রবিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১৮

ছোটগল্পঃ অচেনা অগন্তুক


ঘটনাটা ঘটার ঠিক তিনদিন পর লোকটিকে দেখা গিয়েছিলো এলাকায় বাজারের শেষপ্রান্তে সাজু মিয়ার চায়ের দোকানে প্রতিদিনের মত আড্ডাটা তখন জমে উঠেছে কেবল। লোকটি হঠা সেখানে উপস্থিত হয়ে একজন ভদ্রলোকের খোঁজ করছিল। তার ভাষ্য থেকেই জানা গেল তিনি স্থানীয় সমাজসেবা কেন্দ্রের এক ভদ্রলোকের কাছে এসেছেন, যিনি এখান থেকে অন্যত্র বদলী হয়ে গেছেন প্রায় দু’মাসের বেশী সময় আগে। বন্ধুকে না পেয়ে ভদ্রলোক খানিকটা হতাশই হলেন। লোকটির বয়স পয়ত্রিশ কি ছত্রিশ হবে উচ্চতা মাঝারি, ভরাট ফর্সা মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়িগুলো বেশ মানিয়ে গেছে, আর পরনে আকাশী রঙের স্ট্রাইপ পাঞ্জাবী পরিহিত লোকটিকে দেখে উপস্থিত সবারই মনে হয়েছিলো একজন নিখাত ভদ্রলোক।
লোকটি চা-দোকানের সামনের বেঞ্চিতে বসে চায়ের অর্ডার দিল। চা খেতে খেতে এলাকার মানুষজনের আলাপচারিতা শুনছিলো।
এখান থেকে লাস্ট ট্রেন ক’টায় ছাড়ে? লোকটি জানতে চাইলো।
রাত দশটায়। পাশে বসা তোরাব আলী জবাব দিল।
লোকটি ঘড়ির দিকে তাকালো। মুখে হতাশার ছাপ স্পষ্ট। এখনো অনেক সময় বাকী। অচেনা এলাকায় এতটা সময় কাটানো কিছুটা সমস্যাই বটে। ছোট্ট মফস্বল শহর। এখানে দেখার মত তেমন কিছুই নেই। কয়েকটা চায়ের স্টল, কিছু মুদি দোকান, টেইলার্স, সেলুন, বাজারের একপাশে একটা কাঠ চিড়ানোর স-মিল আর ধান ভাঙানোর কল। সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পর পুরো বাজার এলাকা প্রায় খালি হয়ে যায়। এখান থেকে প্রায় দুই মাইল উত্তরে ষ্টেশন।
তোরাব আলী তার দিকে তাকিয়ে বলল, ভাই সাহেব যাইবেন কই?
ঢাকা।
ও আচ্ছা। সাতটার পর এই বাজারে কাউরে পাইবেন না। স্টেশনে যাইতে হইলে আগে ভাগেই রওনা দিতে হইবো।
দূর মিয়া, নয়া মানুষটারে হুদাই চিন্তায় ফালাইয়া দিতাছো ক্যান, আমগো জগলুরে কইয়া রাখলে হেয় তো ওনারে স্টেশনে পৌঁছাইয়া দিতে পারবো। দোকানের একপাশে বসা রাজিব সিদ্দিকী বলে উঠলো।
আপনে ঠিকই কইছেন কমিশনার সাব, জগলুরে কইয়া ওনারে যাওনের ব্যবস্থা কইরা দেওন দরকার। বিদেশী মানুষ য্যান বিপদে না পড়ে।
লোকটি কিছুটা আশ্বস্ত হল।
চা খেতে খেতেই লোকজনের আলাপচারিতা চলছিল। বিষয়বস্তু দেশ-বিদেশের রাজনীতি। ইউরোপ-আমেরিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ পরিস্থিতিও উঠে এসেছিল আলোচনায়। আগন্তুক লোকটি মনে মনে ভাবছিল, এই প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোকজনও এখন বেশ সচেতন হয়ে উঠেছে। লোকজনের কথার ফাঁকে আগন্তুক লোকটি হঠাৎ জানতে চাইল,  
আমার বন্ধুর কাছে শুনেছিলাম, এইখানে নাকি লম্বা সময় ধরে মেলা বসে, যাত্রাপালা হয়; সেটা কি শেষ হয়ে গেছে?    
কেউ কোন উত্তর দিল না। লোকটি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো হঠাৎ যেন পরিবেশটা কেমন থমথমে হয়ে গেল। সবার দৃষ্টি এখন আগন্তুকের দিকে। কয়েকজন লোক উঠে চলে গেল।
আমি আসলে মেলাটা দেখতেই এসেছিলাম। আমার বন্ধুর মুখে শুনে শুনে এখানকার মেলা সম্পর্কে একটা আগ্রহ জন্মেছিলো।  
ওটা শেষ হয়ে গেছে। রাজিব সিদ্দিকী বলে উঠলো।
ও। তাইলে তো আমার বন্ধু এখানে থাকলেও কোন লাভ হইতো না। শুধু শুধুই এতদূর আসা।
আপনে জানতেন না যে আপনের বন্ধু এখান থেকে বদলী হয়ে গেছে? কিছুটা রুক্ষ কণ্ঠে বলে উঠলো বলরাম হালদার, এলাকার প্রাইমারী স্কুলের মাস্টার।  
মাস্টার তোমার কথা বলার ধরণটা আর বদলাইলো না। উনি জানলে কী এতদূর আসেন! বলরামের কথার উত্তরে বলল রাজিব সিদ্দিকী।
বিষয়টা হালকা করতে আগন্তুক বলে উঠলো,
আসলে অনেকদিন ওর সাথে যোগাযোগ নই, ফোনেও পাচ্ছিলাম না। তাই ভাবলাম হঠা এখানে এসে ওকে চমকে দেব।
কেউ আর কোন কথা বলছিল না। আবার সেই নিরবতা। লোকটি কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছিলো। পরিবেশটা হালকা করতেই সাজু মিয়া বলল,
ভাই, আপনেরে আরেক কাপ চা দেই?
লোকটি হেসে সায় জানাল।

সন্ধ্যা হয় হয়। ঠিক এমন সময় চায়ের দোকানের সামনে পুলিশের ভ্যানটি এসে থামল। অন্য সবাই নির্বিকার। তবে লোকটিকে দেখে মনে হল এই ছোট্ট বাজারে এই সময় পুলিশের ভ্যানটি দেখে সে কিছুটা অবাকই হয়েছে। মুখে কিছুই বলল না। গফুর দারোগা চায়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল। রাজিব সিদ্দিকীকে দেখে জিজ্ঞেস করল,  
আপনার কী খবর?
ভাল। কোন কিছু জানতে পারলেন দারোগা সাব?
তদন্ত চলছে, দেখা যাক কি হয়। আপানার বাড়িতে নজু মিয়া নামে কেউ কাম করে?
হ, করে তো।
ওকে এখন কোথায় পাওয়া যাবে?
হয়তো বড়িতেই আছে।
কে এখন খবর দিয়া আনানো যাবে?
কিন্তু দারোগা সাব ও তো একটা সহজ সরল পোলা। ওরে আপনাগো কেন দরকার?
গফুর দারোগা কয়েক মুহূর্ত রাজিব সিদ্দিকীর দিকে তাকিয়ে রইল। রাজিব সিদ্দিকী কিছুটা ইতস্থত বোধ করছিল। হঠাৎ দারোগা মুখে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বলল, তদন্তের স্বার্থে আমাদের অনেক কিছুই করতে হয়, সেইটা আপনেরা বুঝবেন না।
রাজিব সিদ্দিকী দারোগার কথায় সায় জানিয়ে বলল, তাহলে ঠিক আছে।  
ইতিমধ্যে পুলিশের দলটি চায়ের দোকানে এসে এক পাশের বেঞ্চিতে বসলো। হঠা গফুর দারোগার চোখ পড়লো নতুন আগন্তুকের দিকে। দারোগার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে রাজিব সিদ্দিকী বলে উঠল,
উনি ঢাকা থেকে আমগো এলাকার মেলা দেখতে আইছেন।
দারোগা ভ্রূ কুচকে লোকটিকে দেখল কিছুক্ষণ। তারপর সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে বলল,
তাইলে যা শুনছি মিথ্যা না।
আগন্তুক ভদ্রলোক মূল ঘটনা না বুঝলেও এটুকু আঁচ করতে সমস্যা হয়নি যে এ আলোচনা তাকে ঘিরেই। হঠাৎ গফুর দারোগা তার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
আপনার পরিচয়?
আমাকে বলছেন? আগন্তুক জানতে চাইলো।
হুম, কোত্থেকে আসছেন?
আমার নাম জামিল, জামিল আহসান। ঢাকায় থাকি।
হঠাৎ এ সময় এখানে কেন?
এক বন্ধুর কাছে এসেছিলাম। কিন্তু এসে দেখি সে এখান থেকে বদলী হয়ে গেছে। আজ রাতের ট্রেনেই আবার ফিরে যাব।
আচ্ছা! কিন্তু আপনে ভুল সময়ে এসে পড়েছেন। এখন তো এই এলাকা ছাড়তে পারবেন না।
জামিল কিছুটা অবাক হয়ে জানতে চাইল- কেন?
দারোগা যেন শিকারকে বাগে পেয়েছে এমন ভঙ্গিতে বলল,
ঐ যে বললাম আপনি ভুল সময়ে এসেছেন। তিনদিন আগে এই এলাকায় একটা খুন হয়েছে, যাত্রাদলের একটা মেয়েও নিখোঁজ। এখন তার তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সবাইকে এলাকা না ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

একটু আগে মানুষের রহস্যময় আচরণের বিষয়টা এতক্ষণে পরিস্কার হ জামিলের কাছে। সে দারোগার উদ্দেশ্যে বলল,
কিন্তু এই ঘটনার সাথে আমার সম্পর্ক ক? আমি তো এখানকার কেউ না! তাছাড়া এখানে মাত্র আজই এলাম।
আমার কিচ্ছু করার নেই। উপর মহলের নির্দেশ। তদন্ত শেষ হলে চলে যাবেন।
তা ক করে হয়? এখানে আমি থাকব কোথায়? কোন হোটেলও তো নেই।
সেটা একটা ভাবনার বিষয় বটে! কিছুক্ষণ চুপ থেকে দারোগা হঠা রাজিব সিদ্দিকীর দিকে তাকিয়ে বলল,
আপনার বাড়িতে তো অনেক ঘর, ওনাকে একটা ঘরে থাকার ব্যবস্থা করে দেন না
রাজিব সিদ্দিকী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। দারোগা আবার বলল- কী কমিশনার সাব, আপনার বাড়িতে ভদ্রলোককে রাখা যাবে না?
এবার আমতা আমতা করে বলল রাজিব সিদ্দিকী - তা না হয় রাখলাম, মেহমান হল লক্ষ্মী; কিন্তু দারোগাসাব এই ভদ্রলোক তো আইজই আইলেন, ওনারে এর মধ্যে জড়ানো কী ঠিক হবে?
সে ভাবনা আমাদের ভাবতে দেন। আপনে শুধু ক’দিনের জন্য ওনার থাকার ব্যবস্থা করেন। তদন্ত শেষ হলেই উনি চলে যাবেন।
রাজিব সিদ্দিকীকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই দারোগা উঠে দাঁড়াল। গাড়ির দিকে এগিয়ে আবার ঘুরে তাকাল। রাজিব সিদ্দিকীর উদ্দেশ্যে বলল-
আর হ্যা, নজু মিয়াকে কাল সকালে থানায় পাঠাবেন।
রাজিব সিদ্দিকী কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো- থানায়!
দারোগা হেসে বলল,
ভয় নেই, জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হলেই ছেড়ে দব। সাথের কন্সটেবলকে জামিলের নাম-ঠিকানা লিখে নিতে বলে দারোগা গাড়িতে গিয়ে বসল।
রাজিব সিদ্দিকী কিছুক্ষণ গুম মেরে বসে থাকল। তার চোখেমুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ। এই বিরক্তি দারোগার আচরণের জন্য না-কি জামিলকে তার বাড়িতে আশ্রয় দিতে হবে সে জন্য ঠিক বোঝা গেল না। বলরাম হালদার খোঁচা দিতে ছাড়ল না। সে বলে উঠল-
নাও, এইবার মেহমানকে তোমার বাড়িতে নিয়া যাও। ঠিকমত আপ্যায়ন কইরো, নইলে দারোগা আবার তোমার উপরে একচোট নিতে পারে!
রাজিব সিদ্দিকী বলরাম হালদারের কথার কোন উত্তর দিল না। জামিলের উদ্দেশ্যে বলল,
চলেন ভাই। রাইত হইয়া যাইতেছে।
রাজিব সিদ্দিকীর বাড়িটি বাজার থেকে বেশ দূরে। কিছুটা পথ এগোতেই লোকজনের আনাগোনা কমে গেল। চারিদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। গ্রামের মধ্য দিয়ে দু’জনে এগিয়ে চলছে। রাজিব সিদ্দিকী বেশ চুপচাপ। অনেকক্ষণ পর মুখ খুলল সে,  
বুঝলেন ভাইসাব, আমাদের দেশের পুলিশগুলার ব্যবহার খুব খারাপ। মানুষ ক্যামনে তাদের বন্ধু ভাববেবলে? এই দ্যাখেন, আপনারে হুদাহুদাই ঝামেলায় ফালাইয়া দিল
আসলে ঠিক কি ঘটেছে, কে খুন হয়েছে? জামিল জানতে চাইল।
যাত্রাদলের এক বুড়ারে কারা যেন মাইরা ফালাইছে, আর একটা নর্তকীরে খুঁইজা পাওয়া যাইতাছে না।
কীভাবে খুন হল?
ক্যামনে কমু ভাই! মনে হয় অগো দলের মধ্যের কারও কাম হইবো। আমগো এলাকার মানুষ খুব শান্তিপ্রিয়, এইহানে খুনাখুনি করার মত লোক নাই। 
আমি ভাবছি, এই ঝামেলায় কতদিন এখানে আটকে থাকতে হয়! জামিল মৃদুস্বরে বলল।
যাত্রাদলের কয়েকজনকে আটক করছে, মনে হয় খুব তাড়াতড়ি একটা সুরাহা হয়ে যাবে।
কথা বলতে বলতেই তারা পৌছে গেল। রাজিব সিদ্দিকীর বাড়িতে ঢোকার মুখেই কাছারিঘরটি। লম্বা আকৃতির ঘরটির দু’পাশে দু’টি বিছানা পাতা। এ বাড়ির কাজের লোক নজু মিয়া এসে জামিলের জন্য বিছানাটা ঝেড়ে দিয়ে বাড়ির ভেতরে সেই যে অদৃশ্য হয়েছে আর ফেরার নাম নেই। জামিল একা একা বসে থেকে বেশ বিরক্ত হয়ে উঠেছে। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার, ঘরের ভেতরেও আলোর স্বল্পতা যথেষ্ট। কাছারিঘরের সামনের খোলা জায়গায় নেমে কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করলো জামিল। একটু এগোতেই বাম পার্শ্বে বড় একটি পুকুর। পুকুরের অপর প্রান্তে ঘন জঙ্গল।
জামিল পুকুরের ঘাটে এসে বস। এখন থেকে ভেতর বাড়িতে ঘরগুলোয় আলো জ্বলতে দেখা যায়। এ বাড়িতে এসেছে প্রায় ঘন্টাখানেক হল, কিন্তু রাজিব সিদ্দিকী আর নজু মিয়া ছাড়া আর কেউকেই দেখেনি। কিছুক্ষণ পর অবশেষে নজু মিয়া জামিলের রাতের খাবার নিয়ে ফিরে এল। টেবিলে জামিলের খাবার সাজিয়ে নজু মিয়া তার বিছানায় গিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়লো।  
জামিল খাওয়া সেরে একটা সিগারেট ধরিয়েছে, এমন সময় রাজিব সিদ্দিকী এসে ঘরে ঢুকল। মাফলারটা গলায় জড়ানো। কাশতে কাশতে বলল,   
ক’দিন ধরে ঠাণ্ডায় খুব ভুগতেছি। ভাইসাব, আপনের কোন সমস্যা হইতাছে না তো!
না না, কোন সমস্যা নেই। আমি এসে বরং আপনাদের ঝামেলায় ফেলে দিলাম।
রাজিব সিদ্দিকী অনেকটা আফসোসের সুরে বলল- আমাদের আর ঝামেলা কি, দারোগাই তো আপনারে বিপদে ফেলল।    
জামিল হেসে বলল, আইনের লোকজন কিছুটা এমনই হয়ে থাকে। যান, আপনে গিয়ে রেস্ট নেন।  
নজু মিয়াকে শুয়ে থাকতে দেখে জোরে হাঁক দিয়ে উঠল রাজিব সিদ্দিকী।
নজু!
তাড়াতাড়ি উঠে রাজিব সিদ্দিকীর কাছে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়ায় নজু মিয়া।  
ঐ বেয়াদব, সাহেব একা একা বসে আছে আর তুই গিয়া শুয়ে আছোস! দেখ ওনার কি লাগে। বিদেশী মানুষ, খেয়াল রাখবি ওনার যেন কোন অসুবিধা না হয়।
নজু মিয়া ঘাড় নেড়ে সায় জানায়।
রাজিব সিদ্দিকী চলে যাওয়ার পর নজু মিয়া জামিলের সামনে এসে দাঁড়ায়। দৃষ্টি মাটির দিকে। অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
স্যার, আর কিছু লাগবে?
না। কিছু লাগবে না।
জামিলের ঘুম পাচ্ছিল না। আবার এই অচেনা পরিবেশে একা ভালও লাগছিল না। তাই ভাবল, নজু মিয়ার সাথে কথা বলে কিছুটা সময় কাটবে। সে হেসে বলল,  
তোমার কি খুব ঘুম পাচ্ছে নজু?
নজু মিয়া চুপ। জামিল তার দিকে তাকাল। মাথা নেড়ে জানাল তার ঘুম পাচ্ছে না।
তাহলে বস, আমরা কিছুক্ষণ কথা বলি।
নজু একটা বেতের মোড়া নিয়ে জামিল থেকে একটু দূরে বসল।
জামিল এই প্রথম ভালভাবে দেখল নজুকে। বয়স বিশ-একুশের মত হবে। লম্বা ছিপছিপে গড়ন, চোয়ালটা ভাঙা। বড্ড বেশি চুপচাপ। সে মনে মনে ভাবল, এটা কি ওর স্বাভাব নাকি নতুন মানুষ দেখে এমন করছে। জামিল কিছুটা স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করে।
এই বাড়িতে তুমি কতদিন আছ?  
পাঁচ বছর।  
তাই! অনেক লম্বা সময়। তাহলে তো তুমি সিদ্দিকী সাহেবের অনেক বিশ্বস্ত একজন।
নজু কোন উত্তর দেয় না।
জামিল হেসে বলে, নজু তুমি কি কোন কারণে বিরক্ত?
নজু মিয়া জামিলের দিকে তাকায়। মুখে কিছুই বলে না।
এখানে আসার পর এই প্রথম তাকে চোখ তুলে তাকাতে দেখল জামিল। তার দৃষ্টি কিছুটা অস্বাভাবিকও মনে হল। কেমন যেন অস্থির চাহনি, কিছুটা আতঙ্কগ্রস্থ।
নজু, আমার এ বাড়িতে আসার কারণ কি তুমি জান?
নজু ছোট্ট করে উত্তর দেয়- না।
শোন নি, তোমার সাহেব কি বলল? দারোগা আমাকে আটকে দিয়েছে। এক ধরণের এরেস্ট করাই বলতে পারো। লকআপে ঢোকায়নি, আবার ছেড়েও দেয়নি। হাসতে হাসতে বলল জামিল।
নজুর ভিতরে কোন ভাবান্তর নেই। সে নির্বাক শ্রোতার মতই কেবল শুনে যাচ্ছে।
তোমার জানতে ইচ্ছে করছে না দারোগা আমাকে কেন আটকে দিল?
নজু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জামিলের দিকে তাকালো।
তোমাদের এলাকায় একটা খুন হয়েছে, জান তো?
হ।
আসলে ঠিক কি ঘটেছিলো আমাকে বলবে?   
নজু কোন কথা বলছে না। জামিল হেসে আবারও জিজ্ঞেস করল,
কি, কিছু বলবে না?
নজু গম্ভীরভাবে জবাব দিল- আমি কিছু জানি না।
কী বল! এলাকার সবাই তো জানে, তুমি জান না?
শুনছি যাত্রাদলের একজন মানুষ খুন হইছে।
তুমি যা জান তা-ই বল।  

নজু মিয়া আবারও চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। জামিল বুঝতে পারে নজু হয়ত এ বিষয়ে কিছু বলতে চাইছে না। জামিল নজুর সাথে আরও স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে। নজু কিছুক্ষণ ইতস্থত করছিল। জামিল খুব নরম স্বরে বলে,
 তুমি হয়ত ভাবছ আমি কেন এই বিষয়ে তোমাকে জিজ্ঞেস করছি। আমি তো এই ঘটনার কিছুই জানি না, অথচ দেখ এই খুনের কারণেই এখানে আটকে গেলাম! এই কেসের সমাধান না হলে ছাড়াও পাচ্ছি না। তাই জানতে চাচ্ছিলাম আসলে কি ঘটেছে। তুমি যতটুকু জান তা-ই বল।
নজু মিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে শেষমেশ শুরু করল,
আসলে পুরা ঘটনা আমি জানি না। অনেক রাত পর্যন্ত যাত্রা দেইখা বাড়ি ফিরা আইছিলাম। সকাল বেলা শুনলাম যাত্রাদলের একজন বুড়া মানুষ খুন হইছে আর মাইয়াডারে ধইরা নিয়া গেছে।
তুমি কেবল এটুকুই জান?
নজু মাটির দিকে তাকিয়ে বলল- হ।
জামিলের মনে হল নজু মিয়া সবটা বলছে না। সে হয়ত আরও বেশি কিছু জানে কিন্তু মুখ খুলছে না।
বুড়ো লোকটা কে?
ঐ লোকটা না-কি যাত্রাদলের মেয়েদের দেখাশোনা করতো।
আর মেয়েটা?
শুনছিলাম মাইয়াডার নাম যূথী।
কার কাছে শুনেছ?
এলাকার মানুষ বলাবলি করতছিল
তুমি কি তাকে দেখেছিলে?
হ, একবারই দ্যাখছিলাম। যাত্রা চলার ফাঁকে ঐ মাইয়াডা নাচছিলো।  
একজন বুড়ো লোককে মেরে ফেলা হল! কিন্তু কেন?
আমি ক্যামনে কমু সার? আমি তো যাত্রা শেষ হওয়ার আগেই বাড়ি চইলা আইছি।
তারপর আর বের হওনি?
নজু মিয়া মুখে না বলতে গিয়ে আবার থেমে গেল। সে আমতা আমতা করে বলল,
হ, একবার বাইর হইছিলাম। কাকার ফিরতে দেরি দেইখ্যা কাকী খুব অস্থির হইয়া উঠছিলো, তাই তারে খুঁজতে গেছিলাম।
জামিল লক্ষ করলো, নজু মিয়ার চোখ দুটো যেন আরও অস্থির হয়ে উঠেছে।
তোমার কাকা কি সেদিন অনেক রাতে ফিরেছিলো?
হ।  
লোকটার মৃত্যুর খবর তুমি কখন শুনেছ?
পরদিন সকালে, বাজারে যাওয়ার পর।
আমি ভাবছি বৃদ্ধ লোকটাকে খুন করল কেন?
আমি তো জানি না, তয় হুনছি মাইয়াডারে তুইল্যা নেওনের সময় বুড়ো লোকটা নাকি বাধা দিছিল।  
আচ্ছা! আর মেয়েটাকে যে তুলে নেয়া হয়েছে সেটা সবাই জানল কেমনে? 
বুড়ো লোকটা মারা যাবার আগে বলছিলো।
লোকট তাহলে সাথে সাথেই মারা যায়নি!
না, হাসপাতালে নেবার পথে মারা গেছে।
এটা কার কাজ হতে পারে? তোমার কি মনে হয়?
আমি তো কিছু জানি না সার
জামিলের মনে পড়ল সন্ধ্যায় দারোগার কথা। সে নজু মিয়ার উদ্দেশ্যে বলল,
তোমার সাহেব কি বলেছে যে দারোগাসাব তোমাকে কাল থানায় গিয়ে দেখা করতে বলেছে?
চমকে উঠল নজু মিয়া। অনেকটা ভয়ার্ত স্বরে বলে উঠল,
আমারে থানায় দেখা করতে কইছে দারোগাসাব? কই কাকা তো আমারে কিছু কয় নাই!
এখন বলেনি, হয়তো কাল বলবে।
কিন্তু আমারে থানায় যাইতে কইবো ক্যান? আমি এসবের কী জানি?
তা তো আমি বলতে পারব না, তবে আমার মনে হয় কেউ তোমার সম্পর্কে দারোগাকে কিছু বলেছে।
জামিল লক্ষ কর নজু মিয়ার ভয়ের মাত্রাটা আরেকটু বেড়ে গেছে।
কী বিপদ! আমি গরীব মানুষ, থানা-পুলিশের ঝামেলা ক্যামনে সামলাই কন তো সার! পুলিশরে আমি এমনিতেই খুব ডরাই।
জামিল তাকে অভয় দিল। তুমি এত ভয় পাচ্ছ কেন? তুমি তো আর খুন করনি। তোমার সাহেবকে বল সব সামাল দিতে।
নজু মিয়ার মধ্যে কোন ভাবান্তর নেই। অনেকক্ষণ অন্যমনস্কভাবে বসে থাকল। জামিল আবার বলে উঠল,
 তোমার সাহেব তো এলাকার কমিশনার, দারোগাসাবের সাথে তার সম্পর্ক তো ভালই মনে হল। কাল তাকে সাথে করে নিয়ে যেও। দেখবে সে-ই দারোগাকে বুঝিয়ে তোমাকে এই ঝামেলা থেকে রক্ষা করবে।
নজু মিয়া বিড়বিড় করে কি যেন বলল ঠিক বোঝা গেল না। তারপর সোজা গিয়ে তার বিছানায় শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পরই তার নাক ডাকার শব্দও শোনা যাচ্ছিল।
ঘড়ি দেখল জামিল, রাত দশটা বাজে মাত্র। সারা বাড়ি নিঃশব্দ নিঝুম। বাইরে থেকে ঝিঁঝিঁপোকা ও নাম না জানা পাখির ডাক ভেসে আসছিলো। জামিল জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। ঠিক তখনই মনে হল জানালার পাশ থেকে কেউ সরে গেল! একটু পরই কারো পায়ের শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেল জামিল। কাছে কোথাও বিড়াল ডেকে উঠল। পর পর তিনবার।  
ভোর সাতটায় ঘুম ভাঙল জামিলের। নজু মিয়াকে ঘরে কোথাও দেখতে পেল না। অচেনা এলাকা, কোথায় যাবে, তাই চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। এই খুন রহস্যের সুরাহা না হলে সে এই এলাকা ত্যাগ করতে পারছে না, যেভাবেই হোক সে এখন এই ঘটনায় জড়িয়ে গেছে। গতরাতে নজু মিয়ার সাথে কথা বলে জামিল বুঝেছে কেসটা বেশ জটিল। এত সহজে এর সমাধান হবে বলে মনে হচ্ছে না। নজু মিয়াকে কাছে পেলে আরও কিছু জিজ্ঞেস করা যেত।
বেলা আরেকটু বাড়লে জামিল বাড়ি থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তার দিকে হাঁটতে লাগলো। যতটুকু মনে পড়ে গতকাল রাতে এ পথ ধরেই বাজার থেকে ফিরেছিলো। বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার এগিয়েই একটা ছোট বাগান। গতকাল রাতের অন্ধকারে সেভাবে খেয়াল করা হয়নি। বাগানের মধ্যে দিয়ে একটি সরু পথ একেবেকে চলে গেছে বাজারের দিকে। পথের একপাশে একটি লম্বা দিঘি। জামিল কিছুক্ষণ দিঘির পাড়ে দাঁড়াল। দিঘিটা লম্বায় প্রায় চারশো এবং আড়ে দেড়শ ফুটের মত হবে। পুরোটাই কচুরিপানায় ভরা। অসংখ্য ছোট ছোট ঝোপঝাড়ে দিঘির পাড় ঢেকে আছে। জামিল পেছনে তাকিয়ে একজন বৃদ্ধ ফকিরকে তার দিকে আসতে দেখল। তাকে পাশ কাটানোর সময় বৃদ্ধ তার দিকে জিজ্ঞসু দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আবার সামনের দিকে হাঁটতে লাগলো। জামিল মনে মনে হাসল।
এই দিঘির কাছাকাছি কোন জনবসতি নেই। জামিল লক্ষ করল, এখানে বাড়িগুলোর মাঝে দূরত্ব বেশ, কাছাকাছি একমাত্র রাজিব সিদ্দিকীর বাড়ি। জামিল বেশ কিছুক্ষণ বাগানটির চারপাশে চোখ বোলাল তারপর আবার এগিয়ে চলল বাজারের দিকে। দিঘির দক্ষিণ পাড় বরাবর আসতেই হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো। পথের একদিকে গুল্ম লতায় জড়ানো ছোট ছোট গাছগুলোর উপর তার চোখ আটকে গেল! ঠিক তখনই তার মনে হল পাশের গাছের আড়াল থেকে কেউ তার উপর নজর রাখছে!  
বাজারে ঢোকার ঠিক আগেই বড় একটা খোলা মাঠ। সেখানে এখনও মেলা এবং যাত্রার জন্য প্যান্ডেল টানানো আছে। তবে আশেপাশে কোন লোকজন নেই। জামিল কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে জায়গাটাকে ভালমত দেখল। তারপর বাজারের দিকে এগিয়ে চলল।
সাজু মিয়ার চায়ের দোকানটা সবসময়ই জমজমাট থাকে। জামিল সেখানে পৌঁছে একটা খালি আসনে বসে পড়ল।
ভাইসাবরে চা দেই? সাজু মিয়া হেসে জিজ্ঞেস করল
জামিল হেসে সায় জানাল। চারিপাশে তাকিয়ে দেখল সব অপরিচিত লোকজন। গতকাল সন্ধ্যায় এদের কাউকেই দেখেনি। এরা নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায় ব্যস্ত। আলোচনার বিষয়বস্ত মেলা, খুন এবং গুম।
হঠাৎ একজন বলল, হুনলাম নজুরে পুলিশে ধরছে!
আরেকজন বলে উঠল- নজুরে পুলিশে ধরলো ক্যান? ও তো একটা সাদাসিধা পোলা।
মধ্যবয়স্ক একজন বলে উঠল, কে যে সাদাসিধা আর কে যে ধড়িবাজ চেহারা দেখে কী বোঝা যায়! নিশ্চয়ই পুলিশ কোন ক্লু খুইজা পাইছে।
আরেকজন যোগ করলো, শুনলাম আমগো কমিশনার খুব চিন্তায় আছে।
মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক বললেন- চিন্তা হইবো না! নজু তো অনেকদিন ধইরাই ওর বাড়িতে আছে
ভাইসাব, চা নেন।
সাজুর হাত থেকে চা নিতে গিয়ে জামিল দেখলো পথে দেখা সেই বৃদ্ধ ফকির সাজুর সামনে হাত পেতে দাঁড়িয়েছে।
সাজু হেসে বৃদ্ধের উদ্দেশ্যে বলল- কী, চা-ও খাইতে হইবো?
ওনাকে চা দাও, টাকা আমি দেব। জামিল বলল।
বৃদ্ধ জামিলের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি হাসল।
জামিল চা শেষ করে উঠে পড়ল। একটা রিকশা নিয়ে ষ্টেশনের দিকে এগিয়ে চলল। মনে মনে ভাবল, একবার থানায় গিয়ে দারোগার সাথে দেখা করতে হবে।   

জামিলের ফিরতে বিকেল চারটে বেজে গেল। বাজারের ভেতরে না ঢুকে সে সোজা রাজিব সিদ্দিকীর বাড়ির দিকে এগিয়ে চলল। দিঘির পাড়ে এসে সকালের দেখা জায়গাটায় আরেকবার চোখ বোলাল। কোন পরিবর্তন চোখে পড়ল না। চারিদকে তাকিয়ে খেয়াল করল কেউ তার উপর নজর রাখছে কী-না। দ্বিতীয় কারও উপস্থিতি নজরে এল না। জামিল বাগান ছাড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলল।
রাজিব সিদ্দিকী মাত্র গোসল সেরে পুকুরের ঘাটে উঠে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ জামিলকে সামনে দাঁড়ানো দেখে গামছাটা দ্রুত গলায় জড়িয়ে নিল।
জামিল স্মিত হেসে বলল-আজ সারাদিন আপনাদের শহরটা ঘুরে দেখলাম।  
এই ছোট্ট মফস্বল শহরে আর দেখবার কী আছে! আপনার খাওয়া-দাওয়া হয়েছে?
হ্যা। ষ্টেশনে একটা হোটেলে খেয়ে নিয়েছি। বাজারে শুনলাম নজুরে না-কী পুলিশ আটকে রেখেছে!
হ। দারোগারে অনেক রিকোয়েস্ট করলাম কিন্তু শুনলো না। সহজ সরল পোলাডারে আটকাইয়া রাখলো।
আপনিই তো এখন ওর গার্জিয়ান, যা করার আপনাকেই করতে হবে। জামিল বলে উঠল। 
চেষ্টা কী কম করছি! দারোগা কইলো জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হলে ছাড়বে।
নজু যা ভীতু ছেলে, দেখেন পুলিশ কাস্টডিতে জিজ্ঞাসাবাদে কি বলতে কী বলে ফেলে! বলেই রাজিব সিদ্দিকীর দিকে তাকালো জামিল। রাজিব সিদ্দিকী জামিলের দিকে ঘুরে তাকালো, চোখে-মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। কিছুক্ষণ পর বলল,
আপনে ঠিকই বলেছেন। বোকাসোকা ছেলে, কি বলতে কী বলে ফেলে কে জানে! শেষে নিজের বিপদই না ডেকে আনে!
আমি ভাবছি, আমাকে আর কতদিন এখানে আটকে থাকতে হবে! জামিল হতাশ কণ্ঠে বলল।
রাজিব সিদ্দিকী নিশ্চুপ। জামিল লক্ষ করল লোকটি কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে। নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছে। কাছারিঘরের সামনে এসে তাকে বিশ্রাম নিতে বলে বাড়ির ভেতরে চলে গেল।
একা একা শুয়ে বসে আর ভাল লাগছিল না জামিলের। প্রায় আধা ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে ভাবল বাইরে বেরিয়ে গ্রামটা ঘুরে দেখা যাক। ঘরের দরজার সামনে আসতেই দেখল বলরাম হালদার পুকুর পাড় ধরে এগিয়ে আসছে। কাছাকাছি আসতেই দু’জনের চোখাচোখি, জামিলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বাড়ির ভেতরে অদৃশ্য হল সে। আরও কিছুক্ষণ পর বাইরে বেরিয়ে এল জামিল। পেছনে রাজিব সিদ্দিকীর কণ্ঠ শুনে ঘুরে তাকালো। বলরাম হালদারকে আশেপাশে কোথাও দেখা গেল না। তাকে বাইরে দেখে রাজিব সিদ্দিকী জিজ্ঞেস করল-
কোথাও যাইবেন?
আপনাদের গ্রামটা একটু ঘুরে দেখি, শুয়ে বসে থাকতে তো আর ভাল লাগছে না। জামিল জবাব দিল।
একা একা যাইতে পারবেন, না-কি কাউরে লগে দিমু? নজু থাকলে খুব ভাল হইত।
না, লাগবে না। খুব বেশিদূর তো আর যাব না। আশে পাশে একটু ঘুরে আসি।
আচ্ছা, সন্ধ্যার আগেই ফিরা আইসেন।
রাজিব সিদ্দিকীর কথায় সায় দিয়ে বেরিয়ে পড়ল জামিল। বাজারে যাবার রাস্তাটিকে ডান দিকে রেখে উল্টাদিকের রাস্তায় হেঁটে চলল। এদিকটায় বাড়িঘরের সংখ্যা কিছুটা বেশি। রাস্তার দু’পাশে গাছপালা ক্রমশ ঘন হয়ে এসেছে। তবে পথটা মোটামোটি নির্জনই বলা যায়। কিছুদূর চলার পরই হঠাৎ মনে হল কেউ যেন তাকে ফলো করছে। জামিল পেছনে ফিরলো, কেউ নেই। ভাবলো এটা তার মনের ভুল। আরও কিছুদূর এগোনোর পর একই রকম অনুভূতি হল। জামিল কান খাড়া করে হাঁটছে, এবার আরও কাছে কারো চলার শব্দ শুনতে পেল। হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। পেছনে ফিরতেই মনে হল কেউ একজন যেন গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো। কী যন্ত্রণা! সামনে একটা বাঁক দেখে লার গতি কিছুটা বাড়িয়ে দিল জামিল। দু’পাশে ভালমত লক্ষ রাখল। বাঁকটা পার হয়েই বাম দিকে একটা খেড়ের পালা ও কয়েকটা বড় গাছ চোখে পড়তেই গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো। কারো দ্রুত চলার শব্দ আসছে, জামিল চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। চারিদিকে নজর রাখছিল, হঠাৎ লোকটিকে চোখে পড়লো। তার সোজাসোজি রাস্তায় দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক দেখছে; একবার খেড়ের পালার দিকে তাকিয়ে আবার অন্যদিকে ঘুরে গেল। জামিল লোকটিকে দেখেই মনে মনে হেসে ফেলল। লোকটি বেশিক্ষণ দাঁড়ালো না। সে চোখের আড়াল হতেই গাছের পেছন থেকে বেরিয়ে রাস্তায় উঠে এল জামিল। রাজিব সিদ্দিকীর বাড়ির দিকে ফিরে চলল। খুব দ্রুত হেঁটে যাচ্ছিলো, বাড়ির খুব কাছাকাছি আসতেই রাস্তার একপাশ থেকে বেড়ালের ডাক ভেসে এল। পরপর তিনবার। জামিল থমকে দাঁড়ালো, খুব সতর্কভাবে চারপাশে চোখ বোলালো। তারপর বাগানের মধ্য দিয়ে তৈরি সরু রাস্তার দিকে তাকাতেই চোখে পড়লো সকালে দেখা সেই বৃদ্ধ ফকির বাগানের ভেতর থেকে ধীরে ধীরে রাস্তার দিকে এগিয়ে আসছে। 
রাতের খাবার শেষে শুয়ে শুয়ে কিছুক্ষণ আজকের পত্রিকা পড়ছিলো জামিল। ষ্টেশন থেকে গত চারদিনের কয়েকটা পত্রিকা কিনে এনেছে। কোন পত্রিকায়ই এখানকার খুনাখুনির খবর নেই। জলজ্যান্ত একটা মানুষ খুন হয়ে গেল, আরেকজন নিখোঁজ; কোন পত্রিকাই নিউজ করলো না! মোবাইল ফোনটা হাতে নিতেই হঠাৎ মনে হল জানালায় একটা মুখ উঁকি দিয়েই আবার সরে গেল। এখানেও তার উপর নজর রাখা! পত্রিকা থেকে মুখ না সরিয়েই আড়চোখে জানালার দিকে লক্ষ রাখলো সে। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল, কাউকে দেখা গেল না। হঠাৎ আবার কেউ উঁকি দিল। কয়েক সেকেণ্ড মাত্র, তারপর উধাও হল।
জামিল মনে মনে হাসলো। গতকাল রাতে, আজ সকালে দিঘির পাড়ে তার উপর নজর রাখা, বিকেলে গ্রামের পথে তাকে অনুসরণ করা আবার এখন উঁকিঝুঁকি মারা! এসবের মাকে কী? জামিল আলো নিভিয়ে দিল। খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে খুব সন্তর্পণে বেরিয়ে নিঃশব্দে ঘরের পাশ ঘেঁষা গাছটার আড়ালে দাঁড়াল। বেশ কিছুক্ষণ কোন সাড়াশব্দ নেই। জামিল ওখানেই দাড়িয়ে রইলো। একটু পর কাছে কোথাও একটা চাপা গোঙানির শব্দ শুনতে পেল। জামিল কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। শব্দের উৎসটা বোঝার চেষ্টা করল। কোথায় যেন বিড়াল ডেকে উঠলো। পরপর তিনবার। জামিল খেয়াল করল ডাকটা পুকুর ঘাটের দিক থেকেই আসছে। নিঃশব্দে সেদিকে এগিয়ে গেল।
সকাল দশটা। লোকজনের হৈ-চৈ শুনে বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এল রাজিব সিদ্দিকী। কাছারিঘরের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। অনেক লোকের জটলা, সম্মুখভাগে দাঁড়িয়ে গফুর দারোগা।   
আপনারা এত সকালে!  
আসামী ধরতে এসেছি। ঝটপট উত্তর দিল গফুর দারোগা।
খুনির পরিচয় কি জানা গেছে? রাজিব সিদ্দিকী জিজ্ঞেস করলো।  
দারোগা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল-হ্যা।
খুনী কে?
খুনী তো আমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। গফুর দারোগা একটা হাতকড়া রাজিব সিদ্দিকীর সামনে তুলে ধরল।
রাজিব সিদ্দিকী প্রথমে ভড়কে গেলেও খুব অল্প সময়ের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিল। সে গফুর দারোগার উদ্দেশ্যে বলল- এসবের মানে কী? আপনে কি কইতে চান আমি খুনী?
কমিশনার সাব, আর আড়াল করে লাভ নাই। আমরা কনফার্ম না হয়ে আসিনি।
রাজিব সিদ্দিকী বেশ জোরের সাথেই বলল- ভুল করতাছেন দারোগা সাব।
দ্যাখেন, দিঘি থেকে কিন্তু মেয়েটার লাশ তোলা হয়েছে। অলরেডি পোস্টমোর্টেমের জন্য পাঠানো হয়েছে। দারোগা বলে উঠল।
তাতে কী হয়েছে? কোথাও থেকে লাশ পেলেই কি প্রমাণ হয় যে আমি খুন করেছি?
জটলার পেছন থেকে সামনে এগিয়ে এল জামিল আহসান। রাজিব সিদ্দিকীকে উদ্দেশ্য করে বলল- কমিশনার সাব আপনার গলা থেকে মাফলারটা সরান তো।
রাজিব সিদ্দিকী কিছুটা অবাক হয়ে জামিলের দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ পর বলল- আপনি!
গফুর দারোগা বলে উঠল- ইনি ডিবি ইন্সপেক্টর জামিল আহসান। পুরো ছকটাই আমাদের সাজানো। আরও আছে।  
জামিল স্মিত হাসল। জটলার দিকে মুখ করে বলে উঠল- হাসান, সামনে এসো।
ভিড় ঠেলে সামনে এসে দাড়ালো সেই ভিক্ষুক। যাকে গত কয়েকদিন ধরে এলাকার বিভিন্ন জায়গায় দেখা গেছে। ছদ্মবেশটা খুলে ফেলতেই দেখা গেল বছর পচিশের এক যুবক দাঁড়িয়ে। 
দারোগা আবার বলল- কী হল কমিশনার সাব, গলা থেকে ময়াফলারটা সরান!
রাজিব সিদ্দিকী কিছুক্ষণ ইতস্তত করে অবশেষে গলা থেকে মাফলারটা খুলে ফেলল।
জামিল প্রশ্ন করল- আপনার গলায় ঐ ক্ষতগুলো কীসের?
রাজিব সিদ্দিকী নিরুত্তর।
জামিল বলে উঠল- গতকাল গোসলের পর আপনার গলায় এই দাগগুলো দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল। তারপর নজু এবং কাল রাতে বলরাম হালদারের জবানবন্দিতে বাকীটা পরিষ্কার হয়েছে।
রাজিব সিদ্দিকী এদিক-ওদিক তাকিয়ে কি যেন খুঁজছিলো। ঠিক তখনই কয়েকজন কনস্টেবল বলরাম হালদারকে হাতকড়া পরিয়ে সামনে হাজির করল। রাজিব সিদ্দিকী বলরাম হালদারকে হাতকড়া পরিহিত অবস্থায় দেখে কিছুটা হতাশ হলেও নিজেকে খুব শান্ত রাখল।
রাজিব সিদ্দিকীর দিকে তাকিয়ে জামিল বলল- বলরাম বাবুকে আমার পিছনে লাগিয়েছিলেন, তাই না?
জামিলের দিকে কটমট করে তাকিয়ে রাজিব সিদ্দিকী বলল- আমি কাউরে কারো পিছে লাগাই নাই। আর শোনেন, আপনারা আমার বিরুদ্ধে কিছুই প্রমাণ করতে পারবেন না।
গফুর দারোগা এবার বলল- চলেন, আপনার যা বক্তব্য কোর্টে বলবেন।
জটলার মধ্য থেকে নজু মিয়া সামনে এসে দাঁড়ালে গফুর দারোগা নজু মিয়ার উদ্দেশ্য বলল- নজু, তুমি এখন মুক্ত। যেখানে খুশি যেতে পারো।
পুলিশের দলটি রাজিব সিদ্দিকী ও বলরাম হালদারকে নিয়ে বাজারের দিকে এগিয়ে চলল। আসামী নিয়ে পুলিশের ভ্যানটি চলে গেলে জামিল সাজু মিয়ার চায়ের দোকানে গিয়ে বসলো। তাকে দেখে উপস্থিত লোকজনের মধ্যে চলমান কথাবার্তা থেমে গেল হঠাৎ। সাজু হেসে জিজ্ঞেস করে- স্যার, চা দেব এক কাপ?
জামিল হেসে বলল- দাও।
চা শেষ করে উঠে পড়লো জামিল। রিকশার উদ্দেশ্যে কিছুটা পথ এগোতেই হঠাৎ রাস্তার একপাশ থেকে বিড়ালের ডাক শোনা গেল, পরপর তিনবার। জামিল সেদিকে ঘুরে দেখল- হাসিমুখে এগিয়ে আসছে হাসান।





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উপন্যাসঃ ফেরা (পর্বঃ ২১ - ২৫ - শেষ পর্ব)

এ ই উপন্যাসটিতে সম্মুখ সমরের কোন ঘটনা তুলে ধরা হয়নি।  ওয়ারফ্রন্টের কোনও দৃশ্য নেই। তবে এই লেখায় মূলত যে গল্পটি বলার চেষ্টা ক রা হয়েছে  তা মু...