শনিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

টুকরো গল্পঃ শূন্য এ বুকে পাখি মোর ফিরে আয়…


বেশ কিছুদিন ধরেই মেয়েটার শরীর ভাল যাচ্ছিল না, তাই মনটাও বেশ খারাপ থাকতো। দিন দিন মেয়েটা কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছিল, ওয়েট লুজ করছিল বেশ। অনেক চিন্তা হচ্ছিল, কারণ প্রতিদিনই পায়খানার সাথে রক্ত যেত। কয়েকজন ডাক্তার দেখানোর পর বোঝা গেল ছোট একটা অপারেশন লাগবে, তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। যাক, অনেকদিন পর আশ্বস্ত হওয়া গেল যে মেয়েটা সুস্থ হয়ে যাবে। মন থেকে একটা দুশ্চিন্তা দূর হয়ে গেল। ওর মা চিন্তিত হয়ে পড়লে তাকে অভয় দিলাম এটা নিয়ে চিন্তার কি আছে! এটা তো অনেকটা ফোঁড়া কাটার মত, কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ও সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরবে, ভয়ের কিছুই নেই। তবুও মেয়েদের মন বলে কথা, অতি অল্পতেই কাতর হয়ে যায়!
আমি নিজে খুব শক্ত মনের না হলেও এইসব ছোট খাটো অপারেশন নিয়ে কখনোই ভাবনা হয়নি তেমন। কারো এপেন্ডিসাইটিস অপারেশনের কথা শুনলে বলি- এটা তো এখন ডাল-ভাতের মত ব্যাপার, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমার মেয়ের বেলায়ও কোন দুশ্চিন্তা করিনি, কারণ এটা আসলেই ভয় করার মত কোন কিছু না। কাটা-ছেড়াঁর কিছু নেই, ওকে ঘুম পাড়িয়ে পলিপটা কেটে ফেলবে, এই তো! আমার সাড়ে চার বছরের ছোট্ট মেয়েটি অপারেশন কি জিনিস জানে না, সে তার আগের দিন থেকেই অনেকটা খুশি মনেই যাকে পাচ্ছে তাকেই বলে বেড়াচ্ছে- জান? কাল আমার অপারেশন হবে! যেন এটা একটা মজার ব্যাপার।
অপারেশনের দিন সে আমাদের সাথেই হেসে খেলেই হসপিটালে গেলো এবং যথারীতি দুষ্টুমির মহড়া চালাতে থাকলো যতক্ষণ পর্যন্ত ভিতর থেকে তার ডাক না পড়ল। আমিও বাধা দেইনি, ওকে ওর মতই থাকতে দিয়েছি। বিপত্তি ঘটলো যখন তাকে ভিতরে নিয়ে যেতে চাইলো। সে কিছুতেই আমাকে ছাড়া যাবে না। অগত্যা আমাকে তার সাথেই অপারেশন থিয়েটারের ভিতরে যেতে হল। সেখানেও একই অবস্থা। তাকে বেড়ে শোয়াতে গিয়েই বাধলো আরও বিপত্তি, দুই হাত দিয়ে সর্বোশক্তি দিয়ে আমার গলা পেঁচিয়ে ধরে সে কি কান্না! বাবা, তুমি যেওনা, আমি এখানে থাকবো না, আমার ভয় লাগছে, আমাকে তোমার সাথে নিয়ে যাও...
আমার ভিতরের শক্ত ‘আমি’টার কেমন যেন পরিবর্তন হতে থাকলো, একটা ভীষণ কষ্টের অনুভূতি আমাকে গ্রাস করছিল। এনেস্থেশিয়ার ডাক্তার ওকে ঘুম পড়িয়ে দিল, আমার রিয়াসা ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়লো, ওকে বেডে শুইয়ে দেয়া হল আর আমাকে বলা হল বাইরে চলে যেতে... চোখের সামনে আমার নিস্তেজ মেয়েকে রেখে আমি একটু একটু করে রুম থেকে বেরিয়ে আসছি... আমার ভিতরটা সেই মুহুর্তে কেমন যেন ফাঁকা হয়ে যাচ্ছিলো। সচেতনভাবে আমি জানি কিছু সময় পর ও স্বাভাবিক হয়ে যাবে কিন্তু অবচেতন মন যেন কোন যুক্তিই মানতে চায়না। আমার কেবলই মনে হচ্ছিলো আমি রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি ঠিকই কিন্তু আমার প্রাণটা যেন রেখে যাচ্ছি এই রুমের ভিতরেই... কিছু কিছু মূহুর্ত থাকে যখন নিজেকে ঠিক সামলে রাখা সম্ভব হয় না, সব কিছু বোঝার পরও শরীরের ভিতরে স্বত্বাকে ঠিক মানানো যায়না। এটি ছিল সেরকমই একটি ব্যাপার।
প্রায় ঘন্টাখানেক বাইরে অধীর অপেক্ষা, এই বুঝি ডাক পড়ল, এই বুঝি ডাক পড়ল! একসময় সেই কাঙ্খিত ডাক এলো, ডাক্তারের এসিসটেন্ট এসে বললো অপেরাশন শেষ, ও ভাল আছে। আমাদের দেখালো ভিতর থেকে কেটে আনা বাড়তি মাংসের টুকরা, যেটা ওকে এতদিন যন্ত্রণা দিচ্ছিলো। আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। আরও বেশ কিছুক্ষণ পর একজন আমাকে ডেকে নিয়ে গেল অবজারভেশন রুমে, দেখলাম অক্সিজেন দিয়ে রাখা অবস্থায় বেডে শুয়ে আছে আমার রিয়াসা।
বাইরে এসে আবারও সেই অপেক্ষার প্রহর! দীর্ঘ সময় পর ওর জ্ঞান ফিরে এলে আবার ডাক পড়লো আমাদের। একজন এসে বলল মেয়েটির বাবা কে? ও বাবার জন্য কাঁদছে। ছুটে গেলাম ভিতরে। আমাকে দেখে আবার সেই কান্না। বাবা, আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও, আমি এখানে থাকবো না। মাত্র জ্ঞান ফিরে এসেছে, এখনই তো ওকে নেয়া যাবে না, আরও কিছুক্ষণ ওকে রাখতে হবে এখানে। অতএব ওর কান্না থামাতে আমাকে আর ওর মাকে পালাক্রমে থাকতে হল ওর পাশে। এভাবেই প্রায় দুই ঘন্টা পর ডাক্তার রিলিজ দিলেন ওকে। দীর্ঘ পাঁচ ঘন্টা অবসানের পর রিয়াসা ফিরে এল আমার বুকে! আমার মনে হল আমার প্রাণ ফিরে পেলাম।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উপন্যাসঃ ফেরা (পর্বঃ ২১ - ২৫ - শেষ পর্ব)

এ ই উপন্যাসটিতে সম্মুখ সমরের কোন ঘটনা তুলে ধরা হয়নি।  ওয়ারফ্রন্টের কোনও দৃশ্য নেই। তবে এই লেখায় মূলত যে গল্পটি বলার চেষ্টা ক রা হয়েছে  তা মু...