শনিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

উপন্যাসঃ ধূসর গোধূলি (পর্বঃ ৪১ - ৫০)






সকালের চা পান শেষে ঘরের সিঁড়িতে বসে ছোট ভাতিজার সাথে গল্পে মেতে আছে তারাপদ। সুবলও নাছোড়বান্দার মতো একটার পর একটা প্রশ্নে করে চলেছে। তারাপদ ক্লান্তিহীনভাবে উত্তর দিয়ে চলেছে ভাতিজার সব প্রশ্নের। এমন সময় হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এসে সামনে দাঁড়ায় গোপাল।
কী রে গোপাল, এমন করতাছস ক্যান? তারাপদ জিজ্ঞেস করে।
ছোটকর্তা, আমগো মাঝ-কোলার ক্ষেতের পাশে পুকুর কাটতাছে বাদইল্যা।
কাগো জমি কাটতাছে?
অগো জমিই কাটতাছে তয় একেবারে আমগো জমি ঠেকাইয়া খাড়া কইরা কাটতাছে। বৃষ্টি অইলেই আমগো জমি ভাইঙা পড়বো।
ল তো, দেইখ্যা আসি।
তারাপদ গোপালকে সাথে নিয়ে জমির দিকে এগিয়ে যায়। দূর থেকেই দেখতে পায় ওখানে অনেক লোকজন জড়ো হয়ে আছে। নিজেদের জমির কাছে গিয়েই তারাপদর মেজাজ চড়ে যায়। আট-দশজন যোগালি মাটি কাটছে আর বাদল তার দলবল নিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে তাদারকি করছে। তারাপদর জমিঘেঁষে এমনভাবে মাটি কাটা হচ্ছে যে, বৃষ্টি হলেই তার জমি ভেঙে পড়বে। সে খুব ভালোভাবেই বোঝে এটা ইচ্ছাকৃতভাবে করা হচ্ছে।
কী রে বাদল, এইডা কী করতাছস? এইভাবে কেউ মাডি কাটে?
আমার জমির মাডি আমি কাটতাছি, তোমারে কী তার কৈফিয়ত দিতে অইবো?
তোর জমির মাডি কাটা নিয়া কতা অইতাছে না, যেইভাবে কাটতাছস আমার জমি তো ভাইঙা পড়বো। এত খাড়া কইরা না কাইটা একটু ঢালু কইরা কাটলে তো আমার জমি ভাঙে না।
তোমার জমির ভাঙন ক্যামনে ঠেকাইবা হেইডা তোমার ব্যাপার কাকু, আমি তোমার জমি কাটতাছি না। এইডা নিয়া আমার লগে বাৎচিত করতে আইসো না।
তোর লগে বাৎচিত করার কোনো দরকার নাই, কিন্তু আমার জমি যেন ভাইঙা না পড়ে হেইডা খেয়াল রাহিস।
বাহ! খুব ভালো কইলা তো কাকু। জমি তোমার আর খেয়াল রাখুম আমি?
এইরকম কইরা কেউ পুকুর কাটে? পাড় ঘেইসা খাড়া কইরা মাটি কাটলে পাশের জমি ভাইঙা পরবো এইডা তো পাগলেও বোঝে। তুই কী ভাবছোস তোর উদ্দেশ্য আমি বুঝিনা? তারাপদ ক্ষেপে যায়।
অত বোঝাবুঝির কাম নাই, আমার কাম আমারে করতে দেও। আমার লগে ক্যাচাল করতে আইসো না কাকু, সবাই জানে আমি কিন্তু মানুষ ভালো না।
তুই আমারে ডর দেহাস?
ছি ছি! এইডা কী কও কাকু? তুমি মুরুব্বি মানুষ, তোমারে ডর দেহামু ক্যান? আমি কইতাছিলাম আমার কাম আমারে করতে দাও।
ঠিক আছে। তুই যহন আমার কথা রাখবি না তাইলে তো আমারে অন্য ব্যবস্থা নিতে অয়। বলে তারাপদ বাড়ির দিকে চলে আসে।
পেছনে দাঁড়িয়ে তারাপদর চলে যাওয়া দেখে বাদল আর বিড়বিড় করে বলে,
কাকু, সবে তো শুরু; সামনে আরও কত দেখবা!
সন্ধ্যার পর সাত্তার মাস্টারের দোকানের সামনে প্রতিদিনের মতো আড্ডায় মশগুল বয়স্কদের দল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে উপস্থিত হয় হরিপদ আর তারাপদ।
কী খবর হরি, তোমারে এত অস্থির লাগতাছে ক্যান? সাঈদ খান বলেন।
সব কপালের দোষ। স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতাছি। হরিপদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।
কী অইছে খুইলা ক তো তারা। তারাপদর উদ্দেশ্যে বলেন সাত্তার মাস্টার।
তারাপদ সকালের ঘটনাবলি খুলে বলে। সাঈদ খান রেগে ওঠেন। এইডা কী মগের মুক্কুক নাকি? কেউরে পাঠাও তো, খালেইক্যারে ডাইক্যা আনুক। এহনি জিগামু ওর ভাই এতবড় সাহস কই পায়?
সাত্তার মাস্টার বলেন- শান্ত হও। এহন খালেইক্যারে ডাইক্যা কোনো লাভ অইবো না। লও, কাইল বিহানে আমরা হরি’র জমিতে গিয়ে দেইখ্যা একটা বিহিত করি। অইগুলানরে বোঝানো দরকার অগো জোর-জুলুমের দিন শ্যাষ।
ঠিক আছে। কাইল বিহানেই আমরা যাইতাছি। কজেম, যাওয়ার পথে আতিকরে একটু বইলা রাইখো তো। অরেও দরকার অইবো।
প্রতিদিনের মতো আজ সকালে কলাবতী বাজারে যাননি হরিপদ। অপেক্ষা করছেন সাঈদ খান আর সাত্তার মাস্টারের জন্য। গোপাল জমিতে গরু বেঁধে এসে জানায়Ñ ‘বড়কর্তা, বাদইল্যা আইজও মাডি কাটা শুরু করতাছে’। হরিপদ বাড়ির দক্ষিণ প্রান্তে দাঁড়িয়ে দেখেন বাদল তার দলবল নিয়ে মাটি কাটা শুরু করেছে। রাস্তার দিকে তাকাতেই চোখে পড়ে রমেন সাহা, বলাই শীল, সুজিত দাশকে নিয়ে তারাপদ তাদের বাড়ির দিকেই আসছে। রমেন সাহা বাড়িতে ঢুকেই বলে,
দাদা, এইভাবে চুপচাপ বইসা থাকলে তো নিজেগো অস্তিত্ব টিকান যাইবো না। সবাই মিইল্যা চলেন।
হরিপদ ওদের থামান। খাড়াও, সাঈদ খাঁ আর সাত্তার মাস্টার তাগো লোকজন নিয়া আসুক। সবাই একলগে যামুনে।
গোপাল অস্থির হয়ে ওঠে। দক্ষিণ-দ্বারের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে লক্ষ করে বাদলের মাটি কাটা। কিছুক্ষণ পর পরই খাল পাড়ের দিকে তাকায়।
কোটাখালী ব্রিজ দিয়ে সাত্তার মাস্টার ও তার সাথের লোকজনকে আসতে দেখেই বাড়ির ভিতরে ছুটে আসে।
বড়কর্তা, চেয়ারম্যানসাব লোকজন নিয়া চইলা আইছে।
হরিপদ ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখেন সাত্তার মাস্টার আর সাঈদ খানের পেছনে পেছনে প্রায় জনা পনেরো লোক খালের পাড় থেকে জমির দিকে এগিয়ে আসছে।
, এইবার যাই।
সবাই একসাথে হরিপদর জমির পাড়ে গিয়ে দাঁড়ায়। সাঈদ খানকে দেখে এগিয়ে আসে বাদল।
সালাম কাকা। আপনে এইহানে?
আমরা তো আইতে চাই নাই। তুই তো বাধ্য করছোস।
আমি কী করছি?
হরিপদর জমি ঘেইষা এই যে পুকুর কাটতাছোস, তোর পুকুরের পাড় কই?
কাকা, আমি তো পুকুর কাটিনাই। প্রয়োজনে আমার জমি থেইক্যা মাডি নিতাছি। হরিকাকুর জমি তো কাটিনাই।
হরির জমি কাটোস নাই বুঝলাম, কিন্তু অগো জমি ঘেইষা কাটতাছোস ক্যান? এইডা কী জমি থেইক্যা মাডি নেওয়ার নমুনা? হরির জমি তো যে কোন সময় ভাইঙা পড়বো। সাত্তার মাস্টার বলে।
হেগো জমি ভাইঙা পড়বো দেইখা আমি আমার জমি থেইক্যা মাডি কাটতে পারুম না?
তুই কী উদ্দেশ্যে এই মাটি কাটতাছোস তা কারো বুঝতে বাকি নাই। কারে কী বুঝাইতে চাস? আতিক বলে ওঠে।
আপনেরা সবাই মিইল্যা মিছা মিছাই আমারে দুষতাছেন।
হরিপদর জমিতে জড়ো হওয়া মানুষজন সবাই বাদলের উপরে ক্ষেপে যায়। রমেন সাহা বলে ওঠে,
ওরা দেশটারে কী মগের মুল্লুক পাইছে, যা খুশি তাই করবো? আমরা কী এই দেশে ভাইসা আইছি?
বাদল আড়চোখে তারাপদর দিকে তাকায়। এই সময়ে হঠাৎ গোপাল ছুটে আসে হরিপদর দিকে। বড়কর্তা, দেহেন আমগো ক্ষেতের মধ্যে কতবড় ফাডল ধরছে।
উপস্থিত লোকজন এগিয়ে যায় গোপালের দেখানো স্থানের দিকে। কাটা মাটির প্রান্ত থেকে প্রায় দশ হাত দূরে আড়াআড়িভাবে একটা ফাটল দেখা যায়। বৃষ্টি এলে যে কোনো সময় নরম মাটির এই জমি ভেঙে পড়বে।
বাদলকে ডেকে সাত্তার মাস্টার বলেনÑ এইবার তুই কী কইবি? এই জমি যে কোনো সময় ভাইঙা পড়বো।
বাদল চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। এমন সময় খালের পাড়ের রাস্তা ধরে খালেক তালুকদারকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। কাছাকাছি আসলে সাঈদ খান বলেন,
কী রে খালেক, তুই এতক্ষণ কই আছিলি? আমি তো তোরেই খুঁজতেছিলাম।
বাড়িতে কিছু কাম আছিলো কাকা। কী হইছে?
ক্যান, তোর ভাই যে এইভাবে জমির মাডি কাটলো তোরে কিছু জিগায়নাই?
, খালপাড়ে কিছু মাডির দরকার আছিলো, তাই জমি থেইক্যা কাইটা নিবো কইছিলো।
হেই মাডি কাটার নমুনা কী এই? আরেকজনের ক্ষতি করা? সাত্তার মাস্টার বলে ওঠেন।
খালেক তালুকদার কাটা মাটির স্থানে গিয়ে দাঁড়ায়। 
হরিকাকার ক্ষতি হউক তা আমিও চাইনা। এইভাবে মাটি কাটন ঠিক অয়নাই। ও না বুইঝা কামডা কইরা ফালাইছে। কাকা, আমি দেখতাছি হরিকাকার জমি যাতে ভাইঙা না পড়ে।
যেইভাবে ফাডল ধরছে তুমি ক্যামনে এই ভাঙন রোধ করবা? আতিক বলে ওঠে।
দরকার হইলে গর্ত আবার ভইরা দিমু।
ঠিক আছে, তাই কর। তোর কথার উপর ভরসা কইরা আমরা যাইতাছি। কিন্তু দুই দিনের মধ্যে এই জায়গা ভরাট করার ব্যবস্থা করতে অইবো। দেখিস, এই বিষয় নিয়া আর যেন কোন ঝামেলা না হয়। সাঈদ খান বলেন।
সবাই চলে যায়। খালেক তালুকদার বাদলকে ওর লোকজন থেকে একটু দূরে ডেকে নিয়ে ধমকায়।
তোরে কইছিলাম না হরিপদ-তারাপদ সহজ মানুষ না। আর সাঈদ খান, সাত্তার মাস্টারসহ সবাই যে হেগো পক্ষে যাইবো এইডা তো জানা কতা। বার বার খালি ঝামেলা পাকাস আর আমারে বিপদে ফেলস। বাদল নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। একটু পরই বলে,
ঐ মালাউনের বাচ্চারা যখন জমিডা বেচলো না তহন মাথা খারাপ অইয়া গেছিলো। আমি চাইছিলাম অগো জমি ভাইঙা পড়ুক, বেচতে বাধ্য অইবো। কিন্তু হালারা যে এমন হাঙ্গামা বাধাইবো তা তো বুঝিনাই।
গাধা কোথাকার! এই বুদ্ধি নিয়া চলোস? হের জমি খাইয়া ফালাবি আর হেয় বইয়া বইয়া আঙুল চুষবো? তুই হরিপদ-তারাপদরে চিনস না?
বাদল চুপ করে যায়। কিছুক্ষণ পর খালেক বলে,
যাউক, যা হওনের হইছে। এহন ঐ পুকুর ভরনের ব্যবস্থা কর। মাঝখান থেইক্যা কতগুলান টাকার শ্রাদ্ধ অইলো আর সাঈদ খাঁ কিছু কতা হুনানোর সুযোগ পাইলো।
খালেক চলে গেলে জমির আলের উপর দাঁড়িয়ে থাকে বাদল। আজকের এ পরাজয় তার বুকের ভেতরে হাতুড়ির আঘাত করে চলে। মনে মনে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ফুঁসতে থাকে বাদল। বিড়বিড় করে বলে, ‘কাকু, এইবার এমন কিছু করুম তোমার কোমর ভাইঙা যাইবো মাগার আমারে দুষতে পারবা না’।





 

বৈশাখ মাস শেষ হলে এলো। নদীর পাড়ের বটগাছটার পাতাগুলো ক্যানভসে আঁকা ছবির মতোই স্থির। গ্রীষ্মের প্রচ- দাবদাহে অস্থির মানুষ গাছের তলায় একটু আশ্রয় খোঁজে। কলাবতী বাজারের বটতলার মেলাটা শেষ হয়েছে মেলা দিন হল। দুপুরের কড়া রোদে হাঁটের অস্থায়ী দোকানগুলোর নিচে বিশ্রাম নেয় ঘাটের মাঝিরা।
এই গরমে আর বাচন যাইবো না, মোক্তার মাঝি বলে।
আমরা বাঁচলেই কী আর মরলেই কী? যেইভাবে বাইচা আছি এইডারে কী বাচন কয়? একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রহম আলী উত্তর দেয়।
সময় তো শ্যাষ অইয়া আইলো, সামনেই তো ঘাডের ইজারা বদল অইবো। দ্যাহো আবার কোন রুই-কাতলা এইবার ঘাডের ইজারা পায়। ছগিরের গলায় হতাশার সুর।
হুনতাছি হারু গাজীর পোলা গিয়াইস্যা নাকি এইবার যেমনেই হউক ঘাডের দহল নিবো। রহম আলী বলে ওঠে।
যে-ই পাউক, আমগো লাইগ্যা সবই এক। বাদইল্যার থেইক্যা গিয়াইস্যা কী ভালো নাকি? ছগির বলে।
ঐ-ডা তো আরেক কাঠি সরেস। এক্কেরে বাপের মতোন। দ্যাহো না বাদইল্যারে কেমন ঘোলাপানি খাওয়াইতেছে। রহম আলীর কণ্ঠে বিরক্তি।
এতো চিন্তা করনের কী আছে? যে-ই ইজারা নিক আমগো কী বিনা পয়সায় ঘাড ব্যবহার করতে দেবো? সবাইরেই পয়সা দিতে অইবো। আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর নেওয়ার কাম নাই। মোক্তার মাঝি বলে।
ইদানীং কালে বকুলের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। অনেকদিন ধরে প্রতি রাতে জ্বর আসে। বেশ কিছুদিন ধরেই খাওয়ায় খুব অরুচি হচ্ছিলো। কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে দিন দিন। কলাবতী বাজারে এখন একমাত্র হোমিও ডাক্তার মদনমোহন বাগচী। গ্রামের সবাই বলে মধু ডাক্তর। হারান ডাক্তার চলে যাবার পর এই এলাকায় মধু ডাক্তারই এখন ভরসা। গত দুই বছর ধরে ঠা-া-কাশি কিংবা জ্বরে ওদের নিয়মিত বাধা ডাক্তার তিনিই। বয়স সত্তর পেরিয়ে গেছে। চিকিৎসা বলতে ছোট কাগজের খামে কিছু সাদা মিষ্টি দানা আর খাঁজকাটা কাগজের লেবেল আঁটা কাঁচের বোতলে এক ধরনের তরল ওষুধ, যা প্রতিবার এক দাগ পরিমাণে সেবন করতে হয়। বকুলের কেবলই মনে হয় মধু ডাক্তার সব রোগের জন্য একই ওষুধ দেন। মুখে যেন সারাক্ষণই খই ফোটে। তবে মধু ডাক্তারের একটি ব্যাপার বকুলের ভালো লাগে। ওঁর ফার্মেসীতে গেলে দাদুর গল্প শোনা যায়। 
মধু ডাক্তারের কাছ থেকে আনা ওষুধ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, কিন্তু বকুলের জ্বর কমছে না। সারাদিন জ্বরের মাত্রা মোটামুটি কমই থাকে, সন্ধ্যার পর ধীরে ধীরে বাড়ে।
দুপুরের পর থেকেই অবসাদে ভেঙে আসছিলো বকুলের শরীর। নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে, চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নেয়। সামনের বারান্দা থেকে অয়নের গলা শোনা যাচ্ছে। ছোটদি ছোটদি বলে ডাকছে। বকুল চুপ করে থাকে। অয়ন বকুলের রুমে ঢুকেই বলে,
ছোটদি, তুই এইহানে? আমি তোরে সব জায়গায় খুঁজছি।
ক্যান রে অনু? বকুল শুয়ে শুয়েই জিজ্ঞেস করে।
তুই না কইছিলি, আমারে কইয়া দিবি বড়দির চিঠিতে কী লিখুম?
চিঠি লিখবি তুই আর কইয়া দিমু আমি, এইডা ক্যামন কতা অইলো অনু? বকুল শুয়ে শুয়েই জবাব দেয়। ব্যাপারটাতে বেশ মজাও পায়।
ছোটদি, কইয়া দে না কী লিখুম।
দূর বোকা! তুই কী লিখবি তা আমি জানি? তোর যা মনে আয় লেখ।
 আগেরবার তো তুই কইয়া দিছিলি।
সেইডা তো আছিলো তোর প্রথম চিঠি লেখা।
ভুল অইলে বড়দি কী মনে করবো?
তাইলে তোর গাছের সবচাইতে বড় সপরিটা আমারে দিবি? বকুল মিটিমিটি হাসে।
হ দিমু। এখনি পাইড়া আনি?
না থাউক। এহন লাগবো না, কাইল পাইড়া দিস।
এহন ক কী লিখুম?
ছোটদির বলা কথাগুলো গোটা গোটা অক্ষরে লিখে চলে অয়ন। মায়ের কথা লিখে। বাবার কথা, ছোটদি’র কথা, মন্টু মামার কথা। শিউলির আগের চিঠিতে ও জেনেছে অয়ন মামা হবে। তাই নতুন বাবুটার জন্য আরেক নাম ঠিক করেছে। ছোটদিকে জিজ্ঞেস করে,
বড়দি কী নামডা পছন্দ করবো?
আগের চিঠিতে তুই না নাম পাঠাইলি!
হ পাঠাইছি তো! এহন আরেকটা নাম মনে আইলো।
বকুল জানতে চায়Ñ নামডা কী?
অয়ন বলেÑ অন্তু।
বকুল হাসে।
তুই এই নামের মানে জানোস?
না। শ্যামলদা যহন কইলো তহন নামডা খুব ভালো লাগলো।
তাইলে বড়দিরে জানাইয়া দে।
কিন্তু, বড়দি যদি পছন্দ না করে? অয়ন কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত।
না পছন্দ হইলে রাখবো না, তোর ভালো লাগছে তুই চিঠিতে লিইখা দে। অয়ন লিখে চলে। 
আকাশে বাজ পড়ার শব্দ শুনে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় অয়ন। পূব আকাশ জুড়ে কালো মেঘ জমেছে। ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে আসছে চারপাশ। অয়ন চিঠি লেখা বন্ধ করে একদৌড়ে ঘরের সামনের সিঁড়িতে এসে দাঁড়ায়। ঠিক তখনই পুকুরের উপর দিয়ে দমকা ঝড়ো হাওয়াটা ছুটে আসে।
অয়ন মনে মনে ভাবেÑআজ আম কুড়াতে যাবে। ঘরে ঢুকে ছোটদিকে জিজ্ঞেস করে
ছোটদি, ল আইজ আম কুড়াইতে যাই।
না-রে! আমার শীত লাগতাছে। মনে অয় আবার জ্বর আইবো। তুই যা, তয় বেশিক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজিস না, জ্বরে পড়বি। বকুল আবার চাদর গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়ে।
অয়ন খালি গায়ে উঠানে নেমে আসে। বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে পড়তেই একটু শীত শীত লাগে। অবশ্য ভালোভাবে ভিজতেই শীতভাবটা কেটে যায়। ঝড়ো বাতাসে বড় বড় গাছের উঁচু ডালগুলো নুয়ে আসে। মনে হয় এখনি ভেঙে পড়বে। একা একা উত্তর বাগানের আম গাছগুলোর তলায় যেতে ভয় লাগে। মনে মনে মন্টু মামাকে খোঁজে অয়ন। একটু পরই উঠোনের মধ্য দিয়ে মন্টু মামাকে উত্তর বাগানের দিকে ছুটে যেতে দেখে পিছু নেয়। 
ঝড়ো হাওয়াটা থেমে যেতেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। সালমা বেগম পুকুরঘাট থেকে ঘরে ফিরতেই ভিজে গেলেন। নিজ মনেই বললেন- ‘আইজ আর বৃষ্টি থামবো না।’ কিছুক্ষণ পর বকুলের রুমে ঢুকে দেখেন ও চাদর গায়ে জড়িয়ে শুয়ে আছে। সালমা বেগম মৃদু স্বরে ডাকেন। ডাক শুনে ঘুরে তাকায় বকুল। মায়ের হাতের দিকে চোখ পড়তেই দেখে দুধের গ্লাস হাতে মা দাঁড়িয়ে।
মা, তোমারে কতবার কমু দুধ দ্যাখলে আমার বমি আসে।
অসুখের সময় জোর কইরা অইলেও খাইতে অয় মা।
না, আমি দুধ খামু না। তুমি এইডা এইহান থেইক্যা সরাও।
সালমা বেগম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। এমন করে না মা, কষ্ট কইরা দুধটা খাইয়া ল।
বকুল কোনো কথা না বলে চাঁদর জড়িয়ে আবার শুয়ে পড়ে। সালমা বেগম বকুলের কপালে হাত রাখেন।
জ্বরডা আবার আইতাছে, ব্যাপারডা বুঝতাছি না। মনে হয় মধু ডাক্তরের পথ্যে কাম অইবো না। তোর বাপ কইছে আইজক্যার মধ্যে জ্বর না কমলে কাইল তোরে মধুপুর সদরে নিয়া বড় ডাক্তার দেহাইবো।
মধুপুরে নিতে পারে, তয় আমারে ইঞ্জেকশন দিতে মানা কইরো। গতবার নিয়া ইঞ্জেকশন দিছে, অনেক ব্যথা পাইছি।
দেহো তো! পাগল মাইয়া কী কয়। সুঁই কী এমনি এমনিই দেয় কেউ? তোর ভালো হওন লাগবো না? ডাক্তর দরকার মনে করলে সুঁই দেবো, ডর কী? কত মানুষই তো দিতাছে।
না, আমি দিমু না। আমারে যত খুশি ঔষধ দিতে কইও।
আইচ্ছা কমুনে। অনু কই রে?
আম কুড়াইতে গ্যাছে।
এই পোলাডা কোন কতা হুনে না। বৃষ্টিতে ভিইজা একটা ঝামেলা না বান্ধাইয়া থামবো না।
থাউক মা, ওরে একটু ভিজতে দাও। এই বয়সে একটু মজা না করলে আর কবে করবে?
সারাদিনই তো এদিক ওদিক ছুইটা বেড়ায়, তুই নিজেই তো অরে শাসন করস। আমি কী কখনো কিছু কই? এই বৃষ্টিতে ভিইজা যদি আবার জ্বরে পড়ে?
বকুল মায়ের অস্থিরতা দেখে হাসে। মনে মনে বলে, এই মজাডা তুমি বুঝবা না মা। এইডা ওর পরের জীবনের সম্পদ।
জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি বিছানায় পড়ল মন্টু। জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকতে শুরু করলো। অয়ন মন্টু মামার বিছানার পাশে বসে থাকে। মন্টু মামা বিড়বিড় করে কী যেন বলে কিন্তু কোনো শব্দ শোনা যায় না। একসাথে দু’টি মোটা কাঁথা গায়ে দিয়েও মামা থরথর করে কাঁপছে। অয়ন কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। একেবারে কাছে গিয়ে ডাকে- মন্টু মামা, ও মন্টু মামা? তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখদু’টো নিজের অনিচ্ছায় বুজে আসে মন্টুর। অন্য রাজ্যে চলে যায়, যেন একটা প্রবল শক্তিশালী ঘুর্ণি তাকে টেনে নিয়ে যায় গভীর থেকে আরও গভীরে। কে যেন ক্রমাগত ডেকে চলেছে তাকে, মন্টু চিৎকার করে জবাব দিতে চায়, কিন্তু পারে না। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হয়না।
সালমা বেগম বালতি ভর্তি পানি নিয়ে সামনের বারান্দায় আসেন। জানালার গ্রিলের সাথে মাটির একটি হাড়ি ঝুলিয়ে দেন। অয়ন মন্টু মামার শিয়রের কাছে বসে দেখে হাড়ির নিচের ছিদ্রে লাগানো সলতে দিয়ে পানি গড়িয়ে মন্টু মামার মাথায় পড়ছে। মাথায় পানির ছোঁয়া লাগতেই মন্টু মামা কেঁপে-কেঁপে উঠছে। পানি শেষ হলে অয়ন মগ দিয়ে আবার ভরে দেয় হাড়ি। মন্টু মামা নড়ে ওঠে একসময়। অয়ন আবার ডাকেÑ মন্টু মামা, ও মন্টু মামা?
মন্টু চোখ মেলে তাকায়। অয়ন জিজ্ঞেস করে,
মামা, তোমার খুব খারাপ লাগতাছে?
হ রে মামা, আমি মনে অয় আর বাচুম না। মন্টু মামা ক্ষীণ কণ্ঠে বলে।
দূর! জ্বর অইলে কেউ কী মরে? দেখলা না আমি ভালো অইয়া গেছি, ছোটদি ভালো অইছে।
তুমি আইজ ইস্কুলে যাও নাই?
না। স্কুল তো এহন বন্ধ।
, আইচ্ছা।
আকাশে কালো মেঘের দেয়াল সরে গিয়ে ঝলমলে রোদ ওঠে। অয়ন বাইরে তাকিয়ে দেখে গোপালদা পুকুরের ঘাটে পা ধুয়ে ওদের ঘরের দিকেই আসছে। অয়নের মুখে হাসি ফোটে।
গোপাল মধু ডাক্তারের কাছ থেকে আনা ওষুধের বোতলটা মন্টুর মাথার কাছে রাখে। ওষুধের বোতলের দিকে তাকিয়ে মন্টু বলে,
ঐ তেলাপোকার ডাক্তরের চিনির সরবতে কিছু অইবো না। এইবার আর বাচুম না রে গোপাল।
কী যে কও না দাদা! তোমার কিছু অইবো না, দেখবা দুইদিনের মধ্যেই ভালো অইয়া গ্যাছো। 
গোপাল চলে যাওয়ার জন্য উঠতেই তার পিছু নেয় অয়ন। অয়নকে পেছনে আসতে দেখেই গোপাল বোঝে কিছু একটা বলার আছে ছোটবাবুর।
কিছু কইবা অনু?
হ। গোপালদা, আমগো উত্তরবাগান থেইক্যা কয়ডা আম পাইড়া দেওনা।
, এই কতা? লও পাইড়া দেই।
অয়নদের উত্তরবাগানে বড় বড় আম, জাম, গাব, জামরুল গাছের ছড়াছড়ি। উপর দিকে তাকালেই ওর মনে হয় গাছগুলোর মাথা আকাশ ছুঁয়েছে। অয়ন ভাবে-ঐ গাছে ও কখনো উঠতে পারবে না। মন্টু মামা আর গোপালদা কেমন তড়তড় করে উঠে যায় গাছের মগডালে। গোপালদার কাছ থেকে সুবল কী চমৎকার গাছে ওঠা শিখে নিয়েছে। অথচ অয়নের বড় গাছের মাথায় তাকালেই কেমন ভয় লাগে।
হঠাৎ আকাশ চিরে আষাঢ় নামে। সহসাই চারিদিক কালো করে ধেয়ে আসে মেঘলা আঁধার। ঢাকের শব্দের মতো গুমগুম মেঘের গর্জনে কেঁপে ওঠে রুদ্রমুখর প্রকৃতি। বকুল চেয়ে থাকে আকাশের পানে। কেন যেন মনে হয় ওর জীবনেও ধীরে ধীরে আঁধার নেমে আসছে। মায়ের ব্যাকুলতা, বাবার উৎকণ্ঠা ওর ভিতরে এক ধরনের অজানা ভয় ধরিয়ে দেয়। সারাক্ষণ ঘরে শুয়ে বসে সময় কাটে; বড়জোর উঠোন কিংবা পুকুরের ঘাটে গিয়ে বসে।
অয়ন মাঝে মাঝে ছোটদি’কে জোর করে রাস্তায় হাঁটতে নিয়ে যায়। বাগান থেকে এটা-ওটা ফল পেড়ে দেয়। ও বোঝে ছোটদি আগেরমতো বেশিক্ষণ হাঁটতে পারে না, একটুতেই হাঁপিয়ে ওঠে। অয়নের খুব খারাপ লাগে।
বড় রাস্তার মাথায় দাঁড়িয়ে পড়েছে বকুল।
ছোটদি, তোর কী হইছে? অয়ন বোনের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে, চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা।
জানি না রে অনু; আর ভালো লাগতাছে না। ল’ বাড়ি যাই।
বাবা কইছে তোরে ঢাকা নিয়া বড় ডাক্তার দেহাইবো।
অনু, আমি যদি আর ফিরা না আসি, তোর মন খারাপ হইবো?
দূর! তুই কী যে কস ছোটদি! ডাক্তার দেখাইলে তো মানুষ ভালো হইয়া যায়। তুই ফিরা আইবি না ক্যান?
সবাই তো ফেরেনা, কেউ কেউ একেবারেই হারাইয়া যায়।
অয়ন দেখে ছোটদি’র দু’চোখে জল ছলছল করছে। ওর বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে।
শেষ বিকেলে বাজারে যাওয়ার জন্য বের হতে যাচ্ছিলেন সাত্তার মাস্টার। বারান্দা দিয়ে বাইরে নামার সময় হঠাৎ চোখে পড়ে জানালার গ্রিল ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে বকুল। সাত্তার মাস্টারের খুব মন খারাপ লাগে। মেয়েটা দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে। মধুপুর সদরে ডাক্তার দেখানোর পর কিছুদিন শরীর ভালো ছিল বকুলের। ইদানীং সেই পুরনো উপসর্গগুলো দেখা দিয়েছে আবার। সারাদিন চুপচাপ বসে থাকে, মাঝে মাঝেই বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আর সন্ধ্যার পর প্রায়দিনই জ্বর আসে। তাঁর প্রাণোচ্ছল মেয়েটার চেহারায় বিষাদের ছাপ। মনমরা হয়ে বসে থাকে সারাদিন। সাত্তার মাস্টারের খুব কষ্ট হয়। সালমা বেগমের চোখে ঘুম নেই। প্রতিরাতে উঠে মেয়ের ঘরে গিয়ে বসে থাকেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। বকুলের ঘুমও ইদানীং কমে গেছে। সালমা বেগম মাস্টারসাবকে বলেন, ‘মাইয়াডারে ঢাকায় নিয়া চলেন, ওইহানে আরও বড় ডাক্তার দেখান। আমার বকুল এমন অইয়া যাইতাছে ক্যান? সাত্তার মাস্টার ঠিক করেন তাই করতে হবে। খুব শীঘ্রই ওকে ঢাকায় নিয়ে যাবেন তিনি।




 

বৃষ্টি থামলে আকাশটা হেসে ওঠে আবার। এখন আর ওখানে মেঘের কোনো চিহ্ন নেই। নদীতে স্রোতও নেই। উজানগাঙের শান্ত জলের উপর দিয়ে তিরতির করে ভেসে আসছে ছোট্ট নৌকাটি। কলাবতী বাজার পেরিয়ে আসবার সময় নৌকার ছইয়ের মধ্যে বসে নারী দু’জন আশেপাশের অতিচেনা স্থানগুলো দেখে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই চেনা ঘাট, পরিচিত পরিবেশ, মানুষজন এখন অচেনা লাগে। গোধূলির লালিমাটা মুছে গেলে সন্ধ্যার আলোআঁধারি ছায়া গ্রাস করে চারপাশ। এমন সময় কোটাখালীর মুখে তেমাথার পুলের কাছে এসে ভেড়ে নৌকাটা। নারী দুজন নৌকা থেকে নেমে শ্যামলপুরের রাস্তায় ঢুকে পড়ে।
মাগরিবের নামাজ শেষে প্রতিদিনের মতো মসজিদের সামনের রাস্তায় পায়চারী করে মনু মিয়া। মসজিদ থেকে একটু এগিয়ে আসতেই চোখে পড়ে বাবলাতলার ভাঙা কুঁড়েঘরটি থেকে ক্ষীণ একটি আলোর রেখা হোগলার বেড়ার ফাঁক গলে বাইরে আসছে। মনু মিয়া থমকে যায়। ‘এই ঘরে আলো জ্বাললো কেডা! তাইলে কী বিভা ফিরা আইছে?’ রাস্তা থেকে মফিজ মিয়ার বাড়ির পথে নেমে দাঁড়ায়। ভেতর থেকে নিচু স্বরে কথা ভেসে আসছে। মনু মিয়া ফিরে এসে মাদ্রাসার ছাউনি ঘরটায় কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। একসময় বিড়বিড় করে বলে, ‘বড় আজব দুনিয়া। খোদা, তোমার লীলা বোঝা ভার!’
সকালবেলায় দীঘির পাড়ের রাস্তায় বিভাকে দেখে মেজাজটা খিঁচরে উঠলো পেয়ারা বেগমের। ‘এই আপদ আবার আইসা হাজির অইছে!’ ঘরে ফিরে সোজা বারান্দায় মফিজ মিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কোমরে হাত রেখে দাঁড়ানো স্ত্রীর রুদ্রমূর্তি দেখেই মফিজ মিয়া বুঝে যায় সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটেছে। মফিজ মিয়া কিছু বলার আগেই পেয়ারা বেগম বলে ওঠে,
কী হাওলাদার সাব, কইছিলেন তো আপদ বিদায় অইছে, তো এহন কী অইলো?
ক্যান কী অইছে আবার?
হওয়ার কী বাকি আছে, গিয়া দ্যাহেন আপনের সাধের ভাইজি আইসা হাজির অইছে। সম্পত্তির দখল ঠিক রাখতে অইবো না!
এইডা নিয়া চিল্লাচিল্লির কী অইলো? যাওনের সময় ও কী তোমারে কইয়া গেছিলো যে আর ফিরবো না?
ও কইবো ক্যান, আপনেই তো কইছিলেন ও আর বেশিদিন ঐ ভিডায় থাকবো না।
হ কইছি। যখন সময় অইবো তখন যাইবো।
আমি এতকিছু বুঝি না, এই ঝামেলা আর সহ্য করতে পারুম না। ক্যামনে খেদাইবেন খেদান।
দ্যাহো, চাইলেই তো আর খেদান যায় না, ভুইলা যাইও না এই বাড়িসহ ছয় আনা সম্পত্তির দাবিদার কিন্তু বিভা।
এতদিন পরে এইডা আবার কী হুনাইলেন? আপনে না কইছিলেন অর সব সম্পত্তি আপনের নামে লেইখা নিছেন!
তোমার মতো মাইয়ালোকের মাথায় এইসব ধরবো না, পারো তো খালি চিল্লাইতে।
আমি খালি চিল্লাই, তাইলে আপনের কোনো কুটুম আইসা সবকিছু সামলায়?
পেয়ারা বেগম আর দাঁড়ায় না, গজগজ করতে করতে ভিতরে চলে যায়। বিরক্ত হয়ে মফিজ মিয়া বলে ওঠেÑ এই শুরু হইলো বাংলাদেশ বেতারের বিজ্ঞাপন তরঙ্গ! আইজ সারাদিন চলবে।
বকুলকে পুকুরঘাটে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে পাশে গিয়ে বসে বিভা। ওর ম্লান মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
কী অইছে বকুল, তোরে এমন লাগতাছে ক্যান?
বকুল হাসে। সেই হাসিতে প্রাণ নেই যেন। শরীরটা ভালো না বিভা’পু, তুমি কেমন আছো?
ভালো। কিন্তু এই কয়মাসে তুই এমন শুকাইয়া গ্যাছোস ক্যান? কী অইছে তোর?
জানি না। শরীরে জোর পাই না।
সালমা বেগমকে পুকুর ঘাটের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে উঠে দাঁড়ায় বিভা। চাচি বকুলের কী অইছে? অরে তো চেনাই যায় না!
জানি না রে মা, মধুপুরে নিয়াও ডাক্তার দেহানো অইছে। কোনো কাম অইতাছে না। তোর চাচা কইছে ঢাকায় নিয়া যাইবো।
আহারে! অর দিকে তো তাকানোই যাইতাছে না!
ছালমা বেগমের চোখেমুখে চিন্তায় ছাপ স্পষ্ট। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
তুই কহন ফিরছোস?
কাইল সাঁঝের বেলা।
প্রভা ভালো আছে?
হ চাচি। অই দ্যাশেও অনেক অভাব। হ্যাগোই তিন বেলা খাওন জোডে না, আমগো দুইডা বাড়তি প্যাট আর কয়দিন টানবো? তাই চইলা আইলাম।
ভালো করছোস। তোর চাচা-চাচি কী কয়?
আমারে কিছু কয়নাই, হুনলাম বিহান বেলা হ্যাগো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আমগো লইয়া ঝগড়া অইছে।
হউক। তোর ঐসবে কান দেয়ার দরকার নাই।
না চাচি, আমি তাগো ঘরের ধারে কাছেও যাইনা। তাগো ভালো লাগা না-লাগায় আমার কী আসে যায়? আমি আমার মতোই আছি।
মন্টু চালকল থেকে ধানের বস্তা মাথায় বাড়িতে ঢুকলে দুজনেই ঘরের দিকে এগিয়ে যায়।
মমিনের ঘুম আসছিলো না। কয়েকদিন ভালো থাকার পর কাশিটা আবার বেড়ে গেছে। খোলা জানালা দিয়ে বাইরে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। নারিকেল গাছটার পাতার ফাঁক গলে আঁধখানা চাঁদের আলোয় ঘরের ভেতরের অন্ধকারটা ফিকে হয়ে এসেছে। মমিম মনে মনে গান ধরে, ‘আমার ভাঙা ঘরে চান্দের আলো ঝুরঝুরাইরা পড়ে’। গান গাইতে গাইতেই একটা কথা মনে পড়ে যায়। পারুলের দিকে তাকিয়ে দেখে পাশ ফিরে চুপচাপ শুয়ে আছে সে।
পারু, ও পারু!
কী? আমারে ডাকছো? ঘুমজাড়ানো কণ্ঠে বলে পারুল।
ঘুমাইয়া পড়ছোনি?
হুম! ঘুমডা কেবল আইছিলো, কী কইবা কও।
আমি একটা কতা ভাবতেছিলাম। তোমগো দুশ্চিন্তার একটা সমাধানও অইতো!
পারুল মনযোগী হয়ে ওঠে।
কি কতা?
আমগো মতির লগে প্রভার বিয়া দিলে ক্যামন অয়? তাইলে কেউ আর কিছু করতে সাহস পাইবো না। 
পারুল কিছুক্ষণ ভাবে। তারপর বলেÑ কতাডা তুমি খারাপ কও নাই। মতির আপত্তি না থাকলে আমি রাজি।
আরেকটা ব্যাপার চিন্তা করছি আমি।
কী?
তোমার মফিজ চাচার কাছ থেইক্যা বিভার সম্পত্তি উদ্ধারের চেষ্টাও করন যায়। গ্রামের অনেকেই তো বিভার পক্ষে আছে, সবাইরে ডাইকা এই বিষয়ডার একটা সমাধান চাইলে কিছু একটা অইবোই।
পারুল চুপ করে থাকে। মমিন আবার বলে,
এহন কাউরে কিছু কওনের দরকার নাই। আগে মতির লগে তুমি কতা কও, তারপর বিভারে জানাইও।
ঠিক আছে, এহন ঘুমাও। মতি বাড়ি আইলে কতা কইয়া দেহি।
পারুল ঘুমিয়ে যায়। মমিন আবার একলা জেগে থাকে। ইদানীং ঘুমের সমস্যা তাকে বেশ ভোগাচ্ছে। এভাবেই রাতের পর রাত কেটে যায়, সারারাত অপেক্ষার পর শেষ রাতের দিকে কিছুটা ঘুম হয় তার।
সারারাত ধরে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। কিছুটা হিম হিম ভাব। পাতলা কাঁথাটা গায়ে জড়িয়ে ঘুমটা বেশ আরামদায়ক ছিল সুবলের। গোপালের চিৎকারে খুব সকালেই হুড়মুড় করে উঠে বসে। ঘুমে জড়ানো চোখ কচলাতে কচলাতে ঘরের সামনের সিঁড়িতে এসে দাঁড়াতেই দেখে উঠোনে ছোটকাকু গোপালদাকে ধমকাচ্ছে।
কী রে, এই সাত সকালে ষাঁড়ের মতো চিল্লাইতেছস ক্যান?
ছোটকর্তা, আমগো বড় পুকুরের সব মাছ মইরা ভাইসা উঠছে।
কী কইলি?
, সত্য কইতাছি। বিশ্বাস না অইলে লন আমার লগে।
বাহিরে উচ্চস্বরে কথাবার্তা শুনে হরিপদও ততক্ষণে উঠানে নেমে দাঁড়িয়েছেন।
চল তো, দেইখ্যা আসি।
হরিপদ, তারাপদ পুকুর ঘাটে এসে থ’ হয়ে গেল। ঘাটের সামনের খোলা পানিতে অনেক মরা মাছ ভাসছে। কাজের চাপে পুকুরের কচি কচুরিপানাগুলো পরিষ্কার করা হয়নি। গোপাল পুকুরে কলাগাছের ভেলাটায় চড়ে লাঠি দিয়ে ছোট ছোট কচুরিপানা সরায়। ধীরে ধীরে পানির উপরের স্তর মরা মাছে ভরে ওঠে। রুই, কাতলা, তেলাপিয়াসহ অনেক মাছই ভাসছে। এই পুকুরে ছয়মাস আগে জিয়ানো মাছগুলো বেশ বড়সড় হয়ে উঠেছিলো। তারাপদর বুঝতে বাকি থাকে না এটা কার কাজ।
তুই সাত্তার মাস্টার আর আতিকরে খবর দিতে পারবি? আমার কতা কইবি। হরিপদ গোপালের উদ্দেশ্যে বললেন।
জি বড়কর্তা, যাইতাছি। গোপাল সাত্তার মাস্টারের বাড়ির দিকে ছোটে।
মরা মাছগুলো দেখে সুবলের মন খুব খারাপ হয়ে যায়। ক’দিন আগে গোপালদাকে দিয়ে ভেলাটা বানিয়েছে, ওটায় চড়ে মাছ ধরবে বলে। কাল সকালে বড় বড় তেলাপিয়া মাছগুলোকে ঘাটের পাশে ভেসে উঠতে দেখেছিলো ও। মনে মনে ভাবে, ‘ইস! মাছগুলান মইরা সব সাদা অইয়া গ্যাছে!’
সাত্তার মাস্টার পুকুরের দিকে তাকিয়ে হতবাক। কাজেম আর আতিকের দিকে ফিরে বলেন,
কিছু বুঝছ?
কাজেম মাঝি বলে ওঠেন- না বোঝার কী আছে? আমার আগেই মনে অইছিলো শয়তানডা চুপ কইরা বইয়া থাকবো না। তারারে তো আমি হেইদিনই কইছিলাম।
আমি ভাবতাছি, প্রমাণ ছাড়া শয়তানডারে ধরুম ক্যামনে! আতিক বলে।
সকাল থেকেই মেজাজ খারাপ হয়েছিলো তারাপদর। সে ঝাঁঝের সাথে বলে ওঠে-পুকুরের পানিতে বিষাক্ত কিছু না মেশাইলে এইভাবে সব মাছ কহনও মরে
হেইডা তো আমরা সবাই বুঝি, কিন্তু আতিকের কথাডাও তো ঠিক। প্রমাণ ছাড়া আমরা কাউরে আটকাইতে পারুম না। সবাই আইজ সন্ধ্যায় চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে আইসো, সবার সাথে আলাপ কইরা এর একটা বিহিত করন লাগবো।
বিষয়টি ভাবিয়ে তোলে সবাইকে। সন্ধ্যায় চেয়ারম্যানের সভাকক্ষে গুরুগম্ভীর আলোচনায় সবার একটাই কথা- এর একটা সুরাহা হওয়া দরকার।
ইসমাইল মোল্লা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন।
হারামজাদারে ধইরা আচ্ছাতরে ধোলাই দিলে আসল কথা বাইর অইয়া যাইবো।
তুমি কী মনে কর ও সব স্বীকার কইরা নিবো? যদি প্রমাণ করতে না পারো, তাইলে কিন্তু ও আরও সুযোগ পাইয়া যাইবো। আমগো কৌশলে আগাইতে অইবো। সাঈদ খান বলেন।
রমেন সাহা বলে ওঠে- আইজ হরিদা’র বাড়িতে হইছে, কাইল আমার বাড়িতে যে একই ঘটনা ঘটবো না তার কী কোনো ঠিক আছে?
রমেন, তোমার কথা আমি ফালাইয়া দিতাছি না। কিন্তু প্রমাণ ছাড়া কাউরে দোষী সাব্যস্ত করবা ক্যামনে? আইনে তো আমরা আটকাইয়া যামু। সাঈদ খান আবার বলেন।
আমগো কিছু একটা তো করন দরকার। কাজেম মাঝি বলে ওঠেন।
সবাই সজাগ থাকো আর অর গতিবিধির দিকে খেয়াল রাখো।
তারাপদ চুপচাপ বসে থাকে। সবার কথা শোনে। সে বেশ বুঝতে পারে আইনের বেড়াজালে আবদ্ধ এরা সবাই। আসলে কারো কিছু করার নেই। এই অস্তিত্বহীনতার সংকট শুধুমাত্র তাদের। হয়তো অনেকে তাদের দুরবস্থায় ব্যথিত হবে, কেউ কেউ সান্ত¡না দেবে, এর বেশি না। তাদের অসহায়ত্বকে মনে ধারণ করার মানসিক অবস্থা কারো নেই।
তারাপদ সভা ছেড়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে যায়। একাকী হেঁটে চলে বাড়ির পথে। চারিদিকে রাত্রির নিস্তব্ধ আঁধার। মাথার উপর গুমোট মেঘের আকাশটা যেন উপহাস করছে। তারাপদর অস্থির মনে প্রশ্ন জাগেÑ আজ তারা যে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে, যে খেলা আজ শুরু হয়েছেÑ এর শেষ কোথায়? এ কীসের অশনি সংকেত?
তারাপদর কোন কিছুই ভালো লাগেনা। ঘরের উঠোনে, বাংলাঘরের সামনে-পেছনে-সব জায়গায় ধানের আঁটির উঁচু স্তূপ জমে আছে। লোকজন নিয়ে ধান মাড়ানো, সিদ্ধ, শুকোনো- কিছুই করা হয়নি। আগে এই কাজগুলো ঠিকমত না হলে তারাপদ গোপালের সাথে হৈচৈ শুরু করে দিতো। ইদানীং কোনো কিছুতেই আর আগ্রহ পায়না। গোপাল এসে বলে,
ছোটকর্তা, ধানগুলান মারাইতে অইবো না?
তারাপদ নিস্পলক তাকিয়ে থাকে গোপালের দিকে। অনেকক্ষণ পর বলে,
তুই য্যামনে পারস ব্যবস্থা কর; জগাই, মালেক আর ছমিররে লগে নিয়া নে।
আইচ্ছা।
গোপাল চলে গেলে ঘরের সিঁড়িতেই বসে থাকে তারাপদ। বিজয়া এসে পাশে বসে।
আপনে এমন কইরা ভাইঙা পড়লে অইবো?
কী করুম কও? মনরে যে মানাইতে পারতাছি না। এত্তবড় একটা ঘটনা ঘইটা গ্যালো, সবাই বুঝে এইডা কার কাম- কিন্তু কেউ কিছু করতে পারতাছে না। আসলে ক্ষতডা যার হে-ই বোঝে ব্যথাডা কত তীব্র।
তাই বইলা এমন কইরা হাল ছাইড়া বইসা থাকলে কোনো লাভ অইবো? নিজেগো যুদ্ধডা নিজেগোই করতে অইবো। আপনে রমেনদা, সাত্তার ভাইয়ের লগে কতা কন। একটা উপায় বাইর অইবোই।
দেহি।
তারাপদ বিজয়ার দিকে তাকায়। মনে মনে ভাবে, ‘সহজ সরল এই বিজয়া এত সাহস ক্যামনে রাখে!’ মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এমন করেই তাকে সাহস যুগিয়েছে। তারাপদ মনে মনে ঠিক করে- টিকে থাকার জন্য আরেকটা যুদ্ধ করতে হবে।
সূর্য ডুবে গেছে কিছুক্ষণ আগে। পশ্চিম আকাশে লাল রঙটা এখনো মুছে যায়নি পুরোপুরি। বইয়ের দোকানের সামনের খোলা চত্বরে চুপচাপ বসে আছেন সাত্তার মাস্টার। বকুলের জন্য অজ মনটা বড় অস্থির। ওকে ঢাকায় নিয়ে যাবার কথাই ভাবছেন তিনি। হরিপদ এসে পাশে বসলেন।
মাস্টার, এমন অইলে দেশে থাকুম ক্যামনে কও?
তুমি চিন্তা কইরো না হরি। এইগুলানের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে অইবো। চোখ-কান একটু খোলা রাইখো। তোমার মতো আমারও মনের অবস্থা ভালো নাই। শিউলির ডেলিভারি হইতে আর বেশি দেরী নাই। কিন্তু এই মুহূর্তে মুক্তনগরে যাইতে পারতাছি না। আমার বকুলরে ঢাকায় নিয়া যাইতে অইবো, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। মধুপুর থেইক্যা ডাক্তার বইলা দিছে ওকে দ্রুত ঢাকায় নিয়া ভালোমতো চেক-আপ করাইতে হইবো। বকুলরে নিয়া আমি হয়তো কাইল-পরশুই ঢাকায় চইলা যামু। ফিরা আইসা নেই, একটা ব্যবস্থা অবশ্যই নিতে অইবো। অগো আর বাড়তে দেওন যাইবো না।
হরিপদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন- দ্যাখো, কিছু করতে পারো কিনা।
-আমি ফিরা আসি, তারপর সবাই মিইল্লা বইসা একটা সিদ্ধান্ত নিমু।
-তুমি যাও মাস্টার। বকুল মা’র চিকিৎসা কইরা ফিরা আসো। সাত্তার মাস্টারের কাঁধে হাত রেখে বলেন হরিপদ ঘোষ।
আজ কয়েকদিন ধরে ঘর থেকে বের হচ্ছে না সাজু। বেশির ভাগ সময় পেছনের বারান্দায় ঘুমিয়েই কাটায়। ভয়ে বাবার মুখোমুখিও হতে পারছে না। হারিছের সাথে ব্যবসায় প্রায় পুরো টাকাটাই মার খেয়েছে সে। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে লাপাত্তা হারিছ। এই টাকা উদ্ধারের কোনো উপায়ও জানা নেই সাজুর। মফিজ মিয়া কোনোভাবেই ছেলের উপর আর নির্ভর করতে পারছে না। এখন একমাত্র ভরসা গিয়াস। তাই বাবাকে বোঝাতে গিয়াসকে তার সামনে হাজির করেছে সে।
আপনে একটুও চিন্তা কইরেন না চাচা। হারিছের চৌদ্দগুষ্টির নাড়ি-নক্ষত্র আমার জানা আছে। ও টাকা না দিয়া যাইবো কই?
আমি আগেই কইছিলাম, এই বাদাইম্যারে দিয়া কিচ্ছু অইবো না। এহন আমার আম-ছালা দুইডাই গ্যালো! তুই দ্যাখ টাকাটা ফেরত পাওনের কোনো ব্যবস্থা করতে পারোস কী না। গিয়াসের উদ্দেশ্যে বলে মফিজ মিয়া।
আপনে নিশ্চিত থাকেন চাচা, এই টাকা মাইর যাইবো না।
মফিজ মিয়া কড়া চোখে সাজুর দিকে তাকায়। সাজু চোখ নামিয়ে নেয়। গিয়াস বেরিয়ে গেলে বাবার রক্তচক্ষু থেকে বাঁচতে ঘরের ভেতরে ঢুকে যায় সাজু।
সাত সকালে মফিজ মিয়ার বাড়ি থেকে বেরিয়ে দীঘির পাড়ে আসতেই প্রভাকে দেখে থমকে দাঁড়ালো গিয়াস। তার দিকে চোখ পড়তেই ঘরের মধ্যে চলে যায় প্রভা। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে গিয়াসের মধ্যে ভিন্ন রকম এক অনুভূতি জাগে। কয়েকমাস আগে জনসম্মুখে জুতার বাড়ি খাওয়ার যন্ত্রণাটা তীব্রভাবে অনুভব করে আবার। বাবলাতলার ছোট্ট কুঁড়েটার আশেপাশে ঝোপঝাড়-বাগানের দিকে একবার চোখ বোলায়। প্রমাণের অভাবে সাত্তার মাস্টাররা বাদলের কিছুই করতে পারছে না, তাহলে সে যদি কোনো প্রমাণ না রাখে! নিজেই নিজেকে বলে- ‘একদিন সময় আমারও আইবো’। তারপর হনহন করে হেঁটে বড় রাস্তায় উঠে বাজারের দিকে চলে যায়।





 

বৃষ্টি-বাদলার দিন। টিনের চালে নিরবধি রিমঝিম বারিধারা মনকে উদাস করে দেয়। আজ সকাল থেকেই থেমে থেমে ঝরছে। সারাদিন মেঘের গুঁড়-গুঁড় শব্দ আর অবিরাম বৃষ্টি সুরের মূর্ছনা তুলে চলে। এখন আষাঢ় মাস। মাঝে মধ্যে দমকা হাওয়ার সাথে ঝমঝমিয়ে নামে। বৃষ্টি শিউলির সবসময়ই পছন্দের। বিশেষ করে এই ভারী বর্ষার সময়টা। এই সময়ে হুড়মুড় করে যেমন নামে তেমনি হঠাৎ করেই আবার থেমেও যায়। অদ্ভুত রৌদ্রছায়ার খেলা চলে তখন। শিউলি বসে আছে দখিনের বারান্দায়। এই বারান্দায় বসে বিচিত্র সব মানুষ দেখা যায়। মাঝে মধ্যেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করে মানুষের বিচিত্র অভিব্যক্তি, কথা বলার ধরন। প্রায়ই ও একা একা হাসে। কখনো কখনো নানান ভাবনা এসে ঘিরে ধরে। গ্রামের কথা, নাহিদের কথা, আর ক’দিন বাদে যে নতুন অতিথি আসছেÑ তার কথা। কত কী মনে আসে! এমন বৃষ্টির দিনে বাড়ির কথা খুব মনে পড়ে শিউলির। দিগন্ত বিস্তৃত বৃষ্টিভেজা খোলা মাঠ আর ধূ-ধূ আকাশের ছবিটা মনে হানা দেয়। কতদিন শ্যামলপুরে যাওয়া হয়না!
বারান্দার সামনের খোলা মাঠে পানি জমে আছে। পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত পানিতে ডুবে যাওয়া মাঠে ফুটবল নিয়ে মেতে উঠেছে অল্পবয়সী ছেলেদের দল। কেউ কেউ অয়নের বয়সী। তখনই ওর মনে পড়ে বাড়ি থেকে আসা ওদের চিঠির জবাব দেয়া হয়নি। ইদানীং আলস্য যেন জড়িয়ে ধরে শিউলিকে। আজ কয়েকদিন ধরে চিঠিগুলো পড়ে আছে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে। লিখি লিখি করেও উত্তর লিখতে বসা হয়ে ওঠেনি। 
এখন ওর অফুরন্ত অবসর। বেশির ভাগ কাজ শরিফাই করে দেয়। শিউলি বারান্দায় বসে থাকে। কেন জানি উঠতে ইচ্ছে করেনা। এখন অনেককিছুতেই ওর আগ্রহ হয়না। কোনো কাজ না থাকায় শিউলির মনে হয় যেন নির্বাসিত জীবন। এই বাড়িটার চারিদিকেই ফাঁকা। মাঝে মাঝে মনে হয় পাশাপাশি দু-এক ঘর প্রতিবেশী থাকলে মন্দ হত না। মাঠের উপর দিয়ে দূরে ধূসর আকাশটা ধীরে ধীরে গাঢ় হয়ে আসে। বোধহয় ঝড় আসবে।
রান্নাঘরে শরিফা কাজ করছে। বারান্দায় বসেই শিউলি বাসন-কোসন নড়াচড়া করার টুং-টাং শব্দ শুনতে পাচ্ছে। মেয়েটা বেশ কাজের। ওর ঘরের সব কাজই করে দেয়। যেমন চটপটে, তেমনি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। নিজেও টিপটপ থাকতে পছন্দ করে। হঠাৎ করে দেখলে মনে হবেনা যে ও কারো বাড়িতে      ঝি-য়ের কাজ করে। শিউলির খুব চা খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। একবার ভাবে শরিফাকে ডেকে বলে, পরক্ষণেই মনে হয়- থাক। আবার ভাবনার জগতে ডুবে যায়।
আফা, সব কাম শ্যাষ। আমি এহন যামু?
শিউলি পেছনে ঘুরে দেখে শরিফা দরজায় দাঁড়িয়ে।
এখনই যাবে?
আপনার লইগ্যা চুলায় চা বসাইছি। চা’টা দিয়া যাইতাছি। সন্ধ্যার আগেই আবার আমুনে।
শিউলি হেসে বলে-আচ্ছা।
শরিফা এ ক’দিনে বেশ বুঝে গেছে শিউলির কখন কী দরকার। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে শরিফা এসে ওর সাথেই থাকে। নাহিদ ফিরে এলে চলে যায়। মাঝে মধ্যেই নাহিদের ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়।
শরিফা চলে যেতেই শুরু হয় নাহিদের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা। এতদিন বেশ ভালোই চলছিল। সন্ধ্যা নাগাদ নাহিদ ফিরে আসতো বাসায়। আজ কয়েকদিন ধরে আবার দেরী করে ফিরছে। একা ঘরে শিউলির সময়গুলো বড় অসহ্য লাগে।
আজ তিনদিন ধরে অফিস বেশ গরম। হিসাব নিয়ে একটা গোলমাল বেঁধেছে। বসের মাথা আরও খারাপ হয়ে আছে। নাহিদকে ঠা-া মাথায় সবকিছু সামাল দিতে হচ্ছে। বস ঘণ্টায় অন্তত দুইবার এসে খোঁজ নিয়ে যান কাজের অগ্রগতি কতটুকু হল? কাজের ফাঁকেই বসের রুমে ডাক পড়ল নাহিদের।
কী অবস্থা নাহিদ সাহেব?
স্যার, শেষ হয়ে আসছে। আশা করি আজকের মধ্যে সমাধান হয়ে যাবে।
ভালো। কাল থেকে আপনি আর এদিকে সময় দিতে পারবেন না। ট্রেনিং-এর পুরোটা সময় আপনাকে ব্যস্ত থাকতে হবে। আজকের মধ্যে যেভাবে হোক এটা শেষ করুন। দরকার হলে আরও লোক নিয়ে নিন।
প্রয়োজন হবে না স্যার। আজকের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে।
ধন্যবাদ। আপনাকে পরে ছুটি দিয়ে পুষিয়ে দেব।
বস চলে গেলেন। নাহিদ হাসে। বোঝে, এটা একটা কথার কথা। এর আগেও অনেকবার বলেছেন তিনি; কিন্তু ছুটি আর মেলেনি। অবশ্য তাকে দোষ দেয়া যায় না। অফিসে কাজের যা চাপ সেই তুলনায় লোকবল কম। তাকেও তো অফিস চালিয়ে নিতে হবে। নাহিদ ভাবে, কাল থেকে ট্রেনিং শুরু হলে আবার এক সপ্তাহের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়বে সে। শিউলিকে কথা দিয়েছিল এখন থেকে সন্ধ্যার পর অফিস থেকে ফিরে তাকে সময় দেবে। বেচারি সারাদিন একা থেকে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছে। কাজের ভিড়ে অফিসে নাহিদের সময়টা কেটে যায় কিন্তু বাড়িতে শিউলিকে একাই থাকতে হয়। এই ছোট্ট শহরে দু’একজন অফিস কলিগ ছাড়া পরিচিত জন কেউ নেই। নাহিদ একবার দিপাকে এখানে নিয়ে আসতে চেয়েছিল কিন্তু বাবা-মা রাজি হয়নি।
অফিসের কাজ সেরে নাহিদের বের হতে রাত হয়ে গেল। বেরিয়েই বৃষ্টির মুখে পড়ে গেল। এই মফস্বল শহরটা বেশ ছোট। সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পরই রাস্তাঘাটে লোকজন কমে যায়। এই সময় রিকশা ছাড়া আর কোন বাহন মেলে না। কলিগ কামালের সাথে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে বৃষ্টি থামার জন্য। একসময় কমে আসে বৃষ্টি, কিন্তু থেমে যায় না পুরোপুরি। নাহিদ রাস্তায় নেমে পড়ে।
নাহিদ ফিরল রাত ন’টায়। বৃষ্টিতে চুপচুপে ভিজা। শিউলি এতো করে বলে ‘ছাতা নিয়ে যাও’ কিন্তু ও কিছুতেই ছাতা ব্যবহার করবে না। নাহিদ বলে, ‘এটা একটা বাড়তি ঝামেলা। যেখানেই যাও, হাতে লাঠির মতো একটা জিনিস নিয়ে ঘুরে বেড়াও। তারচে’ বরং বৃষ্টিতে ভেজা ভালো’। বৃষ্টিতে ভিজতে শিউলিরও ভীষণ ভালো লাগে। শ্যামলপুরে থাকতে কতদিন বৃষ্টিতে ভিজেছে! বৃষ্টি নামলেই বকুলকে নিয়ে উঠোনে নেমে পড়তো। মা একটু রাগারাগি করলেই বলতো- মা, একটু ভিজতে দাও না। মাঝে মাঝে মা’কেও ধরে নামিয়ে নিতো সাথে। এখন আর বৃষ্টিতে ভেজা হয়না। নাহিদের কড়া নিষেধ ‘কিছুতেই ঠা-া লাগানো চলবে না’। শিউলি নাহিদের দিকে তোয়ালেটা এগিয়ে দিয়ে রান্নাঘরের দিকে যায়। 
রাতের খাবার পর একটা সিগারেট না হলে নাহিদের চলে না। নাহিদ সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসে। দরজাটা আলগা করে ভিড়িয়ে দেয়। সিগারেটে শিউলির যত অভিযোগ। মাথায় অফিসের দুশ্চিন্তা। একটা না একটা ঝামেলা লেগেই থাকে।
তুমি এখানে?
হু। একমুখ ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে নাহিদ বলে।
আবার সিগারেট!
দরজাটা তো ভেজানোই ছিল, তুমি আবার এখানে এলে কেন?
তোমার সাথে কিছু কথা ছিল, তাই খুঁজতেছিলাম। তোমার সিগারেটের ধোঁয়া খেতে নয়। রাগ করে চলে যায় শিউলি।
ইদানীং শিউলি খুব খিটখিটে হয়ে গেছে। অল্পতেই রেগে ওঠে। নাহিদ অবশ্য স্বাভাবিক ভাবেই নেয়। ডাক্তার বলে দিয়েছে, এই সময় ওর আচরণ এমন হতেই পারে। সিগারেট শেষ হতেই নাহিদ উঠে পড়ে। মনে মনে হাসে- এক্ষনি মহারাণীর রাগ ভাঙাতে হবে। নাহিদ ভিতরে এসে দেখে শিউলি মশারি খাটিয়ে শুয়ে পড়েছে।
বল, কী তোমার জরুরি কথা।
থাক লাগবে না। শিউলির রাগ কমে না।
সরি, মহারানী। আর এমন হবে না। বল, তোমার জরুরি কথাটা শুনি।
শ্যামলপুর থেকে চিঠি এসেছে। বকুল অনেক অসুস্থ। মা-বাবা আসতে পারবে না।
ঠিক আছে, এতে সমস্যা কী? আমি শিপনকে লিখে দিচ্ছি মাকে নিয়ে আসতে।
একবার তাদের আসতে বারণ করে দিলে, আবার এখন আসতে বললে আম্মা-আব্বা কী মনে করবে?
এতে মনে করার কী আছে? মানুষের সমস্যা হতে পারে না?
তবুও ব্যাপারটা কেমন দেখায় না?
তুমি অযথাই একটা সহজ বিষয়কে জটিল করে ভাবছ। বকুল অসুস্থ না হলে আম্মা তো আসতেন। এখন সমস্যা হওয়ায় মা আসবে। এই তো।
তুমি ব্যাপারটা ভালোভাবে বুঝিয়ে লিখ। ওনাদের যেন মন খারাপ না হয়।
ওটা আমার উপর ছেড়ে দাও। এখনো তো বেশ কিছুদিন বাকি আছে।
আর একমাস পর ডেট। তবে ডাক্তার পনেরো দিন আগে থেকে প্রস্তুত থাকতে বলেছে, ভুলে গেছ তুমি?
না, ভুলিনি। আমি কালই চিঠি পোস্ট করে দিব।
তাই দাও।
তোমার শরীর আজ কেমন?
আগের থেকে বেশ ভালো।
শরিফা ঠিকমত আসছে তো?
হুম। তুমি বোনাসের কথা বলেছ না! তাছাড়া মেয়েটা অনেক কাজের। ওকে ছাড়া যাবে না।
ছাড়ার দরকার কী? সামনে তো তোমার সবসময় একজন লোকের প্রয়োজন হবে। ওকে পার্মানেন্ট ভাবে রেখে দাও।
দু’জনেই অনেকক্ষণ চুপচাপ। নাহিদ শিউলির দিকে পাশ ফিরে শোয়। হঠাৎ মনে হলো শিউলি কাঁদছে। আলগোছে নিজের দিকে ফিরিয়ে নেয়।
কী হয়েছে? কাঁদছ কেন?
বকুলের কথা খুব মনে পড়ছে। ওর কী হলো? বাবা ওকে ঢাকায় নিয়ে যাবে কেন?
এ নিয়ে এতো ভাবছ কেন? হয়তো তেমন কিছুই না। মধুপুরে বড় কোন স্পেশালিস্ট নেই, তাই ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছে।
তবুও চিন্তা হয়। অনেকদিন ধরেই ওর অসুখের কথা শুনছি।
তুমি কিছু ভেবো না তো! ঢাকায় নিয়ে গেলে দেখবে ঠিক হয়ে গেছে।
তাই যেন হয়।
আবার নিস্তব্ধতা। কারো মুখে কথা নেই কোনো। শিউলির ঘুম আসছে না। এপাশ ওপাশ করে শুধু। নাহিদের দিকে ফিরে দেখে ও ঘুমিয়ে পড়েছে। নাহিদের ঘুমাতে সময় লাগে না। শোয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে যায় ঘুমের রাজ্যে। ঘরের ভিতরে আধো অন্ধকার। বাহিরে ঝলমলে চাঁদোয়া। জানালা গলে চাঁদের আলো এসে নাহিদের মুখে পড়েছে। শিউলির বড় মায়া লাগে। মাঝে মাঝে নাহিদের সাথে খুব বাজে ব্যবহার করে। অফিসে সারাদিন খুব পরিশ্রম যায়, বাসায় এসে বউয়ের রাগারাগি ভালো লাগার কথা নয়। তবুও নাহিদ কখনো রাগ করে না।
শিউলি জেগে থাকে একা। কখনো মধ্যরাত পেরিয়ে যায়, শিউলির চোখে ঘুম আসে না। অনেক চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারে না। এই সময় ঘুমের ওষুধ খাওয়া বারণ। মাঝে মাঝে একা ভয় ধরে মনে। নাহিদকে জাগায় না। বেচারা সকালে অফিসে চলে যায়। সারাদিন খুব খাটুনি হয়, রাতে ঘুমটা ভালোমত দরকার।
দিনগুলো এমনি করেই চলে যায়। শিউলির সময় কাটে অনাগত দিনের কথা ভেবে। মনে মনে প্রত্যাশিত দিনটির জন্য অধীর প্রতীক্ষা। তার একাকীত্ব ঘুচাতে একজন আসছে। মন খারাপের সময়গুলো সে আনন্দে ভরিয়ে দেবে। শিউলির দু’চোখে জল জমে। দুঃখের নয়, আনন্দ অশ্রু।
সকাল হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ। শরিফা এখনো আসেনি। শিউলি উঠে চুলায় পানি চড়িয়ে দেয়। নাহিদের বারোমাসই গরম পানি লাগে। গরম পানি ছাড়া তার গোসল হয় না। প্রথম প্রথম শিউলি অবাক হত। বলতো, ‘তুমি না গ্রামের ছেলে! গ্রামের ছেলেরা পুকুরে গোসল করে অভ্যস্ত, তোমার এই গরমেও গরম পানি লাগে?’ নাহিদ হেসে বলতো, ‘গরম পানি লাগে না তো, কেবল পানির ঠা-া ভাবটা কাটিয়ে নেই’। শিউলি তখন হাসতো।
একটু পর শরিফা আসে। বাসি বাসন-কোসন ধোয়ার কাজে লেগে পড়ে। শিউলি বাইরে এসে আম গাছতলায় দাঁড়ায়। আজ বৃষ্টি নেই। আকাশ বেশ পরিষ্কার। গেটের বাইরে বেরিয়ে আসে, ঘাসের উপর খালি পায়ে হাঁটে। চারিদিকে একটা স্নিগ্ধ, কোমল ভাব। ঠা-া বাতাসের ঝাপটা গায়ে লাগতেই একটু শীত শীত লাগে। গতকাল এই রাস্তার পাশে ভরা পানি ছিল, আজ শুকনো। কাল রাতে বৃষ্টি হয়নি। এখন বৃষ্টির কোনো ঠিক নেই, যখন তখন হুড়মুড় করে নামে। সবকিছু ভাসিয়ে দিয়ে যায়। চারিদিক ফর্সা হয়ে আসছে। রাস্তায় লোকজন বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। শিউলি গেটের ভিতরে চলে আসে।
নাহিদের অস্থিরতা ইদানীং বেড়ে গেছে। শিউলির আর মাত্র দিন পনেরো বাকি। যত দিন ঘনিয়ে আসছে নাহিদ ততই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে উঠছে। নাহিদের অস্থিরতা দেখে মাঝে মাঝে শিউলি হেসে ফেলে।
তোমার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ডেলিভারিটা তোমারই হবে। শিউলি হাসে।
না, আমার বউয়ের হবে। তাই বলে কী বউয়ের জন্য আমার দুশ্চিন্তা হবে না? নাহিদ হেসে জবাব দেয়।
তা হবে, তবে তোমার-আমার দুশ্চিন্তার মধ্যে পার্থক্য আছে না?
আমার’ আর ‘তোমার’ মধ্যে পার্থক্য কী হে মহারাণী?
পার্থক্য আছে না? মেয়েদের এই অবস্থাটা তোমরা পুরুষ মানুষেরা কখনই অনুভব করতে পারবে না।
ভুল বললে। হয়তো তোমাদের শারীরিক কষ্টের ভাগ নিতে পারবো না কিন্তু অনুভব ঠিকই করতে পারবো। তোমরা শুধু ‘নিজেকে’ নিয়েই ভাব, ‘নিজেদেরকে’ নিয়ে ভাবতে পারোনা; এজন্যই লোকে বলে ‘মেয়েমানুষ!’।
হুম। সেই মেয়েমানুষের গুরুত্ব কিন্তু এখন তোমাদের চেয়ে অনেক বেশি।
তোমাদেরকে এই গুরুত্বপূর্ণ আসনে বসানোর জন্য একজন পুরুষের ভূমিকা কিন্তু কম নয়, এটা ভুলে যাচ্ছ কেন?
ভুলিনি জনাব। আমি বলতে চাইছি, আসলে কষ্টের কাজটা মেয়েদেরকেই করতে হয়।
সেইজন্যই তোমাদেরকে অনেক উঁচুতে স্থান দেয়া হয়েছে। আজও প্রতিটা সন্তানের কাছে মায়ের স্থান সবার উপরে। আমরা কোনো স্বার্থপরতা করিনি।
বাব্বাহ! তোমার সাথে কথায় কখন পারা যায়! যাও, বাজারে যাও। রান্না করতে হবে।
নাহিদ শিউলিকে কাছে টেনে নেয়। শিউলি নাহিদের বুকে মাথা রাখে পরম নির্ভরতায়। আর মাত্র কয়েকদিন। একটা অপূর্ণ আকাক্সক্ষা নিয়ে দুটি মন সুখের জাল বুনে চলে অনাগত দিনের।





 

আজ পাঁচদিন ধরে পিজি হাসপাতালে ভর্তি বকুল। শ্যামলের বন্ধুর বড় ভাই হাসপাতালের ডাক্তার, তাই ভর্তি হতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। এই টেস্ট, সেই টেস্ট! এইসব ঝামেলাও কমে গিয়েছে অনেক। প্রতিদিনই ভার্সিটির হলো থেকে শ্যামল আসে। সাত্তার মাস্টারদের সাথে অনেকক্ষণ থেকে চলে যায়। এ ক’দিনে সাত্তার মাস্টারের দুশ্চিন্তা বেড়ে গেছে অনেক। ডাক্তার বলছেন ভয়ের কিছু নেই তবুও তাঁর মন থেকে ভয়টা দূর হয়না। বেশকিছু প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা করা হয়েছে। আজ কিছু পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়া গেছে, কয়েকটি এখনো বাকি। উৎকণ্ঠা আর একটানা নির্ঘুম থাকায় সালমা বেগমের চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট।
ডাক্তারদের রুম থেকে ফিরে বকুলের মাথায় হাত রাখেন সাত্তার মাস্টার। বকুল একবার তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে থাকে। ইনজেকশন আর স্যালাইন দেয়ার জন্য বাবার উপর অভিমান হয়েছে তার।
তুমি তো এই কয়দিন একটুও ঘুমাও নাই, এখন একটু শোও। আমি ওর পাশে আছি। সালমা বেগমের উদ্দেশ্যে বলেন সাত্তার মাস্টার।
আমার ঘুম আহে না। ডাক্তাররা কী কয়? আমার বকুলের ভালো হইতে আর কয়দিন লাগবো?
মনে হয় হাসপাতালে আরও কয়েকদিন থাকন লাগবো।
ডাক্তার আমগো শ্যামলের বন্ধুর কী যেন হয়? উনি কী কন?
এহনো কিছু কইতে পারতাছে না, সব টেস্টের রিপোর্ট আসলে জানন যাইবো।
আমার আর ভালো লাগতাছে না। মাইয়াডার অবস্থা দিন দিন খারাপ হইতাছে।
বড় ডাক্তারের লগে আলাপ কইরা দেখি তিনি কী বলেন।
একটানা কয়েকদিন হাসপাতালের বেডে শুয়ে থেকে বিরক্ত বকুল। মাথার কাছে অনেকক্ষণ ধরে বাবাকে বসে থাকতে দেখে রাগ কিছুটা কমে আসে। বাড়ি ফেরার জন্য বাবাকে তাড়া দেয়।
বাবা, আমরা বাড়ি ফিরুম কবে?
এই তো মা, আর বেশিদিন না। কাইল সব রিপোর্ট হাতে পাইলে ডাক্তারের সাথে কথা কমু। তারপর আমরা বাড়ি ফিরা যামু।
কতদিন অনুরে দেখিনা! অর লইগ্যা মনডা খুব পোড়ে।
অনু তো মুক্তনগরে। আমরা বাড়ি ফিরলে ওরে আননের ব্যবস্থা করুম মা!
সাত্তার মাস্টার কোনো কিছুতে সহজে বিচলিত হন না। তবে ঢাকায় আসার পর থেকে তার মনে একটা ভয় বাসা বেঁধেছে। হাসপাতালে কত ধরনের রোগী আসে! কেউ কেউ দ্রুত ভালো হয়ে ফিরে যায়, আবার অনেকের স্থান হয় লাশঘরে। সেই শোকাবহ পরিবেশটা মন খারাপ করে দেয় সবার। গতকাল তাদের পাশের রুমে একজন রোগী মারা গেল। একটি মেয়ে, বয়স খুব বেশি না। ছোট ছোট দু’টি বাচ্চা রেখে গেছে। মেয়েটির মায়ের কী যে কান্না! সেই থেকে সালমা বেগমের মন খুব খারাপ। বকুলের জন্য দুশ্চিন্তা যেন সব সময়ের সঙ্গী। সাত্তার মাস্টারের ভয়টা অন্য জায়গায়। বকুলের ব্যাপারে ডাক্তাররা স্পষ্ট করে এখনো কিছু বলছেন না।
আজ বকুলের সব রিপোর্ট হাতে এসেছে। সাত্তার মাস্টার আর শ্যামল বসে আছে ডক্টর তুহিনের চেম্বারে। ডক্টর তুহিন নিবিড়ভাবে রিপোর্টগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। কিছুক্ষণ পর কাগজ থেকে মুখ তুলে শ্যামলের দিকে তাকায়। শ্যামল কিছু বলার আগেই সাত্তার মাস্টার বললেন,
কী দেখলেন ডাক্তারসাব? খুব খারাপ কিছু না তো?
না, খুব ভয়ের কিছু না। তবে, ওর ব্লাডে কিছুটা ত্রুটি আছে।
ব্লাডে ত্রুটি! মাস্টারসাব শ্যামলের দিকে তাকালেন।
খুব জটিল কিছু কী ভাইয়া? শ্যামল জিজ্ঞেস করে।
তোমাদের ভয়ের কিছু নাই, এটা তেমন বড় কোন সমস্যা না। শ্যামলের প্রশ্নের উত্তরে বলল ডক্টর তুহিন।
সাত্তার মাস্টার কিছুটা আশ্বস্ত হন।
ঠিক কী ধরনের ত্রুটি? শ্যামল আবার জিজ্ঞেস করে।
রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কম। অনেকেরই এ রকম হয়ে থাকে। নিয়মিত ঔষধ খেলে কোনো সমস্যা হয় না।
আইজ তিনমাস ধরেই তো ও অসুস্থ।
ওর কিছুটা রক্তশূন্যতা আছে। এই ধরনের রোগীদের নিয়মিত ট্রিটমেন্টে থাকতে হয়। দু’ব্যাগ রক্ত দিলেই ও ঠিক হয়ে যাবে।
রক্ত দিতে অইবো?
হ্যা। আপনার পরিচিত ডোনার আছে?
না। এইহানে তো আমগো পরিচিত আর কেউ নাই। সাত্তার মাস্টারের কণ্ঠে হতাশা।
রক্তের ব্যাপারে চিন্তা কইরেন না কাকা। হলো থেকেই রক্তের ব্যবস্থা করা যাবে। শ্যামল আশ্বস্ত করে। রক্তের গ্রুপ কী’?
ও পজেটিভ।
ঠিক আছে, রক্তের ব্যবস্থা আমি করছি।
কিছু মনে করবেন না, আপনার স্যারের সাথে একটু আলাপ করা যাবে? সাত্তার মাস্টারের চেহারা থেকে শঙ্কার ছাপ দূর হয় না।
ডক্টর তুহিন হাসিমুখে বলে- স্যারের সাথে আমার আগেই কথা হয়েছে। উনি এটাই সাস্পেক্ট করেছিলেন। তবে নিশ্চিত হবার জন্য পরীক্ষাগুলো করার দরকার ছিল।
ওকে আর কতদিন হাসপাতালে থাকতে হবে? শ্যামল জিজ্ঞেস করে।
রক্ত দেয়া পর্যন্তই। তারপর ওকে নিয়ে যেতে পারবে। আমরা ঔষধ লিখে দেব, নিয়মিত ওগুলো খাওয়াবে আর দু’মাস পর এসে আবার চেক-আপ করিয়ে যাবে।
ডাক্তারের রুম থেকে বেরিয়ে করিডোর ধরে হাঁটছে দু’জন। শ্যামল সাত্তার মাস্টারের মনের অবস্থা বোঝে। তাঁকে কিছুটা স্বাভাবিক করতেই সে বলে,
কাকা, চিন্তা কইরেন না। ডাক্তার যা বলল তাতে ভয়ের কিছু নাই। আশা করি রক্ত দিলেই বকুল ঠিক অইয়া যাইবো।
সাত্তার মাস্টার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, তাই যেন হয়!
রাত একটা। হাসপাতালের বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে আছেন সাত্তার মাস্টার। গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত চারপাশ। মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। বাহিরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। নীরব রাতের শহরে দূরে আবছা অন্ধকারে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো নিভু নিভু আলোয় একাকী পথিকের মতো দাঁড়িয়ে। বকুলের ব্লাডে ত্রুটি! সারাজীবন ঔষধ খেতে হবে ওকে। ডক্টর তুহিন যদিও আশ্বস্ত করেছে নিয়মিত ঔষধ খেলে ভালো থাকবে ও, তবুও সাত্তার মাস্টার শঙ্কামুক্ত হতে পারেন না। স্তব্ধ আকাশে চেয়ে দেখেন মেঘের অস্থিরতা। কাঁদে, মেঘেঢাকা আকাশ কাঁদে- অঝোর ধারায়। কখনো বেদনার রঙ ছড়ায় ক্ষতবিক্ষত মনের বিদগ্ধ অলি-গলিতে।




 

মুক্তনগরে এসে একটা নতুন জীবনের স্বাদ পেয়েছে অয়ন। এই প্রথম শ্যামলপুরের বাইরে দূরে কোথাও আসার সুযোগ ঘটলো ওর। এখানে শ্যামলপুরের মতো সবুজ বনানী নেই, খোলা প্রান্তর নেই, খাল-বিল-পুকুর নেই; তবে বড়দি আছে। কতদিন পর বড়দিকে দেখলো ও! এক বছরেরও বেশি সময় পর ছোট ভাইটির মুখ দেখে শিউলিও ভীষণ খুশি।
তুই তো অনেক বড় হয়ে গেছিস রে অনু!
বড়দি জানো, আমি এহন নৌকা চালাইতে পারি; গাছেও উঠতে পারি।
তাইলে তো আমার ভাইটা সত্যি সত্যিই বড় হয়ে গেছে।
ছোটদি আমারে একলা কোত্থাও যাইতে দেয়না। অয়নের কণ্ঠে অভিযোগ।
তাই? বকুল কেমন আছে রে অনু?
অয়নের মুখের হাসি মুছে যায়।
ছোটদি ভালো নাই, বড়দি। অর খালি জ্বর আহে। একলা একলা বইয়া থাকে; বেশিক্ষণ হাঁটতে পারে না।
শিউলির খুব মন খারাপ হয়। ‘কবে যে আবার ওর সাথে দেখা হবে!’
দীর্ঘদিন পর রাতে ঘরে ফিরে মাকে দেখতে পায় নাহিদ। মাকে কাছে পেয়ে অন্যরকম এক প্রশান্তি আসে মনে। পাশে বসে কুশল জিজ্ঞেস করে। পথে আসতে কোনো কষ্ট হয়েছে কিনা, খাওয়া দাওয়া ঠিকমত হয়েছে কিনা। একটার পর একটা প্রশ্ন শুনে মা হাসেন।
পাগল ছেলে। এইটুকুন পথ আইতে আবার কষ্ট কী?
ছেলেকে দেখে মায়েরও আফসোস হয়। তুই ক্যামন শুকাইয়ে গ্যাছিস বাবা; অনেক কষ্ট অয় বুঝি?
মা-ছেলের কথোপকথন শুনে শিউলি কাছে আসে। অভিমানী কণ্ঠে শাশুড়ির উদ্দেশ্যে বলে,
, ছেলেই তো শুধু আপন, বউ কী আর এমন আপন হয়!
ছেলের বউয়ের অভিমান ভাঙাতে শাশুড়ি সাথে সাথেই বলে ওঠেন,
দ্যাখো মাইয়ার কা-। বউরে দ্যাখতেই তো এতদূর আইলাম।
শিউলি হেসে শাশুড়ির কাছে এসে বসে। নাহিদের উদ্দেশ্যে মা বলেন,
আমি তো কয়েক দিনের মধ্যেই চইলা যামু; তোর একটা মা অইলেই ভালো অয়।
এতো তাড়াতাড়ি তুমি কোথায় যাবে? এখানে কয়েকমাস থেকে তবেই বাড়ি যাওয়ার কথা বলবে।
তাই কী অয় রে বাপ! তোর বাবা, শিপন, দীপা- ওগোরে দ্যাখবো কেডা?
ওরা বড় হয়েছে, এখন কিছুদিন নিজেরাই নিজেদেরকে সামলাক। তোমার এত শীঘ্রই বাড়ি ফেরা হচ্ছে না। নাহিদ তার দাবিতে অনড়।
বাবা, নাতির মুখ দ্যাখতে আর কয়দিন বাকি? মা কথা ঘুরিয়ে দেন।
তিনদিন পর ডেট। তবে ডাক্তার বলেছে ভর্তির জন্য প্রস্তুত থাকতে। যে কোনদিন ভর্তি হওয়া লাগতে পারে।
মা-ছেলে, ছেলেবউয়ের আনন্দ-অভিমানের পালা শেষ হলে একমাত্র শালাবাবুর সাথে হাসি-ঠাট্টায় মেতে ওঠে নাহিদ। অয়ন লজ্জা পায়। অনেকদিন পর দেখা হওয়ায় নাহিদের সাথে স্বাভাবিক হতে পারে না। নাহিদ শিপনকে ডেকে বারান্দায় নিয়ে বকুলের অসুখের কথা জানতে চায়। ঢাকা নিয়ে যাবার প্রয়োজন হলো কেন, শিপন কিছু জানে কী না! শিপন তেমন কিছু বলতে পারে না।
রাতের খাবার শেষে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। শিউলির ঘুম আসে না। পাশ ফিরে শুয়ে আছে নাহিদ। শিউলি জানালার পাশে বসে বাইরে তাকিয়ে থাকে। বকুলের মুখটা চোখে ভাসে। অয়ন কিছু বলতে না পারলেও বকুলকে ঢাকা নিয়ে যাওয়ার কথা শুনে শিউলির মনটা খুব অস্থির হয়ে আছে। আজ আকাশে মেঘ নেই। অন্ধকার কেটে গিয়ে চাঁদ উঠেছে; চমৎকার ফকফকে জোছনা। পূর্ণ চাঁদের আলোয় আজকের রাতটা বড়ই মায়াময়। এই অপার্থিব আলোয় পৃথিবীর সব পঙ্কিলতা ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাক এমনটাই তার সবসময়ের চাওয়া; তবে আজ আকাশ জুড়ে এমন আলোকিত জোছনা বড্ড বেশি অসহ্য লাগে শিউলির।
রাত দশটা। হাসপাতালের সফেদ-শুভ্র বিছানায় বসে আছে শিউলি। আজ বিকেলেই তাকে ভর্তি করা হয়েছে। কিছুক্ষণ পর পর নার্স আর ডিউটি ডক্টর এসে দেখে যাচ্ছে। চেম্বারে রুগী দেখা শেষ করে ডক্টর কোহিনূর আসবেন রাতে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রুম, তবুও হাসপাতালের গন্ধটা সবসময়ই বিদঘুটে লাগে শিউলির। নাহিদ এসে পাশে বসে। শিউলিকে দেখে মনে হয় ও প্রচ- নার্ভাস।
ভয় লাগছে?
শিউলি মাথা নাড়ে।
ভয়ের কিছু নেই, প্রতিদিন কত ডেলিভারি হচ্ছে!
তবুও।
শিউলির দু’চোখে জল। তার হাতে হাত রাখে নাহিদ।
মাত্র তো কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার। কালকেই দেখবে সুস্থ্ হয়ে উঠেছ।
মাকে খুব মনে পড়ছে। বকুলের কী অবস্থা কে জানে।
নাহিদ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। ঢাকার কোনো খবর এখনো পায়নি। শিউলিকে সান্ত¡না দিতে বলে,
চিন্তা করোনা, সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমার এই অসুখের সময়ও বাবা-মা আসলো না, অয়নকে এখানে পাঠিয়ে দিয়ে বকুলকে নিয়া ঢাকায় গেলো, ওর খুব খারাপ কিছু হয়নাই তো? আমার কিছু ভালো লাগছে না। সত্যি করে বলো, বাবা তোমাকে কোনো কিছু জানাইছে?
না। আমাকে জানালে তো তুমি জানতে।
তবুও, আমি কিছুতেই শান্তি পাচ্ছি না।
এই সময় তুমি অস্থির হয়ো না, এটা তোমার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
শিউলি আর কিছু বলে না। কেবল একটা ভয় বুকের ভিতরে জমাট বেঁধে থাকে।
রাত্রির শেষ প্রহর। হাসপাতালের লেবার রুমের সামনে অপেক্ষা করছে নাহিদ আর শিপন। রাত এগারোটায় শিউলিকে এখানে আনা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো খবর আসেনি। নাহিদের চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। ছোট্ট করিডোর জুড়ে পায়চারি করে। কিছুক্ষণ পর পরই শিপনকে বলে খবর নেয়ার জন্য। মাঝে মধ্যে রুমে গিয়ে মাকে দেখে আসে। মা জায়নামাজে বসে তসবি জপছেন। পাশের বেডে ঘুমিয়ে পড়েছে অয়ন। ছেলের অস্থিরতা দেখে মা বলে ওঠেন,
তুই শান্ত হ বাজান। সময় অইলেই মুশকিল আছান অইবো।
আমার ভয় লাগছে মা। রাত এগারোটায় ওকে নিয়ে গেছে আর এখন ভোর হতে চলল।
সব ওপরওয়ালার ইচ্ছা। উনি যহন চাইবেন ক্যাবল তহনই অইবো। মানুষের সাধ্য কি!
মা নাহিদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। নাহিদ ধীরে-ধীরে এগিয়ে যায় লেবার রুমের দিকে।
আবার অপেক্ষা। ঢুলু ঢুলু চোখে বসে থাকে দু’জনে।
হঠাৎ শিউলির নাম শুনে ঘুরে তাকালো নাহিদ। মাঝবয়সী একজন মহিলা লেবার রুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। তার দু’হাতের মাঝে সাদা তোয়ালে জড়ানো একটা পুটুলি। নাহিদ ছুটে যায় সেদিকে।
আপনার মেয়ে হইছে, বকশিশ দেন।
সদ্যজাত ফুটফুটে শিশুটির দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে নাহিদ। তোয়ালে জড়ানো শিশুটিকে কোলে তুলে নেয়। মুহূর্তেই মনে হয় এক অমূল্য সম্পদ তার হাতের মুঠোয়। তখনই বাইরের মসজিদ থেকে ভেসে আসে ফজরের আযান।

  


 

বেশ কিছুদিন নির্বিঘ্নে কেটে যায়। রাত জেগে পাহারা দেয়াও বন্ধ হয়েছে ক’দিন হল। কলাবতী বাজারে হরিপদ ঘোষের দোকানে নিত্যদিনের কর্মকা- শুরু হয়েছে আগের মতোই। পুকুরের পানি বিষমুক্ত করে নতুন করে আবার মাছ ছেড়েছে তারাপদ। পরিষ্কার স্বচ্ছ পানিতে ছোট ছোট পোনা-মাছগুলো সাঁতরে বেড়ায়। সুবল ঘাটের উপর বসে দেখে ঝাঁকে ঝাঁকে ছোট মাছ ঘাটের কাছে পানির উপরে ভেসে ওঠে, হাত বাড়ালেই টুপ করে পালিয়ে যায়। বিজয়া-সুরবালার মনে যেন শান্তি ফিরে আসে।
একদিন হঠাৎ ঘটনাটি ঘটলো। সবাই বোঝে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে কাজটি করা হয়েছে। যতটা না আর্থিক ক্ষতি, তারচেয়ে অনেক বেশি মানসিকভাবে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করাই যেন এর লক্ষ্য। খালপাড়ের কালীখোলায় সন্ধ্যাপূজা দেবার জন্য ম-পের সামনে গিয়েই বিজয়ার চক্ষুস্থির! ম-পের সবগুলো মূর্তি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অবস্থা দেখে নিশ্চল পাথরের মতো অনেকক্ষণ বিমূঢ় হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকে সে। 
বাড়ির সবাইকে সারাক্ষণ হাসি-আনন্দে মাতিয়ে রাখে যে বিজয়া, আজ তার মনের মধ্যে কান্নার ঢেউ ওঠে। এতদিন শক্ত মনের মানুষ বলে যাকে জানতো সবাই, নানা বিরূপ পরিস্থিতিতে তারাপদ, সুরবালাকে সান্ত¡না দিয়েছে, বিপদে সাহস যুগিয়েছে যে বিজয়া- কেউ দেখতে পায়না অপ্রত্যাশিত ঝড়ে আজ এই নির্জন সন্ধ্যায় তার ভেতরটা এলোমেলো হয়ে যায়।
ঈশান কোণে পুঞ্জীভূত মেঘ আরও গাঢ় হয়ে আসে। যে কোনো মুহূর্তে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামবে। বিজয়ার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। চারিদিক থেকে অন্ধকারের আবরণটাকে এগিয়ে আসতে দেখে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। কোটাখালী ব্রিজের পাড়ে পৌছুতেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে। আষাঢ়ের অঝোর ধারার বৃষ্টির সাথে বিজয়ার চোখের জল মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। কোটাখালী খালের দিক থেকে বয়ে আসা হিমেল হাওয়া ভেজা শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দেয়।  
হরিপদ ঠিক করেন আজকের ঘটনা নিয়ে কাউকে কিছু বলবেন না।
তারাপদ একবার জিজ্ঞেস করেÑ কী কও দাদা! কাউরে কিছু জানাইবা না?
জানাইয়া কী অইবো? প্রতিমা কেডা ভাঙছে তার কোন প্রমাণ আছে? প্রমাণ ছাড়া কারে ধরবি? হুদাহুদাই মানুষজনরে আর বিরক্ত করা ক্যান?
তাইলে এইভাবে সবকিছু মুখ বুইজ্যা সহ্য করতে কও?
তুই ছোডকাকু আর দেবুরে চিঠি লেইখ্যা দে। দেবুরে ঐ-পাড়ের অবস্থা জানাইতে ক’। দরকার অইলে সবকিছু বেইচ্যা চইলা যামু।
চমকে ওঠে তারাপদ। ঘুরে ভাইয়ের গম্ভীর চেহারার দিকে তাকায়। হরিপদর কোনো ভাবান্তর নেই।
-চইলা যামু! কী কইতাছ দাদা?
হরিপদ ভাবলেশহীনভাবে বলেন- হ, আর মায়া বাড়াইয়া লাভ নাই। তারপর কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা ঘরের ভিতরে চলে যান।
তারাপদ আর কিছু বলতে পারে না। শ্যামলপুরের সাথে হরিপদর বন্ধন জন্ম-জন্মান্তরের। শত ঝড় ঝাপটার মধ্যেও কখনো মনে হয়নি এ বন্ধনে সামান্যতম ছেঁদ পড়তে পারে। আজ এত বছর পরে মনে হচ্ছে এ বন্ধন যেন একটু একটু করে আলগা হয়ে আসছে।
পেছনে দিকে তাকিয়ে দেখে সুরবালা-বিজয়া দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে। সুরবালার চোখের কোণে জল ছলছল করে। বিজয়া স্থির। এতক্ষণ হরিপদ-তারাপদর কথোপকথনে তার মধ্যে যেন কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।
বৌদি, তুমি হুনছো দাদা কী কইলো? নিজেদের পূর্বপুরুষের ভিটা ছাইড়া কই যামু আমরা? তারাপদর কণ্ঠে আকুতি।  
সুরবালার মুখে কোনো কথা সরে না। বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে। অর্থহীন তাকিয়ে থাকা। হরিপদর শেষ কথাগুলো মনে ভাসে শুধু ‘দরকার অইলে সবকিছু বেইচ্যা চইলা যামু’। এই মানুষটার সাথে দুই যুগের বেশি সময় ধরে জড়িয়ে আছে সে। এই দেশ, এই মাটির প্রতি মানুষটির মনে যে ভালোবাসা এতোটা কাল ধরে সে দেখেছে, মাঝে মাঝে মনে হত নিজের ছেলেমেয়েদের চেয়েও এই দেশটাকে বেশি ভালোবাসেন। আজ সেই হরিপদ অবলীলায় বলে ফেললেন- এ দেশ ছেড়ে চলে যাবেন তিনি!  
তারাপদর মন উতলা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এতটা ভেঙে পড়েনি সে। একাত্তরে সিরু তালুকদারের শত হুমকি স্বত্ত্বেও যে দাদা দেশত্যাগ না করার সংকল্পে অটল ছিলেন, ছোটকাকার আকুতিকে উপেক্ষা করে মাটি কামড়ে পড়ে রইলেন, আজ সেই দাদা দেশ ছেড়ে যাবার কথা বলছেন! ঘরের সিঁড়িতে থম মেরে বসে থাকে তারাপদ। রাত্রির গাঢ় অন্ধকারে কত কথা মনে ভিড় করে! বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষের ভিটা; যার প্রতিটি কোণে কোণে ছড়িয়ে আছে হাজারো স্মৃতি। এদের ছেড়ে কোথায় যাবে সে? তারাপদ দিব্যিচোখে দেখতে পায় তার অতিপ্রিয় এ বাড়িটা জনশূন্য; উঠোনে, এখানে-ওখানে আগাছার জঙ্গলে ভরা। বুকের ভেতরটা হু-হু করে ওঠে। মনে মনে বলে- না না, দাদাকে যে করেই হোক থামাতে হবে, এ বাড়ি ছেড়ে সে কোথাও যাবে না।
বিজয়া এসে সিঁড়িতে চুপচাপ বসে থাকে। আশ্চর্যরকম নির্লিপ্ত। তারাপদর কাছে এই বিজয়াকে অচেনা লাগে। মনে হয় অনেক দূরের মানুষ। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বিজয়া যেন আমূল বদলে গেছে। তারাপদ বিজয়ার মনের নাগাল পায় না।
আজ দুইদিন হলো গায়ে এসেছে শ্যামল আর তাপস। শ্যামলপুরে এতোকিছু ঘটে গেলো অথচ তারা কিছুই জানতে পারলো না! খুব আফসোস হয়। হরিপদ আর তারাপদর উপর রাগও হয়। হরিপদকে কিছু বলতে না পারলেও তারাপদর কাছে অভিযোগ জানাতে ভোলে না। দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত কিছুতেই মেনে নিতে পারে না শ্যামল।
এই ঘটনার জন্য তোমরা দেশ ছাইড়া চইলা যাবার মতো সিদ্ধান্ত নিয়া ফেললা কাকু?
ব্যাপারটা আসলে তা না রে বাপ! এই ঘটনাগুলান তো একটা উপলক্ষ মাত্র। আমরা তো এই দেশেরই মানুষ, বাপ-দাদা চৌদ্দপুরুষের ভিটামাটির প্রতি তোর বাপেরও তো মায়া কম না। এই দেশ, এই মাটির লাইগা আমগোও পরাণ কান্দে। কিন্তু কিছু মানুষ সংখ্যালঘু হিসেবে আমগো দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক মনে করে, আমগো উপর ওদের অধিকার ফলাইতে চায়Ñ এইডা কী মাইনা লওন যায়!
এইডা তো সামান্য কিছু মানুষের কথা। এই ধরনের মানুষ আগেও ছিল এখনো আছে। এদের জন্য আমরা দেশত্যাগ কইরা চইলা যামু ক্যান?
আমার তো এই শ্যামলপুর ছাইড়া কোত্থাও যাইতে মন চায় না। কিন্তু তোর বাপেই তো এহন মানতে চাইতাছে না। তোরা দুই ভাই দাদারে বুঝা।
হরিপদর চিঠির জবাব আসে মাসখানেক পরে। যতটা আগ্রহ নিয়ে তিনি চিঠি পাঠিয়েছিলেন আজ সেই চিঠির উত্তর আসার পর দেশত্যাগের আশংকায় তাঁর বুকের ভেতর একটা বিসর্জনের সুর বেজে ওঠে। নিতান্ত অনিচ্ছায় খামটি খোলেন। চিঠি পড়ার পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। পাশে থেকে তারাপদ বলে,
দাদা, কী লিখছে দেবু?
চিঠিটা তারাপদর দিকে এগিয়ে দেন হরিপদ।
এহন কী করবা? চিঠি পড়া শেষ করে জানতে চায় তারাপদ।
দেখি। দায়সারা জবাব হরিপদর।
হরিপদ উঠে চলে যান। তারাপদ তাঁর প্রস্থানপথের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাইয়ের মনের অবস্থা সে বোঝে। এই বাড়ি হরিপদর মনের কতটা জুড়ে আছে তা তারাপদ ছাড়া ভালো আর কে জানে
তারাপদ মনেপ্রাণে চায় দাদা যেন চলে যাওয়ার ইচ্ছেটা মন থেকে দূর করে দেয়। যদিও বেশ কিছুদিন ধরে সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলছে। শ্যামল-তাপস ক্লাবের ছেলেদের নিয়ে নিয়মিত পাহারার ব্যবস্থা করেছে। তারাপদ ভাবছে, ওদের তো শহরে চলে যেতে হবে, ক্লাবের ছেলেরা কতদিন পাহারা দেবে? তারপর? ঐ শয়তানগুলোর মনোভাব বোঝা বড় দুষ্কর। আবার কিছু ঘটলে দাদাকে দমিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।
কালীখোলায় প্রতিমাগুলো স্থাপন করার কাজ শেষ করে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো শ্যামল। হঠাৎ শিখার কণ্ঠ শুনে পেছনে ফিরে তাকায়।
কখন আইছোস?
অনেকক্ষণ।
এতোক্ষণ কতা কস নাই ক্যান?
তোমার কাম দ্যাখতাছিলাম।
শ্যামল শিখাকে দেখে। প্রতিমার দিকে কেমন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শিখা।
কী রে, তোর কী মন খারাপ?
নাহ! মন খারাপ কইরা আর কী অইবো? আচ্ছা শ্যামলদা, তোমরা কী সত্যি সত্যিই চইলা যাইবা?
কে কইলো তোরে?
অনেকেই তো কয়। হেইদিন বাবায়ও খুব মন খারাপ কইরা কইতেছিলো।
শ্যামল কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। হঠাৎ শিখার হাত ধরে বলে,
যদি চইলা যাই তুই আমার লগে যাবি?
আমি ক্যামনে যামু? আমার হেই শক্তি কই? তোমরা পুরুষ-মানুষেরা যহন যেহানে খুশি চইলা যাইতে পারো, আমরা মেয়েরা হইলাম খাঁচায় বন্দী পাখি; সেটা বাপের বাড়ি অথবা পরের বাড়িতেই হোউক।
শোন, তোর ভয় নাই। এই দেশ ছাইড়া আমি কোত্থাও যাইতাছি না। যত কিছুই ঘটুক।
শিখা শ্যামলের চোখেমুখে অন্যরকম এক দীপ্তি খুঁজে পায়। ওর কেবলই মনে হয়, যেমন করেই হোক শ্যামল তার প্রতিজ্ঞা রাখবেই।




 

এতো বড় বাড়িতে সারাদিন একলা-একা ভালো লাগে না মন্টুর। এ বাড়িতে আসার পর বুজি, বকুল আর অয়নকে ছেড়ে মন্টু একা থাকেনি কখনো। সারাদিন কাজের মাঝে সময়টা কেটে গেলেও রাত্রিগুলো একেকটা অসহ্য লাগে। একা ঘরে ঘুম আসে না। নিঃসঙ্গ বাড়িতে নিজের জীবনের পুরনো দিনগুলো উঁকি দেয় প্রায়ই। চিরদিন নিজের দুঃখ-কষ্টগুলো আড়ালেই রেখে দিয়েছিলো মন্টু। স্ত্রী গত হয়েছে সেই কবে! ইদানীং তার স্মৃতিগুলো প্রায়ই জেগে ওঠে মনে, কষ্ট দেয়।
ঘরের পাশের বাগানে দৌড়ঝাঁপের শব্দ শুনে কান পাতে মন্টু। এখন কোনো সাড়াশব্দ নেই। একাই হাসে। সে এত ভাবছে কেন? বেজি কিংবা শেয়াল হবে হয়তো! কী আসে যায়? ওদের কাজ ওরা করুক। কিছুক্ষণ কেটে যায়, চারিদিকে সুনসান নীরবতা। কেবল ঝিঁঝিঁপোকার ডাক, পাতা ঝরার শব্দ ভেসে আসছে। আবার ভাবনায় ডুবে যায় সে। কত কথা মনে পড়ে! নিজের বলতে কিছুই নেই তার, ছিলও না। হ্যাঁ, কেবল একজন ছিল, মাত্র কিছু কালের জন্য। জীবনে কোনো কিছুর অভাব বোধ করেনি কোনোদিন। না খাওয়া-পরা, না পোশাক-আশাক; কেবল একটা অভাব তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। সালেহা মারা যাবার পর আর থিতু হওয়া হলো না। সারাদিন বুজি, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সময়টা ভালোই কেটে যায়, রাত হলেই ঘিরে ধরে নিঃসঙ্গতা। মনের দিক থেকেও সে একা, ভীষণ একা। রেডিওটা সময় কাটানোর একটা উছিলা মাত্র। নিঝুম অন্ধকারের মধ্যে একেকটা প্রহর কেটে যায়। নিজের মনের কথা শেয়ার করার মতো কেউ নেই তার। প্রায়ই সালেহার কথা মনে পড়ে, এই এখন যেমন!
মন্টু চৌকির নিচ থেকে টিনের বাক্সটা বের করে আনে। অনেকদিন পর এটা খুলল। পকেটে হাত দিতেই বেরিয়ে আসে পুরনো আনকোরা একটা খাম। সেখান থেকে সযতেœ বের করে আনে ছবিটা। ঘোলাটে হয়ে যাওয়া সাদাকালো একটা ছবি। পুকুর পাড়ে চালতা গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে হাসছে সালেহা। ঝাপসা হয়ে গেলেও হাসিটা এখনো অম্লান। আজ প্রায় দশ বছর ধরে মন্টুর মনে স্থায়ী হয়ে আছে এই ছবি। কতবার যে বের করে দেখেছে! বিয়ের পর বুবুর এক আত্মীয় তুলে দিয়েছিলো। সালেহা মারা যাবার পর মন্টু ছবিটা অনেক যতœ করে রেখে দিয়েছে।
মন্টু তাকিয়ে থাকে ছবিটির দিকে। কত স্মৃতি মনে পড়ে! হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল মানুষটা হঠাৎই চলে গেলো। আগের রাতেও যে ছিল তার সুখ দুঃখের সাথী, সকাল হতেই বিস্বাদে আঁকা ছবি। বুকের মাঝে তখনও দগদগে ঘা। ইয়ার দোস্তরা অনেকে বলতো- ‘পুরুষ মানুষ, বউ মরলে এত ভাইঙা পড়ে? কিছুদিন গেলে আরেকটা বিয়ে কইরা ফালাইবি।’ মন্টু পারেনি। সালেহার মুখটা ভুলতে পারেনি সে। সারাদিন এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতো, কোনো কাজে মন ছিল না। কিছুদিন পর চাচাজি পাঠিয়ে দিলেন বুজি’র কাছে। সেই যে এ বাড়িতে এসে উঠেছিলো, আর ওমুখো হয়নি। কেবলই মনে হতো ওখানে গেলে সালেহার স্মৃতি তাকে তাড়িয়ে বেড়াবে। মন্টু তাই পালিয়ে বাঁচে। নিজের কাছ থেকে পালায়, সময়ের কাছ থেকে পালায়। নিজের যাবতীয় দুঃখবোধ লুকিয়ে রাখে হাসির আড়ালে। কাজের কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে ভুলে থাকে সবকিছু। কেবল সন্ধ্যা হলে অবচেতনে প্রায়ই সালেহার মুখটা মনে পড়ে। বুকটা পোড়ে, কখনো চোখে ভাসে সবার অলক্ষ্যে। বুজি মাঝে মধ্যেই লক্ষ করে, মন্টু তাও বোঝে। বুজি আবার বিয়ে দিতে চেয়েছিল মন্টুর। রাজি হয়নি সে। নতুন করে জীবন গড়া আর হলো না। কী হবে এই পড়ন্ত বেলায় এসব ভেবে? এখন এই বাড়িটাই যেন নিজের বাড়ি। বকুল, অয়নও মন্টু মামা ছাড়া যেন কিছু বোঝে না। তাই ওদের সুখের মাঝে নিজের সুখ-শান্তি খুঁজে ফেরে মন্টু।
ভাবতে ভাবতে কখন যে দু'চোখে জল জমে বুঝতে পারে না মন্টু। চোখ মোছে না সে। আজ আর কান্না লুকানোর দরকার নেই। মন্টু উপলব্ধি করে পৃথিবীটা বড় কঠিন জায়গা। মায়া-মমতা ভালোবাসা কী গভীর বন্ধনে জড়িয়ে ফেলে! হাজার চেষ্টা করেও মুক্তি মেলে না।
আজ এই নিঝুম রাত্রির নিসঙ্গবেলায় বকুলের মুখটা ভেসে ওঠে মনে। মনে মনে প্রার্থনা করে বকুল যেন দ্রুত ভালো হয়ে ওঠে। ভাবতে ভাবতেই একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। 
দাদা, ও দাদা! ঘরে আছো?
গোপালের ডাক শুনে বাইরে বেরিয়ে আসে মন্টু।
কী রে গোপাল, এত বিহানে তুই!
বড়কর্তা পাডাইলেন। মাস্টারসাবের খবর নেওয়ার লইগ্যা।
হেরা তো এহনো ফিরে নাই।
তারা কবে আইবো দাদা?
তা তো কইতে পারুম না রে গোপাল।
ও। 
গোপাল, হুনলাম তোগো কালীখোলার মূর্তি কারা নাকি ভাইঙা ফেলাইছে?
হ। কেডা ভাঙতে পারে বোঝো না?
বুঝি তো, কিন্তু আমগো বুঝ-অবুঝে কার কী আয়-যায়? মাস্টারসাব তো গ্রামে নাই, চেয়ারম্যান সাবরে জানাইছো?
নাহ। বড়কর্তা কইছে, কাউরে জানাইবো না।
ক্যান? জানাইবো না ক্যান?
জানাইয়া কী অইবো? কোনো বিচার অইবো?
ক্যান? বিচার অইবো না ক্যান?
গোপাল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে- অয়না রে দাদা। সবাই প্রমাণ চায়। কর্তাগো মন ভালো নাই। কহন যে কী করে জানি না।
আমারও মনডা ভালো নাই রে গোপাল।
ক্যান দাদা, তোমার আবার কী অইলো?
আইজ কতদিন অইয়া গ্যালো আমগো বকুলের কোনো খবর পাইলাম না। মাস্টারসাবরা যে কবে আইবো!
চিন্তা কইরো না, সব ঠিক অইয়া যাইবো। আইচ্ছা যাই দাদা, মাস্টারসাব আইলে কষ্ট কইরা একটু জানাইও।
গোপাল চলে গেলে মন্টু আবার সিঁড়িতে বসে থাকে একাকী। গোপালের কথার অর্থ সে বোঝে। বোঝে ওদের অসহায়ত্ব। ওদের মনের এই ক্ষোভ তো একদিনে তৈরি হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের অস্তিত্বের উপরে আঘাত হলে মানুষের মন এমন বিক্ষুব্ধ হতে বাধ্য। কিন্তু এই ছাপোষা আশ্রিত মন্টুর কি-ই বা করার আছে।
দশদিন পর বাড়ি ফিরে আসলেন সাত্তার মাস্টার। আজ সারাদিন ঘর থেকে বের হননি। এ ক’দিন শরীর ও মনের উপর খুব চাপ গেছে। এখন অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হলেও নতুন করে একটা দুশ্চিন্তা যোগ হয়েছে। দুই মাস পর বকুলকে ঢাকা নিয়ে যেতে হবে। আবার সেই পরীক্ষা!
হরিপদ’র কালীখোলায় মূর্তি ভাঙার খবর শুনে মেজাজ খিচড়ে আছে। সাত্তার মাস্টারের বুঝতে বাকি থাকে না এটা কার কাজ এবং কী উদ্দেশ্যে করা হয়েছে তিনি অনুভব করেনÑ ইদানীং খালেক-হারুদের দৌরাত্ম আবার বেড়েছে। এখনই শক্ত হাতে এই অপশক্তিকে রুখতে না পারলে ভবিষ্যতে নিজেদের অস্তিত্ব আরও বিপন্ন হবে। খুব দ্রুত এর একটা সুরাহা হওয়া দরকার। হরিপদ ঘোষকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে ঘরের বাইরের সিঁড়িতে বসলেন তিনি। তার পাশেই এসে বসেন হরিপদ ঘোষ। বকুলের খোঁজ খবর নেন।
বুঝলা মাস্টার, যতই পরিবর্তন হউক আমগো দিন খুব একটা বদলাইবো না।
হরি, নিজেরে শক্ত কর। এইগুলানরে রুখতেই অইবো। আমি আইজই সাঈদ খা’র লগে কতা কমু।
সাঈদ খা কী করবো? ক্যামনে প্রমাণ করুম এইডা কার কাম?
এই প্রমাণ প্রমাণ কইরা চুপ কইরা থাকলে অগো সাহস আরও বাইড়া যাইবো। 
হরিপদ সাত্তার মাস্টারের হাত ধরে বলে- তোমারে অনেক কষ্ট দিছি মাস্টার। হেই যুদ্ধের সময় থেইক্ক্যা তুমি আমগো লইগ্যা কম কর নাই। আর কত জ্বালামু তোমারে? থাউক মাস্টার, তুমি আর কাউরে কিছু কইও না।
তুমি নিজেরে গুটাইয়া নিতাছো হরি? কিন্তু এই যুদ্ধটা তোমার একলার না। তুমি যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যখানে আছো তাই মনে অইতাছে তুমি এর একমাত্র লক্ষ্যবস্তু, এইটাই যা পার্থক্য। মনে রাইখো, তোমার হার মানে আমগো সবার হার। মিথ্যার কাছে সত্যর হার। তোমারে আইজ কইতাছি, আমি এর শ্যাষ দেইখ্যা ছাড়ুম।
বাড়ি ফিরে বকুল আবার চুপচাপ হয়ে গেল। সারাক্ষণ মনমরা হয়ে বসে থাকে। আগের মতো জ্বরটা যদিও আসে না, তবে শরীর এখনো বেশ দুর্বল। এখন বর্ষাকাল। সারাদিন ঝরঝর ঝরে। বকুল বারান্দার জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। উঠানে পানি জমেছে অনেক। সজনেতলা ছাড়িয়ে বকুলের দৃষ্টি চলে যায় পুকুরের দিকে। পুকুরটা কানায় কানায় ভরা। বকুল মনে মনে ভাবে, অনু না থাকায় বাড়িটা কেমন খা-খা করছে। বাড়ি থাকলে নিশ্চয়ই ওকে বলতো, ‘ছোটদি ল বৃষ্টিতে ভিজি’। বকুলের হঠাৎ হাসি পায়। ছোট ভাইটি কাছে না থাকায় মন খারাপও লাগে।
বাবার কাছে শুনেছে বড়দি’র মেয়ে হয়েছে। বকুলের খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে বড়দি’র মেয়েটা কেমন হয়েছে দেখতে। বড়দি’র মতো সুন্দর হলে খুব খুশি হবে ও। মা বলেছিল, বাবা কয়েকদিনের মধ্যেই মুক্তনগর যাবেন। বকুলের খুব যেতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু ডাক্তার বলেছে এখন ওর পূর্ণ বিশ্রাম দরকার। অনুটা ফিরে আসলে বড়দি’র খবর জানা যেতো। কবে যে ও আসবে!
বাড়িতে এসেই মায়ের ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেল আবার। মায়ের যেন কোনো ক্লান্তি নেই। গত দশদিন ধরে হাসপাতালে প্রায় নির্ঘুম রাত-দিন পার করেছেন তিনি। এ ক’দিনে মায়ের মুখে হাসি দেখেনি বকুল। শুধু চোখের পানি দেখেছে।
সালমা বেগম সবসময় টিপটপ থাকতে পছন্দ করেন। বাড়ি ফিরেই কয়েকদিনের অগোছালো ঘর গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এটা-ওটার জন্য মন্টুকে বকাঝকা চলছেই। মন্টু দূরে দাঁড়িয়ে হাসে। কিছুক্ষণ পর বোনের উদ্দেশ্যে বলে- বুজি, আপনে বাড়ি না থাকলে আমার সবকিছু আউলা-ঝাউলা অইয়া যায়। মন্টুর হাসি দেখে তার উপর বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারেন না সালমা বেগম।




 

দীর্ঘ পথ ভ্রমণ শেষে অয়নদের বাস যখন মধুপুর বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছাল সূর্যটা ততক্ষণে পশ্চিম আকাশের অনেক নিচে নেমে এসেছে। এখান থেকে কলাবতী বাজার খুব বেশি দূর নয়। মাত্র ছয় মাইল, রিক্সার পথ। অয়ন বাড়ি ফেরার আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। মুক্তনগর থেকে ভ্রমণের সারাটা সময় নতুন এডভেঞ্চারের আনন্দে আচ্ছন্ন থেকেছে, আর এটা ওটা প্রশ্ন করে শিপনকে প্রায় অস্থির করে তুলেছিলো।
মধুপুর ছেড়ে কলাবতী বাজারের দিকে এগিয়ে চলেছে ওদের রিক্সা। বাজারের কাছাকাছি আসতেই অয়ন বিজয় পুলটা খোঁজে। আরেকটু এগিয়ে বাঁক ঘুরতেই পুলটা চোখে পড়ে ওর। মন্টু মামা ব্রিজের গোঁড়ায় দাঁড়িয়ে। ওখানেই রিক্সা থামিয়ে নেমে পড়ে। অয়ন দৌড়ে এসে মন্টু মামাকে জড়িয়ে ধরে।
কেমন আছো মামা?
ভালো। তুমি ভালো আছো মামা?
হ। 
ওরা ব্রিজের পাশ দিয়ে ছুটে চলা কাঁচা রাস্তা ধরে শ্যামলপুরে ঢুকে পড়ে। অয়ন অনর্গল মুক্তনগরের গল্প করে যায় মন্টু মামার সাথে। মন্টু হাসে।
মামা জানো? বড়দি’র বাবুটা কী সুন্দর হইছে!    
হাছাই? কার মতোন দেখতে হইছে?
এক্কেবারে বড়দি’র মতোন। কেমন বড় বড় চোখে তাকাইয়া থাকে। আবার হাসেও।
মন্টু অয়নের উচ্ছ্বাস দেখে মজা পায় খুব। অয়নের মুখে যেন খই ফোটে।
এ কয়দিন বড়দির ঐহানে খুব মজা হইছে। বাবা-মা যায় নাই, তাই বড়দি খুব মন খারাপ করছে। ছোটদির অসুখের কথা শুইনাও খুব কানছে। ছোটদি কেমন আছে মামা? এতোদিন আমার কথা খুব মনে করছে, না?
ছোটদি আসার পর থেইক্ক্যা তো খালি তোমার কতাই কয়। তুমি বাড়ি নাই দেইখ্যা তার মন খুব খারাপ।
আমারও তো ছোটদি’র লইগ্যা অনেক খারাপ লাগতেছিলো।
শ্যামলপুর হাইস্কুলের কাছাকাছি আসতেই অয়নের মনে হলো নিজের গ-ির মধ্যে প্রবেশ করেছে। স্কুলটা ফাঁকা পড়ে আছে। আর কয়েকদিন পরই খুলবে। কতদিন পর বন্ধুদের সাথে দেখা হবে আবার!
সন্ধ্যা হয় হয়। তিনজন বড় রাস্তা থেকে অয়নদের বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে। বাড়ির রাস্তায় মাথা থেকেই চোখে পড়ে পুকুর পাড়ে মা দাঁড়িয়ে আছেন। অয়ন এক ছুটে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে। ডানে তাকাতেই দেখে পুকুরের ঘাটে বসে ছোটদি ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে।
সূর্য ওঠার আগে থেকেই কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে পেয়ারা বেগম। হাতের সাথে সাথে অবশ্য মুখও চলে সমান তালে। এ সংসারে গাধার মতো খেটেই জীবন গেল তার। ঘরের পেছনের খোলা জায়গাটায় প্যাচপ্যাচে কাদা। শ্যাওলা জমে স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে। গরু-ছাগল আর হাঁস-মুরগির মলমূত্র সর্বত্র। গরুঘরে কাজ করতে করতে পায়ের শব্দ শুনে পেছনে ফিরে তাকায় পেয়ারা বেগম। মনু মিয়াকে পুকুরের পাড় ধরে হেঁটে আসতে দেখে মেজাজটা আরও চড়ে যায় তার। নিজের উদ্দেশ্যে বলে, আপন যন্ত্রণায় বাঁচি না, তার উপর এই আরেকটা ঝামেলা’!
কাছে এসে মাটির দিকে তাকিয়ে মনু মিয়া বলে,
বুজি ভালো আছেন?
আর আছি! দিনরাইত এই সংসারে খাটতে খাটতে জীবন শ্যাষ। স্বামী, পোলাপাইন কেউ আমার দিগে ফিরাও চায় না। হেই সক্কালবেলা উইঠা গরুর লাহান খাটন শুরু অয়, রাইতে শোওনের আগে আর মুক্তি নাই! মরণ অইলে যদি এর থেইক্যা মুক্তি মেলে।
বুজি যে কী কন! এমন কইরা কইতে নাই, আল্লাহ নাখোশ অয়। আল্লাহ আপনারে যা দিছে এর জন্য তাঁর কাছে শুকরিয়া করেন। নিজের সংসারের কাম করার মধ্যেও শান্তি আছে।
হেইডা তো করতেই আছি। তের বছর বয়সে বিয়া হওনের পর থেইক্যাই তো এই সংসারে খাটন শুরু, কেউ তো আইজ পর্যন্ত আমার দরদ বুঝলো না!
বোঝে বোঝে; সবাই বোঝে। কিন্তু আপনারে কিছু বুঝতে দেয়না। আচ্ছা বুজি, কয়দিন ধইরা একটা কতা হুনতাছি- কতাডা কী সত্য?
কি কতা, না কইলে ক্যামনে বুঝুম?
হুনলাম বিভা’র ভিডা-বাড়িডা নাকি বেইচ্যা দিছেন, কতাডা কী সত্য বুজি?
কেডা কইলো তোমারে যে ঐ ভিডা বেইছা দিছি?
মাইনসে কয়।
মাইনসের তো আর খাইয়া দাইয়া কাম নাই! বেচছি তো খালপারের ভিডা।
আমি তো আপনার দিকে তাকাইয়া পইড়া আছি, আমার দিকটা একটু দেইখেন বুজি।
মনু, তোমার ব্যাপারডা আমি বুঝি, কিন্তু আমগো সময়ডা এহন ভালো যাইতাছে না। তোমার মিয়াভাই অসুগে পইড়া আছে অনেকদিন ধইরা। তার উপর মাইয়াডার জামাইর বিপদ আইলো, পোলাডারে কারবার করার লাইগ্যা টাকা দিলো। চিন্তায় হের মাথাডা খারাপ অইয়া আছে। এই অবস্থায় তোমারে আর কী কমু, কও? আর আপদটা তো এহনো ঐ ভিডায় আছে!
মনু মিয়া বোঝে পেয়ারা বেগম কী বলতে চায়। তার উপর ভরসা করেই এতদিন সে পড়েছিলো শ্যামলপুরে। তার কথা অনুযায়ী মিথ্যা বিচারে বিভার মেয়েকে কঠিন শাস্তি দিয়েছিলো। আজ পেয়ারা বেগমের কথায় অন্যরকম সুর লক্ষ করে একটু একটু করে মনু মিয়ার মনে গড়ে ওঠা আশার সৌধ ভেঙে যায়। দীর্ঘদিন অপেক্ষার পর তার মনে হয় এতদিন যে আশায় শ্যামলপুরে পড়েছিলো সে তা নিশ্চিত মরীচিকা ছাড়া আর কিছুই নয়।












অন্ধকারের আলখাল্লায় মুড়ে ঝিমিয়ে পড়া রাত্রিটা একটু একটু করে গভীর হয়। সন্ধা-রাতই কী আর গভীর-রাতই কী, সূর্য ডোবার পর বেশিক্ষণ বিভার ঘরে আলো জ্বলে না। সন্ধ্যার পর যতক্ষণ আলো জ্বলে কাঁথা সেলাই কিংবা খেজুর পাতার পাটি বোনার কাজেই ব্যস্ত থাকে সে। এগুলো করে তবু কিছু রোজগার হয়। তেল-নুন-কেরোসিন কত কী লাগে! যতক্ষণ জেগে থাকে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মা’কে নানা কথায় ব্যস্ত রাখে প্রভা।
তোমার কাপুড়ডা খুব সুন্দর হইছে মা।
ক্যান তোর জামাডা পছন্দ হয় নাই?
অইছে তো! তুমি তো কতদিন এমন সুন্দর কাপুড় কিনো নাই।
এত দামি জিনিস কিননের সাধ্য কী আমার আছে রে মা!
মাস্টার নানায় তোমারে অনেক ভালো পায়। নানীও।
-, আইজ কাপুড়ডা দিয়া চাচি কইলো নাইয়া এইডা পিন্দিস! দুইজনেই খুব ভালো মানুষ রে মা। এই জন্যই আল্লাহ এগোরে এত ভালো রাখছে।
সাত্তার মাস্টারের বদৌলতে খাওয়া-পরা নিয়ে বিভার দুশ্চিন্তাটা এখন দূর হয়েছে। সারাদিন প্রভা মায়ের সাথে মাস্টার বাড়িতেই থাকে। ওকে নিয়ে যে ভাবনাটা এতদিন তাকে তাড়িয়ে বেড়াতো এখন তা আর নেই।
এহন তো আর কোন ঝামেলা নাই, তুই আবার স্কুলে যাওয়া আরাম্ভ কর! প্রভার উদ্দেশ্যে বলে বিভা।
প্রভা চুপ করে থাকে। বিভা আবার জিজ্ঞেস করে। কিছুক্ষণ পর প্রভা বলে,
কয়দিন আগে ওই লোকটা দীঘির পাড়ে খাড়াইয়া আমার দিকে চাইয়া আছিলো, অর চাউনি আমার ভালো লাগে নাই।
বিভা শোয়া থেকে উঠে বসে। প্রভার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করে,
কবে? তুই তো আমারে কস নাই!
একদিনই দেখছি, তাই তোমারে আর কই নাই, তুমি চিন্তা করবা তাই। পারু খালারে কইছি।
কুত্তার ল্যাজ কোনোদিনও সোজা অয়না। খাড়া, মাস্টার চাচারে কইতে অইবো।
মা লও আমরা এই জায়গা ছাইড়া চইলা যাই, বকুল খালাগো অইহানে গিয়া থাকলে কেউ কিছু করনের সাহস পাইবো না। হেরা তো আমগো থাকতে কইছেই!
বিভা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে- বাপের ভিডা ছাইড়া চইলা যামু! একবার গ্যালে আমার চাচায় আর জায়গা দিবো না। 
তোমার চাচা-চাচি যে শয়তান এইহানে আমগো বেশিদিন থাকতেও দেবো না।
চলে যেতে হবে এই কথা ভেবে নদীর ভাঙনের মতো বিভার ভেতরটা ভাঙে। কিন্তু প্রভার কথাটা অগ্রাহ্য করতে পারে না। চাচা-চাচি যা শুরু করছে একদিন তো এই ভিটা ছেড়ে চলে যেতেই হবে। তবুও এই ঘরটার প্রতি বড় মায়া! ভাবতে ভাবতে চোখে ঘুম জড়িয়ে আসে বিভার। সারাদিন কাজ শেষে পরিশ্রান্ত শরীরে যে রাজ্যের ঘুম! প্রভা মায়ের সাথে কথা বলতে গিয়ে দেখে কোনো সাড়া নেই। বুঝে যায় ঘুমিয়ে পড়েছে মা। প্রভার ঘুম আসে না, চুপচাপ শুয়ে থাকে ও। 
অমাবস্যার রাত। ছোট্ট কুঁড়েঘরটির পাশের বাগানে জমাট-বাঁধা অন্ধকার। দীঘির পাড়ের বাঁশঝাড়-কড়ই গাছের মস্ত ছায়ারা স্থির জলে ছায়া ফেলেছে। সরু পথটার উপরে মফিজ মিয়ার খেড়ের পালার পাশে বেশ কিছুক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে একটি ছায়ামূর্তি। কুঁড়েঘরের বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে শিকারী কুকুরের মতো ওঁত পেতে আছে যেন! পাশের বাগান খুট-খাট শব্দ, ঝিঁঝিঁপোকা-ব্যাঙের ডাক ভেসে আসছে থেমে থেমেই। বাগান-ঘেষা শৌচাগার থেকে মল-মূত্রের বোটকা গন্ধটা নাকে লাগতেই ভেতরটা পর্যন্ত গুলিয়ে ওঠে। রাত বাড়ে তবুও শিকারী জায়গা ছেড়ে নড়ে না। একসময় নিজেই নিজেকে বলেÑ ‘আইজ নিয়া তিনদিন! কয়দিন বাইরে না আইয়া পারবি?’
আরও কিছুটা সময় এভাবেই অতিবাহিত হয়। অবশেষে আততায়ীর ধৈর্য্যরে অবসান ঘটে। হঠাৎ কুঁড়েঘরের দরজাটি খুলে যায়। ছায়া ছায়া অন্ধকারে সেখানে একটি ছিপছিপে ক্ষীণদেহী নারীর অবয়ব দৃশ্যমান হয়। উত্তেজনায় টগবগ করে ওঠে আততায়ীর শরীর। নারীটি ঘরের ভিটার কোণ থেকে পানিভর্তি ঘটিটি হাতে নিয়ে স্বল্প-দূরত্বে বাগানের ধারে কলাপাতায় ঢাকা শৌচাগারের দিকে এগিয়ে যায়। শিকারী ছায়ামূর্তিটি মুহূর্তকাল বিলম্ব করে না, নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে শৌচাগারের পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে।
দানবের শক্ত হাতটি যখন প্রভার মুখ চেপে ধরল, একবার শুধু মা-বলে ডাকার সুযোগ পেয়েছিলো সে, কিন্তু সেই ডাকটা শৌচাগারের সীমানা ছাড়িয়ে কুঁড়েঘর পর্যন্ত পৌঁছেনি। তারপর আর কিছুই করার ছিল না। করবে কী করে? ষাঁড়ের মতো লোকটার শক্তির সাথে কী সে পারে! টেনে-হিঁচড়ে বাগানের ভেতরে নিয়ে গেল লোকটি। গামছা দিয়ে শক্ত করে মুখ আর হাত বেঁধে ফেললে বাকী কাজটা পানির মতোই সোজা! শিকার শিকারীর অসহায় ক্রীড়ানকে পরিণত হয়। প্রভার কাতর-গোঙানির আওয়াজটা সে রাতের নিস্তব্ধ পরিবেশের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। বাগানের গভীরে কিংবা দীঘির পাড়ের বাঁশঝাড়ে কোথাও হয়ত অচেনা পাখির বেশে ডানা ঝাপটিয়ে জেগে উঠেছিলো অশরীরী বন্ধু! তবে সেই শব্দে কারো ঘুম ভাঙেনি। কেউ জানলো না অমাবস্যার গহিন অন্ধকার রাত্রিতে চিরতরে হারিয়ে গেল এক দুঃখিনী মায়ের একমাত্র অবলম্বন। 
খুব সকালে ঘুম ভাঙে বিভার। পাশ ফিরে দেখে প্রভা বিছানায় নেই। বাইরে গেছে ভেবে শোয় আবার। কিছু সময় পেরিয়ে যায়, প্রভা ফিরে না আসায় উঠে বসে বিভা।
কি রে প্রভা, কই গেলি? উচ্চস্বরে ডেকে ওঠে।
কোনো উত্তর নেই। ঘর থেকে বাইরে আসে বিভা। আশেপাশে খোঁজে, কোথাও নেই প্রভা। পারুলের ঘরের দিকে যায়, পারুলকে ডেকে তোলে।
কী রে, কী অইছে?
পারু’বু প্রভারে কোথাও পাইতাছি না।
কস কী? এত্ত সকালে কই গ্যালো?
একলগেই তো ঘুমাইয়া আছিলাম, ঘুম থেইক্যা উইঠা দেহি ও নাই।
পায়খানায় গ্যাছে মনে অয়।
আরে না! আমি সব জায়গায় খুঁজছি। কোত্থাও নাই।
তাইলে তো চিন্তার কতা! ল তো দেহি।
পারুল ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। দু’জনে মিলে ঘরের পেছনে, দীঘির পাড়ের আশেপাশে, রাস্তায় খোঁজে। চিৎকার করে প্রভার নাম ধরে ডাকে। কোনো সাড়া নেই! বিভা ঘরের দাওয়ায় ধপ করে বসে পড়ে।
কলাপাতায় ঘেরা শৌচাগারের কাছে গিয়ে ভ্রু-কুঁচকে যায় পারুলের। ঘটিটি পথের পরে’ যেখানে উপুর হয়ে পড়ে রয়েছে তার পাশেই ভেজা মাটিতে পায়ের ছাপগুলো অন্যরকম! কিছু কিছু পায়ের ছাপ বেশ গভীর। পারুল ভালো করে লক্ষ করতেই দেখে ওখান থেকে ছোট ছোট গাছগুলো ভেঙে বাগানের দিকে ঝুকে রয়েছে, একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায় যে এগুলোর উপর দিয়ে কিছু একটু টেনে নেয়া হয়েছে। পারুল ধীরে ধীরে সেদিকে এগিয়ে যায়। বাগানের কিছুটা ভেতরে ঢুকে ফাঁকা জায়গাটায় পৌঁছুতেই চমকে ওঠে! ফাঁকা স্থানটির এককোণে ঝোপের পাশে নিথর হয়ে পড়ে রয়েছে প্রভার দেহ! দৌড়ে কাছে যায় সে, হাত-পা, শরীর নেড়েচেড়ে দেখে। কোনো সাড়া নেই। তারমানে- প্রভা নেই! বিভাকে ডাকার শক্তিও যেন লোপ পায় পারুলের। আস্তে আস্তে পিছিয়ে বাগানের বাইরে এসে দাঁড়ায়। পারুলকে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেদিকে দৌড়ে যায় বিভা।
কী হইছে পারুবু’ তুমি এমন করতাছ ক্যান?
পারুলের মুখ থেকে কোনো কথা বের হয় না। সে ফ্যালফ্যাল করে বিভার দিকে তাকিয়ে থাকে। বিভা চিৎকার করে ওঠেÑ কী অইছে পারুবু’ তুমি এমন করতাছ ক্যান?
পারুলকে নিশ্চুপ দেখে বিভা বাগানের দিকে ছুটে যায়। চোখের সামনে একমাত্র মেয়ের নিষ্প্রাণ দেহটি দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। জ্ঞান হারায় বিভা।
এই মৃত্যুর খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। অল্প সময়ের মধ্যেই লোকে লোকারণ্য। কলাবতী বাজার থেকে দলে দলে লোকজন ছুটে আসে বিভার ছোট্ট কুঁড়েঘরের উঠানে।
জ্ঞান ফিরে এলে বিভা অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকে উঠানে। তার একমাত্র অবলম্বনটির প্রাণহীন দেহ ওখানে শোয়ানো। এতটা কাল অপরিসীম কষ্ট করে যাকে বুকে আগলে রেখেছিল আজ নিজের চোখের সামনে তাকে নিথর হয়ে পড়ে থাকতে দেখে পাথরের মূর্তির মতো ঘরের দাওয়ায় বসে থাকে।
সাত্তার মাস্টার থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলেন দীঘির পাড়ের সরু রাস্তাটার উপর। বিভার কুঁড়েঘরের দিকে কোনোভাবেই তাকাতে পারছেন না তিনি। তার দেয়া নতুন শাড়িটি পরে ঘরের দরজায় বসে আছে বিভা। গতকাল বিভার মুখে যে প্রশান্তির হাসি দেখেছিলেন তিনি আজ সেখানে তার চেয়ে শতগুণ বিষাদের ছায়া। কিছুদিন পূর্বে বিভার বলা কথাগুলো এখন আবার আর্তনাদের মতো বাজছে তাঁর বুকের ভেতরে। যুদ্ধে জিতে এ কোন সমাজ গড়েছে তারা? এটাই কী চেয়েছিলো? হরিপদর পরিবারের প্রতি ক্রমাগত অন্যায় আচরণের কিছুই করতে পারেননি তারা, তার উপর আজ এই আঘাত! এ কেমন পরাজয়?
এত হৈ-হট্টগোলে বিভার পাথরের মূর্তির রূপ বদলায়নি একটুও। সে একবারও মেয়ের লাশের পাশে এসে দাঁড়ায়নি। যেন এখন তার আর কিছু যায়-আসে না। ভিড়ের মধ্য থেকে উদয়ন ক্লাবের ছেলেদেরকে লক্ষ্য করে ইসমাইল মোল্লা হাঁক দিয়ে ওঠেন। 
খাড়াইয়া দ্যাখতাছো কী? ঐ বদমাইশটারে ধইরা নিয়া আয়।
ওদিকে আরেকটা শোরগোল ওঠে। ‘হ, হেই লগে খালেইক্যা আর ঐ বুড়া শয়তান মফিজ মিয়ারেও।
কেউ একজন বলে ওঠে- মাওলানাডা কই?’
উপস্থিত জোয়ানরা কয়েক ভাগে ভাগ হয়ে যায়। কয়েকজন ছুটে যায় গাজী বাড়ির দিকে, কেউবা মফিজ মিয়ার ঘরে।
মনু মিয়া পেছন থেকে সামনে এসে দাঁড়ায়।
বড় আচানক ব্যাপার! কাইল বিহালেও মায়ের লগে ভালো মাইয়াডা ঘরে ফিরলো!
আপনে কখন হুনলেন? আতিক জিজ্ঞেস করে।
বিভার ডাকাডাকি হুইনা আইলাম। অনেকক্ষণ ধইরাই তো প্রভারে খোঁজা অইতেছিলো।
মফিজ মিয়া কাশতে কাশতে বিভার ঘরের সামনের চত্বরে এসে দাঁড়ায়। প্রভার মৃতদেহ দেখে থমকে যায়।
কহন ঘটলো? কার উদ্দেশ্যে বলল বোঝা গেল না।
সারা গ্রামের মানুষ হাজির অইয়া গ্যালো আর তুমি কই আছিলা? সাঈদ খান বলে উঠলেন।
শরীরডা ভালো না, ঘুমাইয়া আছিলাম।
ঘুমাইয়া আছিলা না-কি খুশিতে বগল বাজাইতেছিলা? রেগেমেগে বললেন হুমায়ূন হাওলাদার।
তোমরা কী কও এইসব? আমিও তো মানুষ! আমারে এতবড় অমানুষ ভাবতে পারলা তোমরা? মফিজ মিয়ার কণ্ঠে আকুতি।
তোমারে মানুষ ভাবুম ক্যামনে? তোমার কাজকাম কী মানুষের মতো? বিভার ঘরের সামনের খেড়ের পালা দেখিয়ে ধমকে উঠলেন ইসমাইল মোল্লা।
এইডা আগামী কাইলই সরাইয়া নেওনের কতা। আমি ছমিরকে গতকাইলই কইয়া রাখছি। অরে জিগাইয়া দ্যাহো তোমরা।
হারু গাজীকে বড় রাস্তা থেকে নামতে দেখে সবার মনযোগ সেদিকেই যায়। উপস্থিত জনতা হৈ-চৈ করে ওঠে। ‘খুনির বাপটা আইছে’।
হারু গাজী উঠানে এসে দাঁড়ায়। প্রভার লাশের দিকে তাকিয়ে মফিজ মিয়াকে জিজ্ঞেস করে,
ক্যামনে ঘটলো?
আমিও তো জানি না। হৈ-চৈ শুইনা আইলাম।
সব ঘটনা শুনে বলল- মনে অয় জ্বিনের আছর অইছিলো।
তোর বাপের আছর অইছিলো শয়তানের বাচ্চা, তামশা দেখতে আইছো? চিৎকার করে ওঠেন কাজেম মাঝি। তার সাথে সাথেই ইসমাইল মোল্লা বলে ওঠেনÑ তোর পোলা কই?
আপনেরা কোনো ঘটনা ঘটলেই আমার পোলারে দোষেন ক্যান? ও তো দুইদিন ধইরা বাড়ি নাই, ব্যবসার কামে মধুপুর গ্যাছে।
উদয়ন ক্লাবের ছেলেরা চিৎকার করে ওঠে, ‘মিথ্যা কতা’। তপু বলে ওঠে- এই বুইড়াডারে ধইরা বাইন্ধ্যা রাখলে সুরসুর কইরা অর পোলাডা আইসা হাজির অইবো। উঠতি তরুণদের একটা দল হারু গাজীর দিকে তেড়ে যায়। আতিক ছুটে গিয়ে তাদের থামায়।
পারুল সবার মাঝে এসে দাঁড়ায়। ‘এই বুইডা হাবড়ার হাড়-বজ্জাত পোলাডা কয়দিন আগেও এইহানে খাড়াইয়া প্রভারে ডর দেহাইছে। আপনেরা আহেন আমার লগে’। বলে শৌচাগারের দিকে এগিয়ে যায় পারুল।
সাঈদ খান আর কাজেম মাঝিকে নিয়ে পারুলের পেছন পেছন যান সাত্তার মাস্টার। তাদের দেখাদেখি উপস্থিত লোকজনও সেদিকে যায়। ভেজা মাটিতে পায়ের ছাপগুলো ভালো করে লক্ষ করে সবাই। হামিদ শেখ হারু গাজীকে ডাকলেন। ‘এইগুলা তোর কোন জ্বিন-বাপের পায়ের চিহ্ন?’
আমারে জিগান ক্যান? এইগুলা কী আমার পায়ের?
তোর না, তোর পোলার পায়ের চিহ্ন। তেড়ে এলেন হুমায়ূন হাওলাদার।
এতো কথার দরকার নাই। পুলিশ ডাকো আর অর পোলার নামে মামলা ঠুইক্যা দাও। পুলিশ প্যাঁদানি দিলে এইগুলা কার পায়ের চিহ্ন পরিষ্কার অইয়া যাইবো। হামিদ শেখ বললেন।
বিভার ঘরের পাশে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে হরিপদ-তারাপদ। হামিদ শেখ কাছে এসে দাঁড়ালে হরিপদ বললেন- তোমরা এইবারও কিছু করতে পারবা না। করবা ক্যামনে, প্রমাণ কই?
আচমকাই এক কা- ঘটলো। সকাল থেকে যে বিভা একটি কথাও বলেনি, মুহূর্তেই অগ্নিমূর্তি ধারণ করলো। বিভার ঘরের দরজার সোজাসুজি দাঁড়িয়েছিলো হারু গাজী, হঠাৎ তাকে এক ধাক্কায় ফেলে দিয়ে মেয়ের লাশের পাশে গিয়ে বসে পড়ে বিভা।
খবরদার! কেউ আমার মাইয়ার গায়ে হাত দিবা না। আমার প্রভা এহন আমার লগে ঘুমাইবো। শান্তিতে ঘুমাইবো। কেডা পুলিশ ডাকবো?
পারুল শাড়ির আঁচলে চোখ মোছে। এগিয়ে এসে বিভাকে ধরে আবার ঘরে নিয়ে যায়। ‘মানুষ মইরা গ্যালে তারে আর ধইরা রাখন যায়না রে বইন। সুখ তোর কপালে নাই, কী করবি’?
বড়বড় চোখ করে পারুলের দিকে তাকায় বিভা। -চুপ! একদম চুপ! অর ঘুম ভাইঙা যাইবো।
হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে ভাঙা লাউয়ের মাচার উপর চিৎ হয়ে পড়ে গেল হারু গাজী। কারো সাহায্য না পেয়ে অতিকষ্টে উঠে দাঁড়ায় সে। কোমরে বেশ চোট পেয়েছে, খোঁড়াতে খোঁড়াতে সাঈদ খানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
চেয়ারম্যানসাব, আমার পোলাডা সত্যই নির্দোষী। ও দুইদিন ধইরা গ্রামেই নাই। এই কাম অন্য কারো।
তোর পোলারে আইনা হাজির কর। আগে ঐ-পায়ের চিহ্নের লগে তোর পোলার পায়ের চিহ্ন মিলাইয়া দেখুম, তারপর সিদ্ধান্ত নেয়া অইবো। নাইলে পুলিশ ডাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নাই। সাঈদ খান স্পষ্ট করে বলে দিলেন।
আইচ্ছা চেয়ারম্যান সাব, আমি অরে খবর দেওয়ার ব্যবস্থা করতাছি। আপনেরা অর নামে পুলিশে মামলা দিয়েন না। হারু গাজী কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল।
যত হম্বিতম্বিই হোক না কেন, সবকিছু একসময় স্বাভাবিক হয়ে এল। দুপুরের পরপরই লাশ দাফন হয়ে গেল। সারাদিনের হৈচৈ-চিৎকার-চেঁচামেচি মিলিয়ে গেলে নিস্তব্ধ-নীরব পরিবেশ। বিভা ঘরের দরজায় মাথা ঠেকিয়ে সেই যে বসে থাকে আর ওঠে না। ক্ষণে ক্ষণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর ফ্যালফ্যাল করে ফাঁকা উঠানটায় তাকিয়ে থাকে। সকাল থেকে মেয়ের প্রাণহীন দেহখানি শোয়ানো ছিল এই উঠানে, এখন আর কেউ নেই, কিচ্ছু নেই! এ বড় আজব দুনিয়া। কায়াকে ঘিরেই যত মায়া! কায়াটা চলে গেলে মানুষের দেহটার কোনো মূল্য নেই, শুধু কিছু আনুষ্ঠানিকতা। তারপর ছায়া-ছায়া স্মৃতিকণা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকেনা।
বিভার ছোট্ট ঘরটা আজ ফাঁকা; ভীষণ ফাঁকা। ভিতরের জমাট বাধা কষ্টগুলো আজ এই কঠিন সময়ের আবর্তে ঘুণে ধরা সমাজের গায়ে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে। চারিদিকে নানান কথা, আলোচনা, গুঞ্জন- কোন কিছুই যেন বিভাকে আর স্পর্শ করে না।
সন্ধ্যায় পারুল এসে দেখে বিভা ঘরে নেই। সারাদিন অনেক সাধাসাধি করে তাকে কিছুই মুখে দেওয়াতে পারেনি। দুপুরে রেখে যাওয়া খাবারগুলো এখন ঘরময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বিড়াল কিংবা অন্য কোনো প্রাণির কাজ হবে হয়তো! ঘরের চারপাশে খোঁজ করে পারু। সাত্তার মাস্টারের বাড়িসহ আশেপাশেও খোঁজে। বিভাকে কোথাও আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
প্রভার মৃত্যুর দু’দিন কেটে গেছে। বিভার অন্তর্ধানের রহস্য এখনো উন্মোচিত হয়নি। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও বিভাকে আর পাওয়া যায়নি। ছেলেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হারু গাজী গত দু’দিন ধরে কয়েকবার ধরনা দিয়েছে সাঈদ খান আর সাত্তার মাস্টারের কাছে। আসে মফিজ মিয়াও। সে এখন অনুতপ্ত। বিভাকে খুঁজে পাওয়া গেলে তার সম্পত্তি তাকে বুঝিয়ে দিতে এখন রাজি সে। কাজেম মাঝি মফিজ মিয়ার উপর রেগে উঠে বললেন- তোমার বুদ্ধিডা ভালোই মফিজ! এহন ঐ সম্পত্তি দিয়া কী করবো বিভা? অর তো আর কোনো ওয়ারিশ নাই। তাছাড়া বিভার নিজেরই তো এহন হদিস নাই!
তোমরা যা খুশি কইতে পারো, আমার আর কিছু কওনের মুখ নাই। নিজেরে খুব অপরাধী লাগতাছে। মফিজ মিয়া চোখ মোছে।
সাত্তার মাস্টার সামনে নদীর দিকে তাকিয়ে ভাবেন, মানুষ কেন সময়মত সবকিছু বোঝে না? একেকটা ভুল তাকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করায়! ইসমাইল মোল্লা আর সাঈদ খান চলে আসলে লাইব্রেরির বাইরে এসে দাঁড়ান সাত্তার মাস্টার। এমন সময় নদীর পাড়ের দিক থেকে সোরগোল শুনে পেছনে ফিরে তাকায় সবাই। বাজার থেকে প্রায় দু’শ গজ দূরে শ্যমলপুরের দিক থেকে ছুটে আসা রাস্তায় একটি জটলা চোখে পড়ে। ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে আসছে ওটা। আরও কিছুটা কাছাকাছি আসতেই উঠে দাঁড়ায় সবাই। এই জায়গাটা রাস্তা থেকে কিছুটা উঁচু, এখান থেকে সামনের অনেকটা জায়গা পরিষ্কারভাবে দেখা যায়। হঠাৎ সাত্তার মাস্টার দেখতে পান নদীর পাড়ের রাস্তা ধরে একটা ভ্যানগাড়ি বাজারের দিকে এগিয়ে আসছে। সাথে দু’জন পুলিশ কনস্টেবল আর পেছনে আসছে বিভিন্ন বয়সী মানুষের একটা দল। মানুষের হৈ-চৈ শুনে মাস্টারসাব এগিয়ে এসে রাস্তার মোড়ে দাঁড়ালেন। তার সাথে সাথে কাজেম মাঝিও এগিয়ে এলো। জটলাটা আরেকটু কাছে আসতেই মাস্টারসাব দেখতে পান ভ্যানের উপরে চাটাই দিয়ে মোড়ানো একটা মৃতদেহ। ভ্যানটি বাজারে ঢুকতেই উৎসুক লোকের একটা ভিড় জমে যায়। দক্ষিণ পাড়ার করিম লস্কর জিজ্ঞেস করে,
ও মিয়ারা, কেডা মারা গেল?
বে-ওয়ারিশ লাশ। দুই মাইল দূরে নদীর চরে পইড়া আছিলো। লোকজনের কাছে খবর পাইয়া নিয়া আইলাম। কনস্টেবলদের একজন উত্তর দেয়।
পুরুষ না মেয়েছেলে?
মেয়েছেলে।
কোন গ্রামের, চেনা যায় নাই?
চেহারা চেনার উপায় নাই।
আহারে!
চাটাই দিয়ে মোড়ানো থাকায় লাশটা দেখা যায় না। ভ্যানটা বড় রাস্তার দিকে মোড় ঘুরবার সময় কিছুক্ষণের জন্য স্থির হয়ে যায়। আচমকাই চাটাইয়ের ফাঁক গলে বের হয়ে থাকা শাড়ির আঁচলের প্রান্তে মাস্টারসাবের চোখ আটকে যায়। তিনি পাশে দাঁড়ানো কাজেম মাঝির দিকে তাকালেন। কাজেম মাঝি সাত্তার মাস্টারের কাঁধে হাত রেখে বললেন- সব শ্যাষ! 

চারিদিক থেকে উৎসাহী মানুষের ভিড়টা ক্রমশ বাড়ে। ভ্যানটা আবার ঢাকা পড়ে গেলে মাস্টারসাব ওখানেই থমকে দাঁড়িয়ে থাকেন অনেকক্ষণ। পশ্চিম আকাশ লাল হয়ে আসে; মানুষের ভিড় ঠেলে ধীরে ধীরে ভ্যানগাড়িটি এগিয়ে যেতে থাকে বড় রাস্তার দিকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উপন্যাসঃ ফেরা (পর্বঃ ২১ - ২৫ - শেষ পর্ব)

এ ই উপন্যাসটিতে সম্মুখ সমরের কোন ঘটনা তুলে ধরা হয়নি।  ওয়ারফ্রন্টের কোনও দৃশ্য নেই। তবে এই লেখায় মূলত যে গল্পটি বলার চেষ্টা ক রা হয়েছে  তা মু...