শান্তনা
মাঝে মাঝে ভাবে, ‘তারা
তো নিচু জাতই, সবাই সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেই কি আর না
দিলেই কি!’ নিজেকে বদলে যাওয়া সময় আর পরিবেশের
সাথে ঠিকই মানিয়ে নিয়েছে সে। অনেকেই চলে যেতে উৎসাহ দিয়েছিলো, তবে সেই উপদেশের মধ্যে যে চাতুর্য ছিল তা বুঝতে একটুও অসুবিধে হয়নি
শান্তনার। হয়তো চলেও যেতো, তবে কিসের আকর্ষণে যে রয়ে গেলো
তা সে নিজেই জানে না। পথ যদিও নির্ধারণ করে দেয় না জীবনের গতি-প্রকৃতি, তবুও কিছু কিছু মানুষ স্মৃতি আঁকড়ে পড়ে থাকে- সেই চেনা পথের বাঁকে।
খুঁজে বেড়ায় জীবনের ফেলে আসা মাধূর্য, রঙ-রস আর হারানো
স্মৃতি।
ঠিক পাঁচটায় ঘুম ভেঙে গেল
শান্তনার। প্রতিদিন এই সময়ই ভাঙে। শীত, গ্রীষ্ম কিংবা ভারী বর্ষায়ও। কাকভোরে উঠে তড়িঘড়ি করে ছুটতে হয় কাজে। সংসারে আপন বলতে একমাত্র ছোট
ভাই অপু। কিশোরী শান্তনা হাই স্কুলে গণ্ডিও পেরোয়নি- ঠিক তখনই
বাবা ওকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল। আর
মা, কয়েক বছর ওদের দু ভাই বোনকে আগলে রেখে সেই যে বিছানায়
পড়লো, আর উঠলো না। দুই বছর ভোগে, শুধু ভোগে না বলে বলা যায় সবাইকে
ভোগায়। তারপর সব শেষ। সেই
থেকে শান্তনার মাথার উপর আর কেউ থাকে না। পাশে থাকে শুধু অপু। ওর জন্য অপু আর অপুর
জন্য ও।
শহরে একটি হাসপাতালে নার্সের
চাকরী করে শান্তনা। বাবা-মা মারা যাওয়ায় লেখাপড়া বেশিদূর এগোয়নি। এস এস সির গণ্ডিটা পার করেছিল কেবল। তারপর অনেক কষ্টেসৃষ্টে ট্রেনিঙটা শেষ করতে পেরেছিল। বাবার
এক বন্ধুর সুপারিশে চাকরিটাও জুটে গেল। এখন এই ছোট চাকুরীটিই ভরসা। যা আয় হয় দু
ভাই-বোনের চলে যায় কোনরকমে। প্রতিদিন প্রায় চার মাইল পথ পায়ে
হেঁটে গঞ্জে পৌছে, সেখান থেকে ভ্যান কিংবা টেম্পু করে
জেলা শহরে। আসতে যেতে অনেকটা সময় পথেই চলে যায়। বৃষ্টি হলে তো কষ্টের শেষ নেই। এই লম্বা পথ কাঁচা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে প্রায়ই ভিজতে
হয়।
তাড়াতাড়ি চারটা খেয়ে বেরিয়ে পড়লো শান্তনা। বাড়ি থেকে বের হয়ে ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে তৈরি নতুন পথ ধরে হেঁটে
চলল। সময় বাচাঁনোর জন্য মূল রাস্তায় না গিয়ে অনেকেই এখন এই
পথটা ব্যবহার করে। একপাশে সবুজ কলাই আর অন্য পাশে হলুদ সরিষার ক্ষেত। কলাই-সরিষা ক্ষেতে তখন ধোয়া-ওঠা কুয়াশা। আবছা একটা আবরণ
আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে চারপাশটা। স্বল্প দূরত্ব সামনে বড় রাস্তাটিও এখন অস্পষ্ট।
পাশের কলাইয়ের ক্ষেতে দাঁড়ানো হিজল গাছটিও কুয়াশায়
আবৃত। স্থির, আবক্ষ মূর্তি একটা। মাথার সিঁথির মত সরু মেঠোপথে কাদা
জমেছে; পিচ্ছিল, আঠালো। জুতোর নিচে পুরু স্তর। জুতো খুলে হাতে
তুলে নিলো শান্তনা। বড়
রাস্তায় উঠতে উঠতেই কাদায় মাখামাখি। স্কুলের সামনের টিউবওয়েলে পা ধোয়। তারপর শুরু হয় পায়ে হেঁটে গঞ্জের পথে যাত্রা।
এই গ্রামে হিন্দু জনবসতি খুবই কম। একসময় অনেকগুলো অবস্থাশালী পরিবার ছিল।
বিভিন্ন পূজা পার্বণে উৎসবমুখর হয়ে উঠত সারা গ্রাম। হিন্দু মুসলমান সবাই মিলে
আনন্দে মেতে উঠত। এখন সেই দিনগুলি কেবলই স্মৃতি। হিন্দুর সংখ্যা কমতে কমতে এখন
কয়েক ঘরে এসে ঠেকেছে। বেশীর ভাগই চলে গেছে ওপারে। যারা এখনো পড়ে আছে তারা নিতান্তই
নিম্ন বর্ণের। অনেকে
এদের গ্রাহ্যের মধ্যেও আনে না। প্রভাবশালীদের দাপটে কোণঠাসা, এদের মধ্যেও যারা গরীব তারা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। শান্তনারা সেই
গুটিকতক পরিবারের মধ্যে একটি। বাবা মা হারা হওয়ায় আরও অসহায়।
কাজ শেষ করে হাসপাতাল থেকে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায় শান্তনার। স্কুলের সামনের
রাস্তা ছাড়া বাড়ি যাওয়ার আর কোন বিকল্প পথ নেই। এখান দিয়ে যাবার সময় অবচেতন মনে
হলেও একবার ক্লাবঘরের দিকে তাকায়, উৎসাহী দু’চোখ কী যেন খোঁজে।
প্রতিদিনের মত আজও ক্লাবের সামনের পথ ধরেই ফিরছে শান্তনা। ক্লাবঘরের কাছাকাছি আসতেই দেখে দরজা দিয়ে বের
হচ্ছে সত্যেন। একবার সত্যেনের দিকে তাকায় শান্তনা, আবার
চোখ নামিয়ে নেয়। এগিয়ে চলে নিজের পথে।
স্কুল সংলগ্ন ক্লাবঘরটি
বিকেল থেকেই সরগরম হয়ে ওঠে। গ্রামের বিভিন্ন বয়সী তরুণ-যুবাদের বিনোদনের
কেন্দ্রবিন্দুই হল এই ক্লাব। প্রতি বছরই ক্লাবের উদ্যোগে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক
অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ক্লাব প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই এর দায়িত্বে আছে সত্যেন।
কেমন আছস অনু?
থমকে দাঁড়াল শান্তনা।
অনেকদিন পর সত্যেনের কণ্ঠে ওর নাম শুনে কিছুটা অবাকও হল। একই এলাকায় বসবাস অথচ
দুজনের মাঝখানে আজ দূরত্বটা অনেক বেশী! সত্যেনের মুখোমুখি দাঁড়াল ও।
ভাল আছি, তুমি কেমন আছ সত্যদা?
ভাল। তোর সাথে কিছু কথা আছে?
হঠাৎ চমক
লাগলো শান্তনার। মনে মনে বলে- এতদিন পর আমাকে তোমার কী প্রয়োজন সত্যদা? তোমার কাছে
আমি তো এখন অতীত। এই কথাগুলো মনেই থাকল, মুখে শুধু বলল-
কী কথা?
কও।
আমরা এইবার ক্লাব থেকে একটা নাটক করুম ঠিক করছি। নার্সের চরিত্রে একটা মেয়ে
দরকার, কিন্তু কাউরে মিলাইতে পারতাছি না। তুই কি অভিনয় করতে
পারবি?
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল শান্তনা। মনে মনে ভাবলো- ও, তাহলে এই কথা! আজ নিতান্ত প্রয়োজনেই
এই আলাপচারিতা!
কী-রে! কি ভাবতাছোস, পারবি?
তোমার কি মনে অয়, আমি পারুম?
তুই তো নার্সের চাকরি করস, তোর তো পারার কথা।
তুমি যহন কইতাছ, তয় চেষ্টা করতে পারি।
হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়া সময় দিতে পারবি তো? রিহার্সেল
করতে অইব কিন্তু।
আচ্ছা, আগে থেইক্যা টাইমটা জানাইয়ো।
ঠিক আছে, আগেই জানামু।
শান্তনা বাড়ির দিকে হাটতে থাকে। অনেকদিন পর আজ এই নামটা শুনলো। মনের মধ্যে
বাজতে থাকে সত্যদার কণ্ঠস্বর- অনু... অনু... অনু... অনু... অনু......। এই জগতে
একমাত্র দু’জন মানুষ তাকে এই নামে ডাকতো।
একজন বাবা আর একজন এই সত্যদা। বাবা দেহ
রেখেছে সেই কবে! আর সত্যদাও আর আগের মত নেই। মানুষ বদলে যায়। সময়, পরিস্থিতি মানুষকে বদলে দেয়। আজ অনেকদিন পর সত্যদা ওর সাথে কথা বলল। মনে আশা জাগে, মন স্বপ্ন
দেখতে চায়, পরক্ষণেই আবার মিলিয়ে যায় অন্ধকারে। নিজের
অবস্থান ভেসে ওঠে চোখের সামনে। শান্তনা কারো কাছ থেকেই আর কিছু আশা করে না। মনে
মনে শুধু বলে, অনু হারিয়ে গেছে সত্যদা, এখন আমি শুধুই শান্তনা।
প্রথম সন্তান বাবা-মা’র অনেক আদরের হয়। জন্মের
পর বাবা মা ভালবেসে ওর নাম রাখে অনামিকা। অনামিকা দাশ। বাবা মা আদর করে ডাকে অনু।
জন্মের দু’বছরের মাথায় কঠিন এক অসুখ হয় অনুর, প্রায় না বাঁচার মত অবস্থা।
কুসংস্কারে আচ্ছন্ন লোকজন বলাবলি করে এই নামটার কারণেই ওর অসুখ ছাড়ে না। অনেকে বলে
ওর নামটা বদলে ফেল, তাহলে অসুখ ভাল হয়ে যেতে পারে। আদরের
সন্তানকে বাঁচাতে যে যাই বলে মা-বাবা যেন তা পালন করতে আর দেরী করে না। ওর নাম
বদলে ফেলা হল। সেই থেকে অনু হয়ে গেল শান্তনা। তবে নাম বদলে গেলেও বাবার ডাকটা কিন্তু বদলায়নি। তার কাছে অনু অনুই রয়ে গেল। গ্রামের অনেকে অবশ্য শান্তনা নামটা
আরও ছোট করে নিয়েছে, কেউ কেউ এখন
ওকে ডাকে শান্তি বলে।
ভাবতে ভাবতে শান্তনা বাড়ির পথে হাঁটে আর মনে ভাসে সত্যদার সাথে হারানো
দিনগুলোর স্মৃতি। দু’জনে কত ছুটোছুটি করেছে
গাঁয়ের পথে পথে! তখন ছোট ছিল, বাবা মাও বেঁচে ছিল।
সত্যদা বলত- তোরে আমি কোনদিনই শান্তনা ডাকুম না। তুই অনু, তোরে আমি অনুই ডাকুম। ঠিক আছে ডাইকো। বাবা-মা মারা যাবার পর ধীরে ধীরে
বদলে যেতে থাকে সবকিছু। আজ শান্তনা সবার কাছেই অস্পৃশ্য। এমন কি সত্যদার কাছেও!
হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার মাথার ব্রিজের
কাছে চলে আসলো শান্তনা।
রেলিঙের উপর বসে আড্ডা দিচ্ছে গ্রামের কয়েকজন যুবক। প্রতিদিনই দেয়, সন্ধ্যার পর এটাই ওদের আস্তানা। শোনা যায় এখানে বসে এরা নেশাও করে।
এদের সবাইকেই চেনে শান্তনা। লিয়াকত, নিমাই, কালু, ফজলু, ব্রজেন-
গ্রামে বখাটে হিসেবে এদের বেশ দুর্নাম আছে।
ব্রিজ পার হয়ে মেঠোপথে নামার মুখে এসে দেখল সামনে দাঁড়ানো তৈয়ব। ওর দিকে
তাকিয়ে। দৃষ্টিতে কি যেন আছে, ভেতরটা
কেঁপে ওঠে শান্তনার।
কি-রে শান্তি, এত দেরী করে ফিরলি যে! হাসপাতালে কি এমুন কাম?
কাম না থাকলে কেউ কী দেরী করে? এদ্দুর
থেইক্যা আইতেও তো সময় লাগে। আর আমি দেরী করলে আপনের কী?
না, একলা একলা ফিরস তাই কইলাম।
আমি একলা চলতেই পছন্দ করি। দেখি, রাস্তা
ছাড়েন।
বড় রাস্তা থেকে নেমে মেঠোপথ ধরে বাড়ির পথ ধরে হাঁটে শান্তনা। তৈয়ব কি যেন
বলতে চায়, না শোনার ভান করে সামনে এগিয়ে যায়। শান্তনা
জানে তৈয়বরা কি চায়। এই গ্রামে অনেক তৈয়ব আছে, এরা শুধু
চায়। তার এই একুশ বছর বয়সে জীবনের অনেক রঙ-রুপ দেখে ফেলেছে। মানুষের ভেতর বাহিরের
পার্থক্যও খুব সহজেই বুঝতে পারে। মাঝে মাঝে মনে হয় অপুকে নিয়ে চলে যায় গ্রাম ছেঁড়ে
কিন্তু পারে না। কোন এক অদৃশ্য সূতোয় বার বার বাঁধা পড়ে যায়।
নিশুতি রাতের নিকষ কালো অন্ধকার। একলা একা ঘরে মনে কেমন ভয় ধরে যায়। সামনের ঘরে অপু ঘুমিয়ে পড়েছে সেই কখন! ঘরের পিছনে
পেঁচার ডাক কিংবা কোন প্রাণির
শুকনো পাতা মাড়ানোর শব্দে বুকের মধ্যে অন্যরকম শঙ্কা জাগে। পানিতে কিছু পড়ার আওয়াজ আসে- গা ছমছম করে! ঘরের চালে বিড়াল কিংবা কাঠবিড়ালীদের
ছুটোছুটি ভয়ের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় আরও অনেক। এরকম অনেক কিছু। অথচ শান্তনা জানে এগুলো খুবই স্বাভাবিক ও
নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ। তবে, এ ভয় অশরীরী কোন কিছুর
নয়, অন্যকিছুর। আরও ভয়ের, আরও
হিংস্র কিছুর! চোখে ভাসে কিছু কুৎসিত মুখের ছবি। বিছানার
নিচে ধারালো রামদা’টার অস্তিত্ব পরখ করে একবার। তারপর শুয়ে পড়ে।
ইদানীং বিকেল হলেই এলাকায় ফিরে আসে শান্তনা। নাটকের রিহার্সেল নিয়ে সন্ধ্যার
পরেও ক্লাবঘরে ব্যস্ত থাকতে হয়। নার্সের চরিত্রে নিজেকে বেশ মানিয়ে নিয়েছে সে। তার
পারফরমেন্সে সবাই বেশ সন্তুষ্ট। শান্তনার নিজেরও চেষ্টার কোন কমতি নেই। মনপ্রাণ দিয়ে সে সত্যদার কথামত অভিনয় করে চলে। মাঝে
মাঝে সত্যদার সাথে চোখাচোখি হতেই মনে হয় সে যেন গভীরভাবে নিরীক্ষা করছে ওকে। কখনও
কখনও তাকে খুব রহস্যময় মানুষ মনে হয়। রিহার্সেল শেষে সত্যদা যখন হাসিমুখে ‘ওয়েল
ডান’ বলে ওর দিকে তাকায়, তখন ক্ষণিকের জন্য হলেও অনেকদিনের চেনা সত্যদাকে খুঁজে
পায়। আবার পরক্ষণেই যেন বদলে যায়
মানুষটি। তখন মনে হয় সত্যদা যেন অনেক দূরের মানুষ।
স্টেজের সামনে বসা আগ্রহী দর্শক। আজ সবকিছু ভুলে গেছে
শান্তনা। প্রাণপণে সত্যেনের সেবা-শুশ্রুষা করে চলেছে। ডাক্তার বলেছে এ রোগীর জন্য
ঔষধের চেয়ে বেশী প্রয়োজন নার্সিং। জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছে সত্যেন, শান্তনার
কপালে চিন্তার রেখা। চোখের কোণে জল। অবিরাম সেবা-যত্ন করে আর প্রার্থনা করে সত্যেন যেন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যায়। তার অক্লান্ত সেবায় চোখ মেলে তাকায় সত্যেন। শান্তনার মুখে হাসি। চোখে
আনন্দের দীপ্তি। সত্যেন কৃতজ্ঞ চিত্তে চেয়ে থাকে শান্তনার দিকে। চোখে চোখে কথা, আলতো হাতের ছোঁয়া! শান্তনার মনে আনন্দের ঢেউ খেলে যায়। কানে বেজে ওঠে
সত্যেনের কণ্ঠস্বর- অনু... অনু... অনু... অনু... । ফর্সা গালে গোলাপী রঙ লাগে।
বুকের ভিতর সুখের কাঁপন জাগে, ছড়িয়ে পড়ে সারা দেহমনে। তখন পর্দা পড়ে যায়। দর্শকদের
হাততালি, প্রশংসা। শান্তনার চোখে জল। এ জল প্রশংসার জন্য নয়, অন্য কিছুর জন্য।
শো শেষে দর্শকরা বিদায় নিলে একসময় ফাঁকা হয়ে গেল স্কুলের মাঠ। শান্তনা বাড়ি যাবার জন্য বের হতে গিয়ে দেখল সত্যেন তাকে
ইশারা করছে।
অনু, একটু খাড়া। রাইত অনেক অইছে, হাতের কামডা শেষ কইরা তোরে আগাইয়া দিমুনে।
ঠিক আছে সত্যদা। তুমি কাম শেষ কর, আমি
অপেক্ষা করতাছি।
সত্যেন শান্তনার সাথে বেরিয়ে পড়লো।
দুজনে হাঁটছে শান্তনাদের
বাড়ির পথে। কতদিন পর আজ একসাথে এই পথে সত্যেনের সাথে হাঁটছে শান্তনা! দুজনেই
চুপচাপ। একই পথ দিয়ে প্রতিদিনই যাওয়া আসা করে সে, তবে
আজকের এই মুহুর্তটি যেন বহু প্রতীক্ষিত। চাঁদ তখন মধ্য
আকাশে। শান্তনার মনেও ছড়িয়ে পড়ে সেই চাঁদের আলোর
রেশ। ব্রিজের উপর এসে একটু দাঁড়ায়। এখানে খালের দু’পাশের ঘন
গাছ-গাছালির ছায়া।
কি-রে, এইহানে খাড়াইলি ক্যান?
এমনিই। হঠাৎ মনে পড়ল ঠিক এই পুলের নিচে থেইক্যা তোমার লগে কতদিন নৌকায়
উঠছি!
হেইডা তো ছোডকালের কথা।
খুব কি আগের কথা সত্যদা?
সত্যেন চুপ।
কী হইল সত্যদা, কথা কও না ক্যান?
যেইদিন চইলা গ্যাছে তারে আর মনে করা ক্যান? এখন
ভবিষ্যতের কথা ভাব।
আর ভবিষ্যত! আমগো মত গরীবের আবার ভবিষ্যত কি কোনরকম দিন কাইটা গেলেই হয়।
দিন তো সবারই যায়, সেই দিনগুলা যাতে ভাল কাটে সেই
ব্যবস্থা করা দরকার।
আমগো ছোডকালডাই অনেক ভালা আছিলো। শান্তনা রেলিঙ
ধরে উপরে তাকায়। ওখানে কুয়াশা ঢেকে রেখেছে আকাশ। দূরে এলোমেলো জোনাকির মৃদু আলো
চোখে পড়ে।
ছোডকালের কতা ভাইবা কী হইবো? এহন
বয়স অইছে, ভালভাবে চলাফেরা করিস। গ্রামে তোরে নিয়া নানান
কথা অয়।
চট
করে ঘুরে তাকায় শান্তনা। আমি কী করুম তুমিই কও? বাবা-মা মইরা গেছে তাই এহন চাকরি করি। কোন অন্যায় তো করি না!
কী করবি? চারিদিকের অবস্থাটা তো বুঝতেই পারতাছোস।
তা কী আর পারি না! কিন্তু ছোড ভাইডারে নিয়া তো বাইচা
থাকন লাগব! আমরা না খাইয়া থাকলে কেউ কি আমগোরে খাওন দিবো?
সত্যেন
চুপ।
শান্তনা
আবার বলে- আমি সব বুঝি সত্যদা। সব হায়েনার দল খালি ছোক ছোক
করে।
তারপরও জলে বাস করে কুমীরের লগে তো আর যুদ্ধ করা চলে না।
তুমি ঠিকই কইছ সত্যদা। কুমীরের লগে যুদ্ধ করা সাজে না, কিন্তু তাই বইলা তো
হাত-পা গুটাইয়া বইসা থাকতে পারি না। আমগো পাশে দাঁড়ানোর মানুষ কই?
সত্যেন
ঘুরে অন্যদিকে তাকায়। তারপর শান্তনার দিকে ফিরে আবার বলে- আমগো গ্রামডা নষ্ট হয়ে
গেছেরে অনু! এহন আর ভাল মানুষ নাই।
আমি এদের অনেকরেই চিনি, সবগুলার ভিতরের
চেহারাডা ভালা কইরা জানা আছে আমার। তাই ঘুমানের
আগে হাতের কাছে রামদাটা রেডি রাখি।
শান্তনার কণ্ঠে ক্ষোভ।
সত্যেন চমকে উঠে শান্তনার দিকে তাকায়। আবছা অন্ধকারে
ওর যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখের ছবিটা চোখে পড়ে না তার। সত্যেন প্রসঙ্গ
বদলায়।
তুই আইজ অনেক ভাল অভিনয় করছস।
তোমার পছন্দ অইছে?
হুম।
শান্তনা মনে মনে বলে, আমি তো অভিনয় করি নাই
সত্যদা, ওটা যে কী ছিল তা তুমি বুঝবা না।
সত্যদা
হুম
তোমার আগের দিনগুলার কথা মনে আছে? আমরা
একসাথে কতদিন এই পথ দিয়া চলছি!
কিছুক্ষণ
চুপ থেকে সত্যেন বলে- হুম, মনে আছে।
দিন বদলাইয়া গেছে সত্যদা, আমাদের জীবনে এহন আনন্দ
বইলা আর কিছু নাই।
সত্যেন অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে শান্তনার দিকে। তখন
জোনাক জ্বলে ওঠে ব্রিজের পাশের ঝোপের কাছে। মধ্যরাতের চাঁদ হালকা আলো ফেলেছে
শান্তনার ফর্সা মুখে। সেই স্নিগ্ধ আলোয় সত্যেন দেখতে পায় শান্তনার
চোখের কোণে জল চিক চিক করছে।
অনু, তুই কানতাছোস ক্যান?
না, এমনিই। ও তুমি বুঝবা না। চল অনেক রাত
অইয়া গ্যাছে। আমারে
পৌঁছাইয়া দিয়া তোমার আবার বাড়ি ফিরতে
অইব।
সত্যেন কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর
ব্রিজ ছাড়িয়ে বড় রাস্তা থেকে নেমে ক্ষেতের মাঝের শিশিরে ভেজা মেঠোপথ ধরে দুজনে
এগিয়ে চলে। চারিদিকে সুনসান নীরবতা, দূরের বাড়িগুলোর বাতি
নিভে গেছে অনেক আগেই। কুয়াশা জমছে খোলা
মাঠে, গাছগাছালির মাথায় আর দূরে বাড়িগুলোর সম্মুখে। পাশের ঝোপঝাড়ে একটানা ডেকে চলেছে
ঝিঁঝিঁপোকারা। খালের পাড় থেকে বয়ে চলা ঠাণ্ডা বাতাসে কাঁপন লাগে। এমনই জোছনার অপরূপ মায়াবী আলোয়
পাশাপাশি এগিয়ে চলেছে দু’জন মানব মানবী। হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির কাছে চলে আসলো ওরা। অনেকদিনের চেনা আমগাছটার নিচে এসে থমকে দাঁড়াল সত্যেন। তারপর হঠাৎ শান্তনার
হাত ধরে বলে উঠলো,
অনু!
কি সত্যদা?
সত্যেন চুপ।
শান্তনার সারা শরীর কেঁপে উঠলো।
বুকের ভিতর অদ্ভুত এক শিহরণ খেলে গেলো। অনেকদিনের
জমানো মেঘ গলে বৃষ্টি নামছে আজ। অঝোর ধারায় বৃষ্টি!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন