শনিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

দিনলিপিঃ পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে


বিকেল পাঁচটায় অফিস থেকে বের হয়ে এলাম। ফার্মগেট এসে মনে হল আজ রিকশা করে বাসায় ফিরলে কেমন হয় ! তেজগাঁও কলেজের সামনে এসে কয়েকটা রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করতে অল্প বয়সী একটি ছেলে মিরপুর যেতে রাজি হওয়ায় উঠে পড়লাম। আকাশে বেশ মেঘ জমেছে। মানিক মিয়া এভিনিউয়ের মাথায় এসে মনে হল যে কোন মুহূর্তে বৃষ্টি নামবে। রিকশাওয়ালা ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম- এই পর্দা আছে ?
ছেলেটা হেসে জবাব দিল- পর্দা নিতে ভুইলা গেছি। হুডটা তুলে দিল। ইতিমধ্যে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করল। সংসদ ভবনের মোড়ে আসতেই প্রায় ভিজে গেলাম। হঠাৎ মনে হল অর্ধেক ভিজে লাভ নেই আজ পুরা পথটাই বৃষ্টিতে ভিজি ! অনেক দিন তো বৃষ্টিতে ভেজা হয় না! ছেলেটিকে বললাম- এই, হুডটা নামিয়ে দে, আজ বৃষ্টিতে ভিজবো।
-ছেলেটি হেসে বলল- অসুখ করবে না !
-তুই যে ভিজছিস !
-আমগো তো ভেজার অভ্যাস আছে।
-আমারও কিছু হবে না, বলে রাস্তার পাশে রিকশা থামিয়ে পাশের দোকান থেকে একটি পলি ব্যাগ নিয়ে মোবাইল আর মানিব্যাগ ভরে শুরু হল আমার বৃষ্টি ভ্রমন। সংসদ ভবনের পূর্ব দিকে রাস্তা দিয়ে বিজয় সরনির দিকে যেতে যেতে ভিজে একাকার ! সংসদ ভবন ঘেষা মাঠের পাশে সারি সারি গাছ, তাতে অসংখ্য রাধাচূড়া ফুটে আছে! মাঝখানের সাড়িতে বেশ কিছু সেগুন গাছ। ইট, কাঠ, পাথরে ঠাসা দালান কোঠার মাঝে একটু সবুজ, মনকে অনেক সতেজ করে দেয়। একটু এগিয়ে বিজয় সরনির মোড়ে যেতেই ঢাকার বিখ্যাত যানজট !
যানজটে রিকশায় বসে বসে ভিজছি আর মনে বাজছে রবীন্দ্রনাথের গান। বর্ষা আর রবীন্দ্রনাথ, যেন একই সুত্রে গাঁথা। বর্ষা দেখলে রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান মনে বাজবে না এমন সংগীতপ্রেমী বোধকরি নিতান্তই নগন্য। একে একে মনে পড়ে বর্ষা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু বর্ষার গান-
পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে.....
বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল......
আজি ঝরঝর মুখর বাদর দিনে.........
নীল অঞ্জন ঘন কুঞ্জছায়ায় সম্বৃত অম্বর, হে গম্ভীর, হে গম্ভীর......
আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার......
যানজট ছুটে গেলে রিকশা এগুতে থাকে। বিজয় সরনি পার হয়ে চন্দ্রিমা উদ্যানের পাশ দিয়ে যেতে যেতে মনে হল এই তো প্রকৃতির কাছে চলে এসেছি ! দু’দিকেই গাছ গাছালী, সবুজের সমারোহ মনকে ভরিয়ে দেয়। আমার উদাসী মন চলে যায় সেই ছেলেবেলায়-
মনে পড়ে যায় ছেলেবেলায় গ্রামে থাকতে দেখা বর্ষার আসল রুপ। এই ভরা বরষায় গ্রামবাংলা অপরূপ রূপে সাজে। প্রকৃতির স্নিগ্ধতায় মুগ্ধ হয়ে ওঠা বাঙালি বর্ষা আসলেই উৎসবে মেতে ওঠে। বর্ষার পানিতে ভরা মাঠে সবুজ ধানের শীষগুলো হাওয়ায় দুলতে থাকে । থৈ থৈ বর্ষার পানিতে মাঠ ঘাট ডুবে একাকার ! আউস ধানের ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে ছোট ছোট নৌকা কিংবা তাল গাছের ডোঙা করে লোকজনের চলাচল, পুকুর-বিলে ফুটে থাকা অজস্র শাপলা-শালুক, কিশোর-কিশোরীদের বৃষ্টির পানিতে দাপাদাপি আর খুব বেশি মনে পড়ে হলুদ সাদা মিশ্রিত কদম ফুল আর ছোট ছোট লাল হিজল ফুল।
বাদল দিনের এই অঝোর বর্ষণ আমার মনে জাগায় এক পরম স্নিগ্ধ সুরের আবেশ। বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ কানে মধুর মত লাগে। হৃদয়ের আকাশে যেন হুড়মুড় করে নেমে আসে অফুরন্ত আনন্দ । আজ কতদিন পরে বৃষ্টিতে ভিজছি ! মনে পড়ে ছোট বেলায় পড়া ছড়া-
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর
বৃষ্টি নামে মিষ্টি মধুর
বৃষ্টি পড়ে ফোঁটায় ফোঁটায়
জুঁই-চামেলী ফুলের বোঁটায়
বাদলা দিনের একটানা সুর
বৃষ্টি নামে ঝুমুর ঝুমুর।
রিকশা একটু একটু এগুতে থাকে আর আমি দুপাশে তাকিয়ে খুঁজতে থাকি কদম ফুল। নাহ ! নেই। আশে পাশে কোন কদম গাছ চোখে পড়ছে না ! চন্দ্রিমা উদ্যানে দেখা যায় বেশ কিছু মেহগনি আর ইউক্যালিপটাস গাছ, রাস্তার মাঝখানের আইল্যান্ডে ফুটে আছে বেগুনি জারুল। একটু সামনে এগুতেই চোখে পড়ল কৃষ্ণচূঁড়ার সাড়ি। রাস্তার বাম পাশে বেশ কিছু কৃষ্ণচূঁড়া গাছে লাল ফুল ফুটে আছে। ডান পাশের রানওয়েতে ঘন সবুজ ইউক্যালিপ্টাস বাগানের উপর দিয়ে দেখা যাচ্ছে ধূসর খোলা আকাশ, অবিরাম বৃষ্টির ধারায় দূরের গাছগুলোকে ঘোলাটে লাগছে ।
উত্তর আকাশে মেঘ যেন আরও ঘন হয়ে আসছে। মনে পড়ে গেল সতিনাথের গাওয়া সেই বিখ্যাত গানটি- আকাশ এত মেঘলা, যেওনাকো একলা, এখনি নামবে অন্ধকার । আমি মনে মনে হাসি আর ভাবি-এই ঝুম বরষায় পথে তো নেমেছিই, কিসের আবার ভয় !
আজকে এই বর্ষা ভ্রমনে রবীন্দ্রনাথ যেন আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে সারাক্ষণ ! রবীন্দ্রনাথের বর্ষা বুননগুলি আমার মনে ভায়োলিনের অপূর্ব সুরের মূর্ছনা তোলে। বর্ষার কবিতা ও গানে রবীন্দ্রনাথের কোনো বিকল্প নেই। শুধু কবিতা বা গান নয়, রবীন্দ্রনাথের গদ্যসম্ভারেও যে রয়েছে বর্ষা-বন্দনা !
এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়
এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়।।
শ্রাবন নিয়ে কবির লেখা অসংখ্য গানের মধ্যে এই গানটির কথা খুব মনে পড়ছে-
আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে
দুয়ার কাঁপে ক্ষণে ক্ষণে,
ঘরের বাঁধন যায় বুঝি আজ টুটে॥
ধরিত্রী তাঁর অঙ্গনেতে নাচের তালে ওঠেন মেতে,
চঞ্চল তাঁর অঞ্চল যায় লুটে
প্রথম যুগের বচন শুনি মনে
নবশ্যামল প্রাণের নিকেতনে।
পুব-হাওয়া ধায় আকাশতলে, তার সাথে মোর ভাবনা চলে
কালহারা কোন্‌ কালের পানে ছুটে॥
গানটিতে ফুটে ওঠে কবির মহাপ্রয়াণের করুণ সুর। এই শ্রাবণেই বাঙালিকে কাঁদিয়ে ধরিত্রীর বাঁধন কেটে চির বিদায় নেন বাঙালির মনস পটের চির অমর এই কবি।
ভাবতে ভাবতে এক সময় খোলা প্রকৃতি ছেঁড়ে মানুষের ভীড়ে চলে এলাম। আগারগাঁও পার হয়ে আসতেই কমতে থাকে সবুজ, ধীরে ধীরে লোকজনের ভীড় বাড়তে থাকে। কোথাও দেখা যায় লোকজন বৃষ্টি থেকে বাঁচতে বিভিন্ন ভবনের নিচে আশ্রয় নিচ্ছে, কেউ কেউ ছাতা দিয়ে বৃষ্টি থেকে নিজেকে রক্ষার ব্যর্থ চেষ্টা করছে আবার কেউবা আমারই মত কাকভেজা।
বাসার কাছাকাছি আসতেই দেখি বৃষ্টির কল্যাণে গলির রাস্তার অনেক জায়গায়ই পানি জমে আছে। অল্পবয়সী ছেলের দল রাস্তায় ফুটবল খেলছে। মনে মনে ভাবি এমন দিন আমারও গেছে ! মনে আছে ছেলেবেলায় উঠানে পানি জমলে কাগজের নৌকা ভাসিয়ে খেলা করার দৃশ্য। পিয়াসী মন গুনগুনিয়ে ওঠে-
কাগজ দিয়ে নৌকো গড়ে
ভাসিয়ে দেব জলের তোড়ে,
কানমলা আজ কেউ দিবে না
বৃষ্টি ভিজে পড়লে জ্বরে......
শেষ হয়ে এলো আমার অনেক দিনের প্রত্যাশী বৃষ্টি ভেজার আকাঙ্ক্ষা। রিকশা আমার বাসার কাছা কাছি চলে এসেছে। একটু একটু শীত লাগছে।
অবিরাম বৃষ্টির ধারার মধ্যে আমি কাকভেজা হয়ে ফিরে চলি আমার নিত্যদিনের আস্তানায়।

রচনাকালঃ জুন ২৫, ২০১২

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উপন্যাসঃ ফেরা (পর্বঃ ২১ - ২৫ - শেষ পর্ব)

এ ই উপন্যাসটিতে সম্মুখ সমরের কোন ঘটনা তুলে ধরা হয়নি।  ওয়ারফ্রন্টের কোনও দৃশ্য নেই। তবে এই লেখায় মূলত যে গল্পটি বলার চেষ্টা ক রা হয়েছে  তা মু...