হাজার বছর ধরে আমি পথ
হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে
সিংহল সমুদ্র থেকে
নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
জীবন গিয়েছে চলে, আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার
তখন, আবার যদি দেখা হয়ে তোমার আমার!
তখন, মুখোমুখি আমি আর শৈশব, মাঝখানে ব্যবধান-
কুড়ি অথবা ত্রিশ অথবা চল্লিশ...
জীবন গিয়েছে চলে, আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার
তখন, আবার যদি দেখা হয়ে তোমার আমার!
তখন, মুখোমুখি আমি আর শৈশব, মাঝখানে ব্যবধান-
কুড়ি অথবা ত্রিশ অথবা চল্লিশ...
নচিকেতার গাওয়া ‘একা একা পথ চলা’ গানটি শুরু হয়
জীবনানন্দের দু’টি লাইনের সাথে বাড়তি কিছু কথা জুড়ে আবৃতি দিয়ে। শুরুতে কিছুটা
হাসি পেলেও গানটা শোনার পর অবশ্য মনটা বেশ খারাপ হয়ে যায়। ছেলেবেলার ছোট ছোট
অনুভুতিগুলো এত সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে গানটিতে যে নিমেষেই নস্টালজিক হয়ে যাই!
আমি এমনিতেই একটু স্মৃতিকাতর মানুষ! ছেলেবেলার ফেলে আসা সময়গুলো ফিরে ফিরে ভিড়
করে মনের কোণে! শৈশবের সোনাঝরা দিনগুলো যখন হাতছানি দিয়ে ডাকে, সবকিছু যেন
এলোমেলো হয়ে যায়!
আমাদের শহুরে জীবনের ব্যস্ততম সময়ের সামান্য অবসরে কিংবা হাজারো কাজের ভিড়ে আনমোনে কখনো কখনো হারিয়ে যাই ছেলেবেলায়। শৈশব আমাকে খুব টানে, গাঁয়ের ফেলে আসা দুরন্ত শৈশবের করণে আমার ঢাকাবাসকে বন্দী জীবন মনে হত! সেই ছেলেবেলা থেকেই যতবার গ্রামে গিয়েছি ফিরে এসেছি প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে, সেই একই রকম অনুভূতি এখনো হয়। আমার মেয়ে যদিও মন খারাপের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে অনেকটাই, তবুও থেমে যায়নি একেবারে।
গত বছরটা চলে গেল, অনেক চেষ্টা করেও গ্রামে যাওয়ার জন্য সময় করতে
পারিনি। বাড়িতে একটা ফ্যামিলি প্রোগ্রাম থাকায় এ বছরের শুরুতেই অনেকটা বাধ্য
হয়েই বাড়িতে যেতে হল, তাও সপরিবারে! আয়োজনের প্রস্ততির জন্য অনেকে আগেই চলে
গিয়েছিল। আমরা গেলাম জানুয়ারীর শেষ দিনটায়, সাথে ভাগ্নে-ভাগ্নীদের একটা গ্রুপ
এবং যথারীতি সেই লঞ্চে!
সবচেয়ে বেশী আনন্দ ছিল আমার মেয়ে রিয়াসার। আগেরবার যখন গিয়েছিলাম ও বেশ ছোট ছিল, তাই আনন্দটা ঠিক বুঝতে পারেনি। লঞ্চে ওঠার পর থেকেই রুমের সামনের বারান্দায় ছোটাছুটি আর একের পর এক প্রশ্ন করে অতীষ্ট করে তুলল! বাবা, লঞ্চটা এত বড় কেন? ওখানে এত পানি কেন? বাবা, দেখ দেখ আরেকটা লঞ্চ! বাবা, এতগুলো লঞ্চ কেন? আমরা লঞ্চে করে কোথায় যাব? বরিশাল, আমাদের গ্রামের বাড়ি। বরিশালে গিয়ে আমরা কি করবো? আমরা ওখানে থাকবো? হ্যাঁ, ওটাই তোমার দাদা বাড়ি। ওর একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকি, ওর মা কিছুটা বিরক্ত হলেও আমার কাছে বেশ মজা লাগে! নতুন যে কোন ব্যাপারে ওর কৌতুহল দেখে আমার ভালই লাগে, কেন যেন বিরক্ত হতে পারিনা বরং ভাল লাগে ওর জানার আগ্রহ দেখে।
লঞ্চ ছেঁড়ে দিলে ওর আনন্দ যেন বেড়ে যায় কয়েকগুণ! প্রশ্নবানে
জর্জরিত আমি কিছুক্ষণ পর খেলনা আর চিপসের লোভ দেখিয়ে কেবিনে পাঠিয়ে দিয়ে কিছুটা
রক্ষা পেলাম! লঞ্চ চলতে আরাম্ভ করল বুড়িগঙ্গার বুক চিড়ে! বুড়িগঙ্গার পানির
দুর্গন্ধে দম বন্ধ হবার জোগাড়! অনেকক্ষণ সহ্য করতে হল এই অত্যাচার, তারপর এক সময়
মুক্তি পেলাম সেই দুর্গন্ধের হাত থেকে! চা, ঝালমুড়ি খেয়ে গল্পে, আড্ডায় আনন্দেই
কাটল সময়টুকু। রাতে বাসা থেকে আনা খিচুড়ি, গরুর মাংস আর ডিম ভাজা দিয়ে ভালই হল
ভুড়িভোজন!
অতঃপর সবাই যার যার রুমে চলে গেলে আমি একা একা কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করি খোলা বারান্দায়, লঞ্চের সামনের খোলা অংশটায়! খোলা নদীর বুক চিঁড়ে তির তির করে এগিয়ে চলেছে লঞ্চ, হালকা ঠাণ্ডা বাতাস। আধো অন্ধকারের মধ্যেও সামনে পিছনে বেশ কিছু লঞ্চ ও নৌকার আলো দেখা যাছে! এই পরিবেশ আমার বেশ ভাল লাগে! তাইতো লঞ্চ জার্নিই আমার সবচেয়ে পছন্দের! অনেককেই লঞ্চ ছাড়ার পরই কেবিনে ঢুকে ঘুম! আমি কখনো পারিনা, বারান্দায় বসে থাকি, খোলা আকাশ আর নদীর বিস্তর জলরাশি আমাকে মুগ্ধ করে! জ্যোৎস্না রাত হলে তো আর কথাই নেই! শেষ রাতের দিকে যদি ঘুমাতে যাই, অবশ্য বেশীক্ষণ ঘুমানোর সুযোগ কোথায়! সবসময়ই মনে হয় ঘুমানোর সাথে সাথে যেন ভোর হয়ে যায়!
গভীর রাত পর্যন্ত লঞ্চের বারান্দায় বসে থাকি, সন্ধ্যার পর চাঁদহীন আকাশটা বেশ অন্ধকার ছিল, চাঁদ ওঠার পর এখন সেই অন্ধকার কেটে গেছে অনেকটাই তবে আকাশে পূর্ণচাঁদের জ্যোৎস্না থাকলে যতটা ভাল লাগতো তেমনটা না হলেও আমার বেশ লাগছে! বউ-মেয়ে কেবিনে ঘুমিয়ে আছে আর আমি বসে আছি বারান্দায় একা! সামনে বিশাল জলরাশি, দূরে দেখা যাছে তীর আবছায়াভাবে! নদীতে চাঁদের ছায়া পড়ে পানি চিক চিক করছে, চারিদিকে শুনশান নীরবতা। অনেক দূরে নদীর মাঝে ছোট ছোট আলোকবিন্দু থেমে থেমে জ্বলে উঠে আবার নিভে যাচ্ছে। ছলাৎ ছলাৎ পানির শব্দ ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই। লঞ্চ মেঘনায় পড়লে সবসময় একটা দুলুনি থাকে, এখন সেটা অনুভব করছি! অনেকক্ষণ একা একা বসে থেকে অবশেষে ঘুমাতে গেলাম!
ঘুমের ঘোরে হঠাত ঝাঁকি খেয়ে উঠে বসি, মনে হয় পৌছে গেছি! জানালার
পর্দা সরিয়ে দেখি লঞ্চ কীর্তনখোলার ঘাটে ভিড়েছে! বউকে ঘুম থেকে তুলে বাইরে
বেড়িয়ে এলাম। একটা হালকা আলো আধারির সকাল, নির্মল কোমল ঝিরি ঝিরি বাতাসে মনটা
জুড়িয়ে গেল! সুর্য ওঠার বেশ কিছুক্ষণ আগেই লঞ্চ থেকে নেমে পড়ি, টার্মিনালের বাইরে
আসতেই বেশ কিছু অটোরিক্সাওয়ালারা ঘিরে ধরে- ছার কই যাইবেন! আজকাল যাতায়াত
ব্যবস্থা অনেক সহজ হয়েছে, আগে রিক্সা ছাড়া আর কোন বাহন ছিল না কিন্তু এখন
ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা, সিএনজি অটোরিক্সা, মাইক্রো লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকে!
একটা অটো নিয়ে বাড়ির পথ ধরি। বরিশাল শহরটা আগের থেকে অনেক সুন্দর হয়েছে। ওয়ান ওয়ে রাস্তা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, দুপাশে চওড়া ফুটপাত, সারা শহর জুড়ে যত্নের ছাপ লক্ষ্য করে বেশ ভাল লাগলো। শীতের জন্য প্রস্তুতি ছিল অনেক কিন্ত শীতের শেষ ভাগে এসে ঠাণ্ডা অনেক কমে গেছে, এত ভোরেও শীত অনুভূত হয়নি তেমন। দশ মিনিটের মধ্যেই বাজারে পৌছে যাই, মামার কড়া আদেশে নিজের বাড়িতে না যেয়ে তাদের ওখানেই যেতে হল আগে। মামাবাড়ি গিয়ে দেখি মামী সকালের নাস্তার জন্য মহা আয়োজন করে বসে আছে! পরোটা, মাংস, ডিম, পায়েস, কয়েক ধরনের পিঠা! এক কাপ চা খেয়ে নদীর দিকে হাঁটা ধরি।
বাড়ি থেকে নদী মাত্র দু মিনিটের পথ! সারারাত নদীপথে আসলেও এই নদীটা আমাকে অনেক বেশী আকর্ষন করে! এখানে এলে আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে ফেলে আসা সোনালী দিনগুলি! আমার ছেলেবেলা। নদীর একেবারে পাড়ে এসে দাঁড়াই, জোয়ার থাকাতে পানি নদীর পাড় ছুঁই ছুঁই করছে, পরিষ্কার টলটলে পানি! চমৎকার স্নিগ্ধ ঠাণ্ডা আবহাওয়া! তখনো সুর্য ওঠেনি পুরোপুরি। এমন জায়গায় এলে মন ভাল হতে বাধ্য! কিছুক্ষণ নদীর পাড়ে হাঁটাহাঁটি করে ফিরে আসলাম আবার মামাবাড়ি, নাস্তার পর্ব শেষ করে তাড়াতাড়ি বাড়িতে যেতে হবে!
বাড়িতে পৌছে দেখি সবাই বসে আছে আমার জন্য। কাল প্রোগ্রাম, অনেক আয়োজন বাকী। বাজার আগে থেকে করা থাকায় সেগুলি নিয়ে আর ভাবনা নাই তারপরও কয়েক হাজার লোকের বসা, খাওয়ার জন্য জায়গার ব্যবস্থা করতে লোকজন সেট করা! কয়েক ঘন্টা বসে সবকিছু ঠিকঠাক করে তবে কিছুটা বিশ্রাম নেয়ার সময় পাওয়া গেল!
দুপুরের পর সবাই যখন যার যার কাজে ব্যস্তও, আমি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে একেবারে খালের পাড়ে চলে আসি! আগে এখানে একটা বড় রেইনট্রি গাছ ছিল, নিচে অনেকটা সমতল ভূমি সবুজ ঘাসে ঢাকা! এখন সেই গাছটা আর নেই। এটা গ্রামে আমার প্রিয় জায়গাগুলোর মধ্যে একটা। এইখানটায় আসলে নিজের অজান্তেই একজনের কথা খুব মনে পড়ে যায়! আমার জীবনে পথ প্রদর্শক হিসেবে যারা ভূমিকা রেখেছেন তাদের সংখ্যা খুব বেশী না! তাদের একজন ছিলেন আমার বাবা আরেকজনের কথা আমার খুব মনে পড়ে- তাঁকে আমি ডাকতাম দাদু।
খুব আপন কেউ নন, আমাদের বাড়ির ঠিক পাশেই ছিল ওনাদের বাড়ি। আমার
জন্মের পর নিজের দাদুকে পাইনি, খুব ছেলেবেলায় দেখতাম যখন তখন আমাদের বাড়িতে
আসতেন, ভীষণ আদর করতেন। বেশ বড় হওয়া পর্যন্ত ওনাকেই নিজের দাদুই মনে করতাম!
ভুলটা ভাঙ্গে অবশ্য অনেক পরে, ততদিনে ওনার প্রতি একটা প্রগাঢ় ভালবাসা তৈরি হয়ে
গিয়েছিল। কিছু কিছু মানুষ থাকে যাদের খুব বেশী কিছু করতে হয় না, তারা নিজেরাই
অনেক প্রেরণার উৎস! আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম, ভাতৃত্ববোধ, মানবতা-এই
শব্দগুলোর সাথে আমার পরিচয় ঘটে সেই দাদুর মাধ্যমে। মাঝে মাঝেই দেখতাম দাদুর চোখে
পানি! পরে বুঝেছিলাম সেই অশ্রু ছিল মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ওনার ছেলের জন্য! নিজের
ভিতরে বোধ নামের ব্যাপারটা উনিই জাগ্রত করেছিলেন! আর বড় হবার সেগুলোকে পরিপূর্ন
রুপ দিয়েছেন আমার বাবা! অনেকদিন এই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আমাকে কত উপদেশ
দিয়েছেন! তাই বাড়িতে আসলে একবার হলেও আমি এখানে আসি আর যখনই আসি ভিতরটা কেমন যেন
ফাঁকা ফাঁকা লাগে!
বাড়িতে ফিরতেই মেয়ের নালিশ! বাবা, মামনি আমাকে বকেছে! কেন, তুমি কি করেছিলে? আমি তো খেলছিলাম। বলতে বলতেই মেয়ের মা এসে হাজির! দেখ, ধুলাবালি লাগিয়ে তোমার মেয়ের কি অবস্থা! আমি বললাম- থাক; গ্রামে এসেছে, একটু ধুলাবালি লাগবেই! মেয়েটাকে কিছু বলনা! আমার কথায় কি আর কাজ হয়! মা তার মেয়েকে সবসময় ফুলকুমারী রুপেই দেখতে পছন্দ করে। আর কিছু বললাম না কিন্তু মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল! আমাদের ছেলেমেয়েদের শৈশব বলে কি কিছু আছে? ইট-কাঠ-পাথরের মাঝে বড় করছি ওদের অনেকটা গিনিপিগের মত করে! দুরন্ত শৈশবকে গলাটিপে হত্যা করি শৈশব শুরুর আগেই!
পরদিন সারাদিনই প্রচন্ড ব্যস্ততায় কাটল, প্রোগ্রাম শেষে ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়লাম খুব তাড়াতাড়িই। অন্যদের ঢাকা ফিরতে দেরী হবে জেনে পরদিন আমরা আবার ফিরে এলাম মামাদের বাড়ি। দুপুরটা এখানে থেকে রাতের লঞ্চে ফিরে আসব ঢাকায়! অনেকদিন পর আবার নদীতে গোসল করলাম! শৈশবের মত ঢেউয়ের সাথে খেলা করা তো আর সম্ভব না, তারপরও কিছুটা হলেও সেই পুরনো দিনের স্বাদ পেলাম! অনেকটা ইচ্ছে করেই মেয়েকেও করালাম নদীতেই! ঢাকায় ফেরার পর থেকে এখন পর্যন্ত নতুন কাউকে পেলেই আমার মেয়ে বরিশালের গল্প, নদীতে গোসল করার গল্প বলে বেড়ায়!
লঞ্চে বুকিং দেয়া থাকায় বাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি বের হওয়ার তাড়া
নেই! বিকেলে বউ-মেয়েকে নিয়ে আবার নদীর পাড়ে গেলাম। রিয়াসা তো ভীষণ খুশি!
দুষ্টুমি আর ছুটোছুটিতে ওর মা তো অস্থির! শেষ বিকেলের হালকা ঠান্ডা বাতাসে নদীর
পাড়ের ঘাসের উপর বসে গল্প জমে ওঠে। সুর্য ডোবার আগে ওরা চলে গেলে আমি আরও
কিছুক্ষণ থাকি। এই গোধূলি বেলার শেষ আলোটুকু বেশ উপভোগ্য! দিগন্তে সুর্য ডোবার
কিছু ছবি তুলি তারপর আস্তে আস্তে ফিরে চলি বাড়ির দিকে। আবার কবে আসা হবে জানিনা
তবে আসব, আমি বার বার ফিরে আসব এখানে, কারণ এই কীর্তনখোলার বাঁকে ফেলে আসা
দিনগুলোর ছায়ারা হাতছানি দিয়ে ডাকে আমায়, ওর ঢেউয়ের ভাঁজে ভাঁজে আজও খুঁজে
ফিরি আমার হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলা!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন