এই উপন্যাসটিতে সম্মুখ সমরের কোন ঘটনা তুলে ধরা হয়নি। ওয়ারফ্রন্টের কোনও দৃশ্য নেই। তবে এই লেখায় মূলত যে গল্পটি বলার চেষ্টা করা হয়েছে তা মুক্তিযুদ্ধের বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। একটি যুদ্ধ নানানভাবে মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে, যার কোনোটিকেই ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। একাত্তরের পঁচিশে মার্চের সেই কালরাত থেকেই নিজেদের পরিবারকে বাঁচানোর তাগিদে মানুষ ঢাকা শহরের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছুটে বেড়িয়েছে। কেউ কেউ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ফিরে গেছে নিজ গ্রামে। এই গল্পে তেমনই কিছু মানুষের জীবনযুদ্ধের ঘটনাবলীই তুলে ধরা হয়েছে; যারা নিজেদের পরিবারকে বাঁচাতে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে ফিরে চলে নিজ গ্রামে। এটা মোটেও সহজ ছিলো না। এই ফিরে যাওয়ার গল্পটিই এই উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য।
শরতের এক
রোদেলা দুপুরে, নিজের দশ বছরের নাতিটিকে বাঁচাতে, তাঁর ছোট ভাইয়ের জোয়ান ছেলেটা
যখন পুকুরে ঝাপ দিলো, ঠিক তখনই চকিতে আরেকটি দৃশ্য মনে পড়ে গেলো বৃদ্ধ সুরুজ
মিয়ার। সম্মুখ যুদ্ধের অগ্নিঝরা দিনগুলো ছাড়াও, সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তায় ভরা কয়েকটি
দিনের ছবি তাঁর চোখে ভেসে উঠলো। আজকের এই ঘটনা তাঁকে এক ঝটকায় ফিরিয়ে নিয়ে গেলো
প্রায় পাঁচ দশক আগে। সেই উত্তাল মেঘনা, সেই আড়িয়াল খাঁ, ঝড়- বৃষ্টি, নদীর স্রোত,
নৌকাডুবি, সেদিনের সেই ছোট্ট সুমিকে স্রোতে ভেসে যাওয়া থেকে বাঁচানো... সবকিছু মনে
করিয়ে দিলো। বৃদ্ধ সুরুজ মিয়া উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে পুকুরের স্থির জলের দিকে। মনে মনে ভাবে, তার বড় ছেলের ঘরের নাতি অপু
বাড়িতে আসার পর থেকেই তার কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে চাচ্ছে। প্রতিদিন একই বায়না। আজ মনে হয় আর ওকে থামিয়ে
রাখা যাবে না।
শেষ বিকেলের আলোটুকু ক্রমশ করে ফিকে হয়ে আসছিলো। পড়ন্ত বেলার সূর্যটা তার তেজী রূপ হারিয়ে পূর্ণ যৌবনা নদীটার ও-পাড়ের ধূসর
গাছপালার প্রান্ত ছুঁয়ে হঠাৎ যেন থমকে গিয়েছিলো। অপু মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল নদীর
দিকে। এখান থেকে দক্ষিণে তাকালেই নদীটা দেখা যায়। দু’শ গজের মত ব্যবধান মাত্র। নদীর পানিতে দিন শেষের বিমর্ষ সূর্যের কোমল আলোর আশ্চর্য মায়াবী রূপ- পুরোটাই চোখে পড়ে। অপু যতবার গ্রামে আসে ততবারই যেন নতুন করে এ নদীর প্রেমে
পড়ে যায়। গ্রামে আর একটি প্রিয় মুখ ওকে খুব টানে। অপুর বৃদ্ধ দাদা। এবার
গ্রামে আসার পর থেকেই দাদার পেছনে
আঠার মত লেগে আছে, দাদার কাছে তাঁর জীবনের গল্প শুনবে। মুক্তিযুদ্ধের গল্প।
বৃদ্ধ সুরুজ মিয়া বসেছিল ঘরের পাশের এক টুকরো খোলা চত্বরে। গাছের ছায়ায় বিকেলের মৃদুমন্দ হাওয়ায় শরীরটাকে জুড়িয়ে
নেয়ার খেয়ালে। একটা
বেতের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে তাকিয়ে ছিল কালের সাক্ষী প্রমত্তা যৌবনা খরস্রোতা নদীটার
দিকে। বৃদ্ধের সামনে বেতের মোড়ায় মুখোমুখি
বসে আছে তাঁর দুই নাতি- অপু আর দীপু। অপু
তন্ময় হয়ে দেখছিল ওর দাদাকে; সে যেন হারিয়ে গেছে কোন এক সুদূরলোকে। গোয়াল-ঘরের
চালার উপরে হেলে পড়া বয়সী জামরুল গাছটার পাতার ফাঁক গলে মিষ্টি রোদের আলোচ্ছটা
চুইয়ে এসে পড়েছে বৃদ্ধের মুখে। বিকেলের মায়াবী রোদ অপুর সত্তরোর্ধ দাদার কাশফুলের
মত সাদা চুল থেকে নেমে ভাঁজ পড়া কপাল-গাল ছুঁয়ে সফেদ-শুভ্র দাড়িতে এসে থেমেছে। তাঁর দৃষ্টি ছিল নদীর দিকে। সুরুজ মিয়া বসে বসে ভাবে- ‘এ
নদী গড়েছে কত ইতিহাস! বাড়ি-কে বাড়ি, গ্রাম-কে গ্রাম উজাড় হয়েছে ওর বুকে!’
আরেকটা দৃশ্য ভেসে ওঠে বৃদ্ধ সুরুজ
মিয়ার মনে।
বুকের মধ্যে চলমান স্রোতের শব্দ শুনতে পায়। উথাল-পাথাল ঝড়ের শব্দ। কতকাল কেটে গেছে! একটুও ম্লান হয়নি
সে স্মৃতি। এতকাল
ধরে নিজের ভিতরে পুষে রাখা মাতমটা হঠাতই যেন বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়। সামনে বসা নাতিরা তাঁরই দিকে তাকিয়ে আছে একনিষ্ঠ শ্রোতা হয়ে। সুরুজ মিয়া হারিয়ে গিয়েছিলো
ইতিহাসের পাতায়। সবকিছু দিব্যচোখে দেখতে পাচ্ছে যেন। কিছু বুঝতে না পারলেও দশ বছরের দীপুও প্রবল উৎসাহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে তার
দাদার মুখের দিকে।
‘সে বড় কষ্ট আর দুর্যোগের সময় ছিল রে ভাই।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এভাবেই
শুরু করলো বৃদ্ধ।
সামনে একবার তাকিয়ে
দেখলো শ্রোতারা গল্প শোনার জন্য কতটা উদগ্রীব। অপু- দীপুর সাথে আরও কিছু মুখ এসে জুড়েছে
তখন। বৃদ্ধ একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলো-
‘তখন আমার বয়স এই ধর ত্রিশের
মত। তোদের দাদীর তেইশ কী চব্বিশ, আর
তোদের বাবা তখন ‘এই এত্তটুকুন’ দুই হাত কাছাকাছি এনে দেখালো বৃদ্ধ।’ দীপু উচ্চশব্দে হো হো করে হেসে ফেলল।
বৃদ্ধ একটু সময় নিয়ে আবার যোগ করলো- ‘জানটারে হাতের মুঠোয় নিয়ে জ্বলন্ত
অগ্নিকূপে দশ-দশটা দিন পার করেছিলাম। তারপর বাঁচার তাগিদে একদিন দলবলসহ
ঢাকা ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম বাড়ির পথে। পায়ে হেঁটে।’
শ্রোতারা সব নিশ্চুপ। পরবর্তী অংশ শোনার জন্য উৎসুক সবাই।
‘আমরা তখন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের খুব কাছেই থাকতাম। বাসা
থেকে বেরিয়ে গলির মাথায় আসলেই রাজারবাগ পুলিশ লাইনটা দেখা যেত’।
এ পর্যন্ত বলে বৃদ্ধ আবার কিছুক্ষণ থামলো। ঘরের পাশের ছোট্ট চত্ত্বরটায় তখন পিনপতন নিরবতা। সবাই মুন্ত্রমুগ্ধের মত চেয়ে আছে বৃদ্ধ সুরুজ মিয়ার দিকে। এবার সে পুরো কাহিনী শুরু করল।
কালরাতের ভয়াল থাবা
২৫শে মার্চ, ১৯৭১
রাতটা ছিল ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্নের মত। তখন আনুমানিক রাত বারোটার কাছাকাছি হবে। সে রাতে
আসাদ ভাই আর ছোটমামা আমার বাসাতেই ছিলো, তাই দেশের পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন আলোচনায়
অনেক রাত হয়ে গিয়েছিলো। আমরা কেবল ঘুমাতে যাওয়ার
প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে চমকে উঠলাম। গোলাগুলির শব্দ, মুহুর্মুহু ভেসে
আসছিলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝলাম গুলির শব্দগুলো পুলিশ লাইনের দিক থেকেই আসছে। গুড়ুম! গুড়ুম! কেঁপে কেঁপে উঠছিলো আমাদের ঘর। মেশিনগান আর কামানের আওয়াজ
সব। মনে হচ্ছিলো আকাশ ভেঙে পড়বে ঘরের উপর। ঘরের আলো বন্ধ ছিলো, কিন্তু হঠাতই বাইরে
থেকে জানালা গলে আসা উজ্জ্বল আলোয় আমাদের ঘরের ভিতরটা আলোকিত হয়ে উঠলো। আনু তখন তিন মাসের শিশু। গোলাগুলির শব্দে চিৎকার করে জেগে উঠলো ও। আমরা আরও ভয় পেয়ে গেলাম। তোদের দাদী
ছিল ভীতু স্বভাবের মানুষ। সে থরথর করে কাঁপছিলো। বাবাও খুব অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। কেবলমাত্র শান্ত, স্থির ছিলেন- মা। মা তখন ছুটে
এসে আনুকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন। বুকের
সাথে এমনভাবে সাঁটিয়ে রেখেছিল যেন ও কান্না না করে। তোদের দাদীকেও সাহস যোগাচ্ছিলেন মা। পুলিশ ব্যারাকের
ওদিকটা আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। মনে হচ্ছিলো আমাদের ঘরেই আগুন ধরে গেছে। পরে
জেনেছিলাম মেশিনগানের গোলায় ব্যারাকে আগুন ধরে গিয়েছিলো। আমরা সবাই ভেতরের রুমে
গিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়লাম। রানু হাউমাউ করে কেঁদে
উঠলো। আমি ধমক দিলাম। একটা বালিশ এনে বললাম এটা দিয়ে কান চেপে রাখো। দেখলাম ও তাই
করলো। এর মধ্যে গোলাগুলির থামাথামি নেই। অবিরাম চলছিলো। আমার পঙ্গু-অন্ধ দাদা
কিছুই শুনতে পাচ্ছিলেন না কিন্তু আমাদের অবস্থা দেখে ঠিকই বুঝেলেন ভয়ংকর কিছু
ঘটছে, তিনি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। আমরা তাকে বিছানায় শুইয়ে দিলাম, বাবা তার পাশে বসে মাথায়
হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন।
আমরা আগে থেকেই আঁচ করছিলাম এরকম কিছু একটা হবে। বেশ
কয়েকদিন ধরে অফিস-আদালত, রাস্তাঘাট, চায়ের দোকান- তখন সব জায়গায় একই আলোচনা ছিল।
কিন্তু সেটা যে এত নির্মম, ভয়াবহ আর বর্বোরোচিত হবে এটা কখনও ধারণা করতে পারিনি। থেকে থেকেই আকাশ আলোকিত হয়ে উঠছে,
যেন হাউই উড়ছে। জানালার পর্দা ভেদ করে সে আলোয় আমাদের ঘর আলোকিত হয়ে উঠছে। মা
ভেতরটা অন্ধকার করার জন্য জানালার পর্দার উপরে বিছানার চাঁদর দিয়ে দিলেন। এভাবেই ঘন্টা দুই পার কললাম।
এখান থেকে কাছাকাছি এলাকায়তেই আমাদের সব অত্মীয়স্বজনের
বসবাস। তবে এই মুহূর্তে আমার বাসাটাই সবচেয়ে বিপদজনক জায়গায়- একেবারে বাঘের মুখে।
আমার মনে হলো আসাদ ভাই আর ছোটমামাকে আজ আমার বাসায় আটকে রেখে ওঁদের জন্য বিপদ ডেকে
আনলাম। ওরা শাহজাহানপুর, খিলগাঁও কিংবা গোরান- যে কোনো জায়গায় থাকলে এখানের চেয়ে
নিরাপদে থাকতে পারতো।
আসাদ ভাই রানুর বড়ভাই। ডিবি ইন্সপেক্টর, চট্টগ্রামে
পোষ্টিং। ঢাকায় একটা কাজে এসেছিলো কিন্তু আর ফিরে যেতে পারেনি। ছোটমামা মিজানুর
রহমানের বাসা শাহজাহানপুরে। বড় আপার
বাসার কাছে। তবে তার স্ত্রী ও একবছর বয়সী ছেলে এখন বড়মামার বাসা গোরনে। তাই সে
স্ত্রী-সন্তানের বিষয়ে কিছুটা চিন্তামুক্ত। আমি ছোটমামা আর আসাদ ভাইয়ের দিকে
তাকালাম। নিচু স্বরে বললাম, ‘জোর করে ধরে রেখে আমি তোমাদেরকে বিপদের মধ্যে ঠেলে
দিলাম।’
এই চরম দুর্যোগের মধ্যেও দু’জনেই নিঃশব্দে হাসলো। ছোটমামা
বললো, ‘তোর কী দোষ? কোথায় কার কখন কীভাবে বিপদ আসবে কে বলতে পারে!’
আমি আর কিছু বললাম না। ছোটমামা ভেতরের রুমে চলে গেলো। মাকে বললো,
‘বুবু, আর দেরী করা যাবে না। জরুরী যা দরকার তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নাও’।
মেজোচাচার বাসা ওখান থেকে আরও কিছুটা ভিতরে; খিলগাঁও। ঠিক হল- প্রথমে ওখানে চলে যাব, তারপর সবাই মিলে ঠিক করা যাবে
পরবর্তী করণীয়।
একটু পর মা এসে জানালেন, পাশের বাসার বাসিন্দাদের সাথে
কথা হয়েছে, ওরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই এলাকা ছেড়ে যাবে।
‘মানে- ফারুক সাহেবরা?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
মা হাঁ সূচক মাথা নাড়লেন। আমি ফারুক সাহেবদের ঘরের দিকের জানালায় গিয়ে দাঁড়ালাম। তাকে দেখলাম ঘরের মধ্যে পায়চারি
করছে। মৃদু স্বরে ডাকতেই বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। আমার মতই অস্থির হয়ে আছে। আমাকে
দেখেই বলে উঠলো,
‘ভাই, অবস্থা ভাল না। এখানে থাকা কোনভাবেই
নিরাপদ না।’
‘আপনারা নাকি আজই চলে যাচ্ছেন?’
ফারুক ভাইকে জিজ্ঞেস করতেই সে জানালো যত দ্রুত সম্ভব তারা এখান থেকে চলে যাবে। সব
গোছগাছ করছে। ঘরে এসে রানু আর মাকে
বললাম জরুরি প্রয়োজনীয় কাপড়চোপর গুছিয়ে ফেলতে। যে কোন সময় এই এলাকা ছাড়তে হবে। ছোটমামা বলার পরই বেশির
ভাগ গোছগাছ হয়ে গিয়েছিলো। এখন বাদবাকী জিনিসপত্র গোছানো শুরু করলো। অল্পক্ষণের
মধ্যেই মা আর রানু মিলে দুটো ব্যাগ গুছিয়ে ফেললো। আনুর কাপড়চোপর আর জিনিসপত্রেই একটা ব্যাগ ভরে গেল। আমরা কেউ সামনের দুই রুমে যাওয়ার সাহস পাচ্ছিলাম না।
আমি আসাদ ভাইকে বললাম,
‘বের হব কী করে? গলির মাথায় গেলেই তো বড় রাস্তা, ওখানকার অবস্থা জানতে পারলে ভালো হতো। কোথায়
কোন বিপদ ওৎ পেতে আছে কে জানে! এই
অবস্থায় বাইরে নামা কি ঠিক হবে?’
ছোটমামা বলল, ‘নিজেদের তৈরি রাখতে হবে, সুযোগ
বুঝে বেরিয়ে পড়তে হবে।’
সবাই পেছনের রুমে বসে ওখান থেকে বেরনোর উপায় খুঁজছিলাম। এরমধ্যেই গোলাগুলি চলছিলো আর আমাদের উৎকণ্ঠাও ক্রমাগত বেড়েই চলছিলো। এভাবেই
পেছনের রুমে বসে আমরা কেবল সময় গুনছিলাম। তবে সময়
যেন আর শেষ হচ্ছিল না। একেকটা মিনিটকে মনে
হচ্ছিল ঘণ্টা। আনুমানিক রাত সাড়ে তিনটার মত হবে, কিছুটা
কমে এলো গোলাগুলির শব্দ। ঘরের পেছনে মৃদু শব্দ শুনে পেছনের জানালা
দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি পাশের ঘরের ফারুক সাহেবরা বেরিয়ে এসেছেন। মামাকে বলতেই সে
বলল,
‘এটাই সুযোগ। চল এখনই বেরিয়ে পড়ি।’
আমি সায় জানালাম।
মায়ের বড় ব্যাগ দেখে মামা ধমকে উঠলো। ‘এই ব্যাগ টানবো কে? এক কাপড়েই বেরিয়ে পড়তে হবে। শুধু
সুরুজের বাচ্চার কিছু জিনিসপত্র নিয়ে নাও।’
মা তবুও কাপড়চোপড় কিছু কমিয়ে ব্যাগটা নিজেই হাতে তুলে
নিলেন। ঘরের পেছন দিক দিয়ে বেরুতে গিয়েই থমকে দাঁড়ালাম। পড়িমরি করে ঘরের দিকে ছুটে আসছে
ফারুক সাহেবরা। আমাদের ঘরের আলো নেভানোই ছিলো। সবাই ভেতরে চলে এলাম। একটু পর
বাইরের অবস্থা জানার জন্য আমি আবারও ফারুক সাহেবদের ঘরের দিকের জানালায় পাশে
দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ পরেই ফারুক সাহেব তাদের জানালার পাশে এলেন। আমি ফিসফিস করে
জিজ্ঞেস করলাম-
ফিরে এলেন যে! ওদিকের অবস্থা কী খুব খারাপ?
ফারুক সাহেব মাথা নাড়লেন। এই গলির মাথায়ই গোলাগুলি চলছে।
ভাই, সবদিকের অবস্থাই খারাপ। এখন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। একটা
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ভাগ্যে যে কি আছে আল্লাহ্ই জানে।
রানু মুখে আঁচল দিয়ে কাঁদছিল। আসাদ ভাই ওর পাশে গিয়ে
দাঁড়ালো। রানুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
‘চিন্তা করিস না, আল্লাহ বিপদ দিছেন, আবার আল্লাহই রক্ষা
করবেন। আমার জান থাকতে তোর কিচ্ছু হইতে দিমু না।’
রানু ভাইয়ের কথায় কিছুটা স্বস্তি পেলো। কান্না থামিয়ে মায়ের
কাছ থেকে আনুকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো, ‘আল্লাহ এই
বিপদ থেকে আমাদের রক্ষা করো’। মা রানুর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো।
শঙ্কা, আতংক আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তায় আমরা নির্ঘুম রাতটা কোনরকমে পার করেছিলাম।
পর্বঃ ২
জ্বলন্ত অগ্নিকূপে কয়েকদিন...
২৬শে মার্চ ১৯৭১
রাতের আঁধার তখনও পুরোপুরি কাটেনি। আমরা ঘরের ভেতরেই ফজরের নামাজ পড়ে নিলাম। সামনের ঘরে
এসে জানালার পর্দা একটু সরিয়ে বাইরে তাকালাম। চারিদিকে কোন সাড়াশব্দ নেই, জনশূন্য রাস্তা। এ সময়
সাধারণত ফজরের নামাজ শেষে মুসুল্লিরা ঘরে ফেরে। আজ রাস্তায় মুসুল্লিদের কাউকে চোখে পড়লো না। তাহলে কি আজ
মসজিদে নামাজ পড়তে কেউ যায়নি! ভেতরের রুমে ফ্লোরে চাদর বিছিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা চললো
কিছুক্ষণ। ঘুম কী আর আসে! মাথায় কেবল একটাই
চিন্তা- কখন এখান থেকে বের হয়ে মেজচাচার বাসায় যাবো।
কিছুটা আলো ফুটতেই আবার সামনের রুমে চলে এলাম। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি তখনও রাস্তাঘাট খা-খা করছে। যেন একটা মৃত নগরী। গতরাতের তাণ্ডবে মানুষ এতটাই ভয় পেয়েছে যে কেউ আর ঘরের বাইরে বেরুতে সাহস
করছে না। আমারও রাইরে যাওয়ার সাহস হল না আর। ছোটমামা মৃদু
ভলিউমে রেডিওটা চালাচ্ছে। কোন শব্দ নেই। ভেবেছিলাম অবস্থা একটু শান্ত হলে এখান থেকে চলে যাব। সারারাতের ক্লান্তিতে কখন যে
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতে পারিনি। বাবা-মা, রানু- কেউ আর আমাকে তোলেনি। ঘুম ভাঙলো ন’টায়। আসাদ ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাইরের অবস্থা কেমন?’ সে ছোট করে বললো, ‘মৃত্যুপুরী’। আমি জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি অবস্থা তখনও থমথমে। ছোটমামা
রেডিওটা নিয়ে নড়াচড়া করেই যাচ্ছিলো। নব ঘোরাতে ঘোরাতেই যন্ত্রসঙ্গীত
ভেসে আসলো। শধুই যন্ত্রসঙ্গীত। মামা লো-ভলিউমে রেডিওটা চালু রাখলো।
বাইরে যাবার উপায় নেই। চারিদিকে কি হচ্ছে কিছুই জানতে পারছি না। রেডিওতে কোন খবর নেই। একটা চরম অস্থিরতার মধ্যে সময়টা কাটছিল। সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার ছিল আমাদের বাসাটা রাজারবাগ পুলিশ
লাইনের খুব কাছে ছিল। কোন কারণে পাকিস্তানি আর্মিরা এদিকে ঢুকে পড়লে বড় ধরনের বিপদে পড়ে যেতাম। কিন্তু কিছুই করার ছিল না তখন। রেডিওটা খুব লো
ভলিউমে অন করাই ছিলো। হঠাৎ যন্ত্রসঙ্গীত বন্ধ হয়ে গেলো। উর্দুতে কি জানি বলছে। আমি
উর্দু ভাল বুঝি না, তবে কার্ফ্যু কথাটা বুঝলাম। একটু পরেই অবশ্য ইংরেজিতে বলতে শুরু করলো।
অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারী করা হয়েছে। একটা একটা
করে কারফিউর নিয়মকানুনগুলো পড়ে শোনানো হচ্ছিল। কারফিউ ভঙ্গ করে বাইরে গেলে কি কি শাস্তি, তা-ও জানানো হলো।
মাকে বলতেই তিনি চুপ করে রইলেন। কিছুক্ষণ পর মা বললেন, ‘সুরুজ, তাইলে এহন উপায়? আমাগো তো এইহান থেইক্যা তাড়াতাড়ি চইলা যাওন দরকার।’
ছোটমামা তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, ‘চিন্তা করো না বুবু, সবার যা হইবো আমগোও তাই।’
মা রানুর দিকে তাকিয়ে থাকলো অনেকক্ষণ। রানু দেখতে খুব সুন্দর ছিলো। তার যাতে কোন সমস্যা না হয়
সেদিকে মায়ের খুব খেয়াল ছিল। মা রানুকে বললেন,
‘বউ তুমি আর সামনের ঘরে যাইবা না। কোন কিছুর দরকার অইলে
আমারে কইবা। এই কার্ফু-টার্ফু শ্যাষ অইলে আমরা আর এইহানে থাকমু না।’
আসাদ ভাই ক্ষিপ্ত হয়ে বললো, ‘হারামজাদা সামরিক সরকার আবার
‘মার্শাল ল’ জারি করছে। বাঙালিদের দমিয়ে রাখতে চায়। কিন্তু ওরা জানে না, এই বাঙালী
জাতিরে দমাইয়া রাখা এত সোজা না।’
এতকিছুর মধ্যে বাবার যেন কোন ভূমিকা ছিল না। চুপচাপ দাদার শিয়রের কাছে বসে রইলো। মায়ের কথামত রানু সব
কাজ করে যাচ্ছিল ঠিক, তবে তার দেহে যেন প্রাণ ছিল না। যেন আতঙ্কিত একটি প্রাণি
প্রবল ভয়ে ছটফট করছে। আসলে আমাদের কারও কিছু করার ছিল না তখন। কে কাকে সান্ত্বনা দেবে? মা হঠাৎ নিচু কণ্ঠে বাবার উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,
‘দেশ ভাগের আগে হুনছি সাদা বিলাতি খেরেস্তানরা মানুষের
উপর অত্যাচার করছে কিন্তু অ্যারা তো মোসলমান, মোসলমান হইয়া অ্যারা ক্যান অন্য
মোসলমানগো এমন কইরা মারতাছে?’
আমি আমার মায়ের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবি, আমার অল্পশিক্ষিত মা’ও দেশ নিয়া কত ভাবে! মায়ের কথার উত্তরে বাবাও
নিচু গলায় জবাব দিলেন, ‘অ্যাগো কাছে
হিন্দু-মোসলমান-খ্রীষ্টান কোন ব্যাপার না, মূল কথা অইলো গিয়া ক্ষমতা। অ্যারা শ্যাখ সাইবের কাছে ক্ষমতা ছাড়বে না- এইজন্যই
এতো হানাহানি।’
আসাদ ভাই ক্ষুব্ধকণ্ঠে বললো, ‘কতদিন ক্ষমতা ধরে রাখবে?
একদিন না একদিন ছাড়তেই হবে।’
বাবা আবার বললেন, ‘আমি ভাবতাছি শ্যাখ সাইব অ্যাগো লগে যুদ্ধ করবে কি দিয়া? শয়তানগুলান আমগো জোয়ানগো তো মাইরা সাফ কইরা দিবে। ওরা এত অস্ত্র পাইবো কই?’
এই পর্যন্ত বলে বৃদ্ধ সুরুজ
মিয়া একটু থামল। দীপু সাথে সাথেই জিজ্ঞেস করে, ‘তারপর কি হল দাদা?’
বৃদ্ধ হেসে বললো ‘সন্ধ্যা হয়ে আসছে, আইজ এই পর্যন্তই থাক’।
দিনের আলো কমে গিয়ে চারিদিকে একটা আবছায়া আঁধার যেন ক্রমশ গ্রাস করছিলো সবকিছু। অপু একটু দূরে নদীটির
দিকে তাকায়। অস্তগামী সূর্যের লাল আভা পড়েছে নদীর পানিতে। এমনিতে এই সময়টা তার
ভীষণ প্রিয়। এই মুহূর্তে নদীটা যেন তাকে প্রবলভাবে টানছে। বৃদ্ধ অপুকে ও’দিকে এক
দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল,
‘এই যে নদীটা দেখছো, এ তো মেঘনার কাছে কিছুই না। কী বিশাল আর প্রমত্তা- মেঘনা! চারদিকে কোন কূল-কিনারা ছিলো না। রাক্ষুসে একেকটা ঢেউ উঠত! যেন গিলে খাবে আমাদের। আমরা যেন এক খণ্ড পাটকাঠির মত
ভেসে চলছিলাম কেবল।’
অপু উঠে দাঁড়ায়। দাদার উদ্দেশ্যে বলে, ‘তুমি নামাজ পড়া
শেষ করো, আমরা এই ফাঁকে নদীর পাড় থেকে
ঘুরে আসি। তারপর আবার শুরু হবে কাহিনী।’
বৃদ্ধ সুরুজ মিয়া নাতির দিকে তাকিয়ে হাসে। এ প্রজন্মের
ছেলেমেয়েরাও তাহলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে
চায়! এটা অবশ্যই শুভ লক্ষণ। অপু নদীর দিকে চলে গেলে বৃদ্ধ ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।
সন্ধ্যার পর সামনের বারান্দায় বসে আবার শুরু হল গল্পের
আসর। আসরের মধ্যমণি সেই বৃদ্ধ সুরুজ মিয়া। বিকালের চেয়ে এখন শ্রোতার সংখ্যা বেশী। বাড়ির সব ঘর থেকেই লোকজন এসে হাজির হয়েছে। বাইরে
হালকা আলোআঁধারি
ভাব। সামনের বারান্দার বাতি নিভিয়ে
শুধুমাত্র ভেতর ঘরের একটা লাইট জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে। সে আলোয় সামান্য আলোকিত হয়েছে
আসরের জায়গাটি। দখিণের জানালা দিয়ে নদীর উপর থেকে ছুটে আসা ঠাণ্ডা
হাওয়া ঘরটাতে একটা হিমেল পরশ বুলিয়ে দিচ্ছিলো। বৃদ্ধ সুরুজ মিয়া আবার শুরু করলো-
সেদিন সারাক্ষণই সবাই খুব উৎকণ্ঠার মধ্যে কাটালাম। রানুর মধ্যে এক ধরনের অপ্রকৃতিস্থতা লক্ষ করলাম। কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল সারাদিন। আমরা কোনরকমে খাওয়া-দাওয়া সারলাম। না খেলেই নয় তাই হালকা কিছু রান্না হয়েছিলো। আসলে পেটের ক্ষুধা মিটানোর জন্য খাওয়া। আসাদ ভাই অনেক বুঝিয়েও ওকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারেনি।
মা এমনিতে খুব শক্ত মনের মানুষ। সহজে ভেঙে পড়েন না। কিন্তু
হঠাৎ তাকে দেখেও চিন্তিত মনে হলো। আমি কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই বললো, ‘শিউলিগো যে কী
অবস্থা কেডা জানে!’
আমি বললাম, ‘আমিও
ভাবছিলাম বড় আপাদের কি অবস্থা। আমরা যে মেজচাচার বাসায় যাচ্ছি তাও তো ওরা জানবে
না। আসাদ ভাই আর ছোটমামার সাথে আলাপ করে দেখি।’
আসাদ ভাই আর ছোটমামা একই কথা বললেন। এখন কিছু করার নেই, মেজচাচার বাসায় গিয়ে একটা ব্যবস্থা করা যাবে। মা বুঝলেন এই মুহূর্তে নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়া জরুরী। রাজারবাগ পুলিশ লাইন তখন পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে। আমরা বেশ বুঝতে পারছিলাম এই এলাকা থেকে যত দ্রুত সম্ভব সরে পড়তে হবে। আমরা শুধু ঘোষণার অপেক্ষা করছিলাম কখন কারফিউ শিথিল হয়।
২৭শে মার্চ, ১৯৭১
সকালে কারফিউ তুলে নেয়া হল। গোছগাছ আগে থেকেই করা ছিল। জিনিসপত্র আর কী? অতি প্রয়োজনীয় কিছু কাপড়চোপড়, রানুর গহনা আর অনুর
দৈনন্দিন ব্যবহার্য সামগ্রী। মা আর
রানুকে তাড়া দিলাম। বাদবাকী সবকিছু দ্রুত গুছিয়ে নেয়ার কথা বলে বাইরে এলাম একটু
খোঁজখবর করার জন্য। গলির মোড়ের দোকানটাও বন্ধ। লোকজন কাউকে চোখে পড়ল না সেখানে। আরেকটু সামনে এগোতেই পরিচিত দু’জনের সাথে দেখা মিললো। তাদের মুখে যা শুনলাম তাতে আমার ভিমড়ি খাওয়ার দশা।
ঢাকার উপর সে রাতে যেন নরক নেমে এসেছিলো। রাজারবাগ পুলিশ লাইন দখল করে নিয়েছে
হানাদার পাকিস্তানিরা। বাঙালি পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা প্রাণপণে লড়াই করেছে কিন্তু
পাকিস্তানি বাহিনীর ভারী অস্ত্রসস্ত্র, ট্যাঙ্ক-কামানের আক্রমণে বেশিক্ষণ টিকতে
পারেনি।
ঢাকা ইউনিভার্সিটি এলাকায় নারকীয় তাণ্ডব চালানো হয়েছে। ইউনিভার্সিটির হলগুলোতে ঢুকে ছাত্র-শিক্ষকদের নির্বিচারে গুলি করে মেরেছে। শহীদ মিনার গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। নিউ মার্কেটসহ বিভিন্ন বাজার, বস্তি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে; পুরনো ঢাকার বেশীর ভাগ এলাকা পুড়িয়ে ছারখার করেছে সারারাত ধরে। সেদিন সব খবর জানা যায়নি, পরে জেনেছিলাম আসলে সে রাতে ঢাকায় একটি পরিকল্পিত গণহত্যা চালানো হয়েছিলো; লাশের স্তূপ জমেছিলো ঢাকার রাস্তায় রাস্তায়।
বৃদ্ধ সুরুজ মিয়া আবার থামলো। অপু বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে দাদার দিকে। এর আগে শুধু বই পড়েই অপু জেনেছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। তবে আজকের এই গল্পের আসর একেবারেই আলাদা। একাত্তরের একজন জ্বলন্ত সাক্ষী- ওর দাদা, যিনি একজন মুক্তিযোদ্ধাও বটে; তাঁর মুখে শুনছে সেই সময়ের দিনিলিপি, দাদার জীবনের গল্প। এটা কী কম সৌভাগ্যের ব্যাপার! সুরুজ মিয়াও দেখছিলো নাতিকে। তাঁর আগ্রহ দেখে আবার শুরু করলো-
আমি তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে এলাম। কিছু নেই বললেও তিন-তিনটে ব্যাগ! খুব দ্রুত বেরিয়ে পড়লাম আমরা। পেছনের গলিটার শেষ মাথাটা বড় একটা রাস্তার সাথে মিশেছে। ওখানে গিয়ে দেখি অগণিত মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। পিঁপড়ার মত দলবেঁধে তারা ছুটছে। ছেলে-বুড়ো-শিশু, চোখেমুখে আতঙ্ক নিয়ে প্রাণটা হাতে করে যেন ছুটছে সবাই। আশেপাশে রিক্সা বা অন্য কোন যানবাহন নেই। অগত্যা হেঁটে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিলাম। সামিল হলাম সেই মানুষের মিছিলে। মা আনুকে কোলে তুলে নিলেন, আমি দাদাকে কাঁধে তুলে নিলাম আর আসাদ ভাই, ছোটমামা আর বাবা ব্যাগগুলো বয়ে নিয়ে চললেন। আমাদের এক ঘন্টারও বেশি সময় লেগে গেল মেজচাচার খিলগাঁওয়ের বাসায় পৌঁছুতে।
পর্বঃ ৩
মেজচাচার বাসায় ঢুকতেই দাদী ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।
‘ভাইরে,
তোগো কিছু অয়নাই তো? আমার পরাণডার মধ্যে এতক্ষণ ছটফট করতেছিলো।’
আমি দাদাকে
বিছানায় শুইয়ে দিয়ে দাদীকে নিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। রানু ঘরের
ভিতরে ঢুকেই মেজোচাচীকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। সম্পর্কে মেজোচাচী রানুর ফুপু। চাচী রানুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন।
‘কান্দে না মা। আমরা
সবাই আছি না! এহন আর ডর কী?’
ঘরের ভেতরে ঢুকে আসাদ ভাই বললো, ‘আমিও অনেক বুঝাইছি কিন্তু
ওর ভয় কিছুতেই কাটছে না। ফুপু, তুমি একটু বুঝাও তো। কাইন্দা কোন লাভ আছে?’
মেজচাচী রানুর দিকে ফিরে বললো, ‘বুকে বল রাখতে হইবো, মা। আল্লাহ
ভরসা।’
মেজচাচা জানতে চাইলেন ওদিকের
অবস্থা কী রকম। সেই
রাত থেকে এখন পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী তাঁকে বললাম।
‘আমরা সবাই তোদের জন্যই দুশ্চিন্তায় ছিলাম। তোরা
তো ছিলি একেবারে জমের মুখে’ চাচা বললেন।
‘চাচা, তোমাদের এদিকের অবস্থা কি?’ আমি জানতে চাইলাম।
মেজচাচা বললেন- ‘এহনও তেমন কিছু বোঝা যাইতাছে না। তয়
একটু আগে শোনলাম এইহানকার কিছু লোক পাকিস্তানের পক্ষে কাজ
করতেছে। ভয়ে আছি, এরা পাকিবাহিনীর লগে হাত মিলাইলে কী
হয় বলা যায় না। তাছাড়া এখানকার বিহারীরা তো পাকিস্তানিগো
পক্ষেই থাকবে।’
আমি বিষয়টাকে উড়িয়ে দিতে পারলাম না। কারণ এদেশে অনেক বাঙালী আছে যারা স্বাধীন বাংলাদেশ চায় না। বাঙালী হলেও এদের
অবস্থান পাকিস্তানের পক্ষেই। পাশাপাশি রয়েছে বিহারী জনগোষ্ঠী, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় ভারতের বিহার রাজ্য থেকে আগত
অবাঙালী মুসলিম সম্প্রদায়। এরা শুরু থেকেই একটি অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষেই রয়েছে।
সবাই না হলেও এই বিহারীদের কেউ কেউ পাকিস্তানের হয়ে কাজ করবে, এটা অস্বাভাবিক কিছু
নয়। এই দুই পক্ষ থেকেই আমাদের সাবধান থাকতে হবে। তবে আমার মনে হয় এদের থেকে বেশি ভয়ঙ্কর হলো বাঙালী স্বাধীনতা বিরোধী চক্র,
যারা মূলত ঘরের শত্রু বিভীষণের মতই। আমি
মেজচাচাকে বললাম,
‘এখনই এত দুশ্চিন্তা করার কিছু নাই। কিছুদিন যাক, পরিস্থিতি
বদলাতেও পারে।’
মেজচাচার সাথে কথা বলতে বলতেই দেখলাম বড় আপারা এসে হাজির।
ঘরে ঢুকেই বড় আপা মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিলো। কিছুক্ষণ পর আমার দিকে চোখ পড়তেই কাছে ছুটে এলো। ‘তোরা ভাল
আছোস তো সুরুজ।’ আমি হাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। জানতে চাইলো ‘রানু কই?’ আমি ইশারায়
মেজচাচীর দিকে ইঙ্গিত করলাম। রানুর সাথে কথা বলতে বলতেই আপা আনুকে কোলে তুলে নিলো।
সফিক ভাইকে খুব চিন্তিত লাগছে। জিজ্ঞেস করতেই বললো, ‘একটা কিছু হবে জানতাম, তবে সেটা যে এত তাড়াতাড়ি ঘটবে
বুঝতে পারিনি। তোমাদের নিয়েই খুব বেশি চিন্তা হচ্ছিলো। শিউলি তো প্রায় সারাক্ষণই
কেঁদেছে। এখন তোমাদের দেখে শান্ত হলো।’
আমি চিন্তাযুক্ত কণ্ঠে বললাম, ‘আমরা কিন্তু এখানেও নিরাপদ
নই। সবাই মিলে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে কি করবো।’
পরের দিন কারফিউ
ভাঙার পর বড়মামা আর
ছোটচাচা চলে আসলো। বড়মামার বাসা গোরান। ছোট চাচার বাসাও একই এলাকায়, আর মিনু ফুপুর বাসা মালিবাগ চৌধুরিপাড়ায়। চারিদিকের অবস্থা দেখে তারা
ভীষণ অস্থির হয়ে উঠেছিলো। এখন সবাইকে এখানে দেখতে
পেয়ে কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো।
বড়মামা বললেন, ‘শেখ মুজিব এরেস্ট হয়েছে জানো?
দেশের অবস্থা মোটেই ভাল না। আর ঢাকায় থাকা ঠিক হবে না, চল সবাই মিলে দেশের বাড়ি
ফিরে যাই।’
মামার কথায় সায় দিলেন বাবা। ‘হ তাই লও। এই গ্যাঞ্জামের মধ্যে
এইহানে থাকন ঠিক অইবে না।’
ছোটমামা
উত্তর দিল, ‘যাবেন যে বললেন এখন তো কারফিউ চলতেছে। আবার শুনলাম বাস-লঞ্চ কিছুই চলবে না।’
বাবা অস্থির হয়ে উঠলেন, ‘এইহানে যে অবস্থা চলতাছে তাতে ঢাকায় তো আর থাকা চলে না।’
মেজচাচা বললেন,
‘অসুস্থ বাবা, ছোট-ছোট বাচ্চারা আর মেয়েছেলেও আছে, এত দূরের পথ ক্যামনে যাইবেন? কখন কোথায় কী অবস্থায় পড়তে হয় কে জানে!’
মেজচাচার কথার উত্তরে আসাদ ভাই বললো, ‘ফুপা, এই এলাকার যে
অবস্থা শুনলাম তাতে তো এখানে থাকাও নিরাপদ না। গ্রামের ভেতরের পথ দিয়া হেঁটে যাওয়া
যাবে। পথে নৌকা নিশ্চয় পাওয়া যাবে। আমার মনে হয় ঢাকায় থাকার চেয়ে গ্রামে ফিরে যাওয়াই
বুদ্ধিমানের কাজ হবে।’
বড়মামাও ঢাকা
ছাড়ার পক্ষে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ‘আমি
কী এখনই যাবার কথা বলছি? আসাদ ঠিকই কইছে। কারফিউ উঠে গেলে যাওয়ার প্ল্যান করতে হবে। আর বাস-লঞ্চ না চললে পায়ে হেঁটে, নৌকা করে হলেও ঢাকা ছাড়তে হবে।’
আমি ভাবছিলাম বড়মামার সিদ্ধান্তও যেমন
সঠিক, তেমনি মেজচাচার কথাগুলোও ফেলে দেবার নয়। এই
দীর্ঘ পথ কি-করে পাড়ি দেবো? সাথে দুধের শিশু, পঙ্গু দাদা, বৃদ্ধা দাদী, বয়স্ক বাবা- চাচা-মামা, ছোট ছোট ছেলেমেয়ে, বেশ ক’জন মহিলাও আছে সাথে- এদের নিয়ে কীভাবে ফিরবো? এত
দূরের পথ; মাঝে জালের মত ছড়ানো নদী। তারপরই আবার মনে
হলো- দেখাই যাক না, সবাই মিলে বসলে একটা পথ
বেরিয়ে যাবে ঠিকই।
সফিক ভাইয়ের চিন্তিত মুখ দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি ভাবছেন
সফিক ভাই?’
সফিক ভাই বিরক্তিসহকারে বললেন, ‘নিজের উপরই রাগ হচ্ছে।
ব্যাংক থেকে টাকা তুলবো তুলবো করেও তুললাম না, ঘরে সামান্য যা ছিলো তাই নিয়ে
বেরিয়ে পড়েছি। যা কিছু ক্যাশ ছিলো দোকানেই রয়ে গেছে। এখন বাড়ি যেতে হলে তো সমস্যায়
পড়ে যাবো।’
ছোটমামা তাকে আস্বস্থ করলো। ‘চিন্তা কইরেন না খালু। আমারও
তো হাত খালি। বাসায় কিছু টাকা আছে, ওগুলো আনতে হবে। পরিস্থিতি শান্ত হলে কাল-পরশু
দু’জনে মিলে নিয়ে আসতে পারবো।’
ছোটমামার আশ্বাস পেয়ে সফিক ভাইকে কিছুটা চিন্তামুক্ত মনে
হলো। ছোটমামা আমারই বয়সী। মাত্র চার মাসের বড়। তবে একসাথে বড় হয়েছি, অনেকটা বন্ধুর
মত। বড় আপা ছোটমামার চেয়ে প্রায় তিন বছরের বড়। তাই মামা বড়আপাকে খালা আর সফিক
ভাইকে খালু বলেই সম্বোধন করে। দু’জনে শাহাজাহানপুরে একই পাড়ায় থাকে। ছোটমামা বাংলা
একাডেমীতে চাকুরী করে এবং সেইসাথে একজন রেশন ডিলার। শাহজাহানপুরেই তার রেশনের
দোকান।
সফিক ভাইয়ের ফার্নিচারের ব্যবসা বেশ রমরমা। শাহজাহানপুরে বড়
শো-রুম। দশ-বারোজন কর্মচারীকে সারাক্ষণই ব্যস্ত থাকতে হয়। বড় আপার দুই ছেলেমেয়ে। বারো বছরের ছেলে তুহিন আর মেয়ে শিলার বয়স আট। দুজনেরই স্কুল শাহজাহানপুরে।
সেদিন বড়মামা আর ছোটচাচা বেশিক্ষণ থাকলো না। কারফিউ শুরু
হবার আগেই ফিরে গেল। ছোটমামাও তাদের সাথে চলে গেলো। তবে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আমরা গ্রামের
বাড়ি ফিরে যাব এটা মোটামোটি নিশ্চিত। সত্যিই বলতে কি, ঢাকার কোন এলাকাই সম্ভবত
নিরাপদ ছিল না তখন।
২৭ তারিখ সকাল থেকেই রেডিওতে ঘোষণা হচ্ছিলো। সবাইকে কাজে
যোগদান করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো। প্রতিদিন সকালে কারফিউ ভাঙে আবার বিকেলে শুরু
হয়। এই মাঝের সময়টুকুতে লোকজন যার যার প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সেরে নেয়। কিন্তু এখন তো
অফিসে যেতে হবে। ঘোষণা শুনে চিন্তায় পড়ে গেলাম। এই পরিস্থিতিতে অফিস করা মানে হল
নিজেকে একটা অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে ঠেলে দেয়া। একে তো নিজের চিন্তা অন্যদিকে
এখানে রানু কিংবা বাকীরাও নিরাপদ নয়। আমি ঠিক করলাম, যা-ই হোক এই অবস্থায় অফিসে
যাব না।
মাকে বড় বিষণ্ণ লাগছিলো। চুপচাপ পেছনের বারান্দায় বসে
জানালার দিকে তাকিয়ে আছেন। নিশ্চয়ই
কোনো সমস্যা হয়েছে, না হলে তাঁকে এমন লাগার কথা নয়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘মা, কি
হয়েছে? কোনো সমস্যা?’ মা অনেকটা দায়সারাভাবে উত্তর দিলো ‘না’। আমার বিশ্বাস হলো
না। তাই কিছুটা জোরাজুরি করতেই বললেন,
‘বকুলের কী অবস্থা কে জানে!’
আমি মাকে দুশ্চিন্তামুক্ত করতে বললাম, ‘ছোট আপা তো চিঠিতে
লিখেছিলো মার্চের বিশ তারিখ বাড়ি যাবে। এতদিনে তো চলে যাবার কথা। তুমি চিন্তা করো
না মা।’
‘জামাই কি বাড়ি গ্যাছে?’
‘ইকবাল ভাই তো পরে যাবার কথা। এখন এই অবস্থায় কী করেছে জানি
না। দেখি খোঁজ নেয়া যায় কি না’
মা আমার হাত ধরে বললো, ‘বাবা
সুরুজ, বড় চিন্তা অয়। তোরা সবাই সহি-সালামতে বাড়ী
ফিররা গ্যালেই মনে শান্তি পামু।’
‘চিন্তা কইরো না। ইকবাল ভাই বুদ্ধিমান মানুষ। একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করে ফেলবে।’
মা হয়তো কিছুটা সান্ত্বনা পেলেন। কিন্তু একটা দুশ্চিন্তার ছাপ তাঁর মধ্যে রয়েই গেলো। আমি আর
বড় আপা তাঁর কাছে থাকায় যতটা স্বস্তি পাচ্ছেন, ততটাই দুর্ভাবনা
রয়ে গেছে ছোট আপা আর ফিরোজের জন্য। ফিরোজ যদিও বাড়িতেই আছে কিন্তু এই মুহূর্তে তাঁর কাছে তো নেই!
প্রচণ্ড শক্ত মনের অধিকারী আমার মায়ের দুশ্চিন্তার একমাত্র
কারণ আমরা চার ভাই-বোন। সব মায়েরই চাওয়া- ‘তার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’। আমার মা-ও সবসময়ই চান আমরা চার ভাইবোনই যেন সুস্থ্ এবং
নিরাপদে থাকি। বাবা কোনদিন আমাদের শাসন করেননি। এমন কী কখনও ধমক পর্যন্ত
দেননি। হোক লেখাপড়ার জন্য কিংবা দুষ্টুমি। এ নিয়ে মা-বাবার মধ্যে মন কষাকষিও চলতো। আমি আর বড় আপা
মুখটিপে হাসতাম। মা কখনও যদি বাবার সাথে রাগ করতেন, বাবা হাসিমুখে বলতেন, ‘তুমি তো
সারাদিনই ওদের বকো, আমিও যদি বকি, তাহলে ওরা যাবে কার কাছে?’ মা বুঝতেন বাবাকে
কিছু বলে লাভ নেই। তাই আমাদের মানুষ করার দায়িত্ব নিজেই পালন করলেন। মায়ের কারণে আমরা
কখনও লেখাপড়ায় ফাঁকি দিতে পারিনি। তার কড়া শাসনে থেকেই বড় হয়ে উঠেছি। সেই মাকেই আজ
ভেঙে পড়তে দেখে ভীষণ খারাপ লাগছে।
আমি মায়ের দুশ্চিন্তা কমাতেই বললাম, ‘একদম চিন্তা করো না,
মা। দেখবা, ইকবাল ভাই আমাদের আগে
বাড়িতে পৌঁছে যাবে।’
মা আমার দিকে তাকিয়ে সান্ত্বনার হাসি হাসলেন।
পর্বঃ ৪
মেজচাচার বাসায় এসেছি আজ দু’দিন হলো। আমি এর মধ্যে বাইরে যাইনি। এই এলাকার অবস্থাও খুব একটা ভাল নয়, তাই বাইরে না যাওয়াই নিরাপদ। আসাদ ভাই তবুও মাঝে মধ্যে গলির মোড়ের দোকানে চা সিগারেট খাওয়ার জন্য যায়। তার কাছ থেকেও কিছু কিছু খবর জানা যায়।
প্রতিদিনই তাকে দেখা যেতো বাইরে থেকে ফিরে ডায়েরীতে কিছু
লিখে রাখে। আমি কখনও সেভাবে চিন্তা করিনি, তবে যুদ্ধের
পরে জেনেছিলাম আসাদ ভাই বিভিন্ন চায়ের দোকানগুলোতে ঘুরে ঘুরে ইনফরমেশন সংগ্রহ
করতো। বাড়ি ফিরে আমরা কয়েকজন মুক্তিযুদ্ধে চলে গিয়েছিলাম। আসাদ ভাইও গিয়েছিলেন তবে
আমাদের সাথে নয়। আলাদাভাবে। যুদ্ধের মধ্যেই তিনি না-কি ঢাকায় অপারেশনে যোগ
দিয়েছিলেন এবং এই এলাকায়ও এসেছিলেন।
মেজচাচা নিজেও খুব একটা বের হন না, কেবলমাত্র বাজার করা
ছাড়া। মেজচাচার প্রিন্টিং প্রেসের ব্যবসা। তাঁর প্রেস এখন বন্ধ। তাই তাঁর বাইরে
যাওয়ার খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না। মেজচাচার ছেলে মতিন এ বছর এইচএসসি পরীক্ষা দেবার
কথা কিন্তু দেশের এই অস্থির অবস্থায় যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে তা-ও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেলো। মেয়ে
তানিয়া ক্লাস টেনে পড়ে। ওরা কেউই এখন আর ঘরের বাইরে যায় না।
ছোটচাচা মিনু ফুপুর খবর নিয়েছে। নুরুল ফুপা জানিয়েছে তার
কয়েকটা দিন সময় লাগবে। তবে এ ক’দিনে নিশ্চয় ফুপার কাজ শেষ হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে কেটে
গেছে আরও তিনটি দিন। এর মধ্যে বড়মামার বাসা থেকে কেউ
আসেনি।
১লা এপ্রিল, ১৯৭১
মেজচাচার বাসায় পাঁচদিন
কেটে গেলো। কোন পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই
বেরিয়ে পড়তে হয়েছিলো। তাই আমাদের অনেকেরই পর্যাপ্ত টাকা-পয়সার ব্যবস্থা করা সম্ভব
হয়নি। আমার নিজেরও কিছু অর্থের সংস্থান করা খুব জরুরী হয়ে পড়েছিলো। হাতের অবস্থা ভাল না। বেতন
তোলা হয়নি। জমানো
টাকা আছে সামান্যই। বাড়িতে গেলে কতদিন থাকতে
হয় কে জানে! তখন আনুর দুধ ও অন্যান্য খাবার তো কিনতে হবে। আজও রানু বলছিলো ওর কিছু গহনা বিক্রি করে টাকার যোগাড় করতে। আমি ভাবছিলাম, ক্যাশ টাকার ব্যবস্থা করতে না
পারলে হয়তো তাই করতে হবে। সবচেয়ে
ভাল হতো যদি একবার অফিসের দিকে যেতে পারতাম।
আজ সকালে ছোটমামা আসলো আবার। সফিক ভাইকে নিয়ে শাহজাহানপুর
থেকে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আর টাকা পয়সা নিয়ে এসেছে। সফিক ভাই এখন অনেকটাই
চিন্তামুক্ত। দুই ছেলেমেয়ে আর ভাতিজা আনুকে নিয়ে বড় আপার সময়টা ভালই কাটছে, তবে
নিজের বাসার জন্য মাঝে মধ্যে চিন্তিত হয়ে পড়ছে। সবকিছুর মধ্যে আমাদের সবার একটাই
চিন্তা- কবে ঢাকা ছেড়ে বের হবো। আমরা বড়মামাদের অপেক্ষায় ছিলাম। পরদিনই বড়মামা আর
ছোটচাচা আসলো। নিজেদের মধ্যে আলোচনার পর ঠিক হলো যত দ্রুত সম্ভব আমরা সবাই বড়মামার
বাসায় চলে যাবো। যাবার সময় ছোটচাচা দাদা আর দাদীকে নিয়ে গেলো তার
বাসায়।
এ ক’দিন তেমন কিছু ঘটেনি। তবে তার পরদিন থেকেই কানাঘুষা শোনা যাচ্ছিলো- পাকিস্তানী
আর্মিরা যে কোন সময় হানা দেবে এখানে। গতকাল
রাতে পাশের মহল্লায় আর্মিরা হামলা করেছিলো। বেশ কয়েকজন যুবককে গুলি করে মেরেছে।
মেজচাচা আসাদ ভাইকে বাইরে যেতে নিষেধ করে
দিলেন। চাচাও একান্ত প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যান না। সেদিন বিকালে বাইরে থেকে ফিরে এসে মেজচাচা বললেন,
‘লোকজন ইয়াহিয়ার চৌদ্ধগুষ্ঠি উদ্ধার করতেছে’।
আমি মৃদু হেসে বললাম, ‘মুখে মুখে গুষ্ঠি উদ্ধার করলে ইয়াহিয়ার কি আসবে যাবে?’ প্রতিরোধ
গড়ে তোলা দরকার, শক্ত প্রতিরোধ।
চাচা হতাশ কণ্ঠে বললো, ‘করবেটা কি দিয়ে, সেই অস্ত্র-সস্ত্র কই?’
আমার কেন জানি মনে হচ্ছিলো এই অবস্থা থাকবে না। বাঙালি
ঘুরে দাঁড়াবেই। কিন্তু যত সময় যাচ্ছিলো নতুন নতুন দুঃসংবাদ আসছিলো। বিভিন্ন এলাকায়
রোমহর্ষক সব খবর। সবই মৃত্যুর সংবাদ।
ট্রাকে-ট্রাকে করে চোখ বেঁধে লোকজন ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তাদের আর হদিস পাওয়া যাচ্ছে
না। বেশির ভাগই উঠতি বয়সী জোয়ান ছেলে। যতই নিরীহ হোক না কেন, আর্মির সামনে পড়লেই হলো। আর রক্ষা নেই। শোনা যাচ্ছিলো, বুড়িগঙ্গার পাড়ে শুধু লাশের স্তুপ জমে আছে। দুর্গন্ধে নদীর
কাছে যাওয়া যায় না। বিভিন্ন জায়গায় আর্মিদের সাথে বিহারিরাও চালাচ্ছে ধ্বংসযজ্ঞ। সেইসাথে যোগ হয়েছে এদেশীয় স্বাধীনতাবিরোধী
চক্র। খুব ভয় হচ্ছিলো কোনদিন আবার এই এলাকায় হানা দেয় পাক
আর্মিরা।
রাত আটটা। রেডিও খুলে লো-ভলিউমে খবর শুনছিলাম। হঠাৎ দরজায় কয়েকবার
মৃদু টোকা শুনতে পেলাম। আমি দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম। আবার সেই মৃদু টোকার শব্দ।
সেইসাথে নিচুকণ্ঠে কে যেন বলছে,
‘কাকা, দরজাটা খোলো’।
আমি জানালার পর্দাটা একটু ফাঁক করে বাইরে তাকালাম, অন্ধকারে ভালমত দেখা
যাচ্ছিলো না।
‘কাকা, আমি চন্দন; দরজাটা খোলো’।
এবার চিনলাম। চন্দন।
আমাদের গ্রামের ছেলে। আমরা একই বয়সী, একসাথেই
বেড়ে ওঠা। ও চাকরি করে আমার অফিসেই। এই ডামাডোলের মধ্যে ভুলে গেছিলাম ওর বাসা এই এলাকায়। দরজাটা খুলে দিলাম। চন্দন ভেতরে ঢুকেই দরজাটা লাগিয়ে দিলো। ঘরে ঢুকে আমার
পাশে বসে বলল,
‘সকালে ফজলু চাচার কাছে তোর এখানে আসার খবর পেয়ে আসলাম। সুরুজ, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই এলাকা ছাড়তে হবে।
আমি জানতে চাইলাম, ‘তোর কাছে কোন খবর আছে?’
ও খুব নিচু স্বরে বললো, ‘স্বাধীনতাবিরোধী চক্র ঘোঁট পাকাচ্ছে। মনে হয় তলে তলে বিহারীরাও ওদের সাথে আছে। শুনলাম বাড়িতে বাড়িতে নজরদারি করবে। কোন বাড়িতে যুবক ছেলে থাকলে অথবা সে বাড়িতে নতুন লোকজন আসলে সাথে
সাথে খবর চলে যাবে
পাকিস্তানি আর্মিদের কাছে। সামনে খুব খারাপ সময় সুরুজ।’
আমি চন্দনের চোখেমুখে স্পষ্ট ভয়ের চিহ্ন দেখলাম।
মেজচাচাকে ডাকলাম। সেও বললো-
‘আমিও সকাল
থেকে খবর পাচ্ছিলাম এই এলাকার
অবস্থা ভাল না, আমাদের এখান
থেকে দ্রুত সরে যেতে
হবে।’
আমি বললাম, ‘চল বড়মামার বাসা গোরানে
চইলা যাই।’
মেজচাচা সায় দিয়ে বললেন, ‘বেশি দেরী করা যাইবো না। কাইলক্যার মধ্যেই চইলা
যাইতে হইবো।’
চন্দনের উদ্দেশ্যে বললাম, ‘তুই তাইলে কি করবি?’
ও কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর মেজোচাচার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘শুনলাম তোমরা গ্রামে ফিরা যাইবা, আমাদের দু’জনকে সাথে নিয়ে নেও না কাকা!’
চন্দনের করুণ আকুতি শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। মেজচাচা কিছু না বলে ঘরের ভেতরে চলে গেলেন। আমি বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম। মেজচাচাকে যেভাবেই হোক ম্যানেজ
করা যাবে কিন্তু ভয়টা বড়মামাকে নিয়ে। তিনি রাজি হবেন কি না
বুঝতে পারছিলাম না। একে তো চারিদিকে পাকিস্তানি চর ছোঁকছোঁক করছে। চন্দন হিন্দু মানুষ, সাথে নিশ্চয়ই ওর স্ত্রীও থাকবে। আবার মনে হয় ওকে এই জ্বলন্ত আগুনে
ফেলে যাবই বা কী করে! বড়মামা রাজি না হলে বড় অসুবিধা হয়ে যাবে। আমি অবশ্য ওকে কিছু
বললাম না। অফিসের খোঁজখবর জানতে চাইলাম।
ও বলল, ‘সুরুজ, কাল অফিসে
গেছিলাম। ডিরেক্টর স্যার
তো রোজই অফিস করে। তোর কথা জিজ্ঞেস করছিলো। আমাকে বললো তোর খোঁজখবর
নিতে।’
এই এলাকা
থেকে আমার অফিসের দূরত্ব
খুব বেশি না। হেঁটেই
যাওয়া যায়।
আমি বললাম- ‘হাত একেবারে
খালি। কিছু টাকা
পয়সারও তো দরকার। বেতনও তোলা হয়নি। কাল একবার যাবো
ভাবছি।’
ও বলল, ‘ঠিক আছে কাল সকালে
আমি আসবো, একসাথেই যাওয়া
যাবে।’
চন্দন চলে গেলে
আবার দুশ্চিন্তাটা ঘিরে ধরলো আমায়। একটু পরই থমথমে চেহারা নিয়ে মেজচাচা ঘরে
ঢুকলেন। চাচীর উদ্দেশ্যে বলল, ‘সবকিছু গুছিয়ে ফেল,
খুব দ্রুত এই এলাকা ছাড়তে হবে। পারলে আজ রাতেই।’
আমি বললাম, ‘আমাকে যে কাল একবার অফিস যেতে হবে। অফিস থেকে ফিরে গেলে হয় না?’
এই অবস্থার মধ্যে অফিসে যাওয়ার কথা শুনে চাচা রেগে গেলেন। আমার উদ্দেশ্যে ধমকে উঠে বললেন,
‘তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে? এই অবস্থার মধ্যে অফিসে
যাওয়ার কী দরকার?’
আমি বললাম, ‘কিছু টাকা পয়সার ব্যবস্থা করা জরুরী। এত দূরের পথে রানু-আনু, মা-বাবা সহ যাওয়ার
খরচের বিষয়টাও চিন্তা করতে হবে। কখন কোন
পরিস্থিতিতে পড়তে হয় কে জানে!’
‘এত চিন্তা করার কী আছে? আমরা সবাই আছি না!’
‘তবুও এভাবে কী এতদূর যাওয়া যায়? বাড়িতে গিয়েও তো খরচ আছে। কবে পরিস্থিতি ঠিক
হয় কে বলতে পারে!’
মেজচাচা সমস্যাটা অনুধাবন করে অফিস যাওয়ার বিষয়টা মেনে নিলেন। ছোট্ট করে শুধু বলে দিলেন, ‘বেশি দেরী করবি না। কাল অবশই আমরা ওহাব দাদার বাসায় চলে যাবো।’
‘একবার পুরান ঢাকায় যেতে পারলে ভাল হত। রানুর কিছু গয়না বিক্রি করা প্রয়োজন।’
আমার পুরান ঢাকার যাবার কথা শুনে চাচা রেগে আগুন হয়ে বললেন, ‘খবরদার! ওদিকে যাওয়ার কথা মুখেও আনবি না। ওখানকার অবস্থা ভাল না।
ইউনিভার্সিটি আর পুরাণ ঢাকারে পাক আর্মিরা ধ্বংসস্তুপ বানাইছে। অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে আসবি। আমরা কাল সন্ধার আগেই ওহাব দাদার
বাসায় চলে যাবো। গহনা বেচার অনেক সময় পাওয়া যাবে।’
আমি মেজচাচার কথা মেনে নিলাম। এই অবস্থায় পুরাণ ঢাকায় যাওয়া ঠিক হবে না।
ভাগ্যিস চব্বিশ তারিখ ব্যাংক থেকে কিছু টাকা তুলে নিয়েছিলাম। এখন অফিসে গিয়ে
বেতনটা তুলতে হবে। তবে আরও কিছু টাকার সংস্থান করতে পারলে ভাল হতো। আবার কবে ঢাকা
ফিরতে পারবো কে জানে! দেখা যাক, কাল অফিসে ফেলে একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে। চন্দনের যাওয়ার ব্যাপারে মেজোচাচার সাথে আলাপ করলাম। চাচাও চিন্তায়
পড়ে গেলেন। ‘ভাবছি
কী করা যায়’।
আসাদ ভাই বললো, ‘ফুপা, এত ভাবাভাবির
কিছু নাই। আমরা তো
যাবোই, সাথে ওরা দুইটা মানুষ যোগ হলে কী এমন ক্ষতি হবে?’
সফিক ভাইও আসাদ ভাইয়ের সাথে একমত পোষণ করলেন।
মেজচাচা চিন্তাযুক্ত কণ্ঠে বললো, ‘সমস্যা হইলো
ওরা হিন্দু।’
মা বিষয়টা খুব স্বাভাবিকভাবেই নিলেন। বললেন, ‘হিন্দু হইছে তো কী হইছে? অরা কী মানুষ না? অগোরে বিপদের মধ্যে ফালাইয়া আমরা যাই ক্যামনে?’
মেজোচাচা বলল, ‘হিন্দুদের উপরে তো পাকিস্তানী আর্মিদের
অনেক আক্রোশ, ওরা জানতে পারলে আমদেরও বিপদ হতে পারে।’
আমি আমার মায়ের দূরদর্শিতা দেখে মাঝে মাঝে সত্যিই খুব অবাক হয়ে যেতাম। মেজো চাচার কথা শুনে মা রেগে উঠে বললেন, ‘আমরা
এহন কী কম বিপদের মধ্যে আছি? আর কত ডরামু কও তো ফজলু?
দরকার অইলে চন্দনরা মুসলমান সাইজাই আমগো লগে যাইবো, তবুও অগো ফালাইয়া যামু না।’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন