কোন কোন জাতির ইতিহাসে এমন কিছু সময় থাকে যা হাজার বছরেও হারিয়ে
যায় না। একটি জাতি যুগ যুগ ধরে আগলে রাখে সেই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। বাঙালি
জাতির ইতিহাস তেমনি এক গৌরবগাঁথা, দীর্ঘ নয় মাস ধরে অনেক ত্যাগে রচিত এক
মহাকাব্যিক অমরগাঁথা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ! বিশ্ব মানচিত্রে নতুন দেশ হিসেবে
নাম লেখাতে গিয়ে হারাতে হয়েছে অনেক তাজা প্রাণ। কেউ কেউ হারিয়েছেন তাঁদের
জীবনের আরও মূল্যবান কিছু! এই হারানোর সূচনা হয়েছিল আজ থেকে বিয়াল্লিশ বছর
আগের এক রাতে।
একটি রাত। হয়ত কারো কারো জীবনের মধুর রাত কিংবা কোন কোন পরিবারে
আপনজনদের নিয়ে আনন্দমুখর রাত! কত স্বপ্ন নিয়েই মানুষ রাতে ঘুমাতে যায়, রাত
পোহালেই দেখবে একটি সুন্দর সকাল! কিন্তু কখনো কখনো সেই স্বপ্নের রাতই হয়ে
ওঠে দুঃস্বপ্নের; বিভীষিকাময়য়! তেমনি একটি রাত- ২৫শে মার্চ, ১৯৭১। আজ থেকে
বিয়াল্লিশ বছর আগে বাংলার ইতিহাসের ভয়ঙ্করতম একটি রাত, যা আমাদের কাছে আজও
কালোরাত হিসেবে পরিচিত। কি ঘটেছিল সেদিন তা আজ আর কারো অজানা নয়!
সে রাতের মেঘমুক্ত আকাশে হঠাত করেই মেঘ জমতে শুরু করে। রাত বাড়ার সাথে
সাথে মেঘের রঙ গাঢ় হতে হতে একসময়ে কালো মেঘে ঢেকে যায় ঢাকার আকাশ! রাত্রি
তখন দ্বিতীয় প্রহর, ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে সারা শহর জুড়ে। একটানা সেই ভয়ানক
বৃষ্টি আর বজ্রপাতের শব্দে ভারী হয়ে ওঠে ঢাকার আকাশ বাতাস, ভিজে যায় সমস্ত
রাস্তাঘাট। এ বৃষ্টির রঙ লাল, গাঢ় লাল! একেবারে রক্তজবার মত! টকটকে তাজা
রক্ত! লাল রক্তে ভেসে যায় ঢাকার রাজপথ!
এই একটি রাত কেড়ে নেয় অনেক কিছুই-কোন নব বধূর সোনালী স্বপ্ন কিংবা কোন
দুরন্ত কিশোরের মনের আকাশের সবটুকু নীল! কোন সন্তানের কাছ থেকে মমতামাখা
মায়ের আঁচল, মাথার উপর থেকে বাবার স্নেহের ছায়া! আবার কোন মায়ের বুক খালি
করে হারিয়ে যায় আদরের সন্তান! অনেকেই হারিয়েছে তার সর্বস্ব যা আর কোনদিনই
পূরণ হবার নয়!
২৫শে মার্চে সমস্ত বাঙ্গালীর বুকে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে তা আজও শুকায়নি,
কারো কারো বুকে এখনো বিরাজমান সেই দগদগে ঘা! কেউ কেউ হয়ত সেরাতের একটানা
রাইফেলের আওয়াজ কিংবা বাতাসে ভেসে বেড়ানো গুমরে গুমরে কান্নার শব্দ আজও
শুনতে পায়! যে সন্তান পিতাকে সে রাতে রাইফেলের গুলিতে ঝাঁঝরা হতে দেখেছে
তার বুকে কি আজও অনুভব করে না সেই প্রতিটি গুলির আঘাত!
১৯৭০ এর নির্বাচনে ছয় দফা দাবীকে সামনে রেখে এই বাংলার মানুষ তাদের
প্রিয় নেতা মুজিবকে ভোট দিয়ে এনে দেয় নরঙ্কুশ বিজয়। একক সংখ্যাগরিষ্টতা
লাভের পরও শুরু হয় ক্ষমতা হস্তান্তরে ইয়াহিয়া-টিক্কা-ফরমান আলী-ভুট্টো-রাজা
দের নতুন ষড়যন্ত্র। ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে শুরু হয় নানান টালবাহানা!
কোনভাবেই বঙ্গবন্ধুকে ওদের ষড়যন্ত্রের ফাঁদে ফেলতে না পেরে বাঙ্গালিদের
জাতিগতভাবে নিশ্চিহ্নের উদ্দেশ্যে তৈরি হয় মাস্টারপ্ল্যান! ‘অপারেশন
সার্চলাইট’ নামে ২৫শে মার্চেই ঘটানো হয় ইতিহাসের নির্বিচারে গণহত্যার এক
কলঙ্কজনক কালো অধ্যায়! অতঃপর সেই রক্তাক্ত পথ ধরেই রচিত হয় বাঙালি জাতির
মুক্তি সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস! দীর্ঘ নয় মাস ধরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ফসল
আমাদের স্বাধীনতা, ত্রিশ লক্ষ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা, দুই
লক্ষ মা-বোনের ত্যাগের অর্জন আজকের বাংলাদেশ!

এই ছবিটি সম্পর্কে কিছু বলার ভাষা বা সাহস কোনটাই আমার নেই! কোন বিবেকবান
সুস্থ মানুষের পক্ষে কি এ দৃশ্য সহ্য করা সম্ভব? আমি অনেকবার নিজ সন্তানের
চেহারা এখানে ভাবতে চেয়েছি, পারিনি! কোন পিতার পক্ষেই হয়ত সম্ভব না! এই
পৈশাচিক কর্মকান্ড সেদিন ঘটিয়েছিল পাক বাহিনী, আর যাদের মদদে এই অবস্থার
সৃষ্টি হয়েছিল সেদিন, তাদেরকেই রক্ষার জন্য আজও যারা বিচারের বিরুদ্ধে কথা
বলে, তাদের কর্মকান্ডকে তীব্র ধিক্কার!


এই ছবিগুলো ইতিহাসের সাক্ষী! এই ছবিগুলোই একটা সত্য ভাষণ, কথা বলে, সাক্ষী
দেয় সেই বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের! আমাদের পুর্বপুরুষের এই ত্যাগ জাতি কখনো
ভুলতে পারে না। আমরা হারিয়েছি তিরিশ লক্ষ প্রাণ আবার কেউ কেউ কালের সাক্ষী
হয়ে এখনো সেই দুঃস্বপ্নের স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন বছরের পর বছর। বেদনামুক্তির
পথ চেয়ে অপেক্ষার প্রহর কাটে সেই বিচারপ্রার্থী মানুষগুলোর! অনেকে আশা
দেয়, মিথ্যা প্রলোভন দেখায় কিন্তু সেই রৌদ্রজ্জ্বল দিনটি আর আসে না! একসময়
লোহার শেকলে বন্দী হয় তাদের স্বপ্ন, বার বার সেই বলয় থেকে বের হয়ে গিয়ে আরও
আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যায়। ধুলো ময়লা জমে ক্রমে ক্রমে ফিকে হয়ে যায় তাদের
স্বপ্ন আর ততদিনে বিষাক্ত সাপের সর্বগ্রাসী কালো থাবা প্রসারিত হয়, ধীরে
ধীরে বিষ ছড়িয়ে পড়ে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে!
বিয়াল্লিশ বছর ধরে নানাভাবে ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা চলেছে।
যাদের সহযোগিতায় সেদিন এই হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল বিগত সময়গুলোতে সেই
বিষাক্ত সর্পবাহিনীকেই বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করা
হয়েছে। যাদের মদদে রক্তে লাল হয়েছিল সবুজ বাংলা, তারাই একসময় সরকারের অংশ
হিসেবে গাড়িতে লাল-সবুজ পতাকা টাঙ্গিয়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছে ঢাকার রাস্তা!
আজ তারা শুধু ক্ষমতায় বসেই ক্ষান্ত হয়নি, সেইসাথে দেশের অর্থনীতিতে
বসিয়েছে বিশাল থাবা! ধীরে ধীরে আমাদের আশেপাশে গড়ে উঠেছে ওদের অসংখ্য
প্রতিষ্ঠান। দিনে দিনে তা ফুলে ফেঁপে বিশাল আকার ধারণ করেছে। এই বিপুল আয়ের
একটি বড় অঙ্ক ব্যবহার হয় এদের রাজনৈতিক তথা জঙ্গি কর্মকান্ডে! দেশের একটি
বিরাট অংশ এখন ওদের এইসব প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে! শুধু
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারই শেষ কথা নয়, সেই সাথে ওদের অর্থনীতির যে বিপুল
পরিমাণ অর্থ জঙ্গি কর্মকান্ডে ব্যবহৃত হয় তা বন্ধ না করতে পারলে প্রকৃত
অর্থে বিজয় অর্জন সম্ভব নয়।
৫ই ফেব্রুয়ারী, ২০১৩। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দ্বিতীয়
যুদ্ধাপরাধী হিসেবে রায় হল কাদের মোল্লার। কসাই কাদের হিসেবে কুখ্যাত কাদের
মোল্লার বিরুদ্ধে আনীত ৬টি অভিযোগের মধ্যে ৫টি ট্রাইব্যুনালে প্রমানিত
হওয়ার পরও রায় হয় ‘যাবজ্জীবন কারাদণ্ড’। কাদের মোল্লা বিজয় সূচক ‘ভি’
প্রদর্শন করে কোর্ট থেকে বের হয়! দেশবাসী বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়! রায়
প্রত্যাখ্যাত হয় সারাদেশে। ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত বাঙালি এই রায়ের
প্রতিবাদে নেমে পড়ে রাস্তায়। ব্লগাররা আন্দোলনের শুরুটা করলেও একসময়
অভূতপুর্ব সাড়া দিয়ে সর্বস্তরের জনগণ জমা হয় শাহবাগে, শুরু হয় স্বাধীনতার
পর সর্বস্তরের জনতার সবচেয়ে বড় স্বতস্ফুর্ত আন্দোলন, সৃষ্টি হয় প্রজন্ম
চত্বর। তরুন-যুবা-বৃদ্ধ সাবার দাবী একটাই- যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি।

বিয়াল্লিশ বছর পর আজ আবার নতুন করে জেগে উঠেছে বাংলার জনগণ সেই
একাত্তরের চেতনায়! এই দীর্ঘ সময় ধরে একটু একটু করে চেপে রাখা আগুন শাহবাগে
এসে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে! মুহুর্মুহ মুহুর্মুহ স্লোগানে ফেটে পড়ে লক্ষ
জনতা! যুদ্ধাপরাধীদের দাবী পরিণত হয় জনতার প্রাণের দাবীতে! এই আন্দোলনের
অন্যতম বড় ব্যাপার ছিল-এত লম্বা সময় ধরে চলমান আন্দোলনে ঘটেনি কোন
অপ্রীতিকর ঘটনা। অহিংস আন্দোলন ছিল একটা বড় শক্তি! এই শক্তির বিপক্ষ শক্তির
হিংসার ছোবলে অকালে ঝরে গেছে কিছু প্রাণ, তবুও থেমে যায়নি তারুণ্যের
অগ্রযাত্রা!
এই জাগরণ সমাবেশ পণ্ড করতে দেখা যায় নানা ধরনের অপতৎপরতা। নাস্তিকতার
ধুয়া তুলে সাম্প্রদায়িক শক্তি বার বার বিনষ্ট করতে চেয়েছে আন্দোলন, দেশের
ধর্মপ্রান মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ক্ষেপিয়ে তোলা
হয়েছে ব্লগারদের বিরুদ্ধে। অথচ এই অপশক্তিগুলোই যখন মসজিদে ঢুকে জায়নামাজ
পুড়িয়ে ধর্মের অবমাননা করে তখন তথাকথিত বিরুদ্ধ শক্তির চোখ এড়িয়ে যায়।
জাতীয় পতাকা ছিঁড়ে ফেলা কিংবা শহীদ মিনার ভাংচুরও তাদের দেশাত্ববোধের
দেয়ালে আঘাত করে না! অথচ ব্লগারদের যৌক্তিক আন্দোলন ঠেকাতে এই শ্রেণীকে
দেখা যায় অধিকতর সোচ্চার! শুরু থেকেই একটি ব্যাপার যেখানে স্পষ্ট- ধর্মের
বিরুদ্ধে কারো অবস্থান নয়, একমাত্র প্রতিপক্ষ একাত্তরে মানবতা বিরোধী
অপরাধী ও তাদের সংগঠন।
শোকের মাস ফেব্রুয়ারী শেষ দিনটি বাঙালি জাতিকে একটি আনন্দের বার্তা
উপহার দেয়। এই দিনে রায় হয় একাত্তরের ‘দেলু রাজাকার’ ওরফে আজকের দেলোয়ার
হোসেন সাঈদীর। উল্লাসে ফেটে পড়ে শাহবাগ চত্বর তথা গোটা বাংলাদেশ। কিন্তু
দিনের শেষ আলোটুকু নিভে যাওয়ার পরই সারা দেশে শুরু হয় জামাত শিবিরের
তাণ্ডব! সারা দেশে আতঙ্ক সৃষ্টি করে, যার বলি হয় অনেক নিরীহ মানুষ! দুঃখজনক
ব্যাপার হল আবারও প্রতিহিংসার স্বীকার হল সংখ্যালঘুরা! দেশের বিভিন্ন
জেলায় হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা, আগুন দেয়া, লুটপাট থেকে শুরু করে মন্দির,
উপাসনালয় গুলোও রক্ষা পায়নি এই আক্রমণ থেকে!
যেসব মানুষ সেই একাত্তর থেকে বয়ে বেড়িয়েছে বুকের দগদগে ঘা, আজও তারা
অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছে এই ঘাতকদের বিচারের। সচেতন জনতাকে কখনো দাবিয়ে
রাখা যায়নি আর ভবিষ্যতে যে যাবে না তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ আজকের শাহবাগের
গণজাগরণ। সেদিনের তৈরি ক্ষতের রক্তক্ষরণ আজও শেষ হয়নি। মুছে যায়নি মানুষের
মন থেকে ভয়ঙ্কর সেদিনের দুঃসহ স্মৃতি! তাইতো মানুষ আবার জেগে উঠেছে!
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারেরে দাবীতে তরুণ-যুবা-বৃদ্ধর কন্ঠে আজ ধ্বনিত হচ্ছে
একই সুর।
মুষলধারে বৃষ্টি হলে জমিনের সব জঞ্জাল ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায় কিন্তু
মনের ভিতরে জমানো কষ্টের দাগগুলো কি কখনো মুছে যায় ? কখনো কি সেই
কষ্টগুলোকে ভুলে থাকা যায় ? যারা সেই কাল রাত্রিতে ভয়াবহতার শিকার হয়েছিল
কিংবা যারা সেই বর্বরতা প্রত্যক্ষ করেছেন অথবা যারা সেই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের
বিভীষিকাকে বুকের ভিতরে ধারণ করতে পারেন, তারাই এখনো সেই সময়ের এই পৈশাচিক
কর্মকান্ডের জন্য দায়ী অপরাধীদের বিচারের দাবীতে সোচ্চার।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন