রঞ্জুর বাসা থেকে বাস স্ট্যান্ডের দূরত্ব খুব বেশী নয়। এটুকু পথ পায়ে
হেঁটেই যাওয়া যায়। ঘড়ির কাঁটা ধরে রোজ সকালে একই পথ ধরে ওর যাওয়া আসা। বাসা
থেকে বের হয়ে রাস্তাটি বেশ কয়েকটি বাঁক নিয়ে বড় রাস্তায় পড়েছে, তারপর পাঁচ
মিনিট হাটলেই বাসস্ট্যান্ড।
আজ একটু দেরী হয়ে যাওয়ায় খুব তাড়া ছিল রঞ্জুর। বাসা থেকে বেড়িয়ে গলির
দ্বিতীয় বাঁকটির শেষ মাথায় নুরুল ডাক্তারের বাড়ি পার হয়ে দ্রুত হেঁটে
যাচ্ছে, হঠাৎ লম্বা বেণী দুলিয়ে উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণা এক উচ্ছলা ষোড়শী
ডাক্তার বাড়ির ডান দিকের গলি থেকে দমকা হাওয়ার মত এসে রঞ্জুর সামনে উদয় হল।
মেয়েটি ভাঁজ করা একটি কাগজ রঞ্জুর হাতের মুঠোয় ধরিয়ে দিয়ে ঝড়ের বেগে দৌড়ে
পালাল যেদিক দিয়ে এসেছিল ঠিক তার উল্টা দিকে। ঘটনার আকস্বিকতায় রঞ্জু তো
অবাক! কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে না পেরে বেশ কিছুক্ষণ হতবিহ্ববল হয়ে ওখানেই
দাঁড়িয়ে থাকার পর চারিদিকে তাকিয়ে আশেপাশে কেউ নেই দেখে স্বস্তি বোধ করলো।
পরে পড়বে ভেবে কাগজটি প্যান্টের পকেটে ভরে হাঁটতে লাগলো বাসস্ট্যান্ডের
দিকে।
বাসে উঠে পিছন দিকের একটি ফাঁকা সিটে বসে পকেট থেকে ভাঁজ করা চিঠিটা বের
করে পড়তে শুরু করল। চিঠিটি পড়া শেষ করে রঞ্জু মনে মনে একচোট হেসে নিল।
এতক্ষনে তাঁর কাছে পরিস্কার হয়ে গেল রহস্যে ভরা গত কয়েকদিনের ঘটনাবলী।
রঞ্জু ঢাকায় এসেছে পাঁচ মাস হল। হলে সিট না পেয়ে দুই রুমের
একটি ছোট ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে কয়েকজন ক্লাস ফ্রেন্ড মিলে থাকে। প্রতিদিন সকাল
আটটায় ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়। সেদিন বাসা থেকে বের হয়ে
ডাক্তার সাহেবের বাসার ঠিক দুইটা বাসা পরে একটি পুরোনো ধাচের একতলা বাসার
সামনে দিয়ে যাবার সময় জানালা দিয়ে দলা পাকানো এক টুকরো কাগজ এসে রঞ্জুর
গায়ে পড়ে। কোন অপ্রয়োজনীয় কাগজ বাসা থেকে কেউ ছুড়ে ফেলেছে মনে করে রঞ্জু
হেঁটে চলে গিয়েছিল। পরের দিন আবার একই ঘটনা। কাগজটা গায়ে পড়তেই রঞ্জু
জানালার দিকে তাকিয়ে কাউকেই দেখতে পায়না, তথাপি কাগজটি খুলে দেখে, তাতে
লেখা- আপনি কি অন্ধ ?
রঞ্জু ঠিক বুঝতে পারে এ কথার মানে কি, কিছু না বুঝে কাগজটি ফেলে দিয়ে হেঁটে
চলে যায়। তার পরের দিন আবার ঠিক একই জায়গায় একই ভাবে আরেকটি
কাগজ এসে তাঁর গাঁয়ে পড়ে, তাতে লেখা-আপনি কি বোকা ?
এবার রঞ্জু অবাক হয়ে কাগজটি রেখে দেয় এবং রাতে সেলিমকে দেখায়। সেলিমও কিছু বুঝতে না পেরে বলে কেউ হয়ত ফাজলামো করছে, বাদ দে!
আজকের ঘটনা অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে গেলো। কিন্তু রঞ্জু কিছুতেই মেয়েটির
এই অদ্ভুত আচরণের কোন মানে খুঁজে পেল না, আর মেয়েটিই বা কে? এর আগে কখনো
মেয়েটিকে দেখেছে বলে মনে করতে পারছিল না!
ক্লাসে সারাক্ষণ চোখে ভাসতে লাগলো শ্যামবর্ণা অদ্ভুত মেয়েটির মুখ। সেলিম আজ ক্লাসে না আসায় ওর সাথে আলাপ করা গেল না।
সারাদিন ক্লাস, লাইব্রেরীর কাজ শেষ করে বাসায় ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল।
রুম মেটরা কেউ রুমে নেই। ফ্রেস হয়ে রুমে এসে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সমরেশের
গর্ভধারিনী পড়তে থাকল। ঘন্টাখানেক পর সেলিম আসলে দু’জনে চিঠিটা নিয়ে আলোচনা
করে। চিঠির মূল বিষয়বস্তু অনেকটা এরকম- “মেয়েটি এতগুলো চিঠি দিল রঞ্জু কেন
কোন উত্তর দিল না সে কি আসলেই বোকা নাকি না বোঝার ভান করছে ? কালকের মধ্যে
উত্তর না দিলে রঞ্জুর খবর আছে।“
চিঠিটি পড়ে দুজনেই কিছুক্ষণ হাসলো।
-দেখতে কেমন রে !
-ভাল করে তো দেখতেই পারলাম না! ঝড়ের বেগে এসে চিঠিটা হাতে ধরিয়ে দিয়েই তো
চলে গেল! তবে বেশ লম্বা, শ্যামলা আর বড় বড় চোখ, এটুকু বোঝা গেছে।
-সেলিম তো রঞ্জুকে পেয়েই বসলো- মামা তোমার ঘাড়ে ভূত চেপেছে! এবার তোমার খবর আছে!
-দূর! তুই ফাজলামি করিস না তো! আমার কিন্তু অন্য রকম মনে হয়।
-কি মনে হয় ?
-মনে হয় মেয়েটি স্বাভাবিক না
-কেন অস্বাভাবিক মনে হল ?
-স্বাভাবিক হলে কেউ এমন পাগলামি করে ?
-করে, মামা করে। প্রেমে পড়লে সবাই অস্বাভাবিক আচরণ করে। কয়েকদিন যাক, তুমিও করবা
-হ, তোরে কইছে ! বাদ দে এসব ক্যাচাল। দোস্ত বল না এখন কি করা ?
-তুই কি করতে চাস ?
-কি করতে চাই মানে ! আরে, এই উটকো ঝামেলা থেকে উদ্ধার পাবার উপায় বের কর।
-উপায় আবার কি ! তুই কোন সাড়া না দিলেই তো হল!
-আমি সাড়া দিব তোকে বলেছি ? প্রতিদিন ও পথ দিয়েই তো যেতে হয়, আবার তো
ঘাড়ের উপর এসে পড়বে ! পরিচিত লোকজন দেখলে তো ইজ্জত পাংচার !
-আমরা তো ভোরেই টিউশনিতে চলে যাই, না হলে সবাই একসাথে যাওয়া যেত। তুই এক কাজ কর, তোর আশা যাওয়ার টাইমিংটা চেঞ্জ করে দেখতে পারিস।
-ভাল বলেছিস, এভাবে দেখা যেতে পারে।
পরদিন থেকে রঞ্জু পনের মিনিট আগে বাসা থেকে বেড়িয়ে পড়ে এবং এভাবে কোন ঝামেলা ছাড়াই এক সপ্তাহ পার করে দেয়।
পরের শুক্রবার বিকালে রঞ্জু মেয়েটিকে দেখতে পায় রিক্সায় একজন বয়স্ক
লোকের সাথে, সম্ভবত ওর বাবা হবে। মেয়েটিকে দেখে বেশ অসুস্থই মনে হল,
চেহারায় সেই উচ্ছলতা আর নেই, সেখানে ভর করেছে এক রাশ বিষণ্ণতা।
মাস খানেক পরের ঘটনা। একদিন দেখে ওদের বাসার সামনে একটা মাইক্রোতে কিছু
লাগেজ ও অন্যান্য মালামাল তোলা হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল ওরা মা-বাবা
আসলে মেয়েটির চিকিৎসার জন্যই ঢাকা এসেছিল। ঢাকায় আসার কিছুদিন আগে মেয়েটির
ব্রেন টিউমার ধরা পড়ে। বাবা-মার একমাত্র মেয়ে, ওকে বাঁচানোর জন্যে চেষ্টার
কোন ত্রুটি রাখেনি। জন্য দুই মাসের জন্য এই বাসাটা ভাড়া নিয়েছিল। গত পরশু
মেয়েটি মারা যায়। মেয়েটির মা বাবা সেদিনই লাশ নিয়ে বাড়িতে চলে যায়, আজ ওর
মামা এসেছে মালামাল গুলো নিয়ে যেতে।
খবরটা শুনে রঞ্জুর মন খুব খারাপ হয়ে গেল। মেয়েটির কাছ থেকে উদ্ধার পাবার
জন্যে কত চেষ্টাই না করেছে ও! এখন আর ওকে আর কেউ বিরক্ত করবে না। মেয়েটির
সেই উচ্ছলতা, বড় বড় চোখ দুটি, রিক্সায় বসা ওর বিষণ্ণ চেহারাটা বহুদিন
রঞ্জুর চোখে চোখে ভাসতো !
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন