এটি একটি
কাল্পনিক গল্প।
জীবিত বা মৃত
কারো সংগে গল্পের কোন চরিত্রের মিল নেই।
কারো সাথে
মিলে গেলে কাকতাল মাত্র।
কিছু
কিছু কষ্ট থাকে বুকের ভিতর যুগ যুগ লালন করে মানুষ। প্রিয়জন হারানোর কষ্ট, স্বপ্ন
ভাঙার কষ্ট, ভালবাসাহীনতায় বেঁচে থাকার কষ্ট। এই দুঃখ-কষ্ট
নিয়েই মানবজীবন। পৃথিবীতে শতভাগ সুখী মানুষ বোধকরি বিরল। তবুও মানুষ এভাবেই সুখের
চাষাবাদ করে, হাসে-কাঁদে; বাঁচার স্বপ্ন দেখে। কেউ কেউ সুখ কিনতে চায় নিজেকে
বিকিয়ে দিয়ে, বুকের মাঝে ছোট্ট সুখের বসতি ছেড়ে আলেয়ার পিছে ছুটে বেড়ায়।
সন্ধ্যা হতেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলো রবিন। আতঙ্কিত, বিধ্বস্ত চেহারা। যেন পেছনে তাড়া করে আসছে কোন ভয়ঙ্কর জন্তু। বেশ কিছুক্ষণ ধরে কলিং বেল বাজানোর পর হঠাৎ মনে পড়লো রীতু আজ বাসায় নেই। মায়ের বাসায় গেছে। পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো সে। ঘরের ভেতরে গুমোট অন্ধকার। রবিন ঘরে ঢুকে ধুপ করে সোফায় বসে পড়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুপিয়ে উঠলো। এক ধরণের হাহাকার, শূন্যতা তাকে যেন ক্রমশ গ্রাস করছিলো। মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে একটি শব্দই কেবল বের হল- রীতুকে এ-মুখ কী করে দেখাবো? অনেকক্ষণ ধরে অন্ধকারেই বসে রইলো সে, আলো জ্বালতে ইচ্ছে করছিলো না।
এখন মাত্র সন্ধ্যা, কিন্তু রবিনের কাছে মনে হচ্ছিলো অনেক রাত। সময়টা যেন স্থির হয়ে আছে। সাধারণত এই সময় ঘরে ফেরে না সে। গত দু’মাস ধরে রাত করে ঘরে ফেরাটাই নিয়মে পরিণত হয়েছে। এ বিষয় নিয়ে রীতুর সাথে মন কষাকষি লেগেই থাকে। আজ অনেকদিন পর এই ব্যতিক্রমটা ঘটলো। এটা যে ইচ্ছে করেই হয়েছে তা নয়, অনেকটা বাধ্য হয়েই সে আজ ছুটে এসেছে নিরাপদ আশ্রয়ে। রীতু ঘরে নেই। মায়ের অসুস্থতার খবর শুনে আজই সেখানে গেছে।
কিছুক্ষণ পর বাথরুমে ঢুকে ঘামে চপচপে ভেজা কাপড় ছাড়লো। বেসিনে কল ছেড়ে মুখে পানির ঝাপটা দিতেই তীব্র গন্ধটা নাকে এসে লাগলো। পেটের ভিতরটা গুলিয়ে উঠলো রবিনের। তাজা রক্তের গন্ধ। আঁতকে উঠে বেসিনের কাছ থেকে সরে আসলো সে। লুকিং গ্লাসের দিকে চোখ পড়তেই আতঙ্কের শেষ অবস্থা।
লুকিং
গ্লাসে মেয়েটা এলো কি করে! পেছনে ফিরে তাকায় রবিন। কেউ নেই তো! সারা বাথরুমে চোখ
বোলায়, নিরেট দেয়াল ছাড়া কারো কোন অস্তিত্ব খুঁজে পায় না। রবিন ভয়ে ভয়ে আবার আয়নার
দিকে তাকায়। মেয়েটা
কেমন করুণ চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কী নিষ্পাপ চেহারা! শরীরের কোথাও কোন আঘাতের
চিহ্ন নেই, কেবল কপালের ঠিক মাঝখানে একটা গোল দাগ। টকটকে লাল একটা রক্তের ধারা
নেমে এসেছে সেখান থেকে। রবিন দু’হাতে মুখ ঢাকে। নিজের উপর রাগ, ক্ষোভ আর ঘৃণায় ক্রমশ বিক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে মন। এই কাপুরুষতার জন্য নিজেকে ধিক্কার দেয় বার বার। এটা সে কি করে করলো!
আলো বন্ধ করে শুয়ে পড়লো। কখন যে ক্লান্ত-অবসন্ন শরীরে ঘুম নেমে এসেছিলো টের পায়নি। ঘুম ভাঙলো রাত দশটায়। প্রচণ্ড ক্ষুধায় পেটের ভিতরটা চোঁচোঁ করছে। মনে পড়লো আজ সকালে সামান্য নাস্তার পর থেকে কিছুই পড়েনি পেটে। ফ্রিজ খুলে দেখলো রীতু অনেকগুলো বক্সে খাবার রান্না করে রেখে গেছে। কোনটাতে কি আছে দেখার সময় নেই রবিনের। সামনে যেটা পেল সেটাই বের করে ওভেনে পুড়ে দিলো। ভাত মেখে মুখের কাছে নিতেই আবার সেই রক্তের বিদঘুটে গন্ধ। এক দৃষ্টিতে প্লেটের দিকে তাকিয়ে থাকলো অনেকক্ষণ। কিছুক্ষণ মাখা ভাত নড়াচড়া করে উঠে ডাস্টবক্সে ফেলে দিলো।
টিভির রিমোর্ট হাতে নিয়ে বিভিন্ন নিয়ে চ্যানেল ঘুরাতে গিয়েই হঠাৎ থেমে গেল রবিন। আজ দুপুরের ঘটনাটি সম্প্রচার হচ্ছে। আজকের আলোচিত খবর মতিঝিলের একটি ঘটনা। সবগুলো চ্যানেলই বিশেষ গুরুত্ব সহকারে খবরটা দেখাচ্ছে। রবিন চেয়ে আছে টিভি স্ক্রীনের দিকে। ঘটনাস্থলে লোকজনের ভিড় জমে আছে। অনেক লোকের জটলা। ভিড়টা একটু কমে যেতেই ক্যামেরা স্থির হয়ে গেল সেই মেয়েটির উপর। বাচ্চা মেয়েটির নিথর দেহটি পড়ে থাকতে দেখা যায় রাস্তায়। লাল রক্তের একটি ধারা পিচঢালা রাস্তা বেয়ে নেমে গিয়েছিলো প্রান্তের দিকে। বাচ্চাটির শরীরে অন্য কোথাও কোন আঘাতের চিহ্ন দেখা যায়নি, কেবল কপালের ঠিক মাঝখানে একটি কালচে-লাল বৃত্ত। মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়া বাবার চেহারার দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না রবিন। দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠলো। এটা কী করে হলো? সে এতটা নীচে নামতে পারলো! দু’হাতে মুখ বিড়বিড় করে বলল- ‘বিশ্বাস কর, আমি এমনটা চাই নি, সত্যিই চাইনি।’
একটা সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। খালি পেটে সিগারেটের স্বাদ তেতো
লাগে। ছুঁড়ে ফেলে দিল বাইরে। সেই দুপুরের পর
থেকেই, ঘটনা ঠিক যখন ঘটলো, তখন থেকেই রবিনের মন ভীষণ বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। বারবার একই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে- এটা কী করলো সে? এতটা
নীচে নামতে পারলো? কোথায় গেল তার শিক্ষা, বিবেক, মনুষ্যত্ব? রীতুকে এ মুখ দেখাবে কী করে?
আজ সকালে রীতু চলে যাবার সময় বলে গিয়েছিলো পারলে একবার মাকে দেখে এসো। মা
খুশি হবে। ইচ্ছেও ছিলো কিন্তু সবকিছু পাল্টে দিলো এই ঘটনাটা। এমনটি চায়নি সে,
আসলেই চায়নি। সে খুনি না। কিন্তু কেন এটা করতে গেল! গত দু’বছর এসব থেকে নিজেকে
দূরে রেখেছিলো সে। আজ কেন আবার? অথচ রীতুকে কথা দিয়েছিলো আর কখনও অস্ত্র হাতে নেবে
না সে।
স্কুল-কলেজ জীবনে তুখোড় ছাত্র মারুফ আহমেদ রবিন আজ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে?
এসএসসি, এইচএসসি দুই পরীক্ষায়ই মেধা তালিকায় স্থান করে নেয়া রবিনের বিশ্ববিদ্যালয়
জীবনটা থমকে গিয়েছিলো কেবলমাত্র ছাত্র-রাজনীতির কারণে। দ্বিতীয় বর্ষ থেকেই তার
পরিচিতি গড়ে ওঠে ক্যাডার হিসেবে। সিনিয়রদের স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হয়েই
কাজ করতো সে। কোনভাবে অনার্সটা শেষ করে করেছিলো, কিন্তু মাস্টার্সটা আর করা হল না।
রীতু পাল্টে দিয়েছিলো তার জীবনটা আবার। খাঁদের কিনার থেকে টেনে তুলেছিলো তাকে, ফিরিয়ে এনেছিলো স্বাভাবিক জীবনে। পরিবারের সবার অমতে রবিনকে বিয়ে করেছিলো সে। এক বছর পরিবারের কারো সাথেই সম্পর্ক ছিল না রীতুর। নিজেই রাখেনি, বাবার সাথে জিদ করে। বিয়ের সময় রবিনকে শর্ত দিয়েছিলো- তাকে মাস্টার্সটা শেষ করতে হবে। সংসারের বোঝা কাঁধে তুলে নিয়েছিলো নিজে থেকেই। রীতু চাকরী করেছে, তিল তিল করে সংসারটাকে সাজিয়েছে। কিন্তু রবিন বিনিময়ে কিছুই দিতে পারেনি রীতুকে।
সাপ্তাহ দুয়েক আগে ভার্সিটি জীবনের বড় ভাই সফিক হায়দারের সাথে দেখা হওয়ার
পর আবার পুরনো ব্যধিটা পেয়ে বসেছিলো তাকে। তার অনুরোধে গত কয়েকদিন ধরে আবার পার্টি
অফিসে যাওয়া আসা শুরু করেছিলো। কত জুনিয়র ছেলেরাও আজ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, অথচ সে
পড়ে আছে ঘরের কোণে- এরূপ বিদ্রূপও তাকে সহ্য করতে হয়েছে। মাঝে মাঝে ভাবনা আসতো,
রীতু একা একা খেটে মরছে আর সে পুরুষ হয়ে সংসারে কোন কাজেই আসছে না! কিছু একটা করা
দরকার।
তবে আজকের ঘটনাটা তার জন্য একটা বিরাট ধাক্কা। দিনশেষে উপলব্ধি হল- রীতুর সব ত্যাগ সে মূল্যহীন করে দিল! মেয়েটা তার জন্য
সবকিছু বিসর্জন দিয়ে কী পেলো? আজ সকালে রীতু চলে যাবার পর পার্টি অফিসে যাওয়াটা একটা বড় ভুল ছিল।
ভুল আরও অনেক ছিল, তবে সেগুলো কাটিয়ে উঠেছিলো সে। কিন্তু আজকের এ ভুলের প্রায়শ্চিত্ত
সে কিভাবে করবে? এ রক্তাক্ত হাত নিয়ে রীতুর সামনে কী করে দাঁড়াবে? এ গ্লানি মোচনের উপায় কি?
রাত সাড়ে দশটা। বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে রবিন। আজ আকাশে তারার দেখা নেই। সামনের পুরো পথটায় একটা আলো-আধারি ভাব। ল্যাম্পপোষ্টের হালকা সোডিয়াম আলোয় নির্জন পথটাকে আজ অন্যরকম লাগে। সামনের উঁচু বিল্ডিঙগুলোকে মনে হচ্ছে একেকটা ভৌতিক অবয়ব। রবিন ঘুরে বারান্দার অন্য পাশে তাকায়। ওদিকে রেল লাইন। অনেকটাই ফাঁকা। কোন হৈচৈ নেই, কোলাহল নেই, গাড়ির হর্ণ কিংবা রিকশার টুংটাং নেই; কেবল ট্রেন আসা যাওয়ার সময়টাতে শব্দটা কানে লাগে খুব। তারপর যখন শব্দটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে রবিনের মনে হয় কোথায় যেন একটা বিষণ্নতার ছাপ ফেলে যায়। রবিন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রেল লাইনের দিকে। এখান থেকে লাষ্ট ট্রেন যাবে রাত এগারোটায়। রবিন পা বাড়ায় দরজার দিকে। দরজাটা ভেজিয়ে রেখে বেরিয়ে পড়ে।
রেল লাইনের দু’পাশে জমাট অন্ধকার। নিস্তব্ধ-নিঝুম চারিদিক। পরিচ্ছন্ন নগরী গড়তে রেল লাইনের পাশের বস্তিগুলো তুলে দেয়া হয়েছে অল্প কিছুদিন আগে। তাই পুরো এলাকায় একটা ভৌতিক নির্জনতা। রবিন পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় রেল লাইনের দিকে। এখন সে একদম একা। মনের মাঝে বার বার উঁকি দেয় কেবল একটা মুখ, রীতু। রবিন ভুলে থাকার চেষ্টা করে। একটু সামনে রেল লাইনটায় একটা বাঁক। দূর থেকে ট্রেন আসার শব্দ ভেসে আসছে, মৃদু ঝাকুনিও টের পায়, তবে ট্রেনটা বাঁকটার ওপাশে থাকায় দেখা যায় না। একটু পরই একটা উজ্জ্বল আলো এসে চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। রবিন নিশ্চল পাথরের মুর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকে। মনস্পটে ফিরে আসে সেই ছোট্ট মেয়েটা। তার কপালে অঙ্কিত লাল তিলকটি ধীরে ধীরে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন