শুক্রবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

স্মৃতিচারণঃ বাবা, আমার প্রিয় বাবা

খুব ছেলেবেলায় আমি আমার মাকে হারাই। মার চেহারা কেমন ছিল মনে পড়ে না আমার। সবার কাছ থেকে তাঁর সম্পর্কে শুনে শুনে মায়ের একটি ছবি মনে মনে কল্পনা করে নিয়েছিলাম। মা না থাকাতে বাবাই ছিলেন আমার সব, তিনি একাধারে বাবা ও মায়ের দায়িত্ব পালন করতেন। ফুপু, মামা, খালাদের কাছ থেকেও যথেষ্ট আদর যত্ন পেলেও আমি সব সময়ই বাবার আদরের প্রত্যাশী ছিলাম। সৎ মা, সৎ ভাই বোনদের প্রতি তাঁর দায়িত্ব কর্তব্যের কোন কমতি না থাকলেও বাবার ভালবাসা মাপার যদি কোন যন্ত্র থাকতো, তাহলে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি সবার প্রতি তাঁর ভালবাসার চেয়ে আমার প্রতি ভালবাসার পরিমান অবশ্যই বেশী হত। বাবার কাছে মার তো দূরের কথা, কখনও বকা খেয়েছি বলে আমার মনে পড়ে না।
তখন আমি ক্লাস ফোর এ পড়ি, মামা আমাকে ঢাকায় নিয়ে এলেন। মনে পড়ে কতদিন আমি একা একা কেঁদেছি! আমি বুঝতে পারতাম আমার কাছে আমার বাবাই ছিলেন আমার পৃথিবী, তেমনি তার কাছেও আমিই ছিলাম তাঁর সবকিছু। প্রতি সপ্তাহন্তে আমার লেখা লম্বা লম্বা চিঠি পেয়ে বাবা আর গ্রামে থাকতে পারলেন না। সৎ মা, সৎ ভাই বোনদের গ্রামে রেখে চলে আসলেন ঢাকা, শুধুমাত্র আমার কাছাকাছি থাকার জন্যে। মামার বাসা থেকে একটু দূরে শুরু হলো তার একাকী কষ্টকর জীবন। যে মানুষটা বাড়িতে থাকতে জীবনে কোনদিন রান্না ঘরে ঢোকেননি, তাকে কখনো কখনো রান্না করেও খেতে হয়েছে! পরিণত বয়সে এসে আজ বুঝতে পারি কত কষ্ট দিয়েছি বাবাকে!
প্রতি শুক্রবারটা বরাদ্ধ থাকতো শুধুই বাবার জন্য। খেলা ধুলা, বন্ধু-বান্ধব সব বাদ, আমি তীর্থের কাকের মত অপেক্ষা করতাম শুধু বাবা আসবার মূহুর্তটির জন্য। বাবাও সেদিনের বিকালটা বরাদ্ধ রাখতেন বাপ-ছেলের মিলনের জন্যেই। বিকালে বাবা আসতেন, আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। একেকদিন একেক জায়গায় নিয়ে যেতেন আর আমায় শিক্ষা দিতেন জীবনবোধ, দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি ভালোবাসা। মোটকথা, একজন ভাল মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার যাবতীয় গুনাবলী সব বাবার কাছ থেকেই পাওয়া। জানিনা তাঁর আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পেরেছি কিনা, তবে বাবার শেখানো পথে চলার চেষ্টা অব্যাহত আছে এখনো।
বাবার ব্যক্তিত্ব ছিল অসাধারণ। সেই ছেলেবেলা থেকে দেখেছি বাড়ির সবাই তাঁকে কতটা মান্য করত! তাই বলে কখনো তাঁকে কাউকে জোড়ে ধমক দিতেও দেখিনি। যখনই তিনি বাড়িতে ঢুকতেন, দেখতাম আমার চাচীরা ও অন্যান্য মহিলারা তড়িঘড়ি করে ঘরের ভিতরে চলে যেত। দেখতাম সবাই তাঁর কথা মেনে নিত অবলীলায়, বাড়িতে যত বড় ঝগড়াই হোক বাবা যেন খুব সহজেই মিটিয়ে ফেলতে পারতেন! এটা সম্ভব হত তাঁর প্রতি সবার ভালবাসার জন্যই, এখন বাড়িতে গেলে বুঝি সবাই কেন তাঁর অভাব অনুভব করে!
আমার চাকরী জীবনের প্রথম থেকেই দেখেছি আমি অফিস থেকে না ফেরা পর্যন্ত বাবা বারান্দায় বসে থাকতেন, ক্ষুধা লাগলেও খেতে বসতেন না। আমি মনে করতে পারি না দুজনেই বাসায় আছি অথচ বাবা আমাকে ফেলে খাবার খেয়েছেন। মনে আছে বাবা অনেক সময় মাছ খেতে চাইতেন না, আমি কাঁটা বেছে দিতাম আর বাবা ঠিকই বাধ্য ছেলের মত খেয়ে উঠতেন। আজ এসব কথা মনে হলে বুক চিড়ে শুধুই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
বাবার শেষ কটা দিন ছিল খুব কষ্টের । তৃতীয় বার ব্রেইন স্ট্রোকে সেই যে জ্ঞান হারালেন আর চোখ মেলে তাকালেন না আমার প্রিয় বাবা। দশ দিন! একটানা দশ দিন ধরে হসপিটালে মৃত্যূর সাথে লড়াই করে অবশেষে হার মানলেন । আমাকে একাকী করে চিরতরে চলে গেলেন। আমার মাথার উপর রইল না কোন ছায়া।
বাবা মারা যাবার পরের দিনগুলো যে কি দুর্বিষহ কেটেছে আমার তা কাউকে বোঝানো যাবে না। সারা ঘরে বাবার স্মৃতিচিহ্ন। তাঁর রুমের সব জিনিসপত্রগুলো বার বার জানান দিত তাঁর অনুপস্থিতি। তাঁর ব্যবহৃত জামা কাপড়, চশমা, ছড়ি, তাঁর সেলফে সাজানো বইপত্র- সবই বার বার শুধু তাঁকে মনে করিয়ে দিত। খাবার টেবিলটা আমার জন্য খুবই কষ্টকর জায়গা হয়ে দাঁড়াল। বাবার জন্য নির্ধারিত আমার ডান পাশের চেয়ারটার দিকে তাকালে বুকের ভিতরটা হু হু করে উঠত। বাবা নেই ভাবতেই বুকটা যেন ভেঙ্গে যেত।
আজ দীর্ঘ ছয় বছর ধরে প্রতিনিয়ত বাবার অভাব অনুভব করে চলেছি। এই লেখা লিখতে গিয়ে দুচোখ আবারও ভিজে উঠেছে নিজের অজান্তে। এ কান্না শুধুই আমার, একান্তই।

রচনাকালঃ জুন ১৭, ২০১২

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উপন্যাসঃ ফেরা (পর্বঃ ২১ - ২৫ - শেষ পর্ব)

এ ই উপন্যাসটিতে সম্মুখ সমরের কোন ঘটনা তুলে ধরা হয়নি।  ওয়ারফ্রন্টের কোনও দৃশ্য নেই। তবে এই লেখায় মূলত যে গল্পটি বলার চেষ্টা ক রা হয়েছে  তা মু...