এই উপন্যাসটিতে সম্মুখ সমরের কোন ঘটনা তুলে ধরা হয়নি। ওয়ারফ্রন্টের কোনও দৃশ্য নেই। তবে এই লেখায় মূলত যে গল্পটি বলার চেষ্টা করা হয়েছে তা মুক্তিযুদ্ধের বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। একটি যুদ্ধ নানানভাবে মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে, যার কোনোটিকেই ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। একাত্তরের পঁচিশে মার্চের সেই কালরাত থেকেই নিজেদের পরিবারকে বাঁচানোর তাগিদে মানুষ ঢাকা শহরের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছুটে বেড়িয়েছে। কেউ কেউ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ফিরে গেছে নিজ গ্রামে। এই গল্পে তেমনই কিছু মানুষের জীবনযুদ্ধের ঘটনাবলীই তুলে ধরা হয়েছে; যারা নিজেদের পরিবারকে বাঁচাতে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে ফিরে চলে নিজ গ্রামে। এটা মোটেও সহজ ছিলো না। এই ফিরে যাওয়ার গল্পটিই এই উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য।
পর্বঃ ৫
২রা এপ্রিল, ১৯৭১
সকাল সাড়ে আটটায় চন্দন এসে হাজির। ওর সাথে বেরিয়ে পড়লাম। মা পেছন থেকে বললেন, ‘সাবধানে যাইস বাবা’। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে আসার পরও মা দরজা খুলে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন ‘ফি আমানিল্লাহ’।
অফিসে পৌঁছুতেই কলিগরা সবাই ঘিরে ধরলো আমায়। সবারই এক প্রশ্ন, আমি সুস্থ আছি
তো! পঁচিশে মার্চের সেই কালরাত থেকেই রাজারবাগ এলাকা গরম ছিলো। সবাই জানে আমার বাসা পুলিশ লাইনের
খুব কাছে, তাই আমার ব্যাপারে তাদের চিন্তা একটু
বেশিই ছিলো। চন্দন খোঁচা মেরে বললো,
‘তোর জন্য সবচেয়ে দুশ্চিন্তায় আছে বড় স্যার। যা দেখা করে আয়।’ অন্যরা তখন মুখটিপে
হাসছে।
আমি স্যারকে বেশ
স্বাভাবিকই দেখলাম। তার
ভাবভঙ্গী দেখে মনে হলো যেন কোথাও কিছু ঘটেনি, সবকিছু আগের মতই চলছে। অবশ্য তার কাছ থেকে এমন আচরণই প্রত্যাশিত। কারণ দেশের এই অবস্থায় পাকিস্তানি দোসররাই তো সবচেয়ে
নিরাপদ। আমাকে
দেখে একবার শুধু জিজ্ঞেস করলেন,
‘তোমাদের কোন সমস্যা হয়নি তো সুরুজ?’
আমি বললাম- ‘না।’
কিছুক্ষণ পর তিনি বললেন, ‘কোন সমস্যা হলে আমাকে জানিও।’
‘আচ্ছা স্যার’। আমি ছোট করে জবাব দিলাম।
চন্দন আমাদের এই অফিসের একাউন্টস অফিসার। আমি ওর কাছ থেকে বেতনটা তুলে নিলাম।
কিন্তু আমার আরও কিছু টাকার দরকার। চন্দন বললো,
‘স্যারের কাছে একটা লোনের এপ্লিকেশন করে দে। আমাদেরকে না দিলেও তোর লোন এপ্রুভ
হয়ে যাবে, শত হলেও তুই তার উত্তরসূরি তো! স্যারের পেয়ারের অফিসার।’ চন্দনের ঠোঁটের
কোণে ব্যাঙ্গহাসি।
আমি গায়ে মাখলাম না। তবে ওর কথামতো লোনের এপ্লিকেশন করে দিলাম। অপ্রত্যাশিত
হলেও আমাকে অবাক করে দিয়ে স্যার লোনটা এপ্রুভ করে দিলেন। এপ্লিকেশনের উপর এপ্রোভাল
সাইন নিয়ে তার রুম থেকে ফেরার সময় চন্দন আমার কাঁধে টোকা দিয়ে কাগজটা আমার সামনে
নাচাতে নাচাতে বললো, ‘কী! বলেছিলাম না? আপনার লোন এপ্রুভ হয়ে যাবে, দেখলেন!’
আমি মুচকি হেসে ওর কথায় সায় জানালাম। চন্দন বাকী ফরমালিটিজ শেষ করে আমাকে টাকার ব্যবস্থা করে দিলো। আমরা ভাবছিলাম
এবার তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে যাবো, কিন্তু হলো না। একটু পরেই ডিরেক্টর স্যার আমাকে আর চন্দনকে রুমে ডেকে পাঠালেন। অনেক মিষ্টি কথার শেষে আমার
হাতে একটা ফাইল ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই ফাইলটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি এটা শুধু তোমার হাতে দেবো বলেই আর কারো মাধ্যমে পাঠাইনি। আজই মিরপুর শাখায় গিয়ে সাত্তারকে
ভালোমত সবকিছু বুঝিয়ে দেবে। আগে পড়ে দেখো। কোন প্রশ্ন
থাকলে আমাকে জানাতে পারো। লাগলে
চন্দনকে সাথে নিয়ে যেও।’
চন্দন আমার দিকে তাকালো। বুঝলাম, না করে লাভ নেই। দেরী না করে বরং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব
বেরিয়ে পড়া দরকার। আমি ওকে নিচু স্বরে বললাম, ‘যাওয়া-আসার খরচ নিয়া নে।’ চন্দন আমার
দিকে তাকিয়ে মৃদুহেসে বললো, ‘জ্বি স্যার।’
চন্দন ওর রুমের দিকে চলে গেলো। আমি ফাইলটা নিয়ে বসলাম। সবকিছু পড়ে মনে হলো ডিরেক্টর স্যার যতটা ইম্পর্টেন্স দিয়ে বলেছে, এ ফাইলে তেমন জরুরী
কোন বিষয় নেই। তবুও সিনিয়র বসের অর্ডার বলে কথা, যেতে তো হবেই। আমরা খুব তাড়াতাড়ি মিরপুরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। পঁচিশে মার্চের পর এই প্রথম আমি ওদিকটায় যাচ্ছি। বিকাল পাঁচটা থেকে কারফিউ।
ফাইলটা সাত্তার ভাইকে বুঝিয়ে দিয়ে
এর মধ্যেই ফিরে আসতে হবে।
চন্দনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘যাবি কী করে? গাড়ি তো চলে না।’
‘দেখি একটা রিকশা জোগাড় করা যায় কি না।’
বেশ কিছুদূর হাঁটার পর একটা রিকশা পেলাম। চন্দনকে বললাম, ‘আজরাতেই এই এলাকা ছেড়ে বড়মামার বাসায় চলে যাবো।’
চন্দন বললো, ‘সুরুজ আমাদের নিবি না?’
আমাকে চিন্তিত দেখে ও খুব করুণ স্বরে বললো, ‘আসলে তোদের সাথে গেলে মনে কিছুটা
শক্তি পাবো, তাই বলা। দরকার হলে আমরা তোদের থেকে
দূরত্ব রেখে চলবো। কেউ বুঝতে পারবে না আমরা তোদের
দলের।’
আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম- ‘চন্দন, ব্যাপারটা তা নয়। তোদেরকে এই বিপদের মধ্যে
রেখে গিয়ে আমি কী শান্তি পাবো? ভয়টা বড়মামাকে নিয়া। উনি খুব কড়া স্বভাবের মানুষ।
উনি রাজি না হলেই সমস্যা।’
‘সেইজন্যই তো বলছি আমরা দরকার হইলে তোদের থেকে দূরত্ব রেখে যাবো।’
আমি স্মিত হেসে বললাম, ‘আচ্ছা বাদ দে। তোরা আমাদের সাথেই যাবি। মাকে দিয়ে
বড়মামাকে বোঝাবো। মিরপুর থেকে বাসায় ফিরেই তাড়াতাড়ি মেজচাচার বাসায় চলে আসবি।’
‘ঠিক আছে। আমাদের
সময় লাগবে না। কিছুই তো সাথে নেওনের নাই, শুধু দুইজন মানুষ চলে যাবো। জানটা নিয়ে কোনরকমে বাড়ি পৌঁছাতে পারলেই হয়!’
আমি রিকশাওয়ালার সাথে কথা বলছিলাম। বয়স্ক লোক। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, চাচা,
আপনার ঘরে আয়-রোজগারের কেউ নাই?
বৃদ্ধ পেছনে ঘুরে একবার আমার দিকে তাকালো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘আছে রে বাবা। দুইডা জোয়ান পোলা ঘরে বসা। আর্মিগো
ডরে অগোরে ঘর থেইক্যা বাইর হইতে দেই না। আর্মিরা জোয়ান ব্যাটাছেলে দেখলেই অত্যাচার
করে। যাগো ধইরা নিয়া যায় তাগো আর খবর পাওয়া যায় না।’
আমি ম্লান মুখে চন্দনের দিকে তাকালাম।
চন্দন বললো, ‘চিন্তা করিস না সুরুজ। আমাদের
সাথে আইডি কার্ড আছে। তাছাড়া আমি ডিরেক্টর স্যারের
কাছ থেকে মিরপুর অফিসের অফিসারের কাছে লেখা চিঠি নিয়ে এসেছি।’
রিকশাওয়ালা চাচা বয়স্ক হলেও বেশ দ্রুতই চালাচ্ছিলো। আমি চারিদিকে চোখ
বোলাচ্ছিলাম আর মাঝে মাঝে চাচার সাথে কথা বলছিলাম। চাচা বলছিলো,
‘যার লগেই কথা কই, খালি জ্বালাও-পোড়াও আর মানুষ মরার খবর। সারা শহর ঘুইরা
নিজের চোখেও তো কম দেখলাম না।’ রিকশাওয়ালা চাচা বিরক্তি মেশানো কণ্ঠে বললো।
আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বললাম, ‘চারিদিকে কি অবস্থা চাচা?’
রিকশাওয়ালা চাচা আরও একবার পেছনে ফিরে তাকালো। তারপর ঘৃণামিশ্রিত কণ্ঠে বললো, ‘বাবারে কী আর কমু! হারামজাদারা তো শহরডারে
শ্যাষ কইরা দিছে। ইনুয়ারছিটি আর পুরাণ ঢাকারে তো চেনাই যায় না। রাস্তার নানান
জায়গায় অহনো রক্তের দাগ লাইগা রইছে। আমি নিজে যাইনাই, তয় হুনছি বুড়িগঙ্গা নদীতে
নাকি মানুষের লাশ আর লাশ। আল্লায়ই জানে কত মায়ের কোল যে খালি হইছে! কত সন্তান তাগো
বাবারে হারাইছে! খালি প্যাডের দায়ে রাস্তায় বাইর হই।’
আমার আর কিছু বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না। প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিলো। আমরা কী করছি? ভীতুর
মত পালাচ্ছি। আমি চন্দনের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলাম। ওকে নিচু স্বরে বললাম,
‘খোদার কসম, যদি বেঁচে থাকি, সবাইকে বাড়ি পৌঁছিয়ে দিয়ে আমি যুদ্ধে যাবো। এই
হারামিগুলার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে হবে – এটাই আমার প্রতিজ্ঞা।’
‘একলা লড়বি ক্যামনে?’ চন্দন জানতে চাইলো।
‘একলা লড়বো কেন? আমি খবর পাইছি, দেশে মুক্তিবাহিনী গঠন করা হইতেছে। বাড়ি গিয়া
খোঁজ নিতে হবে, কীভাবে কোথায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়া যায়।’
‘আমাকেও তোর সাথে নিস। তুই অস্ত্র হাতে তুলে নিলে আমি কী ঘরে বসে ঘুমাবো?’
দৃঢ়কণ্ঠে বললো চন্দন।
আমি বললাম, ‘ঠিক আছে। তুইও থাকবি আমার সাথে। বাড়ি গিয়ে খুব গোপনে খোঁজ নিতে এলাকার আর কে কে যুদ্ধে
যাবে।’
প্রায় ঘন্টা খানেক পর আমরা দারুস সালাম রোডে পৌঁছালাম। রিকশাওয়ালা চাচা বললো,
‘বাবা, আর তো যাওয়া যাইবো না। এইবার তোমগো একটু কষ্ট কইরা হাইটা যাইতে হইবো।
এইখান থেইক্যা মিরপুর-১ নম্বর বেশি দূর না।’
আমরা নেমে গেলাম। রিকশাওয়ালা চাচাকে তার দাবী করা ভাড়া থেকে কিছুটা বেশিই
দিলাম। সে খুশি হলো। যাওয়ার আগে বললো, ‘বাবারা,
যুদ্ধে যাবার কথা কইলা হুনলাম। আমার
পোলা দুইডার মুখেও যুদ্ধের কতা হুনছি। নেতারা না-কি কইতাছে দেশে যুদ্ধ অইবো। হাছা
কতা? আমার শরিলে তো আর শক্তি নাই, তয় দোয়া করি বাবা। তোমরা এই হারামিগুলারে উচিৎ
শিক্ষা দেও।’
আমি চাচাকে বললাম, ‘চাচা, দেশের মুক্তি না হলে তো আমাদেরও মুক্তি নাই। কতকাল পরাধীন থাকবো আমরা? তাই জিততে আমাদের হবেই।’
রিকশাওয়ালা চাচাকে আর কিছু না বলে আমরা সামনের দিকে হাঁটতে লাগলাম। মেইন রোডে
না গিয়ে আমরা এলাকার ভেতরের রাস্তা দিয়ে গেলাম। খুব বেশি সময় লাগলো না। মিরপুর শাখার সাত্তার ভাই আমাদের দেখে বেশ
অবাক হলেন। কাগজপত্রগুলো দেখে বলে উঠলেন,
‘এমন অবস্থার মধ্যে আপনাদের পাঠানো কী দরকার আছিলো? এই কামটা তো কয়দিন পরে
করলেও চলতো।’
চন্দন বললো, ‘ডিরেক্টর স্যার
তো বললো খুব জরুরী’।
‘জরুরী না ছাই! এইডা হইছে আপনাগো শাস্তি। কয়েকদিন অফিসে আসেন নাই, তাই এইভাবে
শাস্তি দিলো। ব্যাটা পাকিস্তানি মোসাহেব’। সাত্তার
ভাই এভাবেই ক্ষোভ ঝাড়ছিলো।
খুব প্রাণখোলা মানুষ এই সাত্তার
ভাই। হেড অফিস থেকে প্রায়ই আমাকে মিরপুরে যেতে হতো। উনিও মাঝে মধ্যে হেড অফিসে যেতেন। আমাদের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে আড্ডা জমে উঠত। তবে সেদিনের সেই অবস্থায় বেশিক্ষণ এখানে থাকার সাহস হচ্ছিলো
না, আর হাতে সময়ও ছিল না। আমরা তাড়া দিলে
সাত্তার ভাই বললেন,
‘আরে এতদিন পড়ে আপনার সাথে দেখা হল কিছু না খেয়েই যাবেন?’
তিনি চা-নাস্তা আনার জন্য লোক পাঠালেন। আমরা কথা বলছিলাম। বিষয়বস্তু একটাই, দেশের বর্তমান অবস্থা। কোথাও কোন স্বস্তির খবর নেই, ধ্বংস-মৃত্যু আর অনিয়শ্চয়তা ছাড়া।
আমাদের কথা বলার ফাঁকেই হঠাৎ বাইরে থেকে হৈচৈ আর চেঁচামেচির শব্দ ভেসে আসছিলো।
সাত্তার ভাই জানালা দিয়ে বাইরে দেখে এসে বললেন,
‘কিছু চ্যাংড়া পোলাপাইন চিল্লাইতাছে, ঠিক অইয়া যাইবো।’
কিছু সময় কেটে গেল, তবে গোলমাল কমেনি, বরং ধীরে ধীরে বাড়ছিলো। একটু পরই পাশের অফিসের জব্বার মিয়া এসে সাত্তার ভাইকে বললেন,
‘তাড়াতাড়ি অফিস বন্ধ করে চইলা যান, অবস্থা খারাপ।’
আমরা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না আসলে কি ঘটেছে। জব্বার মিয়া বুঝিয়ে বললেন।
সামনের ভবনের কারো সাথে বিহারীদের কোন ঝামেলা হয়েছে,
তাই নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেছে কিছুক্ষণ আগে। এখন বিহারীরা দল ভারী করার জন্য
লোকজন পাঠাইছে। এই অবস্থায় পাকিস্তানি আর্মি নিয়া আসাও অসম্ভব না। তখন এখানে কি ঘটবে কেউ বলতে পারে না। আপনারা তাড়াতাড়ি চলে যান।
সাত্তার ভাই জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। আমাদের উল্টাদিকের বিল্ডিঙের গেটে দশ-বারোজন বিহারী পাহারা
দিচ্ছে। আমরা দু’জন তখন হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। সাত্তার ভাই জব্বার মিয়াকে বুঝিয়ে
বললেন যে আমরা হেড অফিস থেকে এতদূর আসছি, এখন চলে যাবার একটা ব্যবস্থা করে দিতে
হবে। জব্বার মিয়া একটু ভেবে বললেন, আপনারা আমার সাথে আসেন।
সাত্তার ভাই আমাদেরকে ভবনের পেছনের গেট দিয়ে বের করে জব্বার মিয়ার অফিসে নিয়ে
গেলেন। সেখানেও কয়েকজন আটকা পড়েছে। আমরা পাশের গলি
দিয়ে সরাসরি তার বাড়ির গ্যারেজে চলে এলাম। জব্বার মিয়া গ্যারেজ থেকে নিজের
গাড়ি বের করে যারা দূরে যাবে তাদের সবাইকে তুললেন। ছোট্ট সেই গাড়িতে সেদিন আমরা
আটজন মানুষ গাদাগাদি করে বসেছিলাম।
তিনি আমাদের দেখিয়ে ড্রাইভারকে বলে
দিলেন
‘ওনাদেরকে যার যার এলাকায় নামিয়ে দিবে’।
আমরা মালিবাগ মোড়ে নেমে গিয়েছিলাম। সেদিন জব্বার মিয়া আমাদের সাহায্য না
করলে কী যে হতো! আমাদের ঘরে ফিরতে বেলা দুইটা বেজে
গেল। ফিরে দেখি
সব গোছগাছ শেষ। সবাই
আমার জন্য চিন্তিত।
মেজোচাচাকে জিজ্ঞেস করলাম- ‘কখন রওনা
দিবা?’
মেজো
চাচা জানালো, ‘দেরী করনের
দরকার নাই, তুই কয়ডা
ভাত খাইয়া ল, আমরা একটু
পরই বের হয়ে যাবো।’
পাশে
দাঁড়ানো বড় আপা বললো- ‘চারটায়
তো কারফিউ, এর মধ্যে
কি পৌঁছতে পারবা
চাচা?’
সফিক
ভাই জানালো, ‘আজ কারফিউ
পাঁচটায়।’
পর্বঃ ৬
চন্দনকে
তৈরি হয়ে আসতে বলতেই ও তাড়াতাড়ি ওর বাসায় চলে
গেলো। এই ফাঁকে আমি ভাত খেয়ে নিলাম।
আনুর যেসব জিনিসপত্র বের করা হয়েছিলো সেগুলো আবার ব্যাগে ভরে রাখছিলো রানু।
মেজচাচীর খুব মন খারাপ। তিনি বাসার খুঁটিনাটি জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতে রাখতে
বলছিলেন, ‘আবার কবে ঘরে ফিরতে পারবো কে জানে!’ আসাদ ভাই চেমচাচীর সাথে দুষ্টুমি
করছিলো। ‘ফুপু, কাইন্দো না। সব কান্দন শেষ করলে ভবিষ্যতে কী করবা?’ মেজচাচী আসাদ
ভাইয়ের দিকে তাকালো, তাঁর মুখে তখন বিষাদমাখা হাসি। চোখ দু’টো ছলছল করছিলো। আসাদ
ভাই চাচীর কাছে বসে খুব শান্তভাবে বললো, ‘একদম চিন্তা করবে না। দেইখো, খুব
তাড়াতাড়িই সব ঠিক হয়ে যাবে।’ চাচী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘তা-ই যেন হয় বাপ।’
চন্দন আর উষা
চলে এলো সময়মত। উষার
মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিলো
না। ভয়ে এতটুকুন
হয়েছিল।
মা ওকে অভয় দিল, ‘এত ডরাও
ক্যান? একদিন তো মরতে অইবোই! চিন্তা
কইরো না, ভাগ্যে যা আছে তা-ই অইবো।’
বেলা
সাড়ে তিনটায় মেজচাচার বাসা থেকে বেরিয়ে
পড়লাম। গন্তব্য- গোরান। বড় মামার
বাসা। রাজারবাগ
থেকে বের হবার সময় যেমনটা করেছিলাম, তেমনি আজও সবাই বিচ্ছিন্নভাবে হেঁটে চলছিলাম। বিশেষ
করে মেজচাচা আর মতিন আগেই চলে গেছে। দাদাকে ছোটচাচা আগেই নিয়ে গিয়েছে, তাঁকে বয়ে
নেয়ার প্রয়োজনটি আজ আর রইলো না। আমরা এলাকার সরু গলিপথ, লোকজনের বাড়ির ভেতর দিয়ে
এগিয়ে যাচ্ছিলাম।
কারফিউ শুরু হবার আগেই আমরা বড়মামার বাসা গোরানে পৌঁছে গেলাম। বড় মামার বাসায়
গিয়ে দেখি ছোটচাচারা
আগেই চলে এসেছেন। বড়মামা অস্থির হয়ে আছেন। গোরানের পরিস্থিতিও ভাল নয়। আমাদের দেখে কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেন। ছোটচাচার সাথে
এলাকার অবস্থা নিয়ে কথা বলছিলাম। এর
মধ্যেই ভেতরে ডাক পড়লো আমার। গিয়ে দেখি বড়মামা থমথমে চেহারা নিয়ে বসে আছেন।
চন্দনকে নিয়ে আমি যা আশঙ্কা করছিলাম তা-ই হলো। বড়মামা বেশ ঝাঁঝের সাথেই বললেন,
‘ওদের সাথে আনছিস ক্যান?
সবাইরে বিপদে ফেলতে চাস?’
মা আমার পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি বড়মামার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘দাদা,
হিন্দু হইলেও অরা তো মানুষ। অগোরে এই বিপদের মধ্যে ফালাইয়া যাই ক্যামনে? আমার
সুরুজের লগে চোখের সামনেই তো বড় হইতে দেখছি।
অগোরে এই আগুনের মধ্যে রাইখা যাইয়া মনে শান্তি পামু?’
বড়মামা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ‘সবই বুঝি রে জয়নাব, কিন্তু পাক বাহিনীরা হিন্দুগো উপরেই বেশি ক্ষ্যাপা, তাই ভাবছিলাম অগো কারণে
আমরা সবাই মিলে বিপদে না পড়ি!’
মা বড়মামাকে অভয় দিয়ে বললেন, ‘আপনারে
চিন্তা করতে অইবো না। ওরা মোসলমান সাইজাই
আমগো লগে যাইবো।’
বড়মামা মাকে খুব ভালবাসতেন। তাই আর কিছু বললেন না। তবে তার চেহারা দেখে মনে হলো তিনি
খুশি হতে পারেননি।
বড়মামা ওহাব হাওলাদার একজন সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন। এক বছর আগে অবসরে এসেছেন।
ব্যক্তিগত জীবনে সৎ ও নিষ্ঠাবান অফিসার হিসেবে অফিসে তার যথেষ্ট সুনাম ছিলো। তবে
সবাই বলতো, তিনি কড়া স্বভাবের মানুষ। নিজে খুব
ডিসিপ্লিনড জীবন যাপন করেছেন এবং তার ছেলেমেয়েকেও একইভাবে গড়ে তুলেছেন। বড়ছেলে
তারেক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্সে অনার্স করছে, মেয়ে তুলি
এইচএসসি পরীক্ষার্থী, তবে যুদ্ধের কারণে এ বছর পরীক্ষা দেয়া সম্ভব নয়, আর ছোট ছেলে
হাসান ক্লাস নাইনে পড়ে। সারাজীবনের পরিশ্রমের রোজগারে তিনি গোরানে একতলা একটা বাড়ি
করতে পেরেছেন। মামা অবশ্য এটুকুতেই খুশি।
আমরা মিনু ফুপুদের অপেক্ষায় ছিলাম। তারা থাকেন মালিবাগ চৌধুরিপাড়ায়। ওখানকার
অবস্থাও ভাল নয়। আমি মামাতো ভাই তারেককে এদিকের অবস্থা
সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই ও যা বললো তাতে শিউরে উঠলাম। দু-দিন আগের রাতে এই এলাকায় নাকি তাণ্ডব হয়ে গেছে। সারা মহল্লাজুড়ে ধরপাকড় চলেছে। ঘরে ঘরে হানা দিয়েছে আর্মিরা। অনেক মানুষ
ধরে নিয়ে গেছে যাদের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। সে-রাতে যে যেমন করে পেরেছে প্রাণ
বাঁচিয়েছে। বড়মামা তখন মসজিদে ছিলো। আর্মি আসার খবর শুনে তারেক ওদের পাকের ঘরের পেছনে কাঠের স্তুপের মধ্যে লুকিয়ে ছিলো। এলাকার অনেকে
তাদের পানির কুপে নেমে, কেউ কেউ অন্ধকারে ঘরের পেছনে
গাছে উঠে লুকিয়ে ছিলো। অনেক মহিলারা দুই ঘরের মাঝের করিডোরে জঞ্জালের মাঝে লুকিয়ে
থেকে জীবন বাঁচিয়েছে। বাচ্চা ছেলেমেয়েদের মুখ চেপে রেখেছে যাতে শব্দ না হয়। তারেকদের পাশের বাড়ির ভদ্রলোকের বড় ছেলে বশির আর মেয়ে জামাই লুৎফরকে
ধরে নিয়ে গেছে পাক আর্মিরা।
তাদের কোন খবর পাওয়া যায়নি।
আমি তারেকের চোখে জল দেখেছিলাম সেদিন। ও বলছিলো, ‘জানো দাদা, লুৎফর ভাইয়ের
জন্য খুব খারাপ লাগছে। ও খুব হাসিখুশি আর প্রাণোচ্ছল মানুষ। আমার সাথে বেশ ভাব
ছিলো।’
ওর কাঁধে হাত রেখে শুধু বললাম- ‘ভাইরে, এরই নাম যুদ্ধ। এ যুদ্ধে আমাদের আরও
অনেক কিছুই হয়তো হারাতে হবে। তবে ভয় পেলে চলবে না, নিজেদেরও রুখে দাঁড়াতে হবে।’
তারেক আর কিছু বললো না, আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শুধু। ও তখন তেইশ
বছরের যুবক। আমার কথার কি মানে বুঝলো জানি না,
তবে দেখলাম ওর চোখদুটো যেন জ্বলে উঠলো একবার।
তার দুই মাস পর তারেক আমাদের সাথে যুদ্ধে চলে গিয়েছিলো। আমি, ছোটমামা, চন্দন আর তারেক। আমরা চারজন একসাথেই গিয়েছিলাম। আমরা ফিরে এসেছিলাম একেবারে দেশ স্বাধীন হবার পর। আসাদ ভাইও যুদ্ধে গিয়েছিলেন, তবে আমাদের সাথে নয়।
ফুপুদের এলাকার অবস্থা ভাল নয়। তারা সেদিন ঘর থেকে বের হতে পারেনি। বড়মামা
চিন্তায় পড়ে গেলেন। আর বেশি দেরি করা যাবে না। এলাকা ক্রমেই গরম হয়ে উঠছে। যত সময়
যাচ্ছে স্বাধীনতা বিরোধীরা দল ভারী করছে। আমাদেরও বিপদ বাড়ছে। তবে ফুপুদের জন্য
অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার ছিলো না।
মিনু ফুপুরা এলো পরের দিন বিকালে। বড়মামা
তখন আছরের নামাজ পড়তে মসজিদে গিয়েছেন। মামা আছরের ওয়াক্তে মসজিদে গেলে একেবারে
মাগরিব শেষ করে ফেরেন। আজও হয়তো তা-ই করবেন। মিনু ফুপুকে দেখে দাদীর মুখে হাসি
ফুটে উঠলো। ফুপু দাদা-দাদীর কাছে কিছুক্ষণ বসলো। বড় আপা সামনের রুমে আসতেই মিনু
ফুপু উঠে আপাকে জড়িয়ে ধরলো। ‘কেমন আছোস শিউলী?’
বড় আপা কপট রাগ দেখিয়ে বলে উঠলো, ‘থাক, আর আদিখ্যেতা করতে হবে না। সামনে দেখলে
আহ্লাদিপনা, আর দূরে গেলে এই শিউলীকে আর মনেই থাকেনা।’
মিনু ফুপু হাসে। সে ভাল করেই জানে তাদের দুজনের সম্পর্কটাই এ-রকম। বড় আপা
দাদীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে আবার বললো, ‘এক্কেরে মায়ের মত।’ দাদী ফোকলা দাঁতে
হাসলো। তাঁর দুই পাটিতেই একটি করে দাঁত
অবশিষ্ট আছে। দাদীর পান-খাওয়া লালচে খয়েরী মুখের ভেতরটা হা হয়ে গেলো আর সেইসাথে
ভাঁজ পড়া গালে ভাঁজের সংখ্যা আরও কয়েকটা বাড়লো। আপা দাদীকে ক্ষেপাতে চায়, ‘আবার
ফোকলা দাঁতে হাসে!’ দাদীও আপার গাল টিপে দেয়। মিনু ফুপু ওঁদের দুজনের খুনসুটি দেখে
হাসতে হাসতেই বলে, ‘পাগলী! তুই আর বদলাইলি না।’
মিনু ফুপু আর বড় আপার মধ্যে অদ্ভুত সুন্দর একটা সম্পর্ক ছিলো। মিনু ফুপু আর বড়
আপা প্রায় সমবয়সী। ফুপু সম্ভবত দু’মাসের বড়, তবে দু’জনের বড় হয়ে উঠা একসাথেই। অনেকটা বন্ধুর মত। মিনু ফুপু যতটা শান্ত-শিষ্ট, নরম আর ভীতু
স্বভাবের, আপা ছিলো ততটাই ডানপিটে। ছেলেদের মত। গাছে চড়ে ফল পাড়া, সাঁতরে পুকুরের
এপার-ওপার করা, ভরা বর্ষায় কলাগাছের ভেলায় চড়ে শাপলা তুলে আনা- এগুলো শুধু বড় আপার
পক্ষেই সম্ভব ছিলো। আমাকে এসব বড় আপাই শিখিয়েছে। তবে আপা শুধু দুষ্টুমিতেই নয়,
লেখাপড়ায়ও ছিলো সবার সেরা। ক্লাসে কখনও ফার্স্ট ছাড়া সেকেণ্ড হয়নি। আবার প্রতিবছর
স্পোর্টসে চ্যাম্পিয়নশিপটা তার দখলেই থাকতো।
সবার ছোট হওয়ায় দাদী মিনু ফুপুকে একটু শাসনে রাখতে চাইতেন কিন্তু বড় আপার জন্য
তা সম্ভব হতো না। ফুপুকে একটু বকাঝকা করলেই বড় আপা দাদীকে একহাত নিতেন। ‘এই বুড়ি,
তুমি ওকে বকো কেন? বেশি বকাবকি করলে বুড়ারে দিয়া তোমার কোমর ভাইঙা দিমু।’ দাদীও
ছাড়ার পাত্রী নয়। ‘খাড়া, তোর বিয়া দিয়া লই, জামাইরে দিয়া আমিও তোর কোমর ভাইঙা
দেওয়ামু।’ আপা ভেঙচি কেটে বলতো, ‘ইস! বুড়ির সখ কতো! হুইনা রাখো, আমার জামাই এই
আঙুলের ইশারায় চলবো। ’ দাদী আপার সাথে না পেরে শেষমেশ বলতো, ‘এই দজ্জালনীরে বিয়া
দিমু ক্যামনে!’ সেই বড় আপার যখন বিয়ে হয়ে গেলো, দাদীকে কতদিন মনমরা হয়ে বসে থাকতে
দেখেছি! মাঝে মধ্যে চোখের পানিও ফেলতো। মা
জিজ্ঞেস করলেই বলতেন, ‘পাগলীটা ঘরডারে মাতাইয়া রাখতো। এহন ক্যামন খাঁ-খাঁ করতে আছে।’
মিনু ফুপু আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘সুরুজ, সবাই আইসা পড়ছে?’
‘হুম, আমরা শুধু তোমাদের অপেক্ষাতেই ছিলাম। কাল সকালের মধ্যেই রওনা দেবো।’
‘বাড়ির কোনো খবর পাইছোস? বকুল এখন কোথায়?’
‘ছোট আপা গত মাসেই বাড়ি যাওয়ার কথা ছিলো। গেছে কি না জানি না।’
মিনু ফুপু আফসোসের সুরে বললো, ‘ও যা ভীতু! এই যুদ্ধের মধ্যে একলা থাকলে তো
কাইন্দা বুক ভাসাইবো।’
ছোট আপা আসলেই অনেক ভীতু স্বভাবের ছিলো। কিছুটা ছিঁচকাঁদুনেও। বড় আপার ঠিক
উল্টো। আমার থেকে দুই বছরের বড় কিন্তু আমরা একসাথেই বেড়ে উঠেছি। ছোট আপা
অনেকক্ষেত্রেই আমার আর বড় আপার উপর নির্ভরশীল ছিলো। সেই ভীতু ছোট আপাই কেমন করে
যেনো ইকবাল ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক করে ফেললো। তা-ও ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার আগেই।
ইকবাল ভাই পুলিশ অফিসার শুনে বাবা তো বেঁকে বসলেন। ‘ঘুষখোর পুলিশের দারে মাইয়া
বিয়া দিমু না।’ আমাদের খুব শান্তশিষ্ট বাবার এই কঠিন রূপ দেখে আমরা একেবারেই
অভ্যস্ত ছিলাম না। তাই নরম স্বভাবের বাবা যখন গোঁ
ধরলেন পুলিশের সাথে মেয়ে বিয়ে দেবেন না, ছোট আপা খুব চিন্তায় পড়ে গেলো। বড় আপাই
বাবাকে বোঝালো। ‘সব পুলিশই ঘুষ খায় না। আমরা খোজ-খবর নিয়ে দেখি।’ বড়মামা দায়িত্ব
নিয়ে ইকবাল ভাইয়ের ব্যাপারে খোঁজখবর নিলেন। বড়মামার কাছ থেকে পজিটিভ রেস্পন্স
পাওয়ার পর অবশেষে বাবা রাজি হলেন।
একবার হলো কী- ইকবাল ভাই আমাদের বাড়ির পাশের বাগানে ছোট আপার জন্য অপেক্ষা
করছিলো। হঠাৎ দাদী সেখানে গিয়ে উপস্থিত।
‘কী গো নাগর, বকুল তলায় ফুল টোকাইতে আইয়া আমগাছের নিচে কি করো? আমার লগে লও,
ঠিক জায়গায় লইয়া যামুনে।’
পেছনে ঘুরে দাদীকে দেখে ইকবাল ভাই তো অবাক! বুড়ির চেঁচামেচিতে না কেলেঙ্কারি হয়ে
যায়, এই ভয়ে দাদীর পিছু পিছু বাড়ির ভেতরে গেলো। দাদী ছোট আপার কাছে গিয়ে বললো,
‘এই যে বকুলী বেগম, বুইঝা লও তোমার নাগর, আমগাছের নিচে বকুল ফুল টোকাইতে
আছিলো।’
ছোট আপা তো লজ্জায় লাল!
পর্বঃ ৭
মাগরিবের নামাজ শেষে বড়মামা মসজিদ থেকে ফিরলেন। মিনু ফুপুদের দেখে স্বস্তির
নিঃশ্বাস ফেললেন। ছোটচাচা কিছু শুকনো
খাবার কিনে আনলো। বিস্কুট, চিড়া-মুড়ি আর গুড়। লম্বা জার্নিতে পথে ক্ষুধা মেটানোর জন্য এগুলোই হয়তো সম্বল হতে পারে। আমি আনুর জন্য প্রয়োজনীয় গুড়োদুধ কিনে নিলাম, যাতে বাড়িতে গেলেও রানুর সমস্যা
না হয়। বড়মামা স্পষ্ট করে বলে দিলেন, ‘এখন থেকে কেউ আর বাইরে যাবে না।’
রাতে
মামা সবাইকে নিয়ে বসলেন। আমাদের মধ্যে যে কোন
বিষয়ে সভা হলেই বড়মামা একটা দীর্ঘ
বক্তৃতা দিবেন এটা অবধারিত। আর আমরা
সবাই কোন না কোনভাবে মিটিঙ এভয়েড করতে পারলেই
যেন বাঁচতাম। তবে সেদিন পরিস্থিতি এমন ছিল যে প্রত্যেকেই মনযোগী শ্রোতা হয়ে
গেলাম। খিলগাঁওয়ের মত এখানেও পাকিস্তানি আর্মি ঘরে ঘরে হামলা চালাচ্ছে। লোকজন ধারণা করছে এলাকার ভেতর
থেকেই পাক আর্মিকে কেউ কেউ ইনফরমেশন পাঠাচ্ছে। খুব
তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যেতে হবে। পারলে আজ রাতেই।
মনে হচ্ছিলো, মেজচাচার ভেতরে এক ধররণের ইতস্থতা কাজ করছে। বড়মামা বিষয়টা লক্ষ
করে বললেন, ‘ফজলু, কোন সমস্যা?’
মেজচাচা আমতা আমতা করে বললো, ‘আরেকটু ভাবলে হতো না? পরিস্থিতি স্বাভাবিকও তো
হতে পারে।’
বড়মামা বললেন, ‘মানে! হঠাৎ তোমার মতের বদল হলো যে! বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে এই বিপদের
মধ্যে থেকে যাবে?’
আমি বুঝলাম না মেজচাচা এখন এমন করছেন কেন। তাঁর বাসায় যখন ছিলাম তখন তো তিনিই
তাড়া দিচ্ছিলেন।
চাচা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ‘দাদা, ব্যাপারটা তা না। আসলে মন মানে না। ভাবছিলাম, এত বছরে যা কিছু অর্জন, সবই তো ফেলে রেখে যেতে
হচ্ছে। ফিরে এসে আবার সব ঠিকঠাক পাবো তো!’
বড়মামা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ‘পঁচিশ তারিখ ঢাকায়
কী হইছে তুমি জানো? এখন ঢাকার কোথাও আমরা নিরাপদ নই। আর কিছু করার নাই। আমাদের
সবকিছুই ভাগ্যের হাতে ছেড়ে যেতে হবে।’
আসাদ ভাইকে গত কয়েকদিন ধরেই মেজ চাচা আর বড়মামাদের এলাকার চায়ের দোকানগুলোতে
ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে। আমরা অনেকেই ভেবেছি চা-বিড়ির নেশা মেটাতেই লোকটা বাইরে
যায়। আসল ব্যাপারটা ছিলো আসাদ ভাই চা খেতে যাওয়ার ছলে একালার লোকজনের কাছ থেকে
তথ্য সংগ্রহ করতো। বড়মামার কথার উত্তরে সে বললো,
‘শুধু পঁচিশে মার্চই নয়, ছাব্বিশে মার্চে কী কম হত্যা হয়েছে? পুরাণ ঢাকার
তাঁতীবাজার, শাঁখারীবাজার,
কোর্ট হাউস স্ট্রিট
ও গোয়ালনগর
এলাকায় অনবরত গুলিবর্ষণ চলেছে। আগুনে ছারখার
করেছে সব। সাতাশ তারিখ নওয়াবপুর থেকে ইংলিশ রোডের
রাস্তার দু-ধারের দোকানগুলোতে
আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। কেউ ঘর থেকে বেরুলেই গুলি করে
মেরেছে।’
নুরুল ফুপা বললো, ‘আমিও শুনেছি মালিবাগে একটি মন্দির জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে।
সেখানে না-কি মানুষও মেরেছে পাক সেনারা।’
বড়মামা চোখ বড় বড় করে বললেন, ‘বলো কী! এই অবস্থা করেছে মিলিটারী বাহিনী? এত
খবর তো জানতেও পারি নাই।’
আসাদ ভাই আবার বললো, ‘শুধু পঁচিশ-ছাব্বিশ তারিখেই নয়, তার পরেও সারা ঢাকা শহর
লাশের মিছিলে সয়লাব ছিলো। পিলখানা, রায়েরবাজার, মোহাম্মদপুর, তেজগাঁও, ড্রাম ফ্যাক্টরি, কচুক্ষেত, ইন্দিরা
রোড, গণকটুলি, কলাবাগান, ধানমন্ডি, কাঁঠালবাগান, শেরেবাংলা নগর এলাকায়
ঢাকা বিমানবন্দরের অভ্যন্তর বহু মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। মিরপুরে রাস্তার পার্শ্বে শত শত বাঙালি
যুবকের ছড়ানো-ছিটানো লাশ দেখা
গেছে। আর বুড়িগঙ্গাকে তো ওরা লাশের ভাগাড়ে পরিণত করেছে।’
বড়মামা আসাদ ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি এত খবর পাও কই?’
‘মামা, আমরা পুলিশের লোক। খবর সংগ্রহ করাই আমাদের প্রথম কাজ। এ ক’দিনে খিলগাঁও
আর গোরানে ঘুরে ঘুরে সব খবরই নিতে হয়েছে। মৃত্যুর খবর, এইসব এলাকার স্বাধীনতা
বিরোধীদের তথ্য।’ আসাদ ভাই মৃদু হেসে বললো।
আমি মেজচাচাকে বললাম, ‘চাচা, বড়মামা
ঠিকই বলেছেন। আমাদের কালকের মধ্যেই ঢাকা ছাড়তে হবে। তা-না হলে খুব খারাপ কিছু ঘটতে
পারে। যা হয়তো কোনদিনই আর পূরণ হবে না।’
অবশেষে মেজচাচা মেনে নিলেন। ‘ঠিক আছে, যা থাকে কপালে, চলেন কালকেই বেরিয়ে
পড়ি।’
সিদ্ধান্ত হল কাল ভোরেই রওনা হবো আমরা। ছোট-বড় মিলে
ছত্রিশ জনের দল। সব নিজেরা
নিজেরাই। তিন ছেলেমেয়ে
আর কাজের লোকসহ বড়মামারা ছয়জন, কাজের লোকসহ ফুপুর পরিবারে পাঁচজন, বড় আপা, মেজচাচা ও ছোটচাচা তিন পরিবারে চার জন করে বারো জন, মা-বাবা, দাদা-দাদী আর আসাদ ভাইসহ আমরা
আটজন আর ছোটমামারা তিনজন। সেইসাথে যোগ হয়েছে চন্দন-ঊষা। এত বড় দল নিয়ে
যাত্রা করতে হবে, যাদের মধ্যে শিশু এবং মহিলার সংখ্যাই বেশি। সাথে আছে আমার পঙ্গু দাদা, যাকে আমাদেরকেই বয়ে নিয়ে যেতে
হবে। আশির কাছাকাছি বছরের বয়স্কা দাদী, যার পক্ষে এতটা পথ হাঁটা
বেশ কষ্টকর হয়ে পড়বে। যাত্রাকালে সম্ভাব্য সমস্যাগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হল। আমরা যতটা সম্ভব হাইওয়ে
এড়িয়ে চলবো। নৌকা, রিক্সা কিংবা ভ্যানেই যেতে হবে বেশির ভাগ পথ।
সারারাত আমরা বলতে গেলে জেগেই কাটালাম। বড়মামা বুঝিয়ে বলছিলেন। পুরো যাত্রাপথের একটা প্ল্যান নিয়ে মাঝে মধ্যে আলোচনা
চললো। বাইরের ঘরগুলোর আলো
নিভিয়ে আমরা ভিতরের ঘরে বসে নিচু স্বরে সবাই কথা বলছিলাম যাতে বাইরে থেকে কেউ শুনতে না পারে। হয়তো এতটা সাবধানতার দরকার ছিলো
না, তবে আমরা কোন রিস্ক নিতে চাইনি। কোন রুটে কীভাবে আমরা এগোবো। পথে কি কি ধরনের সমাস্যার মুখোমুখি হতে
পারি, আর কীভাবে তা মোকাবেলা করবো। যানবাহন ব্যবস্থা, পাক বাহিনীর গতিবিধির খোঁজখবর জেনে
কীভাবে অগ্রসর হবো। বাকিটা পরিস্থিতি বুঝে ব্যবস্থা নিতে হবে।
ঠিক হলো আমরা গোরানের পেছন দিয়ে পায়ে হেঁটে যাত্রা শুরু করবো। তারপর চিটাগাঙ
রোড পাড় হয়ে নারায়নগঞ্জে ঢুকে পড়বো।
ফুপা বলে উঠলো- মিয়াভাই, নারায়নগঞ্জ কী নিরাপদ? ওখানেও আর্মিদের টহল থাকতে
পারে।
আসাদ ভাই বললো, ‘নারায়ণগঞ্জ নিরাপদ না, তবে কেরানীগঞ্জের রাস্তাটাও অতো সোজা
না। চায়ের দোকানে শুনলাম, গতকালই জিঞ্জিরায় মিলিটারীরা হামলা করছে। নৌকা বোঝাই
নিরীহ মানুষজনদের উপর কামান চালানো হইছে, পাক সেনারা জিঞ্জিরায় ঘরবাড়িতে আগুন
দিয়েছে। আর এতে মদদ দিয়েছে পুরাণ ঢাকার বিহারীরা। আমাদের হাতে আর কোন উপায় নাই।’
আসাদ ভাইকে সমর্থন করে সফিক ভাই বললেন, আসাদ ঠিকই বলেছে। নারায়নগঞ্জে পাক আর্মি থাকতে পারে। তবে
আমাদের চোখ-কান খোলা রেখে চলতে হবে। চারিদিকের অবস্থা আর আর্মিদের গতিবিধি বুঝে
হয়তো আমাদের রিমোর্ট এড়িয়াটাই বেছে নিতে হবে। কিছুটা কষ্ট হবে, সময় বেশি লাগবে
কিন্তু কিছু করার নেই।
আসাদ ভাই আবার বললেন, ‘বেশি রিমোর্ট এড়িয়াতেও যাওয়া যাবে না। আমাদের সাথে
দাদীর মত বয়স্কা মানুষ আর বাচ্চারা আছে। সবদিকে চিন্তা করেই পথ চলতে হবে। তবে এখনই
এতকিছু ভেবে লাভ নেই। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।’
আমরা সবাই অনুধাবন করলাম এছাড়া আমাদের সামনে আর কোন পথ খোলা নেই। মামা আবার
শুরু করলেন,
‘তাহলে এটাই ফাইনাল হলো যে, আমরা নারায়নগঞ্জ হয়ে মুন্সীগঞ্জে ঢুকে পড়বো। তারপর
গ্রামের ভেতর দিয়ে দিঘিরপাড়ে পৌঁছাবো। ভাগ্য ভাল থাকলে নৌকা পাওয়া যেতে পারে।
ওখানে গেলে একটা উপায় বেরিয়ে যাবে।’
মামার কথা শেষ হতেই আমি বললাম- ‘একটা জরুরী কথা; যার যার কাছে ছাতা আর টর্চ
আছে তারা যেন সাথে নিয়ে নেয়। আমার কাছে একটা চার ব্যাটারীর টর্চ আছে, নতুন
ব্যাটারি ভরা। আর কার কার কাছে আছে?’
বড়মামা, ছোটমামা আর মেজচাচা প্রত্যেকেই জানালো তাদের কাছে আছে। আসাদ ভাই বললো
প্রত্যেকেই যেন তাদের টর্চগুলোতে নতুন ব্যাটারি ভরে নেয়। বড়মামা বললো,’ আজ তো আর
সম্ভব নয়, কাল পথে কোথাও থেকে নিয়ে নিতে হবে।’
মামার কথা শেষ হলে সবাই যার যার ব্যাগগুলো আবার চেক করে নিলো, প্রয়োজনীয়
কোনকিছু বাদ পড়লো কি না। রাত বাড়ছে। ঘরভর্তি মানুষ কিন্তু আমাদের কারো চোখে ঘুম নেই।
মহিলাদের উদ্দেশ্যে বড়মামা বললেন,
‘তোমাদের সব গহনা সাথে নিয়ে এতদূর যাওয়াটা উচিৎ হবে না। প্রয়োজনীয় কিছু
সাথে রাখো, বাকীটা এখানে কোন নিরাপদ জায়গায় লুকিয়ে রেখে
যাও।’
রানুর ভারী গয়নাগুলো বড়মামী এবং
অন্যান্যদের সাথে তাদের রান্নাঘরের ফ্লোরে পুতে রাখা হল। কেবলমাত্র সবসময় ব্যবহার্য
কিছু হালকা গহনা, কয়েকটি আঙটি সাথে থাকলো। মেজোচাচা
বললো,
‘আরও কিছু গহনা সাথে রাখো, বিপদে কাজে লাগবে।
জরুরী মুহূর্তে ওগুলো বিক্রি করে প্রয়োজন মেটাতে পারবে।’
মেজো চাচার কথামত রানু একটি হার, কয়েকটি গলার চেইন, কানের দুল,
ছোট ঝুমকা আরও কিছু আংটি তার নিজের ব্যাগে নিয়ে নিলো।
সিঁথির সিঁদুর মুছে ফেলার পর সাদামাটা ছাপা শাড়ি পড়া উষাকে একদমই চেনা
যাচ্ছিলো না। প্রায় আধো-ঘোমটা দেয়া অন্য যে-কোন মুসলিম রমণীর মতই মনে হচ্ছিলো।
বড়মামী যখন কুলসুম বলে ডাকলেন, কুলসুমরূপী উষাও জবাব দিলো স্বাভাবিকভাবে। মা একটা
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন-
‘এ কোন যুগ আইলো? বাঁচনের লইগ্যা মাইনসেরে কত কী যে করতে অয়!’
মা আমাকে বার বার বলছিলেন- ‘অ
সুরুজ, তুই একটু ঘুমাইয়া ল, কাইল থেইক্যা অনেক ধকল যাইবে। এরপর কহন যে ঘুমাইতে পারোস তার ঠিক আছে?’
