বুধবার, ৩ অক্টোবর, ২০১৮

ফিরে দেখা একাত্তর- ধ্বংস, মৃত্যু আর অন্ধকারের বিভীষিকা


মোমের আলোয় কি ঢেকে দেয়া যায় সবটুকু অন্ধকার?
কিংবা, ধুয়ে ফেললেই কি মুছে যায় সব রক্তের দাগ?

না, যায় না। কিছু কিছু অন্ধকার কখনই দূর হয় না। আঁধারের কোন রঙ নেই। আঁধার যতই গাঢ় হয়ে ওঠে- মনে বাসা বাঁধে ভয়, শঙ্কা, আতঙ্ক। গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠলে ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের ছায়ারা তাড়া করে ফেরে। কখনো মন থেকে মুছে ফেলা যায় না, হাজার বাতির আলোক রশ্মিও ঢেকে দিতে পারেনা সেই ভয়াল কালো অন্ধকার। ফ্রেমে বাঁধানো ছবির মত ক্ষণে ক্ষণে চোখের সামনে ভেসে ওঠে। নিশীথের অন্ধকার ভেদ করে ভেসে আসা ভয়ঙ্কর শ্বাপদের রক্ত হিম করা চিৎকারে কেঁপে ওঠে অন্তরাত্মা!

কিছু কিছু সময় বড় বেশী স্থির। কারো কারো কাছে অতীতটা অনেক বেশী জ্বলজ্বল করে। ধ্বংসলীলার বিভিষিকাময় প্রহরগুলো জেগে থাকে সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে। ধূসর অ্যালবামের বিবর্ন ছবিগুলি ক্ষণে ক্ষণে মনকে বড় অস্থির করে তোলে! ভালবাসার সবুজ চত্বরে ছোবল হানে বিষাক্ত নাগীন, সবুজের বুক থেকে কেড়ে নেয় তার সবটুকু রঙ। প্রদীপজ্বলা সন্ধ্যার স্নিগ্ধ আলোটুকু নিভে যায় ঝড়ো হাওয়ায়। আশাহত পাখির মত ডানা ঝাপটায়, ছুটে বেড়ায় দিগ্বিদিক। এমনই দুঃস্বপ্নের অমানিসায় ঢাকা ছিল একাত্তরের জীবন। কালরাত্রির অন্ধকার ছিল সে জীবনে, ভয়ঙ্কর হিংস্র শ্বাপদের ভারী পদধ্বনি ছিল সে জনপদে, হায়েনার ধারালো নখের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত ছিল সে জীবন।
ঘরহীন ওরা ঘুম নেই চোখে,
যুদ্ধে ছিন্ন ঘর বাড়ি দেশ
মাথার ভিতরে বোমারু বিমান,
এই কালোরাত কবে হবে শেষ!

ছায়াঢাকা, কোকিল ডাকা সবুজ শ্যামল প্রান্তর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা স্মৃতিময় সোনালী অতীত কেবলি ফিরে ফিরে ডাকে! একটুকরো আঙিনা, পদ্ম পুকুর- যেখানে ফুটে আছে থরে থরে লাল পদ্ম! বাঁশ বাগানের নিচ দিয়ে ছুটে চলা মাথার সিঁথির মত সরু মেঠোপথও হাতছানি দেয়! গোয়ালে বাঁধা নিরীহ পশুগুলির বোবা দৃষ্টি দেখে বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে! তারপরও ওরা ছুটে চলে। কিছুই করার নেই, পিছনে তাড়া করে আসছে হায়েনার দল। চলে যেতে হবে সব ছেঁড়ে, যত দ্রুত সম্ভব। ছুটে চলে ওরা, সবকিছু পিছনে ফেলে। ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, গোয়ালে বাঁধা গরু, পুকুর ভরা মাছ, আর? আর পূর্বপুরুষের শেকড়।

শত শত মুখ হায় একাত্তর,
যশোর রোড যে কত কথা বলে
এত মরা মুখ আধমরা পায়ে,
পূর্ববাংলা কলকাতা চলে

দলে দলে ছুটছে মানুষ! রাস্তার দু পাশ ধরে লাইন দিয়ে ছুটে চলেছে। বিভিন্ন বয়সের মানুষ, ষাট বছরের বৃদ্ধ থেকে শুরু করে পাঁচ বছরের শিশুও ছুটছে। দুধের শিশু কোলে নিয়ে মা ছুটছে, কোন কোন মা ছুটে চলেছেন তার অনাগত সন্তানকে নিজের দেহের ভিতর ধারণ করেই। ছিন্ন বস্ত্র, খাদ্যহীন-দীর্ঘ পথচলায়। যাবার বেলায় বার বার পিছন ফিরে চায়। আবার কবে আসবে, কে জানে হয়ত আর আসাই হবে না! হায়রে নিয়তি! বুকের ভিতর কান্নার ঢেউ চেপে জন্ম জন্মান্তরের চির চেনা সেই সাজানো আঙিনা ছেঁড়ে দলে দলে ছুটে চলে। দুরু দুরু বুকে শঙ্কা! মনে ভয় চেপে পা বাড়ায় অজানা অনিশ্চয়তার পথে! পেছন থেকে বাবা তাড়া সবাইকে দেয়, ছোট ছেলেটা হাঁটতে গিয়ে বার বার পড়ে যাচ্ছে! বাবা চিন্তিত, অনেকটা পথ বাকি। শেষ পর্যন্ত পৌছুতে পারবে তো! পথে ওৎ পেতে নেই তো হায়েনার দল! শত শত আতঙ্কগ্রস্থ মানুষ দিগ্বিদিক ছুটতে থাকে প্রাণভয়ে। সবসময় ভয়ে তটস্থ থাকে এই বুঝি এসে পড়ল পাক বাহিনী কিংবা ধরিয়ে দিল রাজাকার বাহিনী! সবারই লক্ষ্য সীমান্তের ওপারে আশ্রয়কেন্দ্র। আশ্রয়কেন্দ্র? ওখানে ওদের কি পরিচয়? হ্যা, ওখানে ওদের একটাই পরিচয়- উদ্বাস্তু! 



মুক্তিযুদ্ধে পাক বাহিনীর নীল নকশা অনুযায়ী প্রথমে এদেশকে নেতৃত্ব শূন্য করার চেষ্টা চলে। তারপর একে একে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়-বিশেষ করে হিন্দু ধর্মালম্বীদের বিশেষভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হয়। তাদের অনেককেই নির্বিচারে হত্যা করে বাড়ি ঘর লুট করে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। বাকীদের সঙ্গে থাকা টাকা পয়সা, সোনা দানা, কাপড় চোপড় কেড়ে নিয়ে তাড়িয়ে দেয়। আর সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক পরিনতি হয় বিভিন্ন বয়সের নারীদের, যাদের স্থান হয় বিভিন্ন পাক সেনা ক্যাম্পে। বেঁচে থাকার প্রচন্ড আশা নিয়ে এইসব মানুষ দিনের পর দিন শত শত মাইল ছুটে চলে। রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে কেউ কেউ খালি পায়ে, গাঁয়ে কাদা মাটি মেখে। সাথে নেই পর্যাপ্ত খাবার কিংবা বিশুদ্ধ পানি। ক্লান্ত বিধ্বস্ত মানুষগুলো পালাচ্ছে যেন পিছনে তাড়া করছে পাগলা কুকুর! তবুও বাচতে পারে না অনেকেই, যারা ভাগ্যবান তারা সীমান্ত পার হয়ে যায় কিন্তু বিশাল সংখ্যক মানুষই প্রাণ হারায় পাক বাহিনীর বুলেট, বেয়োনেটের আঘাতে। মেয়েদেরকে বন্দী করে নির্বিচারে ধর্ষন করা হয়েছে।

প্রখ্যাত সাংবাদিক অ্যান্থনী মাসকারেনহাস করাচীস্থ ‘দি মর্নিং সান’ পত্রিকায় ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন। একাত্তরের এপ্রিলে ঢাকা সফরকালে তিনি গনহত্যার তথ্যাদি সংগ্রহ করেন এবং বিলেতে পালিয়ে গিয়ে ‘সানডে টাইমস’ পত্রিকায় গনহত্যার তথ্যাদি প্রকাশ করে বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করতে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন। তিনি তার “দ্যা রেইপ অব বাংলাদেশ” গ্রন্থের এক জায়গায় লিখেছেন-
কুমিল্লা অঞ্চলে সেনাবাহিনীর সঙ্গে আমার স্বল্পকালীন অবস্থানকালে হত্যা ও অগ্নিসংযোগের ফলে মানুষের মধ্যে যে প্রচন্ড ভীতি দেখা দেয় তা আমি সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছি। সেখানে গ্রামে গ্রামে ও ঘরে ঘরে হানা দিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে হিন্দু ও যারা সামরিক বাহিনীর চোখে অপরাধী ছিল তাদের ধরে এনে হত্যা করা হত। আমি দেখেছি একটি পুলের ক্ষতি করা হলে তার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে কিভাবে সমস্ত গ্রাম ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।”


পঁচিশে মার্চ রাতে পাক বাহিনীর পরিকল্পিত নীল নকশা অনুযায়ী বাঙালি নিধনে শুরু হয় হত্যাযজ্ঞ। সেই থেকে শুরু করে নয় মাস ধরে সমগ্র বাঙালি জাতির উপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। সেই কালরাতের অবর্ননীয় গণহত্যার দৃশ্য দেখে শহরের ভীত সন্ত্রস্ত মানুষগুলো জীবন বাঁচাতে ছুটতে থাকে গ্রামের পথে, আপনজনদের কাছে। তখনো তারা জানত না সেখানে তাদের জন্য ওত পেতে আছে আরেক বিপদ! যেখানে কুসংস্করাচ্ছন্ন ও স্বার্থান্বেসী মহলের ষড়যন্ত্র, পাকি বাহিনীর সাথে হাত মিলানো বাঙালি রাজাকার বাহিনীর লোকগুলোর হিংস্র দৃষ্টি এড়িয়ে অনেক গ্রামেও টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়ে এই সব নিরীহ মানুষদের। এই চেনাজানা পরিচিত মানুষগুলোই সেসময়ে স্বার্থের কারণে পরিণত হয় শত্রুতে। পাকিদের দোসর এইসব রাজাকার বাহিনীর ষড়যন্ত্রের কারণে হানাদার বাহিনী বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি চালিয়ে তরুন-যুবাদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে, সেই সাথে ধরে নিয়ে যায় অসংখ্য মেয়েদের। তাদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে নিজেদের সবকিছু ছেঁড়ে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে বেড়ায় গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। পথের শত বাধা পেড়িয়ে, পরিবার পরিজনের নিরাপত্তার খাতিরে ছুটে চলে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। মাথার উপরে শকুনের ওড়াওড়ি আর পিছনে তাড়া করে ফেরা এদেশীয় হায়েনা-রাজাকার, আলবদরের দৃষ্টি এড়িয়ে।

অ্যান্থনী মাসকারেনহাস তার “দ্যা রেইপ অব বাংলাদেশ” গ্রন্থের আরেকটি জায়গায় যুদ্ধ চলাকালীন সময়ের বাংলার গ্রামাঞ্চলের বর্ননা করেছেন এভাবে- এপ্রিল মাসে পূর্ব বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছিল খুবই আকর্ষনীয়। হাঁটু উঁচু ধানের সবুজ কার্পেট, মধ্যে মধ্যে কাঁচ স্বচ্ছ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলাশয়, দিগন্ত বিস্তৃত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উঁচু কুটিরের সারি সোভা পাচ্ছিল। রাস্তার উভয় পার্শ্বে লাল বর্ণের চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল চিত্র দেখে মনে হয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেন পূর্নতা লাভ করেছে। আম কাঁঠালের গাছগুলো ফলভারে নুয়ে পড়েছে। চাঁপা ফুলের মন মাতানো সৌরভে বাতাস পরিপূর্ন। প্রকৃতির যৌবন যেখানে থরে থরে সাজানো, সেখানে হতভাগ্য কেবল মানুষগুলোই বিসদৃশভাবে ছিন্নবিছিন্ন!”

একাত্তরের ৪ঠা এপ্রিল ক্যান্টনমেন্ট থেকে এসে পাক বাহিনীর সেনারা যশোর শহরে এক নারকীয় তাণ্ডব চালায়। ধরে ধরে হত্যা করা হয় নিরীহ মানুষদের। নিহতদের মধ্যে ছিল অ্যাডভোকেট সৈয়দ আমির আলী ও তাঁর সন্তানরা। এম এম কলেজের অধ্যক্ষ সুলতান উদ্দিন আহমেদসহ ছাত্র বকুল, আজিজুল ইসলাম, শফিকুর রহমান, জিন্নাহ, মোসাদ্দেক আলী, ওমর ফারুক, অধ্যাপক সিরাজুদ্দীন, আব্দুর রঊফ, ডাক্তার অবায়দুল হক, ম্যাজিস্ট্রেট রহমতুল্লাহ, ক্রিকেটার স্বপন বিশ্বাস, চিত্রশিল্পী আমিনুল ইসলাম, জেলা ছাত্র ক্যাথলিক গির্জার ফাদারসহ ছয়জন, রেলস্টেশন মাদ্রাসার ২৩ জনসহ প্রায় একশ নিরীহ মানুষকে হত্যা করে।


এ রকম অসংখ্য মৃত্যুর ঘটনা ছিল তখনকার প্রতিদিনের চিত্র। সারা বাংলার বিভিন্ন স্থানে নির্বিচারে চলেছে গণহত্যা। ভারত সীমান্তের নিকটবর্তী খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানার সুখনগর নামের একটি ছোট শহর, যেখানে কলকাতা যাবার জন্য জড়ো হয়েছিল হাজার হাজার শরণার্থী। মে মাসের একদিন সকালে দুই ট্রাক ভর্তি পাকিস্তানী সেনা সেখানে পৌছে। যদিও সংখ্যায় খুব বেশী সৈন্য ছিল না কিন্তু তাদের হাতে ছিল এলেমজি, সেমি অটোমেটিক রাইফেলের মত অস্ত্র। ফলাফল- কয়েক মিনিটের মধ্যেই একটা জীবন্ত শহর পরিণত হয়ে গেল ‘A City Of Death’ এ।

বিখ্যাত লাইফ ম্যাগাজিনের সাংবাদিক JOHN SAAR একাত্তরের জুনে কলকাতায় এসে ঘুরে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন এলাকা। শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে ঘুরে ঘুরে তিনি যুদ্ধের সময়কালীন অনেক লোমহর্ষক ঘটনার চিত্র তুলে ধরেছেন আর সে সময়ের তার সাথে ক্যামেরাম্যান MARK GODFREY এর তোলা দুর্লভ ছবিগুলি আজও সেই ভয়াল কালো সময়ের সাক্ষী হিসেবে বিদ্যমান। JOHN SAAR এর বিভিন্ন জায়গা ঘুরে অনেক মানুষের, শরনার্থীর সাক্ষাতকার নিয়ে প্রকাশ করেছেন। তাতে ফুটে উঠেছে অনেক নির্মম চিত্র। পাক বাহিনীর অনেক অত্যাচারের চিত্র ফুটে উঠেছে সেই লেখায়। বেঁচে পালিয়ে সীমান্তের ওপাড়ে পৌছে যাওয়া অনেকের কাছ থেকে জানা যায়- আগুন দিয়ে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া সহ নিরীহ অসহায় গ্রামবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাক বাহিনী। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, শিশু কিশোরও রক্ষা পায়নি তাদের অত্যাচারের হাত থেকে।

একজন ক্রন্দনরত মহিলার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন JOHN SAARমহিলাটি শরণার্থীদের দলের সঙ্গে সীমান্ত পার হয়ে এসেছে। মহিলাটি বলছিল,“ওরা আমাদের পিছনে তাড়া করেছে,আমাদেরকে লাঠি দিয়ে আঘাত করেছে। আমার শিশু সন্তান ছিল আমার কাঁধের উপরেই। লাঠির আঘাতে ওর মাথা গুড়িয়ে গেছে,এখনো ওর রক্ত লেগে আছে আমার গায়ে। ও নেই, তখুনি মারা গেছে।”

জুন মাসের শুরুতেই বর্ষা আরাম্ভ হয়েছে, সেই সাথে শুরু হয়ে গেছে মানুষের দুর্ভোগ। বৃষ্টি যেন উদ্বাস্তু জীবনকে আরও নির্মম করে তুলেছিল। ক্ষুধা, তৃস্নায় ক্লান্ত মানুষগুলোর কষ্ট আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয় এই বৃষ্টি। শরনার্থী শিবিরগুলোতে ছোট ছোট খুপরি ঘর আর খোলা আকাশের নিচে পাতলা হোগলার চাটাইয়ের আচ্ছ্বাদন এই বৃষ্টির কাছে কিছুই না। যখন ঝড়ো হাওয়ার সাথে বৃষ্টি নামে নিমিষেই উড়ে যায় চাটাই। ছোট ছোট খুপরি ঘরগুলিতে গাদাগাদি করে মাথা গোজার চেষ্টা করে, তাতেও শেষ রক্ষা হয় না। দিন রাত বৃষ্টিতে ভেজা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না এই সব ছিন্নমূল মানুষগুলোর। সবচেয়ে বেশী খারাপ অবস্থা বৃদ্ধ ও শিশুদের, মাথার উপর আকাশের বিরামহীন বর্ষনে শিবিরগুলিতে পানি ঢুকে পড়ে। তাপমাত্রা নিচে নেমে এলে অতিরিক্ত ঠাণ্ডা, কাশি, সর্দিতে নিউমোনিয়া দেখা দেয়। 


একাত্তরের আগস্টে প্রকাশিত টাইম ম্যাগাজিনের একটি নিউজ ছিল এ রকম-
Dr. Mathis Bromberger, একজন জার্মান চিকিৎসক কলকাতার বাইরের একটি ক্যাম্পে কাজ করছিলেন। তিনি রিপোর্ট লিখেছিলেন এভাবে- এখানে সমস্ত রাত্রি বৃষ্টির মধ্যে খোলা আকাশের নিচে দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিল হাজার হাজার মানুষ। পর্যাপ্ত আশ্রয় না থাকায় মহিলারাও তাদের কাঁধে শিশু নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তারা শুতে পারছিল না কারণ তাদের হাটু পর্যন্ত পানি চলে আসছিল এবং সকাল হতেই অনেকই অসুস্থ হয়ে পড়ে আর মারা যায় নিউমোনিয়ায়। আমরা সিরিয়াস কলেরা আক্রান্ত রোগীদেরকে হাসপাতালে নিতে পারছিলাম না, তারা একের পর এক পড়ে যাচ্ছিল মাটিতে কিংবা পানিতে। এর প্রকোপ কমাতে উচ্চ মাত্রার কলেরা টিকা দেয়া হচ্ছিল কিন্তু ক্যাম্পের স্বাস্থ্যকর্মীরা ইতিমধ্যেই ৫০০০ মৃতের সংখ্যা গুনেছে এবং প্রায় ৩৫০০০ বমি ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়ছে, যা আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এখন কর্মকরতারা এই ভেবে আরও চিন্তিত হয়ে পড়ছে যে নিউমোনিয়া, ডিপথিরিয়া এবং যক্ষ্মা না আবার আরাম্ভ হয়ে যায়। একজন ডাক্তারের ভাষ্য ছিল এমন- ‘মানুষ যেন কান্না করতেও পারছে না’ ”



পাকিস্তানী বাহিনীর তাড়া খেয়ে ছুটে চলা অসহায় মানুষগুলির অনেকেই মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যায় কিন্তু দুর্ভাগ্য তাদের পিছু ছাড়ে না। তারা জানতেও পারে না সামনে তাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে এক ভয়ঙ্কর দানব। এই দানবের নাম কলেরা, যা তখন মহামারি আকারে দেখা দেয়। এ যেন মুর্তিমান আতঙ্ক! চারিদিকে শুধু মৃত্যুর ছায়া। জুন মাসের কোন এক সময়ে JOHN SAAR গিয়েছিলেন পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরের একটি গ্রাম করিমপুরে। তিনি সেখানে দেখতে পেলেন শরনার্থী মানুষের অনেক লম্বা একটি মিছিল যাদের অনেকের মুখই ছিল রুমাল দিয়ে ঢাকা। একজন শরনার্থীর কাছে জিজ্ঞেস করতে লোকটি কেবল বলল- “কলেরা”। আশেপাশের শিবিরগুলিতে আশ্রয় নেয়া হাজার হাজার শরনার্থীর মধ্যে ‘কলেরা’ নামক কালো থাবার নির্মম আঘাতে অকাতরে মারা পড়ছে শত শত মানুষ! বাকীরা ধুকছে! যে কোন মুহুর্তে তাদেরকেও ছোবল হানবে এই ভয়ঙ্কর দানব।



একজন ভারতীয় স্বেচ্ছাসেবক সাংবাদিক JOHN SAAR কে বলছেন- “তারা সংখ্যায় এত বেশী মরছে যে আমরা হিসাব রাখতে পর্যন্ত পারিনি। এই লোকগুলো জানে না তারা কোথায় যাচ্ছে। তাদের কোন দিক নির্দেশনা ছিল না, প্রচন্ড রোদে চলছে তো চলছেই। হাঁটতে হাঁটতে তারা এতটাই ক্লান্ত ও তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েছে যে পথের পাশের ডোবা থেকে আঁজলা ভরে কলেরা রোগবাহী দুষিত পানি পান করছে। তারা এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ছে যে আক্রান্ত হবার পর একদিনও টিকে থাকতে পারছে না। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে।”


JOHN SAAR এর বর্ননামতে- তাদের চলার পথে রাস্তায় সর্বত্রই মৃত মানুষ পড়ে আছে। আকাশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে আসা শকুন মরা মানুষের গা থেকে ছিঁড়ে ফেলছে কাপড়, তখনো তাদের অনেকের শরীর গরম! তীক্ষ্ণ, ধারালো ঠোঁটের ঠোকরে ছিঁড়ে খুবলে খাচ্ছে মরা মানুষের দেহ। এই বিপুল সংখ্যক মৃত মানুষের দেহ ঝাঁকে ঝাঁকে শকুনও খেয়ে শেষ করতে পারছিল না, তাদেরও খাওয়ায় অরুচি ধরে গেছে। জন সার দেখতে পেলেন রাস্তার পাশের ধান ক্ষেতে শাড়ির অংশ দিয়ে মোড়ানো একটি শিশুর মৃতদেহ। শরনার্থীবাহী ট্রাকে চলার কোন এক সময় অসুস্থ শিশুটি মারা গেছে। চলন্ত ট্রাক আর থামেনি, পুটুলি করা শিশুটির মৃতদেহটি চলন্ত ট্রাক থেকে রাস্তার পাশেই ফেলে দেয়া হয়েছে।


একাত্তরে এদেশের নারীদের উপর যে বিভৎ নির্যাতন চালিয়েছিল পাক বাহিনী তা মানব ইতিহাসে বিরল। এই যুদ্ধে একটি বড় ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ ছিল নারী ধর্ষন। যুদ্ধকালীন সময়ে নারী ধর্ষন ছিল পাক বাহিনীর একটি ‘অস্ত্র’। এটি ছিল পাকিদের দীর্ঘ পরিকল্পনার অংশ, অত্যন্ত সুকৌশলে এ দেশের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে নিজেদের “উত্তরসূরি” রেখে যাওয়া, যাতে এরা ভবিষ্যতে মাথা উঁচু করে না দাঁড়াতে পারে। দেশের কোন অঞ্চলই বাদ পড়েনি, তারা সারা দেশে যত্রতত্র এই কার্যক্রম চালায়। জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হত ক্যাম্পে। যাতে পালাতে না পারে তাই বিবস্ত্র করে রাখা হত, মাথায় চুল পেচিয়ে যাতে আত্মহত্যা করতে না পারে তাই তাদের মাথার চুল কেটে ফেলা হত। ধর্ষন করা হত দিনের পর দিন। এর ফলশ্রুতিতে এই বিশাল সংখ্যক ধর্ষিতা নারীদের একটি বড় অংশ গর্ভবতী হয়ে পড়ে। দেশ স্বাধীন হবার পর এইসব নারীদের নিয়ে বিপাকে পড়ে তাদের পরিবারগুলি। তাদের স্বাভাবিক জীবনে সবচেয়ে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় সমাজব্যবস্থা এবং বিবাহিত নারীদের মধ্যে অনেককেই তাদের এমন কি অনেক মুক্তি-যোদ্ধা স্বামীরাও গ্রহন করতে অস্বীকৃতি জানায়। ঐ পরিস্থিতিতে অনেককেই বেছে নিতে বাধ্য করে আত্মহত্যার পথ। আবার অনেকে গর্ভপাতের মাধ্যমে মুক্ত হতে চেয়েছে এই আপদ থেকে।

মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষিতা নারীদের গর্ভপাত ঘটাতে চিকিৎসা সহায়তা দিতে ১৯৭২ সালে এগিয়ে আসেন অস্ট্রেলীয় চিকিসক ডা. জিওফ্রে ডেভিস। অস্ট্রেলীয় ইতিহাস গবেষক ড. বিনা ডি কস্তা কর্তৃক গৃহীত সাক্ষাতকার থেকে উঠে আসে এক বাস্তব চিত্র। সাক্ষাতকারের বিভিন্ন অংশে ডঃ ডেভিস বলেন-
আমি দেশের অন্য শহরগুলোতেও কাজ করেছি যেখানে হাসপাতালের সুষ্ঠু কোনো ব্যবস্থা ছিল না। আমি সেখানকার অনেক মানুষকেই প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এরপর দেখলাম এর সংখ্যা আরো বেড়েই চলেছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা হাল ধরলে আমি সে স্থান ছেড়ে অন্য স্থানে ছুটে গেছি।”

সবচেয়ে সুন্দরী ও বিত্তশালী পরিবারের মেয়েদেরকে অফিসারদের জন্য রেখে বাকিদের সৈন্যদের মাঝে ভাগ করে দেয়া হতো। এদেরকে খুব কষ্ট দেয়া হতো এবং পর্যাপ্ত খাবারও দেয়া হতো না। অসুস্থ হলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না দেয়ার ফলে অনেকেই ক্যাম্পের মধ্যে মারা গেছে।”

ওই সময় কেবল নারী ধর্ষণের বিষয়টিই মুখ্য ছিল না; যুদ্ধশিশু বিষয়টিও প্রধান হয়ে ওঠে। এসব যুদ্ধশিশুর লালন-পালনের ভার তুলে দেয়া যাচ্ছিল না কারো ওপর। সে সময় কয়েকটি সংগঠন এসব যুদ্ধশিশুদের ইউরোপে পাঠাতে তৎপর হয়ে ওঠে। কারণ সেখানে তাদের দেখভালের যথেষ্ট সুযোগ ছিল। আর যেসব হোমস ছিল সেখান থেকে বিভিন্ন দেশের মানুষ এসব যুদ্ধশিশু দত্তক নিতো।”


ডা. ডেভিস সাড়া দেশে তার চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনার অভিজ্ঞতায় এবং বিভিন্ন জেলায় চালানো নমুনা জরিপের ভিত্তিতে পরিসংখ্যান তৈরি করেন। তাঁর সেই পরিসংখ্যান অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষণের শিকার নারীদের সংখ্যা ৪ লাখেরও বেশী। তিনি আরও জানান শুধুমাত্র অন্তঃসত্ত্বা মহিলার সংখ্যাই প্রায় ২ লাখ।

একাত্তর- বাঙালির কাছে আনন্দ বেদনার অন্যরকম এক অনুভূতি। একদিকে যেমন বিজয়ের আনন্দ ঠিক তার আড়ালেই জমে আছে অনেক হারানোর বেদনা। একাত্তরের ২৫শে মার্চ থেকে শুরু করে ১৬ই ডিসেম্বরের আগের দিন পর্যন্ত পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে তথাকথিত পাকিস্তানী মুসলিম রাস্ট্রজান্তা এবং তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর গোষ্ঠী দীর্ঘ নয় মাস ধরে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে নিরীহ মানুষের উপর চালায় ভয়ঙ্কর গনহত্যা। এই গণহত্যায় কত লোকের প্রাণ হারিয়েছে এই নিয়ে আজও চলছে নানা বিতর্ক। বাংলাদেশের দাবী এই সংখ্যা কমপক্ষে ত্রিশ লাখ, রাশিয়া ও ভারতের মতেও মৃতের সংখ্যা এরকমই আর পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে এই সংখ্যা মাত্র ২৬ হাজার! বিশ্ববিখ্যাত গণহত্যা বিশেষজ্ঞ LEO KUPER তাঁর ‘GENOCIDE’ বইয়ে লিখেছেন ১৯৭১ সালে নয় মাসের যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ বাংলাদেশীকে হত্যা করে হয়েছিল।

তবে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে সে সংখ্যাতত্বই দেয়া হোক নয় মাসের যুদ্ধে হত্যা, ধর্ষন, লুটপাট, বাড়িঘরে আগুন দেয়াসহ যে পরিমাণ মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে তা কোন সংখ্যা দিয়েই বিচার করা সম্ভব নয়। পাক সেনা এবং দেশীয় রাজাকার বাহিনীর হাত থেকে বাঁচার জন্য কোটিরও উপরে মানুষ সীমান্ত পার হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের মধ্যে বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে বিপুল সংখ্যক মানুষ মারা যায়। খাবার, ঔষধের অভাব, রোগ-শোকে ভুগে একসময় এইসব মানুষের কাছে যেন কাম্য হয়ে ওঠে- মৃত্যু।


এই মৃত্যুর মিছিল এখনও চলছে। এ জাতি ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে, স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছে আর এখন প্রাণ দেয় স্বাধীনতার চেতনা অন্তরে ধারন করার অপরাধে। হরিপদরা তখন জীবন দিয়েছে, ভিটেছাড়া হয়েছে, দেশ ছাড়া হয়েছে স্বাধীনতার মূল্য পরিশোধের জন্য, আর এখন তাদের ভিটেয় ধ্বংসের আগুন জ্বলে, এখনও ঘুমন্ত হরিপদরা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে শুধুমাত্র স্ব-পরিচয়ে বেঁচে থাকার আকাঙ্খায়।
তখন তাদের চারপাশে ছিল পরাধীনতার শৃঙ্খল আর এখন লোভ, হিংস্রতা এবং উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বেড়াজাল- পার্থক্য শুধু এটুকুই।

তথ্য সুত্রঃ
১. Newspaper Report: Bangladesh Genocide Archive
২. দ্যা রেইপ অব বাংলাদেশ-অ্যান্থনী মাসকারেনহাস
৩. অস্ট্রেলীয় ইতিহাস গবেষক ড. বিনা ডি কস্তা কর্তৃক গৃহীত ডা. জিওফ্রে ডেভিসের সাক্ষাতকার (1971: Rape and its consequences- Bina D'Costa)
৪. বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ কুলদা রায় এবং এম এম আর জালাল


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উপন্যাসঃ ফেরা (পর্বঃ ২১ - ২৫ - শেষ পর্ব)

এ ই উপন্যাসটিতে সম্মুখ সমরের কোন ঘটনা তুলে ধরা হয়নি।  ওয়ারফ্রন্টের কোনও দৃশ্য নেই। তবে এই লেখায় মূলত যে গল্পটি বলার চেষ্টা ক রা হয়েছে  তা মু...