বুধবার, ৩ অক্টোবর, ২০১৮

দূর আকাশের তারা


বৃষ্টিভেজা বিকেলটা বিষণ্ণতায় ছেয়ে আছে যেন। আজ সারাদিনই টিপটিপ করে ঝরছে। ভেজা, স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া। কেমন যেন মন খারাপ করে দেয়া। হাসপাতালের করিডোরে অনেক মানুষের জটলা। ছোট-বড় অনেক মানুষ। একটু দূরে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট। করিডোর থেকে শিশুদের একজন দু’জন করে সেখানে যাচ্ছে আর ফিরে আসছে। কেউ কেউ চোখ মুছছে। ভেতরে তাদের বন্ধু রোদেলা- মৃত্যুর সাথে লড়ছে। পেছনে সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে অহনা। চুপচাপ। চোখ দুটো ফোলা। তাকে শান্তনা দিচ্ছে কেউ কেউ। কিছুই বলছে না অহনা।
আজ এক-সপ্তাহ হল রোদেলা আইসিইউ’তে পড়ে আছে। একের পর এক লোকজন আসছে আর অশ্রুসজল চোখে ফিরে যাচ্ছে। কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না মাত্র কয়েক দিনে অবস্থা এতোটা খারাপ হতে পারে।
কিছুদিন আগেও রোদেলা ছিল প্রানবন্ত ফুটফুটে এক শিশু। সারাক্ষণ ঘরের এ-রুম থেকে ও-রুমে ছুটে বেড়াতো, অনর্গল কথা বলে মা-বাবাকে অস্থির করে তুলতো। স্কুলের বন্ধুদেরও অনেক প্রিয় ছিল রোদেলা। লেখাপড়া, গান, আবৃতি, ছবি আঁকা সবকিছুতেই ছিল প্রথম সাড়িতে। আত্মীয়স্বজন সবাই অহনাকে বলতো- তুই একটা লক্ষ্মী মেয়ে পেয়েছিস। গর্বে বুক ভরে যেত অহনার।
          দিন বিশেক আগে ব্যাপারটা প্রথম ধরা পড়েছিলোলিউকোমিয়া। পুরো ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে গেল যে ওরা ঠিকমত ভাববারও সময় পেল না। দু’দিন ক্লিনিকে রেখে নিয়ে যাওয়া হল পিজিতে, তারপর এখনে। আজ দশ দিন হয়ে গেল, উন্নতির কোন লক্ষণ নেই। একবার ভেবেছিল দেশের বাইরে নিয়ে যাবে কিন্তু সেই সময়টাও পাওয়া গেল না। অবস্থা এত দ্রুত খারাপ হল যে কেমো শুরু করতে হল।    
একে একে সবাই চলে গেল। হঠাৎ করেই যেন নিরব হয়ে গেল চারপাশ। বারান্দার এক কোণে একা দাঁড়িয়ে অহনাইভা পাশে এসে দাঁড়াল। অহনা ঘুরে তাকাতেই ইভা দেখল তার চোখ দুটো ভেজা। বৃষ্টিতে শাড়ির অনেকখানি ভিজে গেছে, খেয়াল নেই। ইভা ধরে একপাশে সরিয়ে আনলো।
মা এসেছে? অহনা জানতে চাইল।
এখনও এসে পৌঁছেনি। জ্যামে পথে আটকে আছে।
আপু, তুই সকাল থেকে কিছুই খাসনি। চল কিছু খেয়ে নিবি।
আমার খিদে নেই।
খিদে নেই বললেই হল! এভাবে চললে তুই নিজেই তো অসুস্থ হয়ে পড়বি।
আমার কিচ্ছু হবে না।
ইভা হাত ধরে জোর করেতেই রেগে গেল অহনা। জ্বালাসনে তো ইভা। আমাকে একটু একা থাকতে দে।
তুই কিছু খেয়ে নে, তারপর আর তোকে বিরক্ত করবো না।
তোরা কী পেয়েছিস আমাকে? আমার এখন কিচ্ছু খেতে ইচ্ছে করছে না।
ইভা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। একটু পর অহনা বলল- আমার এই এতটুকুন মেয়ে আজ কতদিন ওখানে পড়ে আছে! আমি কি করে খাবার মুখে তুলি বল। ঘুম থেকে জাগলেই মাকে খোঁজে, বাবাকে খোঁজে। আমরা দূরে দাঁড়িয়ে শুধু দেখি। কতবার ইচ্ছে হয় ওকে বুকে জড়িয়ে ধরি, পারি না। আমার এখন খাবার নিয়ে ভাবলে চলে? অহনা দু’হাতে মুখ ঢাকে। ইভা বোনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠে।
আমাদেরও কি খারাপ লাগে না আপু? শুধু তোর কথা ভেবে নিজেদের স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করি।   
সন্ধ্যায় আরও লোকজন এলো রোদেলাকে দেখতে। অহনার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। ওর দৃষ্টি কেবল কাঁচের ঘরটির দিকে। ভেতর থেকে ডিউটি ডাক্তার বেরিয়ে এল। একটু রেগে গিয়েই বলল,
ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের সামনে এত মানুষ কেন? একটু পর স্যার আসবেন, ভিড় দেখলে স্যার রেগে যাবেন। আপনারা এখান থেকে সরে যান। ইভা অহনার কাছে এসে ওকে বুঝিয়ে কেবিনে নিয়ে গেল।
ছোট্ট কেবিনটায় ভর্তি লোকজন, তবুও অহনার বুকটা বড় ফাঁকা লাগে। একটু পর রূপম আসলো মাকে নিয়ে। অহনা মায়ের দিকে তাকাতে পারছে না। মা এসে হাত ধরলেন। অহনার গলা ধরে আসছে। অস্ফুট স্বরে বলল,
মা, আমার তো আর কেউ রইলো না! আমি কি নিয়ে বাঁচবো?
মা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তিনি বোঝে রোদেলার ভাল হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু। তিনি তো মা, অহনার কষ্টটা তার থেকে ভাল আর কে বুঝতে পারবে অহনা পরিশ্রমটাই না করেছে মেয়েটাকে নিয়ে। একটা ভাল স্কুলে ভর্তির জন্য দিন রাত কষ্ট করেছে এই কোচিং সেই কোচিং, নিজে সারা দিন রোদেলাকে নিয়েই পড়ে থেকেছে। প্রায়ই অসুস্থ থাকতো রোদেলা, রাতের পর রাত জেগে থাকতে হয়েছে কে। মেয়েকে হারালে করে বাঁচবে? ওর জগতটাই তো রোদেলাকে নিয়ে! তবুও মেয়েকে সান্ত্বনা দিতে বললেন,
তুই একটু শান্ত হ, মা। আল্লাহর উপর ভরসা রাখ, সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমি জানি, কিছুই ঠিক হবে না মা। আমার রোদেলা আর কথা বলবে না। তুমি জান, পিজিতে থাকতে ও আমাকে কী বলেছে ?
মা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অহনার দিকে তাকালেন।
ও বলেছে- বাবা ওকে ডাকছে। ও না-কি স্বপ্ন দেখেছে-বাবার সাথে খেলছে। আমাকে বলে- আম্মু আমাকে মাফ করে দিও। আমার এতটুকু মেয়ে আমার কাছে মাফ চায়। মা, আমি আর সহ্য করতে পারছি না।
ও একটা বাচ্চা মেয়ে, ওর কথা ধরতে নেই মা! 
          মা মনকে শক্ত করলেন। তিনি জানেন, কোন সান্ত্বনাই অহনাকে এখন শান্ত করতে পারবে না। যে করে হোক ওকে বাসায় নিতে হবে। ওর রেস্ট দরকার।
          বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে অমিত। দূরে বাড়িগুলোর উপরে আকাশে চাপ চাপ কালো মেঘ জমেছে। অমিতের খুব নিঃসঙ্গ লাগছে। চারপাশে এত মানুষ, তবুও। অহনা এখনও কাঁদছে, কিন্তু সে তো কাউকে কিছু বলতে পারছে না, কেবল ভিতরে ভিতরে নিঃশ্বেষ হচ্ছে। রুপমের ডাক শুনে ফিরে তাকায় অমিত।
আবিদ ভাই তোমাকে ডক্টর’স রুমে দেখা করতে বলেছে।
অমিত এগিয়ে গেল ডক্তরস রুমের দিকে।
ড. আবিদের মুখোমুখি বসে আছে অমিত। সে রোদেলার ফাইলটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। অমিত চুপচাপ বসে আছে। থমথমে চেহারা। ড. আবিদ অমিতের দিকে তাকিয়ে কিছুই বলতে পারলো না। শুধু হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বলল- মন শক্ত কর।
কিছুই কি করার নেই? মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করলো অমিত।
তুমি বুদ্ধিমান মানুষ, তোমাকে আর কি বোঝাবো? আমরা চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখিনি। তুমি বরং ভাবীকে সমলাও, তাকে সাহস যোগাও।
অমিত নির্বাক চোখে ড. আবিদের দিকে তাকিয়ে আছে।
ড. আবিদ বলল- দেখি আজ রাতে একটা বোর্ড বসাবো।
অমিত উঠে পড়লো।  
কি বলল ডক্টর? অমিত কেবিনে ফিরতেই ছুটে এসে জানতে চাইল অহনা।
আজ রাতে আবার বোর্ড বসবে।
অহনা অমিতের মুখের দিকে তাকালো। অমিত আর কিছু বলল না। অন্যদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল। রূপম এসে পাশে দাঁড়ালো।
ভাবী, তোমার আজ বাসায় ফেরা দরকার। চল আমি তোমাদের পৌঁছে দিয়ে আসি। রাতে আমিই থাকবো।
আমি আজ কোথাও যাব না। তুমি মাকে নিয়ে বাসায় চলে যাও।
মা কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে- তুই কতরাত ঘুমাস না। আজ বাসায় চল। লাগলে কাল আবার চলে আসিস।
তুমি শোননি আজ আবার বোর্ড বসবে? আমি কোথাও যাব না। তোমরা চলে যাও।
অহনাকে অনেকটা জোর করেই বাসায় নিয়ে যাওয়া হল। এক সপ্তাহ পর আজ বাসায় ফিরলো সে।  
রাত বারোটা। রূপম ঘুমিয়ে পড়েছে কিছুক্ষণ আগে। অমিত একা জেগে আছে কেবিনে। জানে আজ আর ঘুম আসবে না। হাসপাতালে যতদিন থেকেছে এমনই হয়েছে। বাইরে তাকিয়ে দেখলো বৃষ্টি বেড়ে গেছে। অমিত নিচে নেমে আসলো। ডক্টরস রুমে ড. আবিদকে বসে বসে একা থাকতে দেখল। অমিত ভেতরে ঢুকলো না। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের সামনে এসে দাঁড়ালো।
অমিত গ্লাসের ভেতরে তাকাল। শুয়ে আছে রোদেলা। স্থির, চোখ দু’টি বন্ধ। এ ক’দিনে মেয়েটাকে যেন চেনাই যাচ্ছে না। অমিত চোখ মুছলো, তারপর নিঃশব্দে চলে আসলো। করিডোর ধরে হেঁটে শেষ মাথায় এসে দাঁড়াল। বাইরে থেকে বৃষ্টির ছাট এসে লাগছে চোখেমুখে। চারদিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল পুরো শহরটা ঘুমিয়ে পড়েছে। নিচে নির্জন রাস্তায় সোডিয়াম লাইটের আলোয় দু’একটা গাড়িকে দ্রুতবেগে ছুটে যেতে দেখা যাচ্ছে। অমিত ঘড়ি দেখলো। রাত একটা। ধীরে ধীরে হাঁটা দিল কেবিনের দিকে।    
দু’দিন কেটে গেল। রোদেলার অবস্থা আরও অবনতি হল শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ল ইনফেকশন পরিস্থিতি এতটাই জটিল হল যে শরীরে ক্যানোলা বসানোর মত অবস্থাও রইল না।
পরদিন সকালে মারা গেল রোদেলা।

এক মাস পর-
হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে অহনা। জানালার দিকে তাকিয়ে। বাইরে উন্মুক্ত আকাশ। শরতের ঝকঝকে নীল আকাশ। হালকা বাতাসে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে। বালিশের পাশে কয়েকটা বই রাখা, ইভা গতকাল দিয়ে গেছে। এখন আর পড়তে ইচ্ছে করে না। কেন যেন মন বসে না। অহনা ঘরের ভেতরে একবার চোখ বোলায়। ছোট্ট একটা রুম। পুরোটাই সাদা। সাদা বিছানা, সাদা দেওয়াল, সাদা ওয়ারড্রব, এমনকি জালানার গ্রিলগুলোও সাদা। বাইরে নীল আকাশে সাদা মেঘগুলো সরে যাচ্ছে এ-দিক থেকে ও-দিকে। অহনার ক্যানোলা লাগানো বাম হাতটার দিকে তাকায়। হঠাৎ তার মনে প্রশ্ন আসে- সে কি খুব অসুস্থ? শরীরে তো কোন ব্যথা নেই! আর কতদিন এখানে থাকতে হবে? তার খুব মন খারাপ লাগে। মাথার কাছে বসে মা জিজ্ঞেস করলেন-
কিছু খাবি? একটা ফল কেটে দেই?
অহনা একবার মায়ের দিকে ফিরে তাকিয়ে আবার জানালার দিকে সরিয়ে নিল দৃষ্টি। কিছু বলল না। মা একটা আপেল কেটে আবার মেয়েকে ডাকল-
অনু, আপেলটা খেয়ে নে।
না, আমার কিচ্ছু খেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি যাও তো।
মা এবার চটে যায়। এই, ঘুরে তাকা আমার দিকে। খালি খামখেয়ালী করে।
আমার খেতে ইচ্ছে করে না, কী করব?
একদম কথা বলবি না। চুপচাপ খেয়ে নে। মা এবার ধমকে উঠলেন।
অহনা মায়ের দিকে ফিরে স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করে- রোদেলা খেয়েছে? এখন তো ওর দুধ খাওয়ার সময়।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে মা বললেন- খেয়েছে, তুই এখন খা।
ওকে নিয়ে আসো না কেন? মায়ের দেয়া আপেলের টুকরা মুখে দিতে দিতে অহনা বলে।
ডাক্তার নিষেধ করেছে। অন্য রুগিদের সমস্যা হয়।
আমি আর হাসপাতালে থাকবো না, আমাকে বাড়ি নিয়ে চল। আমি তো এখন সুস্থ।
আমরা বললেই তো হবে না-রে মা, ডাক্তার রিলিজ দিলেই নিয়ে যাব।
আচ্ছা, রোদেলার খাওয়া, ঘুম, লেখাপড়া ঠিকমত হচ্ছে তো? ওর গানের স্কুল, আর্টের স্কুল- সবকিছু?
হচ্ছেরে মা, তুই ওকে নিয়ে চিন্তা করিস না।
ইভাকে বলবে, ওকে যেন না বকে। আমার মেয়েকে আমি ছাড়া কেউ বকতে পারবে না।
মা অভয় দেন। ঠিক আছে, আমি ইভাকে বলে দেব।
অহনা কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে আবার অস্থির হয়ে ওঠে। এই হাসপাতালের বদ্ধ ঘর আর ভাল লাগে না। আমি বাড়ি ফিরতে চাই।
মা কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলে- বললাম তো, ডাক্তার ছেড়ে দিলেই বাড়ি যাব।
মা বিরক্ত হচ্ছে বুঝতে পেরে অহনা আর কিছু বলে না। চুপচাপ জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে।
সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পর ডাক্তার এল। অহনা কিছুটা রাগত স্বরে তাকে বললো, আমাকে আটকে রেখেছেন কেন? আমি কবে ছাড়া পাবো?
ডাক্তার মৃদু হেসে বললেন, এই তো, আর ক’টা দিন পরেই ছেড়ে দেব। আপনি সুস্থ হলেই বাড়ি চলে যাবেন।
আরে! আমি তো সুস্থ, আমার তো কিছুই হয়নি। আমার মেয়েকে এখানে আসতে দিচ্ছেন না কেন? জানেন না আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারি না।  
পাশে দাঁড়ানো ইন্টার্নি ডাক্তার নিচু স্বরে বলল, পাশের রুমের রুগিটার খুব কড়া মেজাজ। বাচ্চাদের দেখলেই তেড়ে আসে। তাইতো আপনার মেয়েকে আনতে নিষেধ করেছি।
ও আচ্ছা! তাহলে ঐ লোকোটাকে তাড়িয়ে দেন।
ডাক্তার হেসে বলল, হ্যা, আর কিছুদিন পরই উনি চলে যাবেন।

          অমিত এল রাত ন’টায়। অহনা তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। অমিত তাকে আর জাগালো না। ডাক্তারের সাথে দেখা করার জন্য বেরিয়ে গেল। প্রায় আধ ঘণ্টা পর ফিরে এসে দেখল অহনা জেগে উঠেছে। অমিতকে দেখেই রেগে গেল,
          তুমি সারাদিন কোথায় থাক? আমার এখানে আর ভাল লাগছে না। আমাকে এখান থেকে নিয়ে চল।
          অমিত স্মিত হেসে বলল, এইতো আর কয়েকটা দিন। ডাক্তার বলেছে আরেকটু সুস্থ হলেই তোমাকে ছেড়ে দেবে।
          রোদেলা কেমন আছে?
          অমিত শ্বাশুরির দিকে একবার ঘুরে তাকালো। তারপর ছোট্ট করে বলল, ভাল।
          এভাবে বলছ কেন? মনে হয় তুমি ঠিকমত ওর খবরই রাখ না।
          না না, তা কেন? তুমি এসব নিয়ে ভেব না তো।
ঠিক আছে। তুমি আর বেশিক্ষণ এখানে থেকো না, মেয়েটা বাসায় একা।
          তুই চিন্তা করিস না, ইভা আছে না! অহনার অস্থিরতা দেখে মা বলে উঠলো।
          তবুও। ও মেয়ের কাছে থাক।
          অমিত আরও কিছুক্ষণ থেকে রুম থেকে বেরিয়ে এল। পেছনে শ্বাশুরির পায়ের শব্দ শুনে বারান্দায় দাঁড়াল।
ডাক্তার কি বলল অমিত?
বলল তো আরও সময় লাগবে। আমি ভাবছি ওকে নিয়ে বাইরে কোথাও ঘুরে এলে কেমন হয়।
শ্বাশুরি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, দেখ, যা ভাল মনে কর।

          প্রায় তিনমাস পর বাড়ি ফিরলো অহনাবাড়িটা যেন এক শোক পুরী। সারা ঘর জুড়েই রোদেলার স্মৃতিচিহ্ন। ওর রুমের দেয়ালে টাঙ্গানো রোদেলার আঁকা ছবি, বইখাতা, হরমোনিয়াম, খেলনা- এগুলো কিছুই সরাতে দেয়নি অহনা। সবকিছু আগের মতই আছে, শুধু প্রাণোচ্ছল হাসিখুশি সেই মেয়েটা নেই! অহনা সেই আগের মতই সারাক্ষণ গুম মেরে বসে থাকে। চুপচাপ, যেন অন্য ভুবনের বাসিন্দা। রাতে ঘুমের মধ্যে হঠাৎ জেগে ওঠে বসে থাকে ছুটে যায় রোদেলার ঘরে। রোদেলার প্রতিটা জিনিস ধরে নাড়াচড়া করে আবার রেখে দেয়।  
রাত তিনটা। অমিত পাশ ফিরে দেখে অহনা বিছানায় নেই। রোদেলার রুমে খুঁজে না পেয়ে বারান্দায় এসে দেখ অহনা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। বাহিরে হিম ঝরছেঅমিত ভেতর থেকে চাদরটা এনে গায়ে জড়িয়ে দিলঅহনা ঘুরে তাকিয়ে অমিতকে দেখল একবার। দুজনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। অমিত বলল,
চল, ঘুমাতে চল।
ঘুম আসছে না যে! অহনা জবাব দেয়।
অহনার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় অমিত। অমিতের বুকে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে ওঠে অহনা। দু’জনেই কাঁদে। অনেকদিনের জমানো কান্না।
কত কথা মনে পড়ে যায় অহনার! রোদেলার যখন চার বছর, দুষ্টুমি করলে ও বলত এমন করলে আমি মরে যাব ঐ আকাশের তারা হয়ে যাব। আমাকে আর খুঁজে পাবি না। রোদেলা ছুটে এসে কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ত, আর বলত তুমি মরে যেওনা আম্মু, আমি আর দুষ্টুমি করবো না। আজ রোদেলাই নেই। ওকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল। এরকম আরও কত কথা, কত ভাবনা আসে মনে!  
অমিত আর অহনা অন্ধকারে বারান্দায় বসে থাকে। ঠাণ্ডা হাওয়া এসে লাগে চোখে-মুখে। দুজনের বুকের ভিতর চলে রক্তক্ষরণ, অবিরাম। এ ক্ষরণ যেন শেষ হবার নয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উপন্যাসঃ ফেরা (পর্বঃ ২১ - ২৫ - শেষ পর্ব)

এ ই উপন্যাসটিতে সম্মুখ সমরের কোন ঘটনা তুলে ধরা হয়নি।  ওয়ারফ্রন্টের কোনও দৃশ্য নেই। তবে এই লেখায় মূলত যে গল্পটি বলার চেষ্টা ক রা হয়েছে  তা মু...