মঙ্গলবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০

উপন্যাসঃ ফেরা (পর্বঃ ২১ - ২৫ - শেষ পর্ব)

ই উপন্যাসটিতে সম্মুখ সমরের কোন ঘটনা তুলে ধরা হয়নি।  ওয়ারফ্রন্টের কোনও দৃশ্য নেই। তবে এই লেখায় মূলত যে গল্পটি বলার চেষ্টা করা হয়েছে তা মুক্তিযুদ্ধের বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। একটি যুদ্ধ নানানভাবে মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে, যার কোনোটিকেই ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। একাত্তরের পঁচিশে মার্চের সেই কালরাত থেকেই নিজেদের পরিবারকে বাঁচানোর তাগিদে মানুষ ঢাকা শহরের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছুটে বেড়িয়েছে কেউ কেউ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ফিরে গেছে নিজ গ্রামে। এই গল্পে তেমনই কিছু মানুষের জীবনযুদ্ধের ঘটনাবলীই তুলে ধরা হয়েছে; যারা নিজেদের পরিবারকে বাঁচাতে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে ফিরে চলে নিজ গ্রামে। এটা মোটেও সহজ ছিলো না। এই ফিরে যাওয়ার গল্পটিই এই উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য।


পর্বঃ  ২১ 

দুপুরের পর থেকেই আকাশে মেঘ জমছিলো।  লোকজন অর্থহীনভাবে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে।  আবার কেউ কেউ গাট্টি-বস্তা গোল করে চলে যাচ্ছে। তারা হয়তো নৌকা এরেঞ্জ করে ফেলেছে কিংবা কাছেই কোথাও যাবে। যারা গৌরনদী, আগৈলঝরা কিংবা কাছাকাছি এলাকায় যাবে তাদের অবশ্য নৌকার জন্য অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। এই অঞ্চলের মানুষগুলো হয়তো চলে যাচ্ছে।

বিকেল গড়াতেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। আমি আমাদের জন্য বরাদ্দ রুমটির সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি।  মাঠে, রাস্তায় কিছু লোক এলোমেলোভাবে ঘোরাঘুরি করছিলো, তারা সব স্কুলের বারান্দায় উঠে যাচ্ছে।  দুপুরের পর যারা চলে গিয়েছিলো তাদের মধ্যে কেউ কেউ ফিরে আসছে আবার।  হয়তো কোন ট্রান্সপোর্ট যোগাড় হয়নি, কিংবা বৃষ্টি তাদের যাত্রায় বাদ সেধেছে।

কিছুক্ষণ পরই হুড়মুড় করে নামলো। পশ্চিম আকাশে কালচে মেঘ যেন ব্যঙ্গ হাসি হাসছে।  বৃষ্টির ছাঁট থেকে রেহাই পেতে আমি পেছনে সরে গেলাম।  উল্টাদিকের বারান্দায় অনেক মানুষের ভিড়।  কেউ কেউ বৃষ্টিতে ভিজছে।  টিনের চালে ঝুমঝুম শব্দে অবিরাম ঝরছে।  স্কুলের মাঠে এখন পানি জমেছে বৃষ্টির শব্দের সাথে মানুষের চিৎকার আর চেঁচামেচির আওয়াজ। অদ্ভুত একটি পরিস্থিতি। স্কুল কম্পাউণ্ডের মধ্যে চার-পাঁচশো মানুষ। পূর্ণবয়স্করা ছাড়াও বিভিন্ন বয়সী বাচ্চা এবং বৃদ্ধ মানুষজনও রয়েছে  আমাদের পাশের কক্ষে একটি বাচ্চা অনবরত কেঁদে চলেছে। বাচ্চাটিকে শান্ত করতে একজন মধ্যবয়স্ক লোক ওকে কোলে নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন।  কিন্তু ওর জন্য এখানে জায়গা কই?

‘আহারে! কী অবস্থা! বাচ্চাটির জন্য একটু খোলা জায়গাও নেই!’ দরদী কণ্ঠ তারেকের।

আমি ওকে বুঝিয়ে বললাম, ‘এটা আশ্রয়কেন্দ্র।  এখন স্কুলটাতে চার-পাঁচশো মানুষ, একটু কষ্ট তো হবেই। ’ 

বারান্দার অন্যপ্রান্ত থেকে হেঁটে এসে মতিন বললো, ‘ঐ রুমে জানালায় দরজা নেই, বৃষ্টির পানি ভেতরে এসে সব ভিজে যাচ্ছে।  এখন লোকজন চটের বস্তা দিয়ে পানি আটকানোর চেষ্টা করছে।’

আমি আরেকবার মেঘনায় সেই ঝড়ের কথা ভাবলাম।  কালবৈশাখীর সাথে সেই লড়াইয়ের কাছে এই বৃষ্টি ঠেকানোর চেষ্টা আসলে কিছুই না। সেদিনের সন্ধ্যার পর থেকেই যে কোন সমস্যায় আমি ঐ ঝড়ের পরিস্থিতিকে চোখের সামনে নিয়ে আসি।  তাহলে এইসব ছোটখাটো সমস্যা মনে কোন প্রভাবই ফেলে না। 

তারেক বললো, ‘দেখতো মতি, আমাদের রুমে সবকিছু ঠিক আছে কি না?’

আরেকটা ভাবনা আমার মাথায় কাজ করছিলো। প্রতিদিন যেভাবে মানুষ আসছে, তাতে একসময় হয়তো আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যাবে।  তখন কী হবে? তাদের জায়গা হবে কোথায়? এই দুর্দিনে বৃষ্টি যেন সবার জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।  সামনে আরও কঠিন সময় আসছে। 

আমাদের লোকজন বেশির ভাগই রুমের ভেতরে সফিক ভাই, আমি আর চন্দন বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিলাম আসাদ ভাই বারান্দার শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছেন।  চন্দন বিড়বিড় করে বললো, ‘এত মানুষের মধ্যে আমরা কাল সকালে নৌকা পাবো তো!’ বড়মামা আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন।

‘নৌকা ঠিক হয়েছে?’ মামা জানতে চাইলেন

চেয়ারম্যান ও মাউলানার সাথে আলাপের কথা মামাকে বললামতিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘দেখো, কালকে নৌকা পাওয়া যায় কি না

সন্ধ্যার অনেক আগেই বৃষ্টি থেমে গেলো।  হঠাৎ যেমন ঝুপ করে নেমেছিলো, তেমনি হঠাতই আবার রণে ভঙ্গ দিয়ে বিদায় নিলো।  মেঘ কেটে গিয়ে ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে আসছে আকাশ। একে একে লোকজন আবার বেরিয়ে আসছে রুম থেকে। ছোট ছোট বাচ্চাদের কেউ কেউ মাঠের পানিতে নেমে পড়েছে।  শহুরে বদ্ধ জায়গা থেকে বেরিয়ে মাটির কোলে এই আনন্দের স্বাদই যেন আলাদা। আমি একবার রুমের ভেতর থেকে ঘুরে এলাম।  নুরুল ফুপা, বাবা, বড়মামা, মেজচাচা, ছোটচাচা আছরের নামাজ পড়তে মসজিদে গেলেন।  ছোট বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়েছে। ছোটমামাও ওদের পাশে জায়গা করে নিয়েছে।

তারেক আর মতিন বারান্দায় এসে আমার পাশে দাঁড়ালো।  তারেক আমাকে কিছু বলতে গিয়েও হঠাৎ চুপ হয়ে গেলো।  ওর দিকে ফিরতেই দেখলাম রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়েছে। আমি তারেকের দৃষ্টি অনুসরণ করলাম। তখন পূব আকাশে সবুজ গাছপালার উপর দিয়ে রঙধনু হাসছে।  ওর দৃষ্টি সেদিকেই স্থির হয়ে আছে। মতিন হঠাৎ বলে উঠলো, ‘ইস, কী সুন্দর রঙধনু!’  

‘তোরা সব এইখানে?’ পেছনে বড় আপার কণ্ঠ শুনে ঘুরে তাকালাম। বড় আপা রাস্তার দিকে দেখিয়ে জানতে চাইলো, ‘লোকগুলো কোথায় যায়? ঐদিকে কি আছে রে?’

আমি বললাম, ‘একটু সামনে একটা পুকুর আছে, তারপর রাস্তাটা গ্রামের ভেতরে চলে গেছে।’

আপা আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘যাওয়া যাবে না?’

‘কেন যাবে না? তুই যাবি?’       

‘একটা রুমের মধ্যে এত মানুষ! হাঁপিয়ে উঠেছি।  একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসলে ভালো লাগতো।’

‘তাহলে চল সফিক ভাই কোথায়?’

‘জানি না। ঘরের ভেতরে তো নেই। হয়তো বাইরে কোথাও হাওয়া খাচ্ছে। ’

আমি হেসে ফেললাম। ‘এই দূষিত সময়ে ফ্রেস হাওয়া খাওয়া তো দোষের কিছু না। ’

আপার মুখে স্বভাবসুলভ হাসি। ‘ফ্রেশ হাওয়া খাচ্ছে না দূষিত কে জানে! একটু দাঁড়া, আমি আসছি। ’

একটু পর বড় আপা রুম থেকে যখন বেরিয়ে আসলো, তখন ওর পিছু পিছু রানু, ছোটচাচী, উষা, তুলি আর তানিয়াও আসলো আমি হেসে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই মানবীরাও কী তোর সাথে গ্রাম দর্শনে বের হলেন?

আপা হাসছে। ভ্রু কুচকে তুলি বলে উঠলো, ‘তোমরা যেতে পারো, আর আমরা গেলেই দোষ?’

‘না না, দোষ কেন হবে? চল।  তবে মানুষের ঢল দেখে আবার বিরক্ত হোস না। ’

রাস্তায় ও পুকুর পাড়ে অনেক মানুষ ঘোরাঘুরি করছে।  বদ্ধ রুমের মধ্যে গাদাগাদি করে কতক্ষণ থাকা যায়! তাই বৃষ্টি শেষে বেরিয়ে পড়েছে এই খোলা হাওয়ায় প্রাণটাকে জুড়িয়ে নেয়ার খেয়ালে। আসাদ ভাই আর সফিক ভাই পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলো। বড় আপা পেছনে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো,

‘এইসব ছাইপাঁশ খেয়ে ফ্রেশ বাতাসটাকে শুধু শুধু কেন দুষিত করছো?’

আপার কণ্ঠ শুনে পেছনে ঘুরলো সফিক ভাই।  তারপর সিগারেটের ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে বললো, ‘ও, তোমরাও এসে পড়েছো!’

আপা সিগারেটের দিকে ইশারা করে বললো, ‘ওটা ফেলো কিছুক্ষণ পর পরই মুখের মধ্যে এই জ্বলন্ত লাঠিটা ঝুলিয়ে কী যে মজা পাও!’

‘এই চলে আসলো মহিলা দারোগা! এইবার শান্তি শ্যাষ। ’ তারেক আমার পেছনে এসে ব্যঙ্গহাসি হাসলো।

বড় আপা স্মিত হেসে গ্রীবা বাড়িয়ে দিলো।  তারেককে দেখতে পেয়ে চোখ গরম করে বললো, ‘এই পাঁজিটাও খায় না-কী? যদি দেখি না, কান ছিঁড়ে দেবো।’ 

‘ইস! এখনও আমার কান ব্যথা করছে।’ তারেক ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে বললো।

‘এইদিকে আয়, অন্য কানটা মলে দিই। তাইলে আর ব্যথা থাকবে না। ’ আপা স্নেহদৃষ্টিতে তারেকের দিকে তাকালো।

সফিক ভাই শব্দ করে হেসে উঠলো। ‘তোমরাই মজায় আছো

‘তোমার খুব হিংসা হচ্ছে, তাই না?’

সফিক ভাই তাড়াতাড়ি বলে উঠলো, ‘না না, আমিও মজা পাচ্ছি। ’

ছোটবেলা থেকেই তারেক বড় আপা আর আমার খুব ন্যাওটা।  এখন ও বড় হয়ে গেছে, তবুও যেন তার রেশটা রয়ে গেছে। আমাদের কাজিনদের মধ্যে আপা সবার বড়, আর ভাইদের মধ্যে আমি। সবার সাথেই আমাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ সরল। তবে ছোট বড় সবার আবদারই আমার কাছে।  আমিও এটা খুব এনজয় করি।

মতিন আপাকে রঙধনু দেখিয়ে বললো,’দেখো বড় আপা, কী সুন্দর রঙধনু!’

তারেককে ছেড়ে সবাই রঙধনুর সৌন্দর্য আর তার রূপের বিশ্লেষণে মননিবেশ করলে ও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। সফিক ভাই আরেকটা সিগারেট ধরাতে গেলে বড় আপা চোখ-মুখ গরম করে বিরক্তিমাখা কণ্ঠে বললো, ‘আবার! খবরদার, ধরাবে না ওটা।  আমি ছুড়ে ফেলে দেবো।’

সফিক ভাই ভয় পাওয়ার ভাণ করলো, তারপর অনুগত প্রজার মত মাথা নিচু করে বললো, ‘জো হুকুম বেগম সাহেবা। এই যে শলাকা চলে গেলো যথাস্থানে।’

সবাই হো হো শব্দ করে হেসে উঠলো।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে।  আমাদের শুদ্ধ বাতাসে ভ্রমণ শেষ।  আপারা রুমে ফিরে গেলো। আমি, সফিক ভাই, আসাদ ভাই, চন্দন আর তারেক চা খাওয়ার উদ্দেশ্যে বাজারের দিকে চললাম। ছোট্ট বাজারটায় লোকজনের আনাগোনা তেমন একটা নেই। আমরা একটা চায়ের দোকানে গিয়ে বসলাম।  সামনের গামলায় রসগোল্লা দেখে তারেক খেতে চাইলো।  আমরা সবাই নিলাম।  গ্রামের খাঁটি দুধের ছানা দিয়ে তৈরি, তাই স্বাদটা চমৎকার। তারেক আরও একটা নিলো। তবে গরুর দুধ দিয়ে বানানো সত্বেও চা-টা তেমন ভালো হয়নি। তারেক কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললো, ‘এরা কী কেউ চা বানাতে পারে না?’ ও সামনে গিয়ে নিজের কাপে কিছুটা দুধ বাড়িয়ে নিয়ে এলো।  হাসিমুখে বললো, ‘এইবার কিছুটা সুখাদ্য হয়েছে। ’ ওর কথা শুনে আসাদ ভাই মৃদু হাসলো, তারপর যথারীতি শলাকায় অগ্নি-সংযোগ করে সুখটান দিতে শুরু করলো।

চারপাশে গাছপালা থাকায় স্কুলের মাঠে এখন জমাট অন্ধকার। সেই অন্ধকারের মধ্যেই চেয়ার পেতে গল্প করছে কেউ কেউ। টিনের তৈরি রুমের মধ্যে ভ্যপসা গরম ভাববাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে তখনও ইলেক্ট্রিসিটি পৌঁছেনি। রুমে রুমে মোমবাতি জ্বেলে নিয়েছে সবাই। প্রায় রুম থেকেই বিচিত্র কথাবার্তা ভেসে আসছে। কখনও উচ্চস্বরে, কখনও মৃদুস্বরে, আবার কখনওবা বাচ্চাদের চিৎকার-চেঁচামেচি। হুলস্থূল কাণ্ড কারখানা।  রাস্তায় পুকুরের দিক থেকে একটা টর্চের আলো এগিয়ে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যে মাঠে এসে ওটা থামলো।  কথা শুনে মনে হলো লোকমান। রুমে রুমে গিয়ে কী যেন জিজ্ঞেস করছে। একটু পরই বুঝলাম খোঁজখবর নিচ্ছে, কারো কিছু লাগবে কি না আমাদের রুমটা শেষ প্রান্তে, একেবারে রাস্তা ঘেঁষে।  ও সবগুলো রুম ঘুরে আমাদের দরজায় এসে দাঁড়ালো।  আমি ডেকে জিজ্ঞেস করলাম আগামীকাল সকালে নৌকা পাওয়া যাবে কি নাও জানালো, চেয়ারম্যান সাবের নির্দেশে আমাদের জন্য দ’টো নৌকা ঠিক করে রাখা হয়েছে। সকাল ন’টায় নৌকা ছাড়বে। ও নিজেই আসবে আমাদের এগিয়ে নিতে।  আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।  যাক! শেষ পর্যন্ত নৌকা পাওয়া গেল।

পর্বঃ  ২২

রাত আটটা।  লোকমান এবং আরও কয়েকজন লোক রাতের খাবার নিয়ে এলো। সবজী দিয়ে পাতলা খিচুড়ি। আমাদের রুমেও এক গামলা খিচুড়ি সাথে ছয়টা প্লেট দিয়ে গেলো। মা পালা করে একে একে সবাইকে খাওয়াচ্ছেন।  ছোট বাচ্চারা এবারও বেঁকে বসলো। বড় আপা ছেলে তুহিনকে ধমকাচ্ছে দেখে সব বাচ্চারা চুপচাপ খেয়ে নিলো।  হাসান খিচুড়ি দেখে মুখ-চোখ বাঁকা করে দাঁড়িয়ে আছে।  তারেক ওকে কনুই দিয়ে গুতো দিলো, তারপর বড় আপার দিকে ইঙ্গিত করে ফিসফিসিয়ে বললো,

‘মহিলা দারোগার কানমলা খাইতে না চাইলে তাড়াতাড়ি এই ডাইলে-চাউলে খিচুড়ি গিলে নে। ’     

ছোটচাচী মিটিমিটি হাসছে। বড় আপার দিকে তাকাতেই সে চোখ গরম করে তারেক- হাসানের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘এই লম্বুদ্বয়, তোরা খাইছোস?’

হাসান না-সূচক মাথা নাড়লো। বড় আপা দু’টো প্লেট ওদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

‘নে, তাড়াতাড়ি সাবাড় কর।’

হাসান বাধ্য ছেলের মত খেয়ে নিলো।  আমি বাইরে এসে দেখি আসাদ ভাই আর সফিক ভাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। মাঠে ও রুমগুলোয় বিচিত্র আওয়াজ থাকলেও এদিকটা বেশ নিরিবিলি। এখন অন্ধকার কিছুটা কেটেছে।

হঠাৎ চোখে পড়লো একলোক এক রুম থেকে অন্য রুমে ছোটাছুটি করছে।  আমি ভাবলাম কী ব্যাপার? লোকটা স্কুলের সব রুমেই উঁকি দিচ্ছে কেন? কাউকে খুঁজছে না-কি? আমাদের রুম থেকে বের হতেই দেখলাম মেজচাচা ওর পেছনে পেছনে আসছে। আমিও এগিয়ে গেলাম। লোকটা অস্থির হয়ে বলছে যে, তাঁর স্ত্রীর প্রসব ব্যথা উঠেছে।  এখন বয়স্ক ও অভিজ্ঞ এক-দু’জন মহিলা দরকার।  চাচা রুমের ভেতরে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর দেখলাম দাদী ও মা বেরিয়ে এসে ঐ লোকটির ঘরে ঢুকলো। যারা খাবার নিয়ে এসেছিলো তাদেরই একজন গরম পানির সন্ধানে পাশের বাড়িতে ছুটে গেলো।

প্রায় ঘণ্টা দু’য়েক কেটে গেলো।  সেই মুহূর্তে সবার আগ্রহের বিষয় একটিই। আশ্রয়কেন্দ্রে একটি বাচ্চার জন্ম হতে চলেছে।  ইতিমধ্যে গ্রামে খবর রটে গেছে স্কুলঘরে একটা বাচ্চার জন্ম হবে  চেয়ারম্যান ও মাউলানাসাবও এসে হাজির হলেন। স্কুল লাগোয়া রাস্তায় ততক্ষণে অনেক মানুষ জড়ো হয়েছে

কিছুক্ষণ পর সেই রুম থেকে নবজাতকের চিৎকার ভেসে এলো।  কেউ একজন দৌড়ে এসে চেঁচিয়ে বললো,

‘ছেলে হয়েছে, ছেলে। ’

মাউলানাসাব বললেন, ‘কেউ একজন আযান দেন।’

উপস্থিত লোকজনের মধ্যে থেকে অল্পবয়সী একটি ছেলে আযান দিলো। ছেলেটি সম্ভবত কোনো মাদ্রাসায় পড়ে। লম্বা ফতুয়া দেখে তা-ই মনে হচ্ছিলো।  

মাউলানাসাব বললেন, ‘আল্লাহর কী অসীম রহমত! একটি নিরাপদ জায়গায় পৌঁছাইয়া বাচ্চাটার জন্ম হইলো। রাস্তার কত জায়গায়ই তো বিপদ হইতে পারতো! সব আল্লাহর লীলা

বাচ্চাটির বাবা চেয়ারম্যানকে কৃতজ্ঞতা জানালো। পাশে দাঁড়ানো একজন বলে উঠলো, ‘চেয়ারম্যানসাব আপনে বাচ্চাটার একটা নাম রাইখা দেন।’

চেয়ারম্যান বললেন, ‘না না, আমি ক্যান? বাচ্চার বাবা-মা নাম ঠিক করবে, এইটাই হওয়া উচিৎ।’

বাচ্চাটির বাবা বললেন, ‘কোন অসুবিধা নাই, চেয়ারম্যানসাব আপনিই একটা নাম দেন।’

‘বাচ্চাটা যেহেতু এই সংগ্রামের মধ্যে জন্ম নিছে, তাই ওর নাম দিলাম ‘সংগ্রাম’। এটা ডাক নাম। ভালো নামটা আপনেরা পরে ঠিক করে নিয়েন।

আবার ভাসাইলাম নাও অথৈ দরিয়ার জলে...

৯ই এপ্রিল, ১৯৭১

সকাল ন’টা, ছবিপুর।  আমরা নৌকার অপেক্ষায় নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি। চেয়ারম্যান দুটি নৌকার মাঝিকে বলে রেখেছেন আমাদের কথা। লোকমানও আমাদের সাথে নদীর পাড় পর্যন্ত এসেছেও হাসিমুখে বললো,

‘ভাইসাব, চেয়ারম্যানসাব মাঝিরে কইয়া দিছেন। ওরা আফনেগো তালতলী ঘাটে নামাইয়া দেবে।  ঐখান থেইক্যা নতুল্লাবাদ খুব কাছে।’

লোকমানের কথা শেষ হতেই দেখলাম দু’টো নৌকা আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। ঘাটে আরও অনেক নৌকা ভিড়ানো আছে। কেউ কেউ নৌকায় পাড়ি জমাচ্ছে অন্য কোথাও, আবার কেউবা দূরদূরান্ত থেকে ছবিপুরে এসে নোঙর করছে আমাদের নৌকা দু’টো বেশ ছোট।  অন্ততঃ বিবির বাজার কিংবা মুন্সীরহাট খেয়াঘাটের নৌকার মত বড় নয়।  আমি ভাবছিলাম, এত ছোট নৌকা নিয়ে লম্বা দূরত্বে যাওয়া কী ঠিক হবে? কিন্তু আমাদের আর কোন উপায় নেই।  ঘাটে এ মুহূর্তে প্রচুর লোক নৌকার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে।  নৌকার অভাবে কেউ নিজেদের গন্তব্যে যেতে পারছে না।   

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের নৌকা পাড়ে ভিড়লো। ছোট হলেও দু’টো মিলে দলের সবার জায়গা সংকুলান হয়ে গিয়েছিলো। আমাদের লোকজনকে দুই ভাগে ভাগ করে দুই নৌকায় তুললাম।  সবাইকে সামাল দেয়ার জন্য একটাতে ছোটচাচা, সফিক ভাই আর চন্দনকে রাখলাম; আর অন্যটাতে আসাদ ভাই আর ছোটমামার সাথে আমি রইলাম।

লোকমানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সকাল সাড়ে ন’টায় আমরা নৌকা ভাসালাম। আবার শুরু হলো আমাদের পানিপথে যাত্রা। এবার আমরা চলছি আড়িয়াল খাঁ নদী দিয়ে।  মেঘনার মত বিশাল না হলেও আড়িয়াল খাঁ-কেও হেলাফেলা করার কোন সুযোগ নেই।

আমি যে নৌকায় উঠেছিলাম সেই নায়ের মাঝির নাম ছমির আলী। চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়সী যুবক। ও মুলাদীর খাসেরহাট এলাকার বাসিন্দা। আমি জিজ্ঞেস করলাম,

‘ছমির, তালতলী পৌঁছাতে আমাদের কতক্ষণ লাগবে?’

‘ঘণ্টা চাইরেক লাগবে। ’

তাঁর মানে তালতলী পৌঁছাতে প্রায় দুপুর দেড়টা বাজবে।  আমাদের দুই নৌকাই একই গতিতে এগিয়ে চলেছে। একটার পেছনে আরেকটা। নৌকার মাথায় বসে ছোটমামা আর আসাদ ভাই সবকিছু তদারকি করছেবড়মামাদের নৌকাটাকে সামনে দিয়ে আমরা পেছন পেছন যাচ্ছি। নুরুল ফুপা নৌকায় বসে বিড়বিড় করে দোয়া-দরুদ পড়ছেন, মিনু ফুপু সুমিকে কোলের মধ্যে বসিয়ে চুপচাপ বসে আছে।  মেজচাচী রানু আর ছোটমামীর সাথে নিচুস্বরে কথা বলছে। পূব আকাশে হালকা মেঘ জমেছে, তবে বাতাসের বেগ স্বাভাবিকই রয়েছে। মেঘ থাকায় একটা সুবিধে হয়েছে, রোদের তাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যাচ্ছে।  তবে বৃষ্টি নামলে আবার বিপদ। কারণ দু’টি-ই খোলা নৌকা।  বাচ্চাসহ সবাইকে ভিজতে হবে।

এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী কিছুটা অন্যরকম।  নদীর দু’পাড়েই অবারিত ফসলের ক্ষেত।  সেখানে সবুজ ধান ক্রমশ সোনারঙ ধারণ করেছে। হয়তো আর কিছুদিনের মধ্যেই ওগুলো কাটার উপযোগী হবে, তখন এইসব ক্ষেতে কৃষকের আনাগোনা অনেক বেড়ে যাবে। বরিশাল নিয়ে একটা প্রবাদ চলমান আছে, ‘ধান-নদী-খাল, এই তিনে বরিশাল’ কথাটা একেবারেই সত্য। বরিশালে প্রবেশ করার পরই তা টের পাওয়া গেলো।

এখানে সবই আছে। প্রকৃতি তার অকৃপণ হাতে সবকিছুই সাজিয়ে রেখেছে, সম্পদের সমাহার  আর কিছুদিনের মধ্যেই কৃষকের উঠোন ভরে উঠবে সোনালি ধানেকিন্তু তারা সেগুলো ভোগ করতে পারবে তো! পেছনে হা-করা হায়নার ভয়াল থাবা সেই সুখ কেড়ে নেয়ার জন্য তৎপর। আমার ভাবনা হয়তো এ সবকিছুই ঠিক থাকবে, কেবল ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে এদেশের মানুষগুলোর ভবিষ্যৎ।

আমি ছমিরের কাছাকাছি বসে বরিশালের অবস্থা সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছিলাম।  তারেক যথারীতি আমার পাশে বসে নানা প্রশ্ন করে যাচ্ছে।

তারেক জানতে চাইলো, ‘বরিশাল আর কতদূর?’

‘আমরা তো বরিশালের ভেতরেই আছি। মুলাদী তো বরিশালের একটি থানা।’

‘আমি জানতে চাইছি, আমাদের বাড়ি কতদূর?’

‘এখনও অনেক দূর। এখনও প্রায় চারঘণ্টা লাগবে তালতলী ঘাটে পৌঁছাতে। তারপর পায়ে হেঁটে নথুল্লাবাদ বাসস্ট্যাণ্ডে যাবো। সেখান থেকে যে কোন ট্রান্সপোর্ট যোগাড় করে বাড়ি যেতে হবে। ’

‘নথুল্লাবাদ যেতে পারলে তো পৌছাইয়াই গেলাম!’

‘হুম।  তা বলা যায়। ’

আমি ছমিরকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বরিশালে পাকিস্তানি মিলিটারিরা আসছে না-কি?’

‘না, এহনও এইদিগে মিলিটারী আয় নাই। তয় হুনলাম বরিশালে নাকি শান্তিবাহিনী করা অইবে। ’

তারেক বিরক্তি মেশানো কণ্ঠে বললো, ‘এরা তো আরও খারাপঘরের শত্রু বিভীষণ। ’ তারপর হঠাৎ কী মনে করে ছমিরকে প্রশ্ন করে বসলো, ‘আপনে কী শান্তিবাহিনীতে যোগ দিবেন?’

ছমিরের কণ্ঠে প্রচ্ছন্ন রাগ। ‘ক্যা, শান্তি বাহিনীতে যোগ দিমু ক্যা? লাগলে মুক্তি বাহিনীতে যামু। ’

তারেক বিড়বিড় করে বললো, ‘সাবাস! ব্যাটা বাঘের বাচ্চা। ’

তারেকের বলার ভঙ্গিতে আমি হেসে ফেললাম।  ছমির আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলো, ‘ছার, মোরে কইলেন?’

‘মুক্তিবাহিনীকে বললাম। ’ তারেক হেসে জবাব দিলো।

‘ঢাকায় নাকি অনেক মানুষ মাইর‍্যা ফেলাইছে, কতাডা সত্য ছার?’

আমি ছোট্ট করে উত্তর দিলাম, ‘হুম।’

ছমির তার ক্ষোভ ঝাড়লো। ‘হারামজাদারা কত মানুষ মাইরা ফালাইছে! আল্লাহ অগো বিচার করবে।’

একঘণ্টা হলো আমরা ছবিপুর ছেড়ে এসেছি। আকাশের অবস্থা কিছুক্ষণ পর পরই বদলে যাচ্ছে। এই দেখা গেলো ঘণ মেঘ আবার একটু পরেই রোদ হাসছে। আমি ভয় পাচ্ছিলাম বৃষ্টি নিয়ে। যদিও সকাল থেকে এখন পর্যন্ত আশেপাশে কোথাও বৃষ্টি নামেনি। আমি ছমিরকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ছমির, বৃষ্টি নামার সম্ভাবনা আছে না-কি?’

‘ছার, এহন কালবৈশাখীর সময়বিস্টির কোনো ঠিক-ঠিকানা আছে! যহন-তহন নামতে পারে।’

‘তাহলে তো সমস্যা। ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে তো ভিজতে হবে।’

কিছুক্ষণ পর আমার কথার উত্তর দিলো অনেকটা দায়সায়রাভাবেই। ‘দেহি কী করন যায়। বিস্টি নামলে নদীর পাড়ে কোন বাড়িঘর দেইখা থামাইতে অইবে।’

পর্বঃ  ২৩

আমি বুঝলাম ওর আসলে কিছু করার নেই। তাৎক্ষনিকভাবে যতটুকু সম্ভব তা-ই করবে। ছপ ছপ ছপ। নদীর পানিতে ছমিরের বৈঠা পড়ছে। আমর সবাই চুপচাপ বসে সময় গুনছি কখন তালতলী পৌঁছাবো। আনুর ঘুম ভাঙলো মাত্র। রানুর কাঁধে শুয়ে ও এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। আমার দিকে চোখ পড়তেই হেসে দু’হাত বাড়িয়ে দিলো। আমি ওকে কোলে তুলে নিলাম। ও আমার বুকের সাথে সেঁটে রইলো। মেজচাচী ওর সাথে ইশারায় কথা বলছে, ও খিলখিল শব্দে হেসে চলেছে।

মনে হচ্ছে বড়মামাদের নৌকায় কোন সমস্যা হয়েছে। আসাদ ভাই সফিক ভাইকে জিজ্ঞেস করছেন কী হয়েছে। সফিক ভাই জানালো পানি জমেছে, সেচে ফেলতে হবে।  কিছুক্ষণ পরই দেখা গেলো মনা পানি সেচছে। তার মানে ওদের নৌকায় বেশি পানি জমেছিলো। ছমির আলী বললো,

‘ডরাইয়েন না, পানি হেইচ্চা ফালাইলে আর কিছু অইবো না।’

আমি বললাম, ‘আমাদের নৌকায় পানি উঠেছে না-কি? একবার দেখে নাও।’

ছমির বেশ দৃঢ়তার সাথেই বললো, ‘আমার নাওয়ে পানি নাই, নাও ছাড়ার আগেই আমি দেইখ্যা লইছি।’

আমরা অর্ধেক পথ পার হয়ে এসেছি। নদী এখানে খুব আঁকাবাঁকা। মানে নৌকা সোজাপথে চলছে না। এখন ভাটা। তাই স্রোতের অনুকূলে বেশ দ্রুত চলছে আমাদের নৌকা। এই গতিতে চললে আমি আশা করছি তালতলী পৌঁছাতে আমাদের চারঘণ্টা লাগবে না। একমাত্র শঙ্কার বিষয় হলো বৃষ্টি। যে ভয়টা শুরু থেকেই করছিলাম সেই বৃষ্টি এখনও নামেনি তবে ছাই রঙের পূব আকাশে কালচে খণ্ড খণ্ড মেঘরাশি জানান দিচ্ছে যে কোনো সময় বিনা নোটিশে হুড়মুড় করে নামবে।

আমি নদীর দু’পাশে দৃষ্টি ফেললাম। আমরা উত্তর থেকে দক্ষিণে যাচ্ছি। নদীর পূব ও পশ্চিম পাড়ে কখনও ঘন সবুজ গাছপালার আড়ালে বাড়িঘর চোখে পড়ছে আবার কখনও ধানক্ষেত। আমরা আরও কিছুদূর এগিয়ে গেলাম।

ছমির আলী আকাশের দিকে তাকালো। ওর চোখে একটা শঙ্কার ছাপ দেখলাম, তবে মুখে কিছু বললো না। ও নদীর দু’পাড়ে তাকালো। আমি খেয়াল করলাম এই মুহূর্তে আমাদের চারপাশে বিস্তীর্ণ একালাজুড়ে শুধু ফসলের ক্ষেত। কোনো লোকালয় চোখে পড়ছে না। মনে মনে বললাম, ‘এখন বৃষ্টি শুরু হলে নির্ঘাত ভিজতে হবে।’

ছমিরের দিকে তাকিয়ে আবার বললাম, ‘তোমার নৌকায় বৃষ্টি থেকে বাঁচার কোন কিছু আছে?’

ছমিরের মুখ কালো হয়ে গেলো। ও ছোট্ট করে বললো, ‘না ছার।’

নুরুল ফুপাকে বললাম, ‘আপনার ছাতাটা কোথায়?’

‘ঐ নৌকায়। ব্যাগের সাথেই রাখা।’

‘বৃষ্টি তো শুরু হলো বলে! এখন তো সবাইকে ভিজতে হবে। ছাতা থাকলে বাচ্চাদের অন্তত ভেজার হাত থেকে বাঁচাতে পারতাম।’

আমাদের কথা শেষ না হতেই বড় বড় ফোঁটা পড়া শুরু হলো। মেজচাচী আনুকে আমার কাছ থেকে নিয়ে কোলে বসিয়ে নিজের কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখলেন। রানু নিজেও বৃষ্টি থেকে আনুকে রক্ষার চেষ্টা করতে লাগলো।  কিন্তু সব চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝমঝমিয়ে নামলো। এক ঝটকায় সবাই ভিজে একাকার। বাতাসের বেগও ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে।  আমি মরিয়া হয়ে এদিক ওদিক তাকালাম। কাছাকাছি কোথাও কোন গাছপালা নেই।  অনেক দূরে নদীর পাড়ে কয়েকটি গাছের নিচে একটি ছোট টিনের ঘর দেখা যাচ্ছে।  কিন্তু আমার মনে হলো ঐ ঘরের কাছে আমরা পৌঁছুতে পারবো না। নদী ক্রমশ ফেঁপে-ফুলে উঠছে। আমি ছমিরকে বললাম, ‘নৌকা পাড়ে ভিড়াও।’  

আসাদ ভাইও চিৎকার করে সফিক ভাইকে নৌকা পাড়ে ভিড়াতে বললেন। ছমির নৌকা পাড়ে ভিড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে বার বারসামনে একটা বাঁক। এ মুহূর্তে স্রোত অনেক বেড়ে গেছে। মনে হচ্ছে ও কোনোভাবেই নৌকা কন্ট্রোল করতে পারছে না। প্রায় পাঁচ-ছয় মিনিট চেষ্টার পর সফিক ভাইদের নৌকাটি পাড়ে ভিড়লো। সফিক ভাই আর ছোটমামা লাফ দিয়ে তীরে নেমে রশি দিয়ে নৌকাটিকে পাড়ের কাছাকাছি ধরে রাখছে।

ইতিমধ্যে ছমির আমাদের নৌকাকেও নিয়ে এসেছে পাড়ের কাছাকাছিঠিক তখনই বড় একটি ঢেউ এক ধাক্কায় আমাদের নৌকাটিকে সফিক ভাইদের নৌকার একেবারে কাছে এনে ফেললো।  ছমিরের দক্ষতায় অল্পের জন্য দুটি নৌকাই সংঘর্ষ থেকে বাঁচলো বটে তবে ততক্ষণে ঘটে গেলো আরেকটি বিপত্তি। আমাদের নৌকায় গলগল করে পানি উঠতে শুরু করেছেএমন চলতে থাকলে অল্পক্ষণের মধ্যেই নৌকা ডুবে যাবে। আমরা কেউ পাড়ে নামার সুযোগও পাবো না।

ছমির হঠাৎ আঁতকে উঠে বললো, ‘সব্বোনাশ! ছার, নৌকার তলী ফাইট্টা গ্যাছে। সবাইরে পাড়ে নামাইতে অইলে পানিতে নাইম্যা নাও নিচে থেইক্যা ধইরা রাখতে অইবে।’ 

আমি আমাদের অন্য নৌকাটার দিকে তাকালাম। ঐ নৌকার সবাই পাড়ে উঠে গেছে। আমি সফিক ভাই, ছোটচাচা আর চন্দনকে চিৎকার করে বললাম, ‘এই নৌকার তলা ফেটে গেছে, সবাইকে পাড়ে তোলার ব্যবস্থা করেন।’

আসাদ ভাই আর ছোটমামাকে ইশারা করে আমি আর ছমির পানিতে লাফ দিলাম। আমার সাথে সাথে ওরাও ঝাপিয়ে পড়লো। আমরা চারজনে নৌকার নিচ থেকে ধরে রাখলাম। সফিক ভাই, চন্দন আর তারেক মিলে নৌকা থেকে সবাইকে নামানোর কাজটা করছিলো। স্রোতের জন্য আমাদের পক্ষে পানিতে স্থির থাকা সহজ ছিলো না, তাই সফিক ভাইদের তাড়া দিচ্ছিলাম দ্রুত সবাইকে নামিয়ে নিতে। একে এক সবাই নৌকা থেকে নেমে পড়লো কিন্তু শেষ মুহূর্তে বিপত্তি ঘটালো মিনু ফুপু। তাড়াহুড়া করে পাড়ে উঠতে গিয়ে কখন যে সুমির হাত ছেড়ে দিয়েছে সে খেয়াল নেই।

হঠাৎ ঝপ করে পানিতে কিছু পড়ার শব্দ শুনে ঘুরে তাকাতেই দেখলাম ভেসে যাচ্ছে সুমিআমি ছমিরকে শুধু বললাম, ‘এই পাশটাও ধরো’ নৌকা ছেড়ে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। সুমিকে হাতের নাগালে না পেলেও ওর জামা ধরতে সক্ষম হলাম। একটানে আমার কাছে নিয়ে এলাম। পাড়ের কাছে এনেই ওকে উঁচু করে ধরলাম। সফিক ভাই হাতটা বাড়িয়ে দিলো। নৌকার দিকে তাকিয়ে দেখলাম সবাই নেমে পড়েছে।  আমি আর ছমির মিলে নৌকাটাকে রশি দিয়ে পাড়ে নোঙর করে নদী থেকে উঠে এলাম।

সফিক ভাই সুমিকে সুস্থ করার চেষ্টা করছিলো।  একটু পর ওকে উপুর করে তার থাইয়ের উপর শুইয়ে পিঠে হালকা চাপ দিচ্ছে মিনু ফুপু বড় আপাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে। আমাকে দেখতে পেয়ে ফুপু আমার গলা ধরে বললো, ‘সুরুজ, আমার সুমি বাঁচবে তো?’ আমি তাকে অভয় দিয়ে বললাম, ‘চিন্তার কিছু নাই, ও ঠিক হয়ে যাবে।’

পেটের পানি বের হয়ে যাবার পর সুমি ধীরে ধীরে সুস্থ্ হয়ে উঠলো। অবশ্য বেশি পানি খেতে হয়নি ওকে, আমি সময়মত দেখতে পেয়েছিলাম। চন্দনকে বললাম দেখতো বাকী সবাই ঠিকঠাক আছে কি নাএকটু পরই ও এসে জানালো সবাই ঠিক আছে। হঠাৎ মেজচাচী বললো, তার ব্যাগ পাওয়া যাচ্ছে না। আমি ছমিরকে বললাম, ‘দেখো তো তোমার নৌকায় পড়ে আছে কি না’ ও নৌকা চেক করে বললো নৌকায় কিছু নাই। আমি পাড়ের এদিক ওদিক চোখ বোলালাম। বেশ কিছুদূর সামনে নদীর দিকে ঝুঁকে থাকা আধো ডুবন্ত ছোট একটা হিজল গাছের সাথে কালো কিছু চোখে পড়ছিলো। আমি ইশারা করতেই ছমির সেদিকে দৌড়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর ও হাসিমুখে ফিরে এলো। হাতে ঝুলছে কালো একটা ব্যাগ, ছুপছুপে ভেজা। মেজচাচী বললো, ‘হ্যাঁ, এটাই।’ এতক্ষণে আমি রানুর দিকে তাকালাম। দেখলাম ও তখনও থরথর করে কাঁপছে।

আমি ওর কাছে গিয়ে বললাম, ‘গ্রামের মেয়ে হয়ে তুমি এত ভীতু কেন?’

ও ভীতসন্ত্রস্ত কণ্ঠে বললো, ‘যেখানে জীবন মরণের প্রশ্ন, সেখানে গ্রাম-শহর আলাদা কিছু কী?’

আমি হেসে বললাম, ‘আলাদা নয়, তবুও তোমার আরও একটু সাহসী হওয়া দরকার। কখনও কখনও মানুষকে এ রকম অনেক জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, সেগুলো সামলাবে কী করে? মাকে দেখে শেখো।’

রানু আর কিছু বললো না। মায়ের কাছে চলে গেলো। এখন আর ভারী বৃষ্টি নেই। গুড়ি গুড়ি ঝরছে। মা আনুর ব্যাগটা ছাতা দিয়ে বৃষ্টিভেজার হাত থেকে রক্ষা করেছেন। আনুর জামাকাপড় পালটে দেয়া হয়েছে। মা ওকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আর বাবা পেছন থেকে ছাতা ধরে রেখেছেন।  অন্য বাচ্চাদেরও কাপড় পালটে দেয়া হয়েছে। ছমির আর অন্য মাঝি এখনও আমাদের সাথেই আছে। আমাদের নৌকা উল্টে যাবার পর আরও দু’টো নৌকা এইপথ দিয়ে চলে গেছেএকটা নৌকা তীরে থামিয়ে আমাদের খোঁজখবর নিলো।

ছমির আঙুল দিয়ে সামনের দিকে ইশারা করে বললো, ‘সামনে একটা মোড় তো, হেই-লগগাই এইহানে পানির ছ্রোত এত বেশি।’

আমি কিছুটা রুক্ষস্বরেই বললাম, ‘এইসব বলে তো আর লাভ নাই, এখন বলো আমরা কী করে তালতলী পৌঁছবো।’

ছমির নরম গলায় বললো, ‘ছার, সামনে মীরগঞ্জ গ্যালেই নৌকা পাইবেন

‘আরে! মীরগঞ্জ কীভাবে যাবো?’

‘অলফো পতনদীর পাড় ধইরা আধগন্টা আইট্টা গ্যালেই মীরগঞ্জে যাইতে পারবেন।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

আমি আমাদের নৌকা দুটোকে দেখলাম। আমি যেটাতে চড়েছিলাম সেটা সম্পুর্ণ অকেজো। আর অন্য নৌকাটিও পুরোপুরি অক্ষত নয়। এগুলো নিয়ে সামনে এগোনো সম্ভব নয়। তাই ওদের ভাড়া মিটিয়ে দিলাম। ছমিরের দেখানো পথেই আমরা মীরগঞ্জের দিকে হাঁটতে লাগলাম। নদীর পাড় ধরেই হেঁটে চলেছি। নদীর ওপাশটায় চর, আর এপাশটা ভাঙনের পাড়। পানির গভীরতা ও স্রোত এ পাড়ে অনেক বেশি। পাড় থেকে অল্পকিছুটা জায়গা বাদ দিলে শুধু আধপাকা ধানের ক্ষেত। আশেপাশে কাছাকাছি কোন লোকালয় চোখে পড়ছে না মীরগঞ্জ পৌঁছুতে কতক্ষণ লাগবে জানি না। চন্দন এবার নিজে থেকেই দাদাকে কাঁধে তুলে নিলো। আমি কিছু বললাম না, কারণ আরও কতটা পথ হাঁটতে হবে আমাদের জানা নেই।

ঝড়ের আগে নৌকায় বসে যে ঘরটি চোখে পড়েছিলো, কিছুদূর সামনে আসতেই সেই ছোট ঘরটির কাছে চলে আসলাম। এটি আসলে কোন বসতবাড়ি নয়। তিন রাস্তার মোড়ে নদীর পাড়ে একটা ছোট চায়ের দোকানদূর থেকে টিনের বেড়া দেখে মনে হয়েছিলো কারো বাড়ির অংশদোকানি ছাড়া আর একজন খদ্দের বসে আছে দুজনে কথা বলছিলো। একটু পর দেখলাম দোকানি গলা বাড়িয়ে আমাদের দলটিকে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো,

‘আপনেরাই কি হেই ডুইবা যাওয়া নৌকায় আছিলেন?’

আমি মাথা নেড়ে সায় জানালাম।

খদ্দের লোকটি বললো, ‘পেরায় গন্টাখানেক আগে দুইডা নৌকা গ্যাছে এইহান দিয়া, হেরাই কইলো। আপনেরা সবাই ঠিকঠাক আছেন তো?’

আমি বললাম, ‘সব ঠিক আছে। আপনেরা কি বলতে পারবেন কাছাকাছি কোথায় তালতলী যাওয়ার নৌকা পাওয়া যাবে?’

লোকটি বললো, ‘এইহানে কিছু পাইবেন না। সামনে মীরগঞ্জ। ঐহানে নৌকা পাওন যাইবে।’

বুঝলাম এ লোক ছমিরের বলা কাহিনীই আবার শোনাবে। তাই ওখানে আর সময় নষ্ট না করে সামনে হেঁটে চললাম। আশ্রয়কেন্দ্রে থাকাকালীন সময়ে যতটুকু রিফ্রেশ হয়েছিলাম এই ঝড়ের কবলে পড়ে তারচেয়ে অনেক বেশি বিধ্বস্ত অবস্থা আমাদের। বিশেষ করে বাচ্চারা। ওরা প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে। তবুও আমরা এগিয়ে চলছিলাম। মিনু ফুপু এখনও স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি। সুমিকে কোলে নিয়েছে নুরুল ফুপা আর মিনু ফুপু তার পাশাপাশি হাঁটছে। আনু আমার কোলে বসে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, হয়তো নিজের চেনা পরিবেশের সাথে এই জায়গাকে মেলাতে পারছে না। আমার মুখের দিকে চোখ পড়তেই ও ফিক করে হেসে উঠে আমার গলা জড়িয়ে ধরলো।   

পর্বঃ  ২৪

আমরা আধা ঘণ্টা ধরে হাঁটছি। সবাই খুব ক্লান্ত। ভেজা কাপড় শরীরের তাপে গায়েই শুকিয়ে গেছে প্রায়। হঠাৎ মতিনের ডাকে পেছনে ফিরে চাইলাম। দাদী কিছুটা সমস্যা হয়েছে। সম্ভবত পায়ে ব্যথা পেয়েছেন। এবার দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে গেলো।

শফিক ভাইকে বললাম, ‘মনে হচ্ছে এবার দু’জনকেই বয়ে নিয়ে যেতে হবে।’

সফিক ভাই মৃদু হাসলেন। ‘চিন্তা করো না, একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে। দাদী কি আমার কোলে উঠবে?’

‘মনে হয় না। আপনার নেয়ার দরকার নেই, আমিই নিচ্ছি।’

আনুকে মায়ের কোলে দিয়ে দাদীকে কোলে তুলে নিলাম। দাদী খুব বিব্রত বোধ করছিলেন। নিচু কণ্ঠে আমাকে বললেন, ‘ভাইরে, তোগোরে অনেক কষ্ট দেতে আছি। আল্লাহ তোরে অনেক বড় করবে’ আমার জন্য দাদীর টানটা সবসময়ই একটু বেশি। তাঁর বড় দুই মেয়ের কোন ছেলে নেই। আমার বড় দুই বোনের পর আমিই তার প্রথম নাতি। তাই বরাবরই তার প্রিয় ছিলাম। শুনেছি ছোটবেলায় আমাকে কোলে নিয়ে হাঁটতেন আর সুর বাঁধতেন। বলতেন, ‘একটা সুরুজ ঐ আকাশে, একটা সুরুজ আমার ঘরে। আমার এই সুরুজটাই তো বেশি সোন্দর।’ কথাটা মনে পড়লে এখনও খুব হাসি পায়।

এখন কাঠফাটা রোদ্দুর। একফোঁটাও মেঘ নেই আকাশে। নদীর পাড়ে কোন গাছপালাও নেই। আমাদের সাথে আনা কয়েকটি ছাতা দিয়ে বয়স্ক আর বাচ্চাদেরকে রোদের তাপ থেকে বাঁচানোর চেষ্টা চলছে পায়ের নিচে ভেজা বালুমাটি থাকায় হাঁটতে পারছে সবাই। আরও কিছুক্ষণ হাঁটার পর দূরে নদীর পাড়ে দোকানপাট দেখা যাচ্ছিলোবাচ্চাদের উৎসাহ দেবার জন্যই দোকানগুলো দেখিয়ে বললাম, ‘ঐ যে দেখ মীরগঞ্জ দেখা যাচ্ছে, আমরা চলে এসেছি। আরেকটু কষ্ট কর।’ ওরাও আশান্বিত হয়ে তাড়াতাড়ি হাঁটছিল।

অবশেষে পনেরো মিনিটের মধ্যে আমরা মীরগঞ্জে পৌঁছালাম। ওখানে পৌঁছে বুঝলাম আমাদের নৌকাডুবির খবরটি ইতিমধ্যে চাউর হয়ে গেছে। অনেকেই দুঃখ প্রকাশ করছিলো। আমি মনে মনে ভাবলাম, এতই যদি দুঃখবোধ তোমাদের তাহলে এই একঘণ্টার মধ্যে একটা নৌকা তো পাঠাতে পারতে! যাই হোক, অবশেষে একটা নৌকার ব্যবস্থা করে ফেললাম। এবার সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এই নৌকাটা বেশ বড়। এক নৌকাতেই আমাদের সবার জায়গা হয়ে গেলো। মীরগঞ্জ থেকে আরেকটা নদী পশ্চিমদিকে বাবুগঞ্জ হয়ে আরও সামনে চলে গেছে। এই নদীটির নাম সুগন্ধা

দেরী না করে আমরা তালতলীর উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে দিলামদু’জন মাঝি মিলে দাঁড় টানছে। খুব দ্রুত ছুটে চলেছে নৌকা। সুগন্ধা নদীকে পেছনে ফেলে আড়িয়াল খাঁ দিয়েই চলছি আমরা। এই আড়িয়াল খাঁ আরও দক্ষিণে গিয়ে শহর ঘেঁষে বয়ে চলা বরিশালের মূল নদী কীর্তনখোলার সাথে মিশেছে। আমরা অবশ্য কীর্তনখোলার দিকে যাবো না, তার আগেই ডানদিকে একটি সরু ধারা দিয়ে তালতলী ঘাটে চলে যাবো। এখন নদী একেবারেই শান্ত। মাথার উপরে ত্তপ্ত সূর্য থাকলেও ঝিরঝিরে বাতাসে গরমটা তেমন অনুভূত হচ্ছে না। দলের সবার মাঝেই অনেকটা স্বস্তি ফিরে এসেছে। আমি মাঝিকে জিজ্ঞেস করলাম, তালতলী পৌঁছতে কতক্ষণ লাগবে?

মাঝি দাঁড় টানতে বললো, ‘দেড় ঘণ্টার মতন লাগবে

তার মানে আমাদের দুপুর দু’টো বাজবে। আমি আবার মাঝির কাছে জানতে চাইলাম তালতলী থেকে নথুল্লাবাদ পায়ে হেঁটে যেতে কতক্ষণ লাগবে। সে জানালো, ‘ঘণ্টাখানেক সময় লাগার কতা, তয় আপনাগো লগে পোলাপাইন আর বুড়া মানুষ আছে, একটু সময় বেশি লাগতে পারে’ হিসেব করে দেখলাম সন্ধ্যার আগেই আমরা বাড়িতে পৌঁছাতে পারবো। আমি মনে মনে শান্তি অনুভব করলাম এই ভেবে যে, এত দুর্যোগ, ঝড়-ঝঞ্ঝা, বিপদ পেরিয়ে আমরা এখন বাড়ির খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছি।

মিনু ফুপু এখন অনেক সতর্ক। ঝড়ের পর থেকে সুমিকে কোনোভাবেই হাতছাড়া করছে না এখন যেমন কোলের মধ্যে নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। নুরুল ফুপাও সুমনকে কাছে বসিয়ে রেখেছে। তিনি স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বিড়বিড় করে দোয়া দরুদ পড়ছেন।  গোরান থেকে বের হওয়ার পর থেকে সারাক্ষণই ফুপাকে দেখছি দোয়াদরুদ পড়ছে। মাঝে মাঝে আমাকেও বলছে বিপদে সবসময় আল্লাহকে স্মরণ করতে হয়।  মেজচাচা এখন অনেক ফ্রেশ লাগছে। দাদা মেজচাচাকে বলছে,

‘ও ফজলু, মোরা নৌকায় কই যাইতেছি?’

‘বাড়িতে যাইতেছি।’

দাদা মাঝে মধ্যেই এরকম ছোট ছোট প্রশ্ন করে এবং অল্পতেই তার কৌতুহল মিটে যায়। একটু পরেই আবার জিজ্ঞেস করলেন,

‘সুরুজ আইছে?’

মেজচাচা বললেন, ‘হ্যাঁ, আসছে।’

দাদা চোখে না দেখলেও কেমন করে যেন অনেককিছুই বুঝতে পারেন। এই যেমন এখন তার পাশে যে মেজচাচা বসেছে কেউ তাঁকে বলেনি। চন্দন তাঁকে নৌকায় বসিয়ে দেয়ার পর চাচা চুপচাপ তার একপাশে গিয়ে বসেছে। তিনি কিন্তু ঠিকই বুঝেছেন পাশে তার মেজছেলে।   

আমি দাদীকে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দাদী, পায়ের ব্যথা কমেছে?’

দাদী চিন্তিত মুখে বললো, ‘কইতে পারতেছি না ভাই। খাড়াইতে পারলে বুছতে পারমু।’

তাঁকে আস্বস্ত করতে আসাদ ভাই বললেন, ‘চিন্তা কইরো না দাদী। তোমারে কোলে কইরা বাড়ি নিয়া যামু।’

দাদী নিঃশব্দে ফোকলা দাঁতে হাঁসলো।

আনু এদিক ওদিক তাকিয়ে কী যেনো খুঁজছে। আমি নুরুল ফুপার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছি তাই ও দেখতে পাচ্ছে না। রানু মুচকি হেসে আমার দিকে তাকালো। আমি হেসে আমার মাথা সামনের দিকে বাড়িয়ে দিলাম। আনুর সাথে চোখাচোখি হতেই ও আমার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। আমার কোলের মধ্যে চুপচাপ বসে আছে আনু।  তারেক ওর সাথে দুষ্টুমি করছে আর ও হাসছে।

প্রায় ঘণ্টাখানেক কেটে গেছে আমরা মীরগঞ্জ ছাড়িয়েছি। সামনে একটা বাঁক চোখে পড়ছে।

সফিক ভাই মাঝিকে বললো, ‘সাবধান। আগেরবার এরকম বাঁকের কাছে এসেই কিন্তু নৌকা ঝামেলায় পড়েছিলো।’

মাঝি গম্ভীর মুখে বললো, ‘চিন্তার কিছু নাই। কিচ্ছু অইবে না। আম্ফনেরা চুপচাপ বইয়া থাহেন।’

আমি স্মিতহেসে সফিক ভাইকে বললাম, ‘তখন তো ঝড়ের সময় ছিল, এখন আর সেই ভয় নেই।’

সফিক ভাই হেসে বললেন, ‘জানি। তবুও ওকে সাবধান করা।’

আমরা অল্পকিছুক্ষনের মধ্যেই বাঁকটা পেরিয়ে ডানদিকের সরু নদীতে ঢুকে পড়লাম এটা অনেকটা খালের মত এখানে তেমন স্রোত নেই পানির চাপও নেই খুব একটা নদীতে এখনো ভাটা চলছে, তাই উজান ঠেলে যেতে হচ্ছে বড় নদীতে থাকাকালীন যে ভয়টা ছিলো, এখন আর তা নেই আমরা শুধু সময় গুনছিলাম- কখন পৌঁছব তালতলী

আমরা দুপুর দুইটা নাগাদ তালতলী বাজারে পৌঁছালাম এই ভরদুপুরেও বাজারে লোকজনের আনাগোনা কম নয় দুজন লোক কাছে এসে জানতে চাইলো আমরা সেই ঝড়ে ডুবে যাওয়া নৌকার যাত্রী কি না আমি কিছুটা অবাক হলাম এখানেও নৌকাডুবির খবর ছড়িয়ে পড়েছে! অথচ নৌকা তো ডোবেইনি ডুবে যাবার উপক্রম হয়েছিলো মাত্র লোক দুজনের একজন বললো, ‘আপনেরা আমাগো লগে লন চেয়ারম্যান সাব যাইতে কইছে

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন? ওখানে যেতে হবে কেন?’

লোকটি মৃদু হেসে আবার বললো, ‘চিন্তার কিছু নাই চেয়ারম্যান সাবের বাড়িতে খাওয়া দাওয়া কইরা হেরপর আপনেরা বাড়ি যাইয়েন।’

 এতক্ষণে বিষয়টা বুঝলাম আমরা দুজনের পিছু পিছু হেঁটে চললাম খুব বেশিক্ষণ অবশ্য লাগলো না চেয়ারম্যান বাড়িতে পৌঁছুতে অন্যান্য জায়গার মত এখানকার চেয়ারম্যানকেও দেখলাম খুব আন্তরিক অতিথিপরায়ণ তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বললেন,

আমি একটু আগে খবর পাইলাম আপনেগো নৌকা ডুইবা গ্যাছে আরও আগে জানতে পারলে নৌকা পাঠাইতে পারতামএকটু থেমে আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘ক্যামনে ডুবলো? বড় কোন সমস্যা হয়নাই তো?

আমি হেসে বললাম, ‘না না ঠিক আছে ঝড়ের সময় একটা নৌকার তলা ফেটে গিয়েছিলো আমরা কয়েকজন পানিতে নেমে সামলে নিয়েছি অবশ্য মীরগঞ্জ পর্যন্ত হেঁটেই আসতে হয়েছে

ভদ্রলোকের সাথে আরও অনেকক্ষণ কথা হলো ঢাকার বর্তমান অবস্থা অন্যান্য জায়গার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হলো পথে কি কি ধরণের সমস্যা হয়েছে, আমরা কোথায় যাবো, এইসব।  একটা বিষয় অবশ্য সব জায়গাতেই ঘটছে। যেখানেই পৌছাচ্ছি সবাই শুধু অন্যান্য অঞ্চলের নিউজ জানতে চাচ্ছে।  আসলে পাকিস্তানি মিলিটারিদের গতিবিধি নিয়ে সবার মনেই এক ধরণের শঙ্কা- অজানা ভয় কাজ করছে।  কখন কি হয়, এই আর কি।

চেয়ারম্যান বাড়িতে আমরা দুপুরের খাবার খেলাম  ভদ্রলোক নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের আপ্যায়নের তদারকি করছিলেন। আমি মনে মনে ভাবছিলাম আমাদের ভাগ্য ভালো যে প্রতিটি জায়গাতেই কিছু ভালো মানুষের সাক্ষাৎ পেয়েছি, যারা আমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন। এর ব্যতিক্রম হলে এতবড় দল নিয়ে আরও বিপদে পড়ে যেতাম। কোথাও স্বাধীনতা বিরোধীদের চক্করে পড়তে হয়নি এটাও অবশ্য আমাদের সৌভাগ্য।

কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ভদ্রলোককে বললাম, ‘এবার আমাদের রওনা হতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি পৌঁছাতে চাই।’

ভদ্রলোক হেসে বললেন, ‘ঠিক আছে, আপনারা অনেক ক্লান্ত। আর দেরী করাবো না।’

কোন পথে যেতে হবে জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘এইখান থেইক্যা পায়ে হাইট্টা আপনেরা গ্রামের মধ্যে দিয়া নতুল্লাবাদ যাইবেন তারপর রিকশা-ভ্যান পাইয়া যাইবেন

এবার আবার পথে নামার পালা চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, ‘একটু খাড়ান, আপনেগো লগে একজন লোক দিয়া দিতাছি আপনেগো নতুল্লাবাদ পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দেবে

অল্পক্ষণ পরেই লোকটি এসে হাজির হলো তালতলী বাজার থেকে যে দুজন আমাদেরকে এখানে নিয়ে এসেছিলো, তাদেরই একজন নাম বেল্লাল চেয়ারম্যান সাহেব ওকে বলে দিলেন আমাদেরকে যেন নথুল্লাবাদ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে তবেই ফেরে যাই হোক, আমরা চেয়ারম্যান সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম এবারের গন্তব্য- নথুল্লাবাদ এখান থেকে একঘণ্টার হাঁটাপথ যাত্রায়ও দুজনকে কাঁধে নিয়ে হাঁটতে হবে অতএব দেরী করে লাভ নেই  দাদাকে আমি কাঁধে তুলে নিলাম আর দাদীকে ছোটচাচা অবশেষে আবার শুরু হলো আমাদের পদব্রজে যাত্রা বেল্লালও সাথে সাথে চলেছে আমাদের গাইড হিসেবে নথুল্লাবাদ আমাদের খুব চেনা জায়গা ওখানে পৌঁছতে পারলেই ভাবতে পারবো বাড়ি পৌঁছে গেছি

বাড়ির যত কাছে চলে আসছি, বাবা, মেজচাচা, বড়মামা আর নুরুল ফুপাকে ততই উৎফুল্ল মনে হচ্ছে, যেনো তারা নীড়ে ফিরে এসেছে বৃষ্টিভেজা মাটির রাস্তা মাঝে মাঝে প্যাচপ্যাচে কাদা পিচ্ছিল আমরা চলার গতি কমিয়ে দিলাম তারেক আমার পাশে পাশে হাঁটছে। ও হঠাৎ বললো, ‘দাদাকে আমার কাছে কিছুক্ষণের জন্য দেবে না-কি?’

আমি হাঁটতে হাঁটতেই বললাম, ‘না থাক। এই পিচ্ছিল রাস্তায় তুই পারবি না। আরেকটু এগিয়ে বিশ্রাম নিয়ে নেবো।’

বিশাল ঝড়-ঝঞ্ঝা মোকাবেলা করে যেন অনেক বিধ্বস্ত, এমনই ক্লান্ত স্বরে তারেক বললো, ‘আমি ভাই পুরো এক সপ্তাহ রেস্ট চাই। নো কাজ, কমপ্লিট রেস্ট।’

ওর কথা বলার ধরণে আমি হেসে ফেললাম। ‘বাড়িতে তোকে কে বিরক্ত করবে? পারলে এক সপ্তাহ ধরে ঘুমিয়ে নিস। সামনে কতদিন-কত রাত নির্ঘুম কাটাতে হবে কে জানে!’

তারেক আমার দিকে ঘুরে তাকালো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললো, ‘তুমি ঠিকই বলেছো দাদা। এত অল্পতেই ভেঙে পড়া চলবে না।  আমাকে আরও শক্ত হতে হবে।’

পর্বঃ  ২৫

বিশ-পঁচিশ মিনিট পথ চলার পর আমরা বিশ্রামের জন্য একটা গাছের নিচে বসলাম ছোটচাচাকে দেখলাম হাঁপাচ্ছে আমি ভাবলাম এবার ছোটচাচার পরিবর্তে দাদীকে নেয়ার দায়িত্ব অন্য কাউকে দিতে হবে মিনু ফুপু আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘খুব কষ্ট হইতেছে, না রে বাপ?’ আমি কিছু না বলে শুধু হাসলামতোমার ভয় কাটছে?’ ফুপু আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে মাথা নেড়ে সায় জানালো  তারপর নিচু স্বরে বললো, ‘তোর মত বাপ থাকতে আমার আর চিন্তা কি!’ আমি হেসে বললাম, ‘শুধু আমিই তো না, তোমার তো এখন অনেক বাপ, একদম চিন্তা করার দরকার নাই।’

দশ মিনিট বিশ্রামের পর আমরা আবার চলতে শুরু করলাম বড় আপা সফিক ভাইকে বললো, ‘ছোটচাচা হাঁপাইতেছে, তুমি কি দাদীকে নিতে পারবা?’

ছোটচাচাকে রেহাই দিতে এবার দাদীকে কোলে তুলে নিলো সফিক ভাই ছোটচাচা আর সফিক ভাই একই বয়সী সফিক ভাই সামান্য বড় হলেও হতে পারে কিন্তু শারীরিক মানসিকভাবে সফিক ভাই ছোটচাচা থেকে অনেক বেশি শক্ত বেল্লাল আমাদের জানালো আর বেশি পথ বাকী নেই তবে ওর কথার উপর আমার ভরসা কম কারণ যারা গ্রামে থাকে তারা যখন বলবেএই তো দশ মিনিটের পথবাস্তবে দেখা যাবে আধঘণ্টার দূরত্ব সফিক ভাই লম্বা মানুষ, তাই দাদীকে বহন করতে তেমন কষ্ট হচ্ছে না বড় আপা আবার দাদীকে ক্ষেপানোর সুযোগ পেয়ে গেলো দাদীর মাথার কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলছে,

এই বুড়ি, নিজের জামাইরে আরেকজনের কান্ধে তুইলা দিয়া তুমি আমার জামাইর কোলে চড়লা যে! কাহিনী কি?’

দাদী ফোকলা দাঁতে হাসে আপা আবারও ক্ষেপায়দাঁড়াও, বাড়ি যাইয়া নেই, বুইড়ারে দিয়ে তোমারে ছেঁচা খাওয়ামুদাদী হাসে আর বৃদ্ধাঙ্গুলি নাচায় মানেটা হলো এই যে, বুড়ার আর সেই ক্ষমতা নেই

আসলেই দাদার এখন আর কোন ক্ষমতা নেই নিভু নিভু প্রদীপ শিখা যে কোনোদিন ধপ করে একেবারেই নিভে যাবে এটাই বাস্তবতা কিন্তু একসময় এই হাতে প্রচুর শক্তি ছিলো চৈত্রমাসের কাঠফাঁটা রোদ্দুরে হালের বলদ দিয়ে শক্তহাতে কঠিন জমিতে লাঙ্গল চালাতেন, আবার সেই চষা মাটিকে জোয়াল দিয়ে সমান করতেন তারপর সেখানে সবুজ ফসল ফলাতেন  হ্যাঁ, আমার দাদা চাষী ছিলেন তার পূর্বপুরুষও তা- ছিলো আমার বাবার সময় থেকেই কেবল ব্যত্যয় ঘটেছে এই নিয়মের কতদিন দাদার সাথে জোয়ালে চড়েছি! জোয়ালে উঠে দাদাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতাম দাদাহেই হেই, হাট হাটবলে বলদগুলোকে সামনে ছোটাতেন, আর আমি জোয়ালের উপর দাঁড়িয়ে সারা জমিতে ঘুরে বেড়াতাম আজ দাদার সেই হাতদুটো কত কমজোরি! আমাকে জড়িয়ে ধরে নির্ভরতা খোঁজে 

তারেক পেছন থেকে বড় আপা আর দাদীর কথোপকথন শোনে আর হাসে আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে, ‘বড় আপা পারেও!’

এ পথে আগে কখনও আসিনি। এই এলাকাটাও সম্পুর্ণ অচেনা। আজকের আগে শায়েস্তাবাদ, চর আইচা, চর বাড়িয়ার নাম শুনেছি শুধু, আর আজই প্রথম আসা হলো আমি মনে মনে হাসলাম। কী ভাবছি এসব? এ দেশের কত জায়গায়ই তো যাওয়া হয়নি আমার। কতকিছু দেখা এখনও বাকী! আমি সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। বাবা, বড়মামা পাশাপাশি হাঁটছে আর নিচু স্বরে কথা বলছে বাবা বললোআমরা নথুল্লাবাদের প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছি আর বেশি পথ বাকী নেই।’

মতিন জিজ্ঞেস করলো, ‘নথুল্লাবাদ থেকে আমাদের বাড়ি কতদূর?’

‘পাঁচ-ছয় মাইল হবে’ ছোটমামা বললো।

‘তাহলে তো বেশি দূর না।’

‘হুম।’

 

পাখি তার নীড়ে ফিরলো

বিকাল পাঁচটায় আমরা নথুল্লাবাদ বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছলাম। বড়মামার মুখে এবার সত্যি সত্যিই হাসি ফুটে উঠলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ছোটমামা বললো, ‘অবশেষে আমরা বাড়ির কাছে চলে এলাম।’

নথুল্লাবাদে পৌঁছে মনে হলো এখানকার জীবনযাত্রা ঢাকা থেকে অনেক স্বাভাবিক। লোকজনের মধ্যে কোন উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তার ছাপ চোখে পড়লো না। ঢাকায় যে এতবড় ঘটনা ঘটে গেলো তার রেশ এখানে পৌঁছেছে তেমনটি মনে হয়নি। কেবলমাত্র দূর পাল্লার যানবাহনগুলো চলছিলো না। বেল্লালের দায়িত্ব শেষ। ও বিদায় নিয়ে চলে গেলো।

রিকশা, ভ্যান আর সাইকেলের টুং টাং শব্দ শুনে মনে হলো আমাদেরও রিকশা বা ভ্যান ঠিক করা দরকার। নথুল্লাবাদ থেকে বাড়িতে যাবার জন্য তিনটা রিকশা ও তিনটি ভ্যান ঠিক করা হলো। বাবা, বড়মামা, মেজচাচা, নুরুল ফুপা, মা আর বড়মামীকে রিকশায় তুলে দিয়ে আমরা সবাই ভ্যনে চড়ে বসলাম। যথারীতি আনুকে মা নিজের কাছেই রাখলেন। দাদীকে ভ্যানের মাঝখানে বসিয়ে আমরা চারদিকে পা ঝুলিয়ে বসলাম। সবগুলো ভ্যান আর রিকশা একসাথেই চলছে। আমরা নথুল্লাবাদ থেকে কালিজিরা বাজারের দিকে যাচ্ছি। রাস্তার অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। ভাঙা, এবরো থেবরো। বেশির ভাগ জায়গাতেই বিটুমিনের প্রলেপ উঠে গিয়ে কংক্রিট বেরিয়ে পড়েছে কোথাও কোথাও গর্ত, পানি জমে আছে

মতিন বললো, ‘এর থেকে হেঁটে যাওয়া ভালো ছিলো কত পথই তো হাঁটলাম!’

তারেক মতিনের দিকে আড়চোখে তাকালোএই মতি, এখনও তোর হাঁটার সখ মেটে নাই? তাহলে দাদীকে কোলে নিয়ে তুই হাইটা যা আমরা কালিজিরা গিয়া তোর জন্য অপেক্ষা করবো

মতিন বুঝলো সে বোকামি করে ফেলেছে তাই নিজের দুর্বলতা ঢাকতেই বললো, ‘আমি কী শুধু আমার কথা বলেছি? সবার কথা চিন্তা করেই তো বললাম এভাবে ঝাঁকি খেতে খেতে তোমরা যেতে পারলে আমিও পারবো

মতিনের আত্মপক্ষ সমর্থনের পর কেউ আর কিছু বললো না রাস্তায় লোকজন খুব একটা নেই, বড় গাড়িও চলছে না, তাই এক ধরণের নিরবতা বিরাজ করছে সারা এলাকা জুড়ে। দু’পাশের গাছগুলো নুয়ে এসে রাস্তাটিকে ঢেকে দিয়েছে, দূর থেকে মনে হচ্ছে একটা সুড়ঙ্গ। আমরা সেই সুড়ঙের মধ্যে দিয়েই ঝাকুনি খেতে খেতে চলছিলাম। রূপাতলী স্কুল ক্রস করার সময় হাসান বললো, ‘এবার আমি চিনেছি। আরেকটু সামনে গেলেই আমাদের বাজার।’

ঢাকায় বড়মামার বাসা থেকে বের হয়েছি আজ ছয় দিন। আমাদের জন্য সময়টা অনেক দীর্ঘ ছিলো। কারণ যাত্রার সারাটা পথই ছিলো অত্যন্ত কষ্টকর আর অনিয়শ্চয়তায় ভরা। বেশ কয়েকজন বয়স্ক মানুষ আর ছোট ছোট বাচ্চাসহ এতবড় দল নিয়ে যে শেষ অবধি যে সুস্থ শরীরে সবাই বাড়িতে পৌঁছুতে পেরেছি এটাই আমাদের জন্য স্বস্তিদায়ক ছিলো।  বাড়ির একেবারে কাছে পৌঁছে আবারও অনুভব করলাম দীর্ঘ এ পথযাত্রায় সৌভাগ্যক্রমে প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা মানুষের সহায়তা পেয়েছি। নারায়ণগঞ্জ, বিবির বাজার, বেতকা, কাটাখালি, দিঘিরপাড়, ছবিপুর, তালতলী- প্রতিটি স্থানেই মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে অকৃত্রিমভাবে।  এই মানুষগুলোর প্রতি মনে মনে একটা কৃতজ্ঞতাবোধ সারাজীবনই জেগে থাকবে।  অন্তত আমার ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় ঘটবে না এটুকু বলতে পারি।

আমরা যখন কালিজিরা বাজারে পৌঁছলাম তখন প্রায় ছ’টা বাজেশেষ বিকেল।  সূর্য বিদায় নেবার আয়োজন করছে।  সবগুলো রিকশা-ভ্যান ফিরোজের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ফিরোজ দোকান থেকে বেরিয়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। একটু পরে আনুকে কোলে নিয়ে বললো, ‘ঢাকার খবরাখবর সব হুনছি। তাই তোমাগো লইয়া খুব দুশ্চিন্তায় আছিলাম।’

‘বকুল আইছে?’ মা ব্যাকুল হয়ে জানতে চাইলেন।

ফিরোজ মাকে আশ্বস্ত করলো। ‘ছোট আপা বিশ তারিখ আইছে আর দুলাভাই আইজ বিহানে।’

মায়ের মুখে হাসি ফুটলো। ফিরোজ বললো, ‘চারিদিকে পানি উঠে গেছে। মামাদের বাড়ির সামনে কোমর সমান পানি।’

বড়মামা অবাক হয়ে বললো, ‘বলোস কী! এত তাড়াতাড়ি পানি ঊইঠা গেলো! তাইলে এখন বাড়ি যাবো কেমনে?’

আসাদ ভাই বললো, ‘এখন আর কারো পানি-টানি ভাঙনের অবস্থা নাই। সবাই আমাদের বাড়িতে যাবে। কাল দেখা যাবে কখন কীভাবে বাড়ি যাওয়া যায়।’

বড়মামা কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে শেষমেশ রাজি হয়ে গেলেন। হয়তো গত ছয়দিনের পথের ধকল সয়ে কোমর-পানি ভাঙার মত শরীরের অবস্থা নেই। আমাদের দেখে ইতিমধ্যে এলাকার চেনাজানা লোকজনের ভিড় জমে গেলো। বন্ধু-বান্ধব, কাছের দূরের আত্মীয়স্বজন ঘিরে ধরলো আমাদের। সবার জিজ্ঞাসা আমরা কী করে এলাম? ঢাকার কী অবস্থা, ইত্যাদি। সবাইকে যতটুকু পারলাম সংক্ষেপে বোঝালাম। আর বললাম, আমরা এখন ভীষণ ক্লান্ত, কাল ইনশাল্লাহ বিস্তারিত আলাপ হবে।

লোকজনের কাছ থেকে ছাড়া পেতেই আমরা রানুদের বাড়ির দিকেই হেঁটে চললামবাজার থেকে রানুদের বাড়িই সবচেয়ে কাছে। আমাদের বাড়ি আরেকটু ভেতরে। আধা মাইলের মতো। আমরা কাঁচা সরু রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। এ পথে রিকশা বা ভ্যান যাবে না। রাস্তার অনেক জায়গাতেই কাদা জমেছে। এবার দাদাকে কাঁধে নিয়েছে মনা আর দাদীকে ছোটচাচা। ছোটচাচাকে বললাম সাবধানে পা ফেলতে।

আমি রানুর দিকে তাকালাম। অদ্ভুত এক আনন্দের ছটা ফুটে উঠেছে ওর মুখমণ্ডলে। এটা কি অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তির জন্যে, না-কি মায়ের কাছে ফেরার খুশিতে? আমার কেন জানি মনে হচ্ছে- এ আনন্দ মায়ের কাছে ফেরার জন্যেই এটা সত্যিই অন্যরকম। 

আমরা সবাই জুতা হাতে নিয়ে হাঁটছিলাম। রাস্তার এক জায়গায় অনেক কাদাপানি। প্রায় হাঁটু সমান। হাসান পা পিছলে ধপাস করে সেই কাদায় পড়ে গেলো। বড় আপা হেসে বললো,

‘কি-রে হাসু, তুই বাড়ির কাছে এসে বোয়াল মাছটা ধরলি!’

হাসান নিজের পক্ষে সাফাই গাইলো, ‘আমি কী করবো? যেই পিচ্ছিল কাদা পানি!’

হাসানকে স্বাভাবিক করার জনই আসাদ ভাই বলে উঠলো, ‘আরে লজ্জার কী? এইখানে আমি কতবার আছাড় খাইছি!’

আর কোন ঝামেলা ছাড়াই আমরা রানুদের বাড়ির একেবারে কাছে চলে এলাম। আমাদের গ্রামের একমাত্র প্রাইমারি স্কুলটি ওদের বাড়ির সামনেই ওর দাদার জায়গাতেই প্রতিষ্ঠিত। আমার বাবা একসময় এই স্কুলেই হেডমাস্টার ছিলেন। স্কুলের মাঠের কোণে রানুদের বাড়িতে প্রবেশের মুখেই একটি বড় আমগাছ। আমরা স্কুলের সামনে পৌঁছতেই দেখি রানু কোন ফাঁকে যেন সবার সামনে চলে এসেছে। ওর দৃষ্টি সামনের আমগাছটার নিচে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন রমণীর দিকেই নিবদ্ধ যাদের মধ্যে কেবল একজনই ধবল-শুভ্র বেশে হাসিমুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি রানুর মা। পেছনে গাছপালার উপর দিয়ে দিন শেষের রক্তিম আভাটা ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে একটু পরেই বিদায় নেবে সূর্য।

রানু মাঠের কাছে পৌঁছেই একছুট! মাঠ ছাড়িয়ে সোজা গিয়ে মায়ের বুকে ঠাঁই নিলো। বহুদূর পথ পেরিয়ে রানু আজ আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে। ভালোবাসার আশ্রয়।

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উপন্যাসঃ ফেরা (পর্বঃ ২১ - ২৫ - শেষ পর্ব)

এ ই উপন্যাসটিতে সম্মুখ সমরের কোন ঘটনা তুলে ধরা হয়নি।  ওয়ারফ্রন্টের কোনও দৃশ্য নেই। তবে এই লেখায় মূলত যে গল্পটি বলার চেষ্টা ক রা হয়েছে  তা মু...