শনিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

একাত্তরের বিদেশী বন্ধুঃ দুঃসময়ের সারথি (পর্ব-১২)

ম্যারিয়েটা 

একাত্তর কাঁদিয়েছে অনেককে। খোকার জন্য মা, বাবার জন্য সন্তান, স্বামীর জন্য স্ত্রী কিংবা ভাইয়ের জন্য বোন! এ তো গেল সর্বস্ব হারানো অসহায় বাঙালীদের কথা কিন্তু একাত্তরের দুর্দিনে বাঙ্গালীরা ছাড়াও কেঁদেছে অনেক ভিনদেশী মানুষ! তারাই আমাদের দুর্দিনের বন্ধু, সুহৃদ।
ম্যারিয়েটা, পুরো নাম ম্যারিয়েটা প্রকোপে। অক্সফোর্ডে পড়ুয়া পঁচিশ বছরের স্মার্ট, সুন্দরী এক বৃটিশ তরুণী। তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে কি ঘটছে তার বয়সী অনেক তরুণ-তরুনীদের মনেই সাধারণত তেমন কোন প্রভাব ফেলে না কিন্তু এই তরুণীর ক্ষেত্রে এদেশের মানুষের দুঃখকষ্ট দারুণ প্রভাব ফেলেছিল। কখনও বাংলাদেশ দেখেননি ম্যারিয়েটা। গনমাধ্যমে প্রচারিত বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের ছবি, এদেশের মানুষের উপর অত্যাচারের চিত্র চোখে পানি ঝরিয়েছে তার। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের অসহায় মানুষদের দুঃখ দুর্দশা সেই সময় কাঁদিয়েছিল এই তরুণীকে।
একাত্তরের ২০শে এপ্রিল বৃটেনে ম্যারিয়েটার নিজ বাড়িতে অনুষ্ঠিত এক সভায় অংশ নেন পিস প্রেজ ইউনিয়ন, ইন্টারন্যাশনাল কনসেন্স ইন অ্যাকশন, পিস নিউজ, ইয়ং লিবারেলস, থার্ড ওয়ার্ল্ড রিভিউ, বাংলাদেশ নিউজ লেটার ফ্রেন্ডস পিস কমিটি এবং বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটির প্রতিনিধিগন। এই সভাতেই সর্বসম্মতিক্রমে পল কনেটকে সভাপতি আর ম্যারিয়েটাকে সাধারণ সম্পাদক করে গড়ে তোলা হয় একটি নতুন সংগঠন- অ্যাকশন বাংলাদেশ, যার প্রধান কাজ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানীদের দ্বারা সংঘটিত নিশংসতা সম্পর্কে বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করে তোলা
Marietta Procope.jpg
ম্যারিয়েটা বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জনমত গঠনের জন্য নিজেকে নিয়োজিত করেন। চাকরি ছেড়ে দিলেন। দীর্ঘ ৯ মাস, এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অক্লান্তভাবে এদেশের মানুষের জন্য তহবিল সংগ্রহ আর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সমর্থন আদায় করার জন্য কাজ করে চললেন। শুধু তাই নয়, তার নর্থ ওয়েস্ট লন্ডনের ৩৪ স্ট্র্যাটফোর্ড ভিলার ফ্ল্যাটটিই ছেড়ে দিলেন অ্যাকশন বাংলাদেশের অফিস হিসেবে ব্যবহারের জন্য। বিশ্বখ্যাত দ্য টাইমস, দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার মাধ্যমে সারা বিশ্বকে তারা জানিয়েছিলেন বাংলাদেশে চলমান নানান চিত্র। ম্যারিয়েটা তার অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে সংগ্রহ করতেন বিশ্বের নামী-দামী মানুষদের স্বাক্ষর যা অ্যাকশন বাংলাদেশের ব্যানারে ছাপা হত এইসব পত্রিকায়। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মানুষকে সোচ্চার করার লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশে প্রতিনিধি পাঠায় এই সংগঠনটি। বাংলাদেশের দুর্গতদের সাহায্যার্থে গঠন করা হয় ‘অপারেশন ওমেগা’ যার কাজ ছিল সংগৃহীত তহবিল ও ত্রাণসামগ্রী বাংলাদেশে পৌছে দেওয়া।
বাংলাদেশকে তিনি চোখে দেখেননি, শুধুমাত্র এদেশের মানুষের দুঃখে ব্যথিত হয়ে এতকিছু করার পর দেশটি যখন স্বাধীন হয় তখন তিনিও আবেগে আপ্লুত হয়েছিলেন। আর থাকতে পারলেন না লন্ডনে, যে দেশের মানুষদেরকে ভালবেসে এতকিছু করলেন তাদের টানেই ১৯৭২ সালে লন্ডনভিত্তিক রিহ্যাবিলিটেশন কমিটির সদস্য হয়ে চলে এলেন যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে, যাতে আরও বেশি সাহায্য করতে পারেন। ইচ্ছে ছিল চিরদিনই থেকে যাবেন এদেশের মানুষের পাশে। পারলেন না, যে স্বপ্ন নিয়ে তিনি এদেশে এসেছিলেন মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যেই তা ভেঙ্গে গেল। তিনি দেখলেন এক অন্যরকম বাংলাদেশ! যেখানে শুধু লোভ, হিংসা আর কামড়াকামড়ি! যে দেশের মানুষের জন্য তিনি এতকিছু করলেন সেই দেশের কিছু মানুষের কুৎসিত রূপ দেখে তিনি ভেঙ্গে পড়লেন। প্রতিবাদ করায় তাঁকে দেয়া হয়েছিল সিআইএ এজেন্ট অপবাদ। প্রচণ্ড লজ্জা, অপমান নিয়ে তিনি ফিরে গেলেন নিজ দেশে। দেশে ফিরে প্রচন্ডভাবে ভেঙ্গে পড়লেন তিনি, মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শেও কাজ হয়নি। একদিন নিজের জীবন দিয়ে অবসান করলেন তার সমস্ত দুঃখ আর অপমানের জ্বালা। ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারের সেইন্ট গ্রেগরী নিস্টার্স চার্চে তাকে সমাহিত করা হয়। 
Marietta Procope grave monument.jpg
বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষই আজও জানেনা তাদের অকৃত্রিম বন্ধু এই ম্যারিয়েটা কথা! (তথ্যের জন্য কৃতজ্ঞতাঃ মহিউদ্দিন আহমেদ, ছবি- নেট।) 

পল কনেট ও এলেন কনেট
Ellen Langle Connett-2.JPG
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে হাজার হাজার মানুষের দুর্বিসহ জীবন যাপনের চিত্র অনেক বিদেশীদের চিন্তা চেতনাকেও ওলটপালট করে দেয়। ম্যারিয়েটার লন্ডনভিত্তিক কার্যক্রমের সাথে ওতপ্রেতভাবে জড়িয়ে ছিলেন আরও দুজন সংগ্রামী মানুষ, তারা হলেন পল কনেট ও এলেন কনেট। ব্রিটিশ তরুণ স্কুল শিক্ষক পল কনেটকে ভালবেসে বিয়ে করেছিলো নিউ জার্সির মেয়ে এলেন। দুজনেই লন্ডনভিত্তিক ওয়ার রেজিস্টার্স ইন্টারন্যাশনাল (ডব্লিউআরআই) এর সক্রিয় কর্মী। একাত্তরের এপ্রিল থেকে পল, এলেন এবং ম্যারিয়েটা লন্ডনসহ বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সার্বক্ষনিক কর্মী হয়ে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশী শরনার্থীদের জন্য তহবিল ও ত্রাণ সাহায্য সরবারাহ করার জন্য গঠিত অপারেশন ওমেগার সদস্য হিসেবে ভারতে আসেন তারা। একাত্তরের অক্টোবরে শরনার্থীদের জন্য কিছু শীতের কাপড়, মহিলাদের জন্য শাড়ি এবং বিস্কুট নিয়ে গর্ডন শ্ল্যাভেন নামক এক যুবকসহ এলেন কনেট নৌকাযোগে ভারত থেকে যশোরের উপকন্ঠে শিমুলিয়ায় প্রবেশ করেন। ৪ অক্টোবর পাকিস্তানী সেনাদের হাতে বন্দী হন তারা। সরাসরি পাঠিয়ে দেয়া হয় যশোর কারাগারে। অবৈধ অনুপ্রবেশের দোহাই দিয়ে দু বছরের জেল হয়ে যায় তাঁদের।
Ellen News.jpg
বেচারা পলের অবস্থা বেশ নাজুক। স্ত্রীর কোন সংবাদ পাচ্ছেন না। ১লা ডিসেম্বর সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানতে পারলেন এলেন পাকিস্তানী সেনাদের হাতে গ্রেফতার হয়েছে! পাক বাহিনীর যশোরে পতনের ঠিক একদিন পরে অর্থাৎ ৮ই ডিসেবর নিউইয়র্ক টাইমস এলেনের ছবিসহ খবর প্রকাশ করে। যশোর মুক্তির পর মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা কারাগার থেকে এলেনকে মুক্ত করে সসম্মানে পৌছে দেয় কলকাতায়। 

জ্যাক প্রেগার

Dr_Jack_Preger,_founder_of_Calcutta_Rescue.jpg
ডঃ জ্যাক প্রেগার, একজন ব্রিটিশ ডাক্তার যিনি ১৯৩০ সালে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭২, সবেমাত্র ইন্টার্র্নিশিপ শেষ করেছেন জ্যাক, পরিকল্পনা ছিল দক্ষিণ বা মধ্য আমেরিকার দরিদ্র মানুষদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবেন। সেই লক্ষ্যে স্প্যানিশ ভাষা শিখে নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন। ঠিক এরকম একটি সময়ে তিনি খবরটি পেলেন। সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত বাংলাদেশের মানুষদের সাহায্য করার জন্য ডাক্তারের দরকার, যুদ্ধ পরবর্তী সেদেশে অসহায় মানুষ, শিশুদের সাহায্য প্রয়োজন। সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেন জ্যাক, সাহায্য সংস্থা কনসার্নের হয়ে বাংলাদেশে এলেন। এদেশের মানুষের পাশে দাঁড়ালেন, সেবা দিয়ে গেলেন আন্তরিকভাবে। ক্লান্ত হয়ে একসময় দেশে ফিরে গিয়েও থাকতে পারলেন না, এই দেশ আর দেশের মানুষকে ভালবেসে আবার ফিরে এলেন এদেরই মাঝে। এবার নিজ উদ্যোগেই ১৯৭৫ সালে ৯০ বেডের একটি শিশু হাসপাতাল গড়ে তুললেন ঢাকার কমলাপুরে। তার এই ধরনের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে তৎকালীন সরকার গরীব ও অনাথ শিশুদের জন্য একটি আশ্রয়কেন্দ্র তৈরির জন্য অনুরোধ করেন এবং সেই লক্ষ্যে জমিও বরাদ্ধ দেন। এনায়েতপুরে তৈরি হল শিশুদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রও, জ্যাকের তত্বাবধানে সেখানে নির্বিঘ্নে বেড়ে উঠতে লাগলো অনাথ শিশুরা।
শিশুদের সেবা করতে করতেই একসময় তিনি আবিষ্কার করলেন অনাথ শিশুদের দত্তক দেবার নামে এদেশ থেকে প্রচুর শিশু পাচার হয়ে যাচ্ছে ইউরোপে যাদের ব্যবহার করা হচ্ছে পর্নগ্রাফিতে। প্রতিবাদ করলেন জ্যাক, এবং এই পাচার বন্ধ করার জন্য সোচ্চার হয়ে উঠলেন। কিন্তু কোন কাজ হলনা, পাচারচক্রের হাত যে অনেক লম্বা! একা হয়ে গেলেন তিনি, আইনি সহায়তা চেয়েও পেলেন না। উল্টো তাকেই ইহুদী চর এবং শিশু পাচারকারী অপবাদ মথায় নিয়ে এদেশ থেকে বিদেয় নিতে হল।
ডাক্তার জ্যাক প্রেগার এখনও বেঁচে আছেন আর কাজ করে যাচ্ছেন মানুষের জন্যই। আমরা তাঁকে মূল্যায়ন করতে পারিনি সেটা আমাদের ব্যর্থতা, তিনি এখনও বিনামূল্যে অসহায় মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন কলকাতার হাওড়া ব্রিজের আশে পাশের এলাকায়। 

পিটার শোর
Peter-Shore.jpg
পিটার ডেভিড শোর, বিখ্যাত ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ। ১৯২৪ সালের ২০শে মে গ্রেট ইয়ারমাউথে জন্মগ্রহন করেন। বিরোধী দল কিংবা ক্ষমতাসীন দল, যেখানেই থেকেছেন সমানভাবে জনপ্রিয় ছিলেন। তার প্রবল ব্যক্তিত্বের কারণে কনজারভেটিভ দলের অনেক নেতাও তাঁকে বিশেষ সমীহ করতেন। ১৯৭১ এর টালমাটাল অবস্থায় আরও অনেক ব্রিটিশ রাজনৈতিক নেতার মত তিনিও দাড়িয়েছিলেন বাংলাদেশের পাশে, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় থেকেই তিনি বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলেছেন। শোর প্রথমেই ব্রিটিশ কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধ করার সুপারিশ করেন, সেই সাথে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানকে পূর্ব পাকিস্তানীদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে চাপ প্রয়োগের ব্যাপারেও মতামত দেন। তার বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে লন্ডনের দ্য টাইমস ৩রা সেপ্টেম্বর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটির স্ক্যান কপি নিম্নরূপঃ
Statement by Peter Shore-2.jpg

স্যালি উইলোবি
Shalie Weiloby-2.jpg
এই সিরিজের একটি অংশে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাল্টিমোরের জনগণের সহায়তার কথা তুলে ধরেছি। সেখানে অনেক মানুষের কথা বলা হয়েছে যাদের একজন ছিলেন স্যালি উইলোবি। ১৯৭১ এর ১১ই জুলাই, শ্যালির বয়স তখন মাত্র ২৪। বাল্টিমোর বন্দরে পশ্চিম পাকিস্তানের ‘পদ্মা’ নামের একটি যুদ্ধ জাহাজে অস্ত্র তুলতে বাধা প্রদান করতে গিয়ে যারা গ্রেফতার হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে তিনিও ছিলেন। স্যালির পারিবারিক আবহটাই ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের পক্ষে অবস্থান নেয়ার অনুকূলে। তাঁর বাবা জর্জ উইলোবি নিজেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। নির্যাতন সেলে জাপানিদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদও করেছেন তিনি। আর তাঁর মা লিলিয়ান উইলোবি ৯০ বছর বয়সেও ইরাক যুদ্ধে মার্কিন সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করে জেলে গেছেন।
বাংলাদেশের অনেক মানুষই হয়ত তাঁর সম্পর্কে তেমন জানে না। স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশের সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম এর আহবানে প্রথম বাংলাদেশে আসেন স্যালি। এদেশে এসে এদেশের মানুষের আতিথিয়তায় মুগ্ধ হয়েছেন, বার বার আসতে চেয়েছেন এই দেশেই। অনেক শ্রদ্ধা বাংলাদেশের অকৃত্রিম এই বন্ধুর প্রতি। (তথ্যের ও ছবির জন্য কৃতজ্ঞতাঃ ডঃ সুব্রত ঘোষ)

চলবে...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উপন্যাসঃ ফেরা (পর্বঃ ২১ - ২৫ - শেষ পর্ব)

এ ই উপন্যাসটিতে সম্মুখ সমরের কোন ঘটনা তুলে ধরা হয়নি।  ওয়ারফ্রন্টের কোনও দৃশ্য নেই। তবে এই লেখায় মূলত যে গল্পটি বলার চেষ্টা ক রা হয়েছে  তা মু...