কিন্তু ঘরের কারোই ঘুমানোর মত অবস্থা ছিল না। আমরা শুধু শেষ রাত্রের জন্য
অপেক্ষা করছিলাম।
আমার দু’চোখ কেবল ঘুমে জড়িয়ে আসছিলো। হঠাৎ মায়ের ডাকে জেগে উঠলাম। তখনও ফজরের আযান হয়নি। বিছানায়
শুয়ে শুয়েই জানালার পর্দা সরিয়ে দেখলাম বাইরে অন্ধকার এবং সারা এলাকা নিঝুম-নিস্তব্দ। মোমবাতির মৃদু আলোয় তৈরি হচ্ছে সবাই। আনুর জন্য কিছু খাবারের ব্যবস্থা করছিলো রানু। মা বাদবাকী সবকিছু দেখাশুনা করছিলো। আমার পঙ্গু-অন্ধ দাদাকে বাবা আর দাদী মিলে দীর্ঘ পথযাত্রার জন্য যখন তৈরি
করাচ্ছিলেন। দাদা তখন বাবাকে বলছিলেন,
‘ও আব্দুল্লাহ, রাইত পোহাইছে নি? এত রাইতে ঘুম থেইক্যা তোলছো ক্যা?’
দাদা অন্ধ হলেও কিভাবে যেন বুঝেছিলেন তখন রাত শেষ হয়নি।
বাবা বললেন, ‘নামাজ পড়বেন না?’
‘পড়মু তো। আযান দেছে?’
‘হ’।
‘ও’।
পর্বঃ ৮
দুর্গম যাত্রা শুরু
৪ঠা
এপ্রিল, ১৯৭১
সারা শহর নিস্তব্ধ। শান্ত, নিরিবিলি। কে বলবে এ শহরের লোকজন আতঙ্কের মধ্যে দিন
কাটাচ্ছে। পাকিস্তানি মিলিটারী নামক আতঙ্ক। ঘর থেকে
বের হয়ে মামী বার বার পেছনে ফিরে তাকাচ্ছে। মনে প্রশ্ন- এই সাজানো সংসার ঠিকঠাক
থাকবে তো! মামা তাড়া দিলেন। অবশেষে আমরা বড়মামার গোরানের বাসা থেকে বাড়ির
উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। তখনও রাতের অন্ধকার পুরোপুরি কাটেনি। ফজরের নামায শেষে
মুসুল্লিরা সবে ঘরে ফিরে গেছে। ফাঁকা রাস্তার পাশের মাঠে জমানো ময়লার স্তুপের কাছে কয়েকটা কুকুর কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়েছিলো কেবল।
এলাকার গলিপথ ধরে পূবদিকে
কিছুদূর এগিয়ে গেলে অনেকটা জায়গা জুড়ে খোলা জমি। বর্ষাকালে এই জমিগুলো পানিতে ডুবে থাকে। এই জমির
শেষপ্রান্তে বিচ্ছিন্নভাবে ছোট ছোট গ্রাম। শহরটাকে ডান দিকে রেখে খোলা জমির পাশ
দিয়ে সরু পথ ধরে আমরা এগিয়ে চললাম। আধো-অন্ধকারে দূরে গ্রামগুলোকে দেখা
যায় ঝাপসাভাবে। শীতের
আমেজ শেষ হয়েছে মাত্র কিছুদিন আগে। সবজীও
এখন প্রায় শেষদিকে। অনেক জমিই পরিত্যাক্ত। কিছু কিছু জমিতে দেখতে পেলাম টমেটো, লাউ
ও শিমের মাচা। পূবদিক থেকে আসা ভোরের হাওয়ায় কিছুটা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছিলো।
এমনিতে আমাদের চলার পথটা মোটেই মসৃণ ছিলো না। তার উপর সাথে মহিলা ও বাচ্চারা ছিলো। আমি
বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছিলাম মহিলা আর শিশুদের নিয়ে পথচলা খুব একটা সহজ হবে না। আসলে ঐ-পথে সাধারণত মানুষ যাতায়াত করে না, তাই নির্দিষ্ট
কোন রাস্তাও নেই। মাঝে মাঝেই নানা খানা-খন্দ আর নর্দমা। এগুলো এড়িয়ে আমাদের পথ চলতে হচ্ছিলো। আমি দাদাকে
কাঁধে নিয়ে হাঁটছি। রানুর
নিজেকে সামলানোই কষ্টকর তাই আনু যথারীতি মায়ের কাছেই থাকলো। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল
আলো ফোটার আগেই এই এলাকা ছেড়ে দূরে চলে যাওয়া।
কিছুদূর চলতেই আমাদের সামনে আরেকটি দলকে দেখতে পেলাম। তারাও সামনে এগিয়ে
চলেছে। মনে মনে ভাবলাম- যাক, ওদেরকে
অনুসরণ করে সামনে এগোনো যাবে। আমরা নিঃশব্দে পথ চলছিলাম। খুব প্রয়োজন না হলে কেউ
কথা বলছিলাম না। সবার সামনে আসাদ ভাই, ছোটচাচা আর মেজচাচার
ছেলে মতিনকে দেয়া হয়েছে। তারা চারিদিকে নজর রেখে পরিস্থিতি বুঝে আমাদের নির্দেশনা
দিবে। সবশেষে ছোটমামা, চন্দন (ছদ্ম নাম চান মিয়া) আর বড় মামার কাজের ছেলে মনাকে
রাখা হয়েছে। সবাই ঠিকমত এলো কিনা সে খেয়াল রাখার জন্য।
বড়মামাকে সামাল দেয়ার জন্য আমি বাবাকে তার সাথে মাঝামাঝি জায়গায় থাকতে বললাম। তারেক মাঝখানে আমার পাশে পাশে হাঁটছে।
গতরাতের আলোচনা অনুযায়ী আমরা চলছিলাম। এই পথে পায়ে হেঁটে হাইওয়েতে উঠবো। তারপর মেইন রোড ক্রস করে নারায়ণগঞ্জে ঢুকে পড়বো। চারিদিক
এখনও পরিষ্কার হয়নি, আমরা ধীর গতিতেই চলছিলাম। কাঁধে বৃদ্ধ দাদা, তাই খানা-খন্দ
দেখে আমাকে খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছিলো। আমার
সামনে ছিল মেজোচাচার ছেলে মতিন, ও-ই আমাকে পথ-নির্দেশনা দিচ্ছে।
আরও আধাঘণ্টা চলার পর চারিদিক ক্রমশ ফর্সা হয়ে আসছিলো। এলাকা ছেড়ে অনেকদূর চলে এসেছি। দিনের প্রথম আলোয় দেখলাম আমাদের থেকে বেশ কিছুটা
সামনে আরও কয়েকটি দল এগিয়ে যাচ্ছে।
মা বলল- ‘একটু জিরাইয়া নেওয়া দরকার। বাচ্চাগুলান কাহিল হইয়া পড়েছে’।
মহিলা আর বাচ্চাদের কথা চিন্তা করে আমরা একটা বড় গাছ দেখে তার তলায় থামলাম।
তখন চৈত্র প্রায় শেষের দিকে। গাছে গাছে কাচা আম ঝুলছে। সুমন আর হাসান গাছে ঢিল
ছুড়তে যেতেই বড়মামা ধমকে উঠলেন। দুজনেই ফিরে এসে চুপচাপ যার যার জায়গায় বসে পড়লো।
আমি হাসানকে নিচু স্বরে বললাম, সামনে অনেকটা পথ হাঁটতে হবে। আম খাওয়ার অনেক
সুযোগ পাবি। একসময় আর কিছুই খাওয়ার ইচ্ছে থাকবে না। শুধু
সময় গুনবি কখন বাড়ি পৌঁছাবি।
প্রায় মিনিট বিশের মত আমরা বিশ্রাম নিলাম। তারপর আবার শুরু হল আমাদের পথ চলা। দাদাকে কাঁধে নিতে যেতেই আসাদ ভাই হাসতে হাসতে বললো,
‘এবার বুড়ারে আমার কাছে দাও, তুমি বরং বুড়ির কাছে যাও। দেখো তাঁকে কোলে নিতে হয় কি না’।
তারেক আমার পেছনেই ছিলো। দাদীর পাশে পাশে হাঁটছিল। আসাদ ভাইয়ের কথাগুলো শুনে
তারেক মিটিমিটি হাসছে। ফিসফিস করে আমার উদ্দেশ্যে
বললো, ‘দাদা, দ্যাখো না দাদীর কোন হেল্প লাগে কি না।’ আমিও দাদীর দিকে তাকিয়ে হাসছিলাম। সে হাসির মানেটা ছিলো অনেকটা এরকম ‘কী
দাদী, উঠবে না-কি কোলে?’ দাদী কি বুঝলো জানি না, সে আমার দিকে ফিরে মুখ ভেংচালো। তারপর সেই ফোকলা দাঁতে হেসে আমার কানের কাছে
বললো, ‘আগে নিজের বিবিরে সামলা। দ্যাহো না ও আটতে পারতেছে না। পারলে ওরে কোলে নে।’
মেজচাচী দাদীর পাশ থেকে হাসছিলো। আমি ওখান
থেকে নিঃশব্দে সরে গেলাম। তারেক নিচু স্বরে বললো, ‘কী রকম ধরা খাইলা দাদা? দাদী
তোমার থেকে এককাঠি উপরে, বুঝছো?’
ওকে ধমক দিয়ে আমি সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। চারিদিক আলোকিত হয়ে উঠতেই মনে হলো
আরেকটি দিনের শুরু। মনে উৎকণ্ঠা- কেমন যাবে আজকের দিনটি? লোকজন ঘরবাড়ি থেকে বের
হয়ে আসছে। অনেকে উৎসুক দৃষ্টিতে আমাদের দেখছে। আবার নতুন করে কিছু দল যোগ হচ্ছিলো আমাদের সাথে। সবার উদ্দেশ্য একটাই- এই
অঞ্চল ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাওয়া। এই
দিকটা শহরের বাইরে। কিছুটা নিরাপদ। তাই অনেকেই এলাকা থেকে বের হবার জন্য এই
পথটাকেই বেছে নিয়েছে। ছোটচাচা আর মতিন কিছুটা দ্রুত হাঁটছিল। অন্যরা ওদের সাথে তাল
মেলাতে পারছিলো না। সাথে মহিলা ও বাচ্চারা রয়েছে। বড়মামারও বেশ বয়স হয়েছে। তাই আমি
চোটচাচাকে আস্তে হাঁটতে বললাম। পেছনে এসে দেখলাম বড়মামা হাঁপাচ্ছেন। আমি ঘুরে তাঁর
কাছাকাছি চলে আসলাম। কথা বলে বুঝলাম তার কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। সবাইকে থামতে বললাম।
আমরা আবার কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। ‘চল, আর দেরী করা যাবে না। সামনে অনেক পথ
বাকী।’ বড়মামাই তাড়া দিলেন।
আবার এগিয়ে চললাম। বড়মামার বাসা গোরান থেকে বেড়িয়েছি প্রায় তিনঘণ্টা। এতটা পথ হেঁটে
অবশেষে আমরা ঢাকা-ডেমরা হাইওয়েতে উঠে এলাম।
রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা। এখন কারফিউ নেই। ছোটচাচা আর আমি পরিস্থিতি যাচাইয়ের জন্য
সামনে এগিয়ে গেলাম। আশেপাশে তেমন কিছু চোখে পড়লো না। কেবল মানুষজন ছুটছে। যেন
মানুষের ঢল নেমেছে। এছাড়াও বিচ্ছিন্নভাবে কিছু মানুষ
রাস্তার একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে আসা যাওয়া করছে। আমরা ফিরে এসে পরিস্থিতি জানাতেই বড়মামা সামনে চলার জন্য মতামত দিলেন। আমরা
হাইওয়ে ক্রস করে উল্টাদিকের মাতুয়াইল এলাকায় ঢুকে পড়লাম। এখন এসব এলাকায় ঘন বসতি
গড়ে উঠলেও তখন বেশিরভাগই ছিল নিম্নাঞ্চল। কোথাও
চাষের জমি, কোথাও পুকুর-ডোবা।
মেইনরোড এড়িয়ে অপেক্ষাকৃত গ্রামাঞ্চল আর লোকজনের বাড়িঘরের মধ্য দিয়ে এগিয়ে
চলছি। আসাদ ভাই থেকে এবার দাদাকে কাঁধে তুলে নিলো
ছোটচাচা। আমি হাঁটতে হাঁটতে মায়ের পাশে চলে এলাম। মা সারাটা পথই আনুকে কোলে নিয়ে
হেঁটেছেন।
আমি বললাম, ‘এবার ওকে আমার কাছে দাও।’
আনু এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলো, এবার জেগে উঠলো। আমার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসেই গলা
জড়িয়ে ধরলো।
মা হাসতে হাসতে বললেন, ‘দেখো না, বাবাকে পেয়ে কী খুশি! আমি যেন আর কেউ না।’
মায়ের কথা শুনে এত কষ্টের মধ্যেও হেসে ফেললো মিনু ফুপু। আমি আনুকে কোলে নিয়ে পুরো দলটাকে একবার ভাল করে দেখে নিলাম। সবাই ঠিকঠাকই আছে। দলের
অল্পবয়সী ছেলেদেরকে দেয়া হয়েছে সবার ব্যাগগুলো বহন করার দায়িত্ব। ওরা তা ভালভাবেই
পালন করছিলো। দেখলাম বড়মামা আর বাবা কোন একটা বিষয় নিয়ে আলাপ করছেন। আমি তাদের ছাড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম।
আমার সামনে সামনে হাঁটছিলেন নুরুল ফুপা। তাঁকে
দেখে মনে হচ্ছিলো কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ফুপা, কষ্ট হচ্ছে?’ তিনি
আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন,
‘না। আমার আর কষ্ট কি? ছোট ছোট শিশু আর তোমার বৃদ্ধা দাদীর জন্য চিন্তা
হচ্ছে।’
কাঁচাপাকা শ্মশ্রুমন্ডিত ছোটখাটো গড়নের নিরীহ মানুষ নুরুল ফুপা একজন কেমিস্ট।
ঢাকা মেডিকেলে চাকরী করেন। ফুপার কাছে অফিস আর বাসাই একমাত্র জগৎ। নিজের ধর্মকর্ম
নিয়েই থাকেন। তাঁর দুই ছেলেমেয়ে চৌদ্দ বছরের সুমন এবার ক্লাস এইটে পড়ে আর মেয়ে
সুমি স্কুল শুরু করেছে মাত্র। দুই
সন্তান নিয়ে মিনু ফুপুর ছোট সুখী পরিবার। যুদ্ধের এই অনিশ্চিত পরিস্থিতি নুরুল
ফুপার জন্য সবচেয়ে কষ্টকর। ফুপা আমাকে নিচু কণ্ঠে বললো,
‘সুরুজ, মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়। আল্লাহ আমাদের এই বিপদ থেকে রক্ষা করবেন।’
আমি ফুপার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘জ্বি ফুপা।’
আমরা কখনও ধানি জমি ঘেঁষা সরু রাস্তা আবার কখনও মানুষের বাড়ির পাশের মেঠোপথ
ধরেই এগিয়ে চলেছি। বয়স্ক ও মহিলাদের কথা ভেবে কিছুক্ষণের জন্য আবারও একবার বিশ্রাম
নিয়ে নিলাম। মেজচাচার মেয়ে তানিয়া বললো,
‘সুরুজ দাদা, পানি খাবো।’
তানিয়ার দেখাদেখি আরও কয়েকজন পানি খেতে চাইলো। আমাদের সাথে আনা পানি শেষ। তাই
পাশের বাড়ির টিউবওয়েল থেকে বোতলগুলোতে খাওয়ার পানি নিয়ে নিলাম।
এগারোটা বাজে। আমরা আবার চলতে শুরু করলাম। সকাল থেকে একই ধরণের পথে চলতে হচ্ছে। তাই এখন আর কাউকে নির্দেশনা দিতে হচ্ছে না। সবার আগে আগে
তারেক, তারপর আসাদ ভাই আর মেজচাচা। আমি, ছোটমামা আর চন্দন দলের সবার দিকে লক্ষ
রাখছি। আসাদ ভাই আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিলেন কয়েকদিন আগে নারায়নগঞ্জের চাষাড়াতে
পাকবাহিনী বেশকিছু নিরীহ মানুষকে গুলি করে মেরেছে। বড়মামা সবাইকে নির্দেশনা দিলেন,
এখন থেকেই অনেক সাবধান হতে হবে। সামনে পেছনে যারা থাকবে তারা চোখ-কান খোলা রাইখো।
মাকে ডেকে বললেন,
‘জয়নাব, সুরুজের ছেলেকে তোর কাছে রাখ। ওকে এখন থেকে সামনে থাকতে হবে।’ চন্দনের
দিকে তাকিয়ে আবার বললেন, ‘চান মিয়া, তুমি পেছনে চলে যাও।’
মা আবার আনুকে কোলে তুলে নিলো। বড়মামা তারেক আর মতিনকেও আমার সাথে সামনের
দিকেই রাখলেন। দাদাকে কাঁধে নেয়ার দায়িত্ব পড়লো পালাক্রমে মেজচাচা ও ছোটচাচার উপর।
তবে আসাদ ভাইও তাদের সাথে যোগ দিলো।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন