বিদায়ের বাঁশিটা বেশ করুণভাবেই বেজেছিল বুকের গভীরে ওর। সবকিছু এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল সেদিন। ছোট্ট বুকের মাঝে সযত্নে লালন করা ভালবাসার সূতোটা আলগা হয়ে আসছিলো ক্রমশ। শক্তভাবে ধরার চেষ্টা করেও কোনভাবেই
অটুট রাখার উপায় ছিল না। কেবল
কান্নাটাকে গলার কাছে আটকে রেখেছিল কোনরকমে।
এই গ্রাম, গ্রামের সবুজ গালিচার মত নরম দূর্বাঘাসের স্পর্শ আর শান্ত
স্নিগ্ধ নদীটার বুকে ভোরের প্রথম সূর্যের টকটকে লাল রঙটা যখন ছড়িয়ে পড়ে, অদ্ভুত
ভাললাগায় ছেয়ে যায় মনটা। এগুলো
কোথায় পাবে খোকা?
আর বাবা?
বাবাকে ফেলে ও কোথায় যাবে? বাবাকে না দেখে যে থাকতে পারে না। কাছাকাছি
থাকা সত্ত্বেও দু-একদিন দেখা না পেলেই কেমন মন খারাপ লাগে। সেই বাবাকে রেখে এতদূরে কি করে থাকবে? বাবার কোমল উষ্ণ
আলিঙ্গনের ছোঁয়ার অভাবটা কেমন করে পূরণ হবে? গাঁয়ের দুরন্ত সাথীদের মুখগুলোও সব
একে একে ভেসে ওঠে মনে। ওখানে
কি এমন কাউকে পাবে ও? কত কথা মনে পড়ে যায়! ভর-দুপুরে ছাড়াবাড়ির বাগান থেকে ফল চুরি
করা কিংবা শেষ বিকেলে নদীর পাড়ের নরম ঘাসে ছুটোছুটি করা। ঐ ইট-কাঠের শহরে এগুলো কোথায় পাবে? ছোট্ট মনটা বিদ্রোহ করে ওঠে। বলে-
যেও না, তুমি এখান থেকে কোত্থাও
যেও না। নানীকে চুপিচুপি বলে,
আমি যাব না, বাবার কাছে থাকবো।
নানী মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
তোমাকে বড় হতে হবে না ভাই? এখানে থাকলে তো তা হবে না। ওখানে তো তুমি একা নও, আমিও থাকবো তোমার সাথে, মামা-মামী থাকবে। বাবা না হয় যাবে মাঝে মাঝে। ভয় কী!
রাতে বাবা আসে, গলার কাছের আটকে রাখা কান্নাটা আর চেপে রাখা গেল না। কেমন
অবলীলায় ঝরঝর করে বেরিয়ে এল দু’চোখ বেয়ে। বাবা দু’হাত দিয়ে চোখ মুছিয়ে দেয়, তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
তুমি যাও, আমিও কয়েকদিনের মধ্যেই চলে
আসছি। মন খারাপ করতে নেই বাবা। এই যে তোমার নানু, কত ভালবাসে তোমায়। মামা-মামীও তো কত আদর করে। ওনাদের কথা শুনবে। আর
তো মাত্র ক’টা দিন! তারপর বাবা চলে আসছি তোমার কাছেই।
বাবার দেয়া স্বান্ত্বনা-বাণী তাঁর উপস্থিত সময়টুকুতেই বজায় থাকে, তারপর
বাবা চলে গেলে আবার সেই শূন্যতা। সারারাত ছটফট করেই কেটে যায় খোকার। সকাল হলেই
প্রস্তুতি। মামাকে ভীষণ
ভয়, তাঁর সাথে স্বাভাবিক হতে পারে না
একটুও। মামীকে ভয় না পেলেও ওর যত আবদার নানীর কাছেই। বয়সের ভারে ন্যূজ হলেও নানী
ওকে আগলে রাখে যক্ষের ধনের মতই। তাঁর মৃত মেয়ের একমাত্র চিহ্ন। মেয়ে মারা যাবার
সময় শূন্য চোখে তাকিয়ে ছিল তাঁর দিকে। তার একমাত্র আদরের ধনটিকে হাতে তুলে দিয়ে
বলেছিলো,
মা, আমি তো পারলাম না, আমার বুকের ধনটিকে তোমার হাতেই সঁপে দিয়ে গেলাম; ও
যেন কষ্ট না পায়।
মা মেয়েকে কথা দিয়েছিলো, আজও বুক দিয়ে আগলে রেখেছে মেয়ের নাড়িছেঁড়া ধনটিকে।
পণ করেছে, যতদিন সে বাঁচবে হাতছাড়া করবে না প্রিয় নাতিকে, তারপর ওর বাবা তো রইলোই।
সকাল হতেই খোকা ছুটে যায় প্রিয় নদীটির কাছে। ওর নিঃসঙ্গতার সঙ্গী। দিনের
বেশির ভাগ সময়ই কাটে নদীর কাছে। দূরে নদীর ওপারে কাশের চর, সাদা
ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে। ঝাঁকে ঝাঁকে বকের ওড়াওড়ি! আরও দূরে ধোঁয়াটে গ্রামটা দেখা যায়।
মনে পড়ে, বড়মামার সাথে একবার গিয়েছিলো ঐ গ্রামে। আর কী যাওয়া হবে কোনদিন? নদীর ঢেউয়ে ভাসমান কচুরীপানাগুলো যেন ওর জীবনের প্রতিচ্ছবি! স্রোতে ভেসে
যায় অজানার পথে। বহুদূর থেকে ভেসে আসা ঢেউয়ের শব্দগুলো বুকের ভিতর আলোড়ন তোলে।
হায়রে নিয়তি! মা চলে গেল, সেইসাথে ওর স্থায়ী আবাসটুকুও হারিয়ে গেল। এখন শ্যাওলার মত ভেসে বেড়ানোই যেন ওর ভাগ্যলিপি। মামাকে গোসল করতে আসতে দেখে নদীর পাড় থেকে সরে আসলো খোকা।
মামা বলেছিলো, ‘একা একা নদীর কাছে যাবে না’, কিন্তু ও কী তা পারে! এখানেই যে ওর
আশ্রয়। মামার অগোচরেই অন্যপাশ দিয়ে
ফিরে যায় বাড়িতে।
আর মাত্র কয়েক ঘন্টা। তারপর এ গ্রামের মায়া কাটিয়ে চলে যেতে হবে। শহরের
খাঁচায় বন্দী জীবন কাটানোর কথা ভাবতেই কেমন কান্না পায় খোকার। পুকুর পাড়ের পানির
মধ্যে হেলানো হিজল গাছটার পাশে এসে দাঁড়ায়। ছোট ছোট লাল ফুলে পানিটা কেমন রঙিন হয়ে
আছে। সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে দেখে
পানিতে নিজের ছায়া পড়েছে। ছোট ছোট ঢেউয়ে
ছায়াটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। খোকা ভাবে, আহা! এদের ছেঁড়ে আমি কোথায় যাব? ও পায়ে পায়ে
স্কুলের মাঠের পাশের আমগাছটার নিচে এসে বসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই একে একে বন্ধুরা
এসে হাজির হয়। আজ সবার মন খারাপ। দুষ্টুমিতে মন নেই কারো। কেউ আর বলে না- ‘চল হাজিসাবের ছাড়াবাড়ি থেকে ফল পেড়ে আনি’। একজন হঠাৎ
বললো,
আমাদের কথা মনে থাকবে তোর?
খোকা কোন জবাব দেয় না। কেবল মনে মনে বলে-ভুলে
যাওয়া কী এত সোজা!
আরেকজন জিজ্ঞেস করে- আবার কবে আসবি?
খোকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে- জানি না।
মনে মনে ভাবে আমার ভাগ্যটা যেন কচুরিপানার মত, স্রোতের টানে কখন কোথায় যে
ভেসে যাই!
আরেকজন বলে ওঠে- ওর মা বেঁচে থাকলে ওকে গ্রাম ছেড়ে যেতে হত না।
নিজেকে বড়ই অসহায় আর পরগাছার মত লাগছিলো খোকার। কেন মা চলে গেল? কেন আমাকে
এখান থেকে ওখানে ভেসে ভেড়াতে হচ্ছে? প্রশ্নগুলো নিজের ভিতরেই ঘুরে বেড়ায় শুধু।
আজ
স্কুল বন্ধ, তাই মাঠটা ফাঁকা। অন্যদিন এমন সময় সরগরম থাকে। মাঠের পাশের পুকুরে ঝুপ
করে পাকা তাল পড়লো একটা। অন্য সময় হলে ওদের কেউ একজন সাথে সাথেই লাফ দিতো পানিতে।
আজ কেউ আর গেল না সেদিকে। তালটা পানিতে ডুবে রইলো।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়, সবার ভিতরেই একটা তাড়াহুড়া ভাব। শেষ মুহুর্তের
গোছগাছ চলছে। বেরিয়ে পড়তে হবে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই। নানী ওর কাপড়চোপড়, বইখাতা সব
গুছিয়ে নিয়েছে। একটু পর ঘরের সামনে কয়েকটা রিকশা এসে দাঁড়ায়। খোকা শেষবারের মত
দেখে নেয় ওর প্রিয় গ্রামকে, উৎসুক চোখ চারপাশে তাকিয়ে খুঁজে ফেরে একজনকে। নানী
বুঝতে পেরে বলে, বাবা লঞ্চে আসবে। খোকার মন কিছুটা শান্ত হয়।
লঞ্চ টার্মিনালে প্রচণ্ড ভিড়। গায়ে-গা লাগানো মানুষের দল এদিক-ওদিক
ছুটোছুটি করছে। যাত্রী, হকার আর লঞ্চের লোকজনের চিৎকার-চেচামেচিতে পুরো এলাকা
সরগরম। কেবিনে খোকার মন বসে না। ও
চলে আসে সামনের খোলা বারান্দায়। রেলিঙের সামনে দাঁড়িয়ে অধীর অপেক্ষা। টার্মিনালের লোকের ভিড়ে খুঁজে ফেরে প্রিয় মুখ। একসময়
চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বাবা এসেছে,
মন ভোলাতে এনেছে চকোলেট আর খেলনা।
বাবা-ছেলের কথকথা চলতেই থাকে। বাবার নানা উপদেশবাণী মন দিয়ে শোনে খোকা।
ঘুরেফিরে তার একটাই প্রশ্ন- ‘বাবা কবে ওর কাছে আসবে?’ বাবা আশ্বাস দেয়- খুব
তাড়াতাড়ি চলে আসবে।
সময় দ্রুত বয়ে যায়, লঞ্চটা হঠাৎ ভেঁপু বাজিয়ে জানিয়ে দেয় এখনই যাত্রা শুরু
হবে। বিদায়ের বাঁশিটা আবারও করুণ সুর তলে। শেষবেলায় এসে বাবার মনটাও কেমন করে ওঠে! ছেলেকে অনেক বুঝিয়ে লঞ্চ থেকে নেমে
যায়।
লঞ্চ ছেড়ে দেয়, একটু একটু করে দূরত্ব বাড়ে- বাবার সাথে, গ্রামের সাথে। বাবা
টার্মিনালে দাঁড়িয়ে দু’হাত নেড়ে বিদায় দিচ্ছে। খোকা দাঁড়িয়ে
আছে রেলিঙ ধরে, মামা এসে দাঁড়ায় পাশে। খোকার খুব কান্না পাচ্ছে কিন্তু কাঁদতে
পারছে না। আস্তে আস্তে লঞ্চ এগিয়ে যায়, বাবার অবয়বটি ক্রমশ ছোট হতে হতে একসময়
মিলিয়ে যায়।
সূর্য্য ডুবে গেলে আঁধার ঘনিয়ে আসে ক্রমশ। ছেলেটি রেলিঙ
ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। আজ সে বাবাকে ফেলে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। এতটা দূরে যে চাইলেই
বাবা যখন তখন তাঁর কাছে যেতে পারবে না। নাটাই থেকে সূতো ছেঁড়া ঘুড়ির মতই উড়ে চলেছে
সম্পুর্ণ আজানা অচেনা পরিবেশে। যেখানে কেউ ওকে চেনে না। কখন যে দু’চোখ বেয়ে নামে
অশ্রুর ধারা বুঝতে পারে না। চোখের জলমাখা কষ্টগুলো রাতের অন্ধকারের সাথে
মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন