অনেকদিন
পর গ্রামে বেড়াতে যাচ্ছি। নানা ব্যস্ততার মাঝে ইদানীং সময় বের করা বেশ কঠিন।
অফিসে শুধু কাজ আর কাজ। দীর্ঘদিন অপেক্ষার পর অবশেষে চার দিনের ছুটি মিলল। এই
ভ্রমণে সবচেয়ে খুশি আমার চার বছরের মেয়ে। সে আজ প্রথম গ্রামে যাচ্ছে, গত কয়েকদিন ধরে সবাইকে বলে
বেরিয়েছে- সে তার দাদাবাড়ি যাচ্ছে।
ফেরিঘাটে এসে লম্বা জ্যামে বসে আছি প্রায় একঘণ্টা ধরে। গাড়ি যেন আর এগুচ্ছেই না। গাড়ি চলুক আর থেমে থাকুক, একজনের তাতে কিছুই যায় আসে না। তার ক্রমাগত প্রশ্নবাণে আমি জর্জরিত। সামনে-পেছনে, ডানে-বামে যা দেখছে তাই নিয়ে প্রশ্ন। তার মা পাশে বসে মিটিমিটি হাসছে, যেন আমার এই দুরাবস্থা দেখে মজা পাচ্ছে। দীর্ঘ দেড়ঘন্টা অপেক্ষার পর অবশেষে বাসটি ফেরিতে উঠল।
গাড়ি ফেরিতে
উঠে এলে
আমি স্ত্রী
ও মেয়েকে নিয়ে তিন তলায়
উঠে আসলাম। সাধারণত ফেরিতে উঠলেই আমি এমনটাই করি। তবে আমার
স্ত্রী, যে সহজে কোন কিছুতে খুশি হয় না, এবার সেও বেশ উচ্ছ্বসিত
হয়ে উঠলো। ইতিমধ্যে ফেরি ছেড়ে দিয়েছে। নদীর উপর দিয়ে একটা ফুরফুরে হাওয়া বইছে,
চমৎকার আবহাওয়া। এমন পরিবেশে যে কারো মন ভাল হয়ে যেতে বাধ্য।
এখান
থেকে পদ্মার চারপাশটা খুব ভালভাবেই দেখা যায়। বিশাল পদ্মার বুকে নিজেকে বড় ক্ষুদ্র
মনে হয়। যে দিকে তাকাই শুধু পানি আর পানি। সূর্যের আলো পড়ে
নদীর পানি চিঁক চিঁক করছে। খোলা নদীতে বালি হাঁসদের উড়া উড়ির দৃশ্য দেখে আমার মেয়ে আবার তার
প্রশ্নের ঝুড়ি খুলে দিলো। বাবা, ওগুলো কী? উত্তর
দিতে না দিতেই আবার প্রশ্ন- ওরা ওখানে কী করে? ডুবে যাবে না?
না, ওরা উড়তে জানে, সাতার
জানে। আমার উত্তর শুনেই নতুন বায়না, আমিও সাতার শিখবো। ওকে
ঠাণ্ডা করতেই বললাম, আচ্ছা শিখিয়ে দেবো, এবার থামরে বাবা!
রেলিং
ধরে বিশাল পদ্মার দিকে তাকিয়ে আছি আর মনে মনে ভাবছি এই শান্ত পদ্মাই কখনো কখনো
সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে, কত
মানুষ এই পদ্মার বুকে তাদের সর্বস্ব হারিয়ে আজ নিঃস্ব! তবে প্রমত্তা
পদ্মা আজ অনেক শান্ত। আমাদের ফেরির সামনে পিছনে আরও কয়েকটা ফেরি দেখা
যাচ্ছে- শাহ মখদুম, শাহ
জালাল, শাহ
আলী, বীরশ্রেষ্ঠ
হামিদুর রাহমান, আমানত
শাহ।
ঝালমুড়িওয়ালা
দেখে স্ত্রী বলল, ওকে ডাকো ঝালমুড়ি খাবো। পেছনে তাকিয়ে দেখি বারো-তেরো
বছর বয়সী একটি
ছেলে ঝালমুড়ির পাত্র গলায় ঝুলিয়ে হাঁটছে আর
বলছে- জাল মুড়ি, খাইবেন
গরম গরম জাল মুড়ি!
কী-রে মুড়ি ভাল হবে তো?
জে ছার, মচমচা মুড়ি, খুব মজা।
তাই! আমাদের তিনজনকেই দে। একটাতে একদম ঝাল দিবি না।
আমি ছেলেটির দিকে তাকিয়ে
ছিলাম। কী নিপুণ দক্ষতায় সে বিভিন্ন কৌটা থেকে হরেকরকম মসলা দিয়ে মুড়ি বানাচ্ছে। মায়াবী চেহারা, হাসি খুশি মুখ। চোখ দুটোতে যেন অন্য রকম দীপ্তি। আমি জিজ্জেস করলাম,
তোর নাম কি রে?
বাড়ি কোথায়?
ওই পাড়ে। হাতের ইশারায় নদীর অন্য পারের দিকে দেখয়ে বলল ছেলেটি।
বাড়িতে কে কে আছে ?
মা ও ছোট তিন ভাই-বইন।
বাবা নেই ?
ছেলেটি
চুপ। কিছুক্ষণ পর বলে- বাবা আমাগো ফালাইয়া চইলা গ্যাছে। আরেকটা
বিয়া কইরা অন্য জায়গায় থাকে।
মনটা
খারাপ হয়ে গেলো। ভীষণ রাগ হল ছেলেটির অদেখা বাবার প্রতি। ছেলেটি
মুড়ির প্যাকেটটি আমার দিকে এগিয়ে দিলো, মুখে সেই হাসি।
ছার, আইজকা আমার মনডা খুব বালো।
কেন
রে, আজকে
তোর খুশির কারণ কী ?
আমার
ছোড ভাই পাশ করছে।
তোর
ভাই কি পাশ করছে?
পি এস সি; ভালা
পাশ করছে।
তোর
বাবা নাই তো সংসার চলে কেমন করে ?
আমি
পরতি দিন জাল মুড়ি বেচিঁ, মাজে
মাজে মানুষের বোজা টানি।
এই
দিয়ে সংসার চলে ?
কুন
রকম চইল্লা যায়। তিনডা ভাই-বইন লেহাপড়া করে, হেগোরে তো আর কামে দেওন যায় না!
আমি
ছেলেটির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। যে বয়সের তার স্কুলে যাবার কথা, বন্ধুদের সাথে খেলেধুলা করে সময় কাটানোর কথা সেই
বয়সে তাকে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। ছোট ছোট ভাই বোনদের মুখে অন্ন তূলে দেবার কথা, তাদের লেখাপড়ার কথা ভাবতে হচ্ছে।
না ছার, আমি এমনি এমনি টাকা নেই না। এই বলে বাকি টাকা ফেরত দিয়ে সে তার ঝালমুড়ির পাত্রটি নিয়ে ফেরির অন্য প্রান্তে চলে গেলো।
আমি কিছুটা অবাক হয়ে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমাদের চারিপাশে তাকালে প্রতিনিয়ত দেখি মানুষের লোভ, হিংসা, জবরদখলের চিত্র। এসবের মাঝে এইটুকুন বয়সী একটি ছেলের কঠিন জীবন সংগ্রাম, তদুপরি তার আত্বসম্মানবোধ দেখে নিজেই অভিভূত হয়ে গেলাম।
আমার
স্ত্রী ভাবছিলো, ছেলেটা
হয়ত কম টাকা বলে বকশিস নিলো না। তাই সে তার ব্যাগ থেকে কিছু টাকা বের করে দিতে
চাইল। আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম-
না, ওকে আত্বসম্মান নিয়ে মাথা উঁচু করে বাচঁতে দাও।
কিছুক্ষণের
মধ্যে ফেরি তীরের কাছে পৌছে গেলে আমরা নিচে নেমে এসে বাসে উঠে বসলাম। ফেরি পাড়ে
ভিড়লে আমাদের বাস ছেড়ে দিলো। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে
দেখি ছেলেটি তখনো আগের মতই চিৎকার করে বলছে-
জাল মুড়ি, খাইবেন গরম গরম জাল মুড়ি!
নিভৃত স্বপ্নচারী
রচনাকালঃ ১০ই ডিসেম্বর ২০১৩।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন