ভদ্রলোকের নাম ছিল রনবীর গুহ। পেশায় হোমিও ডাক্তার। সবাই বলত রবি ডাক্তার।
আমাদের বাড়ির আনতিদূরেই ছিল তাঁদের বাড়ি। তাঁর ছেলে স্বপন ডাক্তার ছিল আমার বাবার ছেলেবেলার বন্ধু; তাই ও-বাড়িতে আমার যাতায়াত
ছিল অবারিত। ভদ্রলোককে আমি ডাকতাম দাদু।
রবি দাদুর হোমিও ফার্মেসিটা ছিল আমাদের বাজারেই। আমি বাজারে গেলে তাঁর
ফার্মেসিতে যাওয়া ছিল অবধারিত। ফার্মেসির দুটি জিনিসের প্রতি আমার আকর্ষণ ছিল
প্রবল। প্রথমত ওঁর কাছে গেলে এক ধরনের ছোট্ট সাদা দানার মত দেখতে মিষ্টি হোমিও ঔষধ খেতে দিতেন, যেগুলো আমার ভীষণ প্রিয়
ছিল। দ্বিতীয় যে জিনিসটি দেখার লোভে
ওঁর দোকানে যেতাম সেটি ছিল দাদুর ফার্মেসির সেলফে রাখা একটা ছোট্ট সাদা পুতুল। খুব আহামরি কিছু নয়,
তুলা দিয়ে তৈরি হাঁটু ভাঁজ করে বসা এক বৃদ্ধের প্রতিকৃতি। দেখতে ছিল অনেকটা রবি দাদুর মতই। পুতুলটির মাথা একটি স্প্রিং দিয়ে ওটার
শরীরের সাথে জোড়ানো ছিল, হাত দিয়ে মাথাটি ছুঁয়ে দিলেই ওটা দুলত। ওখানে গেলে আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পুতুলটার
দিকে তাকিয়ে থাকতাম। দাদু আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতেন।
মাঝে মধ্যেই বলতেন, দাদুভাই, তুমি দেখছি আমার চেয়ে আমার এই পুতুলটিকেই বেশি
ভালবাস! আমি কিছুটা লজ্জিত ভঙ্গীতে
বলতাম, আমি তো তোমাকেও ভালবাসি।
রবি
দাদুদের বাড়িটি ছিল বেশ বড়। ঘাট বাধানো বড় একটা পুকুর ছিল,
বিশাল বাগানে ছিল অনেক ধরনের ফলের গাছ। স্বপন কাকার ছেলে অজিত আর আমি একই ক্লাসে
পড়তাম, তাই ওর সাথে বেশ ভাব ছিল। সময় পেলেই ওদের বাড়ি চলে যেতাম। কাকীও খুব আদর
করতেন। মনে আছে, কাকীর হাতের নাড়ু, সন্দেশ
বেশ মজার ছিল। আমি আর অজিত বাগানে ঢুকে ছুটোছুটি করতাম, এ গাছ ও গাছের ফল খাওয়া
ছিল রোজকার ব্যাপার। মনে আছে পূঁজার সময়
ওদের বাড়িতে বেশ কয়েকদিন ধরেই উৎসব চলতো। গান বাজনা হত, নানা ধরনের খাবার দাবার থাকতো। সব ধর্মের মানুষই পূঁজা
দেখতে আসত। আমরাও অনেক মজা করতাম।
বাবার চাকরির সুবাদে একসময় আমরা গ্রাম থেকে শহরে চলে এলাম। প্রথম প্রথম খুব
খারাপ লাগতো। শহরে মন টিকতে চাইত না। গ্রামের সেই পরিচিত মানুষজন, আত্মীয়স্বজন,
খোলামেলা পরিবেশ, বাগান, নদী, ফসলের মাঠ এ সব কিছুই খুব মনে পড়তো। আত্মীয় স্বজনদের
খবরাখবর সবসময় পেতাম কিন্তু ওদের কোন খবর কখনো কেউ দিত না, আসলে ওদের বাপ্যারে
বাসায় তেমন কোন আলোচনা হতো
না। মাঝে মাঝেই অজিতদের কথা বেশ মনে পড়তো। অজিত, রবি দাদু আর কাকিমার কথা।
সময়ের
আবর্তে মানুষ অনেক কিছুই ভুলে যায়। শহরে নতুন স্কুলে ভর্তি হয়েছি, তখন স্কুলের বন্ধুদের সাথে মিশে অজিতদের কথা প্রায় ভুলেই
ছিলাম। বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে।
আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। একদিন শুনি আমরা
গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছি। শুনেই আমার মনে একটা আনন্দের ঝড় বয়ে গেলো। হঠাৎ
অজিতদের কথা মনে পড়লো, রবি দাদু, অজিত,
কাকী, ওরা কেমন আছে? মনে মনে ভাবি বাড়ীতে গেলে ওদের সাথে তো দেখা হবেই।
সেদিন বাড়িতে পৌছুতে আমাদের অনেক রাত হয়ে গেলো। খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে উঠে নাস্তা সেরে হাঁটতে হাঁটতে
অজিতদের বাড়ির দিকে গেলাম। আমি বাগানের পাশ দিয়ে হেঁটে ওদের বাড়িতে ঢুকলাম। উঠানে এসেই
বেশ অবাক হলাম! বাড়িটা জনমানবহীন কেন! নিস্তব্দ-নিঝুম, কোন মানুষের সাড়া নেই। আমার কেমন যেন খটকা লাগলো, সবাই বেড়াতে গেছে নাকি? কিন্তু কতদিন ধরে বেড়াচ্ছে? সারা
উঠান জুড়ে আগাছার জঙ্গল। আগে তো কখনো এমন দেখিনি! ওদের বাড়ির উঠানে বিভিন্ন ধরনের ফুলের গাছ ছিল। সবসময় খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন
গোছানো একটা বাড়ি। কাকী নিজেও এমনই থাকতে পছন্দ করতেন।
পুকুর ঘাটে গেলাম, মনে হল অনেকদিন কেউ এখানে আসে না। ঘাটের
ধাপে ধাপে শ্যাওলার পুরো স্তর জমে আছে। বাড়িটা অনেকটা
ছাড়াবাড়ির মতই লাগছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল।
ওদের কারো সাথে দেখা হল না।
বাড়িতে গিয়ে আমার চাচাতো ভাই বসিরকে জিজ্ঞেস করলাম অজিতদের বাড়িতে গেলাম, দেখলাম কেউ নেই, ওরা সব
কোথায় গেছে?
বসির বলল, ওরা তো নাই।
নেই মানে, কোথায় গেছে?
ইন্ডিয়া চইলা গেছে।
ভেতরটা এক নিমেষে কেমন যেন ফাঁকা হয়ে গেল। অজিতরাও চলে গেল!
আর রবি দাদুর ফার্মেসি?
রবি দাদু তো কবেই মারা গেছে।
আমি
খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী বলিস! কবে?
তা প্রায় বছরখানেক হইবে।
মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। রবি দাদুর হাসি খুশি রুগ্ন চেহারাটা চোখের সামনে
ভেসে উঠলো। কতদিন ওঁর ফার্মেসিতে গিয়েছি, ওঁর দেয়া হোমিও ঔষধ খেয়েছি। আজ রবি দাদু
নেই! আর ওঁর ফার্মেসির সেই ছোট্ট সাদা
পুতুলটা, আজও চোখে চোখে ভাসে।
ওরা চলে গেল কেন?
বসির কি যেন বলতে চাইল কিন্তু ফজলু চাচার ডাক শুনে বসির ভেতরে চলে গেলো।
আমি আবার হাটতে হাটতে অজিতদের বাড়িতে গেলাম। বাড়িতে ঢোকার মুখে বাগানের
দিকে একবার তাকালাম, আগে আরও অনেক ফলের গাছ ছিল। যদিও অনেক দিন আগের কথা কিন্তু এ
বাগানের প্রতিটা জায়গা আমার চেনা। অজিত আর আমি এ বাগানে কত ছুটোছুটি করেছি, ফল
খেয়েছি। রাস্তার দিকে হেলে পড়া জামগাছটা এখনও আছে। কতদিন আমি আর অজিত হেঁটে হেঁটে
এই গাছটাতে চড়েছি! কাকী কী যে
আদর করত আমাকে! ও বাড়িতে গেলেই মাথায় হাত বুলিয়ে চুলগুলি এলোমেলো করে দিত আর বলতো, কী-রে, মুখটা শুকনা কেন? খেয়েছিস? আমি হ্যা-সূচক মাথা নাড়াতাম। না হলে ধরে বেধে খাইয়ে দিতেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক বাহিনীদের অত্যাচারের বিষয়ে নতুন করে আর বলার কিছু নেই। তখন
দেশীয় রাজাকারদের কারণে রবি দাদুদের পরিবার ওদের
টার্গেটে পরিণত হয়েছিলো। শুনেছি সেই সময়ে ওঁরা কিছুদিন আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। তাই আমার মার সাথে কাকীর খুব ভাল
সম্পর্ক ছিল। মা মারা যাবার পর কাকী যেন আমাকে আরও বেশী আদর করত। আজ সব কথা মনে পড়ছে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো।
বিকালের দিকে বাজারে গেলাম। স্বভাবতই রবি দাদুর ফার্মেসির সামনে দিয়ে যাবার
সময় চোখটা আটকে গেল। রবি দাদুর সেই পুরানো মলিন ফার্মেসিটা আর নেই, সেখানে স্থান
করে নিয়েছে একটা ষ্টেশনারী দোকান। ঝকঝকে নতুন ফার্নিচারে থরে থরে সাজানো জিনিস
পত্র।
কয়েকদিন পরেই আমরা গ্রাম থেকে চলে এলাম। অনেক পরে জেনেছিলাম ওরা দেশ ছেঁড়ে
যেতে চায়নি, এলাকার প্রভাবশালী মানুষেরা তাদের চলে যেতে বাধ্য করেছিল।
এরপর অনেকটা সময় কেটে গেছে। দীর্ঘ সময় আমি গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন। অনেক বছর
পরে আবার গ্রামে ফিরে দেখি অনেক কিছুই বদলে গেছে। অজিতদের বাড়িটা খুঁজে পেতে বেশ কষ্টই হল। ওদের বাড়ির চিহ্ন বলতে
শুধুমাত্র একটি হেলেপড়া জামগাছটা ছাড়া আর কিছুই নেই। এই গাছটা ছিল বাগানের দক্ষিণ পাশে।
ঘন বাগানটা এখন আর নেই। পুকুরটা ভরাট করে ওখানে নতুন বাড়িঘর উঠেছে, উঠানটার এক পাশ
দিয়ে নতুন একটি পাকা রাস্তা করা হয়েছে। এটা আগে ছিল না, এখানে শুধু ওদের বাড়িতে
ঢোকার একটা নিজস্ব রাস্তা ছিল।
আজ আবার এতগুলো বছর পরে এ পথ দিয়েই যাচ্ছি। আগেরবার যখন এসেছিলাম ওদের
বাড়িটা ছিল পরিত্যাক্ত। এখন ওটা আর পরিত্যাক্ত নেই, বেশ কিছু বাড়িঘর উঠেছে, আরও
নতুন বাড়ি উঠছে। কে বলবে এখানে এক সময় গুহ ঠাকুরদের বড় একটা বাড়ি ছিল, ঘাট বাধানো
পুকুর, বাগানে নানা ফলের সমারোহ, উঠানটা নানা জাতের ফুলে সাজানো থাকতো ? সুখি একটা
যৌথ পরিবার যে এখানে বাস করত এখন তার কোন চিহ্নই নেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন