বিস্তীর্ণ নীল জলরাশির বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে আমাদের ছোট প্রমোদ তরী। চান্নি-পসর রাত। মাথার উপর পূর্ণ চাঁদের জোছনা। হাজার নক্ষত্রের মেলা বসেছে সেখানে। তার ছায়া পড়েছে জলের বুকে। আমরা ক’জন বন্ধু নৌকার ছাদে বসে সেই জ্যোৎস্না রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করছি। বাউল শিল্পীরা সুরের মূর্ছনা তুলেছে.........
বেশ ক’দিন ধরে এমনটাই ভাবছিলাম। সবকিছু ঠিকঠাকই ছিলো- সময়, হাওরের জলরাশি, শিল্পীর গানের মূর্ছনা- সবকিছু; কেবল বাদ সাধলো বৃষ্টি। জ্যোৎস্না আর দেখা হয়নি, কারণ মেঘের আড়ালে ঢাকা ছিলো চাঁদ। তবুও আমাদের যাত্রা থেমে থাকেনি। যতটুকুই পেয়েছি, উপভোগ করেছি পুরোমাত্রায়।
ডাক্তার কিছু সীমাবদ্ধতা বেঁধে দেয়ার পর থেকে একটা বিষয়
মনের ভেতরে গেঁথে গেছে। যে করেই হোক মনটাকে হালকা করতে হবে। এই ইট-কংক্রীটের শহর
ছেড়ে দূরে কোথাও ঘুরে আসতে হবে। কিন্তু কিছুতেই সময় সুযোগ মিলছিলো না। মেয়ের স্কুল খোলা; আজ
এই পরীক্ষা- তো কাল সেই পরীক্ষা, গিন্নী ভীষণ ব্যস্ত। তাই বেড়াতে যাওয়ার কোনরকম
চান্স পাচ্ছিলাম না। একা একা তো আর ঘুরতে যাওয়া যায় না! নিদেনপক্ষে একজন কিংবা
দু’জন সঙ্গী দরকার; সবচেয়ে ভাল হয় একটা দল সাথে পেলে। অনেকদিন পর হঠাৎ সেই আকাঙ্ক্ষিত সুযোগটা
মিলে গেলো। হাওরে ভ্রমণের সুযোগ।
আমাদের বন্ধু আলমগীর সুনামগঞ্জে পোষ্টিং হওয়ার পর বেশ সুখেই
দিন কাটাচ্ছে বলে মনে হচ্ছিলো। একের পর এক ঘুরে বেড়ানোর ছবি আপলোড করে সবাইকে লোভ
দেখাচ্ছিলো। একদিন টাঙ্গুয়ার হাওরে ভ্রমণের ছবি দেখে আমারও খুব লোভ হলো।
সুনামগঞ্জের বৈচিত্রময় টাঙ্গুয়ার হাওরের কথা অনেক শুনেছি; সীমান্তের কাছে যাদুকাটা
নদী, স্বচ্ছ নীল জলের নীলাদ্রি লেক আর মেঘালয়ের পাহাড়শ্রেণী। কার না দেখতে মন চায়! আমারও যাওয়ার
ইচ্ছা ছিলো খুব, কিন্তু যাওয়া আর হয়নি। ধীরে ধীরে সেই লোভটা প্রবল ইচ্ছায় পরিণত
হলো যখন দেখলাম আমাদের ব্যাচের আরও কিছু বন্ধু হাওরে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করছে।
ব্যাস! শুরু হলো আলোচনা। দিনক্ষণ ঠিক করার জন্য সবার মতামত নেয়া। টার্গেট করা হলো পূর্ণিমা রাতকে কেন্দ্র করে। আসছে পূর্ণিমায় ঈদ। অর্থাৎ এই
পূর্ণিমায় যাওয়া হচ্ছে না। সবাই কুরবানি নিয়ে
ব্যস্ত থাকবে, কেউ কেউ গ্রামে যাবে ঈদ উৎযাপন করতে। আগামী পূর্ণিমা আবার একমাস
পরে। অগত্যা ঠিক হলো একমাস পরেই যাবো।
গ্রুপে সদস্য সংখ্যা শতাধিক, সবাইকে আহবান করা হলো। অনেকেই
আগ্রহ প্রকাশ করলো তবে শেষ পর্যন্ত সময়-সুযোগের অভাবে কেউ কেউ আমাদের হাওর যাত্রার
সঙ্গী হতে পারলো না। সবমিলে হাওর
ট্যুরের সদস্য সংখ্যা দাঁড়ালো ২৩ জন। দল হিসেবে একেবারে ছোট নয়। শুরু হলো ট্যুর
প্ল্যান। অর্থাৎ কিভাবে যাওয়া। প্রফেসর মিজান গোঁ ধরে বসলো- ট্রেনেই যেতে হবে, এসি
এবং বার্থ ছাড়া চলবে না। আমাদের বন্ধু ট্যুর কো-অর্ডিনেটর সাত্তার যথাসাধ্য চেষ্টা
করছিলো ট্রেনে বার্থ ম্যানেজের জন্য, তবে শেষ পর্যন্ত বার্থ কিংবা এসি সীট পাওয়া
সম্ভব হলো না। সবশেষে পর্যটনের এসি মিনিবাসের ব্যবস্থা করা হলো। ৩০ সীটের নতুন
বাস, সীটগুলোও বেশ আরামদায়ক। আমাদের ২৩ জনের দলের জন্য চমৎকার ব্যবস্থাপনা। হাওর
ভ্রমণ উপলক্ষ্যে আমাদের ৯১ ব্যাচের লোগোসহ টি-শার্ট এবং ক্যাপ তৈরি করা হয়েছে। হোস্ট
আলমগীর আরও জানালো তাহিরপুরে নৌকার ব্যবস্থাও করা হয়েছে এবং টাঙ্গুয়ার হাওরে
যতগুলো নৌকা চলে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় নৌকাটাই ভাড়া করা হয়েছে। সুনামগঞ্জে রেস্ট
নেয়ার ব্যবস্থাপনাও সম্পন্ন। এখন আমরা বেরিয়ে পড়লেই হয়।
নির্ধারিত দিনে যথারীতি আমরা সবাই উপস্থিত হলাম মহাখালিস্থ
পর্যটন কর্পোরেশনের কার্যালয়ের সামনে। রাত এগারোটায় আমাদের যাত্রা শুরু হল
সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যে। এরই মধ্যে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হল। মনে আশঙ্কা জাগলো-
হাওরে পৌঁছানোর পর বৃষ্টি থাকবে না তো! তাহলে আমাদের জ্যোৎস্না বিলাশের কী হবে!
যাই হোক, আমরা ছুটে চললাম সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যে। বাসের মধ্যে গল্পে-আড্ডায় সময়টা
চমৎকার কাটছিলো। পথিমধ্যে যাত্রা বিরতি হলো আশুগঞ্জে। হালকা খাওয়া-দাওয়া হল উজানভাটি রেস্টুরেন্টে। গুড়িগুড়ি
বৃষ্টির মধ্যেই আবার শুরু হল আমাদের যাত্রা সিলেট অভিমুখে।
বৃষ্টি থাকায় আমাদের গাড়ি ধীর গতিতে চলছিলো। সকালে আমরা যখন
সুনামগঞ্জে পৌঁছালাম সূর্য ততক্ষণে তার স্ব-রূপ দেখানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। হোস্ট
আলমগীর আমাদের অভ্যর্থনার যথার্থ ব্যবস্থাই করেছিলো। লম্বা জার্নির পর সুনামগঞ্জে
হাওর উন্নয়ন বোর্ড গেস্ট হাউজে আমাদের বিশ্রাম এবং সকালের নাস্তার আয়োজন-
সুচারুভাবেই সম্পন্ন করে রেখেছে। সবাই ফ্রেস হয়ে নাস্তা সেরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম
নিয়ে নিলাম। অনেকে গেস্ট হাউজেই গোসল সেরে নিলো। তবে নদীর কাছাকাছি এসে বাথরুমে
গোসলের পক্ষপাতি আমি নই। গেস্ট হাউজ থেকে একটু এগোলেই সুরমা নদী। আমি আলমগীরের
সাথে নদীতে চলে গেলাম। নদীর ঠাণ্ডা পানি গায়ে লাগতেই সারা রাতের ক্লান্তি দূর হয়ে
গেলো। আমার কাছে নদীতে গোসলের মজাটাই আলাদা। বাড়িতে গেলে কখনও বাসায় কিংবা পুকুরে
গোসল করি না। কারণ খুব কাছে কীর্তনখোলা নদী। ছেলেবেলা থেকেই এই কীর্তনখোলা আমার
মনে অনেকটা জায়গা করে নিয়েছে। এই নদীর পাড়ে হেসেখেলে আমার শৈশব কাটিয়েছি, আজ
অনেকদিন পর তার কিছুটা স্বাদ পেলাম।
আমাদের আজ রাতের খাবার নৌকায় রান্না হবে। খাসী বারবিকিউ,
ফিশ ফ্রাই, হাওরের তাজা গলদা চিংড়ি, আইড় মাছ ইত্যাদি। রান্নাবান্নার যাবতীয়
সামগ্রী গোছগাছ করে আলমগীর আর সাত্তার বেলা একটার দিকে আমাদের নিয়ে রওনা দিলো
তাহিরপুরের উদ্দেশ্যে। হাওর-বাওরের জন্য বিখ্যাত সুনামগঞ্জের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য
দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে চললাম তাহিরপুরের দিকে। চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ।
রাস্তার দু-দিকেই জলাভুমি। শুধু জলের রাজত্ব। ইতোমধ্যে বৃষ্টি থেমে গেছে পুরোপুরি,
রোদ উঠেছে। আমরা সবাই আশান্বিত হয়ে উঠলাম এই ভেবে যে আজ হয়তো আর বৃষ্টি হবে না।
আমাদের হাওর যাত্রা সফল হবে।
বিশ্বম্ভরপুর পার হয়ে আরো কিছুটা পথ চলার পরই শুরু হলো
বিপত্তি। সামনের রাস্তা পানিতে ডুবে আছে। গতকাল রাতে বৃষ্টিতে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢলের কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আমরা
সবাই গাড়ি থেকে নামলাম। অনেক গাড়ি এখানে এসে আটকে পড়েছে। ড্রাইভারকে বলেও কাজ হলো
না। অফিসে কথা বলে সে জানালো গাড়ির এসি নষ্ট হবার সম্ভাবনা আছে, তাই আর যাওয়া যাবে
না। আমরা চেক করে দেখলাম প্রায় দেড়শ গজের মত
রাস্তা পানিতে ডুবে আছে। লোকজনকে
জিজ্ঞেস করে জানলাম ওখান থেকে তাহিরপুর ছয়-সাত কিলোমিটার পথ। ব্যাটারিচালিত
অটোরিক্সা, টেম্পু, মাইক্রোবাস- অনেককে অনুরোধ করা হলো কিন্তু কেউ পানি ভেঙে যেতে
রাজি হলো না। ধীরে ধীরে বেলা গড়াচ্ছিলো। অলরেডি আড়াইটা বাজে, এখনও আমাদের দুপুরের
খাবার খাওয়া হয়নি। তাহিরপুরে লাঞ্চ সেরে নৌকায় উঠতে হবে, তাই দেরি করার উপায় নেই।
বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজতে আরও প্রায় আধাঘণ্টা সময় চলে গেলো। অগত্যা সবাই পানিতে নেমে
পড়লাম। পানিতে নেমেই বুঝলাম কেন কেউ যেতে রাজি হচ্ছে না। পানিতে বেশ স্রোত, কখনও
কখনও নিজেকে সামলানোই মুশকিল। রাস্তায় বিছানো সূচালো পাথরের টুকরার উপর দিয়ে হাঁটতে বেশ সমস্যা হচ্ছিলো
সবার। কোথাও কোথাও পানির উচ্চতা হাঁটুর উপরে। অনেক কসরত করে পানির চাপ আর পাথরের
আঘাত সহ্য করে আমরা পার হলাম। ওপারে উপস্থিত ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সায় করে যে যার
মত ছুটে চললাম তাহিরপুরের দিকে।
পায়ে হেঁটে ভাঙা রাস্তা পারাপার
বৃষ্টিভেজা ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে অটো বেশ স্লথ গতিতেই
চলছিলো। প্রায় বিশ মিনিট চলার পর আনোয়ারপুরে এসে থেমে গেলো অটো। আবার রাস্তা ভাঙা
এবং যথারীতি পানিতে ডুবে আছে। অগত্যা কি আর করা! আবার সেই পানি ভেঙে সামনে এগিয়ে চলা। তবে এবারের যাত্রাটি আরও কষ্টকর। পানির
নিচে এবড়োথেবড়ো ব্লকের উপর দিয়ে হাঁটতে গিয়ে বেশ বিপাকে পড়তে হচ্ছে। একটু অসাবধান
হলেই বিপদ। যাই হোক শেষ অবধি পানিপথের যুদ্ধ শেষ করে আমরা সবাই ওপারে পৌঁছলাম। তবে
আলমগীর আর সাত্তারের জন্য যুদ্ধটা আরও কঠিন হয়ে দাঁড়ালো, কারণ- নৌকায় রাতের খাবার
রান্নার যাবতীয় সামগ্রী তাহিরপুরে বয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্ব ওরাই কাঁধে তুলে
নিয়েছিলো। আবার অটো ধরে তাহিরপুরে পৌঁছুতে আমাদের বেলা চারটা বেজে গেলো।
হোস্ট আলমগীর তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ ডাকবাংলোয় আমাদের বিশ্রামের
ব্যবস্থা করে রেখেছিলো। বিআরডিবি উপজেলা দপ্তর তাহিরপুরের কয়েকজন
কর্মকর্তা-কর্মচারী আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। আমরা সবাই ওখানে ফ্রেস হয়ে দুপুরের
খাবার খেলাম। এর মধ্যেই আবার শুরু হলো বৃষ্টি। আকাশের অবস্থাও ভাল নয়। নাহ! এই
বৃষ্টির বাড়াবাড়ি আর ভাল লাগছে না। এত কষ্ট করে আসলাম, এখন বসে থাকতে ভাল লাগে! বন্ধু বাকী
অবশ্য প্রশ্ন তুলেছিলো- এই বিরূপ আবহাওয়ায় নৌকা নিয়ে হাওরে যাওয়া উচিৎ হবে কি-না;
তবে আমরা অনেকেই হাওরে যাওয়ার ব্যাপারে অনড় ছিলাম। এতদূর এসে হাওরে নামবো না, তাই কী হয়! আরও বেশ কিছু সময় পর
বৃষ্টি কমে এলো। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম- আর দেরি নয়, এখনই বেরিয়ে পড়তে হবে। বৃষ্টিস্নাত
স্নিগ্ধ বিকেল। শেষ বিকেল। কিছুক্ষণ আগে যে এক পশলা
বৃষ্টি হয়েছে, প্রকৃতিতে তার রেশ রয়ে গেছে এখনও। এমন ভেজা আবহাওয়ায় অভিমানী সূর্য
কী আর দেখা দেয়! অগত্যা আমরা ধীরে ধীরে ঘাটের দিকে এগিয়ে চললাম।
থানাঘাটায় প্রস্তুত আমাদের হাওর যাত্রার বাহন- নৌকা
আমরা সবাই দাঁড়িয়ে আছি তাহিরপুরের
থানাঘাটায়। সামনে দিগন্তবিস্তৃত জলরাশি। পাশেই
ভিড়ানো আগে থেকে ভাড়া করে রাখা আমাদের হাওর-যাত্রার বাহন- নৌকা। কারুকাজ করা
সুন্দর একটি নৌকা। এতক্ষণে সবার মুখে ফুটলো তৃপ্তির হাসি। এত ঝঞ্ঝাল পেড়িয়ে শেষ
অবধি আমরা সেই আকাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছালাম। সবাই যার যার ব্যাগেজ নিয়ে নৌকায় উঠে
বসলাম। রাতে নৌকায় রান্নার যাবতীয় সরঞ্জামও তুলে নেওয়া হল। বৈরী আবহাওয়াতেই আমাদের
যাত্রা শুরু হল। তাহিরপুরের থানাঘাটা থেকে আমাদের নৌকা ছাড়লো, গন্তব্য- টেকেরঘাট; ভারতের
মেঘালয়ের পাহাড়ের ঠিক পাদদেশে। হাওর ভ্রমণে আসা বেশির ভাগ মানুষ এখানেই রাত কাটায়।
আজকের রাতটা আমরা ওখানেই কাটিয়ে দেবো। পরদিন সকালে সবাই মিলে বেরিয়ে পড়বো। বাংলার কাশ্মীরখ্যাত নীলাদ্রি লেক, যাদুকাটা নদী, বারিক্কা
টিলা, শিমুল বাগান ঘুরে আবার মূল হাওরে ঢুকে পড়বো। ওয়াচ টাওয়ারের চারিদিকে
ডুবন্ত হিজল-করচের বনের কাছে নেমে গোসল করবো, তারপর আবার ফিরে আসবো তাহিরপুরে।
আগামীকাল বিকেলের মধ্যেই সেখান থেকে রওনা দেবো ঢাকার উদ্দেশ্যে। আর সৌভাগ্যক্রমে
যদি রাতে চাঁদ দেখা দেয় তবে আমাদের ভ্রমণ সম্পুর্ণরূপে সার্থক হয়!
তাহিরপুরের
থানাঘাটায় নৌকায় ওঠার পূর্বমুহূর্তে আমরা কয়েকজন
কেউ কেউ সেলফি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কিছু গ্রুপ ছবিও তোলা
হলো। আমি তাকিয়ে ছিলাম সামনের দিকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে বার বার দেখছিলাম, মনে
ক্ষীণ আশা যদি মেঘ সরে গিয়ে আকাশ পরিষ্কার হয়। আমি বরাবরই একটু স্মৃতিকাতর মানুষ।
সামনের থৈথৈ জলরাশি নিমেষেই আমাকে শৈশবে ফিরিয়ে নিয়ে গেলো। আজকের এই হাওরভ্রমণ
ছেলেবেলায় ভরা নদীতে নৌকায় ঘুরে বেড়ানোর স্মৃতিকে নতুন করে জাগিয়ে তুললো আবার।
নীল জলরাশির বুক চিরে ছুটে চলেছে আমাদের ইঞ্জিনচালিত নৌকা। উপরে খোলা আকাশ আর দূরে আকাশ যেখানে দিগন্তে মিশেছে তার
পায়ের কাছে মেঘালয়ের পাহাড়গুলি যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। দিনের শেষ আলোটুকু মিলিয়ে
গেলে চারিদিকে ধীরে ধীরে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছিলো। আকাশ মেঘলা তাই জ্যোৎস্না দেখার
আশা ছেড়েই দিয়েছি আমরা। আমাদের সবারই
প্রত্যাশা ছিলো বিকেলে নৌকাযাত্রা শুরু করে হাওরে বসেই সূর্যাস্ত দেখবো, তারপর
রাতে ধবল জ্যোৎস্নায় স্নান করতে করতে হারিয়ে যাবো অন্য জগতে। কিন্তু বৃষ্টির কারণে
তার কিছুই হলো না। আমি বুঝে গেলাম এই অন্ধকারে হাওর দর্শনের আশা বৃথা। যা দেখার
আগামীকালই দেখতে হবে।
আলমগীর নৌকার ছাদে এসে বললো- সবাই এত চুপচাপ কেন? এখন বাউল
গান হবে, আমরা নাচবো। হ্যা, তাহিরপুর থেকে বাউল শিল্পীদের একটা দল আমাদের সাথে
নৌকায় যোগ দিয়েছে। বাউল হীরা মোহন ও তার দল। শিল্পীরা তাদের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে
নৌকার ছাদের মাঝখানে আসন গেড়ে বসলো। দলে সদস্য সংখ্যা তিনজন। বাউল হীরা মোহন নিজে
হারমোনিয়াম, অল্পবয়সী একটি ছেলে ঢোল এবং লাল রঙের ফতুয়া পরনে পাগড়ি মাথায়
কাঁচাপাকা শ্মশ্রুমণ্ডিত একজন খঞ্জরি নিয়ে প্রস্তুত। সিলেট
অঞ্চলের মরমী শিল্পী শাহ আব্দুল করিমের একটি বিখ্যাত গান দিয়ে শুরু হলো তাদের
পরিবেশনা-
গ্রামের
নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম
মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম
আগে কি সুন্দর
দিন কাটাইতাম
আমরা আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম...
আমরা আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম...
সবাই যেন নতুন করে
প্রাণ ফিরে পেল। আলমগীর সত্যি সত্যিই নাচতে আরাম্ভ করলো, সাথে আরও কয়েকজন যোগ
দিলো। আসর বেশ জমে উঠলো। এর মধ্যেই সাত্তার মুড়ি মাখিয়ে নিয়ে হাজির। রসিক সাত্তার
অবশ্য কোমল পানি, কঠিন পানির ব্যবস্থাও রেখেছিলো। যার যেমন প্রয়োজন- তুলে নিলো।
খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা-গানে বেশ জমে উঠলো আসর। এই সুনামগঞ্জে অনেক মরমী বাউল সাধকের
জন্ম। তাদের গানে হাওরের জীবনের দুঃখগাঁথাই বেশি ফুটে ওঠে। একে একে আরও
অনেকগুলো গান হয়ে গেলো। শাহ আব্দুল করিম, হাছন রাজা ও সিলেট অঞ্চলের আরও কিছু
জনপ্রিয় গান।
গানে-আড্ডায় আমাদের সময়টা আনন্দেই কাটছিলো। নৌকা ছুটে চলেছে
তার নির্দিষ্ট গন্তব্যে। হঠাৎ মাঝিদের তৎপরতা দেখে আমরা কেউ কেউ সচকিত হয়ে উঠলাম। ব্যাপার
কি? মাঝিরা নানা কসরত চালিয়েও নৌকা সামনে নিতে পারছে না। কিছুক্ষণের মধ্যে কারণ
জানা গেলো। পাহাড়ি ঢলের জন্য স্রোত খুব বেড়ে গেছে। নৌকা সেই স্রোত ঠেলে সামনের
খাঁড়ি পার হতে পারছে না। বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছে কিন্তু যতবারই স্রোত ঠেলে ওপারে
যেতে চাইছে নৌকা ঘুরে আবার আগের জায়গায় চলে আসছে। আমাদের বাউলদের দলটিকে দেখা গেলো
সবাই সারিবদ্ধ হয়ে হাত উপরের দিকে তুলে কারো উদ্দেশ্যে কিছু বলছে- সেটা
সৃষ্টিকর্তা না অন্য কারো উদ্দেশ্যে ঠিক বোঝা গেলো না। প্রায় বিশ মিনিট কসরত করার
পর মাঝিরা সফল হলো। নৌকা খাঁড়ি পার হয়ে এলো। আমরাও অনেকটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। রাত
প্রায় ন’টার দিকে আমরা টেকেরঘাট পৌঁছালাম।
অসংখ্য নৌকা ভিড়ে আছে ঘাটে। সবাই আমাদের মত ভ্রমণ পিপাসু দল। আমরা কয়েকজন পাড়ে নামলাম।
একটু সামনেই ভারতের মেঘালয়, অন্ধকারে প্রহরীর মত উঁচু পাহাড়শ্রেণী দাঁড়িয়ে। তার উপরের রাস্তায় সারিবদ্ধভাবে হলুদ
রঙের আলো জ্বলছে। পাহাড়ের কোল ঘেঁষেই বাংলাদেশী সীমান্ত সড়ক। তবে নৌকা থেকে বেশি
দূরে যাওয়া হল না আমাদের, কারণ- চারিদিকে বেশ অন্ধকার। নিরাপত্তার কথা ভেবে আমরা
নৌকার কাছাকাছি কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে ফিরে এলাম। নৌকার ছাদে রান্নাবান্নায় ব্যস্ত
হয়ে পড়েছে সাত্তার, আলমগীর ও তার লোকজন। ফিশ ফ্রাই, খাসী বার-বি-কিউ এর সুঘ্রাণ
আসছে। একপাশে অবশ্য বাউল শিল্পীরা গানে মত্ত। কেউ
কেউ নিচে কেবিনে কার্ড নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আশেপাশে নৌকা থেকেও হৈ-হল্লার শব্দ
ভেসে আসছিলো। কেউ কেউ ফানুস উড়াচ্ছিলো।
টেকেরঘাটে নোঙর করা অবস্থায় নৌকার ছাদে বাউল শিল্পীদের সঙ্গীত পরিবেশনা
‘রঙের বাড়ই রঙের বাড়ইরে
বেষম উন্দুরায় নাগাল পাইলো’ গানের সাথে আলমগীর আর মাঝহারের যুগলনৃত্য দর্শন করতে করতে
আর ভাজা মাছ খেতে খেতে সময়টা বেশ আনন্দেই কাটছিলো আমাদের। এর মধ্যেই সাত্তার জানালো খাসী বার-বি-কিউ প্রস্তুত। আবার শুরু হলো খাসী ভক্ষণ। নিচে অবশ্য
মাঝির রন্ধনশালায় চলছে পোলাও, হাওরের গলদা চিংড়ি, আইড় মাছ আর গরুর মাংস রান্না। গান-আড্ডা-খাওয়া
দাওয়ায় সময় দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছিলো। আমাদের রাতের খাবার শেষ হবার কিছুক্ষণ পরই আবার বৃষ্টি
নামলো। আমরা সবাই নিচে কেবিনে চলে গেলাম। নিরাপত্তার কথা ভেবে ঘাট থেকে কিছুটা
দূরত্বে হাওরের পানিতে নৌকাটা নোঙর করালাম। বেশির ভাগ নৌকা দেখলাম সেভাবেই নোঙর
করা।
নৌকার ভেতরে একটা
ভ্যাঁপসা গরম ভাব। বদ্ধ কেবিনে এতগুলো মানুষ, গরম তো লাগবেই। যে যেভাবে পেরেছে শুয়ে পড়েছে। অনেকেই
ঘুমিয়ে গেছে। কেউ আধশোয়া হয়ে, কেউ কুণ্ডুলি পাকিয়ে, আবার কেউ বা বসে বসেই। সবার
দিকে একবার চোখ বুলিয়ে হাসি পেলো। আরাম আয়েশের ঘর-বিছানা ছেড়ে এই অবস্থায়! কারো
কারো তো আবার এসি ছাড়া ঘুমই আসে না, অথচ এখন এই গরমে ঠিকই ঘুমিয়ে পড়েছে! আমার
ঘুমটা কেটে গেছে। মনে হয় ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়েছিলাম। রাত প্রায় দুইটা বাজে। রুম থেকে
বেরিয়ে এলাম। ছাদে এসে দাঁড়াতেই ঝিরিঝিরি বাতাসে প্রাণটা জুড়িয়ে গেলো। ঠিক এই মুহূর্তে হুমায়ূন আহমেদের লিলুয়া বাতাসের কথা মনে পড়ে গেলো। লোকটা বড় জ্যোৎস্না পাগল ছিলো। চারিদিকে
নিস্তব্ধ নিঝুম, কোথাও মানুষের পদচারণা, শোরগোল-হৈচৈ নেই। চারিদিকে একটা স্নিগ্ধ,
শান্ত ভাব।
এবার তোমার মন ভেজাবার পালা,
মেঘলা রাতে খুব নিশীথে, জলের বুকে জলকপোতে-
এবার তোমার হারিয়ে যাবার পালা।
আমি সত্যি সত্যিই হারালাম। নক্ষত্রবিহীন এই রাতে নিবিড়
নিস্তব্ধতার মাঝে নৌকার ছাদে আমি একা। চারিদিকে অসংখ্য নৌকা ভেড়ানো, দূরে- কাছে;
তবে মানুষজনের সাড়া নেই। একদিকে আবছায়া অন্ধকারে মেঘালয়ের পাহাড়শ্রেণী প্রাচীরের
মত দাঁড়িয়ে। অন্যদিকে বিস্তীর্ণ জলরাশি। যতদূর চোখ যায়- শান্ত, টলটলে জল। অবশ্য বিশাল এই জলাশয়ের মাঝেই গাছপালা
ঘেরা ছোট ছোট দীপের মত ছায়াছায়া কিছু স্থলভূমি চোখে পড়ছে, তবে সেখানে মানুষের
বসবাস আছে কি-না বোঝা গেলো না। হঠাৎ হঠাতই মেঘ সরে গিয়ে আকাশ কিছুটা পরিষ্কার হয়ে
ওঠে, তবে তা অতি সামান্য সময়ের জন্যই। তারপর আবার সেই মেঘেদের রাজত্ব। আবার গুড়ি
গুড়ি বৃষ্টি শুরু হলো। আমি সামিয়ানার
নিচে চেয়ার পেতে বসলাম। এমন শান্ত নির্মল পরিবেশ হয়তো আর কখনও পাবো না। বৃষ্টি
হঠাৎ বেড়ে গেলো। আর ছাদে থাকা যাবে না। অনিচ্ছা সত্বেও নিচে নেমে এলাম। ভেতরে বসার
জায়গা তেমন নেই। সবাই এলোপাথাড়ি শুয়ে-বসে ঘুমাচ্ছে। বাধ্য হয়ে আমিও শুয়ে পড়লাম।
তবে ঘুম আসছিলো না।
এটা সেটা ভাবতে ভাবতেই কখন জানি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ফজরের
আযানের ধ্বনি কানে যেতেই ঘুম ভেঙে গেলো। নৌকার বদ্ধ রুমের মধ্যে আর থাকতে ইচ্ছে
করছিলো না। বাইরে বেরিয়ে খোলা ছাদে চলে এলাম। হালকা বৃষ্টির ছাঁট এসে চোখেমুখে
লাগছে, গায়ে মাখলাম না। চারিদিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়লো মনে।
ভোরের আলো ফোটেনি তখনো। আকাশ মেঘলা
থাকায় সবকিছু স্পষ্টভাবে দেখাও যাচ্ছিলো না। তারপরও হালকা আলোয় যতটুকু চোখে পড়লো
আমার কাছে তা-ই ছিল যথেষ্ট। অন্ধকারে ছাওয়া রাতের টাকেরঘাট এই প্রত্যুষে আমার কাছে
ভিন্নরূপে ধরা দিলো। স্নিগ্ধ ভোরের এই নৈস্বর্গিক রূপের সৌন্দর্য যতটা অনুভব করলাম,
বর্ণনা করা আমার জন্য ততটা সহজতর নয়।
একজন দু’জন করে আরও কয়েকজন উঠে এলো ছাদে। মিজান, মাকসুদ, বদরুল, শাহীন। আকাশ ধীরে ধীরে
পরিষ্কার হয়ে আসছে। যত আলো ফুটছে মেঘালয়ের পাহাড়শ্রেণী যেন নতুন করে জেগে উঠছে; অথৈ
জলরাশির পাশে একটা সবুজ প্রাচীর, তার ভাঁজে ভাঁজে ভেসে বেড়াছে খণ্ড খণ্ড সাদা মেঘ। বেলা আরও কিছুটা বাড়লে অনেকেই উঠে পড়লো।
সাত্তার আর আলমগীরের সাথে বসে আমাদের পরবর্তী করনীয় নিয়ে আলোচনা করলাম। এরপর আমরা
যাদুকাটা নদীতে, নীলাদ্রি লেকে কীভাবে যাবো, নৌকা কোথায় থাকবে ইত্যাদি। তবে বৃষ্টি
আমাদের ভাবনার বেশি সময় দিলো না, হুড়মুড় করে নামলো আবার। এবার মুষলধারে। কিছুক্ষণ
দেখার পর ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিলো না, কারণ নীলাদ্রি লেক কিংবা যাদুকাটা
নদীতে যেতে হলে আমাদের নৌকা থেকে নেমে অন্য ট্রান্সপোর্ট নিয়ে যেতে হবে। বৃষ্টির
জন্য সেটা আর সম্ভব নয়। আজ বিকেলের আগেই আমাদের ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে।
অতএব সম্মিলিত সিদ্ধান্ত হলো যাদুকাটা নদী, বারিক্কা টিলা ও নীলাদ্রি লেক দেখা
হচ্ছে না আমাদের। ঠিক হলো আমরা হাওরে বেড়াবো, ওয়াচ তাওয়ারের কাছে গিয়ে গোসল করবো,
তারপর ফিরে যাবো।
আমাদের নৌকা ছুটে চললো মূল
হাওরের দিকে। গতকাল রাতে অন্ধকার থাকায় তেমন কিছু দেখতে পাইনি। আজ এই দিনের আলোয়
হাওরের আসল রূপটা ধরা দিলো। এখন বর্ষার শেষ সময়, চারিদিকে থৈথৈ জল, খাল-বিল-নদী সব
পানিতে একাকার। শীতে এই হাওরে পরিযায়ী পাখিদের মেলা বসে যায়। এই বর্ষায় পাখি তেমন চোখে
পড়ছে না। সকাল থেকে একটা দুইটা পানকৌড়ি দেখা গেলো মাত্র। বৃষ্টি থেমে গেছে
পুরোপুরি। আকাশে নীল সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে, তার ছায়া পড়েছে হাওরের জলে। আলমগীর
এসে জানালো- সকালের নাস্তা রেডি। খিচুড়ি আর গরুর মাংস। নৌকার ছাদে সবাইকে পরিবেশন
করা হলো।
খিচুড়ি স্বাদ নিতে নিতেই শেয়ার করা যাক টাঙ্গুয়ার হাওর
নিয়ে কিছু তথ্য। টাঙ্গুয়ার হাওরের বিশালত্ব এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য
সম্পর্কে আগেই শুনেছিলাম, তবে আজ নিজ চোখে দেখার সৌভাগ্য হলো। এই হাওরটি সুনামগঞ্জ
জেলার দু’টি উপজেলা- ধর্মপাশা ও তাহিরপুর জুড়ে অবস্থিত। এই দুই উপজেলার পঞ্চাশটিরও
বেশি হাওরের সমন্বয়ে ন’হাজার হেক্টরেরও বেশি এলাকা জুড়ে টাঙ্গুয়ার হাওর জেলার
সবচেয়ে বড় জলাভূমি। এর শেষপ্রান্তে ভারতের মেঘালয় পাহাড়। পাহাড় থেকে ছোট বড় বেশ কিছু ঝর্ণা এসে মিশেছে এই হাওরে।
শীত মৌসুমে পানি শুকিয়ে কমে গেলে এখানকার প্রায় ২৪টি বিলের পাড় জেগে ওঠে,
যাকে স্থানীয় ভাষায় ‘কান্দা’ বলে। তখন শুধু কান্দা'র ভিতরের অংশেই আদি বিল থাকে। তাইতো স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে এই হাওরটি ‘নয়কুড়ি
কান্দার ছয়কুড়ি বিল’ নামেও পরিচিত। বর্ষায় থৈ-থৈ পানিতে নিমগ্ন হাওরের জেগে থাকা উঁচু কান্দাগুলোতে আশ্রয় নেয়
হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি— রোদ পোহায়। তাই শীত মৌসুমে এই হাওরের রূপ সম্পুর্ণ বদলে যায়।
এ রকম সারি সারি হিজল করচের বনের মধ্য দিয়ে নৌকা নিয়ে ঘুরে
বেড়িয়েছি আমরা
নাস্তা শেষ। আমাদের নৌকা সামনে এগিয়ে চলছে। সবাই গল্প আর
ছবি তোলায় মশগুল। হঠাৎ সামনে তাকাতেই চোখে পড়লো পানিতে মাথা উঁচু করে থাকা হিজল-করচের
দৃষ্টি নন্দন সারি। সে এক অভাবনীয় দৃশ্য। সামনে ওয়াচ টাওয়ার। ধীরে ধীরে
আমাদের নৌকা এগিয়ে গেলো সেদিকে। আমাদের নৌকা ভিড়লো ওয়াচ টাওয়ারের পাশে। জলের বুকে ভাসমান
ছোট বড় বেশ কিছু ডিঙি আমাদের নৌকার দিকে ছুটে এলো। সাত্তার জোরে হাঁক দিলো। আমরা ওয়াচ
টাওয়ারে চলে এসেছি। কে কে গোসল করবা রেডি হও। সাত্তার, আলমগীর, মান্নান, আনোয়ার,
সোহেল, বেলাল, আলম সবাই হাফ প্যান্ট পড়ে পানিতে নামার জন্য তৈরি। বৃষ্টি থাকায়
কিছুটা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব, আমি জলে নামবো কি নামবো না ভাবতে ভাবতে শেষে নেমেই
পড়লাম। এই সুযোগ হয়তো আর পাবো না। এখানে পানির উচ্চতা একেক জায়গায় একেক রকম। কোথাও
বুক সমান পানি, কোথাও গলা সমান আবার কোথাও কোথাও ঠাঁই মেলে না। পানি বেশ ঠাণ্ডা তাই
খুব বেশি সময় আমি জলে থাকলাম না। তবে সাত্তার, আলমগীর আর মান্নান আরও অনেকক্ষণ
পানিতে দাপাদাপি করলো। আমার গোসল শেষ। সাত্তার আলমগীরের ফেরার অপেক্ষায় বসেছিলাম।
ছোট ছোট শিশু কিশোররা ডিঙি নিয়ে আমাদের নৌকার আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এগারো-বারো
বছরের একটি ছেলে হঠাৎ গান গেয়ে উঠলো। এখানকার আঞ্চলিক একসেন্টে নিজস্ব সুরে
একেবারে মাটির গান। গানের কথা শুনে আমরা খুব মজা পাচ্ছিলাম, অবশ্য ভালও লাগছিলো। গানের
কথাগুলো ছিল অনেকটা এরকম-
অন্তরে না রাখিলে, অন্তরে না রাখিলে
মনে মনে রাইকো,
আমি তো বালা না, বালা লইয়া থাইকো।
সাথে আরও কয়েকটি কিশোর এসে গলা মিলাচ্ছিলো। আমাদের মাকসুদ গানটি ভিডিও করে রাখলো।
ছেলেটির গানের রেশ থাকতে থাকতেই আমাদের নৌকা ছেড়ে দিলো। আমি নৌকার ছাদে দাঁড়িয়ে
চারিদিকে একবার চোখ বোলালাম। যেদিকে তাকাই সারি সারি হিজল-করচের বন, জলের বুকে
মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকটা রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্টের মত। এটা আসলেই
অসাধারণ এক দৃশ্য। ছোট ছোট স্থানীয় শিশু-কিশোর ডিঙি নিয়ে সেই গাছগুলোর ফাঁকে ফাঁকে
ঘুরে বেড়াচ্ছে। সোয়াম্প ফরেস্টের সৌন্দর্য্য উপভোগ
করতে করতে আমরা ফিরে চললাম তাহিরপুরের দিকে।
নৌকা চলছে তো চলছেই। পথ যেন আর শেষ হচ্ছে না। তবে আমাদের
কারো খারাপ লাগার কোন কারণ নেই। এই হাওরের একেক প্রান্তে একেক রূপ। কোথাও অবারিত
জলের আধার আবার কোথাও বা আঁকাবাঁকা নদীপথ দিয়ে আমরা ছুটে চলছি।
বিস্তীর্ণ জলরাশির মাঝে মাঝে দ্বীপের মতো ছোট ছোট গ্রাম কিংবা প্রায় ডুবন্ত রাস্তায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো হাওরের প্রকৃতিতে যোগ করেছে নতুন
মাত্রা। এই বহুমাত্রিক সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে
আমরা পৌঁছে গেলাম তাহিরপুরে। তবে তাহিরপুরে আমরা নৌকা থেকে নামলাম না। গতকালের
পানি ভাঙার অভিজ্ঞতার কথা আমরা কেউ ভুলিনি। তাই আজ নৌকা নিয়ে আরও সামনের দিকে এগিয়ে
চললাম। উদ্দেশ্য গতকাল যেখানে রাস্তায় পানি ভেঙেছি সেটা পার হয়ে নৌকা নিয়ে আমাদের
গাড়ির কাছে চলে যাওয়া। আরও কিছুদূর যাওয়ার পর আমি মাঝিকে জিজ্ঞেস করলাম- এটাও কি
টাঙ্গুয়ার হাওর? মাঝি বললো- না, এটা শনির হাওর। লক্ষ্য করলাম এই হাওরে পানি কিছুটা
কমে এসেছে বলে মনে হচ্ছে। তবে এখানে পানির উচ্চতা কম হলেও টোটাল এরিয়া কিন্তু কম
নয়। সামনে বহুদূর পর্যন্ত শুধু পানি আর পানি। মাঝে মধ্যে ছোট বড় হিজল গাছ পানিতে
মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। লোকজন ছোট ছোট ডিঙি নিয়ে মাছ ধরছে। বর্ষা শেষে আশেপাশের
বেশির ভাগ অংশই শুকিয়ে যায়, তখন এখানে চাষাবাদ হয়। আরও প্রায় ঘণ্টাখানেক চলার পর নৌকা
পৌঁছে গেলো আমাদের গন্তব্যে। সবাই নৌকা থেকে নেমে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো গাড়ির
অপেক্ষায়।
আমাদের হাওর যাত্রার
এখানেই ইতি ঘটছে। গত দুই দিনের এই ভ্রমণে পাওয়া না পাওয়ার হিসেব করা অর্থহীন। এই
দুইদিন ২৩ জন বন্ধু একসাথে যে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিলাম সেটাই বা কম কীসে! আমরা
জ্যোৎস্না রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারিনি, যাদুকাটা নদী কিংবা নীলাদ্রি লেকে
যেতে পারিনি, তবে গতকাল সন্ধ্যা থেকে হাওরের যে বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্য উপভোগ করলাম,
হাওর-নির্ভর মানুষের জীবনযাত্রার যে রূপ দেখলাম- সেটাও এক অনন্য অভিজ্ঞতা। আগামী
দিনে সময় সুযোগ হলে আবার কখনও আসবো এখানে, তখন হয়তো দেখতে পারো ভিন্ন এক টাঙ্গুয়ার
হাওর।
আমাদের গাড়ি চলে এসেছে।
আমরা একে একে গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে
আছি। আমাদের বহনকারী সেই নৌকাটি ফিরে যাচ্ছে তার চেনা গন্তব্যে। এখন আর বৃষ্টি
নেই। রোদ উঠেছে, চারিদিক সোনালি আলোয় ঝলমল করছে।