মানুষ মাত্রই স্বপ্ন দেখে, আমি সব সময়ই চাইতাম- আমাদের একটা মেয়ে হবে।
সে হাসবে, খেলবে, সারা ঘরময় ছুটে বেড়াবে! একসময় আমার সেই স্বপ্ন সত্যি হল।
আমার মেয়ে এখন সারাক্ষণই ঘরকে মাতিয়ে রাখে। সারা ঘরময় ওর ছুটে বেড়ানো, পাকা
পাকা কথা বলা, দুষ্টুমি, মান-অভিমান আমাদেরকে এক ভিন্ন আবেশে জড়িয়ে রাখে, ও
চুপ করে থাকলেই বরং ভাল লাগে না !
আজ থেকে প্রায় চার বছর আগে এক শীতের দুপুরে আমাদের কোল জুড়ে এলো আমাদের
একমাত্র মেয়ে রিয়াসা। ওর জন্মটি আসলে খুব সহজ ছিল না ! দীর্ঘ তিন বছর ওর
মায়ের চিকিৎসা, অপারেশন, তারপর প্রেগ্ন্যান্সীতে টাইফয়েডের কারণে লম্বা
সময়ের জন্যে হসপিটালাইসড, হাই এন্টিবায়োটিক গ্রহণ-এ সব বাধা অতিক্রম করে
সুস্থ একটি বেবি পাওয়া আমাদের জন্যে ছিল একটি বিশাল ব্যাপার ! আমাদের বহু
আকাঙ্ক্ষিত, ডাক্তারের ভাষায় “আ ভ্যালুয়েবল বেবি” রিয়াসা যখন এ পৃথিবীতে
এলো সেদিনের আনন্দের কথা আমি কখনো ভুলতে পারব না, আমার জীবনের সবচেয়ে
আনন্দের মুহূর্ত ছিল সেই ক্ষণটি। জন্মের পর চাইল্ড স্পেশালিষ্ট যখন ওকে
সম্পূর্ণ সুস্থ বললেন, আমার মনে হয়েছিল বুকের উপর থেকে বিশাল এক ভার নেমে
গিয়েছিল !
জন্মের পর থেকে প্রথম তিন মাস রাতে দুই থেকে তিন ঘন্টার বেশী ঘুমাতে
পারিনি। সারারাত জেগে থাকতো আর কাঁদত, সকাল হলে ঘুম! আমার অফিস থাকায় রাত
আড়াইটা-তিনটার দিকে আমি ঘুমিয়ে যেতাম কিন্তু ওর মা’র আর সারারাতে ঘুম হত
না। তিন মাস পর ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসে আমাদের রিয়াসা।
ছয় সাত মাস থেকেই আধো আধো বলে কথা বলতে শুরু করল! বছর পূর্ণ হতেই অনেক
কথাই স্পস্টভাবে বলত, খুব মজা লাগত যখন সব কথার সাথেই ‘ই’ যোগ করত! বাবা’কে
বলত ‘বাবাই’ মা’কে বলত ‘আম্মাই’ এভাবে মামাই, দাদাই। সেই সময় তার সবচেয়ে
পছন্দের জিনিস ছিল জুতা, ও বলত-জুতাই। কোন মার্কেটে জুতার দোকানের সামনে
দিয়ে যাবার সময় জুতার দোকান দেখিয়ে দিয়ে সে চিৎকার করে বলত বাবাই দেকো-
জুতাই! এ ব্যাপারটা নিয়ে সবাই বেশ মজা করত!
বাসায় ঢোকার সাথে সাথেই ঝাপিয়ে পড়ত আমার কোলে, কাঁধে নিয়ে সারা ঘরে
ঘুরতে হত, তাকে অনেকক্ষন আদর করে তবে নিজে ফ্রেস হওয়া। দু’গালে পাপ্পা দিয়ে
বলত বাবা, তোমাকে আমি এতোগুলো বালবাছি। আর মামনিকে ভালাবাস না ? হ্যা,
মামনিকে এতুকু বালবাছি। ওর মা কপট রাগ দেখিয়ে বলত- কি! বাবাকে এতোগুলো আর
আমাকে এটুকু ! দাড়াও, আমি তোমাকে কাল গোসল করিয়ে দিবনা, খাইয়ে দিবনা ! আমার
মেয়ে মাকে খুশি করার জন্যে সাথে সাথে বলত-মামনি, তোমাকেও এতোগুলো বালবাছি।
ওর মা তখন হেসে বলত- দেখেছ, তোমার মেয়ে এখনি কেমন ব্যালেন্স করতে শিখে
গেছে !
কিছুদিন যেতেই তার কথা বলার ধরন বদলে যেতে থাকে। তখন সবাইকে সে আপু বলে
সম্ভোধন করতে শুরু করে- বাবা’কে- ‘বাবামনি আপু’, মা’কে ‘আম্মু বাবুনি আপু’।
ওর মা ঠিক করে দিতে চাইলে আমি বারন করতাম, আমি বলতাম-বলুক না এভাবে! সময়
গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি ওর এই নতুন নতুন কথা বলার ধরনটা বেশ এনজয় করতাম !
ওর বয়স যখন দুই বছর, একদিন অফিসে বসে ওর মায়ের ফোন পেলাম । ও কেঁদে
কেঁদে শুধু বলল-রিয়াসা পুড়ে গেছে, তুমি তাড়াতাড়ি বাসায় এসো। আমি অনেক
প্রশ্ন করলেও ও আর কিছু বলতে পারলো না, আমি শুধু ওপাশ থেকে কান্নার শব্দই
শুনতে পেলাম। আমি মুহূর্তকাল বিলম্ব না করেই বাসায় চলে এলাম। এসে দেখি
দুষ্টুমি করতে গিয়ে গরম চালগুড়া স্যালাইন গাঁয়ে ফেলে পুড়িয়ে ফেলেছে অনেকটা
শরীর। সাথে সাথে নিয়ে গেলাম সিটি হসপিটালে। আমাদের বাহিরে রেখে ওকে যখন
ড্রেসিঙের জন্যে ভিতরে নিয়ে গেল- ভিতর থেকে শুধু ওর চিৎকার শুনছিলাম- বাবা
আমাকে কোলে নাও, মামনি আমাকে কোলে নাও। ভিতরটা তখন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে
যাচ্ছিল ! মন চাচ্ছিল এখনি ছুটে যাই ওর কাছে ! সেই মুহূর্তে আমি ফিল
করছিলাম- ছেলেবেলায় কেন আমার বাবা সবকিছু গ্রামে ফেলে শুধুমাত্র আমার ডাকে
ঢাকা চলে এসেছিলেন !
ওর মায়ের নামে নালিশ যেন প্রতিদিনের রুটিন। অফিস থেকে ফিরলেই তার শুরুটা
হবে এরকম- বাবা! মামনি আমাকে বকেছে, পিঠ দেখিয়ে বলে- আমাকে এখানে মেরেছে।
আমাকে অবশ্যই তার পক্ষ নিতে হবে, না হলে শুরু হয়ে যাবে আমার সাথে আড়ি।
অনেকক্ষণ লাগবে তার মন গলাতে!
প্রতিদিনের নালিশের মধ্যে আরেকটা বিষয় হল কার্টুন। বাবা জান! মামনি আমাকে
একটুও কার্টুন দেখতে দেয়না, শুধু সিরিয়ালই দেখতে থাকে! বাবা চল, তুমি আমার
সাথে কার্টুন দেখবে। অগত্যা কি আর করা! মেয়ের কল্যানে এখন আমাকে কার্টুনও
দেখতে হয়। টম এন্ড জেরী, ডরিমন, ছোটা ভীম- মেয়ের সাথে এ সব কার্টুনের আমিও
এখন নিয়মিত দর্শক।
রাতে ঘুমাতে গেলে তার প্রতিদিনের আবদার-গান শোনাতে হবে! বাবা গ্রামছাড়া
শোনাও, শোনালাম। এবার পুতুল পুতুল শোনাও, তাও শোনালাম। কোলাবেরি, আয় খুকু
আয়, আলু বেঁচো ছোলা বেঁচো... এভাবে একের পর এক গান শোনানোর পর একসময় বাবার
গলা ধরে ঘুমিয়ে যায় সে। এটা নিত্যদিনের ব্যাপার! কবে শুরু হয়েছিল ঠিক মনে
নেই, এখনো চলছে!
ক’দিন আগে অফিসের কাজে চিটাগং গিয়েছিলাম, যতদিন ছিলাম প্রতিরাতে আমাকে
এই অভিযোগ শুনতে হয়েছিল। বাবা, তুমি আসছ না কেন ? আমি তোমার সাথে ঘুমাবো।
মামনি, আমি তো আজ আসতে পারবো না, আমি তো অনেক দূরে চলে এসেছি! তুমি তোমার
মামনি’র সাথে ঘুমাও ! মামনি তো গান শোনায় না, শুধু বকা দেয়। আমাকে না পেলে
যেন ওর ঘুমও ঠিক মত হয় না ! সারাদিন মায়ের সাথে থাকলেও ঘুমের সময়টায় তার
বাবাকে চাই । আমার নিজেরও মেয়ের জন্যে মন খারাপ থাকে। কাজ শেয হলে আর দেরি
করি না, যত তাড়াতাড়ি পারি ছুটে আসি মেয়ের কাছে ।
ছেলেবেলায় শখ ছিল গাইয়ে হব, হওয়া হয়নি। তাই দুধের সাধ ঘোলে মিটানোর মত
আমাকেও এই বয়সে একদিন পেয়ে বসেছিলো ভায়োলিন শেখার ভীমরতিতে। সন্ধ্যায় বাসায়
ফিরে বঊ-বাচ্চাকে সময় দিয়ে যখনই প্রাকটিস শুরু করতাম- মেয়ে হাজির! আমাকে
ভালিন দাও, আমি ভালিন বাজাবো। কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ তার আবদার মিটানো, বেশ
কিছুক্ষণ ধরে ভায়োলিনের উপর চলে বো এর অত্যাচার ! অবশেষে ওর মা এসে উদ্ধার
করে ! আচ্ছা ছিক আছে (ঠিক আছে) বাবা তুমি ভালিন বাজাও, আমি মামনির সাথে
খেলা করি !
বাহিরে কোথাও গেলে মাকে যেন সে চেনেই না ! সারাক্ষন বাবার সাথে, আর নানা
প্রশ্ন করে অস্থির করে তোলে। রিক্সা করে কোথাও যাচ্ছি, শুরু হয়ে যায়
প্রশ্নর পর প্রশ্ন- বাবা, কুকুরটা ওখানে কি করে? শুয়ে আছে মামনি। ওর ঘর
নেই? না, রাস্তাই ওর ঘর। ওর ঘর নেই কেন? মাইক্রোটা দাঁড়িয়ে আছে কেন? এটা
কি, ওটা কি ? যতক্ষন আমার সাথে থাকবে একটার পর একটা প্রশ্ন চলতেই থাকবে।
আমি মনে করি এটাই এ বয়সী একটা বাচ্চার বৈশিষ্ট্য, এই বয়সের একটা বাচ্চা
চুপচাপ থাকবে এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারিনা। যত কিছুই হোক, ওর মা বিরক্ত
হলেও আমি হতে পারি না, এনজয় করি !
একসময় আমার রিয়াসা বড় হয়ে যাবে, আমার থেকে দূরে সরে যাবে অনেকটাই। যত
দিন যাবে ওর নিজস্ব একটা জগত তৈরী হবে। তখন আজকের ওর এই চঞ্চলতা, দুষ্টুমি,
পাকা পাকা কথা বলা খুব মিস করব। তাই যতদিন ও এরকম থাকে আমি উপভোগ করি
প্রতিটি মুহূর্ত। আমার অবসরের বেশীর ভাগটাই এখন ওকে ঘিরে।
রচনাকালঃ ২৫-০৮-২০১২
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন