্বাচনী উত্তাপে ক্রমশ গরম হয়ে উঠছে শ্যামলপুর-উজানপুর জনপদ। এবার কে কে দাঁড়াবে এ নিয়ে মানুষের মাঝে বেশ আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে। খালেক তালুকদারের গতবারের ব্যর্থতায় তার বিকল্প একজন ভালো প্রার্থীর প্রত্যাশা বাড়তে থাকে মানুষের মধ্যে। চেয়ারম্যান হিসেবে বশিরুল্লাহ পাটোয়ারী গ্রামবাসীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল বেশির ভাগ সময়। তার প্রতি মানুষের আস্থার জায়গাটাও প্রায় শূন্যের কোঠায়। লোকমুখে বেশ কিছুদিন থেকে চেয়ারম্যান হিসেবে সাঈদ খানের নাম শোনা যাচ্ছে। গ্রামবাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে তাঁর নিজ মুখে ঘোষণা শোনার জন্য।
স্বাধীনতার পর এই প্রথম নির্বাচনমুখী হলো মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি। এতদিন নিজেদের দূরে রেখে দেখেছে শকুন হায়েনারা ছিঁড়ে খাচ্ছে দেশটাকে। তাই চুপ করে না থেকে রুখে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে এই উদ্যোগ। সাঈদ খানের বাড়িতে আজ প্রথম সভা বসেছে। আসছে নির্বাচনে কিভাবে নিজেদের সংঘটিত করবে তাই নিয়ে চলছে আলোচনা। সাঈদ খান চেয়ারম্যান পদে দাঁড়াচ্ছেনÑ এ বিষয়টা এলাকায় শোনা গেলেও আতিকের মেম্বার পদে দাঁড়ানোর খবর এখনো গোপন রাখা হয়েছে।
নমিনেশন পেপার সাবমিট শুরু হইবে আগামী পরশু থেইক্যা। আতিক বলে।
শেষদিন কবে? সাইদ খান জানতে চান।
আগামী পাঁচ তারিখ। বললেন ইসমাইল মোল্লা।
তাইলে আমরা পাঁচ তারিখেই জমা দিমু। সাইদ খান বললেন।
উপস্থিত সবাই একবাক্যে সম্মতি জানায়।
হুনতাছি হারু গাজী এইবারও খাড়াইবো।
কাজেম মাঝির কথার পিঠে হামিদ শেখ বলে উঠলেন ও খাড়াইলেই কী আর না খাড়াইলেই কী? মরা-গরু নিয়া চিন্তার কিছু নাই। ওরে কেডা ভোট দেবো? আতিক এমনিই পাশ কইরা যাইবো।
পাটোয়ারীরে নিয়াও চিন্তার কিছু নাই। জানি গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ আমগো লগে থাকবো তয় আমগোও কিন্তু কাম করতে অইবো। ক্লাবের পোলাপাইনগো কামে লাগাইতে অইবো।
সাত্তার মাস্টারের সমর্থনে হরিপদ ঘোষ বলেনÑ তুমি ঠিকই কইছো মাস্টার। ওরা মাঠে থাকলে আমাদের কাজটা অনেক সহজ অইবো।
রঞ্জু, তুই ক্লাবের সবাইরে আমগো লগে আইজ সন্ধ্যায় দেহা করতে কইবি। ছেলের উদ্দেশ্যে বলেন সাঈদ খান।
ঠিক আছে বাবা। সন্ধ্যায় অগোরে মাস্টার চাচার দোকানের সামনে আইতে কমুনে।
আজ এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের পর সাত্তার মাস্টার স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। অনেকদিন পর তার চাওয়া পূরণ হতে চলেছে। দীর্ঘদিন ধরে তাদের অবহেলার কারণে যে অশান্তির বিষ ছড়িয়ে পড়েছিল এই জনপদে আজ এই শুভ শক্তির জাগরণে তা থেকে মুক্তি মিলবে এই অঞ্চলের মানুষের। এ আলোর মশাল কিছুতেই নিভতে দেয়া যাবে না।
দিনের শেষে বেশির ভাগ কর্মচারী বিদায় হলে গদিতে বসে থাকে হারু গাজী। মজনুর মৃত্যুর পর ইদানীং বেশ গম্ভীর হয়ে পড়েছে। মনে প্রতিহিংসার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে। খালেক-বাদলকে একটা শিক্ষা না দেয়া পর্যন্ত মনে শান্তি আসবে না। সে বেশ বুঝতে পারে মজনুকে সরিয়ে দিয়ে পথের কাঁটা দূর করেছে খালেক। নির্বাচনে তাকে এত সহজে জিততে দেয়া যাবে না। হারু গাজী বোঝে গ্রামে তার নিজের অবস্থান বেশ নাজুক, কিন্তু খালেককেও লোকজন ভালো চোখে দেখে না এটাও অনুধাবন করে সে। হারু গাজী ঠিক করেছে সে আবার মেম্বর পদে দাঁড়াবে। দরকার হলে টাকা দিয়ে হলেও তাকে হারানো চাই। গদিতে বসে হারু গাজী ছেলের উদ্দেশ্যে বলে- বাইরে বাদাইম্যার মতোন আর কতকাল ঘুরবি? বাজারে আইসা আমার লগে একটু হাত লাগাইতে পারোছ না?
আমি তো গদিতে বইতে চাই, তুমিই তো দেও নাই।
ধমকে ওঠে হারু গাজী, ক্যান বইতে দেইনা তুমি বোঝো না? গদিতে বইলেই তো ট্যাকা লুঙ্গিতে গোঁজো। এইহানে তোমার বহনের কাম নাই। এহন মজনু নাই, স-মিলডা দেহাশুনা কর।
গিয়াস মাথা নিচু করে রাখে। আইচ্ছা ঠিক আছে, কাইল থেইক্যা স-মিলে বমুনে।
কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে থেকে হারু গাজী বলে-আমি ঠিক করছি এইবারও মেম্বরে খাড়ামু।
গিয়াস চট করে বাপের দিকে তাকায়। তুমি খাড়াইয়া কোনো লাভ অইবো? অইতে তো পারবা না।
হারু গাজী ক্ষেপে যায়, অইতে পারুম না আগেই মনে অইলো ক্যান তোর?
গতবারও তো খাড়াইছিলা, তাই কইলাম।
গতবার আর এইবারের অবস্থা এক না। খালেইক্যার ফিল্ড এহন আগের চাইতে অনেক খারাপ। য্যামনেই হউক অরে আটকাইতে অইবো। অয় আমার ভাইরে মাইরা পথ পরিষ্কার করতে চাইছে, এত সহজে ওরে ছাইড়া দেওন যাইবো না। তোগো এহন থেইক্যাই কাম শুরু করতে অইবো।
বাপের রাগ দেখে দমে যায় গিয়াস। নিচু কণ্ঠে বলে- আইচ্ছা ঠিক আছে, তুমি য্যামনে কইবা তেমনেই অইবো। কিন্তু সময় তো বেশি নাই!
অসুবিধা নাই। সময় যা আছে তাতেই অইবো। তোরে যা কইছি তাই কর। আর একটা কাম কর- সামসু খোনকাররে আইজই আমার লগে দেখা করতে কইবি।
হারু গাজী মনে মনে ভাবে, ‘এইবার খালেইক্যার ভোডে অন্য কারুর ভাগ বসানের ব্যবস্থা করতে অইবো’।
মফিজ মিয়া মুখে যতই বলুক মেয়েজামাইকে টাকা দেবে না, শেফালির দিকে তাকিয়ে শেষ পর্যন্ত তার পণ রক্ষা হয় না। একমাত্র মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে টাকার ব্যবস্থা করে দেয় সে। শেফালি চলে যায় শ্বশুরবাড়ি। যাবার সময় জামাই অতীব ভক্তি সহকারে শ্বশুরের পা ছুঁয়ে সালাম করে।
আব্বা, আমগো লইগা দোয়া কইরেন।
মফিজ মিয়া সবই বোঝে। মনে মনে ভাবে মেয়েটা তবু সুখে থাক।
সারাদিন পর সাজু বাড়িতে ঢোকে। মফিজ মিয়ার রক্ত মাথায় চড়ে। খেঁকিয়ে ওঠে সে,
হারামজাদা! সারাদিন কই থাহস? বাপের হোডেলে খাস আর টো-টো কইরা ঘুইরা বেড়াস?
সাজু কোনো উত্তর দেয় না। নীরবে ঘরে ঢুকে যায়। মফিজ মিয়ার রাগ আরও চড়ে যায়।
কী রে? কী কই কানে ঢোকে না?
কাম আছিলো।
সোজাসাপ্টা উত্তর দেয় সাজু। মায়ের উদ্দেশ্যে বলেÑ মা, খাইবার দাও।
সারাদিন বাইরে কী কাম তোর? ঘোড়ার ঘাস কাটতে গেছিলি? দুই পয়সা আয়ের তো মুরোদ নাই।
বাপকে কিছুই বলে না, মার উদ্দেশ্যে বলেÑ ওনারে চিল্লাইতে মানা কর। সারাদিন পর ঘরে আইসা এত চিল্লাচিল্লি ভালোøাগে না।
ওরে কইবা কাইল থেইক্যা আমার লগে তহসিল অফিসে যাইতে। স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলে মফিজ মিয়া।
আমারে কন ক্যান, নিজের পোলারে কইতে পারেন না? স্বামীর উদ্দেশ্যে খেঁকিয়ে ওঠে পেয়ারা বেগম।
পোলা তো আমার না, তোমার। তুমি অরে লাই দিয়া মাথায় তুলছো।
সাজু, তোর বাপ কী কয় হুনস না? এবার ছেলের উপর রাগ ঝাড়ে পেয়ারা বেগম।
ওনারে কইয়া দাও আমি ঐ কাম করুম না। আমারে টাকা দিতে কও, আমি ব্যবসা করুম।
মফিজ মিয়া ধমকে ওঠে আবার। টাকা কী গাছে ধরে? চাইলেই পাওয়া যায়। আমি এহন কোনো টাকা দিতে পারুম না। তুই কাইল থেইক্যা আমার লগে শহরে তহসিল অফিসে যাবি।
মা তোমারে না আগেই কইছি, আমি ঐ দালালি কাম করুম না। ওনারে কইয়া দাও টাকা দিলে দেবো, নইলে যেন চিল্লাচিল্লি না করে। আমার ব্যবস্থা আমি নিজেই করুম।
মফিজ মিয়া নিজেকে আর সামলাতে পারে না। পায়ের জুতা খুলে ছেলের দিকে তেড়ে যায়, ’দালালির কাম, না! জুতাইয়া ঘর থেইক্যা বাইর কইরা দিমু হারামজাদা।’
পয়ারা বেগম মফিজ মিয়ার সামনে এসে দাঁড়ায়। তাকে একপাশে সরিয়ে নিয়ে বলে- এতবড় পোলার গায় কেউ হাত তোলে?
সাজু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে হনহন করে হেঁটে সোজা রাস্তার দিকে চলে যায়। পেয়ারা বেগম সাজুর পেছনে পেছনে উঠান পর্যন্ত যায়। সাজু একবারও ফিরে তাকায় না। ফিরে এসে স্বামীর উদ্দেশ্যে বলে,
পোলাডা সারাদিন পর আইলো, চাইরডা খাইতেও দিলেন না! এই কতাগুলান একটু পর কইলে কী অইতো?
মফিজ মিয়া এবার স্ত্রীর উপর রেগে যায়, এমন কইরাই ওর মাথাডা খাইছো তুমি। তোমার কারণেই আমার পোলাপানগুলান অমানুষ অইছে।
, এহন সব দোষই তো আমার। পোলাপাইন বড় অইছে, হেরা কই যায়, কী করেÑ তাও আমারে দেইখ্যা রাখতে অইবো। আমার হইছে যত জ্বালা!
মফিজ মিয়া ঘরের সিঁড়িতে গুম মেরে বসে থাকে। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে আসে। মসজিদ থেকে মাগরিবের আযান ভেসে আসে; মফিজ মিয়া সিঁড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। পা বাড়ায় মসজিদের দিকে।
স-মিলের অফিস ঘরে কাজে ব্যস্ত খালেক তালুকদার। আজ নমিনেশন সাবমিট করে আসার পর থেকে বেশ খোশ-মেজাজে আছে। অনেকদিন থেকে এই দিনটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল সে। এখন অনেকটাই নিশ্চিন্ত। মজনু না থাকায় এখন তাকে আর শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি হতে হবে না। তার প্রতিদ্বন্দ্বী একমাত্র হারু গাজী, যাকে সে গতবার বিপুল ভোটে হারিয়েছিল। দূর থেকে বাদলকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখে হিসাবের খাতা বন্ধ করে ভাইয়ের অপেক্ষায় বসে থাকে।
কী রে! তোরে এত অস্থির লাগতাছে ক্যান?
তুমি ঠিকই কইছো ভাই, খোনকাররা হাড়ে-হারামি। খালেকের উদ্দেশ্যে বলে সে। মেজাজ খিঁচড়ে আছে বাদলের।
ক্যান, কী অইছে আবার?
তুমি জান সামসু খোনকার নমিনেশন সাবমিট করছে?
কথাটা কানে যেতেই হঠাৎ চুপ হয়ে যায় খালেক। অনেকক্ষণ পর বলে- এইডা হারু গাজীর কোনো চাল না তো? ভালো কইরা খবর নে তো।
অইতেও পারে। খোনকারগো বিশ্বাস করন যায় না। সামসু অফিস থেইক্যা বাইর হওনের সময় আমারে দেইখ্যাও না দেখার ভান কইরা চইলা গ্যালো!
একটু আগের অনুভূতি উবে যায় খালেকের মন থেকে। সে ভাবে- হারু গাজী পরীক্ষিত প্রতিপক্ষ, তাকে হারাতে পারবে এই আত্মবিশ্বাস আছে। কিন্তু সামসু খোনকার প্রতিন্দ্বন্দ্বী হিসেবে কেমন হবে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না সে।
হঠাৎ হৈচৈ শুনে বাবার দোকানের সামনে থেকে বড় রাস্তার মুখে এসে দাঁড়ায় অয়ন। পাকা রাস্তা ধরে একটা মিছিল বাজারের দিকে এগিয়ে আসছে। সামনে থেকে হারু গাজীর ছেলে গিয়াস হাত উঁচিয়ে কিছু বলছে আর পেছনে পেছনে জনা কয়েক লোক ওর সাথে গলা মেলাচ্ছে। ধীরে ধীরে শব্দগুলো স্পষ্ট হয়। অয়ন বুঝতে পারে ওরা ‘হারুন গাজী’কে ভোট দেবার জন্য মানুষজনকে আহবান জানাচ্ছে। বাজারের লোকজন কেউ কেউ দু’একবার তাকিয়ে দেখে, তারপর মন দেয় যে যার কাজে।
ইতিমধ্যে বাজারে খবর রটে গেছে এবার মেম্বার পদে হারু-খালেকদের সাথে আরও একটি নাম যোগ হয়েছে। করিম লস্কর বলে- ‘খ্যালা জমবে এইবার। হারু-খালেক সহজে পার পাইবো না’। কেউ কেউ আবার বলে ওঠে- সামসুরে ভোট দেবো কেডা?
কিছু মানুষ এই আলোচনায় কোনো উৎসাহ পায় না। তারা জানে, হারু-খালেক-সামসু কেউই তাদের কাক্সিক্ষত প্রার্থী নয়। এলাকার উন্নয়ন কিংবা মানুষের ভালোর জন্য এরা নির্বাচনে আসে নি, এসেছে কেবলমাত্র নিজেদের ভবিষ্যৎ গোছাতে। 
সামসু বাজারে ঢুকতেই লোকজন ঘিরে ধরে। করিম লস্কর এগিয়ে এসে হাসতে হাসতে বলে,
খোনকার, মিষ্টি খাওয়াও; নইলে ভোট দিমু না’। সাথে আরও অনেকে কণ্ঠ মিলায়।
এহনই কী? সামনে তো অনেক সময় পইরা আছে। খাওয়ামুনে।
পরে বইলা পার পাবা না খোনকার, খুশির খবর গরম থাকতে থাকতেই মিষ্টিমুখ করাইতে অয়।
সামসু ভাবে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে লাভ নেই। শুরুতে মানুষজনকে সাথে না রাখলে কাজের সময় এদের কাছে পাওয়া যাবে না। সবাইকে নিয়ে হরিপদর দোকানের দিকে এগিয়ে যায় সে। একজন দু’জন করে দলটা ভারী হয়। অল্পক্ষণের মধ্যেই হরিপদর দোকানটা ভরে যায় লোকে।
মিষ্টি খেতে খেতে কিছু মানুষ সামসুর গুণগান করে। সামসু বোঝে, এদের মধ্যে অনেকেই তাকে ভোট দেবে না। লোকজন ভোট দেক বা না-দেক তার কিছুই আসে যায় না। নির্বাচনে জয়লাভের জন্য সে দাঁড়ায়নি। এভাবে টাকা নষ্ট করার মানুষ সে নয়। দোকানের ভিড়ের দিকে একবার চোখ বুলায় শামসু; মনে মনে ভাবে, আজকেই এতগুলো টাকা পকেট থেকে বেরিয়ে যাবে, হারু গাজী সব টাকা দেবে তো!
ছোট্ট অয়ন এলাকায় ভোটের গুরুত্ব বোঝে না, তবে কলাবতী বাজারসহ সারা গ্রামে মানুষের মুখে একই আলোচনা শুনে ভোট সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠে। সে বাবাকে প্রশ্ন করে,
বাবা, ভোট কইরা কী অয়?
ভোটের মাধ্যমে এলাকার প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়। তারা এলাকার উন্নয়নের জন্য কাম করে।
আতিক ভাই আর সাঈদ কাকা কী আমগো লইগ্যা কাম করবো?
হুম, আমরা সবাই তাগোরে ভোট দিলে তারা নির্বাচিত অইবো, তহন তারা গ্রামের উন্নয়নের জন্য কাম করবো।
সবাই ভোট দিতে পারবো?
হুম, যারা বড় শুধু তারাই ভোট দেবো।
ও! তাইলে আমরা দিতে পারুম না, না?
না, তুমি এহন দিতে পারবা না। তয় বড় অইয়া দিতে পারবা।
আতিক ভাই আর সাঈদ কাকা দুইজনেই অনেক ভালো মানুষ, আমি বড় হইয়া হেগোরে ভোট দিমু।
সাত্তার মাস্টার হাসেন। সবসময় ভালো মানুষরে নির্বাচিত করতে হয়। তুমি বড় হইলে যে ভালো মানুষ খাড়াইবো তারেই ভোট দিবা।
বাবা বাজারে চলে গেলে অয়ন সুবলদের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। বড় রাস্তার মোড়ে আসতেই চোখে পড়ে সুশীল ওদের বাড়ির দিকে আসছে। কোটাখালী খালের ওপারে হরিপদ ঘোষের বাড়ির পেছনে সুশীলদের বাড়ি। কলাবতী বাজারের পোস্ট অফিসে চাকুরি করে সে। অয়ন বাজারে গেলে প্রতিবারই পোস্ট অফিসে খোঁজ নেয় বড়দি’র কোনো চিঠি আসলো কিনা।
কই যাস অনু?
সুবলগো বাড়ি। সুশীলদা আমগো কোনো চিঠি আইছে?
, শহর থেইক্যা শিউলিদি’র চিঠি আইছে।
অয়নের চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
দাও, আমার কাছে দাও। অয়ন হাত বাড়ায়।
সুশীল হাসে। কী বড়দির কথা খুব মনে পড়ে, না?
, পড়েই তো। সুশীলের হাত থেকে চিঠির খামটি নিয়ে সোজা বাড়ির দিকে ছোটে অয়ন।





 

নির্বাচনী প্রচারণায় কলাবতী বাজার এখন সারাদিনই সরগরম থাকে। রাস্তাঘাট, চায়ের দোকান, বটতলা নদীর ঘাটÑ সর্বত্রই একই আলোচনা-নির্বাচন। সাইদ খান আর আতিক প্রার্থী হওয়ায় এলাকার মানুষজনের মধ্যে যেন স্বস্তি ফিরে এসেছে। ভোট নিয়ে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার তারা অনেক বেশি আগ্রহী। উদয়ন সবুজ সঙ্ঘ ক্লাবের তরুণরা সবাই নির্বাচনী প্রচারণায় মহাব্যস্ত।
আতিক মেম্বারে খাড়াইয়া খালেইক্যার বাড়া ভাতে তো নুন ছিডাইয়া দিলো। দেখছো খালেইক্যা কেমন ফাটা বেলুনের মতোন চুপসাইয়া গ্যাছে। হাসতে হাসতে বললেন হামিদ শেখ।
ও নাকি লোকজনরে বইলা বেড়াইতেছে এইডা সাঈদ খা আর সাত্তার মাস্টারের কাম। হামিদ শেখের কথার পিঠে বলে ওঠে জগানন্দ।
সাইদ খানের কণ্ঠে স্পষ্ট বিরক্তি, ওর কতায় আমগো কী আসে যায়? এহন আমরা শুধু এইডাই বুঝি যে আতিকরে পাশ করাইতে অইবো। পাটোয়ারী কী কয়?
পাটোয়ারীর কী কোনো জনসমর্থন আছে? হেরে তো এলাকায়ই দেখি না। শ্লেষ মেশানো কণ্ঠে সাত্তার মাস্টার বললেন।
কাজেম মাঝি হাসেন, তুমি কী যে কওনা মাস্টার! পাটোয়ারীও বুইঝা গ্যাছে, এইবার তার কাম অইবো না।
আমগো কিন্তু প্রচারণায় নামা দরকার, কী কও সাঈদ? সাত্তার মাস্টার বলেন।
, এহন বইসা থাকনের সময় নাই। কাইল পোস্টারগুলা পাওয়া যাইবো। ক্লাবের পোলাপানগুলা ভালোই কাম করতেছে। অগোরে পোস্টার লাগানের জন্য এলাকা ভাগ কইরা দিতে অইবো।
একাত্তরের পর এই প্রথম শ্যামলপুর-উজানপুর জনপদে আরেকটা খুশির উপলক্ষ পেল মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের এই মানুষগুলো। দীর্ঘদিন পর তারা আবার দেশের উন্নয়নের জন্য নিজেদের সংঘটিত করে। এই প্রজন্মের তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এর উত্তাপ। চারিদিকে নানা অনাচারের মধ্যেও এঁরা ক্লাবের তরুণদের নানান উদ্যোগ ও সামাজিক কর্মকা-ে উৎসাহ দিয়ে এসেছে। তাদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ, স্বাধীনতার চেতনা জাগ্রত করেছে বিভিন্ন সময়ে। আজ নিজেরাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে সমাজ গড়ার কাজে। অন্যায় আর সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে এটি এদের বলিষ্ঠ প্রতিবাদ।
আতিকের নমিনেশন সাবমিটের খবর শুনে হারু-খালেক দুই শিবিরেই ভাটা পড়েছে। হারু গাজীর তুলনায় খালেক তালুকদার মুষড়ে পড়েছে বেশি। ভোটের খেলায় জয়ী হবার জন্য অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে তাকে। খালেকের মধ্যে কয়েকদিন আগের সেই উৎসাহ এখন কমে গেছে। হারু গাজী কিংবা সামসু খন্দকারকে নিয়ে সে আর ভাবে না। এখন তার চিন্তার একমাত্র কারণ- আতিক। প্রার্থী হিসেবে আতিক তার থেকে অনেক যোগ্য এটা সে নিজেও বোঝে। গত টার্মে এলাকায় তেমন কোনো কাজ করতে পারেনি, সেইসাথে যোগ হয়েছে প্রভার সাজানো বিচারে তার ভুমিকা। এসব কারণে তার জনপ্রিয়তা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। ফলাফল নিজের দিকে আসার সম্ভাবনা যে একেবারেই নেই তা কাউকে বলে দিতে হয় না। বাদল তাকে সাহস দেয়। খালেক কিছুটা ভরসা পায়। পকেট থেকে টাকা পয়সা বেরিয়ে যাবে কিছু। সে যাক, তবুও নির্বাচিত হতে পারলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
রাত নামে উজানগাঙের পাড়ে। চারপাশের মানুষগুলোর চেহারা ও চরিত্র বদলে যায় ধীরে ধীরে। রাত গভীর হলে নদীর পাড়ের স-মিলের ঘরে আড্ডা বসে; প্রায় প্রতিদিনই। আজকের আড্ডার বিষয়বস্তু অবশ্য অন্যান্য দিনের চেয়ে ব্যতিক্রম। জুয়া আর সুরার নেশা আজ কাটিয়ে দিয়েছে ক্ষমতার লোভ। স-মিলের ঘরটাতে বাদল তার লোকজনকে নিয়ে আলোচনায় বসেছে। মনা, রইস, কাসেম, জব্বারের সাথে নির্বাচনের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলছিল বাদল।
হারু গাজীরে নিয়া চিন্তার কিছু আছিলো না, কিন্তু আতিকরে নিয়া ভাই চিন্তায় আছে। গ্রামে তার অনেক জনপ্রিয়তা। চিন্তা কইরা বাইর করতে অইবো লোকজনরে আমগো দিকে ক্যামনে ভিড়ান যায়।
তোমগো পাড়ায় তো হিন্দুর সংখ্যাই বেশি। ওগো ভোট পাওয়া কঠিন অইয়া যাইবো। সব হিন্দুরা হরিপদরে খুব মানে। হরিপদ-তারাপদরে যদি কোনোরকমে আমগো পক্ষে আনা যাইত তাইলেই অনেক কাম অইত। বাদলের কথার উত্তরে বলে রইস।
এইডা সম্ভব না। হরি ঘোষ নিজেই তো সাঈদ খা’র লোক। তাছাড়া ঐ হালারা সাত্তার মাস্টার যা কইবো তাই হুনবো। সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো বাদল।
কোনোরকম ভয় দেখাইলে কাম অইবো না? মনা জানতে চায়।
তোরা তারাপদরে চিনস না? ঐডা ভয় পাওয়ার মাল না। ওরা গ-গোলের সময় থেইক্যাই আমগো উপরে ক্ষ্যাপা। অগোরে বাদ দিয়াই চিন্তা করতে অইবো।
সামসু খোনকার খাড়াইয়া আরও বিপদে ফালাইয়া দিছে। তোমগো এলাকার কিছু ভোট ওর দিকেও যাইতে পারে। বলে ওঠে জব্বার।
এইগুলা যাতে ওর পক্ষে না যায় হেইডা দ্যাখতে অইবো। মাস্টারের বাড়ির আশেপাশের ভোট আর হিন্দুগো ভোট আতিক পাইব, উজানপুরেও তাই। আমগো কাম করতে অইবো সুবর্ণপুরে। ঐদিকের লোকজনকে আমগো দিকে ভিড়ানের চেষ্টা করতে অইবো। বুঝাইয়া হউক, টাকা পয়সা দিয়া হউক। আমগো কাইল থেইক্যাই কামে নাইমা পড়তে অইবো। তোরা সবাই আমার লগে থাকবি। বাদল জিজ্ঞেস করে।
সবাই বাদলের কথায় সায় দেয়।
খুব সকালে বকুলের ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল অয়নের। শীত শুরু হবার পর থেকে প্রতিদিন বেলা করে ঘুম ভাঙে ওর। আজ এক ডাকেই উঠে পড়ল।
ছোটদি, পুকুরের পানি শুকাইয়া গ্যাছে? ঘুমজড়ানো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে অয়ন।
, তুই না কইছিলি মাছ ধরা দেখবি। একটু পরই মাছ ধরা শুরু অইবো।
অয়ন তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে উঠানে চলে আসে। পুকুরের ঘাটে এসে অবাক হয়ে যায়। সব পানি শুকিয়ে গেছে। কাল বিকেলেও প্রায় অর্ধেক পানিভর্তি পুকুরটি এখন পানির অভাবে খাঁ-খাঁ করছে। চারিদিকে থকথকে কাদা আর একেবারে মাঝখানে কিছুটা কাদাপানি জমে আছে। মাছগুলো সব কাদাপানিতে ছটফট করছে। ওকে দেখে মন্টু মামা হেসে ফেলে।
কি মামা, উইঠা পড়ছ?
হ। মামা, এহন কী মাছগুলান সব ধইরা ফেলবা?
, ধরুমই তো। মাছ ধরার লইগ্যাই তো এত কষ্ট কইরা পুকুর হিচা হইলো।
অয়ন পায়ে পায়ে পুকুরের জানের কাছে চলে আসে। জানের ওপাশের খালটা পানিতে ভরপুর। পুকুরের সব পানি খালে গিয়ে জমেছে। জানের বাঁধের উপরেই পড়ে আছে ঢুঁড়িটা। অয়ন খুব আগ্রহ নিয়ে দেখে ওটি। একটি তেলের টিনকে কোণাকুণিভাবে কেটে বাঁশ দিয়ে বেঁধে বানানো হয়েছে তিনকোণ বিশিষ্ট পানি সেঁচের এই পাত্রটি। ঢুঁড়িটির উপরে নিচে দুটি করে মোট চারটি রশি বেঁধে দেয়া হয়েছে। দু’জন লোক দু’হাতে দুটি রশি ধরে একদিক থেকে পানি তুলে অন্যদিকে ঢেলে দিয়ে পানি সেঁচার কাজটি সারে। কাল সকাল থেকেই মন্টু মামা লোকজন নিয়ে জানে বাঁধ দিয়ে পানি সেঁচার আয়োজন করছিলো। অয়ন অনেক রাত অবধি জেগে ছিল। সারারাতই থাকতে চেয়েছিল, মন্টু মামা বলেছিল রাতে পানি সেঁচার পর সকালে মাছ ধরা হবে। অয়ন মন্টু মামাকে খুব করে বলে রেখেছিলো সকালে ওকে তুলে দিতে।
পুকুরের মাঝে চোখ পড়তেই অয়ন দেখে ছমির, জগাই, বারেক আর কয়েকজনকে নিয়ে মন্টু মামা বড় বড় বাঁশের ঝুড়িসহ কাদাপানির মাঝখানে নেমে গেছে। সবাই মিলে মাছগুলো টপাটপ ঝুড়িতে তুলে ফেলছে। সব মাছ ধরে ঝুড়িগুলো উপরে তুলতেই অয়ন দেখে অনেক ধরনের মাছে প্রতিটি ঝুড়ি পরিপূর্ণ।
বশিরুল্লাহ পাটোয়ারীর বসার ঘরে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে খালেক তালুকদার। আতিকের সাথে প্রতিযোগিতায় দাঁড়াতে হলে পাটোয়ারীর সাহায্য তার খুব দরকার। তবে সে এটাও জানে যে বশিরুল্লাহ পাটোয়ারীর নিজের অবস্থানও বেশ নাজুক।
জনবিচ্ছিন্ন মানুষ কখনো সাধারণ মানুষের ভালোবাসা পায় না, বশিরুল্লাহ পাটোয়ারী তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। গত নির্বাচনে তাকে কোনো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি হতে হয়নি। অনেকটা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। বিগত সময়গুলোতে পাটোয়ারীকে তেমন করে পাশে পায়নি এলাকাবাসী। উন্নয়নের অভাবে আশেপাশের গ্রামগুলোর শোচনীয় অবস্থা দেখে সহজেই বোঝা যায় জনগণ থেকে তিনি কতটা বিচ্ছিন্ন। কিছুক্ষণ পর পাটোয়ারী বসার ঘরে প্রবেশ করেন।
কি খবর খালেক, পরিস্থিতি কেমন বুঝতাছো?
মিয়াভাই, খবর তো তেমন সুবিধার মনে হইতাছে না। সাঈদ খা এইবার অনেক প্ল্যান কইরাই মাঠে নামছে। চেয়ারম্যান পদে নিজে খাড়াইছে আর মেম্বর পদে প্রত্যেকটা ওয়ার্ডে বাইছা বাইছা তার পক্ষের লোকজন ফিট করছে। উজানপুর আর আমগো শ্যামলপুরের বেশির ভাগ মানুষ মনে হয় হেগো পক্ষেই যাইবো। এইবার জিতা সহজ অইবো না। আপনাগো এই দিগের অবস্থা কেমন?
আমগো ইন্দ্রকাঠিতে মানুষের সমর্থন পাওন যাইবো, কিন্তু খালি এক গ্রামের মানুষের ভোটে তো চেয়ারম্যান হওন যাইবো না। এই ওয়ার্ডে মেম্বর প্রার্থীগো মধ্যে হুনতাছি ওহাব জোয়ার্দারের অবস্থাই বেশি ভালো, সে তো সাঈদ খা’র পক্ষেরই লোক।
আমার অবস্থা তো আপনের চাইতেও খারাপ। আতিক তো আমার নিজ গ্রামেরই কেন্ডিডেট, তার উপর আমার আশেপাশে বেশির ভাগই হিন্দু পরিবার। হেরা কী আর আতিকরে রাইখ্যা আমারে ভোট দেবো?
তবুও, মাঠে যহন নামছি এহন পিছাইয়া আসনের তো উপায় নাই।
হেইডা তো ঠিক কতাই। এলাকায় ব্যাপক প্রচারণা চালাইতে অইবো। আমি বাদলরে কামে লাগাইয়া দিছি, দেহা যাক কী অয়।
আমারে পরিস্থিতি জানাইও।
আইচ্ছা। বলে পাটোয়ারীর ঘর থেকে বেরিয়ে এলো খালেক তালুকদার।
শ্যামলপুর মাদ্রাসায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আরবি পড়ছে। সামনের খোলা মাঠের উপর দিয়ে পৌষের হিম-হিম ঠা-া বাতাস এসে কাঁপিয়ে দিচ্ছে ওদের ভেতরটা পর্যন্ত। মাদ্রাসার ঘরটিতে বেড়া দেয়া হয়নি এখনো। মফিজ মিয়ার একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে মাদ্রাসার উন্নয়ন কাজে গ্রামের অন্য কেউ এগিয়ে আসেনি। সেইসাথে মনু মিয়াকে অপছন্দ করাও আরেকটা কারণ। খোলা মাদ্রাসায় বসে ছেলেমেয়েরা কাঁপতে কাঁপতে উচ্চস্বরে আমসিপারা পড়ছে আর মনু মিয়া মাঝখানে বসে সবকিছু লক্ষ করছে। অবশ্য আজ পড়ানোয় মন নেই তার। অনেকদিন ধরেই মনু মিয়ার মন ভালো নেই। বিভার ভিটাটা আর পাওয়া হলনা। মাঝখান থেকে গ্রামের মানুষের কাছে নিজের অবস্থানটা আরও খারাপ হয়ে গেল! সেদিন বিচারে সাত্তার মাস্টারের হুমকির কথা আজও ভুলতে পারেনি মনু মিয়া। এখন সে বুঝে গেছে ঐ ভিটা তাকে আর দেবে না মফিজ মিয়া। কয়েকদিন মফিজ মিয়ার সাথে এই বিষয়ে আলাপ করার জন্য গিয়েছে সে কিন্তু মফিজ মিয়া যেন বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকে। মনু মিয়া সবই বোঝে। কিন্তু তার কি-ই বা করার আছে? মফিজ মিয়ার সাহায্য ছাড়া সে এই গ্রামে টিকে থাকতে পারবে না। অবশ্য সে যেভাবে আছে এটাকে ভালো থাকা বলে না, কোনোরকম বেঁচে থাকা। তবে মফিজ মিয়ার দয়ার উপর কতদিন থাকা সম্ভব হবে সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।
ইদানীং মফিজ মিয়ার স্বাস্থ্য ভালো যাচ্ছে না। প্রায়ই অসুস্থ থাকে। কাশিটা খুব কষ্ট দিচ্ছে, তার উপর বাতের ব্যথাটাও বেড়েছে। শহরে যাওয়া হয়না বেশ কিছুদিন। ছেলেটাও যদি মানুষ হতো! বাপের কষ্টটা একটু বুঝত। জমিজমা থেকে যা আসে তাতে সংসারটা চলে যায়, তবুও বাড়তি আয়ের পথটা বন্ধ হলে সময়-অসময়ে প্রয়োজন মেটাতে জমি-জমা বিক্রি ছাড়া গত্যান্তর থাকে না। মেয়ে জামাইকে টাকা দিতে গিয়ে জমি বন্ধক দিতে হয়েছে। ছেলেটা লেখাপড়া করলো না, এখন কিছু করার জন্য টাকা চাচ্ছে। ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে ব্যবসার জন্য কিছু টাকার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। হয়ত বন্ধকী জমিটা বিক্রি করে সে প্রয়োজন মেটাতে হবে। এভাবে জমি বিক্রি করতে থাকলে একসময় তাকে পথে নামতে হবে। মফিজ মিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুয়ে পড়ে আবার।
আজ পাঁচদিন পর ঘরে ফিরলো সাজু। সামনের বারান্দায় বাবার কাশির শব্দ শুনে পেছনের দরজা দিয়ে চুপিসারে নিজের ঘরে ঢুকে পড়ে। এ ক’দিন বাইরে থেকে সে ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছে বাবার সাথে বাড়াবাড়ি করে লাভ নেই। বাবার সাহায্য ছাড়া সে কিছু করতে পারবে না। সাজু মনে মনে ঠিক করে, মাকে দিয়ে যেভাবেই হোক বাবাকে রাজি করাতে হবে। আপাকে দেবে না বলেও বাবা ঠিকই টাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সাজু পুকুরের কাছে এসে দেখে মা ঘাটে কাপড় ধোয়ায় ব্যস্ত। তাকে দেখে ঠিক আগের মতো খেঁকিয়ে উঠলো পেয়ারা বেগম।
এই যে নবাবজাদা, বাড়ি আইছেন তাইলে? বাইরে বেশিদিন ভাত জুটলো না?
সাজু কোনো কথা বলে না। জানে এই সময় কথা বললে মায়ের মেজাজ আরও বিগড়ে যাবে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে মায়ের রাগ কমে যাবার অপেক্ষায়। কিছুক্ষণ পর রাগ কমে এলে মায়ের কাছে এগিয়ে যায়।
মা, তুমি বাবারে কইয়া কিছু টাকার ব্যবস্থা কইরা দেও না?
তোর বাপে টাকা দেবো কোত্থেইক্যা? খালপাড়ের বটতলার ভিডা হারু গাজীর কাছে বন্ধক রাইখা টাকা দিছে শেফালির জামাইরে। এহন হের কাছে টাকা আছে?
দুলাভাইরে তো কতবারই টাকা দিলো, আমি কিছু করতে চাইলে দেয়া যাইবো না?
এহন কিছু কইতে পারুম না, আলাপ কইরা দেহি।
দেহি কইলে অইবো না, তুমি বাবারে বুঝাইয়া ব্যবস্থা কর। তুমি কইলে বাবায় হুনবো।
এহন আমারে কইতে কও ক্যান? হেদিন বাপের মুখে মুখে বাহাস করনের সময় মনে আছিলো না? এহন বাপের কাছে যাইয়া মাপ চাও, তারপর তার কাছে আবদার কর।
না, বাবার কাছে যাইতে ডর লাগে। তুমিই ব্যবস্থা কইরা দাও। তোমার যে গলার হারডা আমি বেইচা ফেলাইছিলাম, ব্যবসার প্রথম লাভ থেইক্যা অইডা গড়াইয়া দিমুনে।
আর দিছো! তোমরা আমগো লইগা যে কী করবা হেইডা বুঝা অইয়া গ্যাছে। পেয়ারা বেগম রান্নাঘরের দিকে হেঁটে যায়। সাজুও এগিয়ে চলে মায়ের পিছু পিছু।



 

দুপুরের খাবার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বাজারের দোকানের উদ্দেশ্যে বের হলেন হরিপদ ঘোষ। বাড়ির উঠোনের প্রান্তে আসতেই দেখেন খালেক তালুকদার তার দলবল নিয়ে তাদের বাড়ির ভিতরে এগিয়ে আসছে। হরিপদ ওখানেই দাঁড়িয়ে পড়লেন। খালেক তালুকদার কাছাকাছি এসে খুব বিনয়ের সঙ্গে বলে,
আদাব কাকা, কেমন আছেন?
ভালো। তোমরা সবাই আমার বাড়ি? কী ব্যাপার?
আমি এইবারও ভোটে খাড়াইছি। আপনের আশীর্বাদ নিতে আইলাম। আপনেরা হইলেন আমগো নিজেগো মানুষ, আপনেরা লগে না থাকলে তো গ্রামের কাম করতে পারুম না। কী কাকা, আমার লগে থাকবেন তো?
হরিপদ কী বলবেন ভেবে পান না। ভদ্রতার খাতিরে হলেও মনের সব কথা মুখের উপরে বলা যায় না। শেষমেশ বলেন,
এইডা তো খুব ভালো কতা। তুমি তো আগেও খাড়াইছো। গ্রামের উন্নয়ন করা তো খুব ভালো কাম। আশীর্বাদ করি অনেক উন্নতি হউক তোমার।
খালি আপনে একলা আশীর্বাদ করলেই অইবো না কাকা, আশেপাশের বাড়ির লোকজনরেও আপনের একটু কইতে হইব। খালেক তালুকদার বেশ জোর দিয়েই বলে।
ভোট তো হইল গিয়া নিজের স্বাধীন মতামত প্রদানের ব্যাপার, আমি কইলে কী লোকজন হুনবো?
আমি জানি এই এলাকার সবাই আপনেরে খুব মানে। আপনে কইলে হেরা হুনবো।
আইচ্ছা দেহি। কমুনে সবাইরে।
খালেক তালুকদার লোকজন নিয়ে চলে যায়। খালেকের পেছনে পেছনে বাজারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যান হরিপদ ঘোষ।
কিছুক্ষণ পর পেছনের জমি থেকে বাড়িতে এসে ঢোকে তারাপদ। বাবাকে দেখে মিটিমিটি হাসে চারু।
কীরে মা, হাসতাছোস ক্যান? মেয়েকে হাসতে দেখে জিজ্ঞেস করে তারাপদ।
বাবা, তুমি একটু আগে আইলে নাটকটা দেখতে পারতা। ফিক করে হেসে ফেলে চারু।
হেইডা কেমন?
জ্যাঠা তো খালেক তালুকদাররে আশীর্বাদ কইরা দিলো।
কি কস? তোর জ্যাডা খালেইক্যারে আশীর্বাদ করবো ক্যান?
চারুর দুষ্টুমি দেখে সুরবালা এগিয়ে এসে বলেÑ আরে দ্যাহো তো! মাইয়াডা বাপের লগে কেমন করতাছে! এইডা নিয়া এত হাসনের কী অইলো?
কী অইছে বৌদি? খুইলা কও তো।
আরে, খালেক তালুকদার ভোডে খাড়াইছে তো, তাই তোমগো লগে দ্যাহা করতে আইছিলো। তোমারে পায়নাই, তোমার দাদার লগে কতা কইছে। 
, তাইতো জ্যাঠা হেরে আশীর্বাদ কইরা দিলো। আবারো হাসে চারু।
বুঝছি। ওরা আমগো ভোট আশা করে ক্যামনে? মনে নাই একাত্তরে আমগো লগে কী আচরণ করছিলো? হেইকথা আমরা এহনও ভুলি নাই, খালি সুদিনের অপেক্ষায় আছিলাম। এহন হেইদিন আইতাছে। আমগো ভোট ওরা কোনোদিনও পাইবো না। কথাগুলো বলে নিজের ক্ষোভ ঝাড়ে তারাপদ।
ইদানীং মাস্টারসাহেবের উপর বেশ রাগ হয় সালমা বেগমের। সংসারের দিকে তার কোনো খেয়াল নেই। স্কুল, লাইব্রেরি আর এলাকার উন্নয়নের বাইরে তিনি যেন আর কিছুই বোঝেন না। সংসারের সকল ঝক্কি ঝামেলা বলতে গেলে একাই সামলান সালমা বেগম। সেইসাথে এখন যোগ হয়েছে ভোট। আরে! তিনি তো আর ভোটে দাঁড়ান নি, তবে কেনো এত ঝামেলা নিজের কাঁধে নিতে যাওয়া? বড় মেয়েটা শহরে চলে গেল কয়েকমাস হয়ে গেছে। একবার গিয়ে দায়িত্ব সেরেছেন। আর খবর নেয়ার যেন কোনো প্রয়োজন মনে করেন না তিনি। মেয়েটার অসুস্থতার খবর শুনে মনটা বড় উতলা হয়ে পড়েছে। কেমন আছে, কিভাবে আছে বড় জানতে ইচ্ছে করে।
নাস্তা শেষ করে বাজারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন সাত্তার মাস্টার। সালমা বেগমকে এগিয়ে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
কিছু বলবা?
কইছিলাম, আপনের এই ভোডের ঝামেলা শেষ অইবো কবে?
ক্যান, ভোট আবার তোমার কী ক্ষতি করলো?
আমি কবে থেইক্যা শিউলির খবর নিতে কইতাছি, হেইদিগে তো আপনের কোনো মনই নাই। খালি সারাদিন ব্যস্ত থাকেন ভোড নিয়া। হুনলাম মাইয়াডার অসুখ, কেমন আছে একবার জানার কী দরকার নাই?
ক্যান, কয়দিন আগেই তো অগো চিঠি পাইলা। অরা ভালো আছে, তোমার চিন্তার কিছু নাই।
খালি চিডি পাইয়া জানলেন তাইতেই সব শ্যাষ? একবার যাইয়া খোঁজ খবর নেওয়া উচিৎ না?
, তারও দরকার আছে। ভোটটা শ্যাষ অইলেই যামু।
দ্যাহেন। আপনে যা ভালো বোঝেন তাই তো করেন, আমার কতার কী কোনো দাম আছে?
এমন কইরা কইতাছো ক্যান? এ সংসারের সবকিছু তো তুমিই সামলাইতেছ। তোমার কথাতেই তো সবকিছু হয়। কয়ডা দিন সময় দেও, আমি নিজেই যামুনে। মাইয়া তো আমারও। তোমার মতো আমারও তো মন খারাপ লাগে।
সালমা বেগম আর কথা বাড়ান না। সাত্তার মাস্টার বাইরে চলে গেলে তিনিও বাড়ির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
আজ পরীক্ষার রেজাল্ট হবে। অয়নের ক্লাসের বন্ধুদের মধ্যে রেজাল্ট নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই। হাফ-ইয়ার্লী পরীক্ষায় অয়ন ফার্স্ট হয়েছিলো, সুবল সেকেন্ড। আজ সকালে স্কুলে আসবার সময় ওর মনে পড়েছে বড়দি চিঠিতে লিখেছিলো এবার ফার্স্ট হলে ওর জন্য পুরস্কার আছে। ও খুব গর্ব করে ছোটদিকে বলে এসেছে- দেহিস, এইবারও আমি ফার্স্ট হমু।
ওদের ক্লাস টিচার জগানন্দ বসু আজ কয়েকদিন ধরে অসুস্থ। ইসমাইল স্যারকে ক্লাসরুমের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে অনেকেই ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আছে। অয়নের কখনো ইসমাইল স্যারকে ভয় লাগেনি। এসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে ছাত্রছাত্রীদের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে স্যার যখন জাতীয় সংগীত গান তখন খুব মায়া লাগে ওর। এই সময় অনেকদিন অয়ন স্যারের চোখ ভেজা দেখেছে।
ইসমাইল স্যার ক্লাসে ঢুকতেই সবাই উঠে দাঁড়ায়। স্যারের হাতে বেত না দেখে অনেকের মন থেকে ভয় কেটে গেছে।
তোমরা সবাই কেমন আছ?  
ভালো স্যার। সবাই সমস্বরে জবাব দেয়।
আজ তো পরীক্ষার ফলাফল দেয়া হবে। সবাই নতুন ক্লাসে উঠবে। আরও ভালোভাবে পড়ালেখা করবে, যাতে সবাই মানুষের মতো মানুষ হতে পারো।
ইসমাইল স্যার হাতে রেজাল্ট শীট নিয়ে যারা পাশ করেছে একে একে তাদের নাম বলে যান। অয়ন অপেক্ষা করতে থাকে কখন স্যার ফার্স্ট-সেকেন্ড-থার্ড ঘোষণা করবেন। কিছুক্ষণ পরই আসে সেই কাক্সিক্ষত ক্ষণ। প্রথম হয়েছে বলে ইসমাইল স্যার যখন অয়নের দিকে তাকায়, ওর চোখে তখন ভেসে ওঠে বড়দির হাসিখুশি মুখ।
প্রায় দেড় মাস পর বাড়ি ফিরছে শ্যামল। বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান শেষে সেই যে ফিরে গিয়েছিল শহরে, আর ফুসরত মেলেনি গ্রামে আসার। কলাবতী বাজারের আগে বিজয় পুলের মোড়ে রিকশা থামিয়ে নেমে পড়ল। এখান থেকে একটা কাঁচা রাস্তা একেবেঁকে শ্যামলপুর হাইস্কুলের সামনে দিয়ে গ্রামের ভিতরে ঢুকে পড়েছে। গ্রামের ধুলোবালি মেখে বড় হয়ে ওঠা শ্যামলের কাছে এই রাস্তাটার একটা বিশেষ গুরুত্ব আছে। এখানকার প্রতিটা বাঁকে ছড়িয়ে আছে ওর শৈশবের স্মৃতি। তপ্ত দুপুরে মধ্য আকাশ ছাড়িয়ে যাওয়া গনগনে সূর্যটা তখনো রোদের তেজ ছড়াতে ব্যস্ত। গাছগাছালি ঘেরা চিরচেনা পথ ধরে বাড়ির দিকে এগিয়ে চলেছে শ্যামল। এই মুহূর্তে আশপাশটা বেশ ফাঁকা। রমেন সাহার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। হঠাৎ দৃষ্টি পড়ে পুকুরপাড়ে ডালপালা ছড়ানো রেইনট্রির ছায়ায় বসে আমোদে মশগুল সাহা বাড়ির উচ্ছ্বল তরুণ-তরুণী দলটার দিকে। দিনের এই সময়টায় মাঝে মধ্যেই এখানে বিশ্রাম নেয় ওরা। বিশাল রেইনট্রি মাথার উপরে ছায়া দিয়ে যায় অকৃপণভাবে। গাছের নিচে সবুজ ঘাসের গালিচায় বসে ওরা এমন আমোদে মেতে ওঠে প্রায়ই। বাড়ির পেছনের দক্ষিণ দিকটা খোলা। দিগন্ত বিস্তৃত ফসলী জমির উপর দিয়ে চমৎকার ফুরফুরে হাওয়া খেলে যায়। শ্যামলের হাঁটার গতি কমে আসে। তার উৎসুক দু’টি চোখ দলটির মাঝে খুঁজে ফেরে একটি চেনা মুখ। একঝাঁক তরুণীর মাঝে কাক্সিক্ষত মুখটি দেখতে না পেয়ে ঘুরে সামনের দিকে তাকাতেই মুখে হাসি ফুটে ওঠে। ওর ঠিক উল্টোদিক থেকে খালের পাড়ের রাস্তা ধরে এদিকেই আসছে শিখা। ওখানেই দাঁড়িয়ে পড়ে শ্যামল। হঠাৎ শ্যামলকে সামনে দেখে অবাক হয়ে যায় শিখা; এ যেন অপ্রাত্যাশিত প্রাপ্তি! শিখা কাছে আসলে শ্যামল বলে,
ক্যামন আছোস?
ভালো। তুমি হঠাৎ
তোরে কইছিলাম না সেমিস্টারটা শেষ হইলেই আমি বাড়ি চইলা আসুম! এইদিকে কই গেছিলি?
তোমগো বাড়ি থেইক্যাই তো আইলাম। 
কার খোঁজে গেছিলি রে? শ্যামলের মুখে দুষ্টুমির হাসি।
ইঙ্গিতটি বুঝতে পারে শিখা। সাথে সাথেই হেসে জবাব দেয়- কারো খোঁজে যাইতে অইবো ক্যান?
না, মানে আমি ভাবলাম বিশেষ কারো খোঁজে গেছিলি কিনা।
ক্যান, ও বাড়িতে কী বিশেষ একজন ছাড়া আর কেউ নাই? সারা বছর যেন কেউ একজন আমার লইগ্যা অপেক্ষা করে? সে কী জানে না ও বাড়িতে আমি যহন ইচ্ছা যাইতে পারি।
, তা তো জানি! তুই ঐ বাড়িরই একজন।
কিন্তু, আমি তো অনেকক্ষণ ধইরা দেখতেছিলাম তুমি এইহানে খাড়াইয়া কী যেন খোঁজাখুঁজি করতাছিলা। মনে মনে ভাবতাছিলাম ভিনপুরুষ ভেতর বাড়িতে মেয়েছেলেদের আসরে উঁকি-ঝুকি মারে ক্যান?
খুব পাকছোস না? বেকায়দায় পড়ে শ্যামল জবাব দেয়।
শ্যামলের অবস্থা দেখে হেসে ফেলে শিখা।
পড়ন্ত দুপুরের উজ্জ্বল আলো শিখার গালে এসে পড়েছে। শ্যামল মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। শুধুমাত্র এ-জন্যই ঢাকায় বসে তার প্রাণ আনচান করে। এমন লাবণ্যতা, এমন মায়াময় চাহনি শিখা ছাড়া আর কার মধ্যে পাবে শ্যামল? তাইতো এই পাহাড়ি ঝর্ণাধারার মতো কলকল হাসির শব্দ শোনার জন্য এমন উতলা হয়ে থাকে। অনেকদিন পর সাগরের স্বচ্ছ জলের মতো দু’টি চোখের মাঝে হারিয়ে যায় শ্যামল।
শ্যামলের দিকে চোখ পড়তেই হঠাৎ খুব লজ্জা পায় শিখা। চোখ নামিয়ে নেয়। তারপর বলে,
কী দ্যাখছো?
হাসলে তোরে অনেক সুন্দর লাগে।
এই নিয়া কতবার কইলা?
শ্যামল হেসে বলে- হিসাব নাই। তয় যখনই দেখি আমি আর নিজের মধ্যে থাকতে পারি না।
ক্যান? কই যাও তুমি? শিখা হাসতে হাসতেই বলে।
তুই বুঝস না? তোর ঐ চোখ দুইটার মধ্যে হারাই।
বুঝছি, তোমারে ডাক্তার দেহাইতে অইবো।
ডাক্তার লাগবো না, এই রোগের ওষুধ আমি জানি।
তাইলে চিকিৎসা করাও না ক্যান?
করামু। একটু সময় নিতাছি। রোগটা আগে ভালো কইরা বুকে বাসা বানাক।
দ্যাহো, ততদিনে রোগ আবার অন্যদিকে মোড় নেয় কিনা!
না, অন্যদিকে মোড় নেওনের আগেই প্রতিশেধক দেওয়ার ব্যবস্থা করুম।
হঠাৎ বাড়ির দিকে দৃষ্টি পড়তেই শিখা দেখে- রেইন্ট্রির নিচ থেকে কয়েকটি উৎসুক চোখ সোজা তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। শিখা তাড়াতাড়ি বলে ওঠে,
সবাই দ্যাখতাছে, আমি এহন যাই।
আচ্ছা, বিকালে আসিস।
শিখা হাসে। সেই হাসিতে সম্মতির ইঙ্গিত লক্ষ করে শ্যামল বলে,
আমি আইজ কোত্থাও যামু না। শুধু তোর জন্য অপেক্ষা করুম।
শিখা শ্যামলের চোখের দিকে একবার তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নেয়। তারপর মৃদু হেসে বাড়ির দিকে এগিয়ে চলে। শ্যামল আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পা বাড়ায় কোটাখালী ব্রিজের দিকে।



 

আজ সকাল থেকেই কিছুটা অস্থির অয়ন। বাবা বাজারে চলে যেতেই উঠানে নেমে এলো। বাড়ির প্রবেশমুখে মিরাজকে ঢুকতে দেখে একছুটে চলে এলো রাস্তার মাথায়। মিরাজের সাথে সুবলও দাঁড়িয়ে আছে।
তাড়াতাড়ি ল, দাদারা এহনই বাইর হইয়া যাইবো। অয়নকে দেখেই তাড়া দেয় সুবল।
তিনজনে মিলে দৌড়ায় সুবলদের বাড়ির দিকে। আজ ওদের রজনীকান্তর দীঘিতে যাওয়ার কথা। শ্যামলদা আর তাপসদা আজ পাখি শিকারে যাবে। অয়ন শুনেছে দীঘির পাড়ের ছনের বন আর পাশের জঙ্গলে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি আসে আর কচুরিপানার মধ্যে বাসা বেঁধেছে অনেক ডাহুক।
সুবলদের বাড়িতে পৌঁছে দেখে শ্যামল আর তাপস তৈরি হয়ে আছে। শিকারের সরঞ্জামগুলো একে একে সব উঠোনে এনে জড়ো করেছে। পাখি শিকারের জন্য ওদের বড় দলটাকে দেখে চারু অনেকটা ঠাট্টাচ্ছলে বলে ওঠে,
বড়দা, আমি মসলা বাইট্যা রাখুম?
আরে আগে ফিরা আসি, তারপর করিস। তুই সকাল থেইক্যাই আমগো পেছনে লাগছস ক্যান রে বুচি? শ্যামল বলে।
আমি আবার তোমগো পেছনে লাগলাম কই? এতবড় দল নিয়া পাখি শিকারে যাইতেছো, আইজক্যা তো আমগো বাড়িতে বিশাল ভোজের আয়োজন অইবো মনে অয়। আমি তো ভাবতাছিলাম শিখাদিরেও দাওয়াত দিমু। চারু মুচকি হাসে।
সবার সামনে শিখার নামটা আসায় শ্যামল কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে। চারুকে বলে,
বেশী পাইক্যা গ্যাছোস, মাইর দিমু তোরে? ধমকের সুরে তেমন জোর নেই বরং চেহারা থেকে লজ্জার ছাপ ঢাকতে পারে না শ্যামল। চারু যেন আরও পেয়ে বসে।
বারে! আমি কী খারাপ কিছু কইছি? শিখাদি তো আমগো নিজেগো মানুষের মতোই। আইজক্যার এই আয়োজনে ও থাকলে আমগো আনন্দটা আরও বাইড়া যাইতো।
শ্যামল বুঝে এই পাগলীকে ক্ষেপিয়ে কোনো লাভ নেই। তাতে বরং ও আরও বেশি পেয়ে বসবে। বেরিয়ে পড়বার জন্য সবাইকে তাড়া দেয়। তাপস এয়ারগানটা পরিষ্কার করতে করতে ঘর থেকে নেমে এলে ওরা সবাই বেরিয়ে পড়ে শিকারের উদ্দেশ্যে।
শ্যামল এয়ারগানটি হাতে নিয়ে আগে আগে এগিয়ে চলেছে। পেছনে পেছনে যাচ্ছে তাপস, গোপাল, অয়ন, সুবল আর মিরাজ। তাপসের হাতে অনেকগুলো সরু বাঁশ। একটি বাঁশের সরু অংশে লোহার সূচালো ফলা সংযুক্ত করা। রমেন সাহার বাড়ির মুখে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে দলটি। সুবলকে উদ্দেশ্য করে শ্যামল বলে- ‘এই সবু, যা তপনরে ডাইকা নিয়া আয় তো’। সুবল ভিতরে চলে যায়। বাড়ির সম্মুখে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার সময় নিজের অজান্তেই শ্যামলের দৃষ্টি চলে যায় ভেতর বাড়ির দিকে। উদগ্রীব দু’চোখ যেন খুঁজে ফেরে কাউকে।
তপন ওদের সাথে যোগ দিলে দলটি আরও ভারী হয়। সবার আগে আগে ছুটছে অয়ন, সুবল আর মিরাজ। একটু সামনে এগোতেই হঠাৎ শিখাকে চোখে পড়ে শ্যামলের। বাড়ির পাশের ছোট্ট ভিটেয় অন্যান্য মেয়েদের সাথে শাক তুলছে। একসাথে অনেক মানুষের পদশব্দ শুনে রাস্তার দিকে ফিরে তাকায় শিখা। দু’জনের চোখাচোখি হতেই দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। শিকারি দলটি পূর্বদিকের রাস্তা ধরে এগিয়ে চলে রজনীকান্তর দীঘির দিকে।
বাবার মুখে কয়েকবার রজনীকান্তর দীঘির নাম শুনেছে অয়ন। তবে এদিকটায় আসেনি কখনো। কোটাখালী খালের এপারে শুধুমাত্র সুবলদের বাড়িতেই যাওয়া হয়েছে ওর। অয়ন, সুবল আর মিরাজ- ওদের প্রত্যেকের হাতে একটি করে গুলতি। সুবল তাপসদাকে দিয়ে তিনজনের জন্যই কাল বানিয়ে রেখেছিলো। মাটির গুলি বানিয়ে আগুনে পুড়িয়ে রেখেছিল গুলতিতে ব্যবহারের জন্য। সকালে অয়নকে দেখিয়ে দিয়েছে বামহাতে তিনকোণ বিশিষ্ট গাছের ডালটিকে শক্ত করে ধরে ডানহাত দিয়ে রাবারটির মধ্যে গুলি নিয়ে কিভাবে এটা ব্যবহার করতে হয়। অয়ন কয়েকবার প্রাকটিস করতেই শিখে গেছে।
অল্পক্ষণের মধ্যেই শিকারী দলটি দীঘির কাছে পৌঁছে যায়। সবুজে ঘেরা চমৎকার জায়গাটা দেখে মুগ্ধ হয় অয়ন। বিশাল দীঘি, ঘন কচুরিপানায় ঢেকে আছে। দীঘির তিনদিক আকাশ ছোঁয়া ঘন জঙ্গলে ঘেরা, একদিক খোলা।
একসময় রজনীকান্ত সেন নামে একটি বনেদী পরিবারের বসবাস ছিল এখানটায়। দেশভাগের সময় তারা এই অঞ্চল ত্যাগ করে ভারতে পাড়ি জমায়। তাদের কাছ থেকে এই এস্টেটের পুরো জমি হরিপদর বাবা বিষ্ণুপদ ঘোষ আর ব্রজেন সাহা মিলে কিনে রেখেছিল। বর্তমানে জায়গাটার মালিক হরিপদ ঘোষ আর রমেন সাহার পরিবার।
ওরা দীঘির পাড়ে একটা খোলা জায়গায় এসে দাঁড়ায়। তাপস ওদের তিনজনকে বলে,
বাগানের মধ্যে পাখি ধরার সময় কথা কইবি না, শব্দও করবি না। 
তিনজনেই ঘাড় কাত করে সায় জানায়। সুবল অয়নকে ইশারা করে দেখায় দীঘির ওপারে ঘন ছনের বনের পাশে কিছুটা খোলা জায়গা, সেখানে চড়ে বেড়াচ্ছে কয়েকটা সাদা বক। শ্যামলদার দিকে তাকিয়ে বুঝে যায় ওরাও দেখেছে। ছোট ছোট গুল্মলতা আর ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়েই সরু একটা মেঠোপথ বাগানের ভিতরে চলে গেছে। তাপস আর গোপাল সাথে আনা বাঁশগুলো হাতে নিয়ে বাগানের দিকে এগিয়ে যায়। সুবলরাও ওদের পিছু পিছু ঢুকে পড়ে। পথের মাঝে পড়ে থাকা শুকনো পাতার উপর পা পড়লেই মচমচ করে শব্দ হয়। অয়নরা সেই শুকনো পাতা এড়িয়ে দু’পাশের ঝোপের ডালপালা সরিয়ে নিঃশব্দে হাঁটার চেষ্টা করে। কিছুক্ষণ এয়ারগান নিয়ে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকার পর শ্যামল আর তপনও ওদের পিছু নেয়। তাপস আর গোপালের দৃষ্টি উপর দিকে। একটু পরপরই গাছের পাতার ফাঁক গলে উপরে তাকিয়ে খোঁজাখুঁজি করে; তারপর আবার সামনে এগিয়ে চলে। নিঃশব্দে।
এই বাগানটি বেশ ঘন। ছোট বড় বিভিন্ন জাতের গাছ-গাছালিতে ভরা। নানা রকমের ফলের গাছ যেমন আছে, তেমনি ফল বিহীন গাছের সংখ্যাও কম নয়। কেনার পর থেকে হরিপদ কিংবা রমেন সাহাকে নতুন করে কোনো গাছ লাগাতে হয়নি। কবে কারা এই গাছ লাগিয়েছিলো তাও জানা নেই। হয়ত রজনীকান্ত সেনের কোন পূর্বপুরুষের হাতে প্রথম রোপন করা হয়েছিল। এখন এমনি এমনিই হয়। নানান ধরনের প্রচুর ফল জন্মে এই বাগানে। বেশিরভাগ ফলের ভোগদখলকারী বাগানের পশু-পাখিরাই। বাড়ি থেকে অনেক দূরে হওয়ায় বাগানের মালিকরা কালেভদ্রে আসে এদিকে। পশুপাখিদের খাওয়ার পর বাকীগুলো মাটিতেই পড়ে থাকে। ওখান থেকেই নতুন গাছ জন্মায়। কখনো কখনো পাখিরা মুখে করে ফল নিয়ে ফেলে অন্যত্র, সেখানেই হয়ত গজিয়ে ওঠে নতুন চারা। এভাবেই বাগানটি কালক্রমে ঘন হয়ে উঠেছে।
ওরা বাগানের বেশ ভিতরে চেলে এসেছে। হঠাৎ বড় একটা আমগাছের নিচে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে তাপস। ইশারায় অয়নদের কিছুটা দূরে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে। তাপস গোপালের কাছ থেকে লোহার ফলাযুক্ত বাঁশের টুকরাটি নিয়ে উঁচু করে উপরের দিকে তোলে। তারপর আরেকটা নিয়ে সেটার গোড়ায় লাগিয়ে নিঃশব্দে গাছের পাতার ফাঁক গলে আরও উপরে উঠিয়ে দেয়। তারপর আরেকটা, আরেকটা...। অয়নরা গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখে তাপসের কাজ। কিছুক্ষণ পরই তাপস হাতে ধরা বাঁশটা দিয়ে খুব জোরে উপরের দিকে খোঁচা দেয়। শ্যামল জিজ্ঞেস করে, কী রে কাম অইছে? তাপসের মুখে হাসি। হ, এক্কেবারে গাইত্থা গেছে। একটা একটা করে বাঁশের টুকরা খুলতে থাকে। যখন শেষটা নামানো হলো অয়ন অবাক হয়ে দেখে ওটার মাথায় গাঁথা একটা মাঝারি আকারের ধূসর রঙের পাখি, সারা গায়ে ডোরাকাটা দাগ।  
শুরুটা ভালোই অইলো। তপন বলে ওঠে।
এই জঙ্গলে প্রচুর পাখি, ধৈর্য ধরে শিকার করলে অনেক পাওয়া যাইব। শ্যামল বলে।
বড় বড় গাছপালা, গুল্মলতা আর ছোটবড় ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ এই ঘন জঙ্গল নানান প্রজাতির পাখপাখালির লীলাভূমি। দীঘি আর বাগানের অভায়ারণ্যে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায় হরিয়াল, পানকৌড়ি, ঘুঘু, হট্টিটি, মাছরাঙা, কালিম, কুড়া, অক, দোয়েল, ইষ্টিকুটুম, কোকিল, বুলবুলি, টুনটুনি, চড়ুই, ফিঙ্গে, কাঠ-ঠোকরার মতো আরও নাম না জানা কত পাখি! জঙ্গলের পাশঘেষে ছনের বনে, বিশাল দীঘির জলে আর কচুরিপানার আড়ালে একটু খুঁজলেই মেলে বিভিন্ন জাতের বক, সারস কিংবা ডাহুক।
সবাই মিলে বনের আরও গভীরে ঢুকে পড়ে। প্রতিবার পাখি ধরার সময় সুবলদের উচ্ছ্বাসের মাত্রাটা যেন আরও বেড়ে যায়। বাগানের মধ্যে অনেকক্ষণ ধরে ঘুরে বেড়ায় শিকারি দলটি। অয়ন, সুবল আর মিরাজের হাতে ঝুলতে দেখা যায় রং বেরঙের বেশকিছু পাখি। ঘন জঙ্গল থেকে দীঘিরপাড়ের খোলা জায়গায় বেরিয়ে আসে দলটি। কচুরিপানার মধ্যে থেকে চির-পরিচিত ডাহুকের একটানা কোয়াক কোয়াক ডাক কানে আসে শ্যামলের। ’অইডা কীসের ডাক?’ সুবল বলে উঠতেই আঙ্গুলের ইশারায় চুপ থাকতে বলে শ্যামল। তাপস আর গোপাল ডাহুকের ডাক অনুসরণ করে তীরের মতো ফলাযুক্ত লম্বা বাঁশটি নিয়ে এগিয়ে যায় দীঘিরপাড়ের ছোট ঝোপটার দিকে। কিছুক্ষণ পর ওরা যখন ফিরে আসে, অয়ন দেখে তাপসদার হাতে ঝুলছে একটি মৃত ডাহুক। ডাহুকটি দেখে অয়নের খুব খারাপ লাগে, ও সুবলকে বলে- ঈশ! পাখিডা কী সুন্দর! মাইরা ফালাইলো?
শ্যামল এয়ারগান নিয়ে ছনক্ষেতের দিকে এগিয়ে যায়। ক্ষেতের পাশের খোলা জায়গায় কিছু বক অলসভাবে ঘোরাফেরা করছে। সুবলরা ওদিকে যেতে চাইলে তাপস হাতের ইশারায় নিষেধ করে। একটু পরই এয়ারগান থেকে গুলির শব্দ ভেসে আসে। অয়ন দেখতে পায় গুলির শব্দে খোলা জমিতে ঘুরে বেড়ানো বকগুলো উড়ে গিয়ে পাশের উঁচু গাছের ডালে বসে। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর আবার গাছের ডালে নিশানা করে শ্যামল। ‘গুড়ুম!’ অয়নরা ছুটে যায় ছন ক্ষেতের দিকে। দেখে দু’টো ধবধবে সাদা বক শুয়ে পড়া সবুজ ছন ক্ষেতের উপরে ছটফট করছে। আরও কিছুক্ষণ শিকারের পর ওরা যখন বাড়ির পথে ফিরে চলে প্রত্যেকের হাতেই ঝুলতে থাকে শিকার করা পাখির ঝাঁক। 



 

দিনগুলো যেন সব উড়ে চলে যায়।
অয়ন, সুবল আর মিরাজের বেশির ভাগ সময় কাটে গাঁয়ের মাঠে-পথে-প্রান্তরে। ওরা ছোটে; সবুজ শ্যামল মেঠোপথ ধরে ছুটে চলে। কখনো কোটাখালীর পাড়ে আবার কখনোবা উজানগাঙের তীরে।
শেষ বিকেলে কিছুতেই ঘরে মন বসে না অয়নের। দুপুরের পর সূর্যটা যখন পশ্চিম আকাশের অনেক নিচে নেমে আসে, সুবল আর মিরাজ এসে ওর শোবার ঘরের জানালা দিয়ে খুব আস্তে করে ডাক দেয়। ও তখন চুপিসারে ঘর থেকে বের হয়।
কোটাখালী ব্রিজের একটু আগে রাস্তার উপরে যে বড় জামগাছটা, ওর বিশ্বাস ওটার উপরে ও কোনোদিনও উঠতে পারবে না। অথচ সুবল এখনই মাটি থেকে একটু উঁচুতে বড় ডালটিতে উঠতে পারে। বর্ষাকালে এই গাছের মগডালে টসটসে কালোজামগুলো ওকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে। ওরা গাছে উঠে পাড়তে পারে না, তখন সুবল রাস্তার পাশ থেকে বড় বড় মাটির চাকা নিয়ে ছুড়ে মারে উপরে। কয়েকবারের প্রচেষ্টায় পাকা জামও পেয়ে যায়, তখন তিনজনে মেতে ওঠে নির্মল আনন্দে।
বিকেলে রোদের তেজ কমে এলে তিনজনে তেমাথার পুলের কাছে এসে দাঁড়ায়। নদীর ওপারে চরে কাশের বন ছাড়িয়ে বহু দূরের গ্রামটা ওদের হাতছানি দেয়।
প্রতিদিনের মতো আজও মিরাজ চুপচাপ। এখানে এলে ও যেন কেমন হয়ে যায়। অয়ন জিজ্ঞেস করে,
বাড়ির লইগ্যা খারাপ লাগতাছে মিরাজ?
নাহ! এহন আর খারাপ লাগে না।
তোর বাড়ি যাইতে মন চায় না?
আগে মাঝে মধ্যে মনডা বড় উচাটান হইতো, এহন আর অয় না। কার লইগ্যা খারাপ লাগবো, অইহানে কেডা আছে আমার? এক ফুফু আছিল, হেয়ও মইরা গ্যালো।
ক্যান, তোর বাপ? সুবল জিজ্ঞেস করে।
একটা কতা আছে না, মা মইরা গ্যালে বাপ হয় তালুই? আমার মা মরার আগেই বাপ তালুই অইছে। আমার থেইক্যা ঐহানে হের আপন লোক আছে।
ইস! দেখ, নদীর পানিডা কী পরিষ্কার! এক্কেরে টলটল করতাছে। হঠাৎ অয়ন কথা ঘুরিয়ে দেয়। ও জানে, বাবার কথা বলতে ভালো লাগে না মিরাজের।
, জোয়ার আইছে। দেহস না, নদী কেমন ভরা! আমার এই নদীতে নাও বাইতে ইচ্ছা করতাছে। সুবল বলে।
তোর অনেক বেশি সাহস। এইডা তোমগো বাড়ির পাশের বিল না। এইহানে পানির অনেক টান আছে, বড় বড় ঢেউ ওডে। অয়ন বলে।
তুই যাই কস অনু আমি একদিন এই নদীতে নাও বামু। তুই দেহিস! সুবলের কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস।
অয়ন তোর এই নদী দেইখ্যাই ডর লাগে, তাইলে ঠোডায় বড় নদীর কাছে গ্যালে কী করবি?
ক্যান? ঐডা কী আরও বড়?
অনেক বড়; আমারই ডর লাগে। তয় আমার কাছে আমগো এই নদীডাই বেশি ভালো লাগে। জানস, চান্নি রাইতে নদীডার চেহারা এক্কেবারে বদলাইয়া যায়। মিরাজ বলে।
হেইডা কেমন? অয়ন জানতে চায়।
পানিতে চান্দের আলো পইড়া নদীডা ঝলমল করতে থাহে। আমি ছালাম দাদার লগে কাইল রাইতে নদীর পাড়ে আইছিলাম। কী সুন্দর লাগতেছিল! কলাবতী বাজার থেইক্যা এক্কেবারে গৌরীপাশা পর্যন্ত যতদূর দেহা যাইতেছিল, নদীডা এক্কেবারে ঝলমল করতেছিল। আমার কী যে ভালো লাগতেছিল! তোরা আইজ রাইতে আইবি? তাইলে দেখতে পারবি।
আমারে এত রাইতে বাড়ি থেইক্যা বাইর অইতে দেবো না। অয়ন বলে।
আমারেও না। আর, আমগো বাড়ি থেইক্যা নদী তো আরও দূর!
তোরা না আইলেও আমি আমু। আর দুইদিন পরই অমাবস্যা আরাম্ভ অইয়া যাইবো। তহন আর দেখতে পারবি না।
এমনি করেই একেকটা দিন কেটে যায় অয়ন-সুবল-মিরাজের। বিষণœ সন্ধ্যার ঠিক আগের উদাসী গোধূলি বেলায় অয়নের মনের ভেতরটা কেমন হু-হু করে ওঠে। উজানগাঙের পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখে টকটকে লাল সূর্যটা কেমন টুপ করে হারিয়ে যায় নদীর ওপারের গাছগুলোর আড়ালে। ধীরে ধীরে অন্ধকারে ঢেকে যায় চারিদিক।
নির্বাচনের শেষ দিনের প্রচারণায় ব্যস্ত সবাই। বাজারের সর্বত্র প্রার্থীদের পোস্টারে ছেয়ে গেছে। পৌঁছে গেছে গ্রামের ঘরে ঘরেও। বিগত বছরগুলোতে যারা ছিল নির্বাচন বিমুখ, এ বছর তাদের মধ্যেও বেশ উত্তেজনা লক্ষ করা যাচ্ছে। সাঈদ খান আর আতিকের জন্য প্রচারণার কাজে ক্লাবের ছেলেগুলোর ব্যস্ততা এখন কমে গেছে অনেকটা। এ ক’দিন খুব পরিশ্রম গেছে ওদের উপর দিয়ে। ইউনিয়নের প্রতিটা ঘরে ঘরে ছুটে বেড়িয়েছে, মানুষকে ভোটের জন্য আহবান জানিয়েছে। সারা গাঁয়ে পোস্টার লাগানো, বিভিন্ন সভার আয়োজন করা- এগুলো সবই করেছে ওরা। সাত্তার মাস্টার, হামিদ শেখ, জগানন্দ, ইসমাইল মোল্লা ও অন্যান্যরা ওদেরকে উৎসাহ যুগিয়েছে পুরোটা সময়। বলেছে- তোদের এখন থেকেই তৈরি হতে হবে, কারণ তোরাই হবি দেশের আগামী দিনের কর্ণধার।
হারু-খালেক-সামসু এই তিনজনের মধ্যে খালেকের মনে কিছুটা আশার বাতি এখনো টিমটিম করে জ্বলছে। হারু গাজীর কাছ থেকে নির্বাচনী খরচের জন্য তেমন সাড়া না পেয়ে শামসু খন্দকারের প্রচারণায় ভাটা পড়েছে আরও আগে। সে ইতিমধ্যেই বুঝে গিয়েছে নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা এখন অর্থহীন। হারু গাজীর মধ্যেও আগের সেই উৎসাহ নেই। খালেককে ঠেকানোর উদ্দেশ্যেই সে মূলত নির্বাচনে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এখন সে নিশ্চিন্ত। আতিকের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে খালেকের জেতার কোন সম্ভাবনা নেই।
বাদল ওদের এলাকায় হিন্দু ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। উপরন্তু তারাপদ স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছে, একাত্তরে তালুকদারগো অত্যাচারের কথা আমরা এহনও ভুলি নাই। তারা আমগো ভোট আশা করে ক্যামনে? স্পষ্টতই নিজেদের এলাকায় পিছিয়ে পড়েছে খালেক গ্রুপ। উজানপুর সাঈদ খানের দখলে। রাতটুকু পার হলেই অগ্নিপরীক্ষা!
আজ ভোট। বিগত কয়েকদিনের জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটবে আজই। সকাল থেকেই মানুষের মধ্যে ভোট নিয়ে বিপুল উত্তেজনা বিরাজ করছে। এই ওয়ার্ডে উজানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শ্যামলপুর হাইস্কুল আর সুবর্ণপুর প্রথমিক বিদ্যালয়ের ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোট গ্রহণের সমস্তপ্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। গৌরীপাশা, চন্দ্রপাশা, ইন্দ্রকাঠী, আলীপুর, কমলডাঙ্গাসহ বাকী কেন্দ্রগুলোতেও ভোটের প্রস্তুতি শেষ। 
উত্তেজনা আর টেনশনে দিনের শুরু খালেক তালুকদারের। সকাল সকাল বাদলকে নিয়ে সে স্কুলের উদ্দেশ্যে বের হয়।
সব লোকজন আইছে তো? বাদলকে জিজ্ঞেস করে।
আইছে, খালপাড়ের হাটখোলাতে বইসা আছে। ক্যান অগো কোন কামে লাগবো?
, কামে লাগবো না! প্রথমে ওগো ভোট দিতে ক’। তারপর তিনভাগ কইরা তিন কেন্দ্রে পাঠা। আর আমগো বাড়ির সবাইরেও সজাগ থাকতে কইবি। ভালো কইরা ক্লাবের পোলাপাইনগুলার দিকে নজর রাখতে কইবি।
আইচ্ছা ঠিক আছে, তুমি কোনো চিন্তা কইরো না। আমি লোকজন সবদিকেই ফিট করতাছি। তুমি কী অগো কিছু করতে কও?
কী করবো?
ভোটকেন্দ্রে ঢুইক্যা কিছু করনের চেষ্টা করা আর কি।
আরে, না না! এইবার হেইডা সম্ভব অইবো না। আমি খবর নিছি সাঈদ খা, সাত্তার মাস্টার, ইসমাইল মোল্লা, হামিদ মিয়া, ক্লাবের পোলাপাইনগুলা সজাগ থাকবো। সব কেন্দ্রেই ওরা পাহারা বসাইবো।
দু’জনে তালুকদারের হাটখোলার কাছে চলে আসে। খালপাড়ের ঘরেই পাওয়া গেল মনা, চুন্নু, কাসেম, জব্বার, কালু আর রইসকে। ওদের সবাইকে নিয়ে ভোটকেন্দ্রের দিকে এগিয়ে চলে খালেক তালুকদার। যাবার পথে বাদল সবাইকে যার যার কাজ বুঝিয়ে দেয়, সেইসাথে প্রত্যেককেই হাতখরচও।
আজ সকালে একটু তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছে অয়ন। মিরাজ আর সুবলকে বলে রেখেছে আজ ওরা একসাথে ভোট দেখতে যাবে। ওদের স্কুলেই ভোট হবে। সকালে উঠে মাকে বলে,
মা, তাড়াতাড়ি খাওন দেও। আমি খাইয়া স্কুলে যামু
আইজ তো স্কুল নাই বাজান, আইজ তো ভোট অইবো।
আমি জানি তো আইজ ভোট। আমি তো ভোট দেখতেই যামু। মা, বাবা কী চইলা গ্যাছে?
, তোমার বাবা তো সক্কাল বেলায়ই বাইর হইয়া গ্যাছে।
তুমি ভোট দিতে যাবা না মা?
, যামু। তুমি যাও, আমি হাতের কামটুকু সাইরা একটু পরে যামু।
আইচ্ছা। অয়ন স্কুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়।
শ্যামলপুর হাইস্কুলে সকাল থেকেই মানুষের ঢল নেমেছে। কোটাখালী খালের পাড়ের রাস্তা ধরে নানা বয়সী মানুষ হেঁটে চলেছে স্কুলের দিকে। অয়ন, সুবল আর মিরাজও ছুটে যায়। এর আগে ওরা কখনো ভোট হতে দেখেনি। অনেক আগ্রহ নিয়ে তাই ছুটে চলেছে ভোটকেন্দ্রের দিকে। স্কুলের কাছে এসে দেখে ওদের ক্লাসের আরও অনেকে এসেছে। সবগুলো রুম থেকেই লম্বা লাইন শুরু হয়ে মাঠ ছাড়িয়ে রাস্তায় চলে এসেছে। স্কুলের বাইরেও অনেক লোক। বেলা বাড়ার সাথে সাথেই লোকজনের ভিড় যেন আরও বাড়ে। হঠাৎ শ্যামলদাকে রাস্তার পাশের মাঠে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। একটু পরেই দেখে তাপসদা, রিয়াজ ভাই, তপনদা আশেপাশেই ঘোরাঘুরি করছে। ওরা কাছে এগিয়ে যেতেই শ্যামলদা দুষ্টুমি করে বলে,
কি রে অনু, ভোট দিছোস?
ইস! আমার কী ভোটের বয়স অইছে নাকি? তোমার মতোন বড় হইলে দিমু।
তুই আমারে ভোট দিবি? শ্যামল হেসে জিজ্ঞেস করে।
, তুমি খাড়াইলে তো দিমুই। তুমি কী আতিক ভাইরে ভোট দিছো?
উহু! এইডা তো কওন যাইবো না। শোন, ভোট হইলো গিয়া গোপন ব্যাপার, এইডা কাউরে কওন ঠিক না।
আমি জানি তুমি আতিক ভাইরেই দিছো কিন্তু কইবা না।
তোর তো অনেক বুদ্ধি!
হুম, আমরা সব জানি। বাবা, হামিদ চাচা, ইসমাইল স্যার, কাজেম চাচা, হরিকাকা আর তোমরা সবাই সাঈদ কাকা আর আতিক ভাইরে ভোট দিছো।
শ্যামল অয়নের কাছে এগিয়ে আসে। কানে কানে বলে- কাউরে কইয়া দিস না! যেন খুব গোপন বিষয় বলে দিচ্ছে ওকে। দূরে দাঁড়িয়ে তাপস আর অন্যরা হাসে।
অনেকক্ষণ অবস্থানের পর ভোটকেন্দ্র থেকে বের হয় খালেক তালুকদার। স্কুলের মাঠের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়। সারা মাঠে, পাকুড়গাছতলা এমনকি রাস্তায়ও প্রচুর মানুষ জড়ো হয়েছে। যেন মানুষের ঢল নেমেছে। এতো মানুষ বিগত কয়েক নির্বাচনে দেখেনি সে। খালেক তালুকদার বোঝে- এ জনতার স্রোত তার জন্য নয়। নয় হারু গাজীর পক্ষেও। নতুন শক্তি জেগে উঠেছে। খালেক তালুকদার ভীত হয়। ভাবে তাদের দিনের বুঝি শেষ হলো!
বাদল কিংবা ওর লোকজনের পক্ষে এবার কিছুই করা সম্ভব না এটা বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করে খালেক তালুকদার। সাত্তার মাস্টার কেন্দ্রের ভিতরে বসে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছেন, স্কুলের চারপাশে ওদের পক্ষের ছেলেরা সজাগ দৃষ্টি রেখে বসে আছে। বাদল ভোট দিয়ে নেমে এলে তাকে মাঠের একপাশে ডেকে নিয়ে যায় সে।
তোর পোলাপাইনগুলারে কিছু করতে মানা কর। অবস্থা বুঝতে পারছোস?
, আমিও তোমারে তাই কইতে চাইছিলাম। এবার কিছু করন যাইবো না।
খালি আশেপাশে থাইক্যা চারিদিকে নজর রাখতে ক’।
আইচ্ছা।
ইসমাইল মোল্লা আর আতিককে এই কেন্দ্রের দায়িত্ব দিয়ে সাত্তার মাস্টার কলাবতী বাজারে চলে আসলেন। উজানপুর কেন্দ্র ঘুরে সাঈদ খাঁন বাজারে এলে দুজনে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন অন্যান্য কেন্দ্রগুলোর অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই সুবর্ণপুরের কেন্দ্রে পৌঁছে যান তাঁরা। এখানেও মানুষ ভোট দিতে এসেছে স্বতঃস্ফুর্তভাবে। উপস্থিত ভোটারদের অনেকেই সাঈদ খানকে দেখে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। কেউ কেউ তাঁদের কাছে গ্রামের নানা দুরবস্থার কথাও তুলে ধরলেন। সাঈদ খান আশ্বস্ত করলেন তিনি তাঁর সাধ্যমত চেষ্টা করবেন এইসব সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করবেন। এই কেন্দ্রে জগানন্দ, রঞ্জু আর তপুকে অতন্ত্র প্রহরীর মতো জেগে আছে। ওদেরকে সুবর্ণপুর কেন্দ্রে রেখে তাঁরা গৌরীপাশার দিকে এগিয়ে চললেন।
কী বুঝলা মাস্টার? সাত্তার মাস্টারের উদ্দেশ্যে বলে সাঈদ খাঁন।
আমি তো তোমারে আগেই কইছিলাম, আমগোরে তেমন কিছু করতে অইবো না। মানুষ ক্যামনে সাড়া দিতাছে বুঝতে পারছো?
আমারে কইলে কী অইবো? আমরা তো গতবারই চাইছিলাম তুমি খাড়াও, রাজী অইলা না। তাইলে খালেইক্যাগো দৌরাত্ম্য এতডা বাড়তে পারতো না।
তোমরা কইছিলা ঠিকই। কিন্তু আমি বুঝি, এই কাম আমার লইগ্যা না। তুমিই ঠিক আছ। 
হুনলাম, আইজ সকাল থেইক্যাই খালেইক্যার ছটফটানি নাকি অনেক বাইড়া গ্যাছে?
, আমগো স্কুল কেন্দ্রেই দেহা অইছে কয়েকবার। ফাটা বেলুনের মতোন চুইপস্যা গ্যাছে। মুখের দিকে তাকানোই যায় না! সাত্তার মাস্টার হাসতে হাসতে বললেন।
এইডার খুব দরকার আছিলো। আমরাই বরং দেরী কইরা ফালাইছি।
কথা বলতে বলতে দু’জনে এগিয়ে চলে গৌরীপাশার দিকে।
বিকাল চারটা। সবগুলো কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ শেষ। কোনো কেন্দ্র থেকে বিশৃঙ্খলার খবর পাওয়া যায়নি, তবুও প্রতিটা কেন্দ্রের চারপাশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়েছে। ভিতরে চলছে ভোট গণনার কাজ আর বাহিরে প্রতীক্ষারত মানুষের ঢল। সবার মনে জিজ্ঞাসা- কারা হবে এবারের প্রতিনিধি?
শ্যামলপুর হাই স্কুলের সামনের রাস্তায় লোকে লোকারণ্য। সবাই ফলাফল শোনার অপেক্ষায়। যদিও বেশির ভাগ মানুষ মোটামোটি নিশ্চিত যে সাঈদ খান আর আতিকই জয়ী হবে তবুও তারা অপেক্ষা করছে কেন্দ্র থেকে ঘোষণা শোনার জন্য।
সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে ঘোষিত হলো ফলাফল। চেয়ারম্যান পদে সাঈদ খান সবগুলো কেন্দ্রেই জয়ী, আর শ্যামলপুর-উজানপুর-গৌরীপুর ওয়ার্ডে মেম্বার পদে জয়ী আতিক। ভোটের ব্যবধান এতটাই বেশি যে খালেক তালুকদার আর বশিরুল্লাহ পাটোয়ারীর জন্য ব্যাপারটা রীতিমত লজ্জাজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। হারু গাজী আর সামসু খন্দকার তো জামানতই হারিয়েছে।
শ্যামলপুর হাইস্কুল মাঠের জনসমুদ্রের মাঝে যেন আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। এ যেন আরেকটা যুদ্ধ জয়ের আনন্দ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে গ্রামবাসীর এটাই নীরব প্রতিবাদ।



 

দুপুরের পর জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে শিউলি। চৈত্র মাসের কড়া রোদে খা-খা করছে খেলার মাঠটা। মাঠের অপরপ্রান্তে বেল গাছটার ছায়ায় কয়েকটি অল্পবয়সী ছেলে মার্বেল খেলছে। দূর থেকে ডাকপিওনকে এগিয়ে আসতে দেখে গেটের কাছে এগিয়ে যায় শিউলি। ডাকপিওনের মুখে হাসি দেখেই বুঝতে পারে ওর চিঠি আছে। হলুদ খামের উপরে বকুলের গোটা গোটা হাতের লেখায় ওর নামটা দেখে মনটা খুশিতে ভরে ওঠে। অনেকদিন পর বকুলের চিঠি পেয়েছে শিউলি। বাবা, মা অয়ন, বকুল, মন্টু মামা কেমন আছে ওরা? কোনো খারাপ খবর নেই তো? চিঠিটি হাতে নিয়ে একছুটে ঘরের মধ্যে চলে এল। বিছানায় শুয়ে শুয়ে পড়তে শুরু করলো। বাড়ির সবার কথাই লিখেছে বকুল। অয়নের গল্প শুনে মনে হলো ও যেন অনেক বড় হয়ে গেছে। সারাদিন গ্রামের মাঠে ঘাটে ছুটে বেড়ায়, একা একাই স্কুল, বাজারে যায়। শিউলির চোখে ভেসে ওঠে আদরের ছোট ভাইয়ের মায়াভরা মুখটি। ইস, কতদিন ওদের দেখি না! সাইদ চাচা, আতিক ভাই ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে দাঁড়িয়েছে! গ্রামে কত কী ঘটে যাচ্ছে! বিভাপু, প্রভার সংবাদ পড়ে অনেক মন খারাপ হয় ওর। মনে প্রশ্ন জাগে, সহজ সরল ভালো মানুষ ওরা, ওদের ভাগ্যটা কেনো এমন হলো? গ্রামের কথা ভাবতে ভাবতে একসময়য় ঘুমিয়ে পড়ে শিউলি।
বাইরের গেট খোলার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল শিউলির। পায়ের শব্দ শুনেই বুঝতে পারে নাহিদ ফিরেছে। আজ অবশ্য বলে গিয়েছিলো তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করবে। বেশ কিছুদিন ধরেই ওর শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। অফিসে কাজের ঝামেলায় সময় করতে পারছিল না নাহিদ। আজ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার কথা। নাহিদের ঘরে ঢোকার শব্দ শুনেও চুপচাপ শুয়ে থাকে শিউলি। সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। ঘরের মধ্যে আবছা অন্ধকারে শিউলিকে শুয়ে থাকতে দেখে নাহিদ বলে,
এই অসময়ে শুয়ে আছ যে! শরীরটা কী বেশি খারাপ?
শিউলি কোনো কথা বলে না। ঘুমের ভান করে চুপচাপ শুয়ে থাকে। নাহিদ কপালে হাত রাখে, শিউলি চোখ মেলে তাকায়।
ওঠো। ডাক্তারের কাছে এপয়েনমেন্ট করা আছে, এক্ষুণি বেরিয়ে পড়তে হবে। 
শোয়া থেকে উঠে বসে শিউলি, চুপচাপ তৈরি হয়ে নেয়। ডাক্তারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে নাহিদের সাথে। বাইরে অন্ধকার কেবল দানা বাঁধতে শুরু করেছে।
গাইনোকোলজিস্ট হিসেবে ড. কোহিনূরের বেশ সুনাম আছে মুক্তনগরে। মধ্যবয়স্কা মহিলা, বেশ হাসিখুশি। রোগীদের সাথে আন্তরিকভাবেই মিশে যান, যেটা অনেক বড় ডাক্তারের মধ্যে সচরাচর দেখা যায় না। বেশ কয়েক মাস ধরেই শিউলি ড. কোহিনূরের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নিচ্ছে। আজ চেম্বারে বেশ ভিড়।
ড. কোহিনূর চেম্বারের একপাশে পর্দার আড়ালে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে দেখছেন শিউলিকে। পর্দার বাহিরে চেয়ারে বসে অপেক্ষা করছে নাহিদ। এই মুহূর্তে বেশ অস্থির হয়ে আছে। ডক্টর আর শিউলির মধ্যকার মৃদু কথোপকথন কানে ভেসে আসছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল ওরা। ড. কোহিনূর ফিরে এসে নিজের চেয়ারে বসলেন। নাহিদ বসে আছে তার মুখোমুখি। চিন্তিত। ব্যাংকের গ্রাহক হওয়ার সুবাদে ডক্টর নাহিদের পূর্ব পরিচিতা। এই মুহূর্তে তাঁকে কিছুটা উৎফুল্ল লাগছে। তিনি নাহিদের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন,
সুখবর তো খালি মুখে হয় না। মিষ্টি খাওয়াতে হবে যে! 
নাহিদের মন থেকে নিমেষেই দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যায়।
অবশ্যই, মিষ্টিমুখ তো হবেই! নাহিদ বের হবার জন্য উঠে দাঁড়াতেই তিনি বললেন,
ব্যাংকার সাহেব, এখুনি ব্যস্ত হতে হবে না। ওটা পাওনা রইলো। এখন তো সবে শুরু, সামনে অনেক সময় বাকী।
নাহিদ ঘুরে শিউলির দিকে তাকায়। দেখে, শিউলির দু’চোখে একটা খুশির রেখা ক্ষণিকের জন্য ঝিলিক দিয়ে যায়। লাজুক দু’ঠোঁটে স্মিত হাসি ভেসে ওঠে, লজ্জায় মুখটা নিচু করে।
ড. কোহিনূর বলেন- ও বেশ দুর্বল। এখন ও আর একা নয়, ঠিক মতো যতœ নিবেন।
সমস্যা হলো, বাসায় সারাদিন ও একা থাকে, আমি অফিসে ব্যস্ত থাকি। বাড়তি যতœ নেয়ার যে কেউ নেই!
উহু, এখন ওকে আর একা রাখা ঠিক হবে না। কাউকে সাথে রাখার ব্যবস্থা করেন। ওর কিছুটা ডিফিকাল্টিজ আছে, আমি অবশ্য ঔষধ দিয়েছি। তবে তিনমাস পর্যন্ত খুব সাবধানে থাকতে হবে।
ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হতে বেশ রাত হয়ে গেল ওদের। আশপাশটা গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত। রাস্তায় লোকজনের চলাফেরা কমে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। ফাঁকা রাস্তা দিয়ে ধীরলয়ে ছুটে চলেছে ওদের রিকশা। হালকা বাতাসে শীত শীত লাগছে শিউলির। জ্বরটা পুরোপুরি সারেনি। আজকের সুখবরটা শোনার পর থেকে নাহিদের উপর থেকে সব রাগ-অভিমান দূর হয়ে গেছে। নাহিদ হাসিমুখে শিউলির উদ্দেশ্যে বলে,
তোমার অনেক দিনের চাওয়া পূর্ণ হল।
শুধু কী আমার চাওয়া? তোমার ছিল না?
হ্যাঁ, তা তো ছিলই।
কখনো বলনি তো!
সব কথা কী মুখে বলতে হয়? তাছাড়া এ বিষয়টা নিয়ে সবসময় তোমার মন খারাপ থাকতো, তার উপর আমি কিছু বললে তোমার কী ভালো লাগতো? ডাক্তার কী বলল শুনতে পেয়েছ?
কী?
তোমাকে খুব সাবধানে থাকতে হবে।
আর কিভাবে সাবধানে থাকবো? সারাদিন তো শুয়ে বসেই কাটে।
আমি ভাবছি একজন লোক কোথায় পাই। গ্রাম থেকে কাউকে আনাতে পারলে ভালো হত।
যেহেতু এখনই কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না, এত চিন্তা করে লাভ নেই। আমাকে তো আর কোন ভারী কাজ করতে হয় না।
তবুও, কালকেই বাড়িতে চিঠি লিখে দিব।
তুমি খুব অস্থির হয়ে পড়েছ।
দেখ, আমি সারাদিন তোমার কাছে থাকতে পারছি না। তোমাকে একা রাখাটা ঠিক হবে না, একান্তই যদি কাউকে পাওয়া না যায় তাহলে ভাবছি তোমাকে শ্যামলপুরে পাঠিয়ে দেব। এই সময়টা ওখানে থাকলে তোমার ভালো লাগবে। শ্যামলপুরে যাওয়ার কথা শুনে শিউলি মনে মনে খুশিই হয়, পরক্ষণেই মনে পড়ে, তাকে আগামী তিন মাস ড. কোহিনূরের তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে। তাছাড়া, সে চলে গেলে নাহিদ এখানে একা হয়ে যাবে।
আমি চলে গেলে তোমার কী হবে?
কী আর হবে? কিছুটা একা হয়ে যাব। তবুও তোমাকে নিয়ে তো দুশ্চিন্তা থাকবে না।
আমাকে নিয়ে তোমার দুশ্চিন্তা হয়? শিউলির কণ্ঠে অভিমানের সুর।
নাহিদ কিছু বলে না। বুঝতে পারে ইদানীং শিউলিকে ও সময় দিতে পারে না, তাই ওর উপর এত অভিমান। শিউলির হাতটা নিজের হাতে তুলে নেয়। তারপর বলে,
এই মুহূর্তে তোমার ভালো থাকা জরুরী।
কথায় কথায় রিকশা ওদের বাসার সামনে চলে আসে। অনেকদিন পর দু’জন মানব-মানবী ভালোলাগার অনুভূতি নিয়ে প্রবেশ করে নিজেদের সুখের নীড়ে।




 

খুব সকাল। পূব আকাশে সূর্য উঁকি দেয়নি এখনো। কোটাখালী খালের পাড়ে হাঁটছে তারাপদ ঘোষ। খাল পাড়ের সরু রাস্তা দিয়ে কিছুদূর এগিয়ে এসে জমির আল ধরে নেমে পড়ে ধানক্ষেতের মাঝে। যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। যেন গাঢ় সবুজের চাঁদর বিছিয়ে রেখেছে প্রকৃতি। নতুন গজিয়ে ওঠা কচি ধানের শীষে ভোরের স্নিগ্ধ বাতাস দোল দিয়ে যায়। তারাপদর মন ভরে উঠে। কঠোর পরিশ্রম করে ফসল ফলায় তারাপদ। নিজের ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের পর যখন নতুন ধানে গোলা ভরে ওঠে, মনটা ভরে যায় আনন্দে। এ বছর বোরো ধান রোপনের জন্য সেচ বাবদ বেশ খরচ হয়েছে। ভালো ফলন পেলে টাকা উঠে আসবে আর পরিশ্রমও সার্থক হবে। তারাপদ জমি থেকে উঠে আসে রাস্তায়। বাড়ির দিকে আসার পথে চোখে পড়ে কোটাখালী ব্রিজের উপর থেকে মন্থর গতিতে নেমে আসছে বাদল। কিছুক্ষণের মধ্যেই কাছাকাছি পৌঁছে যায়। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। তারাপদকে সামনে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে।
তারাকাকু কেমন আছো? বাদল জিজ্ঞেস করে।
ভালো, তুই এত্ত বিহানে? কোত্থেইক্যা আইলি?
রাইতে স-মিলে আছিলাম। তোমার লগে কিছু কতা আছিলো।
কী কতা?
এহন থাউক। সারা রাইত ঘুমাইনাই, খুব কাহিল লাগতাছে। কাইল পরশু সময় নিয়া কমুনে।  
আইচ্ছা।
তারাপদ মনে মনে ভাবে, এত মিষ্টি করে কথা বলল বাদল! ব্যাপার কী? কোনো মতলব ছাড়া তো ওরা কারো সাথে এত ভালো ব্যবহার করে না। যাউকগা; যখন বলবে তখন দেখা যাবে। ভাবতে ভাবতে বাড়ির পথে এগিয়ে চলে তারাপদ।
বাবাকে কিছুটা ভয়ই পায় সুবল। রাশভারী মানুষ হরিপদ। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা তেমন একটা বলেন না। তাই বলে কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করেছেন এমনটি শোনা যায়নি কখনো। সুবল কখনো রাগতে দেখেনি বাবাকে। তবুও তাঁকে ওর কেনো যে এত ভয় নিজেও জানেনা। ওর যত আবদার মায়ের কাছে। বাড়ির অন্য প্রিয় মানুষদের তালিকার প্রথম দু’জন হলো কাকু আর কাকীমা। তারাপদর কাঁধে চড়ে ঘুরে বেড়িয়েছে সারা গ্রাম। তারাপদও সুবল বলতে অজ্ঞান। ভাতিজার যে কোনো আবদার হাসিমুখে মেনে নেয় সে।
বাবাকে পুকুর ঘাটে গোসল করতে দেখে অনেকক্ষণ ধরে দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে সুবল। গোসল শেষে হরিপদ চলে গেলে পুকুরের ঘাটে আসে ও। সিঁড়ির শেষ ধাপে নেমে দাঁড়ায়। কচুরিপানায় ঢাকা থাকায় এই পুকুরের পানি বেশ ঠা-া। গোসলের সুবিধার জন্য ঘাট থেকে কিছুটা দূরে ভাসমান বাঁশ দিয়ে কাচুরিপানা আঁটকে দেয়া হয়েছে। ঘাটের সামনের অনেকটা জায়গা এখন ফাঁকা। সুবল কিছুক্ষণ সিঁড়িতে বসে দাঁত মাজে। হঠাৎ চোখে পড়ে বড় একটা মাছ পানির উপরে ভেসে উঠে আবার পালিয়ে যায় গভীর পানিতে। সুবল একমনে তাকিয়ে দেখে ছোট ছোট মাছদের সাঁতার কাঁটা। দেখলে মনে হয় হাত বাড়ালেই ধরা যাবে কিন্তু ও জানে ওগুলো ধরা এত সহজ নয়। তবুও অতি সন্তর্পণে দু’হাত পানিতে ডুবিয়ে দেয়। হাত কাছাকাছি নেবার আগেই- ফুড়ুৎ! নিমিষেই চোখের আড়ালে। ও মাছগুলোর উদ্দেশ্যে বিড়বিড় করে বলে- ‘খাড়া কাকু আসুক, আইজ জাল দিয়া তোগরে ধরুম’। হাতমুখ ধুয়ে উঠে দাঁড়ায়। পুকুরের অপর প্রান্তে চোখ পড়তেই দেখে তারাপদ খালপাড় থেকে বাড়ির দিকেই আসছে। ও ঘাট থেকে সরে পথের মাঝে এসে দাঁড়ায়। তারাপদ অনেক দূর থেকেই ভাতিজাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই বুঝে যায়- এ অপেক্ষা তারই জন্য। কাছাকাছি এসে বলে,
কী বাজান, এইহানে খাড়াইয়া কী করতাছ?
তোমার লইগ্যাই তো খাড়াইয়া আছি। আমি তো অনেক আগেই তোমারে দেখছি।
তাই নাকি? বাজান মনে হয় কিছু কইবেন। তারাপদ হাসতে হাসতে বলে।
কাকা জানো! একটু আগে পুকুরে একটা বড় মাছ ভাইসা উঠছিলো। মাছ ধরবা না?
, আমার বাজান চাইলে তো ধরতেই অইবো।
আইজ ধরবা?
না রে বাজান, এহন অনেক কামের সময়। এই ঝামেলা শ্যাষ অইলেই ধরুম।
আমি তোমার লগে পুকুরে নামুম কিন্তু। ঐ কলাগাছের ভেলায় চইড়া জাল ফেলুম।
তারাপদ হাসে। বলে- তুমি জাল ফেলতে পারবা?
তুমি শিখাইয়া দিলেই পারুম।
আইচ্ছা শিখাইয়া দিমুনে। এহন ঘরে লও।
আজ পহেলা বৈশাখ। উৎসবের একটা রেশ ছড়িয়ে পড়েছে কলাবতী বাজারের সর্বত্র। আজকের বটতলার হাটে নিয়মিত পণ্যের পাশাপাশি বাচ্চাদের জন্য বাহারি সব খেলনা আর নানান ধরনের মিষ্টান্নের দোকানও বসেছে। যদিও সুবর্ণপুরের গড়ের মাঠে কাল থেকেই শুরু হয়েছে বৈশাখী মেলা। রাতে যাত্রাপালা হয়। তবে কলাবতী বাজারের মজাটা একটু অন্যরকম। এই অঞ্চলের মানুষজনের মিলনকেন্দ্র হলো এই বাজার। কিশোর-তরুণ থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত দিনে একবার বাজারে না এলে যেন পেটের ভাত হজম হয় না।
মন্টু মামার সাথে গতকালই গড়ের মাঠের মেলায় গিয়েছিল অয়ন। আজ এসেছে কলাবতী বাজারে। বাবার দোকানের সামনে বসে দেখছে হরিকাকার দোকানে আজ খুব ভিড়। বাবাকে জিজ্ঞেস করতেই বাবা বলেন,
আইজ হালখাতা তো, তাই তোমার হরিকাকা সবাইরে মিষ্টিমুখ করাইতেছে।
বাবার মুখে হালখাতার নাম শুনে অয়ন জানতে চায়, বাবা হালখাতা কী?
হালখাতা হইলো পুরনো হিসাব-নিকাষ চুকিয়ে দিয়ে নতুন করে হিসাব চালু করা। বৈশাখের প্রথম দিনে ব্যবসায়ীরা পুরনো হিসেবের খাতা বাতিল করে দিয়ে নতুন করে খাতা খোলে। এটাকেই বলে হালখাতা। মানে হচ্ছে হিসাব হালনাগাদ করা।
সাত্তার মাস্টার অয়নকে বৈশাখের ইতিহাস ও বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে নিজেই একসময় আনমনা হয়ে যান।
এই বাংলায় পহেলা বৈশাখের ইতিহাস বহু বছরের পুরনো। সম্রাট আকবরের নাম হুনছো? অয়ন মাথা নেড়ে বোঝায় শোনেনি সে। সেই কয়েক’শ বছর আগে এই অঞ্চলে ছিল সম্রাট আকবরের রাজত্ব। তিনিই বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তখন থেইক্যাই ধীরে ধীরে বৈশাখের প্রথম দিনটা বাঙালির মনের মধ্যে ঠাঁই কইরা নিছে। ঈদ, পূজা’র মতোন পহেলা বৈশাখও আমাদের কছে একটা আনন্দের উৎসব। বৈশাখে মেলা বসে। আমরা বাঙালিরা অনেক আনন্দে মাইত্যা উঠি। আগে আরও আনন্দ অইতো। পুতুল নাচের আসর, গরু-মহিষ কিংবা মোরগের লড়াই অইতো। আগের থেইক্যা কইমা গেলেও এহনও এই দিনে অনেক মজা অয়। এহন যেমন গড়ের মাঠে যাত্রাপালা অইতাছে। কাইল থেইক্যা বটতলায় পালাগানের আসর জমবো।
অয়ন খুব মন দিয়ে বাবার কথা শোনে। তারপর বলে
বাবা, কিছুদিন আগে গড়ের মাঠে যে মেলা হইছিল, ঐহানে আমি মোরগের লড়াই দ্যাখছি।
হ। ঐটা তো ছিল চৈত্র-সংক্রান্তির মেলা। তখনও অনেক আনন্দ হয়।
হরিপদর দোকানে লোকজনের ভিড় কমে আসে একসময়। লোকজনের ঝক্কি-ঝামেলা সামলিয়ে কিছুটা ক্লান্ত হরিপদ দখিনা বাতাসের লোভে এসে বসেন সাত্তার মাস্টারের দোকানের চত্বরে। সাত্তার মাস্টার হেসে বলেন,
কী হরি, খুব খাটনি গ্যালো মনে অয়?
হ মাস্টার। এহন আর আগের মতোন পারি না।
আর কত? বয়স অইছে না?
হুম, বয়স যে অইছে তা এহন ভালোই বুঝতে পারি।
গোপাল প্লেটে করে কিছু মিষ্টি এনে রাখে অয়নের সামনে। হরিপদ অয়নের উদ্দেশ্যে বলেন- আমার অয়ন বাবাজির তো মিষ্টি খুব পছন্দের, খাও।
বাজারে এলে হরিকাকার দোকানের মিষ্টি অয়নের চাই-ই। তাই আর দেরী না করে খেতে শুরু করে। মিষ্টি খেতে খেতেই অয়নের চোখে পড়ে নদীর দিকে। ওর ঠিক সোজাসুজি একটা পালতোলা নৌকা ছুটে যাচ্ছে বড় নদীর দিকে। অয়ন দ্রুত খাওয়া শেষ করে বাবার দোকানের সামনে থেকে নিচে নেমে আসে। রাস্তা থেকে নদীতে নেমে যাওয়া বাঁধানো সিঁড়ির একেবারে শেষ ধাপে গিয়ে দাঁড়ায়। এখন নৌকাগুলো ওর অনেক কাছে। নৌকায় বসা লোকগুলোকে স্পষ্ট দেখা যায়। বাতাসে লোকজনের উড়ন্ত চুলও দেখতে পাচ্ছে। তখনই অয়নের মনে হয় অনেকদিন ও ছৈ-ওয়ালা নৌকায় ওঠে না।
মজনুর মৃত্যুর পর থেকে বাদলের সাথে গিয়াসের একটা ঠা-া লড়াই শুরু হয়েছে ভিতরে ভিতরে। গ্রামের মানুষজন মজনুর মৃত্যুকে স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে মনে করলেও হারু গাজী আর গিয়াস এখনো প্রকাশ্যে খালেক আর বাদলকেই দায়ী করে আসছে। গিয়াস তো সবসময়ই বলে বেড়ায়- এর প্রতিশোধ আমি নিমু।
নদীর পাড়ে স-মিলের ব্যবসায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুজনের কোন্দল এখন নিত্য নৈমত্তিক ব্যাপার। বাদলের সমস্যার কারণ- মজনু থেকে গিয়াস অনেক বেশি আক্রমণাত্মক। মজনুর সাথে দীর্ঘদিনের সম্পর্কের ফলে তাকে বুঝতে সুবিধা হতো, কিন্তু গিয়াসের বেলায় ঘটছে ঠিক তার উল্টোটি। ইদানীং বাদল লক্ষ করছে- গ্রামের দিক থেকে আসা গাছ-বোঝাই নৌকাগুলোকে হারু গাজীর স-মিল পার হয়ে বাদলের মিলে পৌঁছুতে দেয় না গিয়াস। শোনা যায় বাদলের অর্ধেক দামেই খদ্দেরদের কাঠ চিড়িয়ে দেয় ও। আজ কয়েকদিন ধরে দিনের বেশির ভাগ সময় স-মিলেই কাটছে বাদলের। অনেক সময় রাতেও থেকে যায় স-মিলের পাশের ছোট্ট ঘরটিতে। মাঝে মধ্যেই দু’পক্ষ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়। 
সন্ধ্যা হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। চারিদিকে আঁধার নেমে এসেছে। নদীর বুকে ভাসমান ডিঙ্গি নৌকায় টিমটিম করে জ্বলে হারিকেনের আলো। নদীর পাড়ের পথ ধরে বাজারের দিকে যাচ্ছে বাদল। হারু গাজীর স-মিলের কাছে আসতেই চোখে পড়ে হাল্কা অন্ধকারে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বিড়িতে টান দিচ্ছে করিম লস্কর।
কী লস্কর দাদা, অন্ধকারের মধ্যে এইহানে খাড়াইয়া কী করতাছেন?
তেমন কিছু না, ছোড একটা গাছ ফাড়াইতে দিছিলাম। করিম লস্করের মধ্যে কিছুটা অস্বস্তি লক্ষ করে বাদল।
আপনে সবসময় আমার স-মিলেই গাছ ফাড়াইতেন। আমি কী ক্ষতি করছি যে আইজ অন্য জায়গায় যাইতে অইলো? পয়সা না হয় কয়ডা কমই দিতেন। আমি কী না করতাম?
ব্যাপারডা তেমন কিছু না বাদল। তোমার স-মিলে তো সবসময়ই ফাড়াই, আইজক্যা গিয়াস ধরলো তাই না করতে পারলাম না।
বাদল গিয়াসের স-মিলের দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। গত এক সপ্তাহ ধরে ওর স-মিলে খদ্দের নেই বললেই চলে, অথচ গিয়াসের স-মিলে গাছের উঁচু স্তূপ জমে আছে। বাজারের দিকে চলে যাবার সময় করিম লস্করকে বলে,
এহন সময় খারাপ তো, তাই সবাই আমার দিক থেইক্যা মুখ ফিরাইয়া নিছে। তয় লস্কর দাদা, সময় আমারও আইবো। 
প্রায় একমাস হলো নতুন ব্যবসায় নেমেছে সাজু। ব্যবসায়িক মারপ্যাঁচ তেমন একটা বোঝে না সে। গিয়াস আর হারিছের উপরেই নির্ভর করে চলতে হয় বেশির ভাগ সময়। মধুপুর থেকে মালামাল কিনে নীলগঞ্জ আর সোনাপুরে বিক্রি করে। মজনু মারা যাবার পর গিয়াস ইদানীং বাবার স-মিলে সময় দেয়। হারিছের সাথে সাজুকে ছুটতে হয় মধুপুর গঞ্জে। কলাবতী বাজার থেকে নীলগঞ্জ যাওয়ার জন্য নৌকা-পথটাই উত্তম। উজানগাঙের ওপারে চরকমল থেকে একটা রাস্তা অবশ্য নীলগঞ্জ পর্যন্ত চলে গেছে, তবে এবড়ো-থেবড়ো সে পথটা বড়ই দুর্গম।
গিয়াসের সাথে সাজুর যতটা হৃদ্যতা হারিছের সাথে ঠিক ততটা নয়। অনেকদিন একসাথে চলাফেরা করলেও ব্যবসায়ী হারিছকে ঠিক বুঝতে পারে না সাজু। কেবলই মনে হয়- মালামাল কেনার সময়, পাইকারের সাথে কথা বলার সময় হারিছ যেন কিছু একটা আড়াল করতে চায়। তাদের কথার মাঝে ও কাছে এসে পড়লে প্রায়ই চুপ করে যায় কিংবা প্রসঙ্গ পালটে ফেলে। সাজুর মাঝে মাঝে মনে হয় এই ব্যবসায় নেমে সে ভুল করল কিনা! তার ভয় হয়-তেমন হলে বাবার সামনে দাঁড়াতে পারবে না সে।
মফিজ মিয়ার শরীর দিন দিন ভেঙ্গে পড়েছে। অনেকদিন শহরে যাওয়া হয়না। আগের বন্ধকী জমি হারু গাজীর কাছে বিক্রি করে ছেলের ব্যবসার টাকার যোগাড় করে দিয়েছে। ছেলে তাকে কথা দিয়েছে ছয় মাসের মধ্যে তার টাকা তাকে ফেরত দেবে। মফিজ মিয়া জানে, এ টাকা আর ফেরত পাওয়া যাবে না। আশাও করে না সে। শুধু চাওয়া ছেলেটা যেন দাঁড়িয়ে যায়।
দু’দিন পর জ্বর কিছুটা কমে এসেছে তবে এখনো শীত শীত লাগে। শ্বাসকষ্ট আর কোমরের পুরনো ব্যথাটা বেশ ভোগাচ্ছে তাকে। বারান্দায় চৌকির উপর কাঁথা গায়ে জড়িয়ে শুয়ে থাকে কিছুক্ষণ। বেলা বাড়লে উঠোনে নেমে দাঁড়ায়। সকালের রোদটা খুব আরামদায়ক। এই কোমল রোদের উষ্ণতা কাঁথার ওম থেকে হাজার গুণে ভালো। মফিজ মিয়া উঠোনে চেয়ারে বসে থাকে অনেকক্ষণ। শীত ভাবটা আর নেই। সে মসজিদের দিকে পা বাড়ায়। মাদ্রাসার সামনের খোলা চত্বরে তালপাতার চালা বানানো তদারকি করছে মনু মিয়া। মফিজ মিয়াকে দেখে এগিয়ে আসে।
ভাইসাবের শরীর কেমন এহন?
আগের চাইতে একটু ভালো।
কয়দিন ধইরা খুব ব্যস্ত, আপনের একটু খবর নিতে পারি নাই।
অসুবিধা নাই। আপনারে একটা কাম করতে অইবো।
কী কাম? কন মিয়াভাই।
সাত্তার মাস্টার আর কাজেম মাঝি কইছিলো কিছু টাকা দেবো হোগল কেনার জন্য। আমি তো যাইতে পারি নাই। আপনে হেগো লগে দেহা কইরা অইগুলার ব্যবস্থা কইরেন।
আইচ্ছা আইজ বিহালে মাস্টারসাবের লগে দ্যাহা করুমনে।
গত বর্ষা আর শীতে অনেক দুর্ভোগ গেছে মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীদের। মাদ্রাসায় বেড়া না থাকায় হাড় কাঁপানো শীতে পড়ানো বন্ধ রাখতে হয়েছিলো। মনু মিয়া বুঝে গেছে মফিজ মিয়া একা এই মাদ্রাসা সচল রাখতে পারবে না। তার একচ্ছত্র আধিপত্য আর খবরদারি থাকলে গ্রামের অন্য কেউ এগিয়েও আসবে না। এই অবস্থার অবসান এখন অতীব জরুরি। এই ক’বছরে এখানে নিজের একটা অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিলো সে, কিন্তু প্রভার বিচারের ঘটনার পর গ্রামের মানুষের মানুষিকতার অনেক পরিবর্তন এসেছে। তার প্রতি মানুষের আগের সেই বিশ্বাস আর আস্থার জায়গাটায় ফাঁটল ধরেছে। মনু মিয়া শঙ্কিত হয়।




 

আজ তিনদিন ধরে জ্বরে শুয়ে বসে সময় কাটছে অয়নের। এ ক’দিনে একবারের জন্যেও ঘরের বাইরে যেতে পারেনি ও। ছোটদি’র কড়া হুকুম- ‘জ্বর শরীরে বাইরে গেলে পা ভাইঙা দিমু’। ইস! উত্তর বাগানের আমগুলো এতদিনে নিশ্চয়ই পাকতে শুরু করেছে। কাল সুবল এসেছিলো। ওর আর মিরাজের কী মজা এখন! স্কুল ছুটির পর ওরা একসাথে বাগানে গিয়ে আম পেড়ে খায়। ছোটদি’টা যে কি! একটুও চোখের আড়াল করেনি এ ক’দিন।
আর পাঁচ দিন পর ঈদ। এর মধ্যে ও ভালো হয়ে উঠবে তো? ছোটদি ওকে একটাও রোজা রাখতে দেয়নি। ও কেবলই বলে, ‘তুই তো এহনো ছোড, বড় অইয়া সব রোজা রাখিস’। বাবা, মা, ছোটদি, মন্টু মামা ভোর রাতে সেহরি খেতে ওঠে কিন্তু অয়নকে একদিনও তোলেনি। অনেক জিদের পর মা সেদিন বলেছিলো- ‘ঠিক আছে, কাইল রাইতে সরগাই খাওনের সময় তোমারে তুইল্যা দিমুনে’। সে’রাতে জ্বর আসায় ওর আর রোজা রাখা হয়নি।
তিনদিন পর আজ ভাত খাবে ও। শুধু জাউভাত আর কত খাওয়া যায়? মা বলেছে আজ শিং মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেতে দেবে। খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে ও। অয়ন মনে মনে ভাবে- তারপর দেখব ছোটদি কী করে আটকায়।
দুপুরের পর রোদের তাপটা কমে আসে। অয়ন বারান্দায় খাটের উপর বসে সামনের উঠোনে মাকে কাজ করতে দেখে। এই গরমেও মা সারাদিন খেটে চলে। কোনো ক্লান্তি নেই। ছোটদি’র কোনো সাড়া শব্দ নেই। ও জানে ছোটদি ঘরের সামনের সিঁড়িতে বসে আছে। ওখানে বসে বই পড়ছে আর ওকে পাহারা দিচ্ছে। আজ বিকেলে সুবল আর মিরাজ আসলে ও বাইরে যাবেই যাবে। কাল বাবা বলেছিল আর একদিন শুয়ে থাকলেই হবে। অয়ন বসে বসে বিকাল হওয়ার জন্য অপেক্ষা করে।
বাইরে এখন আর রোদ নেই। চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। জানালা দিয়ে ওর দৃষ্টি চলে যায় পুকুরের ওপারের গাছপালা ছাড়িয়ে আরও দূরে। আকাশে কালো মেঘ জমতে শুরু করেছে। বৃষ্টি হবে নাকি? ছোটদিকে ডাকতেই সিঁড়ির উপর থেকে উঠে এলো।
কী রে অনু, কী অইছে?
ছোটদি দ্যাখ, আকাশে কেমন কালা মেঘ করছে। এহন কী বৃষ্টির দিন?
মনে অয় ঝড় হইবো, কালবৈশাখী। ইস! আমগুলা সব ঝইরা পড়বো।
এইসময় ঝড় অয় ক্যান?
ক্যান অয় কইতে পারুম না, তয় প্রতিবছরই তো দেহি অয়।
ছোটদি, আমি একটু বাইরে যাই? খালি একবার।
বকুলের খুব মায়া হয়। কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বরটা নেমে গেছে এখন।
আয়। সিঁড়িতে বইয়া থাকবি, এর বাইরে যাইতে পারবি না। একটু পরই বাতাস ছাড়বো।
আইচ্ছা।
অয়ন আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে মেঘগুলো ক্রমশ আরও গাঢ় হয়ে আসছে। ছাড়াবাড়ির গাছগুলো বাতাসে দুলছে। হঠাৎ বাতাসের বেগ অনেক বেড়ে গেল। বকুল ওকে ঘরের মধ্যে যাবার জন্য তাড়া দেয়। অকস্মাৎ রাস্তার দিকে চোখ পড়তেই দেখে সুবল আর মিরাজ দৌড়ে ওদের বাড়ির দিকে ছুটে আসছে।
তালুকদারের হাটখোলায় চায়ের আড্ডাটা জমে উঠেছে বেশ। রফিকের চায়ের দোকানে গল্পে মশগুল তারাপদ, রমেন সাহা, বলাই শীল আর তোরাব আলী। যেদিন কলাবতী বাজারে যাওয়া হয়না, সেদিন এখানেই আড্ডা জমায় এরা। রেডিওতে শোনা খবর নিয়ে চলে আলোচনা। কখনো নিজেদের এলাকার হালচাল নিয়ে, আবার কখনোবা সরকারের সমালোচনায় তুমুল তর্কে মেতে ওঠে। আবার কিছুক্ষণ পর সব স্বাভাবিক। তারাপদ একটু দূরে মাঠের পানে তাকায়। দিগন্ত বিস্তৃত ধানের ক্ষেতে সমুদ্রের ঢেউ জেগেছে। তিরতির করে বয়ে আসা বাউল বাতাসে ধানগাছের মাথায় দোলা লাগে, যেন অসীম সমুদ্রে বহুদূর থেকে ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে তীরে। সদ্য বয়ঃপ্রাপ্ত তরুণীর মতো লকলকিয়ে ওঠা সবুজ ধানগাছের ডগায় হালকা সোনালি রঙ লেগেছে। আর কয়েকদিনের মধ্যে সারা মাঠজুড়ে পাকা ধান হাসবে। সেই পাকা ধানের উপরে যখন রোদ ঝিলিক দিয়ে উঠবে, তারাপদর মতো অন্য কৃষকদের মনেও তার রেশ ছড়িয়ে পড়বে।
তারাপদ রমেনের দিকে তাকায়।
রমেন বলে ওঠে- তারা, ধান কাটার তো আর বেশি দেরী নাই, সবাইরে নিয়া আমগো একবার বসন উচিৎ। এইবার কামলাগোরে দুইদলে ভাগ কইরা কামে লাগাইতে অইবো।
রমেন ঠিকই কইছো। ধান পাকলে বেশি সময় পাওন যাইবো না। কমলডাঙার পরবাশিগোরেও খবর দেওন দরকার। পারলে আগামীকাইল কাউরে ঐদিকে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে অইবো।
মাঝে মধ্যে অগোরে কলাবতী বাজারে দেখা যায়। বাজারে খোঁজ করলে অতদূর যাওন নাও লাগতে পারে। বলাই শীল বলে।
কাইলকেই খবর নেওন দরকার। দাদার দোকানেই তো দুই-একজনরে দেখা যায়, দেখি আইজ দাদারে কইয়া রাখুমনে। তারাপদ বলে।
সন্ধ্যা অইয়া গ্যাছে, লও বাড়ি যাই। বলে রমেন আর বলাই শীল উঠে পড়ে।
তারাপদ আরও কিছুক্ষণ বসে। সূর্য ডুবু ডুবু। চারিদিকে আঁধার ঘনিয়ে আসলে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। কিছুদূর এগোতেই পেছন থেকে বাদলের ডাক শুনে দাঁড়ায়। বাদল কাছে এসে বলে,
ও কাকু, তোমার লগে কিছু কতা আছিলো।
কী কতা? হেইদিন কী যেন কইতে চাইলি, তারপর তো তোর দেহাই নাই।
, মাঝে কয়েকদিন খুব ঝামেলার মধ্যে আছিলাম। আসলে তোমগো কাছে কিছু চাওনের আছিলো।
তাগো নিজেগো তো কোনো কিছুর কমতি নাই, আমগো কাছে আবার কী চাওনের আছে? তারাপদ হেসে বলে।
ব্যাপারডা আসলে থাকা না থাকা নিয়া না। আগে কও দিবা কিনা।
তা খুইলা ক, আমার দেওনের উপায় থাকলে দিমু। অসুবিধা কী?
কলাবতী বাজারে স-মিলডা নিয়া বড় সমস্যার মধ্যে আছি গো কাকু। জানোই তো মজনু মারা যাওনে হারু গাজী এহনো আমগোরে দোষে। আর তার পোলা গিয়াসের লইগ্যা বাজারের স-মিলে গাছ পাওয়া নিয়া ক্যাচাল লাইগাই আছে। কোনদিন যে অঘটন ঘইট্যা যায় কে জানে! আমি ভাবতাছিলাম এই খালপাড়ে একটা স-মিল দিতে পারলে ভালো হইত। আমগো গ্রামের মানুষদের কষ্ট কইরা কাঠ চিড়াইতে আর কলাবতী বাজারে যাইতে অইতো না।
এইডা তো ভালো কতা, আমরা দরকার অইলে এইহানেই কাঠ চিড়ামু। তারাপদ বলে।
না, সমস্যা অইলো গিয়া খালপাড়ে আমগো সুবিধামত জমি নাই।
ক্যান? হাটখোলায় তো তোগো অনেক জায়গা।
হ অইহানে আছে, কিন্তু ঐ জায়গাটা অনেক উঁচা। গাছ উঠানো নামানোতে অনেক অসুবিধা। এইপাশটা কিছুটা নিচা, গাছ উঠানো নামানোতে অনেক সুবিধা অইবো। এইদিকে তো তোমগো অনেক জমি আছে, তাই কইতেছিলাম কী তোমগো কালীখোলার দক্ষিণ পাশের জমিটা যদি আমার কাছে বেচতা।
তারাপদ মনে মনে হাসে। তাই তো বলি এত মিষ্টি মিষ্টি কথা! কিছুটা সময় নিয়ে বলে- আমি ভাবলাম তুই কী না কী চাইবি। কিন্তু জমি বেচার কথা তো আমরা কোনদিন ভাবিনাই। ভগবানের দয়ায় টাকা পয়সার তো কমতি নাই।
আমি জানি তোমগো কোন টাকা-পয়সার অভাব নাই, আমার দরকারেই কইছিলাম। ভালো দাম দিমুনে কাকু।
দামটা তো ব্যাপার না, কিন্তু জমি বেচা তো আমগো পক্ষে সম্ভব না।
যদি বেচতে না চাও, তাইলে আমার লগে অদল-বদল কইরা নাও না কাকু। রাস্তার পাশে তোমার জমি, আমগো জমি তো ভিতরের দিকে। তুমি তো চাষবাসই করবা, দরকার অইলে ভেতর থেইক্যা বদল কইরা দিমুনে।
ভিতরের জমি আর রাস্তার পাশের জমি কী এক?
তা এক না, তোমরা একটা দাম ধইরা নিও, বাড়তি টাকা আমার কাছেত্তন নিয়া নিও।
ঘুইরা ফিইরা তো হেই একই কতা। তাছাড়া রাস্তার পাশের জমি আমগো নিজেগোও দরকার। শুকনা সিজনে খাল থেইক্যা সেচের পানি তুলতে অয়। এই জমি বেচন সম্ভব না রে বাদল।
হেইডা তো যে যে কারও জমি থেইক্যা করা যায়। তোমার এহনই কইতে অইবো না। একটু ভাবো, কয়দিন পরে আমারে জানাইও।
তারাপদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে- দ্যাখ বাদল, এইহানে ভাবাভাবির কিছু নাই। জমি বেচা কিংবা অদল বদল করা সম্ভব না।
কাকু, তোমরা হইলা আমগো দীর্ঘদিনের প্রতিবেশী। কোনোদিন তোমার কাছে কিছু চাই নাই। আইজ কিছু চাইছিলাম। এমনি এমনিই তো আর না। তুমি চাইলেই অদল বদল কইরা নিতে পারতা।
তুই ভুল বুঝিস না, জমির ব্যাপার ছাড়া অন্য কোনো সাহায্য লাগলে আমারে কইস।
থাউক, লাগবে না।
তারাপদ বাড়ির পথে চলে যায়। বাদল ওখানে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে তার গমনপথের দিকে। তারাপদ দেখতে পায়না সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে বাদলের চোখে-মুখে ফুটে ওঠে ক্রূর হাসি। বিড়বিড় করে নিজের উদ্দেশ্যে বলে- ব্যাটা মালুর বাচ্চা মালু, আমারে জমি দিবি না, আমিও দেখুম তোরা ক্যামনে শান্তিতে থাকোস।



 

হরিপদ ঘোষ কথাটা শুনেই রেগে উঠলেন।
অগো দরকার বইলাই আমারে জমি বেচতে অইবো? আমার জমি আমি বেচুম না, এইডা নিয়ে এত কথা ক্যান? আর রাস্তার পাশের জমি ওগো দিয়া আমরা ভিতরের জমি ক্যান নিমু? ওরা আমগো কোন জনমের সমব্যথী আছিলো?
বাদ দাও দাদা। বাদইল্যার কতায় কার কী যায় আসে?
বাদইল্যার কতা বাদ দিলাম। খালেক আইজ বিহানে রমেনের লগে এই ব্যাপার নিয়া অনেক কতা কইছে। ওরা অইলো মতলববাজ মানুষ, কালসাপের মতোন ধূর্ত। দেখবি অন্য কোনো দিক থেইক্যা জ্বালাতন শুরু করছে।
এইডা তুমি খারাপ কও নাই, আমগো সাবধান থাকতে অইবো।
ভেতর ঘর থেকে সামনের বারান্দার কথোপকথন কানে যায় সুরবালার। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সবকথা শোনে সে। ভয় পায় সুরবালা। মনে পড়ে, একাত্তরে ওদের অত্যাচারের কথা। কত হিন্দু পরিবারের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিলো এই বাদলের দাদা সিরু তালুকদার আর তার লোকেরা! সেইসময় সিরু তালুকদারও জমি কিনতে চেয়েছিলো তার শ্বশুরের কাছে। আজ আবার সেই জমির দিকে চোখ পড়েছে সিরু তালুকদারের নাতির। বিজয়া এসে সুরবালার পাশে দাঁড়ায়।
এই বিজু হুনছোস ঠাকুরপো কী কয়?
কী অইছে দিদি?
তালুকদারগো জমির খায়েস কী শ্যাষ অইবো না? সেরুর নাতি বাদইল্যার নাকি আমগো খালপাড়ের জমির দিকে নজর পড়ছে। ঠাকুরপোরে অগো কাছে জমি বেচতে কয়।
ওর নজর পড়লেই কী আর না পড়লেই কি? এইজন্য এত ডরাইতাছো? বাদইল্যারে ডরানোর কী আছে, আর আমরা জমি না বেচলে ক্যামনে নিবো?
একাত্তরের কতা মনে পড়লে ডর লাগেরে বিজু। ঐগুলান মানুষ না, ওগো রক্তের মধ্যেও শয়তানি।
দূর! তুমি যে কী কও! হেইডা তো আছিলো যুদ্ধের সময়। এহন কী আর হেই দিন আছে? এত ডরাইও না।
হেইদিন যেন আর না আসে। ঘরের ভিতরে চলে যায় সুরবালা।
রাস্তা থেকে শ্যামল আর তাপসকে বাড়ির ভিতরে আসতে দেখে চুপ করে যায় হরিপদ। তারাপদর উদ্দেশ্যে বলে- অগোরে কিছু জানানোর দরকার নাই। শহরে গিয়া দুশ্চিন্তা করবো।
ঠিক আছে দাদা, এই বিষয় নিয়া তুমিও আর ভাইবো না।
দুপুরের ঠিক পর পরই একটা ঝিমুনি আসে। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলেই ঘুম। তবে এই সময় কখনো শোয় না শ্যামল। বৈশাখের তপ্ত দুপুরে সূর্যদেব যেন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। দখিন-দ্বারে গাছের নিচের মাচায় গিয়ে বসে শ্যামল। হঠাৎ খিলখিল হাসির ঝংকার কানে যেতেই এদিক ওদিক তাকায়। হাসির উৎস খোঁজে। মনে মনে ভাবে, শিখা কখন এলো? শ্যামল হাঁটতে হাঁটতে বড় পুকুরের দিকে এগিয়ে যায়।
পুকুর ঘাটে বসে আছে চারু আর শিখা। ওদের ঠিক উপরেই ডালপালা ছড়ানো জামরুল গাছটার ছায়া পড়েছে। শিখাকে চারুর সাথে গল্পে মশগুল দেখে এগিয়ে যায় শ্যামল।
কী রে, তোরা এইহানে কী করস?
আমরা গল্প করি। তুমি মেয়েদের গল্পের মধ্যে ক্যান আইলা? চারু উত্তর দেয়।
আমি বুঝি তোগো লগে গল্প করতে পারিনা!
চারু শিখার দিকে তাকায়। বুঝে যায়, শিখা যেন এই মুহূর্তটির জন্যই মনে মনে অপেক্ষা করছিলো।
শিখার উল্টাদিকের সিঁড়িতে বসতে বসতেই শ্যামল জিজ্ঞেস করে- শিখা, তপন কইরে? কয়দিন ধইরা গ্রামে আছি ক্লাবে এলাকায় কোত্থাও ওরে দেখলাম না।
দাদা তো বাড়ি নাই, কমলডাঙা গ্যাছে। কাইল আইবো।
কাইল আইলে আর কী অইবো! আমরা তো কাইল ভোরেই চইলা যামু। কাকীমা কেমন আছে রে?
এহন একটু ভালো। কয়দিন আগে খুব অসুখ গ্যাছে। বাবা মধুপুর সদরে নিয়া ডাক্তার দ্যাখাইছে।
তোর কলেজ ক্যেমন চলতাছে?
ভালো।
চারুকে উঠে চলে যেতে দেখে শ্যামল বলেÑ কী রে বুচি, তুই কই যাস?
তোমরা কথা কও, আমি মুড়ি মাইখ্যা নিয়া আইতাছি।
আচ্ছা যা।
তুমি আইসা ওরে তাড়াইয়া দিলা। শিখা হেসে বলে।
শ্যামল উঠে দাঁড়ায়।
অসুবিধা কি? কাইল আমি চইলা গ্যালে তোরা কথা বলার অনেক সময় পাবি।
তুমি কাইলক্যাই চইলা যাইবা?
হু। ক্যান তোর খারাপ লাগতাছে? শিখার কাছে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে শ্যামল।
শিখা কিছুটা সরে গিয়ে চারিদিকে তাকায়। কিছুক্ষণ পর শ্যামল আবার জিজ্ঞেস করে,
কি-রে কিছু কইলি না যে!
শ্যামলের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শিখা। নাহ! আমার খারাপ লাগবো ক্যান? বলেই ঘুরে পুকুরের শান্ত জলের প’রে এক দৃষ্টিতে থাকিয়ে থাকে। তারপর নিচু স্বরে বলে- তুমি আমার কে?
আমি তোর কেউ না? শ্যামল ঘুরে শিখার সামনে চলে আসে।
শহরে গেলে কী আমার কতা মনে থাকে? শিখার কণ্ঠে অভিমান।
শ্যামল হেসে বলে- আবার সেই প্রশ্ন! তুই জানোস না?
সেই যে গ্যালা, একটা চিঠিও তো দিলা না!
শ্যামল হেসে ফেলল। আসলে মেয়েদের বোঝা খুব কঠিন! বাইরে একরকম আর ভিতরে অন্যরকম!
শিখা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে শ্যামলের দিকে তাকায়। শ্যামল কিছুটা অন্তরঙ্গ হবার চেষ্টা করে। তারপর নিচু স্বরে বলে- তাইলে সেইবার চিঠি পাইয়া এত ক্ষেপছিলি ক্যান?
শিখা অভিমানী কণ্ঠে বলেÑ ডাকে পাঠানের দরকার কী? চারুর কাছে পাঠাইলেই তো অয়!
আচ্ছা বুঝলাম! এরপর তাই হবে আফ্রোদিতি। শ্যামল নতি স্বীকার করার ভঙ্গি করে।
শিখা হেসে ফেলে।
এই তো! কতক্ষণ পর তোরে হাসতে দ্যাখলাম! এই হাসি দেখার জন্যই তো মনটা আনচান করে।
বলতে বলতেই শ্যামল শিখার চোখের দিকে তাকায়। ঠিক তখনই পুকুরের উল্টোদিক থেকে বাউন্ডুলে দখিনা বাতাস এসে শিখার চুলগুলো উড়িয়ে দেয়। শিখা নিজের চুল সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আর শ্যামল মোহাবিষ্টের মতো তাকিয়ে থাকে শিখার দিকে। বুকের মাঝে পুষে রাখা অস্থিরতাগুলো এই সময়ে এসে বড্ড বেশি জীবন্ত হয়ে ওঠে।
শ্যামলের দিকে চোখ পড়তেই লজ্জা পায় শিখা।
এই, এমন কইরা চাইয়া আছো ক্যান? কেউ দেখলে কী ভাববো?
দেখুক না! আকাশে চাঁদ উঠলে সবাই দেখে। লুকাইয়া রাখার কিছু নাই।
ইস! কী বীরপুরুষ! কাকাবাবু জানতে পারলে তোমার খবর আছে।
খবর আবার কী! তখন দেখবি তোরে আর আমারে শেকলে বন্দী করার ব্যবস্থা হইবো।
শিখা যেন আনমনা হয়ে যায়। অবুঝ মন কখনো কখনো বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। ভালোবাসার বাঁধভাঙা জোয়ারে প্রায়শঃই ভেসে যেতে ইচ্ছে করে। মনের শেকলে বন্দী ভালোবাসা মুক্তি খুঁজে বেড়ায়, সাত পাঁকে বাঁধা পড়তে বড় সাধ হয়। বাঁধানো ঘাটের পাশে তাকায় শিখা। পুকুরের পানিতে নিজের ছায়া দেখে, পেছনে দাঁড়ানো শ্যামল। কাল শ্যামল চলে যাবে ভাবতেই ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে।













বৈশাখ মাসের কাঠফাটা রোদ্দুরে ঘরে টেকা দায়। বেলা চড়লেই টিনশেড বাসাটা জ্বলন্ত উনুন হয়ে ওঠে। বেশির ভাগ দুপুরে শিউলি ঘরের সামনের আমগাছটার নিচে চেয়ার পেতে বিশ্রাম নেয়। বেলা পড়ে গেলে ধীরে ধীরে কমে যায় রোদের তেজ। ঘরটা তখন ঠা-া হয়ে যায়। অনেকদিন ধরেই নাহিদ বাসাটা বদল করার জন্য চেষ্টা করছে কিন্তু পছন্দমত বাসা পাওয়া যায়নি এখনো। দুপুরের সময়টাতে গরম থাকলেও এ বাসাটার একটা চমৎকার দিক রয়েছে। বিকাল থেকে দক্ষিণ দিকের খোলা মাঠের উপর দিয়ে ঠা-া বাতাসটা মন ভরিয়ে দেয়। রাতে ঘুমটা অনেক আরামের হয়।
ভবিষ্যৎ সুখ-স্বপ্নে শিউলির দিনকাল এখন ভালোই কাটছে। সারাক্ষণ মনে ভাসে একটা নরম হাত, তুলতুলে গাল আর স্নিগ্ধ চাঁদের হাসি। ইদানীং তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফেরার চেষ্টা করে নাহিদ। দুজনের সংসার আবার হাসি-আনন্দে ভরে ওঠে।
দখিনের বারান্দায় বসে ভবিষ্যৎ স্বপ্নে বিভোর হয়ে ওঠে শিউলি। মাঠের শেষ প্রান্তে বিকালের সোনারোদ ঝলমল করছে এখন। একটু পরই মাঠটা ভরে উঠবে ছেলেমেয়েদের কলকাকলিতে।
আফা, কাইল আমার আইতে একটু দেরী অইবো।
শরিফার কণ্ঠ শুনে ঘুরে তাকায় শিউলি।
আচ্ছা।
নতুন অতিথি আসার খবর শোনার পর থেকে শিউলির প্রতি অতিরিক্ত যতœবান হয়ে উঠেছিলো নাহিদ। একজন লোক যোগাড় করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলো। শেষপর্যন্ত অবশ্য পাওয়া গেল এই শরিফাকে। কাছেই নাহিদের এক কলিগের বাসায় কাজ করে শরিফা। সে’ই ঠিক করে দিয়েছে। দু’বেলা এসে ঘরের কাজ করে দিয়ে যায়। শিউলিকে আর ভারী কোন কাজ করতে হয় না।
নাহিদের কথা ভাবতেই হাসি পায় শিউলির। ইদানীং যা ছেলেমানুষি করে! ঘরে আসলে তাকে কিছুই করতে দেয়না। শরিফাকে কড়া করে বলে দিয়েছে, দিনের মধ্যে তিনবার বেগম সাহেবার খোঁজ খবর রাখতে হবে। তাহলে বোনাস মিলবে। শরিফা অবশ্য তিনবারই আসে। সবকাজ শেষে ঘরে ফেরার সময় শিউলির খোঁজ নিয়ে যায় আবার। 
আজ প্রায় দু’মাস পর বাড়ি থেকে চিঠি পেল শিউলি। একসাথে তিনটি চিঠি। বাবা, বকুল আর অয়নের। অয়নের হাতের লেখা খুব সুন্দর হয়েছে। মায়ের কাছ থেকে কোন চিঠি না এলেও বকুলের চিঠির বেশির ভাগ অংশ জুড়েই মায়েরই কথা। শিউলির জন্য মায়ের উৎকণ্ঠা ওর চিঠির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত । কিভাবে চলতে হবে, কী কী খেতে হবে, নিজের যতœ নিতে হবে- মায়ের এ ধরনের উপদেশ বাণীই ওর চিঠির বিষয়বস্তু। মায়ের মুখটা চোখে ভেসে ওঠে। মনে পড়ে, বাড়ি থেকে চলে আসবার সময় বড়রাস্তা পর্যন্ত চলে এসেছিলেন, মুখে আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছেছেন আর ওরা দৃষ্টির আড়ালে চলে না আসা পর্যন্ত মা ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। চিঠি পড়তে পড়তেই দু’চোখ ভিজে ওঠে শিউলির। অয়ন লিখেছে, ও পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছে। এবার তার পুরস্কার চাই। ছোট ভাইটার মুখটা মনে পড়তেই মুখে হাসি ফোটে। বকুল ওর বাবুর জন্য দু’টো নাম পাঠিয়েছে। শিউলি অবশ্য বুঝতে পেরেছে নামগুলো বাবাই ঠিক করে দিয়েছেন। ছেলে হলে রুদ্র আর মেয়ে হলে মুনিয়া। নাহিদের খুব পছন্দ হয়েছে নাম দুটো। বাবা এমনই। চমৎকার সব নাম বাছাই করেন। বাবার চিঠির ভাষাও যেন অন্যরকম। সবকিছুর এত নিখুঁত বর্ণনা যে পড়তে পড়তে শিউলি শ্যামলপুরে চলে যায়। চেনাজানা মুখগুলো ভেসে ওঠে চোখের সামনে। নাহিদ মাঝে মাঝেই বলে-শ্যামলপুরকে খুব ঈর্ষা হয়। মনে হয় তুমি আমার থেকে শ্যামলপুরকেই বেশি ভালোবাসো। শিউলি তখন কিছুই বলতে পারে না, কেবল হাসে। বাবা লিখেছেন, এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের ভোট শেষ হলেই তিনি শিউলিকে দেখতে আসবেন। হিসেব করে দেখে এতদিনে ভোট শেষ হয়ে গেছে। তাহলে বাবা খুব শিঘ্রই চলে আসছেন! শিউলির খুব লজ্জা লাগে। এই অবস্থায় কী করে বাবার সামনে যাবে সে?
বাবা আসার কথা শুনে নাহিদ ঠিক করে রেখেছে, দুই মাসের জন্য শিউলিকে বাবার সাথে শ্যামলপুরে পাঠিয়ে দেবে। শিউল বলে- না, এই সময় সে কোথাও যাবে না। শিউলি উঠে বসে। হঠাৎ পেটের চিনচিনে ব্যথাটা আবার অনুভব করে। দু’দিন থেকেই এটা হচ্ছে। আজ ডাক্তারের কাছে যাবার কথা। শিউলি শুয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে ব্যথাটা কমে আসে, একসময় ঘুমিয়ে পড়ে।
অনেকক্ষণ ধরে গেটে নক করে যাচ্ছে নাহিদ। ভেতর থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে কিছুটা শঙ্কিত হয়ে পড়ে। ঘুরে মাঠের দিকের বারান্দার বাইরে থেকে শিউলির নাম ধরে ডাকে।
শ্যামলপুরে বাড়ির রাস্তা ধরে কোটাখালী খালের দিকে হেঁটে যাচ্ছে শিউলি। সাথে মালতি, চারু-বকুলও আছে। অনেকদিন পর মালতির সাথে এই পথ ধরে হাঁটছে সে। রাস্তার দু’পাশ থেকে চমৎকার বাতাস উড়িয়ে দিচ্ছে ওদের চুল; আঁচল। হঠাৎ কোত্থেকে একটা দমকা হাওয়া এসে তাকে যেন ফেলে দিচ্ছে পাশের খালে। সে পড়ে যাচ্ছে নিচে, ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে..., কে যেন জোর করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আরও গভীরে। মালতি চিৎকার করে ডাকছে- শিউলি...শিউলি...শিউলি...
ঘুম ভেঙ্গে যায় শিউলির। কপালে-বুকে হাত দিয়ে দেখে সারা শরীর ঘামে ভিজা! বুঝতে পারে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলো। হঠাৎ বাইরে মাঠের দিক থেকে নাহিদের কণ্ঠ ভেসে আসে। শিউলি জানালার পর্দা সরিয়ে দেখে বারান্দার ওপাশ থেকে নাহিদ ডাকছে।
শিউলি বিছানা থেকে নামতেই আবার সেই ব্যথাটা আঁকড়ে ধরে। এবার আগের থেকেও বেশি। অনেক কষ্টে গেট পর্যন্ত হেঁটে যায়। নাহিদ ভিতরে ঢুকেই দেখে শিউলি গেটের একপ্রান্ত ধরে দাঁড়িয়ে আছে, চোখমুখ বিকৃত।
ঘণ্টাখানেক পর। নাহিদ বসে আছে ডাক্তারের চেম্বারে। পেছনের রুমে শিউলিকে পরীক্ষা করছেন ড. কোহিনুর। তার টেবিলের সামনে বসে ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠছে নাহিদ।
ড. কোহিনুর এসে বসেন তার চেয়ারে।
মি. নাহিদ, আমি আপনাদের আগেই সাবধান করেছিলাম।
নাহিদের কপালে ঘাম জমে। অস্থিরভাবেই ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে- বড় কোন সমস্যা ম্যাডাম? শিউলি কেমন আছে?
ও ঠিক হয়ে যাবে তবে আজকের রাতটা আমার অবজারভেশনে থাকতে হবে।
কোনো সমস্যা নেই তো ম্যাডাম?
না, এখন আর কোনো সমস্যা নেই, তবে হতে পারতো। আর কোনো অনিয়ম করা চলবে না। কিছু ওষুধের নাম লিখে দিয়েছি, ওগুলো আনার ব্যবস্থা করুন।
নাহিদ ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যায়। নিচের ফার্মেসী থেকে ঔষধ ও অন্যান্য সামগ্রী এনে ভেতরে পাঠায়।
আমি কী ওর সাথে একটু কথা বলতে পারি? ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে নাহিদ।
হ্যা, কথা বলতে তো বাধা নেই।
নাহিদ শিউলির কাছে যায়। ডাক্তার স্যালাইন দিয়েছে। পাশে বসতেই শিউলি ঘুরে তাকায় নাহিদের দিকে।
কেমন লাগছে এখন? শিউলির একটি হাত নিজের হাতে তুলে নেয়।
এখন কিছুটা ভালো। তোমাকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিলাম, তাই না?
তুমি ভালো হয়ে উঠলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
ডাক্তার কী বলল? আমাকে কতদিন এখানে থাকতে হবে?
আজ রাতটুকু শুধু। কাল সকালেই বাসায় নিয়ে যাব তোমাকে।
তুমি কী এখন চলে যাবে?
হুম। আমাকে তো এখানে থাকতে দেবে না।
আজ অনেকদিন পর তুমি বাসায় একা থাকবে, খুব খারাপ লাগবে তোমার।
একটা রাতই তো মাত্র, কাল তো তুমি চলে আসছ।

রাত দশটা। অন্ধকারে ছেয়ে আছে চারপাশ। মফস্বল শহরে এই সময়ে রাস্তায় লোকজন কমে যায় অনেক। ল্যাম্পপোস্টের হালকা আলোয় একাকি হেঁটে চলেছে নাহিদ। মনে মনে ঠিক করে নেয় আর একটা মাস পার হলেই শিউলিকে কিছুদিনের জন্য শ্যামলপুরে রেখে আসবে। বাবা-মার কাছে কিছুদিন অন্তত ভালো থাকবে ও।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উপন্যাসঃ ফেরা (পর্বঃ ২১ - ২৫ - শেষ পর্ব)

এ ই উপন্যাসটিতে সম্মুখ সমরের কোন ঘটনা তুলে ধরা হয়নি।  ওয়ারফ্রন্টের কোনও দৃশ্য নেই। তবে এই লেখায় মূলত যে গল্পটি বলার চেষ্টা ক রা হয়েছে  তা মু...