আজ সারাদিন আকাশটা যেন অঝোর ধারায় কাঁদছে। আবীর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সারি
সারি অট্টালিকার উপরের ধূ-ধূ আকাশটার দিকে। চোখে ভর করে আছে এক অদ্ভুত শূন্যতা। বারান্দার
গ্রিলের বাইরে খোলা মাঠে ফুটবল খেলছে তারই বয়সী ছেলেরা। প্রতিদিনই সে হুইল
চেয়ারে বারান্দায় বসে ওদেরর খেলা দেখে। আজ সেদিকে মন নেই। গলার কাছে দলা পাকানো
কান্নাটা আটকে আছে যেন। তার একমাত্র ভালবাসার আশ্রয় মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। মা কেন
আসছে না?
ঘরের ভেতরে দাদীর কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে।
ফুপুকে ধমকাচ্ছেন। একটু পরই দাদীর পায়ের শব্দ শুনে ঘুরে তাকালো আবীর। দাদী হেসে
মাথায় হাত রাখলেন পরম মমতায়।
আবীর কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, মা কখন আসবে দাদু?
দাদী স্বান্তনার সুরে বললেন- এই তো, একটু পরই মা চলে আসবে
দাদু!
চল আমরা ভেতরে যাই।
আবীর ঘাড় কাত করে সায় জানায়।
দাদী ফুপুকে বললেন, কাল থেকে ছেলেটা কিছুই খায়নি, ওকে কিছু খাওয়ানো দরকার।
বেনু অনেকটা রাগত স্বরেই বলল- আমি কী করবো? ও তো কোন কথাই শুনছে না। প্রায়
একঘণ্টা চেষ্টা করেছি, একটা ভাতও মুখে তোলেনি।
দেখ অন্য কিছু খাওয়ানো যায় কি-না।
বেনু দুধ-পাউরুটি নিয়ে এল। আবীরের মুখের সামনে নিতেই চিৎকার করে উঠলো।
না না না, আমি খাবো না। মায়ের হাতে খাবো। আমার মাকে এনে দাও।
মা আসবে বাবা, এখন এটুকু খেয়ে নাও!
আরেকটু পিড়াপীড়ি করতেই ধাক্কা দিয়ে প্লেটটা ফেলে দিল আবীর।
বেনু এবার ধমকে উঠল- পাঁজি ছেলে!
আবীর ক্ষেপে গিয়ে বেনুকে খামছি দিয়ে জখম করে দিল। শব্দ শুনে পিছনে দাদী এসে দাঁড়ালেন।
মা দেখো তো, বাবু কি করলো! বেনু মাকে
দেখায় তার হাত দিয়ে রক্ত ঝরছে।
কী করবি? মা ছাড়া তো ও কিছুই বোঝে না। বৌমা না ফেরা পর্যন্ত একটু সহ্য কর।
আমি আর পারবো না, তুমি দেখো খাওয়াতে পারো কি-না!
দাদী কাছে এসে বসলেন। আবীরের পছন্দের খেলনা দিয়ে মন ভোলানোর
চেষ্টা করেন। টিভিতে কার্টুন ছেড়ে দেন।
কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। আবীরের কান্না থামাতে পারে না। ওর একটাই কথা ‘মা আসছে
না কেন?’ অবশেষে দাদীও হাল ছেড়ে দিলেন।
অনেকক্ষণ চিৎকার চেঁচামেচি করার পর একদম চুপ করে গেল
আবীর। কিছুক্ষণ পর হুইল চেয়ারটা ধরে বারান্দায় নিয়ে গেল বেনু। বারান্দার
ওপাশে খোলা মাঠ, সবুজ ঘাসে ছাওয়া। সেখানে ছেলে-মেয়েরা খেলছে।
আবীর সেদিকে তাকিয়ে আরও অস্থির হয়ে উঠল। বেনু চকলেট হাতে দিয়ে
ওকে বারান্দায় বসিয়ে দিল। এখন আর বৃষ্টি নেই। বাইরে খোলা আকাশ। নীল আকাশের বুকে মুক্ত পাখিরা উড়ে বেড়াচ্ছে, আবীর চুপচাপ
দেখে।
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে রাবু’র তন্দ্রালু ভাবটা ক্রমশ
কেটে যাচ্ছিলো। একটা ঘোরের মধ্যে থেকেও ছেলের চেহারাটা চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে
উঠছিলো কেবল। যে ছেলেকে মুহূর্তের জন্যেও চোখের আড়াল করতে পারে না, অথচ আজ দু’দিন ধরে তাকে
ছেড়ে হাসপাতালের বিছানায় পড়ে আছে সে। মা মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। রাবু টের পায়। ধীরে ধীরে
চোখ মেলে তাকায়।
আমার আবীর কেমন আছে মা?
ভাল আছে।
ওর জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে।
ওকে নিয়ে এখন তোর চিন্তা করা লাগবে না। ওর কাছে দাদী, ফুপু আছে।
ও যা জিদ্দি! আমি ছাড়া কারো হাতে তো খায় না।
তুই তো এখন হাসপাতালে। এখন তো ওকে অন্য কাউকে দেখতে হবে,
নাকি? মা কিছুটা বিরক্ত হয়।
তুমি ভুলে গেছো মা আমার আবীর অটিস্টিক। সবাই ওকে ম্যানেজ
করতে পারে না।
আমি জানি, কিন্তু এখানে বসে তুই কি করতে পারবি?
রাবু চুপ করে থাকে। চোখে ভাসে হুইল
চেয়ারে বসা ছেলেটার অসহায় মুখের ছবি। যার কাছে মা-ই তার জগৎ। সব আবদার তার মায়ের কাছে। রাবু’র
চোখের কোণে জল জমে। তার ছেলেটা এমন হল কেন? যেদিন ওর জন্ম হল কি ফুটফুটে ছিল
দেখতে! কিন্তু যত দিন যেতে লাগলো ধীরে ধীরে পাল্টে গেল সবকিছু। একসময় হুইলচেয়ারই হয়ে
উঠল ওর চলাচলের একমাত্র অবলম্বন। তারপর কেটে গেল গোটা সাতটি বছর।
অনেকেই বিরক্ত হয় কিন্তু রাবু? ওর খুব কষ্ট হয়। ছেলেটার এই অসহাত্ব দেখে সহ্য করতে
পারে না।
সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। দেশের নামকরা ডাক্তারের
তত্বাবধানে ছিল রাবু। প্রতি মাসে নিয়মিত চেক-আপে কোন অসঙ্গতি ছিল না। কেবলমাত্র
শেষ মুহূর্তে ডাক্তারের অবহেলায় তার ছেলেটার জীবন এলোমেলো হয়ে গেল। আর কয়েক ঘণ্টা
আগে ডেলিভারিটা হলে হয়তো অন্যরকম হতে পারতো। কারো কিছু ক্ষতি হয়নি, কেবল রাবু’র
জীবন থেকে আনন্দ-হাসি-খুশি মুছে গেল চিরতরে।
হাসিব আজ তিন বছর ধরে দেশের বাইরে। রাবুকে
একাই সমলাতে হয় ওকে। ওর সবকিছুই রাবুকে করে দিতে হয়। আবীরের বয়সী ছেলেরা স্কুলে
যায়, মাঠে খেলতে যায় আর আবীর তখন মায়ের উপর নির্ভরশীল হয়ে হুইলচেয়ারে বসে বসে সময়
কাটায়। শোবার রুমের বারান্দা থেকে খেলার মাঠটা দেখা যায়। বিকাল হলেই বিভিন্ন বয়সী
ছেলেমেয়ের কোলাহলে মুখরিত হয়ে ওঠে মাঠ। তখন হুইল চেয়ারটা নিয়ে বারান্দায় বসিয়ে
দিতে হয়। কিছুক্ষণ খেলা দেখে, তারপর অস্থির হয়ে ওঠে। কেমন যেন ছটফট করতে থাকে।
রাবু নানাভাবে ছেলেকে বোঝাতে চেষ্টা করে। যখন কিছুতেই সামলানো যায় না তাকে তখন ধমক
দেয়, তারপর নিজেই কাঁদে।
একটা ছোট্ট অপারেশন অপরিহার্য্য হয়ে উঠেছিলো রাবুর। অপারেশনের
জন্য হাসপাতালে যাওয়ার সময় বাড়ির সবাই মিলে সান্ত্বনা দিচ্ছিল আবীরকে। ‘মা তোমার
জন্য খেলনা কিনতে যাচ্ছে, ফিরে এসে তোমাকে নিয়ে বেড়াতে যাবে।’ সেই থেকে আবীরের মায়ের
জন্য অপেক্ষা। মা আসলে তাকে নিয়ে বেড়াতে যাবে। বেড়াতে যাওয়া মানেই হুইল চেয়ারে করে
সামনের ছোট্ট খোলা চত্ত্বরে কিছুক্ষণ সময় কাটানো। তাতেই খুশি সে। কিছুক্ষণের জন্য
হলেও ঘরের বাইরে তো যাওয়া হয়।
আজ তিনদিন ধরে মাকে দেখে না সে। তার মুখে হাসি নেই।
গতকাল সন্ধ্যা থেকে সে একেবারেই চুপচাপ হয়ে গেছে। কাউকে জ্বালাতন করে না, চিৎকার
চেঁচামেচি নেই। নিরবে বসে থাকে হুইল চেয়ারে। কেউ ডাকলে সাড়া দেয় না, কেবল তাকিয়ে থাকে। সে
চোখে কোন অভিযোগ নেই, প্রত্যাশা নেই, আছে কেবল শূন্যতা।
তিনদিন পর আজ হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরছে রাবু। তার আবীরের
কাছে ফিরছে। নিজের সমস্ত ব্যথা-যন্ত্রণা ভুলে গেছে ছেলেকে কাছে পাবার আকাঙ্ক্ষায়। হাসপাতাল
থেকে বের হতেই চোখে পড়ে- তপ্ত দুপুরের জ্বলন্ত সুর্যটা যেন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। রাবু’র
কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। মা তাকে ধরে ট্যাক্সিতে তোলে, লক্ষ করে তার অস্থিরতা। হাসে;
তারপর মেয়ের উদ্দেশ্যে বলে, ‘মা-রা এমনই, প্রতিটি মায়ের কাছে সন্তানের জন্য সবকিছু
তুচ্ছ মনে হয়। হোক না সে প্রতিবন্ধী।’
প্রতিদিনের মত বারান্দায় হুইল চেয়ারে বসে বাইরে তাকিয়ে আছে আবীর। মুক্ত
আকাশে পাখিদের ওড়াওড়ি, ছোট্ট মাঠে ছেলেমেয়েদের ছুটোছুটি দেখার ফাঁকে চোখে পড়ে মাঠের
পাশের রাস্তায় ট্যাক্সি থেকে নেমে একটি পরিচিত অবয়ব ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে ওদের
বাড়ির দিকে। আবীরের চোখ দু’টি চঞ্চল হয়ে ওঠে। আজ তিনদিন পর তার মুখে হাসি ফোটে।
দাদীকে আঙুল দিয়ে দেখায়। দাদী তার সাথে সায় দেয়- মা
এসেছে, এবার তুমি খুশি তো?
কিছুক্ষণ পরের দৃশ্যটি অন্যরকম। দরজা দিয়ে মাকে ঘরে
ঢুকতে দেখে গত তিনদিনের জমানো অভিমান একীভূত হয়ে ঝড়ে রূপ নেয়। একটি অবুঝ প্রতিবন্ধী
বালক তার একমাত্র অবলম্বন মায়ের উপর অভিমানের তীব্র প্রকাশ ঘটায়। মা হাসিমুখে
এগিয়ে যেতেই হাত সরিয়ে দেয়। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে,
তুমি পচা, এতদিন আসোনি কেন?
মা অপরাধীর মত উত্তর দেয়- মাকে তো হাসপাতালের ঐ লোকেরা আটকে রেখেছিলো, কী করে
আসবো বাবা? ওরা ছেড়ে দিতেই তো তোমার কাছে চলে এলাম।
আবার চলে যাবে না তো!
না, আর কক্ষনো তোমাকে ছেড়ে যাব না।
এবার বালির বাঁধের মত উবে যায় সব রাগ-অভিমান; মায়ের
কোলে ঝাপিয়ে পড়ে আবীর। আশ্রয় খোঁজে, ভালোবাসার আশ্রয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন