শিশুটির বয়স মাত্র আড়াই বছর। ভালমত হাঁটতে পারেনা এখনও। বেশ ক’দিন ধরেই মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত সে। কান্নাভেজা কচি দু'টি চোখ খুঁজে ফেরে শুধু মা’কে। মা আর আসে না, আসতে পারে না। এগিয়ে আসে
ফুপু,
কখনো খালা কিংবা নানী। কোলে
তুলে নেয় ছোট্ট শিশুটিকে, চেষ্টা চলে কান্না
থামানোর। কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়েও পড়ে।
মফস্বল শহরের একটি হাসপাতালে মৃত্যুর
সাথে পাঞ্জা লড়ে চলে এক দুখিনী মা।
চেতনে অবচেতনে অস্ফুট স্বরে কেবলই একমাত্র আদরের সন্তানের নাম
ধরে ডাকে। দু’চোখ
বেয়ে নামে অশ্রুর ধারা, মনে আফসোস- তার কিছু হলে তার সন্তানকে
কে দেখবে? ও
তো এখনও ভালমত হাটতেই পারেনা! পাশে বসা মা, বোনের হাত
ধরে অনুরোধ-
আমার ছেলেটাকে তোমরা দেখো। একসময় সবকিছু শেষ হয়ে যায়, চৈত্রের
এক দুপুরে
হতভাগিনী মা তার একমাত্র শিশু সন্তানটিকে ফেলে রেখে পাড়ি জমায়
অন্য ভুবনে,
যেখান থেকে কেউ কখনো ফিরে আসে না।
ছোট্ট শিশুটি বুঝতেও পারে না মা তাকে
ফাঁকি দিল চিরতরে,
আর কোনদিন ফিরে পাবে না
মায়ের কোমল শীতল ছায়া। দিন
গড়িয়ে যায়,
একটু একটু করে মা হারা শিশুটি বড়
হতে থাকে মায়ের আদর ছাড়াই। নানী, খালা, ফুপুদের
আদরের যদিও কোন
কমতি ছিল না, তবুও মায়ের স্নেহটা কেমন তা কখনই জানা
হয় না তার। ছেলেটি একসময়
হাঁটতে শিখে,
সবাই খুব আফসোস করে বলে- ওর মা ছেলের হাটা দেখে যেতে পারলো
না!
কিছুদিন কেটে যাবার পর ঘরে আসে নতুন মা। আত্মীয়রা
সবাই চলে যায় যার যার অবস্থানে, ছেলেটি
পড়ে থাকে সৎ মায়ের কাছেই। প্রথম
প্রথম ভালই আদর পায়। তারপর
ধীরে ধীরে বদলে যায় দৃশ্যপট। একসময় নতুন মা নিজের করে নেয় সংসার। প্রবাদ
আছে- পর কখনো আপন হয় না, সবক্ষেত্রে এই তত্ত্ব সঠিক না হলেও এই ছেলেটির
ক্ষেত্রে যেন মিলে যায়! দূর থেকে সবাই দেখে অতি আদরের ছেলেটির দিন কাটছে
অবজ্ঞা-অবহেলায়! একই বাড়িতে বসবাসকারী ফুপুর দুচোখে কেবলই অশ্রু ঝরে।
বাবার আদরের কমতি ছিল না কোনো, বাবাকে
দেখলেই কেমন যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠত ছেলেটির দু’টি
চোখ। ধীরে
ধীরে বাবাও বুঝতে পারে তার আদরের ছেলের যত্ন হচ্ছে না
ঠিকমত। ফুপু, নানী, মামাদের
কাছ থেকে অভিযোগ আসতে থাকে বাবার কাছে।
বাবা ভেবে পায় না তার সন্তানকে কিভাবে মানুষ করবেন। একসময় এগিয়ে
আসে নানী-মামারা। ছেলেটিকে
নিয়ে যায় তাদের কাছে। বাবার
মন খারাপ হলেও ছেলের ভবিষ্যৎ ভেবে যেন হাফ ছেঁড়ে বাঁচেন!
নানী-খালা-মামাদের কাছে আদরেই থাকে
ছেলেটি। চুপচাপ
অভিযোগহীন দিন যাপন! একটু একটু করে বেড়ে ওঠে আর গড়ে ওঠে তার
আপন ভুবন। নদীর
পাড়ে,
গাঁয়ের পথে একা একাই ঘুরে বেড়ায়, আপন
করে নেয় প্রকৃতিকেই। সবাই
বলে খুব শান্ত ছেলে। ছেলেটিও
বুঝতে পারে এখানে যতই আদর যত্নে থাকুক, এটা তার
নিজের বাড়ি না,
এই ব্যাপারটা মনে আরও বদ্ধমূল হয়ে ওঠে যখন
কোন আগন্তুকের সমনে সবাই বেশী কর মনে করিয়ে দিত! নতুন মেহমান এলেই অনেকেই
বলে উঠতও- ওহ! এই ছেলেটির মা নেই! আহারে! মা
ছাড়া ছেলে কেমন করে মানুষ হবে? মানুষের এই কথাগুলো তার মনের কষ্টটা
যেন আরও বাড়িয়ে দিত কয়েকগুণ!, কেবলই মনে হত- সে এখানকার কেউ না, এখানে
সে আশ্রিত মাত্র। সে
ধীরে ধীরে খুব আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। প্রয়োজন ছাড়া
কারো সাথে তেমন কথাই বলত না, কেবল বাবার জন্য বুকের ভিতরটায় একটা শূন্যতা
অনুভব করতো কিন্তু কারো কাছে প্রকাশ করত না। সবাই বুঝত, কারণ একমাত্র
বাবার উপস্থিতিতেই ছেলেটি কেমন যেন উচ্ছ্বল-চঞ্চল হয়ে ওঠত!
একসময় গ্রাম ছেঁড়ে মামার সাথে শহরে পাড়ি
জমায়। আবার
সেই বুক ভাঙা কষ্ট! শুরু হয় শহুরে বন্দী জীবনে বুকের ভিতর
চাপা কান্নার ঢেউ আটকে রেখে দিনযাপন।
কেউ দেখে না, কেউ জানতেও পারে না ছাদের নির্জন কোণে
নিরবে নিভৃতে অশ্রু ঝরে। এ কান্না তার ফেলে আসা প্রিয় সবুজ গ্রাম, নদী
আর একমাত্র প্রিয় বাবার জন্য। আর একজনের অভাব সে কখনো ভুলতে পারে না। কতই বা বয়স!
দশ কি এগারো!
বাবার জন্য চাপা কান্না, মায়ের জন্য
হাহাকার বুকে নিয়ে একটু একটু করে বড় হয় ছেলেটি। দূর আকাশের
তারার মাঝে খুঁজে ফেরে মাকে...
অনেক বছর কেটে গেছে। সেই
ছেলেটি আজ আর ছোট্টটি নেই, আজ সেও একজন বাবা। একমাত্র কন্যা তার বুক জুড়ে আছে, আর
পূরণ করে দিয়েছে তার মায়ের অভাব। এখন তার একান্ত
চাওয়া - তার সন্তান যেন তার মত কষ্ট না পায়, ও যেন কখনো
মায়ের
অভাব বোধ না করে। বাবা-মা ছাড়া বড় হওয়ার কষ্ট ওকে যেন
কোনদিনও পেতে না হয়।
তার মেয়ে আজ তাকে ভুলিয়ে দেয় মা না
থাকার বেদনা,
শুধু ভুলতে পারেনা মায়ের
চেহারা মনে করতে না পারার কথা। মায়ের কোন ছবি মনে পড়ে না তার, মনে করতে
পারেনি কোনদিনও-এই বিষয়টা আজও তাকে পীড়া দেয়। তারাভরা রাতে আকাশের দিকে তাকালে আজও মনে পড়ে যায় ছেলেবেলায়
সেই নির্জন রাতে ছাদের কোণে একাকী অশ্রু ঝরানো দিনগুলির কথা। মনে পড়ে কত রাত
একা একা আকাশের তারাদের মাঝে খুঁজে ফিরেছে মাকে.....!!!
শিরোনামটা একটি প্রিয় গানের কলি- ও তোতা
পাখিরে..
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন