সেদিনের সেই নির্দয় সন্ধ্যাটা আমার মনের ভেতরে একটা গভীর ক্ষত এঁকে
দিয়েছিলো। একেবারে
একা যখন নিজের ভেতরে ডুব দেই, অজান্তেই সেখানে মেয়েটির বেদনাক্লিষ্ট মুখচ্ছবিটা
ভেসে ওঠে। সেদিন সবচেয়ে ভঙুর মুহূর্তে আমি যখন অনুভব করলাম মেয়েটির ঐ পরিবেশে চলে যাওয়ার
পেছনে আমার নিজের একটা ভূমিকা আছে, তখন থেকে একটা
অপরাধবোধ আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। ওকে ওখানে দেখার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম
না। মেয়েটি কথা বলার সময় যদিও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছিলো কিন্তু
আমি যেন ওর ভেতরের চাপা গোঙানিটা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম- অনেকটা শববাহী বাহনের
মত। ওর চোখ, মুখের অভিব্যক্তি এতটাই নির্জীব ছিলো- মনে হচ্ছিল যেন পরিত্যক্ত
দেহটিকে কোনরকমে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। সেদিন খুব অসহায়, অক্ষমের মত প্রত্যক্ষ
করেছিলাম একটা জোনাকির অব্যক্ত ব্যথা, বেদনায় ক্রমশ নীল হয়ে যাওয়া। আর ভাগ্যের কি
নির্মম পরিহাস, এই আমিই ঘটনাটির একমাত্র সাক্ষী হয়ে রইলাম।
মেয়েটি দরজা খুলতেই ভূত দেখার মত চমকে উঠলাম।
এ কাকে দেখছি আমি!
আমার মুখের দিকে চোখ পড়তেই নিজেকে লুকাতে রুমের
ভেতরের দিকে দৌড়ে পালালো ও। আমিও কিছুটা ইতস্থত বোধ করছিলাম। ভেতরে ঢুকবো কি ঢুকবো না ভেবে কিছুক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে থাকার
পর অবশেষে প্রবেশ করলাম। ও তখনও আমার দিকে পেছন ফিরে নিজেকে আড়াল করতে ব্যস্ত।
আমারও তখন একই অবস্থা। আমরা কেউই ভাবিনি এই
পরিবেশে এভাবে আমাদের দেখা হবে। আমি ঘরের
চতুর্দিকে চোখ বোলালাম। দশ বাই দশ সাইজের ছোট্ট একটি কামরা। আসবাব
বলতে অতি প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র। একটি ছোট্ট ড্রেসিং টেবিলের উপরে কিছু সস্তা
প্রসাধনী আর আলনায় ওর ব্যবহৃত কাপড়চোপড়। আমি আস্তে করে কাশি দিয়ে নিজের উপস্থিতি
জানান দিলাম আবার। ওর আড়ষ্টতা তখনও ভাঙেনি, তবে ধীরে ধীরে মাথা
নিচু করে আমার দিকে ফিরলো। অনেকক্ষণ পর আমিই মুখ খুললাম।
কেমন আছো পরী?
পরী তখনও
মুখে আঁচল দিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে ছিল। লজ্জা ও সংকোচে আমার মুখের দিকে তাকাতে পারছিল না। চোখ
দুটো ভেজা। অনেকক্ষণ পর বলল-
আমি তো ভাই কচুরিপানা, স্রোতের তোড়ে ভাইসা আইছি, আপনাকে এখানে দেখবো ভাবি নাই কখনো।
আমি কোন জবাব খুঁজে পেলাম না। কী করে বলি প্রায়ই আমার পা পড়ে এ পাড়ায়। ব্যবসার মালামাল কেনার জন্য আমাকে
ঢাকায় আসতে হয়। তখন মাঝে মাঝেই ঢু মারি এখানে। পরী’কে কেন জানি এ কথাগুলো বলতে পারলাম না। আমার কৌতুহল হচ্ছিল ও কিভাবে এখানে এসে পড়ল। স্বেচ্ছায় নাকি কেউ জোর করে এনেছে? ওকে যতটুকু দেখেছি তাতে স্বেচ্ছায় এখানে আসার মেয়ে ও না, কিন্তু কিছুই জিজ্ঞেস করতে
পারলাম না। আমরা দুজনেই বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম। পরী’ই নিরবতা ভাঙল আবার।
মতিন ভাই, আপনার খুব জানতে ইচ্ছা করছে আমি কি করে এখানে এলাম, তাই না?
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ওর চোখের দিকে তাকালাম। পরীও নিশ্চুপ।
নিচের দিকে তাকিয়ে পায়ের আঙুলগুলো দিয়ে মেঝেতে এলোমেলো আঁকিবুঁকি করছিলো। দু’চোখ
বেয়ে টপটপ জল গড়িয়ে পড়ছে। কিছুক্ষণ পর আঁচলে চোখ মুছে আমার দিকে তাকিয়ে বলল-
কী করবো! মুর্খ মেয়েমানুষ। আমার ভাগ্যই আমাকে এখানে টেনে নিয়ে এসেছে। পোড়া কপাল নিয়ে যার জন্ম তার জন্য সুখ-তো সোনার হরিণ। সুখের সংসার আমার কপালে সইলো না, তাইতো এখন হাজার মানুষের জন্যে
সুখের পসরা সাজাই।
এমন থমথমে পরিবেশে কি বলতে হয় আমার জানা নেই। অনেকক্ষণ পর বললাম-
দেখো পরী, জানি না তুমি কিভাবে এখানে এসে পড়লে কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না তুমি স্বেচ্ছায়
এসেছো। তবে একটা ব্যাপার আমি ঠিক মেলাতে পারছি না। কী এমন হয়েছিল যে তোমাকে বাড়ি ছেড়ে
চলে আসতে হল?
পরী সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিল-
কোন মেয়ে কি সুখের সংসার, স্বামী-সন্তান ফেলে
স্বেচ্ছায় এমন পরিবেশে আসে? আপনিই বলেন।
আমি ওর চোখে এমন কিছু দেখেছিলাম যে সাথে সাথে উত্তর দিতে পারিনি। মনে
হচ্ছিলো পরী আমায় কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিল। পরিস্থিতি সহজ করতেই বললাম- শুনলাম ফজল ভাই নাকি তোমাকে
অনেক জায়গায় খুঁজেছে। তুমি ফিরে যাও পরী।
পরী আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল- তা আর হয় না মতিন
ভাই। আমি কাউকে ঠকাতে পারবো না। আমার জন্যে অন্য কারো জীবন নষ্ট হোক তা আমি চাই না। ওরা ভাল
থাকুক।
কিছুক্ষণ পর পরী নিজে থেকেই বলতে শুরু করলো ওর
এখানে আসার কাহিনী।
মায়ের কথামত অন্তুর বাবা আমাকে ঘর থেকে বের করে
দিলে সারারাত ঘরের বাইরের বারান্দায় কাটিয়ে দিলাম। পরদিন আর সেখানেও ঠাঁই হল না। তাড়িয়ে দিলে একেবারেই চলে আসতে বাধ্য হলাম। পা ধরে কত কাঁদলাম! আমার বুকের
মানিকরে কেড়ে নিয়ে আমাকে চলে আসতে বাধ্য করল ওরা। পরী খানিকক্ষণ
ম্লান মুখে বসে রইলো, তারপর নিচুস্বরে বলল-
ওরা বলে আমি নাকি চরিত্রহীনা।
আমি সান্ত্বনা দেবার ভাষা খুঁজে পেলাম না। আঁচলে ভেজাচোখ মুছে মুখ
তুলে আমার দিকে তাকিয়ে আবার বলে উঠলো-
আমার অপরাধ কি ছিল জানেন?
আমি ওর
দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালাম। ও বলল-
থাক, আপনার মন খারাপ হয়ে যাবে।
এবার আমার কৌতুহল আরও বেড়ে গেল। আমি বললাম- মন খারাপ হয় হোক, তুমি বল।
ও কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলল- আপনে যে আমাকে পরী নামে ডাকতেন! কখনও কখনও হাসি-তামাশা
করতেন! সেটাই ছিলো আমার অপরাধ।
তৎক্ষণাৎ মনে হল কেউ যেন আমাকে আগুনের ছ্যাকা লাগিয়ে
দিলো। আমি খুব অবাক হয়ে বললাম,
কী বললে! আমি পরী বলে ডাকতাম সেটাই তোমার
অপরাধ?
পরী চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি আবার
বললাম,
আমি তো কালেভদ্রে ওদের বাড়িতে যেতাম, আর তোমার সাথে হাসি ঠাট্টা যা-ই হতো সেতো
ফজল ভাইয়ের সামনেই। ফজল ভাই তো আমাকে কখনও কিছু বলেনি!
পরী মুখ তুলে আমার দিকে তাকালো। কান্নাজড়িত
কণ্ঠে ও বলল-
এটা অন্তুর বাবার সমস্যা ছিল
না, ওর দাদী সহ্য করতে পারতো না। সে
আমাকেও অনেক কথা শোনাতো।
আমি কিছুটা বিরক্ত হয়েই বললাম- আমি তো ফজল ভাইয়ের কাছে ব্যবসার কাজে যেতাম। তোমার সাথে মাঝে-মধ্যে দেখা
হত শুধু!
পরী তখন বলল- অন্তুর দাদীর
সন্দেহের জন্য ওটাই যথেষ্ট ছিল। সে প্রায়ই
অন্তুর বাবার কান ভারী করতো।
আমি দীর্ঘ সময় ধরে থম মেরে বসে রইলাম। কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না।
অনেকক্ষণ পর বললাম-
কিন্তু এতে তোমার কী দোষ ছিল?
পরী ম্লান স্বরে বলল- আমারই তো সব দোষ। সে ধরেই নিয়েছিলো আপনার সাথে
আমার গোপন সম্পর্ক আছে। অন্তুর দাদী প্রায়ই তার ছেলেকে বলতো- ‘তোর বউ তোরে ফালাইয়া
মইত্যার লগে ভাগবো’।
আমার মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করতে লাগলো। শুধু পরী নামে
ডাকার জন্য এত সমস্যা! এটা বুঝলে আমি কখনই ওকে এ নামে ডাকতাম না। আমার জন্য
এতকিছু ঘটে গেল অথচ আমি কিছুই জানলাম না! নিজেকে প্রচণ্ড অপরাধী মনে হল। কেন আমি
ওকে পরী নামে ডাকতে গেলাম? নিজের
নির্বুদ্ধিতার জন্যে নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না। নগণ্য মানুষ
আমি, কি করে বুঝবো এই সামান্য দুষ্টুমিতে কারো এতবড় ক্ষতি
হয়ে যাবে। ফজল
ভাইয়ের সাথে ভাল সম্পর্কের কারণে ভাবী হিসেবে মাঝে মাঝে ঠাট্টা করে ওকে পরী বলে ডাকতাম। পরীর কথায় সম্বিত ফিরে পেলাম। আবার শুরু করল ও-
আমি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো ভেবে পেলাম না। বাবা-মা না থাকায় মামার সংসারে মানুষ। সেখানে গিয়ে তাদের বোঝা আর
বাড়াতে চাইলাম না। তাই ষ্টেশনের দিকে হাঁটতে লাগলাম। ষ্টেশনে কয়েক ঘন্টা কাটানোর
পর ঢাকামুখী একটি বাসে উঠে বসি। ঢাকার কাছাকাছি আসতেই পাশে বসা এক বয়স্ক মহিলা বিভিন্ন প্রসঙ্গে আমার সাথে আলাপ করতে চাইলে প্রথমে
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকেছি। কোথায় যাব জিজ্ঞেস করলে আমি
বললাম আমার যাবার কোন জায়গা নেই। তিনি যেচে আমাকে আশ্রয় দিতে চাইলেন। আমি যেন অনেকটা স্বস্তি খুঁজে পেলাম। তার সাথে সাথে আশ্রয়ের সন্ধানে এখানে এসে পড়ি। এখানে আসার পর
বুঝতে পারলাম কত বড় ভুল করে ফেলেছি। কিন্তু ততক্ষণে আমার ফেরার পথ
রুদ্ধ হয়ে গেল। আমি চিরদিনের মত
সমাজ থেকে ছিটকে পড়লাম। আজ চাইলেও আর ফিরে যেতে পারবো
না আপনাদের সমাজে।
এই পরিস্থিতিতে আমার ঠিক কি করা উচিৎ বুঝে উঠতে
পারছিলাম না। ওকে কিছু বলার মত
ভাষা আমার জানা নেই। কিছু কিছু ভুল হয়ে যায় যা কখনো শোধরানো যায় না। সারা জীবন সে ভুলের বোঝা বয়ে বেড়াতে হয়।
আমার সামান্য ভুলে এই নিষ্পাপ মেয়েটার জীবন নষ্ট হয়ে গেল! এর প্রায়শ্চিত্ত কী কোনভাবে সম্ভব? আমার হতবিহ্ববল অবস্থা দেখে
পরীই পরিস্থিতি সহজ করে তুলল।
মতিন ভাই, আপনে কি ভাবছেন আপনার জন্যেই এমন হল?
আমি কিছু বলতে পারলাম না। কেবল ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ও যেন
আমাকে সান্ত্বনা দিতেই বলল-
এটা আসলে হবারই ছিলো। আমাকে বিয়ে করা উচিৎ হয়নি অন্তুর বাবার। তার
মায়ের কথামত মামাতো বোনকে বিয়ে করলে সবদিকই রক্ষা পেতো। আপনাকে আমার সাথে জড়িয়ে এই
পরিস্থিতি তৈরি করা একটা উপলক্ষ্য মাত্র। একটু থেমে পরী আবার বলে উঠলো- আমি কাউকেই দোষ দেই না। ধরে নিয়েছি এটাই আমার নিয়তি।
ওর বলা এই কথাগুলো আমার ভেতরের আলোড়নকে খুব বেশি দমাতে পারেনি। আমার অবচেতন
মন বারবার যেন বলে যাচ্ছিল- এ সবকিছুর জন্যই দায়ী আমি। আমার চোখ দু’টো ক্রমশ ভিজে
আসছিলো। দু’হাতে মুখ ঢাকলাম। ও আমাকে স্বাভাবিক করতেই বলে উঠলো- আপনে এত ভেঙে
পড়ছেন কেন? আমি তো আপনাকে দায়ী করিনি!
পরী যেন আমাকে সব অভিযোগ থেকে খুব সহজেই মুক্ত করে দিচ্ছিলো কিন্তু
ওর আজকের এই পরিনতির জন্য আমার নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছিলো। তাই ভাবছিলাম একবার
চেষ্টা করে দেখি- যদি কোনভাবে বুঝিয়ে ওকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নেয়া যায়। আমি
নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বললাম,
দেখো পরী, মানুষের জীবনে অনেক কিছু ঘটে, আবার তা ভুলে গিয়ে মানুষ নতুন করেই শুরু করে। তোমার সামনে এখনো অনেক
সময় পড়ে আছে। জীবনটা এভাবে
নষ্ট করো না। তুমি ফিরে যাও। ফজল ভাই এখনও তোমার অপেক্ষায় আছে।
পরী কিছুই বললো না। আমি ওর চোখের দিকে তাকালাম। ও মাথা নিচু করে রইলো
কিছুক্ষণ। তারপর যখন মুখ তুললো তখন দেখলাম- সে চোখের গভীরে লুকায়িত কান্নাটা ধীরে
ধীরে বাইরে দৃশ্যমান হচ্ছে। আমি আরও কিছু বলতে উদ্যত হতেই ও আমাকে থামিয়ে দিলো।
ম্লান হেসে বললো- মতিন ভাই, জোনাকি দেখেছেন?
আমার জবাবের জন্য অপেক্ষা না করেই বলে উঠলো- জানেন, জোনাকিরা বড় হবার পর আর বেশিদিন বাঁচে না, মরে যায়। আমি এখন অনেকটা সেই জোনাকির মতই।
পার্থক্য হলো ওরা একেবারেই মরে যায় আর আমার এই মরা দেহে প্রাণটা এখনো টিকে আছে। কী
হবে জীবন নিয়ে আর এতকিছু ভেবে?
আমি আর কিছুই বলতে পারলাম না। ও প্রসঙ্গ পাল্টালো। তারপর মলিন মুখে
জিজ্ঞেস করলো- আমার অন্তু কেমন আছে জানেন? ওর জন্যে বুকের ভেতরটা সারাক্ষণ পোড়ে। কাউকে বলতে পারি না। ওর মুখটা চোখে চোখে ভাসে। কতদিন আমার মানিকটাকে দেখিনা! ডুকরে কেঁদে উঠলো পরী।
আমি বললাম- এক সপ্তাহ আগে বাড়ি থেকে এসেছি, ফজল ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছিল।
বলল- মনটা ভাল নেই। ছেলেটার নাকি শরীর খারাপ।
আমার কথা শুনে অস্থির হয়ে উঠলো পরী। কি হয়েছে আমার অন্তুর?
বললাম-ঠিক কি হয়েছে ফজল ভাইও জানে না। ঠিকমত চিকিৎসা করাতে পারছে না। মনে হল টাকা পয়সার সমস্যায় আছে।
আমাকে বসিয়ে রেখে পরী রুম থেকে বেরিয়ে গেল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ফিরে
আসলো। আমার হাতে রুমালে মোড়ানো একটা পুটুলি ধরিয়ে দিয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে বললো-
মতিন ভাই এই টাকাটা অন্তুর বাবাকে দিয়ে ওর চিকিৎসা করাতে
বলবেন। দয়া করে শুধু আমার নামটা বলবেন না।
ফজল ভাই জানতে চাইলে কি বলবো?
বলবেন আপনি ধার হিসেবে দিচ্ছেন, পরে শোধ করে দিলেই হবে। আর কষ্ট
করে আমারে ওর অবস্থাটা একটু জানাতে পারবেন?
আমি এক সপ্তাহ পর আবার আসবো বলে সেদিনের মত ওর
কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম।
পরীর কাছ থেকে চলে আসার পর আমার সবকিছুই কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল। পরীর ঐ করুণ পরিণতির জন্য নিজেকে কোনভাবেই ক্ষমা করতে পারছিলাম। কয়েকদিন ব্যবসার কাজ
বন্ধ রেখে আমি ইতস্থত ঘোরাফেরা করার পর গ্রামে ফিরে গেলাম। ফজল ভাইয়ের
উপর প্রচণ্ড রাগ হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র পরীর কথা ভেবেই তার সাথে দেখা করে টাকাটা দিয়ে
দ্রুত অন্তুর চিকিৎসা করাতে বললাম। পরীকে দেয়া কথা রাখতে ওর নামটাও গোপন রাখলাম।
ফজল ভাই আমার হাত ধরে কেঁদে উঠলেন।
বড় অন্যায় করে ফেলেছিরে মতিন। আজ বুঝতে পারছি- নাজমার কোন দোষ ছিল না।
আমি ওর কথার কোন জবাব দেবার প্রয়োজন বোধ করলাম না, তবে আমার ভেতরে অপরাধবোধ থেকে
একটি তাড়না অনুভব করলাম। আর শুধু সে করণেই সেদিনই ওদের
সাথে করে নিয়ে এসে অন্তুকে সদর হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিলাম। পরদিন ঢাকা ফেরার পথে
হাসপাতালে গিয়ে জানলাম ছোট্ট একটা অপারাশন করলেই অন্তু ভাল হয়ে যাবে। অমি কিছুটা
স্বস্তি বোধ করলাম এই ভেবে যে, অন্তত পরীকে কিছুটা হলেও মানসিক শান্তি দিতে পারবো।
ঢাকা ফেরার একদিন পর আমি আবার পরীর সাথে দেখা
করার জন্যে গেলাম। এই ক’দিনে পরী যেন অনেকটা শুকিয়ে গেছে, চোখের নীচে কালশিটে পড়েছে। ও যেন আমারই আশায় পথ চেয়ে ছিল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম কেমন আছ নাজমা?
ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল- খাচায়
বন্দী পাখি, কতটা আর ভাল থাকি বলুন?
আমি ওকে অন্তু’কে হসপিটালে ভর্তির খবর দিলাম। দেখলাম ওর চোখ দুটো ছলছল করছে।
ও বলল- আমার ছেলেটা হসপিটালে ভর্তি আর আমি একটু
দেখতেও পারবো না!
এ অবস্থায় কোন মাকে কিভাবে সান্ত্বনা দিতে হয়
আমার জানা নেই, আমি শুধু বললাম- চিন্তা কর না, অন্তু ঠিক হয়ে যাবে।
আমি মনে মনে আজ একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছিলাম।
পরীকে এখান থেকে উদ্ধার করে নতুন জীবন দানে নিজের কাছে প্রতিশ্রুতবদ্ধ হয়েছিলাম।
কিন্তু অন্তুর জন্যে ওর মনের অবস্থা দেখে আজকের মত ও প্রসঙ্গ আর তুলতে পারলাম না।
তাই ওখান থেকে পালানোর জন্য ওকে বললাম-
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, আমাকে রাতের বাসেই ফিরতে হবে।
আজ আর সময় নাই, আগামী সপ্তাহে আমি আবার আসবো। পারলে সদর হাসপাতালে গিয়ে একবার তোমার অন্তুকে
দেখে এসো। বেরিয়ে আসার আগে
লক্ষ্য করলাম ওর চোখ দুটো তখনও ভেজা। ও শুধু বলল-
মতিন ভাই, নাজমা মরে গেছে। এখানে আমি পরী নামেই পরিচিত।
আমার আর কিছুই বলার থাকলো না। আমি
অপরাধীর মত মাথা নিচু করে ওর রুম থেকে বেরিয়ে পড়লাম। বাইরে
তখন তুমুল বৃষ্টি। সেই বৃষ্টির মধ্যেই
ফুটপাথ ধরে হাঁটতে লাগলাম। কখন যে নিজের
অজান্তেই চোখ দুটো ভারী হয়ে আসলো বুঝতে পারিনি। বৃষ্টি থাকাতে
অবশ্য অশ্রু লুকানোর কোন প্রয়োজন পড়লো না। বৃষ্টির মধ্যেই আমি হাঁটছিলাম আর দেখছিলাম শহর জুড়ে ব্যস্ত মানুষের পদচারণা। সবাই ছুটছে যে যার গন্তব্যে। এদের মধ্যেই কেউ হয়ত আমারই মত ছন্নছাড়া
আবার কারো বুকে হয়ত জমে আছে অনেক অব্যক্ত ব্যথা। তাদেরই কেউ কেউ হয়ত একেকজন-নাজমা। আমি ফিরছিলাম আমার গন্তব্যের দিকে আর মনে ভাসছিলো পরীর শেষ কথাগুলো। মনে মনে ভাবি- পরী নামের আড়ালেই হারিয়ে গেল গ্রামের সহজ সরল
গৃহবধূ-নাজমা।
একটানা কয়েকদিন হসপিটালে কাটানোর পর আজ বাড়ি
ফিরছে অন্তু। এই ক’দিন বাবা ছাড়া আর কাউকেই কাছে পায়নি ও। বাবার হাত ধরে রিকশায় উঠলো অন্তু। হাসপাতালের গেট থেকে বেরিয়ে কিছুটা পথ এগিয়ে
মোড় ঘুরলেই বাড়ির দিকের রাস্তা। সেই মোড়ে ওদের অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে
আছে একটি নারীমুর্তি। তার দৃষ্টি রিকশাটির দিকেই নিবদ্ধ। কালো বোরখার আড়ালে নারীমুর্তিটির বুকের ভিতরে তখন রক্তক্ষরণ হচ্ছিলো। পাশ দিয়ে মোড় ঘুরবার সময় রিকশাটি তার এত কাছে চলে আসলো যেন হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারে। বুকে পাথর চেপে অনেক কষ্টে দমন করলো সেই ইচ্ছা। বাবার কোলে চড়ে অন্তু এগিয়ে যেতে থাকলো বাড়ির পথে। জানতেও পারলো না- পিছনে তারই জন্যে অশ্রুর বন্যায় ভাসছে এক মমতাময়ী। রিকশাটি চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত নারীমুর্তিটি
ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগলো স্টেশনের দিকে, একসময় মিলিয়ে গেল পথচারীদের ভিড়ে।
লেখাটি অস্ট্রেলিয়ান পত্রিকা প্রশান্তিকা এবং বাংলা ব্লগে প্রকাশিত হয়েছে। প্রচ্ছদটা প্রশান্তিকার করা।
উত্তরমুছুন