এই উপন্যাসটিতে সম্মুখ সমরের কোন ঘটনা তুলে ধরা হয়নি। ওয়ারফ্রন্টের কোনও দৃশ্য নেই। তবে এই লেখায় মূলত যে গল্পটি বলার চেষ্টা করা হয়েছে তা মুক্তিযুদ্ধের বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। একটি যুদ্ধ নানানভাবে মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে, যার কোনোটিকেই ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। একাত্তরের পঁচিশে মার্চের সেই কালরাত থেকেই নিজেদের পরিবারকে বাঁচানোর তাগিদে মানুষ ঢাকা শহরের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছুটে বেড়িয়েছে। কেউ কেউ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ফিরে গেছে নিজ গ্রামে। এই গল্পে তেমনই কিছু মানুষের জীবনযুদ্ধের ঘটনাবলীই তুলে ধরা হয়েছে; যারা নিজেদের পরিবারকে বাঁচাতে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে ফিরে চলে নিজ গ্রামে। এটা মোটেও সহজ ছিলো না। এই ফিরে যাওয়ার গল্পটিই এই উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য।
পর্বঃ ১৩
তখন চৈত্র শেষের দিকে। বৈশাখ কড়া নাড়ছিলো দরজায়। আশেপাশের অনেক গাছে থোকা থোকা
আম ঝুলছিলো। মামুন পেছনের একটা গাছে ঢিল ছুড়তে গিয়ে ছোটচাচার কাছে ধমক খেলো। একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি হেসে
বললেন, ‘পোলাপাইন মানুষ, বইকেন না ভাই’। একটু
পরেই তিনি বেশকিছু কাচা আম নিয়ে এলেন। ছেলেমেয়েরা আমগুলো পেয়ে তো ভীষণ খুশি। ওরা কাচা আম পেয়ে আর কিছু খেলো না। বেতকা বাজার থেকে কেনা
কলা আর মুড়ি খেয়ে আবার পথে নামলাম।
গতদিনের চেয়ে আজকের গরমের মাত্রাটা যেন আরও বেশি। মাথার উপর গমগমে সূর্যটা
ক্রমশ তেজী হয়ে উঠছে। ঝাঁ-ঝাঁ রোদের তাপ সারা গায়ে সূচের মত বিঁধছে। একদিকে ভেজা
রাস্তায় পায়ে হাঁটা, অন্যদিকে চৈত্রের দাবদাহ- বাচ্চারা দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়ছে।
আমি বুঝতে পেরেও কিছুই বলছিলাম না। সবাইকে সাহস যোগাচ্ছিলাম এই বলে যে, বাঁচতে হলে
এই সমস্যাগুলো আমাদের মেনে নিতেই হবে। প্রায় দুই ঘণ্টা হেঁটে আমরা মুন্সীগঞ্জের
কাটাখালি ছোট বাজার এলাকায় পৌঁছালাম। হঠাৎ আকাশে মেঘ জমতে শুরু করলো। রোদের তাপ কমে যাওয়ায় ছেলেমেয়েরা স্বস্তি অনুভব করছিলো,
তবে আমি ভাবছিলাম বৃষ্টি নামলে পথচলা আরও কষ্টকর হয়ে পড়বে। তাছাড়া দ্রুত নিরাপদ
একটা আশ্রয় প্রয়োজন। এলাকার একজনকে জিজ্ঞেস করতেই জানালো চেয়ারম্যান বাড়িতে
লোকজনের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা তাদের দেখানো পথে এগিয়ে গেলাম।
এখানকার বেশির ভাগ ঘরগুলোই কাঠের তৈরি। ঘরের মেঝে মাটি থেকে কিছুটা উপরে এবং
কাঠ দিয়েই তৈরি করা। চেয়ারম্যান বাড়ির সম্মুখদিকের একটি ঘরে নিয়ে বসানো হলো
আমাদের। ঘরটি আয়াতকার এবং দু’দিকে দু’টি চৌকি পাতা। আগে থেকেই দশ-বারো জনের একটা দল একপাশের চৌকিতে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলো।
চেয়ারম্যান নিজেই তদারকি করছিলেন সবকিছু। ভদ্রলোককে দেখে খুব বন্ধু বৎসল মনে
হলো। তিনি হাসিমুখে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। আমরা দিঘির পাড় যেতে চাই শুনে তিনি
আমাদের আশ্বস্ত করলেন।
‘মুন্সীরহাট বাজারের খেয়াঘাট থিকা দিঘির পাড়ে নৌকা যায়।’
আমি জানতে চাইলাম, ‘মুন্সীর হাট এখান থেকে কতদূর?’
‘হাইট্যা গ্যালে আধাঘণ্টা লাগবো। আপনারা
বিশ্রাম নেন, আমি ঘাটে নৌকার ব্যবস্থা করতাছি’।
‘তাহলে তো খুব উপকার হয় ভাই সাহেব।’ আমি কৃতজ্ঞচিত্তে বললাম।
তিনি জানতে চাইলেন, ‘আপনেরা সব মিল্যা কয়জন?’
আমি বললাম, ‘বাচ্চাদের নিয়ে ছত্রিশ জন।’
‘আইচ্ছা। আমি অহনই লোক পাঠাইয়া নৌকার
মাঝিরে বইল্যা দিতাছি।’
আমরা সস্ত্বির নিঃশ্বাস ফেললাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ির ভেতর থেকে আমাদের
জন্য খাবার পাঠানো হলো। তবে খাবার ব্যাপারে কারো মধ্যে কোন আগ্রহ নেই। তবুও কেবল
ক্ষুধা নিবারণের জন্যই আমরা সবাই যৎসামান্যই খেয়ে নিলাম। খেতে খেতেই দেখলাম বৃষ্টি
শুরু হয়েছে। বাইরে তাকিয়ে ছোটচাচার মুখ কালো হয়ে গেলো।
বিড়বিড় করে বললেন, ‘এই বৃষ্টি যে কতক্ষণে থামবে!’
আবার অপেক্ষা।
বড়মামাকে দেখলাম মনমরা হয়ে চৌকির একপাশে বসে আছেন। কাউকে কিছু বলছেন না। তবুও ছেলেমেয়েরা মামার ভয়ে তটস্থ থাকে। চৌকির অন্যপাশে
বসে ওরা নিজেদের ভেতরেও ফিসফিস করে কথা বলছে।
‘তানি, দেখ বাইরে কী সুন্দর বৃষ্টি হচ্ছে। টিনের চালে এমন বৃষ্টির শব্দ কখনও শুনেছিস?’ তুলি নিচু স্বরে বললো।
মতিন ফিক করে হেসে ফেললো। ‘এই গ্রামে তোর জন্য পাত্রী খুঁজবো না-কি? সারাজীবন
বৃষ্টি দেখতে পারবি’।
‘এই ফাজিল! তোকে আমাদের কথার মধ্যে নাক গলাতে কে বলেছে?’ মতিনের উপর কপট রাগ
ঝাড়লো তুলি।
‘বেয়াদপি করিস না, আমি তোর চেয়ে বড়।’
‘হ্যা জানি, মাত্র ছয় মাসের বড়’। তুলি ভেঙচি কাটলো।
আমি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছিলাম। তারেক ওদের কাছে এসে বললো,
‘কী-রে, তোরা ফিসফিস করে কি বলছিস?’
তুলি ছোট করে উত্তর দিলো, ‘কিছু না। এমনিই কথা বলছিলাম’।
‘ও, আচ্ছা।’
হঠাৎ করে বাতাসের বেগ বেড়ে গেলো।
মেজচাচা উঠে এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ঝড় ছাড়ছে না-কি?’
‘হ্যা, বাতাসের বেগ বেড়ে গেছে।’
নুরুল ফুপা আমার পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি বলে উঠলেন, “আল্লাহুম্মা হাওয়ালাইনা ওয়ালা আলাইনা’। সুরুজ এই দোয়াটা বেশি বেশি পড়।”
‘আচ্ছা।’ আমি ঘুরে ফুপার দিকে তাকিয়ে বললাম।
বেশ কিছুক্ষণ প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করলো বাতাস। তারপর ধীরে ধীরে কমে এলো বেগ। বিকাল চারটা নাগাদ থেমে গেলো বৃষ্টি। আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
আমরা চেয়ারম্যানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বিকাল সাড়ে চারটার দিকে মুন্সীরহাট
বাজারের উদ্দেশ্যে বের হলাম। সকালের মত ভেজা রাস্তায় হাঁটছি। তবে ছেলেমেয়েরা এখন কাদামাখা পথে হাঁটতে মোটামোটি অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে মুন্সীরহাট বাজারের দূরত্ব প্রায় দুই
কিলোমিটার। আমরা সোয়া পাঁচটা নাগাদ
সেখানে পৌঁছালাম। ঘাটে একটাই নৌকা ছিলো।
আমি মাঝির দিকে এগিয়ে গেলাম। চেয়ারম্যানের কথা বলতেই বুঝলাম মাঝিকে আমাদের বিষয়ে
আগেই বলা আছে।
ঘাটের পাশে চায়ের দোকান থেকে চা বানানোর টুং-টাং শব্দ কানে আসছে। কাপ আর চামচের ঘর্ষণ আমার চায়ের তেষ্টা জাগিয়ে দিলো। হঠাৎ
মনে পড়লো গত চার-পাঁচদিনে চা খাওয়া হয়নি। আসাদ ভাই দোকানের আড়ালে দাঁড়িয়ে সিগারেট
ফুঁকছে। চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়াতেই তারেক এসে বললো,
‘দাদা, আমিও খাবো’।
আমি বললাম, ‘দেখ তো, আর কে কে খাবে’।
তারেক কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে বললো,
‘তুমি সহ বিশ কাপ অর্ডার দাও’।
আমি দোকানিকে একুশ কাপের অর্ডার করলাম। তারেক আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে
তাকালো। আমি ইশারায় আসাদ ভাইকে ডাকতে বললাম।
তারেক চায়ে চুমুক দিয়েই আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি হয়েছে?’
‘এত বাজে চা কখনও খাইনি, একদম পানশে’।
আসাদ ভাই হেসে বললো, ‘কী ভেবেছিলে? তোমার বাসার চায়ের স্বাদ পাবে?’
আমারও মনে হলো চা-টা মোটেই ভাল হয়নি। তবুও ওকে বললাম, ‘চুপচাপ খেয়ে নে, এটা যে
পেয়েছিস তা-ই বেশি।’
চা খাওয়া শেষে একে একে সবাই নৌকায় উঠে বসলো। আমরা ছাড়া আরও আটজন লোক আগে থেকেই
নৌকায় বসে ছিলো। রাতের জন্য কোন খাবার পাওয়া যায় কি না দেখতে আমি আর ছোটমামা
বাজারের দিকে গেলাম। সন্ধ্যার পর নৌকা ছাড়বে।
অন্ধকার রাত। ছপাৎ ছপাৎ- দাঁড় পড়ছে পানিতে। গলুইয়ের
নিচে কুলকুল করে পানি বয়ে চলছে। নিঃশব্দে এগিয়ে চলছে আমাদের নৌকা। আনুকে সহ নৌকায় এ মুহূর্তে ছেচল্লিশ জন যাত্রী। আমরা ছাড়া
বাকী যাত্রিরা পথে কোথাও নেমে যাবে। সবাই চুপচাপ বসে আছে। মামুন আমার পাশেই বসে
ছিলো। ও আমার হাতটা ধরে বললো,
‘সুরুজ দাদা, খুব অন্ধকার’।
আমি মামুনের কানের কাছে ফিসফিস করে বললাম, ‘অন্ধকারে ভূতেরা ঘোরাফেরা করে।
তোকে ধরতে পারে।’
ও কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, ‘আমার খুব ডর লাগছে’।
‘তাহলে বাবার গলা জড়িয়ে থাক। ভয় কেটে যাবে।’
মামুন ছোটচাচার গা ঘেঁষে বসে তার হাত শক্ত করে ধরে রাখলো।
মুন্সীরহাট বাজারের খেয়াঘাট থেকে বেশ কিছুদূরে চলে এসেছি আমরা। খালটির বামদিকে
কিছু ফাঁকা জায়গা। ছোট ছোট ঝোপঝাড় আর গুল্মলতায় ছাওয়া। অন্যদিকে
লোকালয়। খালটির পাড়ঘেঁষে লোক চলাচলের রাস্তায় কোথাও হালকা আবার কোথাও কোথাও ঘন
গাছগাছালি। সেখানে ছোপ ছোপ জমাট বাঁধা অন্ধকার। সেই অন্ধকারের মাঝেই পোকামাকড়ের
অদ্ভুত ডাকাডাকি। গাছের ডালে জীবজন্তু ছোটাছুটির শব্দও আসছে। বাতাসে কান পাতলে আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে। নানারকম পাখির কিচিরমিচির ডাক শোনা যায়। তবে সেটা অনুভব করার জন্য কিছুটা
বাড়তি মনোযোগের প্রয়োজন।
এঁকেবেঁকে ছুটে চলা খালটির চারপাশের পরিবেশ কিছুক্ষণ পর পরই বদলে যাচ্ছে। এই
একটু আগেও একপাশ ফাঁকা থাকলেও এখন খালের দু’দিকেই ঘন গাছপালা। দু’পাড় থেকেই খালের
দিকে ঝুকে রয়েছে গাছের অসংখ্য ছোট-বড় ডালপালা। সেই গাছের ফাঁকফোকর দিয়ে চোখে পড়ছে
খোলা আকাশ। বাকী পথটা যেন এক অন্ধকারের রাজ্য। অন্ধকারে পানির রঙ কালচে দেখাচ্ছে।
তারেক হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, ‘এই খালটা কোথায় গিয়ে মিশেছে?’
আমি কিছুটা আনমনা ছিলাম। হঠাৎ ওর প্রশ্ন শুনে বললাম।, ‘উম! কিছু বললি?’
ও আবার একই প্রশ্নের পুনরাবৃতি করলো। আমি বললাম,
‘সম্ভবত এই খাল দিঘিরপাড় হয়ে পদ্মায় পড়েছে’।
আমি লোকমুখে শুনেছিলাম এই এলাকায় পদ্মা থেকে শুরু করে
দিঘিরপাড়-মাকাহাটি-কাটাখালী-মুন্সীরহাট হয়ে ধলেশ্বরীতে মিশেছে যে নদীটা- তার নাম
রজতরেখা। কেউ কেউ বলে নদীটি আর আগের মত
নেই, এখন খালে পরিণত হয়েছে। মাঝিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই খালটাই সেই নদী না-কি?’
মাঝি বললো সে কিছু শোনেনি। তারা
এটাকে খাল হিসেবেই জানে।
তারেক বললো, ‘রজতরেখা নদীর নাম? সুন্দর তো!’
আমি বললাম, ‘এটাই সেই নদী কি না জানি না। লোকজন তো খালের কথাই বললো। তবে আমার মনে হয় রজতরেখা হয়তো আশেপাশের কোথাও
বয়ে চলেছে। প্রায় পাঁচশ ফুট প্রস্থের
খরস্রোতা এক নদী ছিলো ওটা। সেই নদী দিয়েই একসময় অনেক বড় বড় নৌকা, লঞ্চ চলতো। আর কোন কারণে সেগুলো যদি দূর্ঘটনার কবলে পড়ে ডুবতো, তবে তার খোঁজই পাওয়া দুস্কর হয়ে যেতো।’
‘বলো কী! এটাকে তো খালের মতই লাগছে। আমাদের গ্রামের খালটাও তো এর থেকে ছোট নয়।’
‘তা ঠিক। বাংলাদেশের অনেক নদীই নাব্যতা-সংকটে শুকিয়ে খালে পরিণত হয়েছে। রজতরেখারও হয়তো একই অবস্থা। এই এলাকার বয়স্ক ব্যক্তিরা হয়তো আরও ভাল জানে।’
নৌকায় ছায়া ছায়া অন্ধকার। মায়ের পাশে বসে বড়মামীর সাথে নিচু স্বরে কথা বলছে
রানু। আনু মায়ের কোলে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। নৌকার মাঝখানটায় চুপচাপ বসে
আছে বড়মামা। ইদানীং বড় বিমর্ষ লাগছে তাঁকে। মনে হচ্ছে অনেকের মধ্যে থেকেও নিঃসঙ্গ।
গতকাল বেতকা বাজারে পৌঁছাবার পর থেকে যেন বদলে গেছে অনেক। যে শক্তি, তেজ বড়মামার
ভেতরে এতদিন দেখেছি, এখন আর তেমনটি নেই। হয়তো অতিরিক্ত পরিশ্রম কিংবা সামনে
অনিশ্চিত পথযাত্রাই এর কারণ, না কি কোন শারীরিক সমস্যা? আজ সকালে একবার জানতে
চেয়েছিলাম শরীর খারাপ কি না। মামা
বললো, ‘না, সব ঠিক আছে’। আমি কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলাম। অর্ধেক পথও আসিনি, এখনই
মেজচাচা অসুস্থ, বড়মামার এ অবস্থা। সামনের সময়টা ভালো কাটলেই হয়। আমি তারেককে নিচু
গলায় জিজ্ঞেস করলাম,
‘বড়মামার কি হয়েছে, তুই কিছু জানোস?’
ও বললো, ‘না। আমিও বিষয়টা লক্ষ করেছি। বাবা খুব চুপচাপ হয়ে গেছে।’
‘তুই কাছাকাছি থাক, আর খেয়াল রাখ মামার দিকে।’
‘আচ্ছা।’
এখন লক্ষ্য একটাই- সবাইকে সুস্থ্য অবস্থায় গ্রামে পৌঁছে দেয়া। আমি ঠিক করলাম দিঘিরপাড়ে গিয়ে আসাদ ভাই, সফিক ভাই, ছোটমামা, ছোটচাচা, তারেক, মতিন আর চন্দনকে নিয়ে বসতে হবে। বয়স্কদের কোন চাপ দেয়ার দরকার নেই। আমাদেরকেই পুরা দলটার দায়িত্ব নিতে হবে।
পর্বঃ ১৪
যাত্রার শুরুতে আকাশে হালকা মেঘ থাকলেও এখন পুরোপুরি পরিষ্কার। বৃষ্টি নামার
কোন সম্ভাবনা নেই। আজ কিছুটা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে। ছোটচাচার মেয়ে মণি বাপের কোলের
মধ্যে গুটিশুটি মেরে বসে আছে। ছোটচাচাও দু’হাতে তার দুই সন্তান মামুন আর মণিকে
আগলে রেখেছেন। সুমীও বসে আছে নুরুল ফুপার কোলের কাছে। পাশে বসে সুমির সাথে খুনসুটি করে যাচ্ছে তানিয়া। মনে হচ্ছে অন্য দলটির লোকজনের সাথে বাবা ও মেজচাচার বেশ ভাব হয়ে গেছে। তারা
খোশগল্পে মেতে উঠেছে। তবে সবাই নিচু গলায় কথা বলছে।
মাঝি নিঃশব্দে নৌকা বেয়ে চলেছে। লোকটির নাম তমিজউদ্দীন। বয়স প্রায় পঁয়ত্রিশ। শ্যামবর্ণ, লম্বা ছিপছিপে গড়নের। কম কথা বলার মানুষ। কিছু কিছু সময় পেটে গুতো
মারলেও মুখ থেকে রা বেরোয় না। তবে কাজের কাজটা সময়মত ঠিকই করে ফেলে। তার সহকারীর
নাম আবুল। সে মাঝির উল্টাদিকে বসে চুপচাপ দাঁড় টেনে যাচ্ছে।
মাঝিকে জিজ্ঞেস করলাম দিঘিরপাড় যেতে কতক্ষণ লাগবে। কোনো উত্তর নেই। যেন শুনতে পায়নি আমার কথা। আমি নৌকার মাঝখান থেকে উঠে মাঝির কাছে গিয়ে বসলাম। যথারীতি আমার পাশে এসে বসলো
তারেক। মাঝির কাছে এগিয়ে গিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম,
তমিজ ভাই, ‘আমাদের দিঘিরপাড় পৌঁছাতে কতক্ষণ লাগতে পারে?’
এবার মুখ খুললো সে। বললো, ‘প্রায় সাড়ে তিন
ঘণ্টা লাগবে।’
আমি বিড়বিড় করে বললাম, ‘তার মানে দিঘিরপাড় পৌঁছাতে রাত প্রায় সাড়ে ন’টা
বাজবে।’
তারেক আমার কানের কাছে মুখ এনে বললো, ‘আমরা রাতে থাকবো কোথায়?’
আমি মাঝিকে আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘তমিজ ভাই, দিঘির পাড়ে আমাদের থাকার জায়গা
পাওয়া যাবে তো? বোঝেনই তো, সাথে মহিলা ও বাচ্চারা আছে।’
ঠিক সেই মুহূর্তে খালপাড়ের রাস্তা থেকে কে যেন হাঁক ছাড়লো। ‘কার নাও যায়?’
তমিজউদ্দীন গতি কিছুটা কমিয়ে নৌকাটাকে লোকটার সোজাসোজি নিয়ে এলো এবং ততোধিক
উচ্চস্বরে জবাব দিলো, ‘তমিজউদ্দীনের নাও যায়। আপনে কেডা?
‘ও, তমিজ? আমি রতন শীল। নাও নিয়া কই যাস?’
‘ওহ। তুমি রতন কাকু? দিঘিরপাড় যাইতাছি। যাবা না-কি?’
‘না। সদরে কিছু কাম আছে। দুইদিন লাগবো।’
‘জমি-জমা নিয়া?’ তমিজউদ্দীন জানতে চাইলো।
‘হ।’
‘ও আচ্ছা। যাই তাইলে।’
‘আচ্ছা যা। পরশু সন্ধ্যায় ঘাটে আমুনে।’
জনমানবশূন্য নিস্তব্ধ রাত্রি। তমিজ আবার নৌকার গতি বাড়িয়ে দিলো। পানিতে ছপাৎ
ছপাৎ দাঁড় পড়ছে নিয়মিত বিরতিতে। আকাশে আর মেঘ নেই, ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে আসছে।
হালকা চাঁদের আলো পড়েছে খালের জলে। সেই আলোতেই দেখতে পাচ্ছিলাম সরু একটি জলধারা
এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে উত্তর থেকে দক্ষিণে। আর সেই জলের বুক চিরে তিরতির করে ছুটে
চলেছে আমাদের ছোট তরী। আমি মাঝির সাথে কিছুটা সহজ হবার জন্য তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘তমিজ ভাই, আপনার বাড়ি কোন এলাকায়?’
‘আমার বাড়ি পুরায়। দিঘিরপাড়ের কাছে’।
‘এত রাতে দিঘিরপাড়ে থাকার জায়গা পাবো তো?’
‘আপনারা কয়দিন থাকবেন?’
‘জানি না। ওখান থেকে লঞ্চ বা ট্রলার পেলেই বেরিয়ে পড়বো।’
‘এলাকার লোকজন দিঘিরপাড় হাই স্কুলে আর অন্য কয়েকটা জায়গায় আপনাগো মতন মানুষের
থাকনের ব্যবস্থা করছে।’
‘যাক, ভালই হলো। আপনে আমাদেরকে তেমন একটা জায়গায় পৌঁছে দিয়েন।’
‘আগে দিঘিরপাড়ে যাই, একটা ব্যবস্থা হইয়া যাইবো।’
আমি কিছুটা আশ্বস্ত হলাম এই ভেবে যে দিঘিরপাড়ে গেলে থাকার একটা ব্যবস্থা হয়ে
যাবে। আমি তাকে আরও স্বাভাবিক করতেই জিজ্ঞেস করলাম,
আচ্ছা তমিজ ভাই, আপনে জানেন দিঘিরপাড় থেকে লঞ্চ কিংবা ট্রলার ছাড়ে কি না? আমরা
বরিশাল যাবো।
আমার কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়া কাজে লাগলো। তমিজউদ্দীন কিছুটা সহজ হয়ে এলো। সে
বললো, ‘বরিশাল যায় কি না জানি না, তয় ট্রলার তো ছাড়ে হুনছি।’
তারেক আমাকে বললো, ‘সুরুজ দাদা, চল আমরা কালকেই ট্রলারে উঠে পড়ি।’
‘আগে দিঘিরপাড়ে পৌঁছাই। ওখানকার অবস্থা বুঝে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। আগামীকাল
লঞ্চ-ট্রলার কিছু পেতে হবে তো!’
তমিজউদ্দিন বললো, ‘প্রতিদিন আপনাগো মতন অনেক মানুষ গ্রামে যাওয়ার লাইগ্যা
দিঘিরপাড়ে ছুইটা আসতাছে। ঐখানে পৌঁছাইলে কিছু একটা
পাওয়া যাইবো’
হঠাৎ আমাদের সাথে আসা অন্য দলটির লোকজন জানালো তারা সামনেই নেমে যাবে।
তমিজউদ্দীন আরেকটু এগিয়ে একটা বাজারের কাছাকাছি পৌঁছে নৌকা ভিড়ালো। লোকগুলো খালের মাথায় ব্রিজের নিচে নামলো। দলটি বিদায় নিয়ে
চলে গেলে নৌকায় রয়ে গেলাম শুধু আমরাই। এবার সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসলো। নৌকা এখন আগের
চেয়ে দ্রুত গতিতে চলছে। আমরা বাজারটি ছাড়িয়ে আরও কিছুটা পথ সামনে চলে এসেছি। এখন
গাছপালা কিছুটা হালকা হয়ে এসেছে। একপাশে গাছপালা, অন্যপাশটা ফাঁকা। খালটা এভাবেই
সোজা সামনের দিকে বহুদূর পর্যন্ত চলে গেছে, তারপর আবার গাছপালায় ঢেকে গেলো চারপাশ।
আমরা আরও প্রায় একঘণ্টা একইভাবে চললাম। হঠাৎ
দেখলাম তমিজউদ্দীন গ্রীবা উঁচু করে খালের ডান
পাড়ের দিকে বার বার তাকাচ্ছে। আমি তার
দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে ঘুরলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে দেখলাম খালের পাড়ে গাছপালার
আড়ালে-আবডালে থেমে থেমে একটা আলো জ্বলছে। টর্চের আলো, আর ওটা ঘোরাঘুরি করছে
এদিক-ওদিক। আলোটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে সামনের দিকে। মাঝে মধ্যে খালের উপরেও এসে পড়ছিলো। তমিজউদ্দীন
সতর্ক হলো। খুব নিচু স্বরে বললো,
‘সবাই চুপ থাকেন। কেউ কোন শব্দ কইরেন না।’
আমরা সবাই নিঃশব্দে বসে ছিলাম। নৌকায় তখন পিনপতন নিরবতা। তমিজউদ্দীন নৌকাটাকে
একটা বড় গাছের নিচে ঝোপের আড়ালে নিয়ে থামিয়ে দিলো। এখন খালের দিকে আলো ফেললেও
কিচ্ছু দেখা যাবে না। হঠাৎ তিনটি লোককে দেখা গেলো রাস্তায়। আমাদের দিকেই এগিয়ে
আসছে। লোকগুলো আমাদের অতিক্রম করে করে হেঁটে চলে গেলো। ওরা নিরাপদ দূরত্বে চলে
যাওয়ার পর নৌকাটাকে ঝোপের আড়াল থেকে বের করে আনলো তমিজউদ্দীন।
আমি নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওরা কারা ছিলো, তমিজ ভাই?’
‘ঠিক বোঝা যাইতাছে না। স্বাধীনতার পক্ষের বইলা মনে হয় না।’
‘পাক আর্মিরা এইদিকটায় আসে না কি?’ আমি তমিজউদ্দীনকে জিজ্ঞেস করলাম।
সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, ‘না। এত ভেতরে
মিলিটারী আসে না। পদ্মা নদীতে মাঝে মধ্যে স্পীডবোট নিয়া টহল দেয়।’
‘তাহলে তো দিঘিরপাড়ে আমাদের সাবধান থাকতে হবে, তাই না?’ তারেক আবার জিজ্ঞেস
করলো।
‘অহন পর্যন্ত দিঘিরপাড়ে মিলিটারি আসে নাই। তয় দেশি শকুনগো থেইক্যা সাবধান
থাকতে অইবো।’
‘হুম। আপনে ঠিকই বলেছেন, এরা হলো ঘরের শত্রু বিভীষণ।’
তারেকের কথা শুনে তমিজউদ্দীন বললো, ‘চিন্তা কইরেন না। দিঘিরপাড়ে আপনাগো
সাহায্য করার জন্য মানুষ আছে।’
আবার নিঃশব্দে এগিয়ে চলছে আমাদের নৌকা। পানিতে দাঁড় পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে আর
পাশের ঝোপঝাড় থেকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে ডেকে চলেছে ঝিঁঝিঁপোকা। পাশ থেকে হাসান জানতে
চাইলো,
‘সুরুজ দাদা, ওগুলো কীসের আওয়াজ?’
তারেক উত্তর দিলো, ‘আরে বোকা, ওগুলো ঝিঁঝিঁপোকার ডাক।’
‘তাই! ঝিঁঝিঁপোকার কথা অনেক শুনেছি কিন্তু কাছ থেকে ওদের ডাক এই প্রথম
শুনলাম।’ তানিয়া অবাক হয়ে বললো।
মাথার উপর এদিক-ওদিক উড়ে বেড়াচ্ছে অসংখ্য জোনাকি। থেকে থেকে আলো ছড়াচ্ছে। তুলি
বলে উঠলো,
‘দ্যাখ, কী সুন্দর! জোনাকিগুলোকে দ্যাখ। দারুণ না?’
‘হুম’। ছোট্ট করে উত্তর দেয় তানিয়া।
‘ওগুলো ধরা যায় না, তানিপু?’ সুমী জানতে চাইলো।
‘তুই চেষ্টা করে দেখ’। তানিয়া হেসে বললো।
‘যাহ!’ সুমী লজ্জা পেয়ে বাবার কোলে মুখ লুকালো।
মতিন হাসতে হাসতেই বললো, ‘আমাদের সুমী বুড়ি লজ্জা পাইছে। থাক ওকে আর কিছু বলিস
না।’
ছেলেমেয়েদের হাসি-ঠাট্টা আর হালকা রসিকতায় সময়টা কেটে যাচ্ছে। তবে কেউ উচ্চ
স্বরে কথা বলছে না। আমাদের নৌকা মাকাহাটি-কেওয়ার-পুরা ছাড়িয়ে অবশেষে দিঘিরপাড়ে
পৌঁছালো। তখন রাত সোয়া ন’টা। তমিজউদ্দীন আমাদের নৌকায় বসিয়ে উপরে উঠে গেলো। বিশ-পঁচিশ
মিনিট পর আরও দু’জন লোক সাথে করে ফিরে এসে বললো,
‘স্কুলে জায়গা নাই। বাজারে একটা হোটেল আর সেলুন খালি কইরা আপনাগো থাকনের
ব্যবস্থা করা হইতাছে।’
আমরা নৌকা থেকে নেমে গেলাম। বিদায় বেলায় তমিজউদ্দীনের মুখে তৃপ্তির হাসি
দেখলাম। সেই হাসির একটা অর্থ ছিলো; যেন সে একটা বড় কাজ সফলভাবে শেষ করতে পেরেছে।
শুরুতে লোকটিকে ভুল বোঝার জন্য আমি মনে মনে লজ্জিত হলাম। আমি তার দিকে তাকিয়ে
বললাম, ‘অনেক কষ্ট করছেন ভাই’।
তমিজউদ্দীন আমাকে থামিয়ে দিয়েই বলে উঠলো, ‘না ভাই, এটা তো এখন আমগো দায়িত্ব।
এই ছোট ছোট বাচ্চাগুলা আর মহিলাগোরে নিয়া আপনারা কতদূর যাইবেন!’
আমাদের এগিয়ে নেয়ার জন্য তমিজউদ্দীনের সাথে যে লোক দু’জন এসেছিলো, আমরা তাদের
পেছন পেছন চলছি। নৌকা থেকে নেমে বেশিদূর হাঁটতে হয়নি। দশ মিনিটের মধ্যেই বাজারে
পৌঁছে গেলাম। লোক দু’জন আমাদেরকে সেলুনের সামনে নিয়ে গেলো। পাশেই হোটেলটা। সেলুনের চেয়ারগুলো রাখা হয়েছে পাশের একটি দোকানে। মেঝেতে ঝাট দিয়ে আমাদের থাকার উপযোগী করে দিয়েছে সেলুনের
মালিক। এখন রাত দশটা। বাজারটা ফাঁকা। বেশির ভাগ মানুষই বাড়ি ফিরে গেছে। দু-চারজন
যারা বাজারে উপস্থিত, তারাও বাড়িতে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। সেলুন মালিকের নাম রমেশ শীল। সে বললো, ‘আপনারা ভয় পাইয়েন না, পেছনের চালের আড়তেও একদল মানুষ
আশ্রয় নিছে।’
রমেশের কথা শেষ হতেই একজন ভদ্রলোক এসে হাজির হলো। তার পেছনে টর্চ হাতে আরেকজন।
নৌকা থেকে আমাদেরকে যারা এগিয়ে নিয়ে এসেছিলো তাদেরই একজন ভদ্রলোকের পরিচয় দিলো।
‘উনি সাইফুল ইসলাম ভাই। আপনাদের
সবকিছু ঠিক আছে কি না দেখতে আসছেন’।
আমি ভদ্রলোকের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম। তিনি নরম স্বরে বললেন- ‘আজ সারাদিনে অনেক লোক আসছে এইখানে, তাই স্কুলে
আপনাগো জন্যে জায়গা করতে পারলাম না। রাতটা একটু কষ্ট কইরা পার করতে হইবো।’
আমি বললাম, ‘কোন সমস্যা হবে না ভাই। রাতটা নিরাপদে
কাটিয়ে দিতে পারলেই আমরা খুশি’।
সাইফুল ইসলাম জানতে চাইলো আমাদের খাওয়া হয়েছে কি না।
এত রাতে আমরা কাউকে আর খাওয়ানোর ঝামেলা দিতে চাইলাম না। তাই হেসে বললাম, ‘আমাদের খাওয়া হয়েছে।’
ঠিক আছে। রাত অনেক হয়েছে, আপনারা সবাই মনে হয় ক্লান্ত। এখন বিশ্রাম নেন।
আমি জানতে চাইলাম দিঘিরপাড় থেকে বরিশাল যাওয়ার জন্য লঞ্চ কিংবা ট্রলার পাবো কি
না।
আপনারা বরিশাল যাবেন?
‘হ্যা, বরিশাল পর্যন্ত যেতে না পারলেও কাছাকাছি কোথাও পৌঁছাতে পারলেও চলবে।’
‘প্রতিদিনই এই ঘাট থেইক্যা বড় ট্রলার ছাড়ে, তবে
বরিশাল যায় কি না জানি না। আজ রাতটা যাক, কাল দেখা যাইবো কি
ব্যবস্থা করা যায়।’
সাইফুল ইসলামের কথায় কিছুটা ভরসা পেলাম। আমরা নৌকায় বসেই মুন্সীরহাট বাজার
থেকে কেনা পাউরুটি আর কলা খেয়ে নিয়েছিলাম। এখন কারো আর খাওয়ার ইচ্ছে নেই। হোটেলের
চেয়ারগুলো একপাশে সরিয়ে রাখায় যথেষ্ট জায়গা পাওয়া গেলো। বয়স্ক আর বাচ্চাদের হোটেলে
থাকার ব্যবস্থা করে আমরা সেলুনে রাত কাটাতে চলে গেলাম। তবে সেলুনের এই ছোট্ট বদ্ধ
ঘরে ঘুমানো সত্যিই কষ্টকর। বড়মামী ব্যাগ থেকে বড় একটা চাদর বের করে দিলেন। সেটা
বিছিয়েই শোয়ার ব্যবস্থা করা হলো।
ছোটমামাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে। আমি
জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি হয়েছে তোমার?’
মামা বললো, ‘ভাবছি ট্রলার বরিশাল পর্যন্ত যেতে রাজি হবে তো?’
‘বরিশাল না হলেও কাছাকাছি কোথাও যেতে পারলেও একটা ব্যবস্থা করা যাবে।’
আমার কথার পিঠে চন্দন বললো, ‘নদীপথে বরিশালের কাছাকাছি মুলাদীর কোন জায়গা হতে
পারে।
আসাদ ভাই বললো, মুলাদীর ছবিপুরে যেতে পারলেও হবে। ওখান থেকে বরিশাল যাওয়ার
নৌকা বা ট্রলার পাওয়া সহজ হবে।
চন্দন আবারও বললো, ‘ওখানে পৌঁছানোর পরও তো ঝামেলা কম না। দিঘিরপার থেকে পদ্মা-মেঘনা পাড়ি দিয়ে ছবিপুর যাবার পরও রয়েছে আড়িয়াল খাঁ। ও তো
সাপের মত পেচিয়ে ধরে আছে মুলাদীকে। দোয়ারিকা
ঘাটের দিকে গেলেও আছে সুগন্ধা নদী। সামনের
অনেকটা পথ হেঁটে যেতে হবে। সমস্যা হচ্ছে বাচ্চারা আর বয়স্করা আর কতটা কষ্ট সহ্য
করতে পারবে। বাড়তি কিছু খাবারও সাথে রাখতে হবে’।
আমি চন্দনের কথা ফেলে দিতে পারছি না, তবে আমার মনে হলো এত চিন্তার কিছু নেই।
নদীপথে গেলে বরং হাঁটার কষ্ট থেকে রেহাই পাবে সবাই। আমার কাছে মনে হচ্ছিলো
সমস্যাটা অন্য জায়গায়। বয়স্কদের স্বাস্থ্যগত অবস্থা। আমি সবার উদ্দেশ্যে বললাম,
‘বড়মামা হঠাৎ কেমন যেন ভেঙে পড়েছেন, দেখেছো সবাই? মেজচাচার স্বাস্থ্যও খুব একটা
ভাল নেই। বাবা এখনও ভাল আছেন তবে তাঁরও তো বয়স হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে দীর্ঘ পথের এই
ঝক্কি তাঁরা আর কতটুকু নিতে পারবে। তাছাড়া
দাদী তো আছেনই, আমি ভাবছি কখন আবার তাঁকেও কাঁধে নিতে হয়।’
আসাদ ভাই আমার কাঁধে হাত রেখে বললো, ‘সুরুজ এত চিন্তা করো না। আমরা এতগুলা ইয়াং লোক থাকতে ওনাদেরকে কোন ঝামেলা দেয়ার
দরকার কি! দেখো, সবাই মিলে ঠিকই সামলে নেবো।’
বাকীরা সবাই আসাদ ভাইয়ের সাথে একমত হলো। আমার কিছুটা দুশ্চিন্তা কমলো। সারাদিনের
পরিশ্রমে প্রত্যেকেই বেশ ক্লান্ত। হাসান আর সুমন ঘুমিয়ে পড়েছে আর নুরুল ফুপা
দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছেন। সেলুনের
ভেতরে যে যেমন করে পারলো এলোমেলোভাবে শুয়ে পড়লো। দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে সেলুনের বেড়ার সাথে হেলান দিয়ে বসে রইলাম আমি
আর চন্দন। পাশাপাশি বসে নিচুস্বরে আলাপ
করছিলাম। শেষরাতের দিকে চোখদুটো বুজে আসলো আমার। একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম।
পর্বঃ ১৫
৭ই এপ্রিল, ১৯৭১
ঘুম ভাঙলো সকাল সাতটায়। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি চন্দন বসে আছে শিয়রের কাছে। ও
বললো, ‘এখন সেলুন খুলবে, আমাদের বাইরে যেতে হবে। তোকে ডাকছে।’
বাইরে বেরিয়ে দেখি রমেশ দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এলো।
‘সেলুনটা খুলতে হইবো। সাইফুল ভাই আপনাদের স্কুলে যাইতে কইছে। ও আপনাগো স্কুলে
নিয়া যাইবো’ পাশে দাঁড়ানো একটি ছেলেকে দেখিয়ে বললো রমেশ।
ইতিমধ্যে হোটেলটাও খুলেছে। বড়মামা, বাবা, মেজচাচাকে দেখলাম হোটেলের সামনে
দাঁড়িয়ে। আমি মাকে বললাম বাচ্চাদের ঘুম থেকে তুলতে। ওদের তুলে নিয়ে সবাই বাইরে চলে এলো। বাচ্চাদের ঘুম তখনও কাটেনি, বড়দের পেছন
পেছন ওরা চোখ মুছতে মুছতে আসছিলো। ছোটচাচা
দাদাকে কাঁধে তুলে নিতে গেলে চন্দন বললো, ‘কাকা, এইবার আমার কাছে দেন।’
স্কুলে পৌঁছে দেখলাম সাইফুল ইসলাম মাঠে দাঁড়িয়ে আছে। সে এবং তার বয়সী আরও কয়েকজন মিলে এই দুর্যোগে
আশ্রয়ের সন্ধানে আসা লোকজনের থাকা-খাওয়া ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধাগুলো তদারকি করছে।
আমাদের দেখে বললো, ‘আপনারা খাবার খাইয়া লন। খাওয়া শেষ হইলে ঘাটের দিকে যামুনে।
দেখি কোন ট্রলার পাওয়া যায় কি না।’
খিচুড়ি আর বেগুনভাজা। সবাইকে পেটপুরে খেয়ে নিতে বললাম। কারণ, দুপুরের আগে
ট্রলারে উঠলে আবার কখন খাওয়া হবে জানি না। দ্রুত খাবার খেয়ে আমি, আসাদ ভাই আর সফিক
ভাই সাইফুল ইসলামের সাথে ট্রলারঘাটের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম।
ঘাটে তখন অনেক মানুষ। সবাই ট্রলার কিংবা নৌকার
অপেক্ষায় সেখানে জড়ো হয়েছে। এদের মধ্যে বেশির ভাগই পদ্মার ও-পাড়ে ফরিদপুর জেলার
বিভিন্ন এলাকায় যাবে। ঐ রুটে গেলে আমাদের অনেকটা পথ হাঁটতে হবে। তাই আমরা
চাচ্ছিলাম ট্রলারে বরিশালের যতটা কাছাকাছি যাওয়া যায়। ঘাটে এ মুহূর্তে কোন ট্রলার নেই, সকালেই সব ছেড়ে গেছে। তবে দুপুরের পর ফিরে
আসার সম্ভাবনা আছে। অগত্যা দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকলো না।
সাইফুল ইসলাম বললো, ‘আপনারা স্কুলে চলে যান। আমি ঘাটে বইলা রাখতাছি। দুপুরের
দিকে ঘাটে চইলা আইসেন। ঘাটে ট্রলার আসলে আপনাদের যাওনের ব্যবস্থা হইয়া যাইবো।’
কাল রাতে জায়গা সংকুলান না হলেও আশ্রয় গ্রহণকারী অনেকেই চলে গেছে তাদের
গন্তব্যের পথে। তাই স্কুলের কয়েকটি রুম আজ সকালেই খালি হয়েছে। তারই একটাতে আশ্রয় নিলাম আমরা।
দাদা-দাদী, মেজচাচী আর ফুপু ঘুমিয়ে পড়েছে। মা ও ছোটচাচী চোখ বন্ধ করে বসে আছে দেয়ালে
হেলান দিয়ে। গতকাল রাতে তারা ঘুমাতে পারেনি।
রুমের এক কর্ণারে দেয়ালের দিকে ঘুরে আনুকে দুধ খাওয়াচ্ছে রানু, আর ছোটমামী পাশে
বসে নিচু স্বরে ওর সাথে কথা বলছে। তারেক আর মতিন বেঞ্চে বসে বসে ঢুলছে। আমি তারেককে ডেকে ওকে সাথে নিয়ে আবার বাইরে বের হলাম।
উদ্দেশ্য আশেপাশের পরিস্থিতি যাচাই করা আর সেইসাথে বাজার থেকে কিছু খাবারের
ব্যবস্থা করা। এখানে কে কি দেবে তার আশায় থেকে লাভ নেই।
বাজারে শুকনো খাবার ছাড়া আর কিছুই পাওয়া গেলো না। কেবল একটি মিষ্টির দোকান ছাড়া। ওখান
থেকেই কিছু মিষ্টি আর কয়েক হাড়ি দই কিনলাম। আমাদের
কাছে আগে থেকেই চিড়া-মুড়ি আর গুড় আছে। আরেকবার ঘাটের দিকে গেলাম। আসাদ ভাই আর সফিক
ভাইকে ঘাটেই দেখলাম। সিগারেট ফুঁকছে। কিছু মানুষ নৌকায় করে বড় নদীর দিকে যাচ্ছে। এরা হয়তো পদ্মা পাড় হয়ে ওপারের জেলাগুলোতে যাবে। ঘাটে কোন
ট্রলার চোখে পড়লো না। বাজারে কয়েকজন লোকের সাথে আলাপ করলাম। ওরা জানালো এখানে এখনও
মিলিটারী আসেনি, তবে বড় নদীতে স্পীডবোট নিয়ে ঘোরাফেরা করে। বুঝলাম নৌকার মাঝি
তমিজউদ্দীন ঠিকই বলেছিলো। এক দিক থেকে নিশ্চিন্ত হলাম। এখানে পাক আর্মি থেকে আপাতত
কোন ভয় নেই। তাই বলে চোখ বন্ধ করে বসে থাকলে হবে না, এখন নেই বলে যে আসবে না তার
কোন গ্যারান্টি নেই। যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে সরে পড়তে হবে। পদ্মা পার হয়ে আরও দক্ষিণে। আমাদের গন্তব্য ওদিকেই।
বেলা আড়াইটা। আমরা ট্রলার ঘাটে দাঁড়িয়ে আছি। ঘাটে একটা বড় ট্রলার আর তিনটা ছোট
নৌকা ভিড়েছে। নৌকাগুলো পদ্মার ওপারে যাবে। বড়
ট্রলারটির সারেঙের সাথে আমাদের বিষয়ে কথা বলছে সাইফুল। বরিশাল যাবো শুনেই সারেঙ
সোজা না করে দিলো। আমাদের অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও সারেঙ কোনভাবেই অতদূরে যেতে রাজি
হচ্ছিলো না। আমি সারেঙকে বললাম, ‘ঠিক আছে, বরিশাল না যান, কাছাকাছি কোন ঘাট
পর্যন্ত আমাদেরকে পৌঁছে দেন।’ অবশেষে ছবিপুর পর্যন্ত যেতে রাজি হলো। আমরাও হাঁফ
ছেড়ে বাঁচলাম।
গোসল এবং খাওয়ার জন্য সারেঙ আমাদের থেকে একঘণ্ট সময় নিলো। আমরা স্কুলের দিকে
ফিরে চললাম। সবাইকে নিয়ে সময়মত ঘাটে চলে আসতে হবে।
নির্ধারিত সময়ের আগেই আমরা ঘাটে পৌঁছে গেলাম। ট্রলারটি বেশ বড়। পঞ্চাশ-ষাটজন
মানুষ অনায়াসে ধরবে। আমরা ছত্রিশজন আর দিঘিরপাড় থেকে তিনজন আমাদের সাথে যোগ দিলো।
সারেঙ ও তার লোকজনসহ এ মুহূর্তে ট্রলারে সর্বমোট বিয়াল্লিশ জন। বিকাল সাড়ে তিনটায়
দিঘিরপাড় থেকে আমরা যাত্রা শুরু করলাম।
পরিষ্কার আবহাওয়া, ফুরফুরে বাতাস বইছিলো। স্থির জলে ট্রলার নিয়ে আমাদের যাত্রা
শুরু হলো ছবিপুরের উদ্দেশ্যে। ট্রলারের
পেছন দিকের অংশে ছোট্ট একটা কেবিন ছিলো। সেখানে বয়স্ক লোকজন আর মহিলাদের বসার
ব্যবস্থা করলাম।
আমাদের সারেঙের নাম ফজর আলী আর তার দুই সাগরেদের একজনের নাম কাউসার আর
অন্যজনের নাম মানিক। ফজর আলীর বয়স চল্লিশের মত। লম্বায় প্রায় ছ’ফুটের কাছাকাছি। পেশবহুল, মেদহীন শরীরই বলে দেয় সে একজন কঠোর
পরিশ্রমী মানুষ। তার কথাবার্তাও মনে হলো বড় নদীতে নৌ-চালনায় সে বেশ অভিজ্ঞ।
ইঞ্জিনের ভটভট শব্দ ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই। ছোটনদী দিয়ে অল্পকিছুদূর এগিয়েই আমাদের ট্রলার পদ্মায় পড়লো।
এটি মূল পদ্মা নয়, পদ্মার শাখা নদী। এ-নদীর দু’পাড়েই তীরঘেষে কিছুটা জায়গায় ভেজা বালু, তারপর একটু উপরে উঠলে পুরো এলাকাটি নানা রঙের ছোট ছোট ঘাস আর গুল্মলতায় ছাওয়া। যেনো প্রকৃতি সবুজ গালিচা বিছিয়ে রেখেছে। সেই গালিচার উপর সুর্যের আলো পড়তেই আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ছেলেমেয়েরা এই দৃশ্য দেখে ভীষণ উৎফুল্ল।
‘এত কষ্টের মধ্যেও একটা চমৎকার নৌভ্রমণ হয়ে গেলো’। তারেকের দিকে তাকিয়ে বললো মতিন।
তারেকও মতিনের কথায় সায় জানালো।
‘দারুণ! আমি কখনও এতো সুন্দর দৃশ্য দেখিনি’ তুলি বললো।
‘মতিন ভাইয়া, ওগুলো কি পাখি?’ মামুন জানতে চাইলো।
‘ওগুলো বক।’
‘তাই? দেখো কত বক!’
‘নদীর চরেই বেশি বক দেখা যায়’
মতিন জিজ্ঞেস করলো, ‘আমরা এখন কোনদিক দিয়ে যাচ্ছি?’
‘আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঘনায় পড়তে যাচ্ছি।’ আসাদ ভাই
বললো।
‘আমাদের বোট পদ্মায় পড়বে না?’ হাসান জানতে চাইলো।
‘পড়বে। আরও সামনে গিয়ে। আমাদের ট্রলার এখন মেঘনার যে
ধারাটিতে পড়তে যাচ্ছে সেটি আরও দক্ষিণে গিয়ে মূল পদ্মার সাথে মিশে মেঘনা নাম নিয়েই
ছুটে গেছে বঙ্গোপসাগরের দিকে।’
‘চাঁদপুর কি ওখানেই?’ মতিন আবার জানতে চাইলো।
‘হুম। পদ্মা মেঘনা যেখানে মিশেছে তার ঠিক পূর্ব দিকেই
চাঁদপুর।’
আমি মনে মনে হাসছিলাম। আসাদ ভাই চমৎকারভাবে ছেলেমেয়েদের
কৌতুহল মেটাচ্ছেন।
আমাদের ট্রলার এখন মেঘনায় পড়লো। চারিদিকে কোন নৌকা বা অন্য
কোন ট্রলার চোখে পড়ছে না। আমরা এগিয়ে চললাম পদ্মা-মেঘনা মূল ধারার দিকে। দুপাশে বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে শুধু ধু-ধু বালুচর।
অনেকদূরে সবুজ গাছপালা দেখা যাচ্ছে, হয়তো সেখানে মানুষের বসতি রয়েছে। এখন নদীতে
তেমন স্রোত নেই, তাই বেশ নির্বিঘ্নেই এগিয়ে চলেছে আমাদের ট্রলার। পদ্মা-মেঘনার
মোহনা আর বেশি দূরে নয়, বড়জোর আর মিনিট দশেক লাগবে। এমন সময় একটি বোট চলার শব্দ ভেসে আসলো।
মাঝি সতর্ক হলো। সে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে কোন নিরাপদ জায়গা খুঁজছে। আমি
তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘ফজর আলী ভাই, কোন সমস্যা?’
‘মনে হয় গানবোট নিয়া মিলিটারী টহল দিতাছে। অহনই আমাদের নদী
থেইক্যা সইরা পড়তে হইবো।’ তাকে খুব চিন্তিত দেখালো।
সে ট্রলারের গতি বাড়িয়ে দিলো। ট্রলার এ মুহূর্তে ডানদিকের
তীরঘেষে এগিয়ে যাচ্ছে। দু মিনিট পরই দেখতে পেলাম নদী থেকে একটি সরু খাল ডানদিকে
ঢুকে গেছে। আমাদের নৌকা সে খালের মধ্যেই ঢুকে পড়লো। খালে একটি বাঁক নিয়েই ফজর আলী
ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলো। নৌকাটিকে কোনরকম নোঙর করে সে ও তার লোকজন তীরে উঠে দৌড়ে
পালালো। আমি আসাদ ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ব্যাপার, ওরা পালাচ্ছে কেন?’ আসাদ ভাই বললো, ‘ওরা ভয়ে পালাচ্ছে। আর্মিদের ভয়ে।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের কাছাকাছি বোটের শব্দ শুনতে পেলাম। আমরা সবাই মাথা নিচু করে বসে রইলাম, ওটা যতক্ষণ পর্যন্ত শোনা যাচ্ছিলো। শব্দটা কিছুটা দূরে চলে যেতেই উঠে দাঁড়ালাম। দেখলাম দূরে একটি গানবোট মেঘনা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে, আমাদের পেছন দিকে। আমরা অপেক্ষা করছিলাম ওরা বিপদসীমার বাইরে চলে যাওয়া অবধি। গানবোটটি এখন মেঘনা দিয়ে গজারিয়ার দিকে যাচ্ছে। আমরা ঘাসে ঢাকা তীরের এদিক ওদিকে তাকালাম। আসাদ ভাই আমার থেকে লম্বা। সে চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে বললো কাউকে দেখা যাচ্ছে না। প্রায় বিশ মিনিট কেটে গেছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম উপরে উঠবো।
আমি, আসাদ ভাই আর ছোটমামা উপরে উঠলাম। এদিক-ওদিক বেশ কিছুক্ষণ খোঁজার পর তাদের পাওয়া গেলো। ধানক্ষেতের পাশে বসে বিড়ি ফুঁকছে।
আমি কাছে গিয়ে বললাম, ‘কী ব্যাপার, আপনারা এখনও এখানে কেন?’
ফজর আলী কোন কথা বলছে না। বসে বসে বিড়ি টানছে, যেন কিছু শুনতেই
পায়নি।
আমি আবার বললাম, ‘কী হলো? চলেন, এমনিতেই অনেক দেরী হয়ে গেছে। আর্মিরা চলে গেছে।’
‘নৌকা আর যাইবো না। দিঘিরপাড়ে ফিরা যাইবো, আপনারা অন্য ব্যবস্থা কইরা নিয়েন।’ নির্বিকারভাবে উত্তর দিলো ফজর আলী।
‘মানে! এতদূর এসে ফিরে যাবো?’ আমি তাকে প্রশ্ন
করলাম।
ফজর আলী বেশ বিরক্ত। সে বললো, ‘দ্যাখতাছেন না, মিলিটারী ক্যামনে টহল দিতাছে! এর মধ্য যাইয়া মরুম না কি?’
ফজর আলীকে অনেক বোঝানো হলো কিন্তু সে তার সিদ্ধান্তে অনড়। তারা আর সামনে যাবে না। আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবে দিঘিরপাড়ে। আসাদ ভাই এমনিতে খুব হাসিখুশি মানুষ। তাকে দেখে বা তার সাথে কথা বলে বোঝার উপায় নেই এই লোক ক্ষেপলে তাকে সামলানো মুসকিল। পুলিশি মেজাজ তো! এবার আসাদ ভাই ক্ষেপে গেলো। রেগেমেগে বললো, ‘তাইলে আপনে যাইবেন না?’
ফজর আলীও ততোধিক চড়া গলায় উত্তর দিলো, ‘এত কথা বইল্যা কোন লাভ নাই। যামু না কইছি, যামু না। আপনারা অন্য ব্যবস্থা করে নেন।’
আসাদ ভাই আমাদের বললো, ‘চলো। দেখি, ও ক্যামনে না যায়’। সে আমাদের নিয়ে খালের দিকে ফিরে চললো। আসাদ ভাই খুব দ্রুত হেঁটে এসে ট্রলারে উঠলো। তার পিছে পিছে আমরাও আসলাম। আমরা ট্রলারে উঠে বসতেই আসাদ ভাই ইঞ্জিন চালু করে দিলো। ফজর আলী ও তার লোকজন তখনও ট্রলার থেকে বেশ দূরে। আসাদ ভাই কোনদিকে না তাকিয়ে ট্রলার নিয়ে খালের বাইরে চলে এলো। ট্রলার চলে যাচ্ছে দেখে এতক্ষণে ফজর আলীর টনক নড়লো। সে আর তার লোকজন চিৎকার করে আমাদের থামতে বলছে কিন্তু আসাদ ভাই তাদের দিকে না তাকিয়ে ট্রলারটিকে মোহনার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
আমি বললাম, ‘থাক, এবার ওদের আসতে দেন।’
আসাদ ভাই মৃদু হেসে বললো, ‘দাড়াও, আরেকটু খেলিয়ে নেই। ব্যাটারা, ঘুঘু দ্যখছো ঘুঘুর ফাঁদ তো দ্যাখোনি!’
নদীর তীর ধরে ফজর আলী ও তার লোকজন দৌড়ে আসছে আর বলছে, ‘ভাই খাড়ান, আপনাগো নিয়া যামু। নৌকা থামান।’
আসাদ ভাই ট্রলার পুরোপুরি থামালো না, তবে কিছুটা স্লো করলো। ওদের সাথে ট্রলারের দূরত্ব ধীরে ধীরে কমছে। আসাদ ভাই হাসতে হাসতেই বললো, ‘এইবার বুঝছো? ঠেলার নাম বাবাজি’। দিঘিরপাড় থেকে যে তিনজন আমাদের সাথে এসেছে তারা এতক্ষণে বুঝতে পারলো আসল ঘটনাটা কী। তাদেরই একজন বললো, ‘আমিও চালাইতে পারি। ওরা ঝামেলা করলে আমিও আপনার সাথে আছি’।
ফজর আলী ও তার লোকজন এতক্ষণে আমাদের কাছে চলে এসেছে। কিন্তু ট্রলারটি তীর থেকে কিছুটা দূরে থাকায় তারা উঠতে পারছে না। আসাদ ভাই মিটিমিটি হাসছে।
ফজর আলী চিৎকার করে বললো, ‘ভাই নৌকা থামান, আমগো উঠতে দেন’।
আসাদ ভাই এবার তাদের দিকে ফিরলো। খুব গম্ভীরভাবে বললো, ‘কী? এবার যাবে?’
‘হ ভাই। যামু যামু। আপনারা যা কইবেন তাই করুম’ হাঁপাতে হাঁপাতে বললো সে।
আসাদ ভাই এবার ট্রলারটিকে তীরের কাছে নিয়ে আসলো। ফজর আলী তার লোকজন নিয়ে উঠে এলে তার হাতে হাল ধরিয়ে দিয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। ফিসফিস করে বললো, ‘দেইখো, এখন থেকে ও তোতাপাখির মত কাজ করবে’। আমরা কেউ ফজর আলীকে আর কিছু বললাম না। সে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে এলো।
সাফিক ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে বললো, ‘উনি তো সাংঘাতিক লোক! নিজেই ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে মেঘনা পার হইতে চাইছিলো!’
আমি হেসে বললাম, ‘শোনেন, ট্রলার নিয়ে ধাওয়া করে ডাকাত ধরার অনেক রেকর্ড আছে ওনার। আপনারা না এলে আমরা তো এই ট্রলার নিয়ে বরিশাল পর্যন্ত চলে যেতাম।’
ফজর আলীর মুখ কালো হয়ে গেলো। ‘উনি কী পুলিশে চাকরী করেন?’
‘হুম।’
পর্বঃ ১৬
কূল নাই কিনার নাই
মতিন আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘সুরুজ দাদা, আমরা প্রতিবার লঞ্চে করে এই নদী দিয়েই বরিশাল যাই?’
আমি বললাম, ‘হুম। লঞ্চে রাতে যাওয়া হয় তো, তাই মেঘনার এই রূপ দেখতে পাস না।’
হাসান পাশে এসে বললো, ‘ইস! দিনে লঞ্চ থাকলে কী ভাল হতো! এই দৃশ্যগুলো দেখতে দেখতে বাড়ি যেতে পারতাম।’
‘কিছুদিন অপেক্ষা কর। আমি যখন লঞ্চ চালু করবো তখন তোর কথা চিন্তা করে হলেও দিনে সার্ভিস রাখবো।’ মতিন হাসানের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।
হাসান মুখ ভেঙচালো। ‘এহ! মতি ভাই, তুমি বানাবে লঞ্চ? সেই লঞ্চ নদীতে ভাসবে?’
‘হুম। তুই চাইলে তোকে আমার ম্যানেজার বানাতে পারি।’
‘থাক। তোমার ম্যানেজার হতে হবে না আমায়।’
তুলি ফিক করে হেসে ফেললো। ‘এটা চাপাবাজ মতির কত নম্বর চাপা?’
‘মতি চাপা মারে না’। অন্যদিকে ফিরে গম্ভীর মুখে বললো মতিন।
‘হুম, তা তো দেখতেই পাচ্ছি’। হাসতে হাসতে
অন্যদিকে চলে গেলো তুলি।
ওদের খুনসুটি দেখে হাসছিলো আসাদ ভাই। বিশাল জলরাশির বুক চিরে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। আমাদের দু’পাশে মাঝে মধ্যেই দেখা মিলছে পানকৌড়ির। পানিতে ডুব দিচ্ছে আবার উঠছে। ছোট ছোট ঢেউগুলোর সাথে দোল খেতে খেতে ছুটে চলেছে আমাদের ট্রলার। শেষ বিকেলের সোনালী আলোয় ঝলমল করছিলো নদীর পানি।
আমি মনে মনে ভাবছিয়াম দীর্ঘ এই পথযাত্রায় এরকম অসাধারণ মুহূর্তগুলো মনকে চাঙ্গা
করে দেয়। এভাবেই প্রায় আধাঘণ্টা ধরে চলছি।
পদ্মা-মেঘনার
মোহনা থেকে অনেকদূর চলে এসেছি। ঠাণ্ডা বাতাস এসে গায় লাগছে। সন্ধ্যা হতে এখনও অনেক বাকী আছে কিন্তু দিনের
আলো ক্রমশ কমে আসছিলো। আমি মনে মনে ভাবছিলাম এত তাড়াতাড়ি অন্ধকার এলো!
ছবিপুর পৌঁছাতে কতক্ষণ লাগবে
কে জানে! অচেনা জায়গা, থাকার
জন্য আশ্রয় খুঁজে পাওয়া
যাবে তো!
প্রচন্ড স্রোত
ঠেলে উজানে ছুটে যাচ্ছে ট্রলার। হঠাতই
যেন ওটা দুলতে শুরু
করলো। কেবিনের ভেতর
থেকে মেজচাচা মাথা বের করে জিজ্ঞেস
করলো, ‘কোন সমস্যা?’ আসাদ ভাই বললো, ‘না ফুপা। ঢেউয়ের তোড়ে একটু
দুলছে।’
তবে দুলুনি একটুও কমছিলো
না। ক্রমশ বেড়েই
যাচ্ছিলো। মতিন, হাসান আর সুমন
কেবিনের ছাদে বসেছিলো। ট্রলার
দুলুনির তোড়ে টিকতে না পেরে
ওরা নেমে এলো। মহিলা
ও বাচ্চারা কেবিনের ভেতরে ভয়ে জড়সড়
হয়ে বসে আছে।
‘সুরুজ, মনে হয় ভুলই
করলাম। কালবৈশাখী আসতাছে। ঐ দ্যাখো।’ বলে শফিক ভাই আমাকে
পেছন দিকে ইশারা করলো।
আমি সেদিকে ঘুরেই হাঁ হয়ে দাঁড়িয়ে
রইলাম। আমাদের পেছনে
মেঘনার দু’পাশের চরেই ঝুলিঝড়
শুরু হয়ে গেছে। পুরো
চরাঞ্চল জুড়েই ধূসর ধোয়া
উপরে উঠে ছড়িয়ে পড়ছে
আকাশে। একটা ধোয়ার
দেয়াল ছাড়া পেছনের আর কিছুই
দেখা যাচ্ছে না। চরের
হালকা ছাইরঙা ধুলা আর বালু
পেছনের পুরো এলাকাটিকে দাবানলের
মত গ্রাস করে নিচ্ছে।
আসাদ ভাই আমাকে বললো, ‘পানির
রঙ দ্যাখো, কালচে, অনেকটা লোহার
মত’।
‘মানে?’
‘মেঘনা
এইখানে সবচেয়ে প্রশস্ত। এখানকার
পানি হবে সবুজ এবং স্ফটিক
স্বচ্ছ। কিন্তু এই কালচে
পানির রঙ ঝড়ের ইঙ্গিত
দেয়’। তাই তো! বৈশাখের
দোরগোড়ায় এসে চৈত্র যাই যাই করছে। এখন তো কালবৈশাখী ধেয়ে
আসারই কথা।
আমি ফজর আলীকে জিজ্ঞেস
করলাম, ‘ফজর আলী ভাই, ঝড় উঠবে
না-কি?
ফজর আলী চিন্তিত মুখে
জবাব দিলো, ‘তাই তো মনে হইতাছে।’
নদীকে যারা জীবিকা হিসেবে
নেয়,
স্বাভাবিকভাবেই সেসব মানুষ নদীর
সব ইশারা বোঝার জন্য
অভিজ্ঞ হয়ে ওঠে। গন্ধ
শুকেই প্রকৃতির বিপদসংকেত বুঝতে
পারে। তাহলে আমাদের
সারেঙ কী কিছুই বুঝতে
পারেনি! মনে তো মনে হয় তেমন
কিছুই টের পায়নি। ফজর আলীর
উপর কিছুটা রাগ হলো। কিন্তু তাকে এখন কিছু
বলা যাবে না, কারণ আমরাই
জোর করে আসতে বাধ্য
করেছি। যাক, এসব ভেবে
এখন কোন লাভ নেই।
আমরা অনেকদূর চলে এসেছি। দিঘিরপাড় থেকে পদ্মা পাড়ি
দিয়ে এই বিশাল মেঘনার
বুকে এতদূরে উজিয়ে আসার
পর ফিরে যাই কী করে? আর যাবোই
বা কোথায়? আমরা এখন মেঘনার
ঠিক মাঝখানে। কোনদিক
যে কাছে হবে বুঝতে
পারছি না। তবে ষষ্ট
ইন্দ্রিয় সতর্কবার্তা দিলো। ভাগ্যের
উপর ছেড়ে দেওয়া চলবে
না। আমাদের সাবধান
হতে হবে। ট্রলারের
দুলুনি আরও বেড়ে গেছে। ট্রলারটা যেন মাতালের মত একবার
ডানদিকে হেলছে তো একবার
বামদিকে। দমকা হাওয়ার
সাথে সাথে ছুটে আসছে বড় বড় ফেনাতোলা ঢেউ, যেন ভয়ঙ্কর দৈত্য
তার ভয়াল দাঁত দেখিয়ে হাসছে। ঢেউগুলো নদীতে আছড়ে পড়ার পর পানি ছিটকে নৌকায় এসে আমাদের ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। অনেকের চোখেই দেখলাম আতঙ্ক ভর করেছে। কেবিনের ভেতরে যারা আছে তাদের শক্ত করে একে অন্যকে
ধরে বসতে বললাম। মেজচাচাকে বললাম সবাইকে ব্যালেন্স
করে বসাতে।
বাতাসের তোড়ে আর ঢেউয়ের দুলুনিতে টিকতে না পেরে আমরা যারা খোলা
জায়গায় ছিলাম তারা ট্রলারের মাঝখানে লম্বালম্বিভাবে রাখা বাঁশটিকে শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে
রইলাম। বিশাল মেঘনার বুকে ঢেউয়ের দোলায় খড়কুটোর
মতো ভাসতে লাগলো আমাদের নৌকা। কেবিনের ভেতর থেকে উচ্চস্বরে দোয়া-দরুদ পড়ার আওয়াজ আসছে। দমকা হাওয়ার ঠেলায় মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিলো ট্রলার
ডুবে যায় যায় অবস্থা। একেকবার ঢেউয়ের
ধাক্কায় ট্রলার উপরে উঠে যায় আবার ধপ করে ঢেউয়ের নিচে তলিয়ে যায়। আমরা সবাই ভিজে একাকার।
শো শো শব্দে কারো কথা ভালমত শোনা যাচ্ছিলো না। আমার নাম ধরে ডাক শুনে কেবিনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম
মা আমাকে ডাকছেন। আমি বাঁশ ধরে ধরে কেবিনের দরজার কাছে
যেতেই উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে মা বললো,
‘বাবা সুরুজ, আমরা বাচমু তো?’
আমি প্রথমে কিছুই বলতে পারলাম না। একটু পরেই মায়ের অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘মা, তুমিই তো আমাকে বিপদে সাহস রাখতে বলেছিলে।’
মা জোরে জোরে বলতে লাগলো, ‘আল্লাহ রক্ষা
করো, রক্ষা করো’।
আমি লক্ষ করলাম যুদ্ধের এই পরিবর্তিত পরিস্থিতি আমার মাকে অনেক
দুর্বল করে দিয়েছে। আমার এই ত্রিশ বছরের জীবনে মাকে এতটা ভেঙে পড়তে দেখিনি, সেই
মায়ের চোখে-মুখে আজ ভয়ের ছাপ দেখলাম। আনুকে কোলের মধ্যে জাপটে ধরে রেখেছেন মা। রানু ভয়ার্ত চোখে বার বার আমার দিকে তাকাচ্ছিলো। দেখলাম মেজচাচী ওকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। এত লোকের
ভিড়ে এ ক’দিনে আমি ওর সাথে ভালো করে কোনো কথাই বলতে পারিনি। ওর পাশে দাঁড়াতে পারলে হয়তো ভরসা পেতো কিন্তু আমার
সে উপায় ছিলো না। দাদা বাবার উদ্দেশ্যে বললো, ‘আবদুল্লাহ কি হইছে? এই রহম দোলাইতেছে ক্যা?’
বাবা বললেন, ‘কিছু হয় নাই। এইতো আমি আপনারে ধইরা আছি।’
বড়মামাকে খুব চিন্তিত লাগছে কিন্তু মুখে কিছুই বলছেন না। ফজর আলী ভাবলেশবিহীন ভাবে হাল ধরে বসে আছে। আমি কেবিনের ছাদের উপর দিয়ে ফজর আলীর দিকে
তাকালাম। সে আমাদেরকে বললো, ‘আপনারা বেশি নড়াচড়া কইরেন না। নৌকার মধ্যেখানে বইসা পড়েন।’
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি অবস্থা মনে হইতেছে?’
‘আল্লাহ ভরসা। ধৈর্য ধরেন আর সবাইকে আল্লাহরে ডাকতে বলেন।’ ফজর আলী সামনের দিকে তাকিয়ে বললো। তার দৃষ্টি ট্রলার ছাড়িয়ে আরও সামনের দিকে।
ওকে নিজের মত ট্রলার চালাতে দিলাম। এতক্ষণ বৃষ্টির পরিমাণ হালকা থাকলেও এখন ঝমঝমিয়ে
নামলো। আমরা যারা কেবিনের বাইরে ছিলাম সবাই
আরও একবার ভিজলাম। মা বার বার আমাদেরকে কেবিনের ভেতরে
ডাকছিলেন। কিন্তু ছোট্ট কেবিনের ভেতরে সবার জায়গা
সংকুলান সম্ভব নয়। আমি কেবিনের দরজার মুখে গেলাম। ভেতরে সবাই উচ্চকণ্ঠে দোয়া ইউনুস পড়ছে। নুরুল ফুপা এক কর্ণারে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে নিচু
স্বরে অনবরত কি যেন বলে যাচ্ছিলেন, ঠিকমত শুনতে পেলাম
না।
ঠক-ঠক-ঠক। পেছনে ঘুরতেই দেখলাম শিল পড়তে শুরু করেছে। ছোট ছোট শিল, এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে
যাচ্ছে। প্রথমে সংখ্যায় কম হলে হঠাতই যেন মুহুর্মুহু
পড়তে শুরু করলো। কিছু কিছু বেশ বড়, এর একটা মাথায় পড়লে আমার দফারফা হয়ে যাবে। এবার আর খোলা জায়গায় থাকাটা নিরাপদ মনে হলো না। আমি, আসাদ ভাই,
ছোটমামা, ছোটচাচা, চন্দন,
তারেক, মতিন ও দিঘিরপাড় থেকে যোগ দেয়া তিনজন কেবিনের
পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে মাথা রক্ষার চেষ্টা করতে লাগলাম। ট্রলারের ফ্লোর বরফে সাদা হয়ে গেছে। চারিদিকে রাশি রাশি বরফখণ্ড ঝপঝপ করে নদীর পানিতে
পড়ছে, যেনো খই ফুটছে। নদীর কালচে পানি এখন পুরোপুরি সাদা। মাঝে মাঝে দু’একটি বরফ ছিটকে এসে কেবিনে ঢুকে পড়ছে।
এভাবে কতক্ষণ কাটলো ঠিক বলতে পারবো না। তবে একসময় শিল পড়া থেমে গেলো। বৃষ্টি আর বাতাসের তেজ কিছুটা কমে এসেছে, তবে থেমে যায়নি পুরোপুরি। আমি অনুভব করলাম আমাদের নৌকা আর সঠিক ডিরেকশনে
নেই। এই নদীর ডানদিক দিয়ে মেঘনার শাখানদীতে
ঢুকে যাবার কথা আমাদের, কিন্তু এ মুহূর্তে আমরা বামদিকের তীরের খুব
কাছ দিয়ে চলছি।
আমি ফজর আলীকে আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমরা কতদূর এলাম?’
‘চানপুরের কাছে।’
‘তাইলে তো আবার এই নদী পার হয়ে ঐ পাড়ে যেতে হবে।’
‘হুম। মেঘনায় নাইমা ঝড়ের লগে তো আর যুদ্ধ করা যাইবো না। বাতাস না কমলে এতবড় নদী পার হওয়া যাইবো না।’
‘তাহলে কী আমরা এখানে অপেক্ষা করবো?’
‘না। অপেক্ষা করুম না, আস্তে আস্তে সামনের দিকে আগাইতাছি। নদী পুরাপুরি শান্ত হইলে পার হমু।’
তারেক জিজ্ঞেস করলো, ‘কতক্ষণ লাগবে?’
ফজর আলী হাসলো। এই প্রথম তাকে হাসতে দেখলাম। ‘ক্যামনে কমু?
দেহি, কতক্ষণে যাওয়া যায়।’
আমি মহিলাদের অবস্থা জানতে কেবিনের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম।
এতক্ষণে ছেলেমেয়েরা কেবিন থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। আমি রানুর দিকে তাকালাম। ওকে
ফ্যাঁকাসে লাগছে। এখনও ওর মন থেকে ভয়টা দূর হয়নি। একহাতে মেজচাচীকে ধরে আমার দিকে
বড় বড় চোখে তাকিয়ে ছিলো। মেজচাচী জিজ্ঞেস করলো, ‘সুরুজ, আবার ঝড় উঠবে না তো?’ আমি
বুঝতে পারলাম রানুকে সান্ত্বনা দিতেই চাচী এই প্রশ্ন করলেন। আমিও ওকে আশ্বস্ত
করতেই বললাম, ‘না। আর ভয় নেই, আমরা এখন নদীর পাড়ে চলে এসেছি।’
উষাও প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে। সেও এখন পর্যন্ত স্বাভাবিক হতে
পারেনি। মা কিছুটা ধমকের সুরেই বললো, ‘তোমরা এ যুগের মাইয়ারা এতো ডরাও ক্যান? মনে
সাহস রাখতে পারো না?’
আমি মৃদু হেসে ওখান থেকে সরে আসলাম। জানি, আমার মা-ই ওদের
মনে সাহস ফিরিয়ে আনার জন্য যথেষ্ট।
চলবে ......
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন