সে এক বরষা রাতে
স্বপনে
একা একা দ্বার
খুলে বেরিয়ে
ঝড়ের বাতাসে দোলা
লাগিয়ে
আমি অচেনার দেশে
চলে এসেছি;
দারুণ বরষা রাতে
স্বপনে...
বিকালটা ক্রমশ ফিকে হয়ে
আসছিলো। খোলা বারান্দায় বসে আকাশে মেঘ আর রোদ্দুরের লুকোচুরিটা বেশ উপভোগ করছিলাম আর সেইসাথে শিল্পী
অজয় চক্রবর্তীর গানের এই কথাগুলো মনে গুনগুন করে বাজছিলো। হঠাৎ কাঁধের উপর কচি হাতের আলতো স্পর্শ পেয়ে বুঝলাম- এ নিশ্চয়ই
ছুটির দিনের আবদার। মনস্থির করলাম আজ কোথাও বেড়াতে যাব। এই
চমৎকার মেঘ-আদুরে বিকেলে আমার একমাত্র রাজকন্যাটিকে নিয়ে
ঘুরে আসবো তার কোন অচীনলোক থেকে।
ঠিক তখনই তুমি বাধ সাধলে। একেবারে বিনা
নোটিশে এসে আমার সবকিছু ভণ্ডুল করে দিলে। এটা কি ঠিক হল?
চারিদিক থেকে যখন অন্ধকার ঘনিয়ে আসলো, তখুনি ঝড়ের বেগে তুমি এলে। ঘন
কালো কেশরগুচ্ছ ছড়িয়ে, প্রবল ঘুর্ণিতে আমায় ভাসিয়ে নিলে। আমার
এই ছোট্ট করিডোরটুকু, যেখানে বসে আমি বর্ণিল মেঘেদের আনাগোনা দেখছিলাম, সবকিছু
এলোমেলো করে দিয়ে বলেছিলে-
চল আমার সাথে।
আমি তোমায় শুধালাম- হে দুরন্ত যৌবনা আমাকে তুমি কোথায় নিয়ে যাবে?
কোথায় আবার! এমন দিনে কি ঘরে থাকা যায়! চল আমার সাথে- দূরে, অন্য
ভূবনে; তোমার অতি চেনা জগতে।
তোমার অপ্রতিরোধ্য উন্মাদনা আমায় কিভাবে জানি
সম্মোহিত করে ফেললো। আমার ভিতরেও এক পাগলামি ভর করলো। কি জানি, হয়তো মুক্তির
আনন্দে। কিংবা আমারও মনে মনে কোথাও ভেসে যেতে ইচ্ছে করছিলো। স্মৃতির ধূসর জগৎ
যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছিলো। পাগলের মত তোমার পিছু নিলাম, আমার ছোট্ট করিডোর ছাড়িয়ে
তোমার সাথে ছুটে চললাম স্বপ্নের বালুকাবেলায়।
ব্যস্ত এই শহরের চেনাজানা
পথঘাট পিছনে ফেলে ছুটে চললাম দূরে- এক অজানার পথে- তোমার সাথে। তুমি
আমায় এ কোথায় নিয়ে এলে? এমন বৃষ্টিজলে একাকার করে দিলে!
আজ তো তোমার ভিজে যাবার দিন! ভাবছ কেন? এমন বরিষায় ভিজতে ইচ্ছে
করে না? মেঘের ভেলায় ভেসে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে না ঐ দিগন্তে?
হুম, করে তো; খুব
ইচ্ছে করে।
আকাশ মেঘের মিতালিতে তোমার সাথে ভেসে যেতে থাকি দূরে, বহুদূরে। এই
শহর ছাড়িয়ে আরও দূরে। ঐ তো বুড়িগঙ্গা। কিন্তু এ কি! এ তো নদী না। শহরবাসী এ-কে
মেরে ফেলেছে গলা টিপে। দেখ-না, কেমন দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে! এখানে তো তোমাকে খুঁজে পাই
না আমি! চল আমরা আরও দূরে যাই।
হ্যা, তাই চল।
এই তো সুবিশাল জলরাশি। হ্যা, এখানে তোমাকে পেয়েছি। কি অপরূপা
তুমি! ইচ্ছে করছে একটু ছুঁয়ে দেই তোমাকে।
তো ছোও না, এত ইতস্তত করছ কেন তুমি? আজ ভেঙে ফেল সব জড়তা।
না, ভাবছিলাম যদি এই মুহূর্তে নিজেকে ধরে রাখতে না পারি?
সে তো তোমার দীনতা,
নিজের উপর একটুও আস্থা নেই তোমার?
আমি বললাম- না, তা
না। তুমি যদি লজ্জা পাও!
তুমি তো হেসেই খুন!
তারপর বললে,
আমি লজ্জা পাবো? আমার
ভারেই তো কত রমণী লজ্জায় একাকার হয়! তুমি জান না?
আমি সত্যিই হাসলাম। তোমার এই বাকপটুতা আর গেল না! -আচ্ছা যাও, এই
তোমাকে ছুঁয়ে দিলাম। এবার হল তো?
তুমি তো হেসেই খুন!
হাসতে হাসতেই বললে- এ কেমন ছোঁয়া তোমার? তুমি তো নিজেই জড়িয়ে গেলে! একেবারে কাকভেজা! এবার কি হবে? যদি ঠাণ্ডা লেগে যায়?
লাগুক, এমন দিন আবার
কবে আসবে জানি না। তোমার জন্য ক’দিন জ্বরে ভুগলাম না হয়!
আচ্ছা ভিজেই যখন গেলে
তখন চল আরও দূরে যাই। তোমার অতি চেনা বিচরণভূমিতে?
আমি কিছুটা পুলকিত
হলাম। -আমার চেনা জগৎ! সে তো অনেক দূর,
এতদূর কী করে যাব?
সে ভাবনা আমার। তুমি
শুধু চলই না!
তোমার পাগলামীতে আজ
আমি এতটাই মজে গেলাম যে নিজেকে ফেরানোর কোন প্রয়াসই খুঁজে পেলাম না। আবার শুরু হল
ছুটে চলা।
মেঘের
পরে মেঘ জমেছে,
ও মাঝি
ধর তোমার হাল,
তোমার
সাথে উড়িয়ে দেবো
আমার
পানসি তরীর পাল।
এই অবিনাশী আনমনা, তুমি আমায় এ কোথায়
নিয়ে এলে? এ যে আমার বহু-চেনা প্রকৃতি!
হুম, এ তোমার অতি
চেনা জগৎ।
ঐ তো কীর্তনখোলা। ওখানে আমি তোমার সাথে হাঁটবো।
আমি শান্ত নদীটার
পাড়ে এসে দাঁড়াই। এখানে শহুরে কোলাহল নেই, মাথায় কাজের টেনশন নেই। শহুরে যানজট, ইট-কাঠ-পাথরের
ইমারতের দেয়ালও নেই। শান্ত স্নিগ্ধ প্রকৃতি- এ আমার অতি চেনা জগৎ। হঠাৎ যেন মনে হল
এ আমায় বলছে, ‘এতদিন কোথায় ছিলে?’
আমি বললাম, তোমায়
ছেড়ে কি থাকা যায়! তুমি তো সবসময় আমার সাথেই ছিলে। এই যে-এইখানে, একেবারে ভেতরটায়।
এমন নরম বালুতে হেঁটে চলা, এমন টলটলে পানিতে চাঁদের আলোর মায়াময়
রূপ কি কখনো ভোলা যায়! ঝুমঝুম বৃষ্টির শব্দ, ঝড়ে নৃত্যরত বৃক্ষরাজির উদ্দামতা সবকিছু
আমাকে নিমেষে নিয়ে যায় অন্য ভুবনে!
এই অপ্রতিরোধ্য
প্রলয়েতারিনীর মাদল নৃত্যে আমি সহসা চমকিত! জীবনানন্দের কবিতার মত তোলপাড় করা
বৃষ্টি নামুক-আঝোর ধারায়, ভাসিয়ে দিক সমস্ত চরাচর। কী ঘোর লাগা আবেগে শুধুই ছুটে
চলা, কী উদ্দাম বন্যতা নিয়ে! এমন বর্ষায় মন আকুল না হয়ে পারে ?
তোমায় অসংখ্য ধন্যবাদ হে আফ্রোদিতি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন