মার্শাল জোসিপ ব্রজ টিটো, সাবেক যুগোস্লাভিয়া

সাবেক
যুগোস্লাভিয়ার অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিত্ব মার্শাল জোসিপ
ব্রজ টিটো ১৮৯২ সালের ৭ মে জন্মগ্রহন করেন। তিনি একাধারে তিনি
যুগোস্লাভিয়ার প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ১৯৪৫ থেকে মৃত্যু-পূর্ব
পর্যন্ত দুর্দণ্ড প্রতাপে দেশ পরিচালনা করেন। কমিউনিস্ট নামীয় রাজনৈতিক
দলের তিনি সদস্য ছিলেন। তাঁর অন্যতম কৃতিত্ব হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের
পর সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বলয়ে অবস্থান করে যুগোস্লাভিয়া
সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র গঠন করা। পরবর্তীতে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে নেতার
ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া। যুগোস্লাভিয়ার বিবাদমান বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীকে
একত্রিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর এক দশকের
মধ্যে তা গৃহযুদ্ধের রূপান্তরিত হয়ে দেশটি ভেঙ্গে যায়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস হত্যা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে
মার্শাল জোসেফ ব্রজ টিটো বাংলাদেশের নিপীড়িত মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত
বাড়ান। তিনি বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে জোরালো সমর্থন জানান।
জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতা হিসেবে তিনি ছিলেন জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের
সমর্থক এবং তাঁর ভূমিকা বাংলাদেশের পক্ষে তৃতীয় বিশ্বের সমর্থন জোরদার করে।
১৯৮০ সালের ৪ঠা মে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
অধ্যাপক সুয়োশি নারা, জাপান
মুক্তিযুদ্ধে
যে ক’জন বিদেশী সুহূদ বাংলাদেশকে আপন করে নিয়ে আমাদের সাহায্যে এগিয়ে
এসেছিলেন অধ্যাপক সুয়োশি নারা তাদের মধ্যে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি
বাংলাদেশের এক অকৃত্রিম বন্ধু। একাত্তরে পাক হানাদারদের গনহত্যা আর
ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে নিজের জীবনের ঝুকি নিয়েও বাংলাদেশের নিপীড়িত মানুষের
পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেন স্টাডিজ বিভাগের
বাংলার অধ্যাপক সুয়োশি নারা আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সহযোগিতার হাত
বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
মহান
মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে স্বীকৃতিস্বরূপ সম্মাননা গ্রহন
করতে ঢাকায় আসা সুয়োশি নারারে ইংরেজিতে প্রশ্ন করতেই মৃদু হেসে অধ্যাপক
সুয়োশি নারা বললেন, “আমি বাংলা জানি। বাংলায় প্রশ্ন করুন।” তারপর শিশুসুলভ
হাসি ছড়িয়ে বললেন, ‘আমি বাংলাদেশে নতুন নই, প্রায়ই আসা হয়। আমি অর্ধেক
বাঙালি, অর্ধেক জাপানি। দুই দেশই আমার প্রিয়।' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক
ভাষা ইনস্টিটিউট আমার হাতেই গড়া। ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করেছি। বঙ্গবন্ধু যখন মারা যান, তখন আমি ঢাকাতেই
ছিলাম।’
মুক্তিযুদ্ধের আগে অধ্যাপক নারা পাকিস্তানে কর্মরত ছিলেন। যুদ্ধের শুরুর
সময়টাতে টোকিওতে কাজ করছিলেন তিনি। এরকম একটি সময় যুদ্ধের খবর পান,
বাংলাদেশী শরণার্থী শিবিরগুলোর করুণ চিত্র প্রবলভাবে নাড়া দেয় তার ভিতরটা।
অধ্যাপক নারা জানান, স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হওয়ার এক সপ্তাহ পর তারা
জাপান-বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতি গঠন করেন। সমিতির মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করে তা
দিয়ে ত্রাণসামগ্রী কিনে নিয়ে যান কলকাতার সল্টলেকের শরণার্থী শিবিরে। ১২০
জন সহকর্মীকে যুক্ত করেন এর সঙ্গে। ত্রাণ কার্যক্রম চলাকালে দু’বার কলকাতায়
আসেন শরণার্থী শিবিরে ত্রাণ বিতরণে।

তাকামাসা সুজুকি, জাপান
তাকামাসা
সুজুকি, একাত্তরে আমাদের আরেক জাপানী বন্ধু, যিনি মক্তিযুদ্ধকালে
বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠন ও ত্রাণ সহায়তার জন্য কাজ করেন। মুক্তিযুদ্ধে
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে স্বীকৃতিস্বরূপ সম্মাননা গ্রহন অনুষ্ঠানে
সঙ্গী গাইডকে জাপানি ভাষায় তিনি বলে যাচ্ছিলেন তার যুদ্ধকালীন স্মৃতির কথা।
স্বাধীন হওয়ার পর তিনি আরও বেশ কয়েক বার বাংলাদেশে এসেছেন। যুদ্ধের সময়
বাংলাদেশের মানুষের জন্য পরম বন্ধু হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি।
তবে
বাংলাদেশের আমন্ত্রনে এবারের আসাটা তার জন্য অন্যরকম আনন্দের, এটিকে
সম্পুর্ন ভিন্নদৃষ্টিতে দেখছেন তিনি। বাংলাদেশ তার সেই বন্ধুত্বের
আনুষ্ঠানিক মূল্যায়ন করছে। সুজুকি বলেন, এটা আমার জীবনের বড় প্রাপ্তি। তিনি
বলেন, আমি কোন ব্যক্তির জন্য বা দেশের জন্য কাজ করিনি। আমি কাজ করেছি
মানবতার জন্য। আমাকে যে সম্মান দেয়া হচ্ছে, সেটিও মানবতাকেই সম্মান করা।
বিমান মল্লিক, ইংল্যান্ড (ভারতীয় বংশদ্ভুত)
বিমান
মল্লিক, পুরো নাম বিমান চাঁদ মল্লিক। একজন লন্ডন প্রবাসী ভারতীয় গ্রাফিক
ডিজাইনার। লন্ডনে বসে তিনি বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকিটের নকশা করে
দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৯ জুলাই মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ নামে প্রথম
আটটি ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়। একটি ডাকটিকিট যে শুধু ডাকমাশুল আদায়ের
মাধ্যম নয়, ইতিহাসেরও একটি অংশ, তা প্রমাণ করেছে বাংলাদেশের প্রথম আটটি
ডাকটিকিট। ১৯৭১ সালের ২৯ এপ্রিল ব্রিটিশ ডাক বিভাগের তৎকালীন পোস্টমাস্টার
জেনারেল জন স্টোনহাউস লন্ডন প্রবাসী ভারতীয় ডিজাইনার বিমান মল্লিককে
বাংলাদেশের জন্য ডাকটিকিটের ডিজাইন করার অনুরোধ জানান।
বাংলাদেশ এই
যুদ্ধবন্ধুকেও এবার সম্মাননা জানাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ঘুরে ঘুরে তিনি
দেখছিলেন সে সময়ের স্মৃতি। সম্মাননার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে
তিনি বলেন, আমি যখন এই সম্মাননার কথা প্রথম আমার মেয়েকে জানাই, তখন
প্রথমেই সে বলে- বাবা তুমি তো অনেক আগেই বড় সম্মান পেয়ে গেছ। তুমি
বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকিটের নকশা করেছো। এর চেয়ে বড় সম্মাননা আর কি হতে
পারে?
ডেভিড ম্যাকাচ্চন, ইংল্যান্ড
ডেভিড
ম্যাকাচ্চনের জন্ম ইংল্যান্ডের কভেন্টির এক মধ্যবিত্ত পরিবারে ১৯৩০ সালের
১২ আগস্ট। তিনি শিক্ষালাভ করেন কভেন্টির কিং হেনরী এইট গ্রামার স্কুলে,
তারপর আঠারো মাস (১৯৪৯-৫০) দেশের আইনানুযায়ী সামরিক কর্মে যোগদান করেন।
এরপর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা জীবনে কেম্ব্রিজের ‘যেশাস কলেজ’ এ অধ্যায়ন করেন
১৯৫৩ সাল পর্যন্ত। ১৯৫৫ সালে ইংরেজী-ফ্রেঞ্চ ও জার্মান ভাষা-সাহিত্যে
‘ট্রাইপস’ পেয়ে স্নাতক এবং ১৯৫৭ সালে কেম্ব্রিজ থেকে স্নাতোকোত্তর হন।
ডেভিড ১৯৫৭ সালে ভারতে আসেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজীর প্রভাষক
হিসেবে। পরবর্তীতে ১৯৬০ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক ভাষা
সাহিত্যের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯৬৪ সালে ঐ বিভাগের রিডার পদে
উন্নীত হন। ভারতবর্ষ ও রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে তাঁর যথেষ্ট কৌতুহল ছিল। তাই
বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি তাঁর একটি অপরিসীম মায়া ছিলো। তিনি তাঁর এক লেখায়
লিখেছেন- “বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যে একটা প্রাণ আছে যা এই অঞ্চলের মানুষদের
বাঁচিয়ে রাখে। এই সংস্কৃতি কোন ধর্ম-সমাজ-বর্ণ বা গোত্র দ্বারা বিভক্ত না,
যদিও এখানে বৈচিত্র্য লক্ষ্যণীয়।“
ডেভিড
ম্যাকাচ্চন বিশ্বাস করতেন- বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি বাঙালির প্রধান
বৈশিষ্ট্য- হিন্দু, মুসলমান কিংবা বৌদ্ধধর্ম নয়। বাঙলাদেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ
শুরু হয়- ডেভিড ছিলেন তখন ইংল্যান্ডে। পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর
অত্যাচারের সংবাদে তিনি উদ্বিগ্ন সময় কাটিয়েছেন এবং সে সময়টাতে তিনি ছিলেন
খুব অসুস্থ। সে সময় তাঁর দীর্ঘদিনের সহকর্মী ও গবেষক, সমালোচক ড.
সুহৃদকুমার ভৌমিকের কাছে লেখা এক আবেগঘন চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন-
সুহৃদ- কী হচ্ছে বাঙলাদেশে? এভাবে পাকিস্তান সরকার মানুষ হত্যা করছে? তোমরা
চুপচাপ কেনো? সংবাদমাধ্যমে তো সব খবর পাই না। গার্ডিয়ানের একটা খবরে পড়লাম
সেখানে নাকি নারী নির্যাতন চালাচ্ছে ‘স্টুপিড সোলজাররা’? সুহৃদ- আমার ভালো
লাগছে না; নার্সিং হোমের দিনগুলো খুব কষ্টে কাটছে। আমি কী কিছুই করতে
পারবো না বাংলাদেশের মানুষগুলোর জন্য? আমি যেবার সেখানে গিয়েছিলাম, তাঁদের
আতিথেয়তা দেখেছি। তাঁরা কেমন আছে সুহৃদ? কী ঘটছে চারপাশে? আমি কেনো অক্ষম
হয়ে গেলাম এই যুদ্ধের সময়ে?
শুনেছি শরণার্থীরা নাকি ভারতীয় সীমান্তে এসে আশ্রয় নিয়েছে? তুমি খোঁজ করো-
ওঁদের মধ্যেই হয়তো আছেন ময়মনসিংহের সেই পরিবারটি, যাঁরা আমাকে খাওয়ানোর
জন্যে একবেলা না খেয়েছিলো। সুহৃদ- অনুজ আমার, তুমি এশিয়াটিক সোসাইটিতে যাও,
আমার লকারে Kodak-Duo ক্যামেরাটা আছে, আর যোগাযোগ করো অমিয় ব্যানার্জীর
সঙ্গে- তাঁর কাছে আমার Agfa-Isolatte ক্যামেরা আর Weston Master III মডেলের
এক্সপোজারটা আছে। এগুলো বিক্রি করো সুহৃদ- আবেগ দেখানোর সময় এখন না; এগুলো
বিক্রি করে যা পাও তা নিয়ে শরণার্থী শিবিরে যাও। ওইখানে বাঙালিরা রয়েছেন-
যারা মাটির কাছে থাকেন, যাঁদের শান্তির নীড়ে হায়না হানা দিয়েছে, তাঁদের
পাশে দাঁড়াতে না পারলে মানবজীবন সার্থক হবে না সুহৃদ। তুমি যাও। কী করলে
দ্রুত জানিও। আমি পঙ্গু হয়ে নার্সিং হোমে পড়ে না থাকলে তোমাকে এই কষ্টটা
করতে হতো না।
ড. সুহৃদকুমার
ভৌমিকের এক লেখা থেকে জানা যায়, এশিয়াটিক সোসাইটিতে দ্যা লেইট মেডিভ্যাল
টেম্পেলস অব বেঙ্গলের উপর কাজ করিবার সময় তিনি একখানা আত্মজীবনী লিখিবার
ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন তিনি। কিন্তু তার হেঁয়ালীপনার কারণে তা অসমাপ্তই
থেকে যায়। পরবর্তীতে সেই অসমাপ্ত পান্ডুলিপি থেকে নিচের কবিতাখানি পাওয়া
যায়, কবিতার বাংলা অনুবাদ তুলে ধরা হল-
বন্ধুর চিঠিতে খবর
হত্যার তাণ্ডবলীলা প্রবল গতিতে চলছে,
বিশেষত ঢাকায়।
লিখেছে বন্ধু- সেখানে সূর্য ওঠে আবার অস্ত যায়!
আকাশ নাকি আগের মতোই সুন্দর-স্বচ্ছ-নীল,
মনে হবে যেনো কিছুই ঘটেনি, স্বাভাবিক রাত আর দিন!
আর এখানে, এই ইঙল্যান্ডে?
একটা আশ্চর্য সুন্দর উত্তাপের দিনে গড়া
বসন্তের আবির্ভাব ঘটেছে।
আকাশ তেমনি নীল, সঙ্গে
নির্মল মৃদু হাওয়া আর সতেজ ফুলের পাপড়ি।
গাছগুলো কতো সবুজ!
চারদিক স্নিগ্ধ আমেজে ভরা!
আর ছেলেমেয়েরা উজ্জ্বল পোষাকে
গড়িয়ে পড়ছে ঘাসে।
পৃথিবীর কোথাও কোথাও মানুষের জীবন
কতো কষ্ট আর হাহাকারে পূর্ণ।
১৯৭২ সালের ১২
জানুয়ারি ইংল্যান্ডের উডল্যান্ড নার্সিং হোমে ডেভিড মারা যান। বাংলাদেশ
তখন স্বাধীন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার আগেই ডেভিড বলে গিয়েছিলেন- “আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, পূর্ব পাকিস্তান থাকবে না- এর ভেতরে একটি নূতন রাষ্ট্র নবজাতকের মতো চিৎকারে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করছে।“
সুত্রঃ নিউজ বাংলা ডেস্ক এবং কালের কন্ঠ
চলবে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন