শুক্রবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

গল্পঃ শিকড় ছেঁড়ার কষ্ট

ভদ্রলোকের নাম ছিল রনবীর গুহ। পেশায় হোমিও ডাক্তার। সবাই বলত রবি ডাক্তার। আমাদের বাড়ির আনতিদূরেই ছিল ওঁদের বাড়িটি।  রবি ডাক্তারের ছেলে স্বপন ডাক্তার ছিল বাবার ছেলেবেলার বন্ধু, তাই ও বাড়িতে আমার যাতায়াতও ছিল অবারিত। ভদ্রলোককে আমি ডাকতাম দাদু।
 
রবি দাদুর হোমিও ফার্মেসিটি ছিল আমাদের বাজারেই। আমি বাজারে গেলে দাদুর ফার্মেসিতে যাওয়া ছিল অবধারিত। ফার্মেসির দুটি জিনিসের প্রতি আমার আকর্ষণ ছিল প্রবল। প্রথমত ওখানে গেলে উনি মিষ্টি হোমিও ঔষধ (এক ধরনের মিষ্টি ছোট্ট সাদা দানা বিশেষ) খেতে দিতেন যা ছিল আমার অনেক পছন্দের আর ছিল ওঁর ফার্মেসির সেলফে রাখা একটা ছোট্ট সাদা পুতুল। আহামরি কিছু না, তুলা দিয়ে তৈরি হাঁটু ভাঁজ করে বসা এক বৃদ্ধ, দেখতে ছিল অনেকটা রবি দাদুর মতই। পুতুলটির মাথাটি একটি স্প্রিং দিয়ে ওটার শরীরের সাথে আটকানো। হাত দিয়ে মাথাটি ছুঁয়ে দিলেই ওটা দুলত। ওখানে গেলে আমি মুগ্ধ হয়ে ওটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম।
 
ওঁদের বাড়িটি ছিল বেশ বড়। ঘাট বাঁধানো বড় একটা পুকুর ছিল, বিশাল বাগানে ছিল অনেক ধরনের ফলের গাছ। স্বপন কাকার ছেলে রঞ্জু আর আমি একই ক্লাসে পড়তাম। তাই ওর সাথে বেশ ভাব ছিল। সময় পেলেই ওদের বাড়ি চলে যেতাম। কাকীও খুব আদর করতেন। কাকীর হাতের নাড়ু, সন্দেশ বেশ মজার ছিল। আমি আর রঞ্জু বাগানে ঢুকে ছুটোছুটি করতাম, এ গাছ ও গাছের ফল খাওয়া ছিল রোজকার বাপার। মনে আছে পূঁজার সময় ওদের বাড়িতে বেশ কয়েকদিন ধরেই উৎসব চলত। গান বাজনা হত, নানা ধরনের খাবার দাবার থাকতো। সব ধর্মের মানুষই পূঁজা দেখতে আসত। আমরাও অনেক মজা করতাম।

বাবার চাকরির সুবাদে একসময় আমরা গ্রাম থেকে চলে এলাম শহরে। প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগতো। শহরে মন টিকতে চাইত না। গ্রামের সেই পরিচিত মানুষজন, আত্মীয়স্বজন, খোলামেলা পরিবেশ, বাগান, নদী, ফসলের মাঠ এ সব কিছুই খুব মনে পড়তো। আত্মীয় স্বজনদের খবরাখবর সবসময় পেতাম কিন্তু ওদের কোন খবর কখনো কেউ দিত না। আসলে ওদের বাপ্যারে বাসায় তেমন কোন আলোচনা হত না। মাঝে মাঝেই রঞ্জুদের কথা বেশ মনে পড়তো। রঞ্জু, রবি দাদু আর কাকিমার কথা।
 
সময় বয়ে যায়, সময়ের আবর্তে মানুষ অনেক কিছুই ভুলে যায়। শহরে নতুন স্কুলে ভর্তি হয়েছি, স্কুলের বন্ধুদের সাথে মিশে রঞ্জুদের কথা প্রায় ভুলেই গেছিলাম। বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে। আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। একদিন শুনি আমরা গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছি। দীর্ঘ সময় পর বাড়িতে যাবার কথা শুনেই আমার মনে একটা আনন্দের ঝড় বয়ে গেলো। হঠাৎ রঞ্জুদের কথা মনে পড়ল, রবি দাদু, রঞ্জু, কাকী, ওরা কেমন আছে? মনে মনে ভাবি বাড়ীতে গেলে ওদের সাথে তো দেখা হবে।
 
সেদিন বাড়িতে পৌছুতে আমাদের অনেক রাত হয়ে গেলো। বাড়ি পৌছে খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে উঠে নাস্তা সেরে হাটতে হাটতে রঞ্জুদের বাড়ির দিকে গেলাম। আমাদের বাড়িটা ওদের বাড়ির পিছন দিকে তাই ওদের বাগানের পাশ দিয়েই বাড়িতে ঢুকতে হয়। আমি বাগানের পাশ দিয়ে হেঁটে ওদের বাড়িতে ঢুকলাম, উঠানে এসে বেশ অবাকই হতে হল। বাড়িটা জনমানবহীন কেন? নীরব, নিস্তব্দ, কোন মানুষের সাড়া নেই। আমার কেমন যেন খটকা লাগলো, বাড়িটা এত নীরব কেন? সবাই বেড়াতে গেছে নাকি? কিন্তু কতদিন ধরে বেড়াচ্ছে? বাড়িতে আগাছা জন্মে গেছে। আগে তো কখনো এমন দেখিনি! ওদের বাড়ির উঠানে বিভিন্ন ধরনের ফুলের গাছ ছিল এবং সবসময় কোন না কোন ফুল থাকত, আর উঠানটা ছিল খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। পুকুর ঘাটে গেলাম, মনে হল অনেকদিন কেউ এখানে আসে না। বাড়িটা অনেকটা ছাড়াবাড়ির মতই লাগছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। ওদের কারো সাথে দেখা হল না।
বাড়িতে গিয়ে আমার চাচাতো ভাই বসিরকে জিজ্ঞেস করলাম
-রঞ্জুদের বাড়িতে গেলাম দেখলাম কেউ নেই, ওরা সব কোথায় গেছে ?
বসির বলল ওরা তো নাই।
-নেই মানে, কোথায় গেছে?
-ইন্ডিয়া চইলা গেছে।
ভেতরটা এক নিমেষে কেমন যেন ফাঁকা হয়ে গেল। রঞ্জুরাও চলে গেল! আমি ওকে আবার জিজ্ঞেস করলাম, আর রবি দাদুর ফার্মেসি?
-রবি দাদু তো কবেই দেহ ত্যাগ করছে।
মুহূর্তে আমার শরীরটা শির শির করে উঠলো। আমি অবাক হয়ে বললাম, কি বলিস! কবে ?
-তা প্রায় বছরখানেক হইবে। ও জবাব দিল
মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। রবি দাদুর হাসি খুশি রুগ্ন চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। কতদিন ওঁর ফার্মেসিতে গিয়েছি, ওঁর দেয়া হোমিও ঔষধ খেয়েছি। আজ রবি দাদু নেই! আর তার ফার্মেসির সেই ছোট্ট সাদা পুতুলটা, আজও চোখে চোখে ভাসে।
-ওরা চলে গেল কেন ?
বসির কি যেন বলতে চাইল কিন্তু ফজলু চাচার ডাক শুনে ভেতরে চলে গেলো।
 
আমি আবার হাঁটতে হাঁটতে রঞ্জুদের বাড়িতে গেলাম। বাড়িতে ঢোকার মুখে বাগানের দিকে একবার তাকালাম, আগে আরও অনেক ফলের গাছ ছিল। যদিও অনেক দিন আগের কথা কিন্তু এ বাগানের প্রতিটা জায়গা আমার চেনা। রঞ্জু আর আমি এ বাগানে কত ছুটোছুটি করেছি, ফল খেয়েছি। রাস্তার দিকে হেলে পড়া জাম গাছটা এখনও আছে। কতদিন আমি আর রঞ্জু হেঁটে হেঁটে এই গাছটাতে চড়েছি! আর কাকী কি যে আদর করত আমাকে! ও বাড়িতে গেলেই মাথায় হাত বুলিয়ে চুলগুলি এলোমেলো করে দিত আর বলতো কি রে, মুখটা শুকনা কেন? খেয়েছিস? আমি মাথা নাড়াতাম।
 
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক বাহিনীদের অত্যাচারের ব্যাপারে আর নতুন করে বলার কিছু নেই আর দেশীয় রাজাকাররা থাকায় রবি দাদুদের পরিবার ওদের টার্গেটে পরিণত হয়েছিলো। শুনেছি সেই সময়ে ওঁরা কিছুদিন আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাই আমার মার সাথে কাকীর খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। মা মারা যাবার পর কাকী যেন আমাকে আরও বেশী আদর করতেন। আজ সব কথা মনে পড়াতে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। কখন যে নিজের আজান্তে চোখে পানি চলে এলো বুঝতেই পারিনি।
 
বিকালের দিকে বাজারে গেলাম। স্বভাবতই রবি দাদুর ফার্মেসির সামনে দিয়ে যাবার সময় চোখটা আটকে গেল। রবি দাদুর সেই পুরানো মলিন ফার্মেসিটা আর নেই, সেখানে স্থান করে নিয়েছে একটা ষ্টেশনারী দোকান। ঝকঝকে নতুন ফার্নিচারে থরে থরে সাজানো জিনিস পত্র।
 
কয়েকদিন পরেই আমরা গ্রাম থেকে চলে এলাম। অনেক পরে জেনেছিলাম ওরা দেশ ছেঁড়ে যেতে চায়নি, এলাকার প্রভাবশালী মানুষেরা তাদের চলে যেতে বাধ্য করেছিল।
 
এরপর অনেকটা সময় কেটে গেছে। দীর্ঘ সময় আমি গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন। অনেক বছর পরে আবার গ্রামে ফিরে দেখি অনেক কিছুই অপরিচিত লাগছে। রঞ্জুদের বাড়িটা খুঁজে পেতে বেশ কষ্টই হল। ওদের বাড়ির চিহ্ন বলতে শুধুমাত্র একটি হেলেপড়া গাছ ছাড়া আর কিছুই নেই। এই গাছটা ছিল বাগানের দক্ষিণ পাশে। ঘন বাগানটা এখন আর নেই। পুকুরটা ভরাট করে ওখানে নতুন বাড়িঘর উঠেছে, উঠানটার এক পাশ দিয়ে নতুন একটি পাকা রাস্তা করা হয়েছে। এটা আগে ছিল না, এখানে শুধু ওদের বাড়িতে ঢোকার একটা নিজস্ব রাস্তা ছিল।
 
আজ আবার এতগুলো বছর পরে এ পথ দিয়েই যাচ্ছি। আগেরবার যখন এসেছিলাম ওদের বাড়িটা ছিল পরিত্যাক্ত। এখন ওটা আর পরিত্যাক্ত নেই, বেশ কিছু বাড়িঘর উঠেছে। আরও নতুন বাড়ি উঠছে। কে বলবে এখানে এক সময় গুহ ঠাকুরদের বড় একটা বাড়ি ছিল। ঘাট বাধানো পুকুর, বাগানে নানা ফলের সমারোহ, উঠানটা নানা জাতের ফুলে সাজানো থাকতো ? সুখি একটা যৌথ পরিবার যে এখানে বাস করত এখন তার কোন চিহ্নই নেই!
 
যতটুকু শুনেছি আমাদের এলাকার স্থানীয় প্রভাবশালী কিছু মানুষ ও তাদের লোভের কারণেই রবি দাদুদের মত আরও অনেক হিন্দু পরিবারকেই এদেশ থেকে চলে যেতে হয়েছে। আমার মনে কিছু প্রশ্ন বার বার উঁকি দিচ্ছিল- কি ছিল তাদের অপরাধ? তারা অমুসলিম, সংখ্যালঘু ? কিন্তু তারা তো বাঙালি, এদেশই জন্ম, এদেশের মাটির ধুলাবালি মেখে বড় হয়েছে। জন্মস্থান, বসত ভিটা, শৈশব কৈশোরের স্মৃতি, পূর্বপুরুষের শিকড় উপড়ে বুকে কান্না চেপে এ দেশ ছেঁড়ে কেন তাদেরকে চলে যেতে হবে? আর আমাদের সমাজের ভালমানুষরুপী হায়েনারা শত্রু সম্পত্তি দখলের জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়বে। শুরু হবে দখলের নতুন বাণিজ্য। আর কতকাল চলবে এই খেলা ?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উপন্যাসঃ ফেরা (পর্বঃ ২১ - ২৫ - শেষ পর্ব)

এ ই উপন্যাসটিতে সম্মুখ সমরের কোন ঘটনা তুলে ধরা হয়নি।  ওয়ারফ্রন্টের কোনও দৃশ্য নেই। তবে এই লেখায় মূলত যে গল্পটি বলার চেষ্টা ক রা হয়েছে  তা মু...