ছেলেবেলায়
রূপকথার গল্পে ভূত-পেত্নী, জ্বীন-পরীর কথা শুনেছি কত! সেই ছোট্টবেলায়, যখন
লেখাপড়ার পর্ব শুরু হয়নি- নানীর কাছে শুয়ে শুয়ে গল্প শোনার বায়না ধরতাম।
রাজা-বাদশা, শুয়োরানী-দুয়োরানী, দৈত্য-দানব, জ্বীন-ভূত আর ডাইনী বুড়ির
গল্প। এসব ভূতের গল্পের প্রতি কেন জানি প্রবল আকর্ষণ ছিল তখন। রাতে নানী
তার গল্পের ঝুড়ি খুলে বসতেন, একটার পর একটা। একটু বড় হয়ে যখন পড়তে শিখলাম,
হাতে পেলাম ঠাকুরমার ঝুলি। পাতার পর পাতা উল্টে রঙ-বেরঙের ছবি! কি যে আনন্দ
হত! আরও পরে জানলাম, ভূত-প্রেত বলে কিছু নেই। মনে প্রশ্ন জাগত- তাহলে এসব
ভূতের গল্প কোত্থেকে এলো? কেউ কেউ বলত- ভূত-পেত্নী নেই ঠিকই, তবে জ্বীন-পরী
আছে। বদ জ্বীনেরা মানুষের উপর ভর করে। এসব জ্বীন কেমন হয় তা জানার খুব
কৌতুহল ছিল মনে। একবার সত্যি সত্যি সেই জ্বীনের দেখা পেলাম। নানী বাড়িতেই।
আমরা ছোটরা তাঁকে ডাকতাম রাঙা নানী। দেখতে ধবধবে ফর্সা, তাই এই সম্বোধন।
চারুরী সূত্রে নানা থাকতেন চিটাগাঙ। নানী একাই বাড়িতে থাকতেন। তাঁর থাকার
কক্ষটি ছিল বিশাল ঘরের এক কোণে। পিছনে ঘন জঙ্গল। একদিন মধ্যরাতে তাঁর ঘর
থেকে উচ্চস্বরে জিকির শুনতে পেয়ে সবাই ছুটে গেল। নানীর পিছে পিছে আমিও
ছুটলাম। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখা গেল, রাঙা নানী খাটের উপর আসন গেড়ে বসে
জিকির করছেন। জিকিরের তালে তালে তাঁর সারা শরীর দুলছে। তাঁর ঘরের দু’দিকের
জানালায় উৎসুক লোকের ভিড় জমে গেল সেদিকে তাঁর কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। কিছুক্ষণ
পর তাঁর জিকির থেমে গেল। তিনি সুর করে বার বার বলতে থাকলেন-
ও মোর আল্লা রে (আঞ্চলিক ভাষায়)
মোরে দয়া কর রে...
হঠাৎ
জানালায় চোখ পড়তেই স্থির হয়ে গেলেন। বড় বড় চোখ করে জানালার দিকে তাকিয়ে
থাকলেন কিছুক্ষণ। তাঁর চোখ দু’টো তখন রক্ত লাল। শান্ত শিষ্ট হাসিখুশি
স্বভাবের নানীকে তখন অন্যরকম লাগছিলো। খুব দ্রুত খাট থেকে নেমে ভিতর থেকে
জানালা বন্ধ করে দিলেন। সে রাতে তাঁর ঘর থেকে আর কোন শব্দ শোনা যায় নি।
দু’দিন পর আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। এরপর প্রায় রাতেই এমন ঘটত। দিনের
বেলায় এ ঘটনা সম্পর্কে তাঁকে জিজ্ঞেস করলে তিনি অবাক হয়ে যেতেন। মাঝে মাঝে
রাগ করতেন, মুরুব্বিদের কাছে অভিযোগ করতেন- সবাই তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা করছে।
আমারা ছোটরা আমাদের মজাটা পেয়ে গেলাম। সুযোগ পেলেই নানীকে ক্ষেপাতাম। তাঁর
থেকে কিছুটা দুরত্ব রেখে হাঁটতাম আর তাঁর মত সুর করে বলতাম-
ও মোর আল্লা রে
মোরে দয়া কর রে...
নানী
কিছুক্ষণ না শোনার ভান করে নিজের মনে কাজ করে যেতেন। কিন্তু আমাদের
কর্মযজ্ঞ থামত না। তারপর একসময় ক্ষেপে গিয়ে কটমট করে আমাদের দিকে তাকিয়ে
সোজা নিজের ঘরে গিয়ে দরজায় খিল দিতেন। তাঁকে নিয়ে আমাদের মজার উপলক্ষ্যের
অভাব ছিল না। আমরা সুযোগ খুঁজতাম তাঁকে ক্ষেপানোর।
নানাদের ঘর আর রাঙা নানীর ঘরে মাঝখানে একটা বড় বরই গাছ। খুব মিষ্টি আর
রসালো সে বরই খাওয়ার লোভ ছিল বাড়ির ছোটবড় সবার। তমাল গাছে উঠে ঝাঁকি দিতেই
বরইতলা পাকা বরই-এ ভরে যেতো। তবে রাঙানানীর জন্য টসটসে বরইগুলো আমাদের
ভাগ্যে জুটত না। যেখানে পাকা বরই পড়তো তিনি ছুটে গিয়ে পুরো জায়গার দখল নিয়ে
নিজ আঁচলে ভরে নিতেন। আমরা কিছুক্ষণ দেখতাম। তারপর যথারীতি শুরু হতো
আমাদের মিশন। তমালকে ইশারা করতেই উপর থেকে ওর সুর ভেসে আসতো। সাথে চলতো
আমাদের কোরাস। ব্যাস আর যায় কোথায়! কিছুক্ষণ চুপ থেকে রাঙানানী যথারীতি কড়া
চোখে আমাদের দিকে তাকাতেন। তারপর আঁচলের সব বরই মাটিতে ছুড়ে ফেলে ঘরে গিয়ে
আবার খিল দিতেন। আমরা সুবোধ বালকেরা মনের সুখে সব বরই পকেটে পুরে সোজা
নদীর পাড়ে।
এভাবে আনন্দেই কাটছিল আমাদের দিনগুলো। একদিন সকালে রাঙা নানা বাড়ি ফিরলেন।
রাঙা নানীর নামের সূত্র ধরে নানাকেও আমরা ডাকতাম রাঙা নানা। সবকিছু শুনে
তিনি বেশ চিন্তিত। প্রথম স্ত্রী গত হবার পর সুন্দরী দ্বিতীয় স্ত্রীর প্রতি
নানার অনুরাগের পরিমাণ কিঞ্চিৎ বেশিই ছিল। এ নিয়ে ঠাট্টার সম্পর্কীয়
লোকজনের কাছ থেকে খোঁচা যে শুনতেন না তা নয়, তবে আমাদের হাসিখুশি নানা এসব
গায়ে মাখতেন না। নানীকে জ্বীনে আছর করেছে শুনে তিনি বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন।
জ্বীন তাড়ানোর জন্য ওঝা ডাকার তোরজোড় শুরু হয়ে গেল। আমাদের বেশ মন খারাপ
হল। আসলে ব্যাপারটা ছিল- ওঝা যদি জ্বীন তাড়িয়ে দেয় তবে আমরা এমন মজা করার
সুযোগ হারাব। তবে জ্বীন তাড়ানোর আনুষ্ঠানিকতা দেখার কৌতুহল মন খারাপ ভাবটা
কমিয়ে দিয়েছিল কিছুটা।
পরদিন রাতে যথারীতি ওঝা হাজির। তখন শীতকাল। খুব দ্রুত যেন রাত নেমে আসে।
ঠিক হল, রাতের খাবার পর শুরু হবে জ্বীন তাড়ানোর আনুষ্ঠানিকতা। আমরা অধীর
আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম সেই ক্ষণের জন্য। আমার বড় মামা ছিল পুলিশের
লোক। গোয়েন্দা শাখায় কাজ করার জন্য তাঁর মধ্যে সন্দেহ বাতিকটা একটু বেশিই
ছিল। তবে রসিক কিংবা ত্যাঁদড় দু’ভাবেই মামার বেশ সুনাম(!) ছিল। সে রাতে বড়
মামা বাড়িতেই ছিলেন। এমন বিরক্তকারী প্রাণি জ্বীনের পছন্দ হবার কথা না।
নানাদের বড় ঘরের মধ্যখানে ওঝা বসে আছে। রাঙা নানীকে সেখানে হাজির করার জন্য
বাড়ির অন্য মহিলারা তাঁর ঘরে গেলে শুরু হয়ে গেল রাঙা নানীর চিৎকার। তিনি
কিছুতেই এখানে আসবেন না। শেষে অনেকটা জোর করেই তাঁকে নিয়ে আসা হল।
ওঝার সামনে বসে আছেন রাঙা নানী। কড়া চোখে তাকিয়ে আছেন ওঝার দিকে।
-চোখ নামা! ধমকে উঠল ওঝা।
-তুই চোপ! রাঙা নানী ততোধিক ঝাঁঝের সাথে ওঝাকে উল্টো ধমক দিলেন।
একটু পরই শুরু হয় তাঁর জিকির। আগে গভীর রাতে নিজ ঘর ছাড়া তাঁকে জিকির করতে দেখা যায়নি।
ও মোর আল্লা রে
মোরে দয়া কর রে...
বড় মামা ওঝাকে ইশারায় কি যেন বললেন। ওঝা চুপ করে রইল। শুরু হল মামার মিশন।
-অ্যাই, তোর নাম কি?
রাঙা নানী তাঁর মত জিকির করে চললেন। কেউ কিছু বলেছে, সেদিকে তাঁর ভ্রূক্ষেপ
নেই। মামা কিছুক্ষণ চুপ থেকে খুব মোলায়েম স্বরে জিজ্ঞেস করেন,
-ও জ্বীন ভাই, আপনের নাম কি?
এবার রাঙা নানী জিকির বন্ধ করে মামার দিকে কড়া চোখে তাকালেন। মামাও ভয়
পাওয়ার ভান করে সরে গেলেন সামনে থেকে। রাঙা নানী ক্রমাগত জিকির করতে
লাগলেন। মামা একটু পর ফিরে এসে আবার শুরু করলেন জ্বালাতন।
-কইলেন না আপনের নাম কি?
এবার মুখ খুললেন রাঙা নানী।
-অ্যাই! মোর নাম দিয়া তুই কি হরবি? বিরক্ত হরিস না, যাহ।
এমনিতে বড় মামাকে নানী সমীহ করেই চলতেন এবং আপনি করেই বলতেন। এই প্রথম
শুনলাম মামাকে তিনি তুই করে সম্বোধন করলেন। মামা কিছুটা নরম সুরে বললেন,
-না এমনেই জানতে চাইলাম! আইচ্ছা থাউক। তাইলে কন না আপনে থাহেন কই?
রাঙা নানী মামার দিকে কটমট করে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বিড়বিড় করে নিজের মনেই কি যেন বললেন। মামা আবার জিজ্ঞেস করলেন,
-আইচ্ছা, আপনেরা খান কি?
-মিষ্টি খাই, মিষ্টি। যা এইহান থেইক্যা, যাহ!
-এহ! আবার মিষ্টি খায়! পারলে মোগো খাওয়ান দেহি!
-তুই একটা ফাজিল! আমার সামনে থেইক্যা যা, নাইলে লাত্থি খাবি।
মামা বেশ বুঝতে পারে রাঙা নানী সেরাম ক্ষেপেছে। আরও ক্ষেপাতে বলে,
-মিথ্যা কথা বলার জায়গা পাও না। তোমরা গু খাও।
তড়াক করে উঠে দাঁড়ায় রাঙা নানী। তারপর তেড়ে যায় মামার দিকে। মামা ঘরের
সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে ঝাঁপি ফেলে দিলেন। কিছুক্ষণ সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে
থাকে নানী। লোকজন ধরে এনে আবার বসিয়ে দেয় ওঝার সামনে।
এবার ওঝা নানীকে সামনে বসিয়ে তাঁর চারিদিকে গোল করে দাগ দিয়ে দেয়। যাকে
গ্রামের ভাষায় বন্ধক দেয়া বলে। নানী ওঝার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে।
-অ্যাই, তুই মোরে বোলাইছো ক্যা?
-এই মাইয়ালোকডার লগে আইছো ক্যা?
-এই হারামজাদা, আমি কার লগে আইমু হেইয়া তোরে জিগামু?
-তুই এই মাইয়ালোকটারে ছাইড়া যা।
নানী ওঝার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন চিবিয়ে খেয়ে ফেলবেন। কিছুক্ষণ পর বললেন,
-তুই কেডা রে, মোরে ধমক দেও?
-তুই যাবি কিনা ক।
-না, আমি যামু না।
-তোরে যাইতে হইবে।
-আমি যামু না, যামু না।
-খাড়া, তোরে মজা দেহাইতে আছি।
ওঝা একে একে তাঁর সরঞ্জাম সামনে আনে। ধূপ-ধোয়া, নারিকেলের শলা আরও কিছু
জিনিস ছিল তার মধ্যে ঠিক মনে পড়ছে না। নানী ওঝার সামনে বসে নিজের মনে জিকির
করে চলে,
আমি যামু না
মোরে দয়া কর রে
ও মোর আল্লা রে...
বড় মামা আবার ওঝার পিছনে এসে দাঁড়ান। খুব নরম স্বরে রাঙা নানীর উদ্দেশ্যে বলেন,
-ও জ্বীন ভাই, আপনের গানডা খুব সুন্দর। কার দারে শেখছেন?
-তুই আবার আইছো? এইবার তোর খবর আছে কইলাম।
-মুই কি হরছি কন দেহি জ্বীন ভাই? খালি কইছি আপনের গানডা সুন্দর। মুই আসলে গান-বাজনার খুব ভক্ত।
-হারামজাদা, মোর লগে ফাইজলামি হরো! তোর ভাল অইবে না কইলাম, এক্কেরে খাইয়া ফালামু।
রাঙা নানী বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন। ওঝা জোরে এক ধমক দিলেন নানীকে।
-বহ! তুই চাইলেই এই দাগের বাইরে যাইতে পারবি না।
রাঙা নানী আবার বসে পড়েন। তবে মামার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে রইলেন। মামা ওঝার
পিছনে নিতান্ত ভাল মানুষের মত দাঁড়িয়ে আছেন। ওঝা আবার ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
-ভালোয় ভালোয় কইতাছি, তুই ওনারে ছাইড়া যা।
-কইছি না আমারে জ্বালাইস না! আমি যামুনা।
-তুই তো যাবি, তোর বাপে যাইবে। খাড়া দেহাইতেছি মজা।
-তোরে কিন্তু আমি ছাড়ুম না। মনে রাহিস।
ওঝা ধোঁয়া জ্বালিয়ে দিয়ে দিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে রাঙা নানী অস্থির হয়ে
ওঝাকে বকাঝকা শুরু করলেন। মাঝে মাঝে সুর করে চলছিল সঙ্গীত চর্চা। ওঝা
নারিকেলের শলা দিয়ে রাঙা নানীর দু’পাশের মাটিতে আঘাত করতে লাগলেন।
-অ্যাই হারামজাদা, এইগুলান বন্ধ কর।
-চোপ! এহনি এই মাইয়ালোকডারে ছাইরা যা কইলাম।
রাঙা নানী গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন অনেকক্ষণ। তারপর বললেন,
-ঠিক আছে আমি যাইতেছি। তয় তোর ভাল অইবে না কইলাম। তোরে আমি ছারমু না।
-আমার কি হরবি হেইয়া পরে দেখমু আনে। তুই এহন যা।
রাঙা নানী ওঝার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বললেন- যাইতেছি।
-ক্যামনে বুঝমু তুই গ্যাছো?
-মুই যাওয়ার সময় ঐ বাগানের বড় গাছটার একটা ডাল ভাইঙা রাইখ্যা যামু।
-ঠিক আছে, যা।
কিছুক্ষণ পর রাঙা নানী অজ্ঞান হয়ে গেলেন। বাড়ির সবাই তাঁকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
সে রাতে আমার আর ঘুম আসেনি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন