মঙ্গলবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০

উপন্যাসঃ ফেরা (পর্বঃ ১৭ - ২০)

ই উপন্যাসটিতে সম্মুখ সমরের কোন ঘটনা তুলে ধরা হয়নি।  ওয়ারফ্রন্টের কোনও দৃশ্য নেই। তবে এই লেখায় মূলত যে গল্পটি বলার চেষ্টা করা হয়েছে তা মুক্তিযুদ্ধের বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। একটি যুদ্ধ নানানভাবে মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে, যার কোনোটিকেই ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। একাত্তরের পঁচিশে মার্চের সেই কালরাত থেকেই নিজেদের পরিবারকে বাঁচানোর তাগিদে মানুষ ঢাকা শহরের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছুটে বেড়িয়েছে কেউ কেউ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ফিরে গেছে নিজ গ্রামে। এই গল্পে তেমনই কিছু মানুষের জীবনযুদ্ধের ঘটনাবলীই তুলে ধরা হয়েছে; যারা নিজেদের পরিবারকে বাঁচাতে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে ফিরে চলে নিজ গ্রামে। এটা মোটেও সহজ ছিলো না। এই ফিরে যাওয়ার গল্পটিই এই উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য।

পর্বঃ  ১৭

চারিদিকে আবছায়া অন্ধকার ঘিরে আছে।  রাত নেমেছে মেঘনার বুকে  ট্রলার চাঁদপুরের খুব কাছে দিয়ে সামনে এগিয়ে চলছে  এখন ঝড় থেমে গেছে সবার মধ্যে স্বস্তিও ফিরে এসেছে তবে একটা বিষয় পরিষ্কার যে, ফজর আলী আসলেই একজন দক্ষ সারেঙ খুব ঠাণ্ডা মাথায় সে জটিল পরিস্থিত সামাল দিয়েছে ছেলেমেয়েরা সবাই আবার সামনের খোলা জায়গায় চলে এলো 

দাদা আমরা এখন কোন জায়গায় যাবো?’ মতিন জানতে চাইলো

‘এই ট্রলারে আমরা মুলাদীর ছবিপুরে যাবো’

‘ছবিপুরে কেন? বরিশাল যাবো না?’

‘ট্রলার বরিশাল শহর পর্যন্ত যাবে না। ছবিপুর থেকে আমাদের অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।’ আমি বললাম।

‘ছবিপুর কতদূর?’

আসাদ ভাই ওকে বুঝিয়ে দিলেনআমাদেরকে প্রথমে মেঘনার ঐ পাড়ে যেতে হবেতারপুর আরও দক্ষিণে গিয়ে ছোটনদী দিয়ে ছবিপুরে যেতে হবে’ 

হতাশ ভঙ্গিতে মতিন বললো, ‘আজ রাত ক’টা বাজবে কে জানে!’

‘এখন আর কিছুই করার নেই। সময় যতই লাগুক, রিস্ক নেয়া যাবে না’ আমি বললাম।

মতিন আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘পাক আর্মি এদিকে আসবে না তো?’

ওর চিন্তা দূর করতে আসাদ ভাই বললেন, ‘রাতে ওদের বের হবার সম্ভাবনা নাই। আমরা ওপারে যেতে পারলে আর ভয় নাই’

এখন সাতটা বাজে। সন্ধ্যা হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। কিন্তু এরই মধ্যে গাঢ় অন্ধকারে ছেয়ে আছে চারপাশ। নিরব-নিস্তব্ধ পরিবেশনা মানুষজন, না কোন নৌকা- কিছুই চোখে পড়ছে নাবিশাল মেঘনার বুকে কেবল আমরা ছুটে চলেছি, নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানেইঞ্জিনের ভটভট শব্দ ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই। ট্রলার মেঘনার তীরঘেঁষে সামনে এগিয়ে চলেছে।

নুরুল ফুপা, বাবা, বড়মামা আর মেজচাচা ট্রলারের ডেকেই নামাজ পড়ে নিয়েছেন। বড়মামা আমার পাশে এসে দাঁড়ালেনচারপাশে তাকিয়ে আমাদের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করছেন। হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,

‘সুরুজ, আমরা এখন কোন জায়গায়? এইদিকে কোথায় যাইতেছি? অন্ধকারে তো কিছুই বুঝতে পারছি না

বড়মামাকে বুঝিয়ে বললাম ‘ঝড়ের কারণে মেঘনার উল্টাপাশে চলে এসেছি। চাঁদপুর ছাড়িয়ে আমরা এখন আরও সামনের দিকে যাচ্ছি। আরেকটু এগিয়ে নদী পার হয়ে ঐ-পাড়ে যাবো।’

বড়মামাকে এখন কিছুটা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। তিনি ছোট্ট করে বললেন, ‘যাক। আল্লাহ শেষ পর্যন্ত রক্ষা করেছেন’। নুরুল ফুপা কাছে এসে বললো,

‘সুরুজ, নামাজ পড়। আল্লাহ এতবড় বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন, তাঁর শুকরিয়া আদায় করো’।

আমি বললাম, ‘জ্বি, ফুপা। পড়বো’

অল্প কিছুদূর এগিয়ে ফজর আলী ট্রলারের মুখ ডানদিকে ঘুরিয়ে দিলো। অর্থাৎ আমরা এখন মেঘনা ক্রস করছি। ফজর আলীর কাছে জানতে চাইলাম ওপারে যেতে কতক্ষণ লাগবে, উত্তরে সে জানালো ঘণ্টাখানেকবেশিও লাগতে পারে।

তারেক অবাক হয়ে বললো, ‘একঘণ্টা!’

‘বিশ মিনিটের জায়গা পার হইতে একঘণ্টা লাগলো। এখন একঘণ্টার পথ তো আর কমাইয়া আনতে পারুম না।’ ভাবলেশহীন ভাবে বললো ফজর আলী।

চন্দন বললো, ‘কিচ্ছু করার নেইআমাদের ধৈর্য ধরতে হবে’

রাত প্রায় দশটা বাজবেবিশাল মেঘনার দিকে তাকিয়ে বললো শফিক ভাই।

আসাদ ভাইয়ের সিগারেটের নেশা পেয়েছে। বড়মামা আর মেজচাচা কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। তাই সে সিগারেট ধরাতে পারছে না। আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, বুড়ো দুইজনকে ফুসলিয়ে ভেতরে পাঠাও। আরাম করে দুইটা টান দিতে পারি। আমি হেসে বললাম, ‘দেখি’।

বড়মামাকে বললাম, ‘মামা, ঠাণ্ডা লাগবে, কেবিনের ভেতরে গিয়ে বসেন’।

‘হ, যাইতেছি’।

বড়মামা আর মেজচাচা কেবিনে চলে গেলে আসাদ ভাই আর সফিক ভাই কেবিনের পেছনদিকে ফজর আলীর কাছাকাছি চলে গেলো। আরেক বিড়িখোর ছোটমামাও পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। 

ছোটচাচা মুচকি হেসে বললো, ‘ভালই তো চালাকী করলিদু’জনে মিলছে ভাল

আমি হেসে বললাম, ‘তুমিও টানবে না-কি? তো যাও’।

‘না, আমি ছেড়ে দিছি’।

আমার মুখটিপে হাসলাম। ‘এই নিয়ে ক’বার ছাড়লে?’

চাচা স্মিত হেসে বললো, ‘এইবার একেবারেই ছেড়ে দিছি। আর খাবো না।

আমি বিজ্ঞের মত মাথা ঝাকিয়ে বললাম, ‘ভালো।’

চন্দন আমার কাছে কাঁধে হাত রাখলো। ‘আজকের অভিজ্ঞতা আমার সারাজীবন মনে থাকবে

চন্দনের কথা শুনে আমার খুব হাসি পেলো। ওকে বললাম, ‘বাঁধাই করে রাখিস।’

মৃদু হেসে চন্দন বললো, ‘বাঁধাই করতে হবে না-রে, এমনিই মনে থাকবে।’

‘জীবনটা আর কতটুকু দীর্ঘ হয় তাই দেখ আগে। তারপর মনে রাখিস’।

‘এইটা ঠিক বলছিস। কখন যে কী হয় কে জানে!’

 নদী এখন সম্পূর্ণ শান্ত। আজ বিকেলে যাত্রা শুরুর সময় যেমন ছিলো, ঠিক তেমনি। আমরা এখন নদীর তীর ছাড়িয়ে ধীরে ধীরে অন্য পাড়ের দিকে চলছি।  এই আবছায়া অন্ধকারে যতদূর পর্যন্ত দৃষ্টি যায় শুধু পানি আর পানি। সেই পানির রঙ কালচে। ঠাণ্ডা একটা হাওয়া বইছে। কিছুটা শীত শীত লাগছে। এই শান্ত মেঘনাকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে মাত্র আধঘণ্টা আগে কী ভয়ঙ্কর রুদ্র রূপটাই ধারণ করেছিলো যেন মেলানোই যায় না। তারেক যেন আমার মনের কথাটা জানতে পেরে গেছে। ও বললো,

‘কী শান্ত-নির্মল এই মেঘনা, অথচ একটু আগে কী চেহারাই না দেখালো’।

ফজর আলীর কথাই ঠিক হলোনদী পার হতে আমাদের একঘণ্টা দশ মিনিট সময় লাগলো। এ যাত্রায় আমরা নিবিঘ্নেই মেঘনা পার হয়ে এলাম। 

ছবিপুর কতদূর?

এখন রাত আটটা। আমাদের নৌকা মেঘনা থেকে অন্য একটা ছোট নদীতে ঢুকে পড়লো মূল মেঘনা থেকে এই ধারাটা কিছুটা সরু হলেও একেবারে কম চওড়া নয়নদীটা ফরিদপুর জেলার পুর্বপাশ দিয়ে বয়ে গেছে। একই ধারা কিছুদূর সামনে গিয়ে আড়িয়াল খাঁ’র সাথে মিলে মুলাদী থানার ভিতর দিয়ে এঁকেবেঁকে বরিশাল শহরের কাছাকাছি গিয়ে সুগন্ধা আর কীর্তনখোলার সাথে মিশেছে। 

ট্রলার একই গতিতে এগিয়ে চলছে। আমি ডানদিকে তাকিয়ে ছিলামসেখানে বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে শুধু শস্যভুমি অনেক দূরে লোকালয়। কালচে ছায়া ছায়া গাছপালার একটা দেয়াল মত চোখে পড়ছে কেবল গ্রামে ইলেকট্রিসিটি নেই, হয়তো হ্যারিকেন বা কুপিবাতি জ্বলছে কোথাও কোথাও কিন্তু গাছপালার আস্তরণ ভেদ করে সেই আলো এতদুরে আসার সুযোগ নেই। 

তারেক এসে জানতে চাইলো, ‘এটা কোন জায়গা?’

‘ডানদিকে ফরিদপুর জেলা এই এলাকার নাম গোসাইরহাট।’

‘এখান থেকে ছবিপুর কতদূর?’

‘প্রায় দেড় ঘণ্টা লাগবে’আসাদ ভাই বললো।   

‘তাইলে তো রাত সাড়ে ন’টা বাজবে

‘হুম।’

তারেক অনেকটা হতাশ কণ্ঠে বললো, ‘জানি না, ঐখানে আবার কী অবস্থা!’ 

অন্ধকার কিছুটা কমে এসেছে। পুরোপুরি স্পষ্ট না হলেও অনেককিছুই এখন দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। বিশাল চর জুড়ে শুধু ফসলের ক্ষেততবে ওখানে কি শস্য চাষ হয়েছে এতদূর থেকে তা ঠিক বোঝা যাচ্ছিলো না। আমি খোলা চরের এদিক ওদিকে টর্চ জ্বেলে দেখছিলাম। মনে হলো তরমুজ আর বাঙ্গি ক্ষেত ওগুলো। 

কেবিন থেকে আনুর কান্নার শব্দ শুনে আমি কেবিনের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মা আনুকে আমার কোলে দিলেন। ‘দ্যাখ তো, কান্দন থামতেছেই না। মনে হয় গরমে এমন করতেছে।’ বাইরে নিয়ে আসতেই ও চুপ। মনে হয় দীর্ঘক্ষণ বদ্ধ জায়গায় থাকার কারণেই কাঁদছিলো। আবছা অন্ধকারে ও কাউকে দেখতে পাচ্ছিলো না। আমার গলা জড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলো।

মহিলারা বাদে সবাই এখন কেবিনের বাইরে ঘোরাফেরা করছে। আধাঘণ্টা হয়েছে মেঘনার শাখা নদীতে প্রবেশ করেছে আমাদের ট্রলার। আসাদ ভাইয়ের কথা অনুযায়ী আরও একঘণ্টা লাগবে ছবিপুর পৌঁছাতে। আমার পেটের মধ্যে ছুঁচোর নাচন শুরু হয়ে গেছে।

আসাদ ভাইকে বললাম, ‘ক্ষুধা লেগেছে, কিছু খাওয়া দরকার’।

‘ক্ষুধা তো আমারও লাগছে। শুকনা কোন খাবার আছে?’ আসাদ ভাই জানতে চাইলো।

বেলা বারোটার দিকে দিঘিরপাড়ের সেই স্কুলে সামান্য কিছু খাওয়া হয়েছিলো। তারপর এই দীর্ঘ সময়ে আর কিছু পেটে পড়েনি কারও। আসলে ঝড়-ঝঞ্ঝা আর অনিশ্চয়তার কারণে খাওয়ার কথা মনেই ছিলো না। আমি তারেককে ডেকে সবাইকে বিস্কুট দিতে বললাম। সকালের কেনা দই-চিড়া রয়ে গেছে কিন্তু পরিবেশনের জন্য তো কিছু নেই। ছবিপুরে পৌঁছে ওগুলোর ব্যবস্থা করা যাবে।

ঠাণ্ডা বাতাসে আরাম পেয়ে আমার কাঁধের উপরেই ঘুমিয়ে পড়েছে আনু। ওকে মায়ের কাছে দিলাম শুইয়ে দেয়ার জন্য। ছেলেরা কেবিনের ছাদে বসে গল্প করছে। আজকের জার্নিটা ওদের জন্য যেন এক অ্যাডভেঞ্চার। ঝড়ের বিষয়টা বাদ দিলে নৌভ্রমণের বাকী সময়টা ওরা এনজয় করেছে। নুরুল ফুপা, বাবা, বড়মামা আর মেজচাচা নামাজ পড়ে নিলেন। ফজর আলী তার সহকারী মানিকের সাথে আলাপ করছে। একটু পরেই মানিক কেবিনের পেছনে কিছু একটা চেক করে আবার তার ওস্তাদকে জানালো। আমি কেবিনের পাশ দিয়ে ফজর আলীর কাছে গেলাম।

‘এখন আমরা কোথায় আছি ফজর আলী ভাই?’

‘এখনও মেঘনায় আরও অনেক সামনে গিইয়া আড়িয়াল খাঁ নদীতে পরুম।’

‘এই চর শেষ হলেই তো ছবিপুর, তাই না?’

‘হ। কিন্তু পথটা সোজা না, ঘুরপথে যাইতে হইবো। তাই সময় কম লাগবে না’

‘ও, আচ্ছা।’

‘ভাই, আরেকটা বড় ঝামেলা হইয়া গেলো যে!’

আমি সামনের দিকে আসতে গিয়েও আবার ফিরে তাকালাম। ‘মানে! কী হয়েছে?’

‘তেল তো শ্যাষ প্রায়। আর বেশিদূর যাওয়া যাইবো না’

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ছবিপুর পর্যন্ত যাওয়া যাবে না?’

‘না। আর বেশিক্ষণ ট্রলার চলবে না।’

‘তাইলে! এখন কী হবে?’

‘সেইটাই তো ভাবতাছি। তুফানের লাইগ্যাই এই ঝামেলাডা হইলো’

‘এখন কি করা যাবে?’

‘তেল ছাড়া তো ট্রলার চলবে না।’

‘আর কতদূর যাওয়া যাইবো?’

‘বেশি না। বড়জোর মিনিট পাঁচেক চলবে

‘ছবিপুর আর কতদূর?’ আমি জানতে চাইলাম।

‘প্রায় একঘণ্টা লাগবে।’

আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। এতরাতে মাঝপথে তেল শেষ হলে তো বিপদছোটবড় এতগুলো মানুষ নিয়ে আবার আটকে পড়বো। সামনে এসে ছোটমামা আর আসাদ ভাইয়ের সাথে আলাপ করলাম। আসাদ ভাই বললো, ‘অসুবিধা কী? আমরা ট্রলারেই থাকবো। সকালে সারেঙের লোক তেল নিয়ে আসলে আবার ট্রলার ছাড়বে’। আমি ভাবছি অন্য কথা। শাখা নদী হলেও এটি কিন্তু মেঘনাই। মূল নদীতে ঝড় হলে এখানেও যে তার আঁচ লাগবে আমার চিন্তার কারণ শুনে ছোটমামা বললো, ‘এত চিন্তা করিস না। সমস্যা যখন হবে তখন দেখা যাবে’। 

পর্বঃ  ১৮

হঠাতই ট্রলার থেমে গেলো।  চরে নোঙর করালো। সারেঙের সহকারী কাউছার চরে নামতেই সবাই বুঝে গেলো কোন সমস্যা হয়েছে। ফজর আলী সামনের দিকে চলে এলো। বড়মামা আসাদ ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন,

‘কি হয়েছে? নৌকা থামালো কেন?’

‘তেল শেষ।’

‘এইটা কেমন কথা! এত দূরের পথ, সারেঙ বেশি করে তেল নিয়া নিবে না?’

‘বললো তো তেল কম ছিলো না, ঝড়ের কারণে বেশি খরচ হইছে।’

‘এখন কী হবে?’

‘কী আর হবে! সকাল না হওয়া পর্যন্ত তেল আনা সম্ভব না। অপেক্ষা করতে হবে।’

 একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বড়মামা বললেন, ‘আল্লাহই জানে সামনে আর কি কি বিপদ অপেক্ষা করছে’।

          ট্রলারে দাঁড়িয়ে চরটাকে ভালভাবে দেখছিলাম। তীর থেকে অনেক দূরে ক্ষেতের মাঝে টিমটিমে আলো চোখে পড়ছে। আসাদ ভাই আমাকে বললো, ‘চলো, ওখানে গিয়ে দেখি কেউ আছে কি না’ সারেঙের সহকারী কাউছার এখনও চরে ঘোরাঘুরি করছে আমরা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ট্রলার থেকে নেমে এলাম। তারেকও আমাদের পিছু পিছু আসছে।

আমি বললাম, ‘সাবধান! আবারর পড়ে যাস না।’

তারেক হেসে জবাব দিলো, ‘আরে দূর! কত বাঁশের সাঁকো পাড় হলাম, আর এইটা তো কাঠের সিঁড়ি।’

আমি ঘুরতে যাবো ঠিক এমন সময় অঘটনটা প্রায় ঘটেই যাচ্ছিলো। আসাদ ভাই তারেকের হাতটা ধরে না ফেললে এতক্ষণে ওর স্থান হতো নদীতে! তীরে এসে ও আমার দিকে আর তাকাচ্ছিলো না। ছোট্ট করে শুধু বললো, সিঁড়িটা ঠিকমত বসানো হয়নি। আমরা কেউ আর কিছু বললাম না।

নদী থেকে বেশ কিছুদূর পর্যন্ত বালুমাটি, তারপর তরমুজের ক্ষেত। ‘ক্ষেতে কী তরমুজ আছে না-কি শুধু গাছ!’ আমার কথা শুনতে পেয়েই কাউছার ক্ষেতের মধ্যে খুঁজতে লাগলো। একটু পরই হাসিমুখে এসে জানালো,

‘ছার, বড় বড় তরমুজ আছে। খাইবেন?’

আমি ধমকের সুরে ওকে বললাম, ‘খাবো মানে! কার জমির তরমুজ খাবো?’

‘ছার, কত মাইনষ্যে খায়! এই রাইতে কেডা দ্যাখবো?’

আমি রেগেমেগে বললাম, ‘খবরদার! অন্যের ক্ষেত থেকে তরমুজ ধরবে না।’

কাউছার অনেকটা চুপসে গিয়ে বললো, ‘ঠিক আছে।’

আসাদ ভাই বললো, ‘দেখো তো, ঐ যে আলো দেখা যায় ওখানে যাবার কোন রাস্তা আছে না-কি।’

কাউছার সামনে এগিয়ে গেলো।  কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে জানালো, ‘ছার, যাওন যাইবো।  ক্ষেতের মধ্যে দিয়া পথ আছে।  যাইবেন?’

আমি জানতে চাইলাম কতক্ষণ লাগবে। কাউছার আমত আমতা করে বললো, ‘বিশ-পচিশ মিনিট লাগতে পারে।’

তারেক বললো, ‘দাদা, চলেন। ’

চারিদিকে সুনসান নিরাবতা। ফাঁকা নদীতে নোঙর করা ট্রলার, নদীর দু’পাশেই চরাঞ্চল খাঁ-খাঁ করছে। এত রাতে অজানা-অচেনা জায়গা, মহিলা, বাচ্চারা ও বয়স্কদের ট্রলারে রেখে দূরে যাওয়া ঠিক হবে কী? আমি ট্রলারে উঠে সফিক ভাই আর ছোটমামার সাথে কথা বললাম। ছোটমামা বললো, ‘তুই এত চিন্তা করিস কেন? আমরা আছি না। ’ আমি হেসে ট্রলার থেকে নেমে গেলাম। 

বৃষ্টির কারণে ক্ষেতের মাটি এবং তরমুজ গাছগুলো ভেজা। আমাদের জুতা আর প্যান্টের নিম্নভাগ ভিজে একাকার। আমার আগে আগে হাঁটছে তারেক আর পেছনে আসাদ ভাই। কিছুদূর এগোনোর পর হঠাৎ আমি স্থির দাঁড়িয়ে গেলাম। সারা শরীরে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেলো। একটা শিরশিরে অনুভূতি হচ্ছিলো তখন।

পেছন থেকে আসাদ ভাই বললো, ‘কী হয়েছে? থেমে গেলে যে!’

আমি আসাদ ভাইয়ের হাত চেপে ধরে আস্তে করে বললাম, ‘তারেক দাঁড়া। ’

তারেক দাঁড়াতেই পায়ের উপর ঠাণ্ডা চলমান জিনিসটি থেমে গেলো।

আমি আসাদ ভাইকে বললাম, ‘আমার পায়ের দিকে আলোটা ফেলেন তো

তিনি সেখানে আলো ফেলতেই একটা ঘাম দিয়ে শিরশিরে অনুভূতিটা চলে গেলো। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। আসাদ ভাই বুঝে গেলো ব্যাপারটা। তার দিকে তাকাতেই হো হো করে হেসে ফেললো।

আমি তাকে থামাতে তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, ‘আরে ভাই এইরকম ক্ষেতের মধ্যে অন্ধকারে কারো পায়ের উপর দিয়ে যদি ঠাণ্ডা সরু কোন বস্তু চলে যায় তখন কী আপনে ভয় পাবেন না?’

আসাদ ভাই হাসি থামিয়ে বললো, ‘না না ঠিক আছে। যে কেউ ভয় পেতো। আমি শুধু তোমার তখনকার মনের অবস্থাটা আমি চিন্তা করতেছি। তোমার হার্টবিট এখন ঠিক আছে তো?’

আমি হেসে ছোট্ট করে বললাম, ‘হুম’।

তারেক আর কাউছার আমাদের দিকে হাঁ হয়ে তাকিয়ে আছে। ওরা আসলে কিছুই বুঝতে পারেনি। তারেক খুব কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইলো ঠিক কি হয়েছিলোওদেরকে আর কিছু বলিনি। কাউছারকে বললাম, ‘সামনে হাটো’।

আবার চলতে শুরু করলাম। আর কিছুদূর সামনে যেতেই দেখতে পেলাম উল্টোদিক থেকে একটা টর্চের আলো আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে।  আমরা আর এগোলাম না, ওখানেই দাঁড়িয়ে ওদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। পাঁচ-ছয় মিনিটের মধ্যে দু’জন লোক এসে হাজির হলো। আমরা এখানে আটকে পড়ার বিষয়টি খুলে বললাম। লোক দু’জন সব শুনে জানালো এখান থেকে কাছাকাছি কোন লোকালয় নেই। বৃষ্টিতে পায়ে হাঁটা পথটাও ভিজে আছে। এই রাতে আমাদের পক্ষে বয়স্ক লোকজন ও বাচ্চাদের নিয়ে লোকালয়ে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তাদের একজন বললো,

‘আপনারা নৌকাতেই থাকেন। ঐ বাজারে তেল পাইবেন। লোকটি হাত দিয়ে দক্ষিণদিকে নির্দেশ করলো। সকাল হইলে একজন গিয়া তেল নিয়া আসলে এই নৌকা নিয়াই ছবিপুর যাইতে পারবেন।’

আমি জানতে চাইলাম, ‘এখান থেকে বাজার কতদূর? ওখানে খাবার পাওয়া যাবে?’

লোকটি উত্তর দিলো, ‘বেশি দূর না। হাইটা গেলে বিশ-পচিশ মিনিট লাগবো। তয় সকাল নয়টার আগে দোকান খোলা পাইবেন না। আপনেরা সাড়ে ন’টার দিকে লোক পাঠাইয়া দিয়েন। বাজারে হোটেলও পাইবেন।’

কাউছার তরমুজের প্রসঙ্গ তুলতেই তারেক জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনেরা তরমুজ বিক্রি করেন?’

লোকটি সহজ সরল হাসি হেসে বললো, ‘দ্যাশের এই অবস্থায় তরমুজ কিননের মানুষ কই? কয়দিন পরে ক্ষেত থেইক্যা তরমুজ তোলার মানুষই তো খুইজা পাওন যাইবো না। আপনাগো কয়ডা লাগবো কন, কাইটা দিতাছি।’

আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘না না এমনিতে দেয়ার দরকার নাই। আপনাদের কষ্টের ফসল। আমরা কিনেই নেবো।’

‘আপনাগো কয়ডা লাগবো কন।’

তারেক বললো, ‘চারটা দেন। অনেক লোক তো। ’

লোকটি বললো, ‘নদীর পাড়ে চলেন। এইখান থেইক্যা টাইনা নেওনের দরকার নাই।  তীরের কাছাকাছি জায়গা থেইক্যা কাইট্টা দিতাছি।’

লোকটি নদীর পাড়ের কাছাকাছি জায়গা থেকে বেছে বেছে চারটি তরমুজ কেটে দিলো।  বেশ বড় সাইজের। কোনভাবেই দাম নিতে চাইছিলো না।  শেষে অনেক বুঝিয়ে দু’টো তরমুজের দাম দিলাম।

লোকটি টাকাটা লুঙ্গির ভাঁজে রাখতে রাখতেই ক্ষেত থেকে আরেকটা তরমুজ কেটে তারেকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, ‘কত মানুষ চুরি কইরা নিয়া যায়! এইডাও লগে নিয়া যান, পরে খাইতে পারবেন।’

আমি লোকটিকে ধন্যবাদ দিয়ে ট্রলারে উঠে গেলাম। কাউছার আর বড়মামার কাজের ছেলে মনা মিলে তরমুজগুলোকে ট্রলারে তুলে নিলো। সফিক ভাই অবাক হয়ে বললো,

‘আরে! করেছো কী? তোমরা তো তরমুজের বন্যা বইয়ে দিলে! এত তরমুজ খাবে কে?’

আমি হেসে উত্তর দিলাম, ‘আমরা কতজন মানুষ হিসেব আছে সফিক ভাই?

ইতিমধ্যে মা আর বড়মামী মিলে সারেঙের কাছ থেকে গামলা আর প্লেট নিয়ে দই-চিড়া পরিবেশনের ব্যবস্থা করে ফেলেছেনক্ষেতের ফ্রেশ পাকা তরমুজ আর দই-চিড়া দিয়েই সে রাতের আহার সারলাম।

রাত দশটা বেজে গেছে। ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় শীত শীত লাগছে। ট্রলারের বেশির ভাগ মানুষই এখনও ডেকের উপরে ঘোরাঘুরি করছেপরিষ্কার নীল আকাশের বুকে আধভাঙা চাঁদ স্থির জেগে আছে। তাঁর হালকা রূপালি ছায়া পড়েছে নদীর জলে।  ছেলেমেয়েদের জন্য এ এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা।  কেউ কেউ খুব মজা পাচ্ছে।  আমার কেবলই চিন্তা হচ্ছে আগামী দিনগুলো নিয়ে, যা পুরোপুরি অনিশ্চয়তায় ভরা

দাদা আর ছোট ছোট বাচ্চারা কেবিনের ভেতরে ঘুমিয়ে পড়েছে। দাদী, বাবা আর বড়মামা ওদের পাশে বসে কথা বলছেন মা, বড়মামী আর মেজচাচী ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। বড় আপা, মিনু ফুপু আর রানু কেবিনের ভেতরে বসেই কি নিয়ে যেন হাসাহাসি করছে। মতিন, হাসান, তুলি, সুমন আর তানিয়াকে দেখে মনে হচ্ছে আজ রাতে ওদের না ঘুমালেও চলবে।

তারেক আমার পাশে দাঁড়িয়ে বললো, ‘দাদা, আমার কিন্তু দারুণ লাগতেছে। দুই দিকেই সবুজ শস্যভরা ক্ষেত, আকাশে আধখানি চাঁদ, খোলা আকাশের নিচে নদীতে নৌকায় রাত কাটানোর মজাটাই তো অন্যরকম।’

‘যে কোন ভাললাগার একটা সময়সীমা থাকে। অনেক সুন্দর জিনিসের দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকলে সেই সৌন্দর্যের অনুভূতিটা ক্রমশ ম্লান হয়ে যায়। দ্যাখ কতক্ষণ তোর এই নৌভ্রমণ ভাল লাগে।’

‘তুমি দেখি দার্শনিকের মত কথা বলছো!’ তারেক নদী থেকে দৃষ্টিটা আমার দিকে ঘুরিয়ে মিটিমিটি হাসছে।

আমি ওর কাঁধে হাত রেখে বললাম, ‘আরে ছোটভাই, এটা দর্শন না। এই হলো বাস্তবতা। কিছুক্ষণ পরই টের পাবি।’

তারেক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ‘ঢাকার বাসার কথা খুব মনে পড়ছে। কবে যে আবার ফিরতে পারবো!’

‘হুম, মনে তো পড়বেইসারাজীবনের স্মৃতিবিজড়িত স্থানমিলিটারীদের মুখ মনে পড়ে না?’

ও চট করে আমার দিকে ঘুরে তাকালো। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বললো, ‘ভুলিনাই দাদা, ঐ হারামিগুলার মুখ কী ভোলা যায়! প্রতিশোধ নিতে হবে। তুমি আমাকে ফেলে যুদ্ধে যাবে না।’

‘হুমকিন্তু তোর বাপধনকে কে সামলাবে?’

‘কাউকেই সামলাতে হবে না। দেশের এই দুর্দিনে অনেক বাপের ছেলেকেই যুদ্ধে যেতে হবে। এতকিছু চিন্তা করলে দেশের হয়ে লড়বে কে? সময়ে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’ তারেক খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো।

আমি খুব শান্ত, ধীরস্থিরভাবে বললাম, ‘তারেক, সুন্দর সুন্দর ভাবনা মনকে আন্দোলিত ঠিকই করে কিন্তু বাস্তবে একটা জটিল পরিস্থিতি সামাল দেয়া এক কথা নয়। বাস্তবটা বড় কঠিন। এটা যুদ্ধ। সম্মুখ সমরে সশস্ত্র ট্রেইন্ড বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবেএখানে সাহসিকতা, দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তা সবকিছুর সমন্বয় দরকার।  সেই মানসিক প্রস্তুতি কী তোর আছে? ঠাণ্ডা মাথায় ভালোভাবে চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নে।’

‘না দাদা। এত চিন্তা করে কোন লাভ নাই। কিছু কিছু বিষয় মানুষ কাজ করতে করতেই শিখে নেয়। ট্রেনিঙ ছাড়া তো আর কাউকে ওয়ার ফ্রন্টে পাঠাবে না।  ট্রেনিঙেও অনেককিছু শিখে নেয়া যাবে।  তাছাড়া তোমরা তো আছোই।  বাকীটা তোমাদের হেল্প নিয়ে করে ফেলবো ইনশাল্লাহ।’

আমি ওর কাঁধে হাত রেখে হাসতে হাসতে বললাম, ‘বুঝলাম তুই বড় হয়ে গেছিস।’

তারেক আমার হাত ধরে বললো, ‘আমি বড় হইলেও তুমি কিন্তু আমার আইডল।  ছোটবেলা থেকেই তোমাকে ফলো করতে করতে বড় হয়েছি।  এখন এই কঠিন সময়েও তোমার সাথেই থাকতে চাই।’

তারেকের কথা শুনে আমি হেসে ফেললাম।  আসাদ ভাইকে দেখলাম কেবিনের পেছন দিকে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে।  এই বান্দা কত প্যাকেট সিগারেট নিয়ে এসেছে কে জানে! ট্রলার এখানে থামার পর তো মনে হয় দশটা সাবাড় করে দিয়েছে। চারদিক থেকে মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে। আমি বুক ভরে সেই নির্মল বাতাসে নিঃশ্বাস নিচ্ছি। সফিক ভাই এসে আমাদের পাশে দাঁড়ালেন।

‘তো শালাবাবুরা, কী শলাপরামর্শ হচ্ছে? আমি কি তোমাদের সাথে যোগ দিতে পারি?’

তারেক তাড়াতাড়ি বলে উঠলো, ‘দুলাভাই, তেমন কিছু না। এমনিই গল্প করছিলাম।  রাতে তো আর ঘুমানো যাবে না।’

মৃদু হেসে শফিক ভাই বললেন, ‘আমার মনে হয় আরও একটা রাত তোমাদের বাইরে কাটাতে হবে। তারপর বাড়িতে গিয়ে আরামে ঘুমিও

আমি সফিক ভাইকে সমর্থন করে বললাম, ‘সামনে এখনও অনেকটা পথ বাকী। এখনও লম্বা নদীপথ পার হতে হবে। একরাত তো লাগবেই। বেশিও লাগতে পারে।’

 

পর্বঃ  ১৯

নদীতে নৌকায় ঘুরে বেড়ানো আনন্দময় কিন্তু এরকম নির্জন ফাঁকা জায়গায় একটা স্থির নৌকায় ঘন্টার পর ঘণ্টা সময় কাটানো একঘেয়ে আর বিরক্তিকর।  অন্তত আমার কাছে। সকাল না হওয়া অবধি অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের তো আর কিছু করার ছিলো না।  তাই নিজেদের মধ্যে গল্প-গুজবের মাধ্যমে পরিবেশটা চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করছিলাম। বড় আপাকে দেখলাম কেবিন থেকে বেরিয়ে আসছে। আমাদের কাছে এসে বললো,

‘বাইরে তো বেশ ঠাণ্ডা, রুমটার ভেতরে ভ্যাঁপসা গরম। অসহ্য লাগছিলো।’

আমি জানতে চাইলাম, ‘মা ঘুমিয়েছে?’

‘এইমাত্র ঘুমিয়ে পড়েছে। বেচারী নাতি-নতনী নিয়ে খুব ঝামেলায় আছে। আনু আর শিলাকে অনেক কষ্টে ঘুম পাড়ানো হয়েছে। মিজানের ছেলেটাও খুব জ্বালাচ্ছিলো।’

‘ভেতরে গরম তো, তাই এমন করছিলো।’ সফিক ভাই বললো।

‘আপা এদিক ওদিক তাকিয়ে জানতে চাইলো বাকী বাচ্চারা কই রে?’

‘কয়েকজন কেবিনের ছাদে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাকীরা গল্পে মশগুল। দ্যাখো, তোমারটাও ওখানে আছে কি না

সেদিকে তাকিয়ে আপা হেসে ফেললো, ‘ওরাই তো আরামে আছে।’

ছোটমামা আমাদের দিকে এগিয়ে এলো। আপাকে উদ্দেশ্য করে হেসে বললো, ‘শিউলী খালা, ভ্রমণটা কেমন লাগছে?’

‘খুব আরামে নিয়া আসছো তোমরা। এমন আরাম যে সবার ঘুমই হারাম হয়ে গেলো!’ আপা ব্যঙ্গাত্মক হাসি হেসে বললো।

‘যুদ্ধের মধ্যে বাড়ি যে যেতে পারছো তাই শুকরিয়া করো। আবার ঘুমাতে চাও! বাড়িতে গিয়ে দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা ঘুমাইও’ ছোটমামাও ঠাট্টাচ্ছলে বললো।

বড় আপা কপট রাগের ছলে বললো, ‘এই ছোটু, মনে রাখিস, তোদের বাড়ি গিয়া আমি তোর রুমটাই দখল করবো।’

ছোটমামা মিটিমিটি হাসছে। ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। তাই কইরো।’

আমাদের উল্টাদিকে কেবিনের পাশে দাঁড়ানো দু’টো নারীমুর্তির দিকে ইশারা করে আপা বললো, ‘দ্যাখ মিজান, তোর বউয়ের সাথে তুলির কী ভাব! যেন দুই বান্ধবী।’ বলেই আপা হাসতে লাগলো।

ছোটমামা আপার কথার সমর্থনে বললো, ‘হ্যা। ওদের এই সম্পর্কটা তো আমাদের বিয়ের দিন থেকে এমনই দেখে আসছি। মন্দ কী! চাচী-ভাতিজীর এমন সুন্দর সম্পর্ক থাকা তো ভালই।’

তারেক আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললো, ‘দাদা, সবচেয়ে মজার এক জুটিকে লক্ষ করেছো?’

আমরা ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ফিরতেই ও ট্রলারের একেবারে সামনের দিকে ইশারা করলো। আলো অন্ধকারে ঠিকমত বোঝা যাচ্ছিলো না। একটু ভালমত দেখতেই বুঝলাম ঐ দু’জন চন্দন আর উষা। তারেক সহাস্যে বললো,

‘আমি অনেকক্ষণ থেকেই লক্ষ করছি দুজনকে। ওরা যেন মধুচন্দ্রিমায় এসেছে।’

আপাও মিটিমিটি হাসছিলো। হঠাৎ তারেকের কান ধরে বলে উঠলো, ‘খুব পেকেছিস না? বড়দের নিয়ে ফাজলামি!’

তারেক কাঁদো কাঁদো স্বরে বলছে, ‘উহ! দারোগা আপু, লাগছে তো!’

আপা হাসতে হাসতে ওর কান ছেড়ে দিলো। তারেক যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। আপার হাত থেকে ছাড়া পেয়ে বললো, ‘আরে ভাই আমার কী দোষ! আমি যা দেখলাম, তা-ই তোমাদের দেখালাম।’

‘হয়েছে, আর পাকামি করতে হবে না।’ আপা কপট রাগের ছলে বললো।

‘উহ! পুরো একদিন মনে হয় আমার কান ব্যথা করবে।’

আপা ফিক করে হেসে ফেললো। আপার হাসি দেখে তারেক কিছুটা পিছিয়ে গেলো। ‘তোমার এই হাসি দেখে কে বলবে তুমি একজন মহিলা দারোগা!’ বলেই দৌড়ে সরে গেলো ও। আমরা সবাই হো হো করে হেসে ফেললাম।

এমন হাসি ঠাট্টায় রাতটা ফুরিয়ে গেলো। নুরুল ফুপা বাইরে এসে আমাদেরকে ফজরের নামাজের জন্য ডাকলেন।

আমি কিছুটা অবাক হয়ে বললাম, ‘ফজরের ওয়াক্ত হয়ে গেছে?’

আসাদ ভাই ঘড়ি দেখে বললো, ‘হ্যা। নামাজের সময় হয়েছে।’

অন্ধকার তখনও কাটেনি। লোকালয়ে আযান হলেও এখান থেকে শুনতে পাবার কথা নয়।  ছোটমামা, আমি আর সফিক ভাই ফুপাদের সাথে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলাম। নামাজ শেষে দেখলাম বাবা আর মেজচাচা নিচুস্বরে আলাপ করছে।  আমি জিজ্ঞেস করলাম কোন সমস্যা হয়েছে কি-না। বাবা জানালো তিনি ঠিক আছেন কিন্তু দাদার শরীরটা ভাল না।  কাল রাতে কিছুই খায়নি।  শুধু ছটফট করেছে। আমি বললাম, ‘ভয় পাওয়ার কিছু নেই।  এ ক’দিনের রাস্তার ধকল, তারপর এই বদ্ধ কেবিনে লম্বা সময় থাকার জন্য হয়তো এমন হচ্ছে।  বাড়ি গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।  বাবা আর মেজচাচা কিছুটা শান্ত হলো।

তবে কেন জানি মনে হয় আমার অষ্টাশি বছরের বৃদ্ধ দাদা সবকিছুই বুঝেছেন। তিনি চোখে দেখেন না, কানেও শোনেন না; কিন্তু সবকিছু অনুভব করতে পারেন।  এই যে ওঁকে কাঁধে করে এতদূর ছুটে চলা, ঝড়-ঝঞ্ঝা সহ্য করে মেঘনা পাড় হওয়া।  নিজস্ব উপলব্ধি থেকে এই দুর্যোগপূর্ণ অবস্থাটা বুঝে গেছেন।  তাই এমন অস্থির হয়ে উঠেছেন।

চারিদিক ফর্সা হয়ে এসেছে, তবে সূর্য ওঠেনি তখনও  খোলা নদীর বুকে নীরব নিস্তব্ধ পরিবেশে একটি চমৎকার সকালের শুরু।  আমাদের এখনও অনেক সময় এই চরেই অপেক্ষা করতে হবে।  সাড়ে ন’টায় বাজার খুললে তেল নিয়ে আসবে, তারপর ছবিপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হবে।

৮ই এপ্রিল, ১৯৭১

সকাল আটটা। ট্রলারের ডেকে উপস্থিত আমরা বেশির ভাগই নির্ঘুম রাত কাটিয়েছিযে ক’জন কেবিনে ঘুমিয়ে পড়েছিলো, ইতিমধ্যে তারাও জেগে উঠেছে।  চরে স্থির ট্রলারে দাঁড়িয়ে আমরা সময়ের হিসেব কষছি। ন’টা বাজলে বাজারে লোক পাঠাবো তেল আর সকালের নাস্তা নিয়ে আসার জন্য।  বেলা দশটা- সাড়ে দশটার আগে এখান থেকে যাত্রা শুরু হচ্ছে বলে মনে হয় না। ছেলেমেয়েদের অনেকেই চরে নেমে হাঁটাহাঁটি করছে। এখন নদীর  দু’দিকই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। চরের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে শুধু সবুজ আর সবুজ। তরমুজ, খিরাই আর বাঙ্গি ক্ষেত। ছেলেমেয়েদের নিষেধ করে দেয়া হয়েছিলো যেন ক্ষেতের কোন শস্যে হাত না দেয়। ওরা আমাদের নির্দেশ অমান্য করেনি। নদীর পাড়ে ঘুরে বেরিয়ে সময় কাটাচ্ছে।  

ন’টা বেজে গেছে। সারেঙের সহকারী মানিক আর বড়মামার কাজের ছেলে মনাকে বাজারে পাঠানো হলো।  চরে ঘোরাঘুরি করা ছেলেদের মধ্যে কেউ কেউ যেতে চাইলো।  আমি শুধু মতিনকে ওদের সাথে যেতে দিলাম।

সূর্য ক্রমশ তাঁতিয়ে উঠছে। কেবিনের ভেতরে দাদা অস্থির হয়ে পড়েছে। বাবা চিন্তিত মুখে আমাকে ডাকলেন। আমি বললাম, ‘দাদাকে বাইরে নিয়ে আসেন। খোলা জায়গায় কিছুক্ষণ থাকলে ঠিক হয়ে যাবে।’ মেজচাচা তাঁকে বাইরে এনে ডেকের উপরে বিছানো চাদরে বসিয়ে দিলেন। ঠাণ্ডা হাওয়ায় দাদা কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এলেন। আমি বললাম, ‘কাল রাতে কিছু খায়নি, খাবার থাকলে দাদাকে কিছু খেতে দেন।’ দাদী চিড়া ভিজিয়ে কলা দিয়ে মেখে দিলেন। মেজচাচা দাদাকে খাওয়াচ্ছেন।

কেবিনের ভেতরে রানু আনুকে সামলাতে পারছিলো না। মা ওকে কোলে নিয়ে বাইরে আসতেই চুপ। আমি আনুকে কোলে তুলে নিলাম। ট্রলারে ওঠার পর রানু এই প্রথম কেবিনের বাইরে এলো। ওকে দেখেও মনে হলো ও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বললো,

‘এখানে কী সুন্দর ঠাণ্ডা বাতাস, আর রুমটার ভেতরে গরমে বসা যায় না।’

‘তা রাতে কেবিন থেকে বের হলে না কেন?’

রানু মৃদু হেসে বললো, ‘এমনিই।  কে কি মনে করে তাই।’

আমি হাসলাম। রানু আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আসলেই রাতে বের হতে পারতাম।  তাহলে আর এত কষ্ট পেতে হতো না।’

আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম। ‘রানু বেগম, একটু পরে রোদের তাপ বাড়বে, তখন এখানেও থাকা কষ্টকর হয়ে যাবে।’

‘তবুও তো বাতাস থাকবে।’

আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। তারপর আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘খুব কষ্ট হচ্ছে, না?’

রানু চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকালো। ‘ঝড়ের সময় যা ভয় পাইছিলাম! একেকবার তো মনে হয়েছিলো এই বুঝি শেষ। মেঘনা নদীতেই সবাই ডুবে মরবো।’

আমি হেসে বললাম, ‘আর?’

‘যাই বলো না কেন, মা খুব শক্ত মনের মানুষ। কেবিনের ভেতরে আমরা তো ভয়ে এতটুকুন হয়ে ছিলাম। মা আমাদের সবাইকে সাহস যুগিয়েছেন।’

আমি ওকে সমর্থন করে বললাম, ‘মা তো বরাবরই এরকম।’

 ‘তোমার ভয় লাগেনি?’

আমি ছোট্ট করে বললাম, ‘না।’

রানু হাসলো আর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললো, ‘তা বীরপুরুষ, আর কতদিন লাগবে বাড়ি পৌঁছাতে?’

আনু হঠাৎ ওর মায়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। আমি ওকে রানুর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললাম, ‘ধরো আরও দু’দিন।’

‘আর ভাল্লাগছে না। এবার বাড়ি পৌঁছাতে পারলেই বাঁচি।’

আমাদের কথার মাঝেই চন্দন আর উষা এগিয়ে এসে পাশে দাঁড়ালো। আমি উষার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘কী কুলসুম বানু, ভয় কাটছে?’

উষা সলজ্জ হাসি হেসে বললো, ‘হ্যাঁ। এখন অনেকটাই চিন্তামুক্ত।’

আমি হেসে চন্দনের দিকে তাকালাম। ‘তা চান মিয়া, কাল রাতে মধুচন্দ্রিমা কেমন হলো? তোমাদের যাতে ডিস্টার্ব না হয়, এজন্য আমি কিন্তু কাউকে ও-দিকে যেতে দেইনি’

উষা লজ্জা পেলো। চন্দন আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো, ‘তোমরা কাল রাতে আমাদের নিয়ে মজা করেছো, না?’

‘খুব একটা না। তবে কেউ কেউ তোমাদের ব্যাপারটা খেয়াল করেছে।’

রানু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো ওর এই বুঝতে না পারার ব্যাপারটা আমি বেশ উপভোগ করছিলাম আর মিটিমিটি হাসছিলাম  আমার দিক থেকে উষার দিকে দৃষ্টি ফেরাতেই দেখলো লাজুক হাসি হেসে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে উষা শেষে কাউকে কোন প্রশ্ন না করে রানু প্রসঙ্গটা চেঞ্জ করলো।

‘বড়মামা ভাল দুইটা নাম দিছে।  চান মিয়া আর কুলসুম বেগম!’

কথা ঘুরে যাওয়ায় উষা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। মাথা নিচু করে বললো, ‘আগে জানটা তো বাঁচুক, নাম দিয়া আর কী হইবো!’

আমি নদীর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘হুম।  জানের কত মায়া!’

চন্দন বললো ‘সামনে কিন্তু এখনও নদী আছে। ওগুলো পার হতে হবে।  তারপর পায়ে হাঁটা পথ তো আছেই।’

‘হুম, তা জানি। কিন্তু ওগুলো তো মেঘনা না। তাই অত ভয়ের কিছু নাই।’ উষা সরল হাসি হাসলো।

রানু মৃদু হেসে বললো, ‘এখন কুলসুম বেগমের মুখে হাসি ফুটছে, সেদিন যদি একবার ওর মুখটা দেখতে! কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছিলো।’

‘এদিকে চান মিয়ার অবস্থাও খুব একটা ভালো ছিলো না।  মৃত্যুভয়ের সাথে সাথে ছিলো কুলসুম বিরহের যন্ত্রণা।’ 

চন্দন আমতা আমতা করে বললো, ‘ভয় পাইছিলাম এটা ঠিক, তবে বিরহকাতর ছিলাম না।’

চন্দনের কথা শুনে আমরা তিনজনেই হেসে ফেললাম। উষা অবশ্য রানুর দিকে তাকিয়ে চোখ নাচিয়ে কি যেন বলছিলো। আমি চোখের ইশারায় রানুর কাছে জানতে চাইলাম, ‘কি, কাহিনী কী? ও কি বলছে?’

রানুর বদলে উষাই মুখ খুললো।  ও রানুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,

রানুদি, আরেকজন সাহসী নারীর কি অবস্থা হয়েছিলো যেন?’

রানু হাসতে হাসতেই জবাব দিলো, ‘হ্যাঁ, ভয় তো সবাই-ই পেয়েছিলো, শুধু আমাদের কুলসুম বানুর চোখ দুটো ফুলে লাল হয়ে গিয়েছিলো

মাত্র ছ-মাস আগে চন্দন-উষার বিয়ে হয়েছে।  উষাদের বাড়ি রানুদের গ্রামে।  রানু আগে থেকেই উষাকে চিনতো। একই স্কুলে পড়েছিলো, তবে উষা রানু থেকে এক বছরের জুনিয়র। স্কুলের গণ্ডি শেষে অবশ্য দুজন আলাদা কলেজে ভর্তি হয়

আমাদের কথা বলার ফাঁকেই দেখলাম ছেলেরা বাজার থেকে ফিরে এসেছে। তখন বেলা সাড়ে দশটা বাজে। মানিকের কাছে তেল ভরা কন্টেইনার, মতিন আর মনার হাতে নাস্তার প্যাকেট। আটার রুটি আর ভাঁজি।  মতিন বললো, ‘পরাটা পেলাম না।  রুটি বানাতেই ওরা অনেক দেরী করে ফেললো’ আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, এতেই চলবে’ মা বললেন, ‘আগে সবাই খাইয়া ল।  তারপর রওনা দেওন যাইবে।’ রুটি আর ভাঁজি দিয়েই সকালের নাস্তা সেরে ফেললাম। ফজর আলীকে বললাম, ‘এবার ট্রলার ছাড়েন।’

 

পর্বঃ  ২০

বেলা এগারোটা বেজে গেছে। আমরা ছবিপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। আমি এখন অনেকটা স্বস্তি অনুভব করছি। ছবিপুর পৌঁছাতে পারলে চিন্তামুক্ত। ওখান থেকে যেকোনোভাবে বরিশাল পৌঁছে যাওয়া যাবে। সফিক ভাই জানতে চাইলো কতক্ষণ লাগতে পারে? উত্তরে আসাদ ভাই বললো এক থেকে দেড়ঘণ্টা।

আমি ফজর আলীর কাছে গেলাম।  সে নির্বিকারভাবে হাল ধরে আছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘আচ্ছা, ছবিপুর থেকে নৌপথে বরিশাল যেতে কত সময় লাগবে?’

‘সেইটা তো নির্ভর করবে আপনারা কীসে যাইবেন। নৌকা না ট্রলারে?’

‘ট্রলার কী পাওয়া যাবে?’

‘জানি না, সেইটা তো ঐখানে গ্যালেই বুঝন যাইবো।’

আমি চুপ করে রইলাম। ফজর আলী জিজ্ঞেস করলো, ‘বরিশালের কোন জায়গায় যাইবেন?’

‘নথুল্লাবাদ পর্যন্ত যেতে পারলে রিকশা বা ভ্যানে বাড়ি পৌঁছানো যাবে।’

‘তালতলী বাজার পর্যন্ত নৌকা যাইবো, তারপর পায়ে হাইটা নতুল্লাবাদ যাইতে পারবেন।’

‘তা হলেও চলবে।’

‘ট্রলারে গেলে আড়াই-তিন ঘণ্টা আর যদি নৌকায় যান তইলে চার-পাঁচ ঘণ্টা লাইগা যাইবো।’

আমি বললাম, ‘ও।’

মনে মনে ভাবলাম আগে ছবিপুর পৌঁছাই, তারপর দেখা যাবে কোন পথে কীভাবে দ্রুত যাওয়া যাবে। আকাশ ক্ষণে ক্ষণেই রূপ বদলাচ্ছে। কখনও দেখা যায় ঝাঁ- ঝাঁ রোদ্দুর আবার কখনও কালো মেঘে ঢাকা।  মনে হয় এই বুঝি ঝুমঝুম করে নামলো।  তবে ছবিপুর পৌঁছানোর আগে আমি চাই না আবার বৃষ্টি নামুক।

আমরা ছবিপুরে পৌঁছালাম বেলা সাড়ে বারোটার দিকেমাঝখানে পনেরো মিনিটের জন্য ট্রলার আবার থেমেছিলো।  ইঞ্জিনে কী যেন সমস্যা দেখা দিয়েছিলো।  ছবিপুরের চরে যখন আমাদের ট্রলার নোঙর করলো, সেখানে তখন প্রচুর মানুষের ভিড়। বিভিন্ন বয়সী মানুষ। ছেলে-বুড়া-যুবা কিংবা নারী। এরা কেউ আমাদের মত আশ্রয়প্রার্থী নয়, এই এলাকারই বাসিন্দা।  সবাই মানুষ দেখতে এসেছে।  দেশের দুর্যোগের এই ক্রান্তিলগ্নে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে আসছে সবাই।  উদ্বাস্তুর মত মানুষের মিছিল এসে নামে ছবিপুরের চরে।  সকাল থেকে রাত অবধি।

আমরা সবাই একজন একজন করে চরে নামলাম। চল্লিশোর্ধ এক লোক আমাদের কাছে এসে বললো, ‘আমার নাম লোকমান। লোকমান ফকীর।  আপনেরা আমার লগে লন।  স্কুলঘরেই আপনাগো থাকনের ব্যবস্থা করা হইছে ’ আমি পেছনে তাকিয়ে তারেককে বললাম ‘দ্যাখ তো সবাই ঠিকমত এসেছে কি না’তারেক একটু পর জানালো কোন সমস্যা নেই, সবাই ঠিকঠাক মত এসেছে। সামনে এগোতে পারি। আমরা লোকমানের পেছনে পেছনে স্কুলের দিকে হেঁটে চললাম।  লোকমান হাসিমুখে বললো,

‘আফনেগো লইয়া আইজ ছয়ডা দল আইলো। ’ 

আমি লোকমানের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আমাদেরর আগে আজ আরও পাঁচটা দল এসেছে?’

লোকমান মাথা নেড়ে হ্যাঁ –সূচক জবাব দিলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তারা এখন কোথায়?’

একগাল হেসে ও জবাব দিলো, ‘স্কুলঘরেই আছে। যাইবো কই? নৌকা পাওন লাগবো না!’

আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্কুল কোনদিকে?’

লোকমান আঙুল দিয়ে ইশারা করে বললো, ‘ঐ দিকে।’ খেয়াল করলাম লোকমান খুব সুন্দর করে হাসে। সহজ সরল হাসি। আগে শুনেছিলাম মানুষের হাসি দেখে স্বভাব চেনা যায়। এখন মনে হচ্ছে কথাটি সত্য। লোকমানকে ভাল করে দেখলাম। লম্বা, হাড় জিরজিরে কৃশকায় একজন মানুষ।  অতি সাধারণ চেহারা কিন্তু খুব মায়াময়।

আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্কুলে কত মানুষ আশ্রয় নিয়েছে?’

ও বললো, ‘অনেক  কয়েকশো। ’  

‘এত মানুষের থাকা খাওয়া কীভাবে হয়?’

‘আমরাই করি।  কি করমু, মানুষ বিপদে পড়লে কী ঠেইল্যা ফেলান যায়? খাওন দাওনের ব্যবস্থা আমগো চেয়ারম্যান সাব আর মৌলভী সাবই করেন।  আমরা গরীব মানুষ, গায় খাইট্যা লোকজনের দেখভাল করি, এই আর কি’ লোকমান বললো। মুখে সেই সহজ সরল হাসি লেগেই রইলো।

মনে মনে বললাম, এটাও অনেক বড় কাজ। ক’জন মানুষের এই কাজটা করার মানসিকতা থাকে! আমরা অনেকদূর চলে এসেছি। আমি জানতে চাইলাম, ‘আর কতদূর?’

‘এই তো, আইসা পড়ছি।  অল্ফো একটু। ’

আমি ভাবছিলাম কত মানুষ দূর দুরান্ত থেকে এখানে এসে আশ্রয় পাচ্ছে।  এখানকার মানুষজন তাদের সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। কিন্তু কতদিন এরা পারবে। সামনে যদি জনস্রোত আরও বাড়ে? এখনও এই অঞ্চলগুলোতে পাকিস্তানি আর্মীদের পা পড়েনি, তাই এত নিশ্চিন্ত এখানকার মানুষ।  জানি না কতদিন শান্ত থাকবে এই জনপদ।

লোকমানের কথাই ঠিক।  অল্পক্ষণ হাঁটার পর স্কুলটি চোখে পড়লো। স্কুল চত্বরে প্রবেশ করে আমি সটান দাঁড়িয়ে পড়লাম। মাঠের একপাশে দীর্ঘ বাঁশের মাথায় সগর্বে উড়ছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। আমি কোনোদিকে না তাকিয়ে পতাকাটিকে দেখছিলাম আর এখানকার মানুষ সম্পর্কে ভাবছিলাম।  স্বাধীনতার বীজমন্ত্র ইতিমধ্যেই গাঁথা হয়ে গেছে এই প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের মনে এখন দরকার যথাযথ পরিচর্যা, তবেই মিলবে কাঙ্ক্ষিত সুফল।  বাংলাদেশের সব জায়গাই কী এ-রকম? যদি তা-ই হয়, তাহলে এই বাঙালিকে দাবিয়ে রাখা সত্যিই সম্ভব নয়।

স্কুলের চারপাশে চোখ বোলাতেই আরও অবাক হলাম।  লোকমান যা বলেছিলো, অনুমান করলাম- পাঁচ শাতাধিক মানুষ এখানে আশ্রয় নিয়েছে। এলাকাবাসী সব ব্যতিব্যস্ত এই আশ্রয়গ্রহণকারী মানুষজনের দেখাশোনা করার কাজে।   

স্কুলের তিনদিকে টিনের তৈরি তিনটি ঘরমাঝখানে প্রশস্ত মাঠ। একদিন খোলা। সেই খোলা মাঠের পাশ দিয়ে একটি রাস্তা চলে গেছে সামনের দিকে। লম্বা টিনের ঘরটিতে অনেকগুলো রুম। এগুলো মূলত শ্রেণিকক্ষ। তারই একটিতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলো। সেই বেতকা স্কুলের মত এখানেও রুমের বেঞ্চগুলো আগেই সরিয়ে রাখা হয়েছেএখন মেঝেতে হোগল পাতার পাটি পেতে দেয়া হলো। আমরা তার উপর চাদর বিছিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে ফেললাম।  দাদাকে শুইয়ে দেয়া হলো।  ঘুমন্ত আনুকেও শোয়ানো হলো। ও ঘুমিয়ে পড়েছিলো মেজচাচীর কোলে। কিছুক্ষণ পর দাদা গুঙিয়ে উঠলেন।

‘ও আবদুল্লাহ, আমারে কই শোয়াইছো?’

বাবা বুঝলেন শক্ত মেঝেতে দাদা ব্যথা পাচ্ছেন, তাই এমন করছেন। মায়ের কাছ থেকে আরেকটি চাদর নিয়ে তাঁর পিঠের নিচে বিছিয়ে দেয়া হলো।  দাদা কিছুক্ষণ শান্ত থেকে আবার বললো, ‘আবদুল্লাহ, আমরা এহন কোন জায়গায়?’ বাবা বললেন, ‘এই তো বাড়ির কাছেই চইলা আইছি।’

যে কোন সমস্যায় দাদা বাবাকেই ডাকেন। তাঁর ছেলে যেন এই একটিই। চাচারা অবশ্য কিছুই মনে করেন না, কারণ তারা কেউ গ্রামে থাকেন না  দাদার দেখাশোনা বেশির ভাগ সময়ই দাদী আর বাবা মিলে করেন।  মা ঘরের কাজ সামলে খুব একটা সময় করতে পারেন না।  আসাদ ভাই আশপাশটা ঘুরে এসে বললেন,

‘সামনে বড় পুকুর আছে। চলো, পুকুরে গোসলটা সেরে নিই। গত চারদিন ধরে গোসল করা হয় না। ’

আমি বললাম, ‘গোসল করতে পারলে মন্দ হয় না। আমারও খুব অস্থির লাগছে। ’

কথার ফাঁকেই দেখতে পেলাম লোকমান এগিয়ে আসছে সাথে আরও দু’জন লোকলোকমান তার সাথের দু’জনকে আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। একজন এই এলাকার চেয়ারম্যান আর অন্যজন স্থানীয় মাদ্রাসার মাওলানাবুঝলাম লোকমান স্কুলে আসার পথে এই দু’জনের কথাই বলেছিলো।

আমরা অনেকক্ষণ কথা বললাম।  চেয়ারম্যানসাব পাকিস্তানিদের প্রতি তীব্র আক্রোশ ঝাড়লেন। এই আক্রোশ মনে হয় এখানকার প্রতিটি মানুষের মনেই কাজ করে। ঢাকার পরিস্থিতি, দেশের বিভিন্ন জায়গার অবস্থা নিয়ে কথা হলো ছবিপুরে পৌঁছে যে বিষয়টা আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিলো আজ চেয়ারম্যান ও মাওলানার কথায়ও সেই একই সমস্যার কথা ফুটে ঊঠলো। সারা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ গ্রামে ফিরে যাচ্ছে।  ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা- সব জায়গার অবস্থাই খারাপ।এসব জেলা থেকে দক্ষিণবঙ্গে যাওয়ার জন্য বেশির ভাগ মানুষই এই অঞ্চলকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করছে। মানুষের এই ঢল কতদিন চলবে কে জানে! তারা নিজেরাও বেশ চিন্তিত।  কতদিন এভাবে সাহায্য সহযোগিতা করতে পারবে সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। তাছাড়া পাক আর্মীদের বিষয়টাও মাথায় রাখতে হচ্ছে।  আর্মিরা যখন তখন আক্রমণ করতে পারে।  কীভাবে সামলাবে তখন?  

আরও কিছুক্ষণ আলোচনার পর আমরা জানতে চাইলাম বরিশালে যাবার জন্য ট্রলার বা নৌকা পাওয়া যাবে কি না

মাউলানা সাব বললেন, ‘পাওন যাইবে তয় আইজ সম্ভব হইবে না ভাই।  বোঝেনই তো, স্কুলে যারা আশ্রয় লইছে হেগো সবাইর বাড়ি যাওনের ব্যবস্থা করতে অইতেছে। কাইলক্যা সক্কালের মধ্যে নৌকার একটা ব্যবস্থা অইয়া যাইবে ইনশাল্লাহ।’  

চেয়ারম্যান সাব বললেন, চিন্তা কইরেন না। আইজকার রাইতটা আরেকটু কষ্ট করেন।

একরাত অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার ছিলো না। নৌকা ম্যানেজ করতে না পারলে যাওয়া সম্ভব না। চেয়ারম্যান আর মাউলানা চলে গেলেন  আমি, আসাদ ভাই, তারেক, চন্দন গোসল করতে পুকুরের দিকে গেলামস্কুলের পাশঘেঁষে রাস্তা ধরে কিছুদূর সামনে গেলেই পুকুরটি চোখে পড়ে। আমরা পৌছুতেই দেখলাম অনেকেই সেখানে ইতিমধ্যেই গোসল করতে এসেছে। পুকুরের পাড়জুড়ে কম করে হলেও জনা পঞ্চাশেক তো হবেই।

ঘাটে দাড়াবার জায়গা নেই।  মানুষে গিজগিজ করছে।  ‘নাও, এইবার গোসল করো। ’ আমি চন্দন আর তারেকের দিকে ইঙ্গিত করলাম।  তারেক হাসতে হাসতে আমার আগে এসে দাঁড়িয়ে বললো, ‘ভাই লাইনে দাঁড়ান, আপনার সিরিয়াল আসলে পুকুরে নাইমেন। ’ আসাদ ভাই ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসি ফুটিয়ে তুলে বললো, ‘বুঝো, তোমার উপরেই টেক্কা মারলো। ’ আমি পুকুরটির চারদিকে একবার দৃষ্টি দিলাম।  স্কুলের পাশ দিয়ে আসা রাস্তাটি পুকুরের পাড় ছাড়িয়ে আরও সামনের দিকে চলে গেছে। চারটি পাড়ই গাছগাছালি ভরা।  বিশেষ করে নারিকেল, সুপারি ও কলাগাছ। ঘাটের উপরে ছড়ানো একটি রেইন্ট্রি গাছ ছায়া দিয়ে ঢেকে রেখেছে অনেকটা জায়গা সবুজ কলমির লতাগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে পাড়ের দিকে। পুকুরের পানি বেশ ঠাণ্ডা। স্বচ্ছ, টলটলে।  আসাদ ভাই ঘাটের শেষ ধাপে নেমে একটা ডুব দিয়ে উঠে তৃপ্তির হাসি হেসে বললো, ‘আহ, কী শান্তি!’

চন্দন সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললো, ‘তাহলে আমিও একটু শান্তির পরশ নিই।’ আসাদ ভাইয়ের পাশ ঘেঁষে ঝুপ করে পানিতে নেমে সাবমেরিনের মত মাঝপুকুরের দিকে ছুটে গেলো।  কিছুক্ষণ পরই টুপ করে পুকুরের মাঝখানে মাথা তুলে বললো, ‘আসলেই শান্তি। কতদিন পর পুকুরে গোসল করলাম!’

দুপুরে চেয়ারম্যান খাবার পাঠালো। ভাত আর লাউয়ের তরকারী। দু’দিন পরে ভাত খাওয়া হলো আবার ছোট বাচ্চারা এই তরকারী দিয়ে খেতে চাইছিলো না। অনেক বুঝিয়ে ওদের খাওয়ানো হলো। আমি ভাবছিলাম এত লোকের জন্য তিনবেলা আহারের জোগান দেয়া চাট্টিখানি কথা নয়। এলাকাবাসী দিনের পর দিন করে যাচ্ছে। এই কাজটা করার মানসিকতা ক’জনের থাকে?


চলবে ......


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উপন্যাসঃ ফেরা (পর্বঃ ২১ - ২৫ - শেষ পর্ব)

এ ই উপন্যাসটিতে সম্মুখ সমরের কোন ঘটনা তুলে ধরা হয়নি।  ওয়ারফ্রন্টের কোনও দৃশ্য নেই। তবে এই লেখায় মূলত যে গল্পটি বলার চেষ্টা ক রা হয়েছে  তা মু...