সোমবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৮

ছোটগল্পঃ গন্তব্য


একটা অদ্ভুত হাহাকারে আচ্ছন্ন হয়ে ছিলো পুরোটা সময়। অস্তিত্বহীনতার অমোঘ নিয়তির প্রহরগুলো দারুণভাবে রেখাপাত করেছিলো ছোট দু’টি সত্তা জুড়ে। প্রবল মনের জোরে কিশোর বয়সের সীমা ছাড়িয়ে হঠাৎ যেন বড় হয়ে উঠেছিলো মাত্র এগারো বছরের কলিম। সময়ের প্রয়োজনে নিজের থেকে মাত্র দুই বছরের ছোট ভাই রতনের অভিভাবক হয়ে উঠেছিলো। আর, কোন এক অলৌকিক উপায়ে মায়ের অন্তিম সময়ের ভারী দেহটিকে বহন করার শক্তি অর্জন করেছিলো। সময়ই যেন সবকিছু নির্ধারণ করে দেয়, মানুষ কেবল সময়ের সীমারেখায় সমান্তরালভাবে নিরন্তর ছুটে চলে চেনা গন্তব্যে।
অনেকক্ষণ ধরে আকাশে চক্কর দিচ্ছিলো শকুনটা। ঘুরে ঘুরে পাক খাচ্ছিলো নীলগঞ্জ আর আলীপুরের মাঝখানে দিগন্তবিস্তৃত বিলের মধ্য দিয়ে মোটা দড়ির মত মাটি আঁকড়ে থাকা কাঁচা সড়কটার উপর। পাশের বিলে থৈ-থৈ পানি। আশপাশের কয়েক মাইলের মধ্যে লোকালয়ের চিহ্ন নেই। ভাদ্র মাসেও মেঘহীন আকাশ। হাওয়াশূন্য রোদ্দুরে খাঁ-খাঁ করা খোলা জলাভূমিটা সম্পূর্ণ স্থির। মৃত্যুর মত নিস্তব্ধ সময়টাতে বৃক্ষবিহীন ফাঁকা রাস্তাটার কোথাও কোন ছায়া নেই। রাস্তাটির দু’পাশে নল-খাগড়া আর জংলি লতাপাতায় পরিপূর্ণ পানিতে সাপ আর জোঁকের আখড়া।
রাস্তা থেকে অনেক দূরে ভরা বিলের মাঝে ডিঙ্গি নৌকার উপর দাঁড়িয়ে এদিকেই তাকিয়ে আছে জমির শেখ। ভাবছে- ‘এই অসময়ে শকুনটা এলো কোত্থেকে? অনেকদিন এ তল্লাটে এ-প্রাণি দেখা যায়নি।’ জমির শেখ কপালে হাত রেখে রোদ আড়াল করে বড় সড়কটির দিকে তাকায়। প্রায় দুই মাইল দূরের রাস্তাটিকে ঝাপসা লাগে। বাঁক খাওয়া সড়কটির যেখানে ভেঙ্গে খাদের সৃষ্টি হয়েছে, তার ঠিক ওপাশে কিছু মানুষের অবয়ব চোখে পড়ে অস্পষ্টভাবে। জমির শেখ নিজের মনেই বলে, ‘আবার কারা আটকা পড়লো?’ দুপুরের কড়া রোদে লু হাওয়ায় ঠিকমত ঠাহর করতে পারে না সে। আরও কিছুক্ষণ চেষ্টা করে বিফল হয়, তারপর বাড়ির দিকে ঘুরিয়ে দেয় নৌকার মুখ।
চারিদিকে থৈ-থৈ জলরাশির মাঝে কাঁচা রাস্তাটার উপর কেবলমাত্র দুটি প্রাণি আর ভ্যানের উপর শোয়ানো ওদের মায়ের দেহটি ছাড়া আশেপাশের কয়েক মাইলের মধ্যে কোন জনমানবের সাড়া নেই। দূরের গ্রামগুলো ক্যানভাসে আঁকা ছবির মতই স্থির। মধ্যগগনে পূর্ণযৌবনা গনগনে সূর্যটা অকৃপণভাবে আগুনের হল্কা ছড়াচ্ছিলো। রতন কিছুক্ষণ পর পর কাপড়ে ঢাকা মায়ের দেহটিকে দেখে, তারপর বড় ভাই কলিমের মুখের দিকে তাকায়। সে চোখে হাজারো প্রশ্ন। কলিম ছোট ভাইয়ের করুণ চোখের দিকে তাকাতে পারে না। বুঝে গিয়েছে আজ থেকে ও-ই রতনের অভিভাবক।
ভাই, আর কতক্ষণ এইহানে বইয়া থাকুম আমরা? কিছুক্ষণ পর বড় ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলে রতন।
জানি না। একটা ভারী নিঃশ্বাস ফেলে বলল কলিম।
রতন ভাইয়ের মুখের দিকে তাকায়।
মনে অয় অনেক সময় লাগবো। পানি না কমলে ভ্যান নিয়া যাওন যাইবো না। ভ্যানের উপর মায়ের নিথর দেহটার দিকে তাকিয়ে বলে কলিম।  
নীলগঞ্জ হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে প্রায় পাঁচ মাইল দীর্ঘ এবড়ো-থেবড়ো পথ পেরিয়ে কলিমের ভ্যানটা এই খাদের কাছে এসে আঁটকে পড়েছে। উদাস চোখে ভাটার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলোনা ওর। নীলগঞ্জ থেকে আলীপুরের দিকে ছুটে চলা কাঁচা সড়কটা এই জায়গাটায় এসে হঠাৎ থমকে গেছে। গত বন্যায় ভেঙ্গে যাওয়া খাদটি রাস্তাটিকে দ্বিখন্ডিত করে দিয়েছে। বছর শেষ হয়ে গেলেও রাস্তাটি মেরামত করা হয়নি আর। জোয়ার-ভাটায় পানির উচ্চতার সাথে তাল মিলিয়ে চলাফেরা করে এখানকার মানুষ।  
ভাটা শুরু হয়েছে মাত্র। কিছুক্ষণ পর পর কলিম দেখে পানি কতটুকু কমলো। পানি হাটু সমান উচ্চতায় নেমে এলে রওনা দিবে ওরা। মাথার উপর সূর্যটা যেন ক্রমশ আরও নির্মম হয়ে উঠছে 
ভাই, কাইল বিহালে তো এত পানি আছিলো না!
বুঝতাছি না রে রতন, আগে তো একলা এইদিকে আহি নাই!
ভাবনায় পড়ে যায় কলিম। ওর ধারনা ছিলোনা গতকাল বিকেলে অসুস্থ মাকে হাসপাতালে নেয়ার সময় দেখা অল্প পানির খাদটি আজ এই সময়ে বুক সমান পানিতে ডুবে যাবে।
মাথার উপরে চক্কর দেয়া শকুনটির দিকে তাকিয়ে রতন বলে-
ভাই, অইডা কি উড়তাছে আকাশে?
আকাশের দিকে তাকায় কলিম। মাথার উপর শকুনের ওড়াউড়ি দেখে কিছুটা অস্থির হয়ে ওঠে। খাদের ঢাল থেকে একটু দূরে ভ্যানটার দিকে তাকায়। আয় তো রতন! তাড়াতাড়ি উঠে ভ্যানের কাছে যায়।
ভাই, কইলা না ঐডা কি?
ঐডা শগুন, হুনছি এইগুলান নাকি মরা খায়। বাজানের লগে বিলে আইসা একবার দেখছিলাম মরা গরু খাওয়ার লাইগ্যা দুইডা শগুন এইরহম আকাশে উড়তেছিলো।
রতন ভয় পায়।
ভাই, ঐডা কি আমগো দিগে আইবো?
কলিম কিছু বলে না, কেবল লক্ষ্য করে উড়ন্ত শকুনটার গতিবিধি। ভ্যানের উপরে মায়ের ছোট্ট দেহটি লম্বালম্বিভাবে শোয়ানো। পা দু’টো বাহিরে কিছুটা ঝুলে আছে। তাঁর পরনের কাপড়ের আঁচল দিয়েই মুখমন্ডল আরও ভাল করে ঢেকে দেয় কলিম।
ভাই, মায় আর ফিরা আইবো না? হঠাৎ রতন জিজ্ঞেস করে।
একটা চমক লাগে কলিমের। চট করে ছোট ভাইয়ের দিকে ঘুরে তাকায়। মনে পড়ে যায়- ঠিক এই প্রশ্নটাই রতন মাকে করেছিলো মাত্র তিনমাস আগে। তখন বাবার নিষ্প্রাণ দেহটা শোয়ানো ছিলো বাড়ির উঠোনে। ছোট ভাইটির দিকে তাকিয়ে মনটা কেমন করে ওঠে কলিমের।
বাবার চলে যাওয়ায় সেদিন বিরাট একটা ধাক্কা খেয়েছিলো কলিম। নিজের চোখের সামনে জলজ্যান্ত বাবাকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলো। বাবার মৃতদেহের কাছে বাকরুদ্ধ হয়ে বসেছিলো অনেকক্ষণ। তারপর জোরে একটা চিৎকার দিয়ে উঠেছিলো। সেই চিৎকারে সবাই ছুটে এসেছিলো ওদের বাড়ির উঠোনে। আজ মা চলে যাবার দিন কেউ নেই ওদের পাশে। আজ ওকে একাই সংগ্রাম করতে হচ্ছে, ছোট ভাইটিকেও সামলাতে হচ্ছে।
ভ্যানের উপর শোয়ানো মায়ের দেহটির পাশাপাশি বাবার মুখটা ভেসে ওঠে মনে। ক সুখ-শান্তি, আদর-স্নেহে ভরা ছিলো ওদের জীবন! বাবা-মা দুজনেই আগলে রেখেছিলো ওদের দু’ভাইকে। মাছ পাগল বাবার সাথে কতদিন এই বিলে এসেছে ও! ঘরের বাইরে নেমে দক্ষিণে তাকালেই দিগন্ত বিস্তৃত বিলের থৈ-থৈ পানি হাতছানি দিয়ে ডাকতো মালেক ঢালীকে। শক্ত সামর্থ্য মানুষ ছিল মালেক ঢালী। ক নিখুঁত নিশানা! বাজপাখীর ক্ষিপ্রতায় পানির নিচে মাছের নড়াচড়া লক্ষ্য করে সপাং করে ছুড়ে মারতো কোঁচ, যা বেশীরভাগ সময়ই ছিল অব্যর্থ। আঁধার রাতে পাঁচ ব্যাটারীর টর্চ নিয়ে বাবার সাথে কতদিন বিলের পানিতে নৌকা ভাসিয়েছে কলিম!  
‘বাপজান, অইহানে আলোডা ফ্যালতো’, কলিম বাপের দেখানো স্থানে আলো ফেলতেই চোখে পড়েছিলো লালচে লেজের সামান্য নড়াচড়া। মালেক ঢালীর জন্য ওটুকুই ছিল যথেষ্ট। সপাং করে কোঁচটা ছুটে গিয়েছিলো মাছের পিঠ বরাবর। বাপ-ছেলের মুখে হাসি ফুটেছিলো। বাপকে এমন হাসি আরও অনেকদিন হাসতে দেখেছিলো কলিম; নিজেও হেসেছিলো। তারপর একদিন সেই হাসি থেমে গিয়েছিলো একেবারেই।
নিখুঁত চোখের দৃষ্টি আর অব্যর্থ ক্ষিপ্রতা ছিল যার, সেও একবার ভুল জায়গায় পা ফেলেছিলো। আর সেই ভুলই তার জন্য কাল হয়ে দেখা দিয়েছিলো। জীবনে আর ভুল করার সুযোগ মেলেনি মালেক ঢালীর।
সেদিন হাত থেকে ছুটে যাওয়া কোঁচটা তুলতে নৌকা থেকে নেমে দাঁড়িয়েছিলো বিলের মধ্যে জমানো আগাছার স্তূপের উপর। হিসহিস শব্দটা কানে যাবার সাথে সাথেই সতর্ক হয়ে উঠেছিলো মালেক, কিন্তু নৌকায় উঠতে কিছুটা দেরি হয়ে গিয়েছিলো তার। হাঁটুর নিচে অব্যর্থ ছোবল খাওয়ার সাথে সাথেই একলাফে উঠে এসেছিলো নৌকায়। ‘বাপ, আমারে কেউটেয় কাটছে, জলদি নৌকা ঘুরা’ বলেই কোমর থেকে গামছাটা খুলে নিয়ে হাটুর উপরে শক্ত করে বেঁধে ছেলের সাথে লগি চালিয়ে ফিরে এসেছিলো বাড়িতে। কিন্তু ঘরে ফেরা হয়নি তার। ঘরের সামনের ছোট্ট উঠোনে সেই যে আছড়ে পড়েছিলো, আর ওঠেনি। কলিমের চোখ দু’টো ছলছল করে ওঠে।
রতন আবার প্রশ্ন করে ভাইকে- ভাই, কতা কওনা ক্যান? মায় আর আমার লগে কতা কইবো না?
কলিমের খুব কান্না পায়। অনেক কষ্ট করে নিজেকে সামলায়। ভাইকে কাছে টেনে নিয়ে বলে,
মানুষ মইরা গ্যালে আর ফিরে আহে নারে ভাই। আমগো মায় আর কতা কইবো না।
রতন কাঁদতে কাঁদতে বলে- তইলে মেডিকেলে বইয়া কইছিলি ক্যান যে মায় ভাল অইয়া যাইবো?
কলিম উত্তর দিতে পারে না। ভাইয়ের কাছ থেকে নিজেকে লুকাতে খাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। রতনকে ক বলবে ও? নিজের বুকে পাথর চেপে ভাইকে সান্ত্বনা দিয়েছিলো। মায়ের শেষ সময়ের করুণ চোখের চাহনি বুকের ভিতর আলোড়ন তোলে কলিমের। রাত্রির শেষ প্রহরে মায়ের অন্তিম মুহূর্তের যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখের ছবিটা ভুলতে পারে না। যাকে দু’দিন আগেও মা মুখে ভাত তুলে দিয়েছে সেই অবুঝ ছোটভাইটিকে কাল রাত্রে বলতে পারেনি- ওদের মা আর বেঁচে নেই।
মায়ের অকাল মৃত্যু কলিমকে মুহুর্তেই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলো। মাত্র এগারো বছরের কলিম হয়ে উঠেছিলো একজন জীবন যোদ্ধা। কাউকে বলে দিতে হয়নি- ওর কি করণীয়। মাতৃপিতৃহীন অনাথ কিশোরটিকে একমাত্র ছোট ভাইটিকে নিয়ে টিকে থাকার সংগ্রামে নামতে হয়েছিলো।
ভোর হতে তখনও অনেক বাকি। হাসপাতালের পাওনা পরিশোধ করার চিন্তাটা কেবলই ঘুরে ফিরে মাথায় আসছিলো। শিক্ষিত ভদ্র মানুষগুলোর নির্মম আচরণ ওকে মনে করিয়ে দিয়েছিলো- বাস্তবতা কত কঠিন! এ পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে কারো উপর নির্ভরশীল হওয়া চলবে না। কারো জন্য অপেক্ষা করে থাকলেও হবে না। নিজে বাঁচতে হবে, ছোট ভাইটির মুখের অন্নও যোগাতে হবে। 
ভোরের আলো ফোটার আগেই ভ্যানটা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলো কলিম। টাকা জোগাড় করতে হবে, মায়ের মৃতদেহ নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। টাকার অভাবে মায়ের লাশ হাসপাতালে পড়ে থাকবে? নিজেই নিজেকে বলেছিলো- ‘তাই কী হয়! কলিম এহনো বাইচা আছে না?’। গলার কাছে দলা পাকানো কান্নাটাকে আটকে রেখে ছোট ভাইটিকে বলেছিলো-‘তুই মার কাছে থাক, আমি টাকার জোগাড় কইরা আইতাছি।’ সেই কাকভোরে ভ্যান নিয়ে চলে গিয়েছিলো ষ্টেশনে। বুকের ভিতর চাপা কষ্টের দাগ কেউ দেখতে পায়নি। কয়েক ঘন্টা মানুষ আর মালামাল টেনে কলিম যখন হাসপাতালের পথ ধরলো ভাদ্র মাসের সূর্য্য তখন তার স্বরূপ দেখানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। 
খাদের কাছ থেকে কলিম ঘুরে তাকায়। রতন তখনও মায়ের দেহকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলো। ছোট ভাইয়ের কাছে এগিয়ে যায়।
কান্দিসনা ভাই। আমগো কপালডাই খারাপ। আইজ থেইক্যা আমরা এতিম অইয়া গেলাম।
রতন তখনও ডুকরে ডুকরে কাঁদছিলো। -মায় ক্যান মইরা গ্যালো?
কলিম রতনকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে- চিন্তা করিস না ভাই, আমি বাইচ্যা থাকতে তোর কোন কষ্ট অইবো না।
রতন তখনও মায়ের মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে থাকে, দু’চোখ বেয়ে নামে বাঁধভাঙা অশ্রুর ধারা।

কলিম উঠে গিয়ে আবার দেখে পানির উচ্চতা কতটুকুতে নামলো। মাথার উপর দগদগে সূর্যটা একটু একটু করে পশ্চিম দিকে নামছে। পেটের ভিতরে রাক্ষুসে ক্ষুধাটা জানান দিচ্ছে বার বার। কলিম রতনের দিকে তাকায়, মনে পড়ে গতকাল রাতে ছোট এক টুকরা পাউরুটি ছাড়া দু’ভাইয়ের পেটে আর কিছুই পড়েনি। এই প্রতিকূল পরিস্থিতি ছোট্ট রতনকেও ভুলিয়ে দিয়েছে ক্ষুধার কষ্ট। 
অপেক্ষার প্রহরগুলো বড় দীর্ঘ। আশেপাশের বিরূপ প্রকৃতি এই সময়টাকে আরও অসহনীয় করে তোলে। প্রচণ্ড গরমে অস্থির হয়ে উঠেছে রতন। গা থেকে জামা খুলে বিলের পানিতে ভিজিয়ে আবার গায়ে জড়িয়ে নেয়। হঠাৎ সামনের পানির দিকে চোখ পড়তেই দেখে একটা সাপ পানিতে সাতার কেটে এদিকেই আসছে। রতন ভাইকে দেখায়।
ভাই দেহো, সাপটা আমগো দিগেই আইতাছে,
কলিম তাকিয়ে দেখে একবার। বলে- আউক।
যদি কামড় দেয়?
এইডা ডোরা সাপ, ডরের কিছু নাই।
কলিম আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে শকুনটা চলে গেছে। রোদের তেজও ধীরে ধীরে কমছে। কলিম আবার খাদের কাছে গিয়ে পানির উচ্চতা পরীক্ষা করে।
ভাই, এহন যাওন যাইবো না? রতন জিজ্ঞেস করে।
না রে রতন, এহনও অনেক পানি, ভ্যান ডুইবা যাইবো। 
তাইলে আমরা আর কতক্ষণ বইয়া থাকুম? মার খুব কষ্ট অইতাছে, না-রে ভাই?
কলিমের মনে পড়ে ওদের মসজিদের হুজুর বলেছিলো- মানুষ মরে গেলে তার শরীরে খুব ব্যথা হয় কিন্তু সে বলতে পারে না। কলিম নিজের জামাটা খুলে কাপড়ে ঢাকা মায়ের দেহটির উপরে বিছিয়ে দেয়। ভাইয়ের দেখদেখি রতন তার ভিজা জামাটা দিয়ে মায়ের পা দু’টো ঢাকে।
অপেক্ষার দীর্ঘ প্রহর  একসময় শেষ হয়। সূর্য্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে অনেকটাই। কলিম আবার খাদের পাড়ে গিয়ে দাঁড়ায়। পানি কমে গিয়ে হাঁটুর কাছাকাছি উচ্চতায় নেমেছে। কলিম ভাবে- ‘এইবার যাওয়া যাইবো।’ ভ্যানের কাছে ফিরে এসে বলে,
রতন ধর তো ভাই, রশি দিয়া মার দেহটারে ভাল কইরা আটকাইয়া নেই।
ভাই, মায়রে বান্ধতাছো ক্যান?
রশি দিয়া ভালমত আটকাইয়া না নিলে মার দেহ ঐ উঁচা-নিচা গর্তে পইড়া যাইবো।
রতন বুঝতে পেরে আর কোন কথা বলে না। বড়ভাইয়ের কথামত কাজ করে চলে শুধু। 
আয় রতন, এইবার আমরা রওনা দেই

ধীরে ধীরে খাদে নামে ওরা। কলিম হ্যান্ডেল ধরে ভ্যানটাকে সামনের দিকে টেনে চলে আর রতন পিছন থেকে ধাক্কা দেয়। উঁচু-নিচু কাদামাটিতে বার বার ভ্যানটা আটকে যাচ্ছিলো। ছোট্ট রতনের পক্ষে নিজেকে সামলে ভ্যান ঠেলা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। কলিম বুঝতে পেরে ছোট ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলে,
রতন তুই খালি ভ্যানের পিছনডা ধইরা রাখ।
আইচ্ছা।
রতন প্রাণপণে চেষ্টা করে ভ্যানটা ধরে রাখার, কিন্তু উঁচু-নিচু পিচ্ছিল খাদের পানিতে পড়ে যায় হঠাৎ। কলিম পিছন ফিরে তাকায়। ভ্যান ছেড়ে ভাইকে ধরার উপায় থাকে না। ছোট ভাইয়ের উদ্দেশ্যে শুধু বলে,
রতন সাবধানে চল ভাই।
রতন উঠে দাঁড়ায়, আবার পেছন থেকে ধাক্কা দেয়।
অল্প জায়গার খাদটি পার হতে দুই ভাইয়ের অনেক সময় লেগে গেল। মায়ের দেহটি নিয়ে যখন ওরা খাদের ওপারে উঠলো- সূর্য্য তখন পশ্চিম আকাশের শেষ প্রান্তে নেমে এসেছে। দূরে গ্রামগুলোর গাছের মাথা ছুঁই ছুঁই।
ভাই, আন্ধার হওয়ার আগে আমরা বাড়ি যাইতে পারুম?
দেহি!
কলিম রতনের দিকে তাকায়; বোঝে ক্ষুধা তৃষ্ণায় ও বেশ ক্লান্ত।
তুই পেছন থেইক্কা জোরে ধাক্কা দিতে পারবি না রতন?
রতন জবাব দেয়- হ, পারুম। ভাই, তোমার পায়ে কত্তবড় একটা জোঁক! হঠাৎ কলিমের পায়ের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ওঠে রতন।
কলিম পিছনে ঘুরে পায়ের দিকে তাকায়। জোঁকটা গোড়ালির উপর থেকে প্রায় হাঁটু কাছাকাছি পর্যন্ত লম্বালম্বিভাবে আঁকড়ে আছে। রাস্তার পাশের ঝোপ থেকে কাঠি নিয়ে জোঁকটা ছাড়ায়। রক্তের লাল ধারাটা পা বেয়ে নেমে আসে। রতন ভাইকে বলে,
ভাই, রক্ত পড়তাছে তো। তুমি একটু খাড়াও।
কিছু দুর্বাঘাস দু’হাতে ডলে কলিমের পায়ের ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দেয় রতন। রক্ত পুরোপুরি বন্ধ হয় না।
কলিম বলে- থাউক আর কিছু দেওন লাগবো না, রক্ত পড়া এমনিই থাইমা যাইবো। আর দেরি করনের সময় নাই। বেলা শেষ অইয়া আইতাছে। তাড়াতাড়ি চল।
আবার শুরু হয় ওদের দুর্গম যাত্রা। নিজেদের শরীরের অবশিষ্ট শক্তিটুকু অবলম্বন করে দুই ভাই ভ্যানটাকে চালিয়ে নিয়ে চলে বাড়ির পথে। উঁচু-নিচু পথের ঝাঁকুনিতে ভ্যানের উপর মায়ের দেহখানি দুলছিলো বার বার। পিছন থেকে ভ্যান ঠেলতে ঠেলতে মাত্র নয় বছরের ছোট্ট রতন বার বার কাপড়ে ঢাকা মায়ের দিকে তাকায় আর ভাবে- এখন থেকে মা বলে ডাকবার আর কেউ থাকলো না। ব্যথা পেলে কেউ আর আদর করবে না, কোলের মধ্যে নিয়ে রাতজেগে পাখার বাতাস করবে না, মুখে ভাত তুলে দেবে না। ঘুমের ঘোরে হাত দিয়ে আর মাকে খুঁজে পাবে না রতন। রতনের বুক ফেটে কান্না আসে। ও বোঝে মায়ের দেহ নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়িতে পৌঁছতে হবে, ক্লান্ত শরীর নিয়ে ভ্যান ঠেলে চলে। দু’টি চোখ ক্রমশ ভিজে ওঠে।
রতন, আর একটু ভাই। এই দ্যাখ- আমরা আইসা পড়ছি। ঐ তো জমির চাচার ঘর দেখা যাইতাছে। সামনে থেকে কলিম বলে।  
ভাইয়ের কথা শুনে রতন সামনের দিকে তাকায়, দূরে ওদের বাড়িটা তখন চোখে পড়ছিলো। বাড়ির প্রবেশমুখে জমির শেখের ছোট্ট কুঁড়েঘরটাও স্পষ্ট হচ্ছিল। ক্লান্ত অবসন্ন দেহে বড়ভাই কলিমের সাথে ভ্যান ঠেলে এগিয়ে চলছিল ছোট্ট রতন।

অপরিণত বয়সী দুটি কিশোরের অসম যুদ্ধটা ধীরে ধীরে শেষ হয়ে আসছিলো। দুঃস্বপ্নময় দীর্ঘ একটি দিনের শেষে একটু একটু করে ওরা এগিয়ে যাচ্ছে চেনা গন্তব্যের দিকে। দিন শেষে গোধূলির রঙিন আভাটুকু মিলিয়ে যাবার পর চারিদিক থেকে অন্ধকারের দেয়ালটা ক্রমশ এগিয়ে এসে ঢেকে দিচ্ছিলো ওদের।

রবিবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৮

কবিতাঃ ফানুস



জলরঙে আঁকা জীবন,
শিল্পীর বিমূর্ত ক্যানভাসে- চেনা সুখ,
হাসি-কান্নার বাহারি জলছবি।
মোমজোছনার নিরেট আলোয়
দুঃখ ভোলার স আয়োজন শেষ হলে
অবিনাশী কবিতা লিখে যায় কবি। 
অনন্ত রাত্রির অদ্ভুত আঁধার ফুরালে
সূর্যের রঙ খোঁজে শিশিরের ভাঁজে,
মেঘলা দুপুরে এক পশলা বৃষ্টি
বদলে দিয়ে যায় জীবনের রঙ,
তখন- বাদলা দিনের পাগলা হাওয়া
সুখের রঙিন ফানুস ড়ায়,
সময় ঘড়ি উল্টোপথে চলে, খোঁজে- 
সুখের আকাশ, নাটাই ঘুড়ি;
পাখীর ডানায় ক্ষ’য়ে যাওয়া ক্ষণ
সুর তোলে ভাঙা বীণায়,
আলোর পাখি উড়ে যায় দূরে
-
পড়ে থাকে
শূন্য খাঁচা।

শুক্রবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৮

ছোটগল্পঃ নীল জোনাকির গল্প


সেদিনের সেই নির্দয় সন্ধ্যাটা আমার মনের ভেতরে একটা গভীর ক্ষত এঁকে দিয়েছিলো। একেবারে একা যখন নিজের ভেতরে ডুব দেই, অজান্তেই সেখানে মেয়েটির বেদনাক্লিষ্ট মুখচ্ছবিটা ভেসে ওঠে। সেদিন সবচেয়ে ভঙুর মুহূর্তে আমি যখন অনুভব করলাম মেয়েটির ঐ পরিবেশে চলে যাওয়ার পেছনে আমার নিজের একটা ভূমিকা আছে, তখন থেকে একটা অপরাধবোধ আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। ওকে ওখানে দেখার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। মেয়েটি কথা বলার সময় যদিও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছিলো কিন্তু আমি যেন ওর ভেতরের চাপা গোঙানিটা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম- অনেকটা শববাহী বাহনের মত। ওর চোখ, মুখের অভিব্যক্তি এতটাই নির্জীব ছিলো- মনে হচ্ছিল যেন পরিত্যক্ত দেহটিকে কোনরকমে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। সেদিন খুব অসহায়, অক্ষমের মত প্রত্যক্ষ করেছিলাম একটা জোনাকির অব্যক্ত ব্যথা, বেদনায় ক্রমশ নীল হয়ে যাওয়া। আর ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, এই আমিই ঘটনাটির একমাত্র সাক্ষী হয়ে রইলাম। 

মেয়েটি দরজা খুলতেই ভূত দেখার মত চমকে উঠলাম
এ কাকে দেখছি আমি!
আমার মুখের দিকে চোখ পড়তেই নিজেকে লুকাতে রুমের ভেতরের দিকে দৌড়ে পালালো ও। আমিও কিছুটা ইতস্থত বোধ করছিলাম। ভেতরে ঢুকবো কি ঢুকবো না ভেবে কিছুক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে থাকার পর অবশেষে প্রবেশ করলাম। ও তখনও আমার দিকে পেছন ফিরে নিজেকে আড়াল করতে ব্যস্ত।
আমারও তখন একই অবস্থা। আমরা কেউই ভাবিনি এই পরিবেশে এভাবে আমাদের দেখা হবে আমি ঘরের চতুর্দিকে চোখ বোলালাম। দশ বাই দশ সাইজের ছোট্ট একটি কামরাআসবাব বলতে অতি প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র। একটি ছোট্ট ড্রেসিং টেবিলের উপরে কিছু সস্তা প্রসাধনী আর আলনায় ওর ব্যবহৃত কাপড়চোপড়। আমি আস্তে করে কাশি দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিলাম আবার। ওর আড়ষ্টতা তখনও ভাঙেনি, তবে ধীরে ধীরে মাথা নিচু করে আমার দিকে ফিরলো। অনেকক্ষণ পর আমিই মুখ খুললাম।
কেমন আছো পরী?
পরী তখনও মুখে আঁচল দিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে ছিল লজ্জা ও সংকোচে আমার মুখের দিকে তাকাতে পারছিল না। চোখ দুটো ভেজা অনেকক্ষণ পর বলল-
আমি তো ভাই কচুরিপানা, স্রোতের তোড়ে ভাইসা আইছি, আপনাকে এখানে দেখবো ভাবি নাই কখনো
আমি কোন জবাব খুঁজে পেলাম না কী করে বলি প্রায়ই আমার পা পড়ে এ পাড়ায় ব্যবসার মালামাল কেনার জন্য আমাকে ঢাকায় আসতে হয় তখন মাঝে মাঝেই ঢু মারি এখানে পরীকে কেন জানি এ কথাগুলো বলতে পারলাম না আমার কৌতুহল হচ্ছিল ও কিভাবে এখানে এসে পড়ল স্বেচ্ছায় নাকি কেউ জো করে এনেছে? ওকে যতটুকু দেখেছি তাতে স্বেচ্ছায় এখানে আসার মেয়ে ও না, কিন্তু কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারলাম না আমরা দুজনেই বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম। পরীই নিরবতা ভাঙল বার
মতিন ভাই, আপনার খুব জানতে ইচ্ছা করছে আমি কি করে এখানে এলাম, তাই না?
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ওর চোখের দিকে তাকালাম। পরীও নিশ্চুপ। নিচের দিকে তাকিয়ে পায়ের আঙুলগুলো দিয়ে মেঝেতে এলোমেলো আঁকিবুঁকি করছিলো। দু’চোখ বেয়ে টপটপ জল গড়িয়ে পড়ছে। কিছুক্ষণ পর আঁচলে চোখ মুছে আমার দিকে তাকিয়ে বলল-
কী করবো! মুর্খ মেয়েমানুষ আমার ভাগ্যই আমাকে এখানে টেনে নিয়ে এসেছে পোড়া কপাল নিয়ে যার জন্ম তার জন্য সুখ-তো সোনার হরিণ সুখের সংসার আমার কপালে সইলো না, তাইতো এখন হাজার মানুষের জন্যে সুখের পসরা সাজাই
এমন থমথমে পরিবেশে কি বলতে হয় আমার জানা নেই। অনেকক্ষণ পর বললাম-
দেখো পরী, জানি না তুমি কিভাবে এখানে এসে পড়লে কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না তুমি স্বেচ্ছায় এসেছো তবে একটা ব্যাপার আমি ঠিক মেলাতে পারছি না কী এমন হয়েছিল যে তোমাকে বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হল?
পরী সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিল-
কোন মেয়ে কি সুখের সংসার, স্বামী-সন্তান ফেলে স্বেচ্ছায় এমন পরিবেশে আসে? আপনিই বলেন।
আমি ওর চোখে এমন কিছু দেখেছিলাম যে সাথে সাথে উত্তর দিতে পারিনি। মনে হচ্ছিলো পরী আমায় কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিল। পরিস্থিতি সহজ করতেই বললাম- শুনলাম ফজল ভাই নাকি তোমাকে অনেক জায়গায় খুঁজেছে তুমি ফিরে যাও পরী
পরী আমাকে থামিয়ে দিয়ে বল- তা আর হয় না মতিন ভাই আমি কাউকে ঠকাতে পারবো না আমার জন্যে অন্য কারো জীবন নষ্ট হোক তা আমি চাই না। ওরা ভাল থাকুক।
কিছুক্ষণ পর পরী নিজে থেকেই বলতে শুরু করলো ওর এখানে আসার কাহিনী।
মায়ের কথামত অন্তুর বাবা আমাকে ঘর থেকে বের করে দিলে সারারাত ঘরের বাইরের বারান্দায় কাটিয়ে দিলাম পরদিন আর সেখানেও ঠাঁই হল না তাড়িয়ে দিলে একেবারেই চলে আসতে বাধ্য হলাম। পা ধরে কত কাঁদলাম! আমার বুকের মানিকরে কেড়ে নিয়ে আমাকে চলে আসতে বাধ্য করল ওরা পরী খানিকক্ষণ ম্লান মুখে বসে রইলো, তারপর নিচুস্বরে বলল-
ওরা বলে আমি নাকি চরিত্রহীনা।
আমি সান্ত্বনা দেবার ভাষা খুঁজে পেলাম না। আঁচলে ভেজাচোখ মুছে মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে আবার বলে উঠলো-
আমার অপরাধ কি ছিল জানেন?
আমি ওর দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালাম। ও বলল-
থাক, আপনার মন খারাপ হয়ে যাবে
এবার আমার কৌতুহল আরও বেড়ে গেল। আমি বললাম- মন খারাপ হয় হোক, তুমি বল।
ও কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলল- আপনে যে আমাকে পরী নামে ডাকতেন! কখনও কখনও হাসি-তামাশা করতেন! সেটাই ছিলো আমার অপরাধ।
তৎক্ষণাৎ মনে হল কেউ যেন আমাকে আগুনের ছ্যাকা লাগিয়ে দিলো। আমি খুব অবাক হয়ে বললাম, 
কী বললে! আমি পরী বলে ডাকতাম সেটাই তোমার অপরাধ?
পরী চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি আবার বললাম,
মি তো কালেভদ্রে ওদের বাড়িতে যেতাম, আর তোমার সাথে হাসি ঠাট্টা যা-ই হতো সেতো ফজল ভাইয়ের সামনেই। ফজল ভাই তো আমাকে কখনও কিছু বলেনি!
পরী মুখ তুলে আমার দিকে তাকালো। কান্নাজড়িত কণ্ঠে ও বলল-
এটা অন্তুর বাবার সমস্যা ছিল না, ওর দাদী সহ্য করতে পারতো না। সে আমাকেও অনেক কথা শোনাতো।
আমি কিছুটা বিরক্ত হয়েই বললাম- আমি তো ফজল ভাইয়ের কাছে ব্যবসার কাজে যেতাম। তোমার সাথে মাঝে-মধ্যে দেখা হত শুধু!
পরী তখন বলল- অন্তুর দাদীর সন্দেহের জন্য ওটাই যথেষ্ট ছিল। সে প্রায়ই অন্তুর বাবার কান ভারী করতো।
আমি দীর্ঘ সময় ধরে থম মেরে বসে রইলাম। কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না। অনেকক্ষণ পর বললাম-
কিন্তু এতে তোমার কী দোষ ছিল?
পরী ম্লান স্বরে বলল- আমারই তো সব দোষ। সে ধরেই নিয়েছিলো আপনার সাথে আমার গোপন সম্পর্ক আছে। অন্তুর দাদী প্রায়ই তার ছেলেকে বলতো- ‘তোর বউ তোরে ফালাইয়া মইত্যার লগে ভাগবো’।
আমার মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করতে লাগলো শুধু পরী নামে ডাকার জন্য এত সমস্যা! এটা বুঝলে আমি কখনই ওকে এ নামে ডাকতাম না আমার জন্য এতকিছু ঘটে গেল অথচ আমি কিছুই জানলাম না! নিজেকে প্রচণ্ড অপরাধী মনে হল। কেন আমি ওকে পরী নামে ডাকতে গেলাম? নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্যে নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না। নগণ্য মানুষ আমি, কি করে বুঝবো এই সামান্য দুষ্টুমিতে কারো এতবড় ক্ষতি হয়ে যাবে ফজল ভাইয়ের সাথে ভাল সম্পর্কের কারণে ভাবী হিসেবে মাঝে মাঝে ঠাট্টা করে ওকে পরী বলে ডাকতাম। পরীর কথায় সম্বিত ফিরে পেলাম। আবার শুরু করল ও-
আমি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো ভেবে পেলাম না বাবা-মা না থাকায় মামার সংসারে মানুষ সেখানে গিয়ে তাদের বোঝা আর বাড়াতে চাইলাম না। তাই ষ্টেশনের দিকে হাঁটতে লাগলাম। ষ্টেশনে কয়েক ঘন্টা কাটানোর পর ঢাকামুখী একটি বাসে উঠে বসি। ঢাকার কাছাকাছি আসতেই পাশে বসা এক বয়স্ক মহিলা বিভিন্ন প্রসঙ্গে আমার সাথে আলাপ করতে চাইলে প্রথমে আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকেছি কোথায় যাব জিজ্ঞেস করলে আমি বললাম আমার যাবার কোন জায়গা নেই। তিনি যেচে আমাকে আশ্রয় দিতে চাইলেন। আমি যেন অনেকটা স্বস্তি খুঁজে পেলামতার সাথে সাথে আশ্রয়ের সন্ধানে এখানে এসে পড়ি। এখানে আসার পর বুঝতে পারলাম কত বড় ভুল করে ফেলেছি কিন্তু ততক্ষণে আমার ফেরার পথ রুদ্ধ হয়ে গেলআমি চিরদিনের মত সমাজ থেকে ছিটকে পড়লা আজ চাইলেও আর ফিরে যেতে পারবো না আপনাদের সমাজে
এই পরিস্থিতিতে আমার ঠিক কি করা উচিৎ বুঝে উঠতে পারছিলাম না ওকে কিছু বলার মত ভাষা আমার জানা নেইকিছু কিছু ভুল হয়ে যায় যা কখনো শোধরানো যায় না সারা জীবন সে ভুলের বোঝা বয়ে বড়াতে হয়। আমার সামান্য ভুলে এই নিষ্পাপ মেয়েটার জীবন নষ্ট হয়ে গেল! এর প্রায়শ্চিত্ত ক কোনভাবে সম্ভব? আমার হতবিহ্ববল অবস্থা দেখে পরীই পরিস্থিতি সহজ করে তুলল।
মতিন ভাই, আপনে কি ভাবছেন আপনার জন্যেই এমন হল?
আমি কিছু বলতে পারলাম না। কেবল ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ও যেন আমাকে সান্ত্বনা দিতেই বলল-
এটা আসলে হবারই ছিলো। আমাকে বিয়ে করা উচিৎ হয়নি অন্তুর বাবার। তার মায়ের কথামত মামাতো বোনকে বিয়ে করলে সবদিকই রক্ষা পেতো। আপনাকে আমার সাথে জড়িয়ে এই পরিস্থিতি তৈরি করা একটা উপলক্ষ্য মাত্র। একটু থেমে পরী আবার বলে উঠলো- আমি কাউকেই দোষ দেই না ধরে নিয়েছি এটাই আমার নিয়তি
ওর বলা এই কথাগুলো আমার ভেতরের আলোড়নকে খুব বেশি দমাতে পারেনি। আমার অবচেতন মন বারবার যেন বলে যাচ্ছিল- এ সবকিছুর জন্যই দায়ী আমি। আমার চোখ দু’টো ক্রমশ ভিজে আসছিলো। দু’হাতে মুখ ঢাকলাম। ও আমাকে স্বাভাবিক করতেই বলে উঠলো- আপনে এত ভেঙে পড়ছেন কেন? আমি তো আপনাকে দায়ী করিনি!  
পরী যেন আমাকে সব অভিযোগ থেকে খুব সহজেই মুক্ত করে দিচ্ছিলো কিন্তু ওর আজকের এই পরিনতির জন্য আমার নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছিলো। তাই ভাবছিলাম একবার চেষ্টা করে দেখি- যদি কোনভাবে বুঝিয়ে ওকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নেয়া যায়। আমি নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বললাম,
দেখো পরী, মানুষের জীবনে অনেক কিছু ঘটে, আবার তা ভুলে গিয়ে মানুষ নতুন করেই শুরু করে। তোমার সামনে এখনো অনেক সময় পড়ে আছে।  জীবনটা এভাবে নষ্ট করো না। তুমি ফিরে যাও। ফজল ভাই এখনও তোমার অপেক্ষায় আছে। 
পরী কিছুই বললো না। আমি ওর চোখের দিকে তাকালাম। ও মাথা নিচু করে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর যখন মুখ তুললো তখন দেখলাম- সে চোখের গভীরে লুকায়িত কান্নাটা ধীরে ধীরে বাইরে দৃশ্যমান হচ্ছে। আমি আরও কিছু বলতে উদ্যত হতেই ও আমাকে থামিয়ে দিলো। ম্লান হেসে বললো- মতিন ভাই, জোনাকি দেখেছেন?
আমার জবাবের জন্য অপেক্ষা না করেই বলে উঠলো- জানেন, জোনাকিরা বড় হবার পর আর বেশিদিন বাঁচে না, মরে যায়। আমি এখন অনেকটা সেই জোনাকির মতই। পার্থক্য হলো ওরা একেবারেই মরে যায় আর আমার এই মরা দেহে প্রাণটা এখনো টিকে আছে। কী হবে জীবন নিয়ে আর এতকিছু ভেবে?  
আমি আর কিছুই বলতে পারলাম না। ও প্রসঙ্গ পাল্টালো। তারপর মলিন মুখে জিজ্ঞেস করলো- আমার অন্তু কেমন আছে জানেন? ওর জন্যে বুকের ভেতরটা সারাক্ষ পোড়ে কাউকে বলতে পারি না ওর মুখটা চোখে চোখে ভাসে কতদিন আমার মানিকটাকে দেখিনা! ডুকরে কেঁদে উঠলো পরী
আমি বললাম- এক সপ্তাহ আগে বাড়ি থেকে এসেছি, ফজল ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছিল। বলল- মনটা ভাল নেই ছেলেটার নাকি শরীর খারাপ।
আমার কথা শুনে অস্থির হয়ে উঠলো পরী। কি হয়েছে আমার অন্তুর?
বললাম-ঠিক কি হয়েছে ফজল ভাইও জানে না ঠিকমত চিকিৎসা করতে পারছে না। মনে হল টাকা পয়সার সমস্যায় আছে
আমাকে বসিয়ে রেখে পরী রুম থেকে বেরিয়ে গেল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ফিরে আসলো। আমার হাতে রুমালে মোড়ানো একটা পুটুলি ধরিয়ে দিয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে বললো-
মতিন ভাই এই টাকাটা অন্তুর বাবাকে দিয়ে র চিকিৎসা করাতে বলবেন। দয়া করে শুধু আমার নামটা বলবেন না।
ফজল ভাই জানতে চাইলে কি বলবো?
বলবেন আপনি ধার হিসেবে দিচ্ছেন, পরে শোধ করে দিলেই হবে। আর কষ্ট করে আমারে ওর অবস্থাটা একটু জানাতে পারবেন?
আমি এক সপ্তাহ পর আবার আসবো বলে সেদিনের মত ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম।
পরীর কাছ থেকে চলে আসার পর আমার সবকিছুই কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল। পরীর ঐ করুণ পরিণতির জন্য নিজেকে কোনভাবেই ক্ষমা করতে পারছিলাম কয়েকদিন ব্যবসার কাজ বন্ধ রেখে আমি ইতস্থত ঘোরাফেরা করার পর গ্রামে ফিরে গেলাম। ফজল ভাইয়ের উপর প্রচণ্ড রাগ হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র পরীর কথা ভেবেই তার সাথে দেখা করে টাকাটা দিয়ে দ্রুত অন্তুর চিকিৎসা করাতে বললাম। পরীকে দেয়া কথা রাখতে ওর নামটাও গোপন রাখলাম। ফজল ভাই আমার হাত ধরে কেঁদে উঠলেন।
বড় অন্যায় করে ফেলেছিরে মতিন। আজ বুঝতে পারছি- নাজমার কোন দোষ ছিল না
আমি ওর কথার কোন জবাব দেবার প্রয়োজন বোধ করলাম না, তবে আমার ভেতরে অপরাধবোধ থেকে একটি তাড়না অনুভব করলাম আর শুধু সে করণেই সেদিনই ওদের সাথে করে নিয়ে এসে অন্তুকে সদর হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিলাম। পরদিন ঢাকা ফেরার পথে হাসপাতালে গিয়ে জানলাম ছোট্ট একটা অপারাশন করলেই অন্তু ভাল হয়ে যাবে। অমি কিছুটা স্বস্তি বোধ করলাম এই ভেবে যে, অন্তত পরীকে কিছুটা হলেও মানসিক শান্তি দিতে পারবো 
ঢাকা ফেরার একদিন পর আমি আবার পরীর সাথে দেখা করার জন্যে গেলাম এই কদিনে পরী যেন অনেকটা শুকিয়ে গেছে, চোখের নীচে কালশিটে পড়েছে ও যেন আমার আশায় পথ চেয়ে ছিল
আমি জিজ্ঞেস করলাম কেমন আছ নাজমা?
 একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল- খাচায় বন্দী পাখি, কতটা আর ভাল থাকি বলুন?
আমি ওকে অন্তুকে হসপিটালে ভর্তির খবর দিলাম। দেখলাম ওর চোখ দুটো ছলছল করছে।
ও বলল- আমার ছেলেটা হসপিটালে ভর্তি আর আমি একটু দেখতেও পারবো না!
এ অবস্থায় কোন মাকে কিভাবে সান্ত্বনা দিতে হয় আমার জানা নেই, আমি শুধু বললাম- চিন্তা কর না, অন্তু ঠিক হয়ে যাবে।
আমি মনে মনে আজ একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছিলাম। পরীকে এখান থেকে উদ্ধার করে নতুন জীবন দানে নিজের কাছে প্রতিশ্রুতবদ্ধ হয়েছিলাম। কিন্তু অন্তুর জন্যে ওর মনের অবস্থা দেখে আজকের মত ও প্রসঙ্গ আর তুলতে পারলাম না। তাই ওখান থেকে পালানোর জন্য ওকে বললাম-
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, আমাকে রাতের বাসেই ফিরতে হবে। আজ আর সময় নাই, আগামী সপ্তাহে আমি আবার আসবো। পারলে সদর হাসপাতালে গিয়ে একবার তোমার অন্তুকে দেখে এসো। বেরিয়ে আসার আগে লক্ষ্য করলাম ওর চোখ দুটো তখনও ভেজা। ও শুধু বলল-
মতিন ভাই, নাজমা মরে গেছে এখানে আমি পরী নামেই পরিচিত।
আমার আর কিছুই বলার থাকলো না আমি অপরাধীর মত মাথা নিচু করে ওর রুম থেকে বেরিয়ে পড়লাম। বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি সেই বৃষ্টির মধ্যেই ফুটপা ধরে হাঁটতে লাগলামকখন যে নিজের অজান্তেই চোখ দুটো ভারী হয়ে আসলো বুঝতে পারিনিবৃষ্টি থাকাতে অবশ্য অশ্রু লুকানোর কোন প্রয়োজন পড়লো না। বৃষ্টির মধ্যেই আমি হাঁটছিলাম আর দেখছিলাম শহর জুড়ে ব্যস্ত মানুষের পদচারণা সবাই ছুটছে যে যার গন্তব্যে। এদের মধ্যেই কেউ হয়ত আমারই মত ছন্নছাড়া আবার কারো বুকে হয়ত জমে আছে অনেক অব্যক্ত ব্যথা তাদেরই কেউ কেউ হয়ত একেকজন-নাজমা আমি ফিরছিলাম আমার গন্তব্যের দিকে আর মনে ভাসছিলো পরীর শেষ কথাগুলো। মনে মনে ভাবি- পরী নামের আড়ালেই হারিয়ে গেল গ্রামের সহজ সরল গৃহবধূ-নাজমা
একটানা কয়েকদিন হসপিটালে কাটানোর পর আজ বাড়ি ফিরছে অন্তু। এই কদিন বাবা ছাড়া আর কাউকেই কাছে পায়নি বাবার হাত ধরে রিকশায় উঠলো অন্তু। হাসপাতালের গেট থেকে বেরিয়ে কিছুটা পথ এগিয়ে মোড় ঘুরলেই বাড়ির দিকের রাস্তা। সেই মোড়ে ওদের অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে আছে একটি নারীমুর্তি তার দৃষ্টি রিকশাটির দিকেই নিবদ্ধকালো বোরখার আড়ালে  নারীমুর্তিটির বুকের ভিতরে তখন রক্তক্ষরণ হচ্ছিলো পাশ দিয়ে মোড় ঘুরবার সময় রিকশাটি তার এত কাছে চলে আসলো যেন হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারে বুকে পাথর চেপে অনেক কষ্টে দমন করলো সেই ইচ্ছা বাবার কোলে চড়ে অন্তু এগিয়ে যেতে থাকলো বাড়ির পথে জানতেও পারলো না- পিছনে তারই জন্যে অশ্রুর বন্যায় ভাসছে এক মমতাময়ী রিকশাটি চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত নারীমুর্তিটি ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগলো স্টেশনের দিকে, একসময় মিলিয়ে গেল পথচারীদের ভিড়ে



উপন্যাসঃ ফেরা (পর্বঃ ২১ - ২৫ - শেষ পর্ব)

এ ই উপন্যাসটিতে সম্মুখ সমরের কোন ঘটনা তুলে ধরা হয়নি।  ওয়ারফ্রন্টের কোনও দৃশ্য নেই। তবে এই লেখায় মূলত যে গল্পটি বলার চেষ্টা ক রা হয়েছে  তা মু...