মঙ্গলবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০

উপন্যাসঃ ফেরা (পর্বঃ ৯ - ১২)

ই উপন্যাসটিতে সম্মুখ সমরের কোন ঘটনা তুলে ধরা হয়নি।  ওয়ারফ্রন্টের কোনও দৃশ্য নেই। তবে এই লেখায় মূলত যে গল্পটি বলার চেষ্টা করা হয়েছে তা মুক্তিযুদ্ধের বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। একটি যুদ্ধ নানানভাবে মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে, যার কোনোটিকেই ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। একাত্তরের পঁচিশে মার্চের সেই কালরাত থেকেই নিজেদের পরিবারকে বাঁচানোর তাগিদে মানুষ ঢাকা শহরের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছুটে বেড়িয়েছে কেউ কেউ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ফিরে গেছে নিজ গ্রামে। এই গল্পে তেমনই কিছু মানুষের জীবনযুদ্ধের ঘটনাবলীই তুলে ধরা হয়েছে; যারা নিজেদের পরিবারকে বাঁচাতে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে ফিরে চলে নিজ গ্রামে। এটা মোটেও সহজ ছিলো না। এই ফিরে যাওয়ার গল্পটিই এই উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য।


পর্বঃ   

আশেপাশের লোকজন থেকে খোঁজখবর নিয়ে আমরা চলছিলাম। চলার পথে একটি বাড়ি থেকে মাঝবয়সী একজন লোক বেরিয়ে আসলো। আমি তাঁর সাথে এখানকার পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ করছিলাম। বড়মামা আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। ভদ্রলোক জানালো গতকাল বন্দর থানার সিরাজদ্দৌলা ক্লাব মাঠে হানাদার বাহিনী অনেক মানুষ মেরেছে। বুঝলাম, আমাদের সাবধানতা আগের মতই মেনে চলতে হবে। মানে যেভাবে আমরা এখন যাচ্ছি। বন্দর থানায় মানুষ মারার খবর শুনে বড়মামা আবার অস্থির হয়ে উঠলেন। মা তাকে ভরসা দিয়ে বললেন, ‘ডরাইয়া কী অইবো? ভাগ্যে যা লেখা আছে তা-ই হইবে, আমগো কার কী করার আছে?’ মামা মায়ের কথায় সায় জানালেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে সামনে এগোনোর জন্য ইশারা করলেন। আমি সামনে এগোচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম কিছু টাকা হাতে এসেছে, তবে এই যুদ্ধাবস্থা বেশিদিন বলবৎ থাকলে আরও টাকার প্রয়োজন হতে পারে। তাই রানুর ছোট ছোট বাড়তি যে গহনাগুলো আনা হয়েছে সেগুলো বিক্রি করে ক্যাশ করা দরকার। ফতুল্লার দিকে গিয়ে গহনা বিক্রির চেষ্টা করতে হবে।

আমার সামনে তারেক। ধীর-স্থির, শান্ত স্বভাবের ছেলে। খুব মেধাবী। এসএসসি ও এইচএসসিতে খুব ভাল রেজাল্ট করেছিলো। গোরানে ওদের বাসায় আসার দিন থেকেই দেখছি ও সারাক্ষণ কি যেন ভাবছেতবে আমি ওর চেখে পাকিস্তানিদের প্রতি তীব্র ঘৃণা দেখেছি। তারেকের মত আরও অনেকের মনের অবস্থা এখন একই রকম। প্রতিটি বাঙালির মনেই পাক সেনাদের প্রতি তীব্র ঘৃণা জন্মে উঠছে। আমি মনে মনে বললাম- এই ঘৃণা একদিন দাবানলের মত জ্বলে উঠবে। আর সেদিন এই হানাদার বাহিনী পালানোর পথ খুঁজে পাবে না। মতিন আমার পাশে এসে ফিসফিস করে বললো,

‘সুরুজ ভাইয়া, বাড়ি পৌঁছে তুমি নাকি যুদ্ধে চলে যাবে?’

‘কে বললো তোকে?’

‘কেউ বলেনি। তারেক ভাইয়া আর চান ভাই কথা বলছিলো। আমি শুনেছি’

‘আমি নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলাম, এসব নিয়ে কারো সাথে আলাপ করিসনি তো?’

‘না’

‘ভাল’।

‘আমিও তোমাদের সাথে যাবো। আমাকে নেবে?’

‘সে দেখা যাবে। এসব কথা এখন নয়’।

আমি ওকে থামিয়ে দিলাম। কারণ এখন এসব আলোচনার সময় নয়। এখন শুধু একটাই চিন্তা। কী করে সবাইকে নিয়ে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছাবো। তাছাড়া মতিনের বয়স অনেক কম। যুদ্ধের ভয়াবহতা, রণকৌশল আর খুঁটিনাটি বিষয়গুলো বোঝার মত ম্যাচিওরিটি ওর এখনও আসেনি।

দুপুর গড়িয়ে গেছে। পথ যেন আর শেষ হয় না। আমরা হাঁটছি তো হাঁটছিইবয়স্ক লোকেরা আর বাচ্চাগুলো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। একটা বাড়ির পাশে বিশ্রামের জন্য থামলাম। বিস্কুট, গুড়-মুড়ি আর পথে কেনা কলা খেয়ে নিলামআবার শুরু হলো পথচলা।  

প্রায় ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর একটা বাজারে পৌঁছালাম। ভেবেছিলাম বাজার থেকে কিছু খাবারের ব্যবস্থা করবো। কিন্তু কোন দোকান খোলা পেলাম না বাজারের একপাশের সরু গলিপথ ধরে কিছুদূর যেতেই একটা খোলা জায়গায় পৌঁছালাম। একজন বয়স্ক ভদ্রলোককে দেখে জানতে চাইলাম কাছাকাছি কোথাও খাবার হোটেল পাওয়া যাবে কি না ভদ্রলোক মৃদু হেসে জানালেন এখান কোন খাবার হোটেল খোলা পাওয়া যাবে না। তারপর উপস্থিত লোকজনের কথা বলে ভদ্রলোক বললেন,

আপনারা আমাদের সাথে চলেন, একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে

বড়মামা কিছু বলতে গিয়েও বললেন না। সাথে অভুক্ত বাচ্চারা আর মহিলারা থাকায় তাঁকে মেনে নিতে হলো। আমরা ভদ্রলোকের বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। বেশ অবস্থাপন্ন গৃহস্থ। বাড়িটাতে তিন ঘর বাসিন্দা। ঘরগুলোর সামনে খোলা উঠোন চারপাশে গাছগাছালিতে ঢাকা। ভদ্রলোকের নাম আফজাল খান তিনি বড়মামার সাথে আলাপ করছিলেন এই ফাঁকে আমরা সবাই ফ্রেশ হয়ে নিলাম আর নুরুল ফুপা যোহরের নামাজ পড়লেন।

স্বল্প সময়ে ভদ্রলোক আমাদের জন্য খাবার ব্যবস্থা করে ফেললেন। খিচুড়ি আর বেগুন ভাজা সকাল থেকে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে এতদূরে এসে একজন অপরিচিত মানুষের আতিথেয়তা অনেকদিন মনে ছিলো আমার। আমাদের খাওয়া শেষ হলে আফজাল সাহেব বললেন, ‘আপনাদের অনেকদূর যেতে হবে, আর আটকে রাখবো না’।

বড়মামা জিজ্ঞেস করলেন, মোক্তারপুর দিয়ে নদী পার হয়ে যাওয়ার প্ল্যান আছে আমাদের, এদিকটা নিরাপদ তো?

পাশে দাঁড়ানো ভদ্রলোক বলে উঠলেন, ‘কয়দিন আগে চাষারায় হামলা হইছে, গ্যাছে কাইল সদরেভেতরে ভেতরে আরও অনেক ধরপাকাড় চলতাছে। মোক্তারপুর পর্যন্ত যাওয়াটা মনে হয় নিরাপদ হইবো না’।

আফজাল সাহেব ভদ্রলোককে সমর্থন করে বললেন,’দেলোয়ার ঠিকই বলছে। আপনারা এতবড় দল নিয়া যাইতেছেন, সাথে ইয়াং ছেলেমেয়ে আছে। তারচেয়ে আপনারা এইদিক দিয়া নদী পার হয়ে জাজিরায় ঢুকে পড়েন। বিবির বাজার হয়ে বেতকার রাস্তা ধরে এগিয়ে যান। একটু ঘুরপথ হবে, তবে নিরাপদ’। 

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘চাচা, এদিকে আর্মিদের টহল নাই?’

‘যতদূর জানি এখনও ঐ এলাকায় মিলিটারী যায় নাই, তবে নদীতে টহল থাকতে পারে। আরেকটু অপেক্ষা করেন, আমি ব্যবস্থা করছি’

তিনি দশ-এগারো বছরের একটি ছেলেকে কোথায় যেন পাঠালেন। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘এখানে কোথাও গহনা বিক্রি করা যাবে?’

তিনি জানালেন, ‘বাজারে একটা স্যাকরার দোকান ছিলো, এখন তো বন্ধ।

পাশের দাঁড়ানো দেলোয়ার সাহেব গহনাগুলো দেখতে চাইলেন। আমি রানুর কাছ থেকে ওর নিজের ব্যবহার্য গহনা ছাড়া বাড়তি গহনাগুলো এনে দেখালাম। উপস্থিত লোকজনের মধ্যে থেকে কয়েকজন মিলে ওগুলো কিনে নিলো। দেড়ভরির একটি গলার হার, দুটি চেইন, দুটি কানের দুল, দুই জোড়া ছোট ঝুমকা আর দশটি আংটি মিলে সর্বমোট সাতশো টাকায় বিক্রি করলাম। রানুর খুব মন খারাপ দেখে আমি ওর হাতটা ধরলাম নিচুস্বরে বললেম,

‘মন খারাপ করো না। বেঁচে থাকলে আবার হবে’

ও মেনে নিলো। এছাড়া আর কী-ইবা করার আছে? এর মধ্যে আল্পবয়সী সেই ছেলেটি ফিরে এলো। সাথে ছাব্বিশ-সাতাশ বছর বয়সী একজন লোকলম্বা, তামাটে বর্ণের সুস্বাস্থ্যের অধিকারী লোকটিকে দেখেই মনে হয় খেঁটে খাওয়া পরিশ্রমী মানুষ। আফজাল সাহেবকে দেখে হেসে জিজ্ঞেস করলো,

চাচা, আমারে ডাকছেন?

‘হ্যা। মজনু, তোর নৌকা কোথায়?’ আফজাল সাহেব জানতে চাইলেন।

‘আছে। কেন চাচা?’

‘ওনারা ঢাকা থেকে এসেছেনঅনেকদূর যাবেএদিককার পথঘাট তো চেনে না। তুই ওনাদেরকে একটা নিরাপদ জায়গা দেখে নদী পার করে দিতে পারবি?’

‘পারুম। তয় আমার নৌকা এই ঘাটে নাই। প্রায় মাইল খানেক দূরে একটা খাঁড়ির মধ্যে রাখা আছে। এইহানে আর্মিরা প্রায়ই স্পীডবোট নিয়া টহল দেয়। ওনাদের পায়ে হাইটা ঐ খাঁড়ি পর্যন্ত যাইতে হইবো’

আমি বললাম, ‘হাঁটতে আমাদের অসুবিধা নাই ভাই। আপনে শুধু নিরাপদে আমাদের নদীটা পার করে দেন’।

‘আল্লাহ ভরসাচলেন আমার লগে’মজনু বললো।

আফজাল সাহেবকে তাঁর আতিথেয়তা আর তথ্য দিয়ে সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা মজনুর সাথে বেরিয়ে পড়লাম। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক বিশ্রামের পর এখন সবাই বেশ ফুরফুরে মেজাজে হেঁটে চলেছে। কারো ভেতরে ক্লান্তিভাব নেই। আমরা হেঁটে চলছিলাম আর মজনুর সাথে এলাকারর পরিস্থিতি নিয়ে টুকটাক আলোচনা করছিলাম। সে জানালো যে পাক আর্মিরা আচমকাই স্পীডবোট নিয়ে হাজির হয় আর অল্পবয়সী কিংবা যুবক ছেলে দেখতে পেলেই ধরে নিয়ে যায়। তাদের আর খোঁজ পাওয়া যায় না। এমনকি মাঝবয়সীরাও রক্ষা পায় না। তাই মানুষজন খুব সাবধানে চলাফেরা করে। মজনু জানতে চাইলো, ‘আপনারা কই যাইবেন?’

আমি বললাম, ‘আপাতত বিবির বাজার’। আফজাল সাহেব যেভাবে পথ বাতলে দিয়েছিলেন।

‘ও’। মজনু ছোট করে জবাব দিলো। তারপর যোগ করলো, ‘আপনারা বড় রাস্তার কাছাকাছি থাকবেন না। গ্রামের ভেতর দিয়ে যাবেন’।

আমি ওর কথায় সায় জানালাম। আমরা মজনুর পেছন পেছন হেঁটে চলেছি। আমার সামনে হাঁটছেন বড়মামা। ক্লান্ত পদক্ষেপআমি তাঁকে লক্ষ করলাম। মাঝে মাঝে হাঁপাচ্ছেন। মামা আর বাবা সমবয়সী হলেও বাবা থেকে মামা একটু বেশিই ভেঙে পড়েছেন। বয়স যতটা না বেড়েছে তারচেয়ে দেহে বার্ধক্যের ছাপ পড়েছে বেশি। চিন্তায় পড়ে গেলাম, কারণ সামনে আরও অনেক পথ বাকী। আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই মজনুর নৌকার কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম।

‘আপনারা এইহানে খাড়ান, আমি একটু খোঁজখবর নিয়ে আসি।’

আমাদেরকে ওর নৌকার কাছে রেখে মজনু সামনের দিকে চলে গেলো। প্রায় পনেরো মিনিট পর এসে বললো, ‘চলেন, এইবার যাই। আল্লাহ যা করেন’। আমি মজনুকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘ঐদিকের অবস্থা কেমন দেখলেন?’

ও উত্তর দিলো, ‘দুপুরের পর আর মিলিটারী দেখা যায় নাই’।

মজনুর নৌকাটা ছোট। ছত্রিশ জন নৌকায় ধরলো না, তাই দু’বারে পার হতে হলো। প্রথম বারে আসাদ ভাইয়ের সাথে বয়স্কদের নৌকায় তুলে দিলাম। বিশ মিনিটের মধ্যে ওদের নদীর ওপাড়ে নামিয়ে নৌকা আবার ফিরে এলো। এবার বাকীরা নৌকায় উঠলাম। খাঁড়ি থেকে বের হয়ে নৌকার গতি কমিয়ে বাতাসে কান পাতলো মজনু বোঝার চেষ্টা করলো স্পীডবোটের কোন শব্দ শোনা যায় কি নাপুরাপুরি নিশ্চিত হয়ে নদীতে চলে এলো। নদী পার হতে খুব বেশি সময় লাগলো না। তবে মজনু সরাসরি নদীর পাড়ে না ভিড়িয়ে নৌকাটিকে একটি খালের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলো। আমরা সবাই নেমে এলাম। মজনু আমাদের বিবির বাজার যাওয়ার পথ দেখিয়ে দিয়ে চলে গেলো। বড়মামা আর বাকীরা কিছুদূর এগিয়ে একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলো।

বিকাল সাড়ে চারটা। নৌকা থেকে আমরা যেখানে নেমেছি তার চারপাশটা ফাঁকা। কাছাকাছি লোকবসতি নেই। পায়ে হাঁটার একটি সরু কাচারাস্তা দূরে গ্রামের দিকে চলে গেছে। রাস্তার দু’দিকে খোলা জায়গা জুড়ে জলাভুমি আর মাঝে মাঝে ফসলের ক্ষেত। অনেক দূরে সবুজ গাছগাছালি চোখে পড়ছে। মজনুর দেখানো পথ ধরে আমরা হেঁটে চললাম। তবে একটা বিষয় ভেবে মনে স্বস্তি পাচ্ছি যে এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে আর্মিদের উপস্থিতির ভয়টা নেই।

বেশ কিছুদূর হাঁটার পর রাস্তার পাশে সবুজে ঘেরা ছোট একটা বাড়ি চোখে পড়লো। সবাইকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখে আমি ভেতরে গিয়ে লোকজনের খোঁজ করছিলাম। আমার কণ্ঠ শুনে পনেরো-ষোলো বছর বয়সী ছেলে বেরিয়ে এলো। কোন পথে বিবির বাজার যাবো জানতে চাইতেই ছেলেটি খুব সুন্দরভাবে পথটা বাতলে দিলো। আমরা আবার হাঁটা শুরু করলাম।

ঘণ্টাখানেক আগে বড়মামার অবস্থা দেখে তাঁকে নিয়েই টেনশনে ছিলাম। বাবা, মেজচাচা কিংবা ফুপাকে নিয়ে তেমন একটা দুশ্চিন্তা ছিলো না। কারণ মামা ডায়াবেটিস আর হাইপার টেনশনের রুগী ছিলেন। তবে বাস্তবে দেখা গেলো বাবা ও বড়মামা নিজেদেরকে সামনে নিয়েছিলেন ঠিকইকিন্তু সমস্যায় ফেলে দিলেন মেজচাচা। এই পর্যন্ত আসতে সে প্রায় হাঁপিয়ে উঠলো। বাধ্য হয়ে আমাদের আবার থামতে হলো। একটা বড় গাছের নিচে আমরা বিশ্রাম নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। মতিন মেজচাচার কাছে এগিয়ে এলো। ভাইয়ের সাথে সাথে তানিয়া ও এসে বাপের পাশে বসলো। বড়মামা তার ব্যাগে কিছু ফার্স্ট এইড সমগ্রী নিয়ে এসেছেন। তিনি বিপি মেশিনটা বের করে চাচার ব্লাড প্রেসারটা চেক করলেন।

তিনি চাচার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘একশ ত্রিশ বাই নব্বই’

‘তাহলে তো প্রেসার বেড়েছে, তাই না মামা?’ মতিন বললো।

‘তোমার বয়স কত ফজলু?’ বড়মামা হাসতে হাসতে চাচাকে জিজ্ঞেস করলেন।

চাচা মৃদু হেসে জবাব দিলো, ‘ছাপ্পান্ন চলতাছে’।

‘তাহলে তো ঠিকই আছে। লম্বা সময় ধরে হাঁটার জন্য হয়তো একটু বেশি আছে। চিন্তা করার কিছু নাই’।

নুরুল ফুপা বললো, ‘মেজদার একটু রেস্ট দরকার’।

বড়মামা বললেন, ‘রাতে ঘুমাতে পারলে ঠিক হয়ে যাবে’। তিনি মতিনকে বললেন, ‘তুই তোর বাবার সাথে সাথে থাক’


পর্বঃ  ১০ 

আমরা চলার গতি কমিয়ে দিলাম। এই জায়গার নাম কোন্ডা। এখান থেকে বিবির বাজার খুব বেশি দূর নয়। তবে যেভাবে চলছি তাতে একটু বেশি সময় লাগবে। আমি আরেকটা বিষয় নিয়ে ভাবছিলাম। রাতে থাকার জায়গা কোথায় পাবো? মহিলা ও বাচ্চাদের জন্য হলেও একটা নিরাপদ আশ্রয় দরকার। সন্ধ্যার আগে পৌঁছাতে পারলে ভাল হতো। প্রায় একঘণ্টা পর আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছালাম।

সামনে একটা বাড়ি দেখে এগিয়ে গেলাম। বাড়ির প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে দেখার চেষ্টা করছিলাম কাউকে চোখে পড়ে কি নাকাউকে দেখতে পেলাম না। ভেতরে ঢুকতে গিয়ে আমি ইতস্থত বোধ করছিলাম। মা আমার দিকে এগিয়ে আসছিলেন, এমন সময় দেখলাম বাইরে থেকে একজন বৃদ্ধলোক বাড়িতে ঢুকছেন। আমাদের দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনেরা কোত্থেইক্যা আইছেন? কাউরে খুঁজতাছেন?’ বড়মামা তাঁকে সবকিছু বুঝিয়ে বললেন। তাঁকে কিছুটা চিন্তিত দেখালো।

তিনি বললেন, ‘আপনারা বিপদে পইড়া আইছেন কিন্তু আমি তো গরীব মানুষ ভাঙাচোরা ছোট্ট কুড়েঘর। আপনাগো যে কৈ জায়গা দেই!

বড়মামা বললেন, ‘কোনরকম রাতটা পার করতে পারলেই চলবে।’

লোকটি কিছুটা ইতস্তত করছিলো। শেষে বললো, আসলে ঘরের দুইদিকের বারান্দাই খোলা, বেড়া নাই। এইখানে কী আপনারা থাকতে পারবেন?

আমি হেসে বললাম, ‘আপনে ভাববেন না। মহিলা আর বাচ্চারা বারান্দায় থাকতে পারলেই হবেআমরা না হয় ঘরের বাইরে রাতটা কাটিয়ে দেবো’  

বৃদ্ধ লোকটি মৃদু হেসে বললো, ‘তাইলে আসেন’

আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। বড়মামা তাঁকে এলাকার অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলেন। এই এলাকায় পাকিস্তানী আর্মি দেখা গিয়েছে কি না তিনি জানালেন ‘এইহানে কোন সমস্যা নেই। মিলিটারীরা অহনও এই এলাকায় আহে নাই’।  

‘যাক, নিশ্চিন্ত হলাম’। বড়মামাকে নিচু গলায় বললাম, ‘রাতে খাবার ব্যবস্থা করতে হবে’

আমি বৃদ্ধের কাছে জানতে চাইলাম এখানে বাজারটা কোন দিকে, আর বাজারে এখন কিছু পাওয়া যাবে কি নাতিনি জানালেন বাজার খোলা আছে। বাড়ির একটি ছোট ছেলেকে সাথে নিয়ে আমি আর চন্দন বাজারের উদ্দেশ্যে বের হতেই বড়মামা আমাকে থামিয়ে দিলেন। চন্দনকে দেখিয়ে বললেন, ‘ওকে বাজারে নিচ্ছিস কেন?’

বুঝলাম মামা চন্দনকে নিয়ে কোনো রিস্ক নিতে চাচ্ছেন না। তাই ওকে রেখে আমি আর আসাদ ভাই বাজারের উদ্দেশ্যে বের হলাম। বৃদ্ধের বাড়ি থেকে বাজার বেশী দূরে নয়। পায়ে হেঁটে মাত্র সাত-আট মিনিট সময় লাগলো আমাদের। বাজারে মাত্র দু’টো মাছের দোকান খোলা পেলাম কেনার মত ভালো মাছও তেমন নাই। অবশেষে এক মাছওয়ালার কাছে কিছু নলামাছ পেলাম। ওগুলোই কিনে নিলাম। সাথে প্রয়োজনীয় চাল-ডাল, পেয়াজ, ডিম ও তেল আমরা ফিরে আসতেই মা আর মেজচাচী জিনিসপত্রগুলো নিয়ে ভেতরে চলে গেল। আমি সামনের খোলা বারান্দায় কিছু শুকনো খড়কুটো বিছিয়ে বাবা, বড়মামা আর মেজচাচাকে রেস্ট নিতে বললাম। আগামীকাল সারাদিন কীভাবে যাবে আমরা জানি না। আজ রাতে আমাদের ঘুমটা খুব জরুরী। 

আমাদের আশ্রয়দাতা ভদ্রলোকের নাম আদম আলী। নিজের আবাদি জমি নেই। অন্যের জমিতে চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। আমাদের আপ্যায়নের যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। পেছনের বারান্দাটা মহিলা ও বাচ্চাদের জন্য ছেড়ে দিয়েছেন।

রাত নেমেছে। অন্ধকারে ছেয়ে আছে চারিদিক। বারান্দায় বসে ঝিঁঝিঁপোকার বিরামহীন ডাকাডাকিতে কান ঝালাপালা। সেইসাথে ঘরের একপাশের গোহাল থেকে আসা গরুর মল-মূত্রের গন্ধ। টেকা দায়। আসাদ ভাই আর সফিক ভাইকে কোথাও দেখতে পেলাম না। বুঝলাম ওরা নিশ্চয় রাস্তায় ধুম্রসেবনে গেছে। তারেক জিজ্ঞেস করলো, ‘কিছু টের পাচ্ছো?’ আমি হেসে উঠে দাঁড়ালাম। রাস্তার দিকে হাঁটা দিতেই ও পিছু নিলো। একটু দুরেই আসাদ ভাইরা সিগারেট ফুঁকছে। সফিক ভাই আমাদের দেখে হাসতে হাসতে বললো, ‘শালাবাবুরা মনে হয় আর টিকতে পারলো না

তারেক বললো, ‘হায় আল্লাহ! এইখানে সারারাত কীভাবে থাকবো?’

আসাদ ভাই উত্তর দিলো, ‘মনে করো তুমি যুদ্ধক্ষেত্রে আছো।’

‘মানে!’

সফিক ভাই বলে উঠলো, ‘বোঝ নাই? যুদ্ধের মাঠে ভাগ্য খারাপ হলে পচা ডোবায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটানোর প্রয়োজন হতে পারে। এটাই হলো যুদ্ধের বাস্তবতা।’

তারেকের মুখের কথা বন্ধ হয়ে গেলো। আসাদ ভাই বললো, ‘কী? যুদ্ধে যাবার ইচ্ছা আছে এখনও?’

তারেক হেসে বললো, ‘হুম’

সফিক ভাই তারেকের পিঠ চাপড়ে বললো, ‘তাহলে আজ থেকেই ট্রেনিঙ শুরু হোক।’

রান্না শেষ হয়েছে। ছোটচাচার ছেলে মামুন এসে জানালো, মা তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়তে বলেছেনসামনের বারান্দায় বসেই আমরা খেয়ে নিলাম। মহিলা আর ছোট বাচ্চারা বাদে আমরা সবাই সামনের খোলা বারান্দায় খরকুটো বিছিয়ে শুয়ে পড়লাম। বড়মামী দু’টো চাদর এনে দিলেন। খরকুটোর উপর বিছিয়ে দেবার জন্য। তারেককে সাথে নিয়ে আমি একবার বাড়ির বাইরে থেকে ঘুরে এলাম। ঘন গাছপালায় ঢাকা থাকায় বাইরে থেকে ভেতর  বাড়ির কিছুই দেখা যায় না। কিছুটা সাবধানতা হিসেবে পালা করে পাহারা দিলাম। প্রথমে আমি আর তারেক এবং পরে আসাদ ভাই আর চন্দন। ওরা কয়েক ঘণ্টা জেগে থাকলো, তারপর একসময় ওরাও ঘুমিয়ে পড়লো।

 ৫ই এপ্রিল, ১৯৭১।

খুব ভোরে আমাদের ঘুম ভেঙে গেলো। উঠে বসতেই দেখি ফুপা ডাকছেন।

‘সুরুজ, আসো নামাজ পড়ে নিইআজান হয়ে গেছে।’

বাবা, বড়চাচা, মেজচাচা সবাই আগেই উঠে পড়েছেন।

মেজচাচাকে অনেক ফ্রেশ লাগছে এখন। আমি উঠে বসলাম। বাইরে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। চাচা চিন্তিত কণ্ঠে বললেন, ‘এখন তো আটকে পড়লাম। বৃষ্টি না থামলে তো যাওয়া যাবে না’।

বাবা ভাবলেশহীন ভাবে বলে উঠলেন, ‘দেহাই যাঊক না, এহনও তো সূর্য উডে নাই’।

‘এই বৃষ্টি থাকবে না। দেখবা ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ঠিক হইয়া যাইবো’। বড়মামা বললেন।

মেজচাচা বড়মামার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘মিয়াভাই, এখন একটু দেখবেন প্রেসারটা ঠিক আছে কি না’

বড়মামা হাসলেন। ব্যাগ থেকে বিপি মেশিনটা বের করে মেজচাচার প্রেসার চেক করলেন। মৃদু হেসে মেজচাচাকে বললেন, ‘বলছিলাম না, ঠিকমত ঘুম হলেই প্রেসার নরমাল হয়ে যাবে’।

চাচা আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কত?’

‘পারফেক্ট। একশ বিশ বাই আশি’

মেজচাচা যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেনএমনিতে সে কিছুটা ভীতু স্বভাবের মানুষ তবে স্বাস্থ্য সচেতন। পরিমিত খাবার খানরিচফুড সবসময়ই এভোয়েড করেন। ব্লাড প্রেসার নরমাল শুনে তাকে বেশ তরতাজা মনে হলো। আমি মনে মনে খুশিই হলাম। এত সমস্যার মধ্যে মেজচাচা অসুস্থ হলে খুব বিপদে পড়ে যেতাম।

বৃষ্টি থেমে গেছে। ধীরে ধীরে আকাশ পরিষ্কার হয়ে আসলো। একে একে সবাই উঠে পড়লো। মা গতকালের কেনা চাল-ডাল দিয়েই খিচুড়ি রান্না করছেন। আমি আর ছোটমামা বাড়ির বাইরে চলে আসলাম। বোঝা গেলো রাতে বেশ বৃষ্টি হয়েছে। রাস্তাঘাট ভেজা। কোনো কোনো জায়গায় পা ফেলতেই পিছলে যাচ্ছে। আমি কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলাম। সামনে কতটা পথ হাঁটতে হবে জানি না। এই ভেজা পিচ্ছিল রাস্তায় সবাইকে নিয়ে এগোবো কীভাবে? এদের তো এইসব পথে হাঁটার অভ্যেসও নেই।

বড়মামা বৃদ্ধ আদম আলীর সাথে বারান্দায় বসে কথা বলছিলেন। আমি মামার পাশে গিয়ে বসলাম। মেজচাচাও এসে যোগ দিলেন আমাদের সাথে। আমি বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘চাচা, এখান থেকে কীভাবে নিরাপদে মুন্সীগঞ্জে যাওয়া যাবে?’

তিনি বললেন, ‘অহন তো রাস্তাঘাট ভেজা। আপনেরা কী মেয়েছেলে আর পোলাপাইনগো নিয়া ভেজা রাস্তায় হাঁটতে পারবেন?’

‘ভাইসাব কিন্তু ঠিকই বলেছেন সুরুজ। এই পথে সবাইরে নিয়া যাবো কীকরে?’ মেজচাচা বলে উঠলেন।

আমি বললাম, ‘এই রাস্তা শুকাতে তো অনেক সময় লাগবে। আমরা কতক্ষণ অপেক্ষা করবো? তাছাড়া রাস্তা শুকানোর পর আবারও তো বৃষ্টি হতে পারে। তখন কী করবেন?’

বড়মামা আমাকে সমর্থন করলেন।

বৃদ্ধ আদম আলী বললেন, ‘আপনেরা এক কাজ করেন। আমগো বিবির বাজার থেইকা বালুচর বাজার পর্যন্ত নৌকায় যানঐখান থেইকা পায়ে হাইটা মুন্সীগঞ্জ যাইতে পারবেন’।

‘এখানে নৌকা পাওয়া যাবে?’ মেজচাচা জিজ্ঞেস করলেন।

‘নৌকা ঘাটেই পাইবেন’।

‘তাহলে তো ভালই হলো। যে পথ দিয়ে নৌকা যাবে সেখানে আর্মির ভয় নেই তো?’ আমি জানতে চাইলাম।

বৃদ্ধ আদম আলী বললেন, ‘এই কয়দিনে এলাকায় তো অগো দেখি নাই’

বড়মামা বললেন, ‘ যেতে তো হবেই। চল খাওয়া-দাওয়া করে বেরিয়ে পড়ি। আমাদের সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না’।

সকাল ন’টায় আমরা আবার বেরিয়ে পড়লাম। ভেজা কর্দমাক্ত রাস্তা কোথাও কোথাও পানি জমে আছে। আমি সবাইকে সাবধানে চলতে বললাম। সমস্যা দেখা দিলো বাচ্চাদের নিয়ে। অবশেষে কোনো বিপত্তি ছাড়াই আমরা বিবির বাজার খেয়াঘাটে পৌঁছালাম। আমাদের সাথে বৃদ্ধ আদম আলীও এসেছেন।

বাজারের পাশ ঘেঁষেই খালটি বয়ে গেছে পাশাপাশি দু’টো নৌকা খেয়াঘাটে বাঁধাবৃদ্ধ আদম আলী একজন মাঝির সাথে কথা বললেন। এই নৌকাটি অপেক্ষাকৃত বড়। আমাদের দলে ছোট-বড় মিলে ছত্রিশ জন। মাঝি আর তার সহকারীসহ নৌকায় সর্বমোট আটত্রিশ জনআমরা বৃদ্ধ আদম আলীর কাছ থেকে বিদায় নিলাম। এই বিপদের সময় সাহায্য করার জন্য বড়মামা তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানালেন। আমরা একে একে নৌকায় উঠে বসলাম। মাঝির উদ্দেশ্যে বৃদ্ধ বললেন,

‘জয়নাল, চারপাশটা দেইখা-শুইনা সাবধানে যাইস। মেহমানগো য্যান কোন অসুবিধা না অয়’

‘চিন্তা কইরো না চাচা। ইনশাল্লাহ কোন অসুবিধা অইবো না’

জয়নাল লগি দিয়ে নৌকার মুখ ঘুরিয়ে নিলো। নৌকা এখন সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই খাল কিছুদূর গিয়ে ছোট নদীতে পড়েছে এবং তারপর এঁকেবেঁকে মিলিত হয়েছে ধলেশ্বরীর সাথে জয়নালের সহকারী ছোটন সামনে বসে খালের দিকে ঝুঁকে পড়া ডালপালা সরিয়ে নৌকাটাকে সোজা রাখতে সাহায্য করছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা বিবির বাজার ছাড়িয়ে এলাম। আনু মায়ের কোলে শুয়ে ছটপট করছিলোমনে হয় ক্ষুধা লেগেছে মেজচাচী ওকে কোলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। রানুর হাত থেকে দুধের ফিডারটি নিয়ে মুখ দিতেই আনু চুপ। বড়মামা আর বাবা নৌকার মাঝখানে বসে নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন।

আমি নৌকার পেছন দিকে মাঝির কাছাকাছি বসে আছি। তারেক আমার পাশে, আর আসাদ ভাই আমাদের উল্টোদিকে, নৌকার সামনে। মাঝে মধ্যেই পেছনে ফিরে দাদীর সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। মনে হচ্ছে দু’জনের মধ্যে রসিকতা চলছে। দাদীও হাসছে।

আসাদ ভাই খুব মজার মানুষ। আমারই বয়সী। যে কোন পরিস্থিতিতে আসর জমাতে ওস্তাদ। সবাইকে সারাক্ষণই মাতিয়ে রাখে। আমি যে তার ছোটবোনের জামাই, মাঝে মাঝে তা-ও মানে না। তবে মনটা খুব ভাল। অনেকটা শিশুর মতই সরল। এজন্য বাচ্চারাও তাঁকে খুব পছন্দ করে।


পর্বঃ  ১১ 

জয়নাল মাঝি ছোটোখাটো গড়নের মানুষ। বয়স বছর ত্রিশের মত হবে। সারাক্ষণ পান চিবোচ্ছে আর কথা বলেই যাচ্ছে কথা বললে মাঝে মধ্যেই পানের পিক ছড়িয়ে পড়ছে এদিক ওদিক। সেদিকে তার কোন খেয়াল নেই। জয়নাল তার পানের কৌটার ভেতর থেকে আরেকটা পান মুখে পুড়ে দিলো। আমার দিকে তাকিয়ে লালচে খয়েরী দাঁত বের করে বললো,

‘ভাইজান পান খাইবেন?’

আমি বললাম, ‘না। আপনে খান’।

সে কৌটাটা যথাস্থানে রেখে দিলো আবার। মৃদু হেসে নিচু স্বরে আমাকে বললো, ‘মাজে মদ্যে পান খাইবেন। দ্যাখবেন ভাবীসাবে বালোবাসপে’ লোকটা খ্যাঁকখ্যাঁক করে হসে উঠলো।

এ ধরণের হালকা রসিকতা আমার একদমই পছন্দ নয়। আমি তাকে থামিয়ে দিলাম। তারেক মুচকি হেসে অন্যদিকে তাকালো।

প্রসঙ্গ চেঞ্জ করতেই জয়নালকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বালুচর বাজারে পৌঁছাতে কতক্ষণ লাগতে পারে?’

‘এই ধরেন দেড় ঘণ্টা’সামনে ভাটার সময় তো, একটু বেশি টাইম লাগবো।

‘তার মানে এগারোটা পার হয়ে যাবে। আচ্ছা, বালুচর বাজার থেকে মুন্সীগঞ্জের সবচেয়ে সহজ রাস্তা কোনটা?’

জয়নাল বললো, ‘আপনারা বালুচর বাজার থেইকা বেতকা বাজারে যাইবেন। আট-নয় মাইল পথ। এতবড় দল নিয়া যাইতে আপনাগো প্রায় আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা সময় তো লাগবোই। বেতকা থেইকা হাতিমারা রাস্তা ধইরা খানকা হইয়া দেওসার দিঘির পাশ দিয়ে একটা রাস্তা মুন্সীগঞ্জের দিকে চলে গেছে। আপনারা ঐ পথ দিয়া যাইতে পারেন তবে সে রাস্তায়ও আপনাগো প্রায় তিন ঘণ্টা লাগবে’।

যদিও এ পর্যন্ত যদিও পাক আর্মির দেখা পাইনি, তবুও অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ঐ পথে আর্মি নেই তো?’

জয়নাল জানালো, ‘না। পাকিস্তানী মিলিটারিরা অহনও এদিকে আহে নাই’।

আমরা ইতোমধ্যে খাল থেকে ছোট নদীতে পড়েছি। ছলাৎ ছলাৎ বৈঠা পড়ছে পানিতেএকই তালে। আমাদের নৌকা কিছুটা ধীর গতিতে এগোচ্ছে। এখন ভাটার সময়। স্রোতের বিপরীত দিকে চলছি। কলকল শব্দে পানি গড়িয়ে যাচ্ছে আমাদের পেছন দিকে। নৌকা বালুচর বাজারের কাছাকাছি গিয়ে ধলেশ্বরীতে পড়বেতারেক আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,

‘সুরুজ দাদা, হালটা ধরমু নাকি?’

আমি স্মিত হেসে বললাম, ‘তোর বাপধন নৌকায় বসে আছে, ভুলে গেছোস?’

‘না, ভুলি নাই। সেই জন্যেই তো পারতাছি না’

আমি হাসলাম। ‘ভাবিস না। বাড়ি পৌঁছে নৌকায় চড়ানোর ব্যবস্থা করাবো’। 

‘হুম। আগে তো বাড়ি পৌঁছাই

আমি আর কথা বাড়ালাম না। অনেকক্ষণ সবাই চুপচাপ। নিঃশব্দে এগিয়ে চলছে নৌকা। যেদিকে তাকাই সবুজ আর সবুজ। নদীর দু’পাড়ে লম্বা লম্বা ঘাস আর ঝোপঝাড়দূরের গ্রামগুলো যেন স্থির ছবি এঁকে রেখেছে আকাশের বুকে। এমন সুন্দর দেশটার বুকে হায়নার থাবা। কত মানুষকে যে প্রাণ হারাতে হবে কে জানে! জয়নাল হঠাৎ নিরাবতা ভাঙলো। আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো,

‘ভাইজান, হুনলাম ঢাকা শহরে নাকি অনেক মানুষ মারা গ্যাছে। ওদিককার কী অবস্থা?’

আমার এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে ভাল লাগছিলো না। কিন্তু ও যেহেতু প্রশ্ন করেছে উত্তর তো দিতেই হবে। তাছাড়া ও তো এখন আমাদের এই অনিশ্চিত যাত্রার একটা অংশ। আমি বললাম,

‘হ্যা। অনেক মানুষ মারা গেছে। পাক আর্মিরা ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমরা নিজেরাও পুরাটা জানি না, কারণ বাইরে বের হতে পারিনিমানুষ এখন নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে পালাচ্ছে’।

‘আহারে! কত মায়ের বুক যে খালি হইছে! জিঞ্জিরাতেও তো অনেক ঘরবাড়ি জ্বালাইয়া দিছে মিলিটারীরা।’

তারেক জিজ্ঞেস করলো, ‘ওরা জিঞ্জিরা পর্যন্তই এসেছে?’

‘হ। লগে নাকি বিহারিরাও আছিলো। মুন্সীগঞ্জের দিকে আহে নাই। তয় ভাইজান, মিলিটারিরা আমগো এদিকে আইলে খবর আছে। আমরাও তৈরি আছি। এমুন মাইনক্যা চিপায় পড়বো, হালারা পলানের পথ খুইজ্যা পাইবো না। সব কচুকাটা করুম’জয়নাল হাত দিয়ে ইশারা করে দেখালো। যেন ধারালো অস্ত্র দ্বারা কোনকিছু কাটাছে।

আমি জয়নালের মুখের দিকে তাকালাম। ঠিক সেই মুহূর্তে তাকে আমার কাছে বাঙালী তারুণ্যের প্রতীক বলে মনে হচ্ছিলোএরা কতটুকু পারবে জানি না; তবে জয়নাল কিংবা তার সাথিদের ভেতরে যে স্পিরিট বা দৃঢ় মনোবল দেখা যাচ্ছিলো, সেটাই তখন প্রয়োজন ছিলো।

আমি জয়নালের দিকে তাকিয়ে সায় জানালাম।

জয়নাল আমাকে বললো, ‘ভাইজান, আপনেরা পালাইতাছেন ক্যান?

আমি মৃদু হেসে নিচু স্বরে বললাম, ‘আমরা পালাচ্ছি না। পরিবারকে নিরাপদ স্থানে রেখে নিজেদেরকে মুক্ত করতে যাচ্ছি। প্রতিশোধ অবশ্যই নেবো। বাঙালী হারবে না জয়নাল। সত্যিই হারবে না’।

ও যা বোঝার বুঝে নিলোশেষে ছোট করে যোগ করলো, ‘তাই য্যান হয়। আমরা জিতবোই।’

আবার চুপচাপ। নৌকা যেন একটু দ্রুতই চলছে। এক ঘণ্টার বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। আমরা এখনও ধলেশ্বরীতে পড়িনিজয়নালের কথামত আরও আধাঘণ্টার মত লাগার কথা তবে এতক্ষণ অবশ্য অপেক্ষা করতে হলো না। বিশ মিনিটের মধ্যে আমরা বালুচর বাজারে পৌঁছে গেলাম।

একে একে সবাই নৌকা থেকে নেমে গেলো। আমি জয়নালের হাতে হাত রাখলাম। ‘ভালো থাকবেন। আপনার ভেতরে যে শক্তি আছে তাকে কাজে লাগাবেন। এটা আমাদের দেশ। অন্য কারো এই দেশ দখল করার অধিকার নেই। ওদের পেলে উচিৎ শিক্ষা দেন।’

বড়মামা বললেন, ‘আমরা এখানে দেরী করবো না। চল তাড়াতাড়ি বেতকার পথে বেরিয়ে পড়ি’

লম্বা বিশ্রামের পর সবাই বেশ তরতাজা। একজন বয়স্ক ভদ্রলোক আমাদের দেখে এগিয়ে এলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনেরা কোত্থেকে এসেছেন? কোথায় যাবেন?’

বড়মামা ভদ্রলোকের সাথে কথা বললেন। তিনি আমাদের সেই পথটাই দেখালেন যেটার কথা জয়নাল বলেছে। আমরা সেদিকেই এগিয়ে চললাম। জয়নালের কথা অনুযায়ী যদি তিন ঘণ্টা সময় লাগে, তাহলেও বেতকা পৌঁছুতে আমাদের বেলা দু’টো বেজে যাবে এবার আর ডোবা নালার পাশ দিয়ে হাঁটতে হচ্ছে না। পায়ে হাঁটা রাস্তা। খুব বেশি প্রশস্ত না হলেও চাষের জমি থেকে উঁচু এবং মসৃণ। হালকা ভেজা হলেও কাদা কিংবা পানি জমে নেই কোথাও। সবাই বেশ স্বাচ্ছন্দেই হেঁটে চলেছে। 

আমরা আবার পায়ে হেঁটে যাত্রা শুরু করলাম। গতকাল সন্ধ্যা থেকে লম্বা একটা বিশ্রাম হয়েছে সবার। মেজচাচাকে এখন অনেক ফ্রেশ লাগছে। সকালে ব্লাড প্রেসার নরমাল দেখে মানসিকভাবে সেও অনেকটা স্বস্তি পাচ্ছে। তবুও তাঁকে সবকিছু থেকে মুক্ত রাখা হয়েছে। দাদাকে বয়ে নেয়ার দায়িত্ব থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এখন থেকে তাই তাঁকে বহন করার দায়িত্ব ছোটচাচা, মনা আর আমার উপরই বর্তেছেআসাদ ভাই অবশ্য নিজে থেকেই সাহায্য করছে। মেজচাচার ছেলে মতিন বললো, ‘মাঝে মাঝে দাদাকে আমিও নিতে পারবো’। ছোটচাচা হেসে বললেন, ‘আচ্ছা নিস’।

পথের দু’পাশে ঝোপঝাড়, লতাগুল্ম আর ছোটবড় নানা ধরণের গাছ। আমগাছে ঝুলছে সবুজ কাঁচা আম। বড়-মাঝারি গাছের সাথে জড়িয়ে থাকা লতানো বেতগাছে ঝুলছে থোকা-থোকা বেতফল। কিছু কিছু রাস্তার উপরেই ঝুঁকে রয়েছে। তুলি আর তানিয়া বেতফলগুলোর দিকে কয়েকবার তাকালো কিন্তু বড়মামার ভয়ে কিছু বলতে পারছিলো না। আমি ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছিলাম।  

 

 

ঘণ্টাখানেক আমরা একটানা হাঁটলাম। বালুচর বাজার থেকে দুই-আড়াই কিলোমিটার সামনে চলে এসেছি। দাদাকে কাঁধে নিয়ে হাঁটতে গিয়ে ছোটচাচা কিছুটা হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। মা সেটা খেয়াল করে ছোটচাচাকে বললেন,

‘ইউসুফ, এহন একটু জিরাইয়া লও।’

আমরা দশ মিনিট বিশ্রামের জন্য থামলাম। বালুচর বাজার থেকে কিছু পাকা কলা আর স্থানীয় হোটেলের তৈরি জিলাপি নিয়েছিলামসাথে আছে চিড়া-মুড়ি আর বিস্কুট। বাচ্চারা কেউ কেউ কলা-জলাপি খেলো। মা আমাকে কাছে ডেকে বললো, ‘ইউসুফ হাপাইতাছে, এহন তোর দাদারে তুই কাঁন্ধে নে’। আমি ছোটচাচার কাছ থেকে দাদাকে নিজের কাঁধে তুলে নিলাম।

পথের দু’পাশে কোথাও কোথাও বসত বাড়ি আর বেশির ভাগ জায়গা জুড়ে বিস্তীর্ণ ফসলি জমি। সেখানে আলু, টমেটো, খিরাই, বাঙ্গি ফলে আছে। আলু আর টমেটোর মৌসুম শেষের দিকে। এই সময়ে এগুলো খুব সস্তা হয়। তাই লোকজন খেত থেকে তুলে নিলেও কোন কোন জমির মালিক কিছুই বলে না। লোকজন জমিতে কাজ করছে। আমরা সদলবলে হাঁটছি দেখে কেউ কেউ তাকাচ্ছে। পাশের জমিতে খিরাই দেখে মেজচাচার মেয়ে তানিয়া ছোটচাচাকে বললো, ‘ভাইয়া, খিরাই খাবো’অন্য বাচ্চারাও খেতে চাইলো

‘দ্যাখ না, লোকটা খিরাই ব্যাচে কি নামাইয়াগুলা খাইতে চাইছে’মা বললেন।

তারেক কৃষকের কাছে যেতেই সে বেশ কিছু খিরাই ওকে দিয়ে দিলো। টাকা দিতে চাইলে লোকটি হাসলো। ‘লাগবো না, আপনেরা আর কত খাইবেন?’

তারেক খিরাইগুলো এনে তানিয়ার হাতে দিতে দিতে বললো, ‘না ধুয়েই খেয়ে ফেলিস না যেনসামনে কোনো বাড়ি পেলে ওখান থেকে ধুয়ে নিস’। তুলি গোমড়ামুখে বললো, ‘জানি। তোমাকে আর জ্ঞান দিতে হবে না’।

মা হাসতে হাসতে বললেন, ‘এই অবস্থার মদ্যেও তোগো খোঁচাখুচি বন্দো অইবো না!’

দুপুরের রোদ তাঁতিয়ে উঠছে ক্রমশ। আমরা ছায়া খুঁজে খুঁজে হাঁটছিলাম। কিন্তু কোথাও কোথাও দীর্ঘ পথজুড়ে কোন গাছপালা ছিলো না। বয়স্করা আর বাচ্চারাই বেশি হাঁপিয়ে উঠছিলো। আমাদের প্রায়ই গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। হাঁটার অভ্যাস না থাকলে যেমন হয়। সাথে আনা পানি শেষ হলে আবার রাস্তার পাশের কোন বাড়ি থেকে খাবার পানি নিয়ে নিচ্ছি। আমরা বালুচর বাজার থেকে রওনা হয়েছি প্রায় দেড় ঘণ্টা হলো। আমি মনে-প্রাণে চাইছিলাম যেন সময় নষ্ট না হয় কিন্তু এতবড় দল নিয়ে চলতে হচ্ছে, পথে একেক জনের একেক ধরণের সমস্যা। না চাইলেও কিছুটা সময় নষ্ট হয়েই যাচ্ছে।

ছেলেমেয়েরা আগে আগেই হাঁটছে, তবে সমস্যায় ফেলে দিলো তিন পিচ্চি। মিনু ফুপুর মেয়ে সুমি, ছোটচাচার মেয়ে মণি আর বড় আপার মেয়ে শিলা। ওরা বেশিক্ষণ হাঁটতে পারলো না। বাধ্য হয়ে ওদের কোলে তুলে নিতে হলো। ছোটচাচা মেয়েকে কোলে নিতে গিয়ে দাদাকে আর কাঁধে নিতে পারছে না। আমি হাসতে হাসতে ছোটমামার উদ্দেশ্যে বললাম, ‘মেজচাচার পর এবার ছোটচাচা, আরও একজন যোদ্ধা কমলো।’ ছোটমামা মৃদু হেসে জবাব দিলো, ‘অসুবিধা নাই, দরকার হলে আমিও নিতে পারবো।’

শিলা কাঁদছিলো। বড় আপা সফিক ভাইকে খুঁজছেআমাকে বললো, ‘সুরুজ, সফিক কোথায়? ওকে তো দেখছি না। শিলাকে তো কোলে নিতে হবে।’

আমি আপার দিকে তাকিয়ে মুখটিপে হাসলাম। ‘চিন্তা করো না, আশেপাশে কোথাও আছে, চলে আসবে। ধুম্রসেবকদ্বয় মনে হয় ইচ্ছে করেই পিছিয়ে পড়েছে।’

বড় আপা বিরক্তি সহকারে বললো, ‘দাঁড়া, স্মোক করাচ্ছি।’

আমি মনে মনে বললাম আজ সফিক ভাইয়ের খবর আছে।

 

পর্বঃ   

বড়মামা, দাদী আর নুরুল ফুপা আবার কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিতে চাইলেন। আমরা পথের ধারে একটা আমগাছের নিচে বসলাম। গাছটার পাশ দিয়ে পায়ে হাঁটা মেঠোপথটি সোজা একটা বাড়ির ভেতরে চলে গেছে। তুলি আর তানিয়াকে সাথে নিয়ে মতিন বাড়িটার ভেতরে চলে গেলো। মেজচাচার কানে কানে কী যেন বললো চাচিমেজচাচা বললো, ‘তাহলে তোমরা ওদের সাথে যাও’। মেজচাচি ফুপুকে নিয়ে ওদের সাথে গেলো মিনিট দশেকের মধ্যে ওরা সবাই ফিরে এলো। হাতভর্তি ধুয়ে নেয়া খিরাই। কয়েকজন মহিলা ওদের পেছন পেছন এসে হাজির হলো। মহিলাদের হাতে থালাভর্তি মুড়ি, গুড় আর জগভর্তি পানি।

আমি মনে মনে ভাবছিলাম, এ দেশের মানুষ অতিথিবৎসল। কেউ বিপদে পড়লে সাহায্যের হাতটি বাড়িয়ে দেয়াই যেন বাঙালির রীতি। গুড়-মুড়ি আর ক্ষেতের তাজা খিরাই খাওয়া শেষে আবার শুরু হলো আমাদের পথচলা। আমি বললাম, ‘আর বিশ্রাম নেয়া চলবে না একেবারে বেতকা বাজারে গিয়েই থামবো’ এবার দাদাকে কাঁধে তুলে নিলো মতিন।

আমি বললাম, ‘তুই পারবি তো?’

ও যে বড় হয়ে গেছে এটা প্রমাণ করার জন্যই বললো, ‘সুরুজ দাদা, আমার বয়স ঊনিশ। এখন আর ছোট নই’।

স্মিত হেসে বললাম, ‘ও আচ্ছা’।

আমরা পাশাপাশি হাঁটছিলাম। ও ফিসফিস করে বললো, ‘দাদা, কাল কি বলেছিলাম মনে আছে তো?’

আমি ছোট্ট করে উত্তর দিলাম, ‘হুম’।

যদিও আমরা চেয়েছিলাম যাতে দু’টোর মধ্যে বেতকা বাজারে পৌঁছুতে পারি, কিন্তু পথে আরও দু’বার বিশ্রাম নেয়ার কারণে আমাদের বেশি সময় লাগলো। আমরা বেতকা বাজারে পৌঁছুলাম বেলা পৌণে তিনটায়। তখন বাজার প্রায় ফাঁকা। দু’একজন লোক বিক্ষিপ্তভাবে এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করছে। হঠাৎ একজন লোককে দেখতে পেলাম দোকান খুলছে। সফিক ভাই লোকটির কাছে এগিয়ে গেলেন

‘ভাই এখানে কোথাও রেস্টুরেন্ট খোলা আছে?’

পেছনে কারো কথা শুনে লোকটি ঘুরে তাকালো। আমাকে এলাকায় নতুন দেখে উৎসাহী হয়ে উঠলোআমার পেছনে বড়সড় দলটির দিকে চোখ পড়তেই বুঝলো আমরা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য গ্রামের দিকে ছুটছি। লোকটি বললো,

আপনেরা খাবার হোডেল খুজতাছেন?

আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘হুম।’

‘অহন বাজারে কোন হোডেল খোলা পাইবেন না’। লোকটি ডানদিকে ইশারা করে দেখালো। ‘ঐদিকে অল্প একটু পথ গ্যালেই একটা স্কুল পাইবেন। ঐহানে আপনাগো মতন আরও কিছু লোক আসছে। স্কুলেই সবার জন্য খানা-দানা আর থাকনের ব্যবস্থা করা হইছে’।

আমরা বুঝলাম ওখানে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এখন আর কিছু করার নাই। বাচ্চাগুলো বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছেপেটে কিছু না পড়লে ওরা আর হাঁটতে পারবে না। তাছাড়া এই গরমে প্রায় তিনঘণ্টা হেঁটে আমরাও বেশ ক্লান্ত। সবারই কম বেশি ক্ষুধা লেগেছে। আমরা আশ্রয়কেন্দ্রের দিকেই এগিয়ে গেলাম।

স্কুলটিতে অনেক লোক জড়ো হয়েছে। স্কুলরুমের বেঞ্চগুলো একপাশে সরিয়ে পাটি বিছিয়ে লোকজনদের বসানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের দেখে স্থানীয় লোকজন আরেকটা রুম খুলে দিলো। আমরা টিউবওয়েলে হাতমুখ ধুয়ে ভেতরে গিয়ে বসলাম। একজন বয়স্ক ভদ্রলোক আমাদের সাথে কথা বলতে এলেনআমরা কোথা থেকে এসেছি, কোথায় যাবো, এইসব খোঁজখবর নিলেন। কিছুক্ষণ পর কয়েকজন লোক খাবার নিয়ে এলো। মোটা চালের ভাত, আলুভর্তা আর পাতলা ডাল। ক্ষুধার্ত বাচ্চাগুলো কোন প্রতিবাদ করলো না। অন্য সময় হলে এই খাবার এদের খাওয়ানোই যেতো না। আমি মনে মনে বললাম, সময় আর পরিস্থিতি মানুষকে কতকিছু মেনে নিতে বাধ্য করে!

পুব আকাশ কালো করে মেঘ জমেছে। যে কোন মুহূর্তে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে। আমি বাইরে এসে দাঁড়ালাম। আরও কয়েকজন লোক স্কুলের মাঠে পায়চারী করছিলো। দু’একজনের সাথে সামান্য কথা হলো। এরাও আশ্রয়ের সন্ধানে যার যার গন্তব্যে ছুটছে। আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। বৃষ্টি হলে তো আমরা আবার আটকে যাবো।

স্কুলের হেডমাস্টার ঘুরে ঘুরে সবার খোঁজখবর নিচ্ছেন সবার খাওয়া-দাওয়া ঠিকমত হয়েছে কি না, কিংবা কার কি লাগবে। স্কুলের মাঠেই ভদ্রলোকের সাথে কিছুক্ষণ আলাপ হলো। সব শুনে তিনি বললেন, ‘যে কোন সময় বৃষ্টি নামবে, এই অবস্থায় আপনারা পায়ে হেঁটে মুন্সীগঞ্জ পর্যন্ত যেতে পারবেন না’। আমিও বুঝতে পারছিলাম যে এই অবস্থায় আমাদের বের হওয়া ঠিক হবে না। অতএব বাধ্য হয়েই রাতটা ওখানেই কাটাতে হলো।

পাশের রুমে একটা বাচ্চা ক্রমাগত কাঁদছে। মা হঠাৎ বললেন,

‘বাচ্চাডা এত কানতেছে ক্যান? মনে অয় কোন অসুবিধা অইতেছে।’

কিছুক্ষণ পর নিজেই গেলেন দেখতে। ফিরে এসে রানুকে বললো, ‘চাইর মাসের বাচ্চা, খাবার নাই। মায়ের বুকের দুধও নাই। বউ, আনুর দুধ থেইক্যা একটু গুড়াদুধ দেও তো। এই বিপদে মানুষের বিপদে তো মানুষই খাড়াইবো।’

আমি মাকে দেখি আর অবাক হই। এত সমস্যার মধ্যেও সবদিকে তার সজাগ দৃষ্টিকখনও কখনও দেখি বড়মামা নিজেও মায়ের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। আমি স্কুলটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। সবমিলে প্রায় একশো মানুষ আশ্রয় নিয়েছে স্কুলটিতে। আমরা বাদে বাকীদের কেউ নবাবগঞ্জ আবার কেউবা মাওয়ার দিকে যাচ্ছেন।   

সন্ধার আগেই হুড়মুড় করে বৃষ্টি নামলো। অন্ধকারে ছেয়ে গেলো চারিদিক। রুমের ভেতরে একটা গুমোট অন্ধকার। হেডমাস্টার সাহেব একটা হ্যারিকেন আর বসার জন্য একটি পাটি পাঠিয়ে দিলেনআমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিলাম। মাঠের সাথে লাগোয়া একটা বড় পুকুর আর দুই দিকে বসতবাড়ি। বাড়িগুলো ঘন গাছপালায় ঘেরা। বৃষ্টির সাথে খুব জোরে বাতাস বইছে। পুকুর পাড়ের নারকেল গাছের ডাল-পাতাগুলো যেন বাতাসের সাথে অসম যুদ্ধে মেতে উঠেছে। একবার উত্তরে হেলে পড়ে তো একবার দক্ষিনে। ডান দিক থেকে মড়মড় করে ডাল ভাঙার শব্দ শুনলাম। মনে হলো পাশের বাড়ির বাগানের কোন গাছ থেকে ভেঙে পড়েছেআচমকা বাতাস তার দিক পরিবর্তন করলো। এখন বাতাস মুখোমুখি স্কুলের দিকেই বইছে। বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা এসে পড়ছে স্কুলের বারান্দায়। আমি কিছুটা পিছিয়ে আসলাম। তবুও বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছে চোখেমুখে। অবশেষে রুমের ভেতরে চলে এলাম।

মহিলারা রুমের মেঝেতে পাটি বিছিয়ে একসাথে জড়সড় হয়ে বসে আছেবয়স্করা কেউ কেউ চেয়ার আর বেঞ্চে বসে ঝিমোচ্ছেআসাদ ভাই, তারেক, হাসান, মতিন আর সুমন রুমের একপাশে সরিয়ে রাখা বেঞ্চের উপর শুয়ে পড়েছে। ছোটচাচা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি চাচার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।

‘তোমার স্কুলের এখন কি অবস্থা কে জানে! আর তুমি আজ আশ্রয় নিয়েছো অন্য কোনো স্কুলে

ছোটচাচা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘হ্যা। ভাগ্য কাকে কখন কোন পরিস্থিতিতে দাঁড় করায় কে বলতে পারে!’

ছোটচাচা ঢাকার গোরানে থাকেন, বড়মামার বাসার কাছাকাছি। গোরানের একটা হাই স্কুলে শিক্ষকতা করেন তার দুই ছেলেমেয়ে। ছেলে মামুন একই স্কুলেই পড়ে, আর মেয়ে মণি পাশের প্রাইমারি স্কুলে ২রা এপ্রিল বড়মামার বাসার আসার পর থেকেই ছোটচাচাকে বেশ বিপর্যস্ত দেখছি। অবশ্য এই পরিস্থিতে আমরা সবাই খুব আপসেট। সবারই বর্তমান-ভবিষ্যত সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে।

ছোটচাচা আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘আমার ছত্রিশ বছরের জীবনে এত কঠিন পরিস্থিতি কখনও দেখিনি। নিজেকে এত অসহায় কখনও লাগেনি’।

চাচার কথা শুনে এমন দুর্দিনেও আমার হাসি পেলো। আমি বললাম, ‘আমরা সবাই এখন একটা সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আমি সামনে একটা ভয়ঙ্কর যুদ্ধের আভাস পাচ্ছি যে যুদ্ধ তুমি, আমি, আমাদের সবার জীবনকেই ওলটপালট করে দেবে। ছোটচাচা, এখনই এত ভেঙে পড়লে হবে? তাহলে সামনে যে কঠিন সময় আসছে, তাকে কীভাবে সামলাবে?’

ছোটচাচা চট করে আমার দিকে ঘুরে তাকালেন। নিচু স্বরে বললেন, ‘তুই কী যুদ্ধে যাবার কথা ভাবছিস?’

আমি বললাম, ‘দেখি পরিস্থিতি কোনদিকে যায়। প্রয়োজন হলে তো যেতেই হবে। তবে এই বিষয় নিয়ে ঘরে কোন আলোচনা নয়’।

চাচা গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে সায় জানালেন। আমাদের আলোচনা থেমে গিয়েছিলো সেখানেই। রাতে আশেপাশের বাড়ি থেকে রুটি আর সবজি পাঠানো হলোকেউ কেউ খেয়ে নিলো। বাচ্চারা বেশির ভাগই না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। আমরা সে রাতটা পার করেছিলাম প্রায় না ঘুমিয়েই।

 

৬ই এপ্রিল, ১৯৭১

পরিষ্কার ঝরঝরে সকাল। আকাশে মেঘের লেশমাত্র নেই। গ্রামবাসির পাঠানো চা-মুড়ি খেয়ে সকাল আটটায় আমরা বেতকা বাজার থেকে মুন্সীগঞ্জের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। কিছুদূর হাঁটতেই বুঝলাম এবারের যাত্রাটি সহজ হবে না। রাস্তায় থকথকে প্যাঁক আর গর্ত ভরা পানি। আমি শুধু চাইছিলাম যত দ্রুত সম্ভব দিঘির পাড় দিয়ে নদী পার হয়ে ওপারে চলে যাওয়া যায় এতবড় দল নিয়ে কোনভাবেই পাকিস্তানি আর্মির মুখোমুখি হওয়া চলবে না।  

আমরা হাতিমারা রাস্তা ধরে যাচ্ছি। গর্ত ও কাদাপানি পেরিয়ে সাবধানে হাঁটছি। তবে ছেলেবেলা থেকেই শহরে বসবাস করা ছেলেমেয়েদেরকে নিয়েই বেশি সমস্যা। অভ্যেস না থাকায় ওদের পক্ষে কাদামাখা পিচ্ছিল পথে হাঁটা সত্যিই কষ্টকর। আমি বললাম, ‘তোরা জুতা খুলে পাশের ঘাসের উপর দিয়ে হাঁট’ তাই করলো ওরাএবার কিছুটা স্বাচ্ছন্দে হাঁটতে পারছে। ছোট বাচ্চারা খুশিমনেই কিছুক্ষণ বড়দের পিছু পিছু হাঁটলো, তবে বেশিক্ষণ নয়। একসময় ছোটচাচা তাঁর সাত বছরের মেয়ে মনিকে আর নুরুল ফুপা পাঁচ বছরের সুমিকে কোলে তুলে নিলোকাউকে কাঁধে নিয়ে এই পথে হাঁটা খুব একটা সহজতর নয়। মতিন দাদাকে কাঁধে নিয়েছে আবার, তবে অভ্যাস না থাকায় ও অল্প কিছুদূর গিয়েই হাঁপিয়ে উঠলো। মতিনের কাছ থেকে দাদাকে কাঁধে নিতে নিতেই বললাম, ‘বুঝলা মতি মিয়া, তুমি এখনও ততটা বড় হওনি।’ মতিন আত্মপক্ষ সমর্থন করতেই যেন বললো, তুমি ভাইবো না দাদা, একটু পর আমি আবার দাদাকে কাঁধে তুলে নেবো’ এভাবেই এগিয়ে চলছিলাম আমরা। 

এবার আর না থেমেই আমরা প্রায় দেড়ঘণ্টা হাঁটলাম। পথিমধ্যে লোকজনের দেয়া নির্দেশনা অনুসরণ করে চলছিছেলেমেয়েদের মধ্যে কেউ কেউ পথে বিশ্রাম নিতে চাইলেও আমি সামনে এগিয়ে যাবার ব্যাপারে অনড় ছিলাম। হাতিমারা-কে পেছনে ফেলে আমরা ডানদিকের সরু পথে নেমে পড়লাম। লোকজন এই পথটার কথাই বলেছিলো। অল্প কিছুদূর সামনেই পড়লো একটা দিঘি। দেওসার দিঘিচারিদিকে সবুজ গাছগাছালির মাঝখানে বিশাল এক জলাধারআমরা ওখানে গাছের নিচে বিশ্রামের জন্য বসলাম।


চলবে ......


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উপন্যাসঃ ফেরা (পর্বঃ ২১ - ২৫ - শেষ পর্ব)

এ ই উপন্যাসটিতে সম্মুখ সমরের কোন ঘটনা তুলে ধরা হয়নি।  ওয়ারফ্রন্টের কোনও দৃশ্য নেই। তবে এই লেখায় মূলত যে গল্পটি বলার চেষ্টা ক রা হয়েছে  তা মু...